ডায়মন্ড বা হীরার প্রতি অনেক মানুষের আকর্ষণ আছে। হীরা সবচেয়ে
শক্ত পদার্থ বলেই যে সবাই শক্তের ভক্ত হয়ে গিয়েছে তা কিন্তু নয়। প্রাকৃতিক হীরা দুষ্প্রাপ্য
বলেই এর এত দাম। বাংলাদেশে এক গ্রাম হীরার দাম চার লাখ টাকার বেশি। কিন্তু এমন যদি
হতো – আকাশ থেকে বৃষ্টির মত অনবরত হীরা ঝরে পড়ছে, এখানে সেখানে সবখানে হীরার কুচি!
তাহলে ব্যাপারটা হতো অবিশ্বাস্য, কিংবা বড়জোর কল্পকাহিনি। কিন্তু যদি বলি আসলেই ব্যাপারটা
ঘটছে আমাদেরই সৌরজগতের একটি গ্রহে! আবার কেউ যদি বলেন সূর্য পশ্চিম দিকে উঠে – আমরা
স্বাভাবিকভাবেই মনে করবো মানুষটি ভুল বলছেন। কিন্তু সত্যি সত্যিই সূর্য পশ্চিম দিকে
উঠে আমাদেরই সৌরজগতের কোন গ্রহে। কোন কোন গ্রহের আবার বছরের চেয়ে দিন বড়। বিস্ময়কর
মনে হচ্ছে তো? আমাদের এই সাদামাটা সূর্যের গ্রহ-উপগ্রহগুলিতে ঘটে চলেছে অসংখ্য বিস্ময়কর
ব্যাপার। এই বিস্ময়কর ব্যাপারগুলির কয়েকটি সম্পর্কে আজ আলোচনা করবো।
সূর্য এবং তার পরিবার
আমাদের সৌরজগত যদি একটি পরিবার হয় – সেই পরিবারের কর্তা সূর্য।
তাকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে তার সন্তানেরা অর্থাৎ তার গ্রহগুলি। অবশ্য গ্রহগুলিকে সূর্যের
সন্তান বললে ব্যাপারটি গোলমেলে হয়ে যায়। কারণ সূর্যের গ্রহগুলির প্রত্যেকের বয়স সূর্যের
বয়সের সমান – সাড়ে চারশ কোটি বছর। শুধু তাই নয়, গ্রহগুলির যেসব উপগ্রহ বা চাঁদ আছে
তাদেরও উৎপত্তি হয়েছে একই সময়ে। অর্থাৎ উপগ্রহগুলির বয়সও সূর্যের বয়সের সমান। এই সৌরজগতে
পিতা-পুত্র-পৌত্র সবার বয়স সমান। তো এই পরিবারের মোট সদস্য কয়জন? আটটি গ্রহ আর তাদের
মোট ২৮৮টি উপগ্রহ। এছাড়াও আছে বামনগ্রহ এবং তাদেরও এগারোটি উপগ্রহ। স্যাটেলাইটের দক্ষতা
যত বাড়ছে, নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে সৌরজগতের সদস্যের সংখ্যাও বাড়ছে। এতবড় পরিবারের
যে কর্তা, সে কিন্তু মহাবিশ্বের নক্ষত্ররাজ্যের ভীষণ উজ্জ্বল কেউ নয়।
মহাবিশ্বের লক্ষ কোটি নক্ষত্রের ভীড়ে আমাদের সূর্য খুবই সাধারণ
একটি জি-টাইপের নক্ষত্র যা পৃথিবী থেকে প্রায় পনের কোটি কিলোমিটার দূরে আছে। জি-টাইপ নক্ষত্রের তাপমাত্রা প্রায় ছয় হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস
এবং সেই তাপমাত্রার কারণে হলুদ বর্ণ ধারণ করে। সূর্যের আকার-আয়তন সম্পর্কে সংক্ষেপে
বলতে গেলে বলা যায়: সূর্যের ব্যাস তের লক্ষ নব্বই হাজার কিলোমিটার যা পৃথিবীর ব্যাসের
১০৮ গুণ। তার মানে সূর্যের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত ছুঁতে হলে ১০৮টি পৃথিবীকে পাশাপাশি
রাখতে হবে। সূর্যের যে আয়তন তাতে বারো লক্ষ পৃথিবী ভরে ফেলা যায় সেখানে। সূর্যকে বাদ
দিয়ে সৌরজগতের যা কিছু আছে সবকিছু একত্র করলে যে আয়তন হবে সূর্য নিজে তার চেয়ে ৭৫০
গুণ বড়। সূর্য পৃথিবীর চেয়ে তিন লাখ তেত্রিশ হাজার গুণ ভারী। সৌরজগতের শতকরা ৯৮ ভাগ
ভর এই সূর্যই ধারণ করে।
মানুষের বুদ্ধি হবার পর থেকেই সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু
করেছে মানুষ। বলা যায় সেখান থেকেই শুরু হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পথচলা। কিন্তু এই এত
বছর পরেও সূর্যের অনেক ঘটনা এখনো সমান বিস্ময়কর। যেমন, সূর্যের তাপমাত্রা।
সূর্যের বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা তার পৃষ্ঠতাপমাত্রার চেয়ে
বেশি
