Sunday, 19 May 2024

বাবা - ৬

 


বইপড়ার ব্যাপারটা ছোটবেলা থেকেই আমাদের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল অনেকটা নিজেদের অজান্তেই। তারজন্য কোন ধরনের আলাদা অনুপ্রেরণা কিংবা জোর কোনটাই ছিল না। স্মৃতিকে অতীতের দিকে যতদূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া যায় – নিয়ে গিয়ে দেখতে পাই – একেবারে ছোটবেলা থেকেই বই ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে আমরা বড় হয়েছি। কারণ আমার বাবার দোকানে বই বিক্রি হতো। মননশীল বা সৃজনশীল বইয়ের তালিকায় আমরা যেসব বই এখন অন্তর্ভুক্ত করি সেসব বই নয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের স্কুল পাঠ্যবই বিক্রি করতেন আমার বাবা। 

সেই সময় স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারি বই বিক্রির জন্য টেক্সট বুক অথরিটির কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হতো। সেই লাইসেন্স পেতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। আমার বাবা কীভাবে সেই লাইসেন্স পেয়েছিলেন জানি না, তবে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাঁশখালিতে আমার বাবাই ছিলেন একমাত্র লাইসেন্সধারী পাঠ্যপুস্তক বিক্রেতা। তিনি ঢাকা গিয়ে টেক্সট বুক অথরিটির কাছ থেকে বই নিয়ে আসতেন। বাঁশখালির অন্যান্য বইবিক্রেতারা আমার বাবার দোকান থেকে বই নিয়ে যেতেন। সেজন্য প্রচুর বই আসতো আমাদের দোকানে। আমরা খুব উৎসাহ নিয়ে সেসব বইয়ের গাইট খুলতাম। আমি পড়তে শেখার আগে থেকেই বইয়ের পাতা উল্টে ছবি দেখতে শুরু করেছিলাম। তখনকার বইগুলিতে প্রচ্ছদ ছাড়া আর কোথাও রঙিন ছবি থাকতো না।  এখনকার শিশুরা অবশ্য আরো কম বয়স থেকেই কত সুন্দর সুন্দর রঙিন ঝলমলে বই নাড়াচাড়া করার সুযোগ পায়।  

বিভিন্ন ক্লাসের বিভিন্ন বিষয়ের বই হাতের কাছে ছিল বলে যা খুশি তা পড়ার সুযোগ ছিল আমাদের, এবং তা যথাসম্ভব কাজে লাগিয়েছিলাম। আমার বাবাকে আমরা দেখতাম প্রচন্ড ব্যস্ত। সপ্তাহের সাতদিনের মধ্যে কমপক্ষে চার-পাঁচদিন তিনি এখানে ওখানে আনাগোনা করেন। যে দু-তিন দিন বাড়িতে থাকতেন, দুপুরে ঘুমানোর সময় আমার হাতে যেকোনো ক্লাসের একটি বই ধরিয়ে দিয়ে পড়ে শোনাতে বলতেন। আমি খুব বাধ্যছেলে ছিলাম তা বলা যাবে না। আমি তক্কে তক্কে থাকতাম কখন বাবা ঘুমিয়ে পড়বেন আর আমি পালিয়ে যাব। দুই-তিন পৃষ্ঠা পড়তে না পড়তেই বাবা ঘুমিয়ে পড়তেন। তখন ভাবতাম বাবাকে বোকা বানানো কত সহজ। বাবা-মায়েরা যে ইচ্ছে করে সন্তানদের কাছে বোকা হয়ে থাকেন – তা বুঝেছি আরো অনেক পরে। 

সেইসময় ক্লাস সিক্স থেকে নাইন পর্যন্ত প্রত্যেক ক্লাসে বাংলা বইয়ের পাশাপাশি আরেকটি দ্রুতপঠনের বই ছিল। অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প থাকতো সেখানে। সব ক্লাসের গল্পগুলি আমার পড়া হয়ে গিয়েছিল বাবাকে শোনাতে গিয়ে। বড় হয়ে যখন তাঁকে বোঝার চেষ্টা করলাম, পর্যবেক্ষণ করলাম – সহজেই বুঝতে পারলাম তাঁর গল্প শোনার ইচ্ছের চেয়েও বেশি ছিল আমাদের ভেতর পড়ার অভ্যাস তৈরি করে দেয়া। 


No comments:

Post a Comment

Latest Post

R. K. Narayan's 'The Grandmother's Tale'

There are many Indian authors in English literature. Several of their books sell hundreds of thousands of copies within weeks of publication...

Popular Posts