১৯৭৭ সালের ১২ মে তেহরানের একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম মরিয়মের। খুব সহজ ছিল না তার শৈশব কৈশোর এবং তারুণ্যের বেড়ে ওঠার দিনগুলো। মেয়েদের জন্য ইরানের সমাজব্যবস্থা কীরকম তা তো আমরা কম-বেশি সবাই জানি। তারপরও যতটুকু সুযোগ পেয়েছিলেন তার সবটুকুকেই কাজে লাগিয়েছিলেন মরিয়ম নিজের মেধা ও অধ্যবসায়ের জোরে।
গণিতের প্রতি ভালোবাসা যে একেবারে ছোটবেলা থেকে ছিল তা কিন্তু নয়। ছোটবেলায় অন্য আরো উচ্ছল কিশোরীদের মতোই গল্প উপন্যাস পড়েছেন, স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন লেখক হবেন। কিন্তু যখন দেখলেন ভালো লাগছে গণিতের রহস্যভেদ করতে - লেগে রইলেন। নিজেকে চ্যালেঞ্জ করলেন দিনের পর দিন।
|
ইরানে মরিয়ম মির্জাখানি |
১৯৯৪ সালে হংকং-এ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ৪২ পয়েন্টের মধ্যে ৪১ পয়েন্ট পেয়ে গোল্ড মেডেল জিতলেন। পরের বছর কানাডায় অনুষ্ঠিত গণিত অলিম্পিয়াডে ৪২ পয়েন্টের মধ্যে ৪২ পয়েন্ট পেয়ে আবারো জিতে নিলেন গোল্ড মেডেল। ১৯৯৯ সালে ইরানের শরিফ ইউনিভার্সিটি থেকে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি পাস করেন। তারপর হার্ডার্ড ইউনিভার্সিটির স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডি। ২০০৪ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করার পর ডাক পেলেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে ২০০৮ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে ফুল প্রফেসর পদে যোগ দিয়েছেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে।
|
বাড়িতে গণিতে মগ্ন মরিয়ম |
মরিয়মের গবেষণার বিষয় ছিল মূলত জ্যামিতি ও গতিবিদ্যার গাণিতিক সম্মেলন। রাইম্যান সারফেসের জ্যামিতিক গতিবিদ্যায় অবদানের জন্য ২০১৪ সালে পেয়েছেন ফিল্ড মেডেল। গণিতের ইতিহাসে ফিল্ড মেডেলে বিজয়ী প্রথম নারী হিসেবে ইতিহাস গড়লেন মরিয়ম।
গণিতে কোন নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় না। কিন্তু গণিতে সবচেয়ে সম্মানজনক পুরষ্কার যেটাকে গণিতের নোবেল পুরষ্কারের সমতুল্য বিবেচনা করা হয় সেটা হচ্ছে ফিল্ড মেডেল। এটা চালু হয়েছে ১৯৩৬ সালে। তারপর থেকে প্রতি চার বছর পরপর ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথমেটিকেল ইউনিয়ন তাদের ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেসে সর্বোচ্চ চারজন তরুণ গণিতবিদকে তাঁদের অবদানের জন্য ফিল্ড মেডেল দেয়া হয়। কানাডিয়ান গণিতজ্ঞ জন চার্লস ফিল্ডস এর নামানুসারে এই ফিল্ড মেডেলের সাথে পনেরো হাজার ডলার আর্থিক সম্মানীও দেয়া হয়। ফিল্ড মেডেল দেবার ক্ষেত্রে গণিতবিদের বয়সও বিবেচনা করা হয়। চল্লিশ বছর বয়সের বেশি কাউকে এই পুরষ্কারের জন্য বিবেচনা করা হয় না। যে বছর এই পুরষ্কার দেয়া হবে সেই বছরের ১লা জানুয়ারিতে বয়স থাকতে হবে চল্লিশের নিচে।
মরিয়ম মির্জাখানি ছিলেন গণিতের বিস্ময়। ২০১৫ সালে আমেরিকান ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি এবং ফ্রান্সের অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের ফেলোশিপ পান। ২০১৭ সালে তিনি আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের ফেলো নির্বাচিত হন।
অ্যাকাডেমিক জীবনের পাশাপাশি সুন্দর ভালোবাসার ঘর-সংসার মরিয়মের। ভালোবেসে বিয়ে করেছেন চেক কম্পিউটার বিজ্ঞানী ইয়ান ভনড্রেককে। ইয়ানও স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। ছোট্ট ফুটফুটে একটি কন্যা তাদের - আনাহিতা।
|
স্বামী ইয়ান ভনড্রেক ও শিশুকন্যা আনাহিতার সাথে মরিয়ম |
মরিয়মের স্তনক্যান্সার ধরা পড়লো ২০১৩ সালে। চিকিৎসা চলছিল, কিন্তু ক্যান্সার রোধ করা সম্ভব হয়নি। মাত্র চার বছরের মধ্যে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছিল বোন-ম্যারোতে। ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই মরিয়ম মির্জাখানির মৃত্যু হয়।
ফিল্ড মেডেলের গায়ে আঁকা আছে আর্কিমিডিসের ছবিএবং আর্কিমিডিসের একটা ল্যাটিন উক্তি - "
"Transire suum pectus mundoque potiri" যার ইংরেজি ভাবার্থ হলো - Rise above oneself and grasp the world. মরিয়ম মির্জাখানি তাঁর মাত্র চল্লিশ বছরের জীবনকালে সত্যি সত্যিই নিজেকে ছাড়িয়ে বিশ্বজয় করেছিলেন।
আজ মরিয়মের জন্মদিনে অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। শুভ জন্মদিন মরিয়ম।
No comments:
Post a Comment