সূর্যের ভেতরে রয়েছে গ্যাসের অনেকগুলো স্তর। যদিও একটা থেকে
আরেকটার মধ্যে তেমন নির্দিষ্ট করে কোন বিভাজন নেই, তবুও প্রত্যেকটি স্তরের আলাদা আলাদা
কাজ আছে। সূর্যের প্রধানত দুটো অংশ। ভেতরের অংশ এবং বাইরের অংশ। ভেতরের অংশকে তিনটি
অঞ্চলে ভাগ করা যায়। সবচেয়ে কেন্দ্রে (core) আছে মূল পিন্ড। তাকে ঘিরে আছে রেডিয়েটিভ
জোন (radiative zone) বা বিকিরণ অঞ্চল। বিকিরণ অঞ্চলকে ঘিরে আছে কনভেকশান জোন
(convection zone) বা পরিচলন অঞ্চল। বাইরের অংশে আছে গ্যাসের তিনটি স্তর। এই অংশকে
সূর্যের বায়ুমণ্ডল বলে ধরে নেয়া যায়। এই অংশের সবচেয়ে ভেতরের স্তর হলো ফটোস্ফিয়ার
(photosphere) বা আলোকমণ্ডল যা পরিচলন অঞ্চলকে ঘিরে থাকে। আলোকমণ্ডলকে ঘিরে আছে ক্রোমোস্ফিয়ার
(chromosphere) বা বর্ণমণ্ডল। আর সবচেয়ে বাইরের স্তর হলো কোরোনা (corona) বা কিরীট
যা সূর্যের উপরিতল।
সূর্যের কেন্দ্র হলো সবচেয়ে উত্তপ্ত অংশ যার তাপমাত্রা প্রায়
দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের আয়তনের এক চতুর্থাংশ বা শতকরা পঁচিশ ভাগ জুড়ে এই
কেন্দ্র। খুবই ঘন উত্তপ্ত গ্যাস এখানে। ফলে কেন্দ্র খুব ভারী। আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ
হলেও ভরের প্রায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ এই কেন্দ্রে। সূর্যের সব শক্তিই আসে এই কেন্দ্র থেকে।
নিউক্লিয়ার ফিশান ঘটে এই কেন্দ্রে। সূর্যের কেন্দ্রে প্রতি সেকেন্ডে চার মিলিয়ন টন
হাইড্রোজেন শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
কেন্দ্রের বাইরের স্তর হলো রেডিয়েটিভ জোন বা বিকিরণ অঞ্চল।
এই অঞ্চল গামা রশ্মিতে পূর্ণ। সূর্যের এক তৃতীয়াংশ আয়তন নিয়ে এই অঞ্চল। এই অঞ্চলের
তাপমাত্রা প্রায় ৫০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের কেন্দ্রে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তা এই
অঞ্চল দিয়ে বাইরে যায়। তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের আকারে শক্তিগুলো যায়। ঘন গ্যাসের সাথে মিথষ্ক্রিয়ার
ফলে শক্তি প্রবাহের হার এখানে খুবই ধীরে হয়। ৩০ হাজার বছর থেকে এক লাখ বছর লেগে যায়
সূর্যের শক্তির এই অঞ্চল ত্যাগ করতে। গামা রশ্মি আকারে উৎপন্ন শক্তিগুলো এখানে ঘুরপাক
খেতে খেতে লম্বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট দৃশ্যমান আলোতে পরিণত হয়। তারপর মহাশূন্য থেকে
পৃথিবীতে আসতে শক্তির লাগে মাত্র আট মিনিট ২৬ সেকেন্ড।
বিকিরণ অঞ্চলের পরের স্তর হলো কনভেকশান জোন বা পরিচলন অঞ্চল।
তাপমাত্রা এখানে গড়ে প্রায় ৫৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি আয়তন নিয়ে এই
অঞ্চল। এখানে শক্তি সঞ্চালিত হয় প্লাজমার পরিচলনের মাধ্যমে। পাত্রে পানি ফুটতে দিলে
যেভাবে গরম পানি উপরের দিকে উঠে এসে ঠান্ডা পানির অণু নিচে নেমে আসে সেভাবে। এই অঞ্চলে
শক্তি সঞ্চালন ঘটে অনেক দ্রুত। এই অঞ্চল থেকে শক্তি সঞ্চালিত হয়ে ফটোস্ফিয়ার বা আলোকমন্ডলে
আসতে সপ্তাহ খানেক সময় লাগে।
সূর্য যেহেতু কঠিন বস্তু নয় - গ্যাসের পিন্ড, তাই সূর্যের
কোন কঠিন আবরণ নেই। যে আবরণটি আছে তা প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পুরু গ্যাসের স্তর। এই স্তরটিই
হলো ফটোস্ফিয়ার বা আলোকমণ্ডল যেটাকেই মূলত আমরা দেখি যখন সূর্যের দিকে তাকাই। আলোকমণ্ডল
থেকে সূর্যের শক্তি আলোর আকারে বেরিয়ে আসে। সূর্যের আলোকমন্ডলকেই আমরা সূর্যপৃষ্ঠ বলে
জানি। আলোকমণ্ডল খুবই স্বচ্ছ। এর মধ্য দিয়ে সূর্যের শক্তি তাপ ও আলোর আকারে ছড়িয়ে পড়ে
মহাশূন্যে। সূর্যের দিকে তাকালে সূর্যকে যে ফুটন্ত গ্যাসপিন্ডের মত মনে হয় তার কারণ
ফটোস্ফিয়ারের ভেতর দিয়ে আমরা সূর্যের পরিচলন অঞ্চলকে দেখতে পাই।
আলোকমন্ডলের পর থেকে শুরু হয়েছে সূর্যের বায়ুমন্ডল। আলোকমন্ডলের
বাইরের স্তরের নাম হলো ক্রোমোস্ফিয়ার বা বর্ণমণ্ডল। এই স্তর সূর্যের বায়ুমন্ডলের সবচেয়ে
ভেতরের স্তর। শুধুমাত্র পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় এই স্তরের দেখা পাওয়া যায়। এই স্তরের
তাপমাত্রা প্রায় ১১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা যেখানে সাড়ে পাঁচ
হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে তার বাইরে ৫০০০ কিলোমিটার পুরু স্তরের তাপমাত্রা এগারো
হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস কীভাবে হয়ে যায়? বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। সূর্যের বর্ণমন্ডল
পার হয়ে বায়ুমন্ডলের সবচেয়ে বাইরের স্তর কোরোনা বা কিরীটে এলে তাপমাত্রা হয়ে যাচ্ছে
প্রায় সতের লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর কারণ কী?
বিজ্ঞানীরা কিছু আনুমানিক কারণ দেখাচ্ছেন, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে
এখনো জানা যায়নি আসল ব্যাপার কী। ধারণা করা হচ্ছে সূর্যপৃষ্ঠ (আলোকমন্ডল) থেকে প্লাজমা
বর্ণমন্ডলে চলে এসে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবার সেখান থেকে চলে আসছে একেবারে বাইরের
স্তরে। সেখানে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে কয়েক লক্ষ গুণ। আবার এটাও মনে করা হচ্ছে সূর্যের
বায়ুমন্ডলে সৃষ্ট শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের কারণেই তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। আশা করা
যাচ্ছে সূর্যের কাছাকাছি পাঠানো স্যাটেলাইট ‘পার্কার’ সূর্যের অনেকগুলি বিস্ময়কর ব্যাপারের
সঠিক ব্যাখ্যা খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।
সূর্যের কিরীটে আরো অনেক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে চলেছে, যেমন সৌরবায়ু, সৌরশিখা, সৌরঝড়, সৌরকলঙ্ক।
সৌরবায়ু
প্রচন্ড তাপমাত্রার কারণে সূর্যের কিরীট থেকে অনবরত ছিটকে
বের হচ্ছে চার্জিত কণা – প্রোটন ও ইলেকট্রন। এদের গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় তিনশ
থেকে আটশ কিলোমিটার। এগুলি সারা সৌরজগতে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রচন্ড গতিতে চার্জিত কণা ছুটে
যাবার কারণে গ্রহগুলির নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্রে এর সাংঘাতিক প্রভাব পড়ে। যেসব গ্রহে চৌম্বকক্ষেত্র
আছে সেখানে মেরু অঞ্চলে অরোরা সৃষ্টি হয় এই সৌরবায়ুর প্রভাবে। মহাকাশে ভ্রমণরত স্যাটেলাইটগুলির
স্বাভাবিক কাজকর্মেও বিঘ্ন ঘটে। সৌরবায়ু সবসময় একই রকম থাকে না। মাঝে মাঝে বাড়ে, মাঝে
মাঝে কমে যায়। কিরীটের তাপমাত্রা একই থাকা সত্ত্বেও সৌরবায়ু প্রবাহে তারতম্য কেন ঘটে
সেটাও এখনো রহস্য।
সৌরকলঙ্ক
সূর্যের ফটোস্ফিয়ার বা আলোকমন্ডলে এগারো বছর পর পর কিছু কালো
দাগ দেখা যায়। এগুলোকে সৌরকলঙ্ক বলা হয়। এই দাগগুলি এক হাজার কিলোমিটার থেকে শুরু করে
এক লাখ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। এগুলো এক ঘন্টা থেকে শুরু করে কয়েক সপ্তাহ
পর্যন্ত থাকতে পারে সূর্যের গায়ে। ১৫১৩ সালে গ্যালিলিও সর্বপ্রথম এই সৌরকলঙ্ক পর্যবেক্ষণ
করেন। কিন্তু এগুলো যে চৌম্বকক্ষেত্রের কারণে হয় তা জানা ছিল না ১৯০৮ সাল পর্যন্ত।
আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জর্জ হেইল এই ব্যাপারটা আবিষ্কার করেন।
সৌরকলঙ্ক আসলে সূর্যের গায়ে ঘা ওঠার মতো। সূর্য মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে সেকেন্ডে ২৪০ কিলোমিটার বেগে ঘুরছে। আবার নিজের অক্ষের উপর ঘুরছে গড়ে সেকেন্ডে প্রায় দুই কিলোমিটার বেগে। এতে তার গ্যাসের ভেতর শক্তিশালী চুম্বকক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। প্রতি এগারো বছর পর পর এই চুম্বকক্ষেত্রের দিক বদলে যায়। কেন এগারো বছর পরপর এটা ঘটে এখনো কেউ জানে না। চৌম্বকক্ষেত্রের দিক বদলে গেলে কিছু কিছু জায়গায় বদ্ধ চুম্বকক্ষেত্র বা লুপের সৃষ্টি হয়। সেই লুপে কিছু গ্যাস সূর্যপৃষ্ঠে আটকে পড়ে। তখন সেখানে প্লাজমার প্রবাহ বন্ধ হয়ে গিয়ে সেই গ্যাসগুলির তাপমাত্রা মুক্ত গ্যাসের তাপমাত্রার চেয়ে কিছুটা কমে যায়। ফলে সেসব জায়গায় উজ্জ্বলতা কমে গিয়ে কালো দেখায়। সৌরকলঙ্ক একেক বছর একেক রকমের হতে পারে। কোন বছর ১০০টাও হতে পারে, কোন বছর ১০টারও কম হতে পারে।
সৌরঝড় ও সৌরশিখা
সূর্যের আবহাওয়া মোটেও শান্ত নয়। সৌরঝড় ওঠে সূর্যপৃষ্ঠে।
পৃথিবীর ঝড়ের মতো নয় এই ঝড়। সৌরঝড় তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রবাহের ফলে সৃষ্টি হয়।
সূর্যের বর্ণমন্ডল থেকে বিশাল বিশাল গ্যাসের ঢেউ উঠে উপচে পড়ে কিরীট অবধি। সূর্যের
চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে যখন সৌরকলঙ্ক দেখা যায় তখন এই ঢেউগুলো দেখা যায়। কয়েক হাজার
কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে একেকটি ঢেউ। কয়েক সপ্তাহ ধরে থাকতে পারে এই ঢেউ।
সৌরঝড়ের সময় মাঝে মাঝে বড় বড় গ্যাসের স্তম্ভ তীরের ন্যায় বেরিয়ে আসে সূর্যের বর্ণমণ্ডল
থেকে। মাঝে মাঝে হঠাৎ বিশাল পরিমাণ শক্তি বেরিয়ে আসে আগুনের বন্যার মতো। এই শক্তিগুলোকে
ধরে রাখার কোন ব্যবস্থা থাকলে একটা নির্গমনের শক্তিতেই আমাদের পৃথিবীর দশ লক্ষ বছর
চলে যেতো।
সৌরকলঙ্কের কারণেই সৌরঝড় ওঠে। সৌরকলঙ্ক যখন ঘটে তখন সূর্যের
চুম্বকক্ষেত্রের যেখানে যেখানে লুপ বা চক্রের সৃষ্টি হয় – সেই চক্রগুলির বেশ কয়েকটি
যদি মিশে গিয়ে বড় হতে থাকে – তখন তাতে আবদ্ধ গ্যাসগুলি শর্ট সার্কিট হবার মতো একসাথে
তীব্রবেগে বের হয়ে আসে চক্র ভেদ করে। জ্বলন্ত প্লাজমাসহ সোলার ফ্লেয়ার বা সৌরশিখা প্রায়
কয়েক লক্ষ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। সৌরঝড়ের কারণে পৃথিবীর নেটওয়ার্কে ঝামেলা
তৈরি হয়। স্যাটেলাইট আর নভোযানগুলিতেও কিছুটা ঝামেলা হয় প্রচুর চার্জিত কণা বায়ুমন্ডলে
চলে আসার কারণে।
সূর্যের গ্রহগুলিতেও ঘটছে নানা রকমের বিস্ময়কর ঘটনা। সূর্যের
নিকটতম গ্রহ বুধের কথাই ধরা যাক।
বুধ গ্রহে দিনে দু’বার সূর্যোদয় হয়
বুধের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার; বলা যায় অনেকটা হাঁসের ডিমের মতো।
তাই সূর্য থেকে বুধের দূরত্ব সব সময় সমান নয়। বুধ সূর্যের চারপাশে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে
ঘুরে। সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে বুধের গতি সবচেয়ে বেশি। ঘুরতে ঘুরতে যখন সূর্যের খুব
কাছে চলে আসে তখন বুধের গতি বেড়ে যায়, আবার যখন দূরে চলে যায় তখন গতি কিছুটা কমে যায়।
আবার বুধের আকাশে সূর্যের চলাচল বুধের নিজের অক্ষের ওপর মন্থর গতির জন্য কিছুটা প্রভাবান্বিত
হয়। বুধ কিন্তু নিজের অক্ষে খুবই আস্তে আস্তে
ঘোরে। নিজের অক্ষে বুধের গতি ঘন্টায় মাত্র ১০.৯ কিলোমিটার। একজন সাধারণ মানুষও এই বেগে
দৌড়াতে পারবে। যে কোন গ্রহের তুলনায় বুধ এতটাই আস্তে আস্তে ঘুরে যে নিজের অক্ষের উপর
একবার সম্পূর্ণ ঘুরতে তার লেগে যায় পৃথিবীর ৫৯ দিনের সমান। এই কারণে সূর্য নিজেও কিছুটা
আস্তে চলতে থাকে এবং কিছু সময়ের জন্য ডুবে যায় মানে অদৃশ্য হয়ে যায়। যখন বুধের কক্ষপথের
গতি কমে যায়, অক্ষের ঘূর্ণন সূর্যকে আবার উপরে তুলে দেয়। অর্থাৎ বুধের আকাশে একই দিনে
দ্বিতীয়বার সূর্যোদয় হয়।
বুধের একদিন সমান দুই বছর
সৌরজগতের গ্রহগুলোর বছর হিসেব করা হয় সূর্যের চারপাশে এক
বার ঘুরে আসতে যে সময় লাগে তার ভিত্তিতে। বুধের এক বছর অর্থাৎ সূর্যের চার পাশে একবার
ঘুরে আসতে পৃথিবীর যেখানে লাগে ৩৬৫ দিন সেখানে বুধের সময় লাগে মাত্র ৮৮ দিন। তার মানে
বুধের এক বছর হলো পৃথিবীর ৮৮ দিনের সমান।
পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর চব্বিশ ঘন্টায় একবার ঘুরে আসে। চব্বিশ
ঘন্টায় পৃথিবীর এক দিন। পৃথিবীর এক দিন বলতে আমরা যে চব্বিশ ঘন্টা বুঝি সেই চব্বিশ
ঘন্টার মোটামুটি দৈর্ঘ্য হলো পৃথিবীর কোন একটা নির্দিষ্ট স্থানে এক সূর্যোদয় থেকে পরবর্তী
সূর্যোদয় পর্যন্ত। বুধের এক দিনের হিসেবও সেভাবে করা হলে সেটা হবে - বুধের কোন একটা
নির্দিষ্ট স্থানে এক সূর্যোদয় থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত যে সময় লাগে সেটা।
বুধ নিজের অক্ষের উপর খুব আস্তে ঘোরে। সেজন্য সম্পূর্ণ একবার ঘুরতে সময় নেয় ৫৯ দিন। কিন্তু সূর্যের চারপাশে অনেক দ্রুত ঘুরে বলে এই ৫৯ দিনে তার কক্ষপথের প্রায় ২/৩ অংশ ঘুরে আসে। তাই বুধের কোন জায়গায় একজন দর্শক যদি দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে পরের সূর্যোদয় দেখতে হলে এই দর্শককে অপেক্ষা করতে হবে বুধ সূর্যের চারপাশে দু'বার ঘুরে আসতে যে সময় লাগবে সেই সময়। অর্থাৎ বুধের দুই বছর। দেখা যাক কীভাবে তা হয়।
উপরের চিত্রে ধরা যাক বুধের 1 অবস্থানে থেকে একজন দর্শক সূর্যোদয়
দেখল। তারপর 2 অবস্থানে মধ্য-সকাল, 3 অবস্থানে দুপুর, 4 অবস্থানে বিকেল, 5 অবস্থানে যখন আসে তখন কিন্তু
সূর্যের চারপাশে এক বার ঘোরা হয়ে গেছে। তার মানে বুধের এক বছর সময় চলে গেছে। অথচ তখন
মাত্র সূর্যাস্ত হয়েছে। তারপর 6 অবস্থানে সন্ধ্যা,
7 অবস্থানে মধ্যরাত্রি, 8 অবস্থানে ভোর এবং তারপর আবার 1 অবস্থানে নতুন সূর্যোদয়।
ততক্ষণে বুধ সূর্যের চারপাশে আরো একবার অর্থাৎ অবস্থান 1 থেকে যাত্রা শুরু করে আবার 1 অবস্থানে আসতে ১৭৬ দিন বা বুধের দুই বছর কেটে
গেছে। সূর্যের চারপাশে দুই বার ঘুরে আসতে যে সময় নেয় সেই সময়ে বুধ নিজের অক্ষের উপর
তিন বার ঘুরে। এইভাবে বুধের এক দিন সমান দুই বছর।
ছোট হয়ে যাচ্ছে বুধ
সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধ। সবচেয়ে বেশি আলো পায়। তারপরও
বুধের ভেতরটা ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ফলে ছোট হয়ে যাচ্ছে বুধ। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ
পেয়েছেন জন্মের পর থেকেই ক্রমশ ছোট হচ্ছে বুধ। এমনিতেই সূর্যের সবচেয়ে ছোট গ্রহ, তার
উপর আরো ছোট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কারণ কী? এই রহস্যেরও সঠিক ব্যাখ্যা নেই এখনও। কিছু
কিছু গবেষক প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে বুধ এখনো ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয়। সাড়ে চারশ
কোটি বছরের ক্রমাগত ঘূর্ণনের পরেও এর ভেতর এখনো কিছু ভূতাত্ত্বিক ফাটল এবং খালি জায়গা
রয়ে গেছে যা আস্তে আস্তে ভরে গিয়ে বুধের ভূগর্ভে সংকোচন ঘটছে। কিন্তু এই ব্যাখ্যার
অকাট্য প্রমাণ এখনো নেই আমাদের হাতে।
সূর্যের দ্বিতীয় গ্রহ শুক্রও কম রহস্যময়ী নয়। পৃথিবীর সাথে
গাঠনিকভাবে ভীষণ মিল আছে এই গ্রহের। আয়তন, ভর, ঘনত্ব সবই প্রায় কাছাকাছি পৃথিবী ও শুক্রের।
কিন্তু পরিবেশ হিসেব করলে পৃথিবী ও শুক্র একেবারে ভিন্ন ধরনের। পৃথিবীর তাপমাত্রা বসবাসযোগ্য।
কিন্তু শুক্রের তাপমাত্রা ৪৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড আর তরল
সালফিউরিক এসিডে ভর্তি। পৃথিবীর ৯০ গুণ চাপ এর পিঠে। শুক্র সূর্যের ১০৮ মিলিয়ন কিলোমিটার
দূরে। আর পৃথিবী ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার। মাত্র ৪২ মিলিয়নের ভেতরই কী এমন ঘটে গেলো? শুক্রের
ভেতর আগ্নেয়গিরিই প্রধান সমস্যা। নাসার ম্যাগেলান স্পেস প্রোব ৯৮ ভাগ জায়গা ঘুরে দেখেছে।
লক্ষ লক্ষ আগ্নেয়গিরি সেখানে এখনো জীবন্ত। কিন্তু রহস্য লুকিয়ে আছে এর ঘূর্ণনের দিকের
ভেতর।
শুক্র উল্টোদিকে ঘুরে
সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলো ঘুরছে ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘোরে তার
বিপরীত দিকে অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে। শুক্র গ্রহও সূর্যের চারপাশে একইভাবে পশ্চিম
থেকে পূর্বদিকে ঘুরছে। গ্রহগুলো যখন নিজের অক্ষের উপর ঘুরে - তখনও ঘড়ির কাঁটার বিপরীত
দিকে ঘুরে। অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরে। আমাদের পৃথিবীও পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে
ঘুরে। কিন্তু শুক্র গ্রহের বেলায় দেখা যাচ্ছে উল্টো ব্যাপার ঘটছে। শুক্র গ্রহ নিজের
অক্ষের উপর ঘোরে ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘোরে সেদিকে। অর্থাৎ পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে। গ্রহগুলোর
মধ্যে আরেকটি মাত্র গ্রহ ইউরেনাস নিজের অক্ষে শুক্র গ্রহের মতো পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে
ঘুরে।
শুক্র গ্রহ কেন অন্যান্য গ্রহগুলোর বিপরীত দিকে ঘোরে সে ব্যাপারে
বিজ্ঞানীরা এখনো একমত হতে পারেননি। ভিন্ন ভিন্ন তিনটি ধারণা বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। বিজ্ঞানীরা
মনে করেন শুক্র গ্রহও উদ্ভব হবার পর পর অন্যান্য গ্রহের মত পশ্চিম থেকে পূর্বদিকেই
ঘুরতে শুরু করেছিল। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে হঠাৎ গ্রহটি 180 ডিগ্রি কোণে উল্টে গিয়ে
উপরের দিক নিচে আর নিচের দিক উপরে উঠে যায়। ফলে ঘুর্ণনের দিক হয়ে যায় উল্টো। অনেক বিজ্ঞানী
মনে করেন শুক্র গ্রহের অভ্যন্তরীণ ভৌগোলিক কারণে কিংবা বায়ুমন্ডলের প্রচন্ড চাপে এই
উল্টেযাওয়ার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। আবার অনেকে মনে করেন বড় ধরনের কোন গ্রহাণুর আঘাতে
শুক্র গ্রহ উল্টে গিয়েছিল।
ফ্রান্সের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আলেক্সান্দ্রে কোরেইয়া
(Alexandre Correia) এবং জ্যাক লাস্কার (Jacques Laskar) কম্পিউটার সিম্যুলেশানের মাধ্যমে
দেখান যে শুক্র গ্রহের কক্ষপথে গতির দিক এবং নিজের অক্ষে গতির দিক শুরুতে একই রকম ছিল।
সেই সময় শুক্রের নিরক্ষীয় রেখা বরাবর বক্রতার পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। শুক্র সেই সময়
নিজের অক্ষের উপর অনেক দ্রুত ঘুরছিল। কিন্তু বক্রতার কারণে এবং শুক্রের বায়ুমন্ডলের
তীব্রতার কারণে নিজের অক্ষের উপর শুক্রের গতি ক্রমশ কমতে কমতে একসময় বিপরীত দিকে ঘুরতে
শুরু করে।
শুক্রে সূর্য উঠে পশ্চিম দিকে
শুক্র গ্রহের ক্ষেত্রে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের ঘটনা ঘটে পৃথিবীর
বিপরীত দিকে। শুক্র নিজের অক্ষে ঘুরছে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে। এখন কেউ যদি শুক্র গ্রহে
কোন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যকে দেখতে থাকে, তখন তার মনে হবে সূর্য আস্তে আস্তে পশ্চিম
থেকে পূর্বদিকে চলে যাচ্ছে। তাই বলা চলে শুক্র গ্রহে সূর্য উঠে পশ্চিম দিকে এবং অস্ত
যায় পূর্ব দিকে। কিন্তু মনে রাখা দরকার পৃথিবীতে যেমন প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় এক বার সূর্য
উঠে এবং একবার অস্ত যায়, শুক্র গ্রহে এক বার সূর্য উঠার পর আবার সূর্য উঠতে সময় লাগে
243 দিন। এর কারণ –
শুক্রে বছরের চেয়ে দিন বড়
পৃথিবীতে আমরা বছরের হিসাব করি সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে
আসতে পৃথিবীর মোট কতদিন লাগে তার হিসেবে। সেরকম শুক্রেরও এক বছর হলো সূর্যের চারপাশে
একবার ঘুরে আসতে তার যত দিন লাগে। সূর্যের চারপাশে এক বার ঘুরে আসতে শুক্রের লাগে
225 দিন। (এই দিন কিন্তু পৃথিবীর দিন, অর্থাৎ 1 দিন = 24 ঘন্টা)। অর্থাৎ শুক্রে
225 দিনে এক বছর।
দিনের হিসেব আমরা করি নিজের অক্ষের উপর এক বার ঘুরে আসতে
আমাদের গ্রহের কত সময় লাগে তার ভিত্তিতে। পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর চব্বিশ ঘন্টায় একবার
ঘুরে আসে। তাই চব্বিশ ঘন্টায় পৃথিবীর এক দিন। শুক্রের ক্ষেত্রে নিজের অক্ষের উপর একবার
ঘুরতে সময় লাগে পৃথিবীর 243 দিন। অর্থাৎ শুক্রের এক দিন সমান পৃথিবীর 243 দিন। তাহলে
দেখা যাচ্ছে শুক্রের দিন শুক্রের বছরের চেয়ে বড়।
রহস্য আছে মঙ্গলেও। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত এভারেস্টের উচ্চতা
৮৮৫০ মিটার। কিন্তু এভারেস্ট কি সৌরজগতের সর্বোচ্চ পর্বত? যদি না হয়, সৌরজগতের সর্বোচ্চ
পর্বত কী এবং কোথায়? তার উত্তর আছে মঙ্গল গ্রহে।
মঙ্গলে আছে সৌরজগতের সর্বোচ্চ পর্বত
মঙ্গল গ্রহে আছে সৌরজগতের সবচেয়ে উঁচু পর্বত - অলিম্পাস মন্স,
যার উচ্চতা প্রায় ২২ কিলোমিটার যা এভারেস্ট পর্বতের প্রায় তিন গুণ। ৩৭০ থেকে ৩০০ কোটি
বছর - এই ৭০ কোটি বছর সময়কালকে মঙ্গল গ্রহের হেস্পেরিয়া পর্যায় ধরা হয়। এই সময়কালের
মধ্যে মঙ্গল গ্রহের সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ ঘটে এবং সীমাহীন লাভাস্রোত ভূগর্ভ
থেকে বেরিয়ে ভূস্তরে লাভার সমতল স্তর তৈরি করেছে। আবার ভূস্তর ঠেলে উপরের দিকে বেরিয়ে
সৃষ্টি হয়েছে অনেক পাহাড়-পর্বত। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে মাউন্ট অলিম্পাস।
শুধু তাই নয়, মঙ্গলেই আছে সৌরজগতের সবচেয়ে বড় অববাহিকা। ধারণা
করা হচ্ছে মঙ্গলের উত্তর মেরুতে বিশাল আকৃতির এক গ্রহাণু - (যার আয়তন চাঁদের আয়তনের
৬০%) এসে আঘাত হানে। ফলে উত্তরমেরু প্রায় ২৬ কিলোমিটার দেবে গিয়ে সমতল হয়ে যায়। উত্তর
মেরুর বরিয়ালিস বেসিন বা বরিয়ালিস অববাহিকার সৃষ্টি হয়েছে এভাবে। সৌরজগতের সবচেয়ে বড়
অববাহিকা এই বরিয়ালিস অববাহিকা, যার দৈর্ঘ্য ১০,৬০০ কিলোমিটার, আর প্রস্থ ৮,৫০০ কিলোমিটার।
এতবড় একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মঙ্গলের আদি বায়ুমন্ডলের বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতি। বিষুবরেখা বরাবর মাপলে
প্রায় ১৪৮,০০০ কিলোমিটার ব্যাস। হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসে ভর্তি। সবচেয়ে বড় হলেও
এটা সবচেয়ে বেশি বেগে ঘুরে। এর দিন মাত্র ৯ ঘন্টা ৫৫ মিনিট। বিশাল একটি কমলার তো দেখা
যায় একে। এর চারটি বড় উপগ্রহও দেখা যায়। গ্যালিলিও দেখেছিলেন সেই প্রথম টেলিস্কোপের
যুগে। স্যাটেলাইট পাইওনিয়ার, ভয়েজার, গ্যালিলিও সবাই বৃহস্পতিকে পরিভ্রমণ করেছে। জুনো
এখন করছে। বৃহস্পতির রহস্য হলো এটির চারপাশে খুবই হালকা রিং আছে। আর ভয়াবহ রকমের বেশি
চুম্বকক্ষেত্র। যার ফলে অনেক উজ্জ্বল অরোরা তৈরি হয়। প্রচুর বজ্রপাত হয়। আরো বড় রহস্য
হলো এর কেন্দ্রে। বৃহস্পতির কেন্দ্রে কী আছে? সূর্য থেকে এটি যে শক্তি পায় – তার চেয়ে
অনেক বেশি শক্তি উৎপাদন করে এর কেন্দ্রে। কেন্দ্রের তাপমাত্রা ৩৫ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বৃহস্পতি যদি আর মাত্র ৭৫ গুণ বড় হতো তাহলে এর কেন্দ্রের তাপমাত্রা এত বেশি হতো যে
নিউক্লিয়ার ফিশান শুরু হয়ে যেতো। আরেকটি সূর্যের মতো। বৃহস্পতির আরেকটি রহস্য হলো এর
রেড স্পট।
বৃহস্পতির রহস্যময় লাল টিপ
১৬৬৫ সালে গ্যালিলির পর ইতালি-ফ্রান্সের জ্যোতির্বিজ্ঞানী
জিওভানি ডোমিনিকো ক্যাসিনি বৃহস্পতির কালো আবছা আকাশে বিশাল এক লাল টিপ দেখতে পান।
পরে জানতে পারা গেছে ওটা বৃহস্পতির বিশাল ঝড়। ক্যাসিনির পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায় ঐ
ঝড় শুরু হয়েছে কমপক্ষে ৩৫০ বছর আগে। ১০০ বছর আগে এটি সবচেয়ে বড় ছিল। পৃথিবীর ব্যাসের
তিন গুণ ছিল। এখন আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। এখনো ওটা আমাদের পৃথিবীর ব্যাসের চেয়ে বড়।
ঐ ঝড় পৃথিবীতে উঠলে পৃথিবীর কী হতো! এত দীর্ঘদিন ধরে এই ঝড় থামছে না কেন? কারণ বৃহস্পতির
কোন ভূমি নেই। ভূমির সাথে ঝড়ের সংঘর্ষে শক্তি কমে যায়। বৃহস্পতির সাথে সাথে সেটা হতে
পারছে না। এটা অত বড় হয়েছে কারণ ছোট ছোট ঝড়্গুলি বড় ঝড়ের সাথে মিলে গেছে। ২০০০ সালে
তিনটি ছোট সাদা বিন্দু দেখা গিয়েছিল। পরে সেগুলি পরস্পর মিশে গিয়ে গাঢ় গোলাপী হয়ে যায়।
এখন ওটার নাম লিটল রেড স্পট। বড়টা এত বেশি বড় যে বায়ুমন্ডলের মেঘেরও আট কিলোমিটার উপরে
উঠে গেছে এর উপরের প্রান্ত। সেখানে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির সাথে বিক্রিয়া করে ওটা
লাল হয়ে যায়। এই চলমান ঝড় পুরোপুরি থামতে আরো কয়েক শ বছর লেগে যাবে ইতোমধ্যে যদি আবার
ঝড় না ওঠে।
গ্যাসীয় গ্রহগুলির রহস্য সমাধান করা অনেক বেশি কষ্টকর – কারণ
সেই গ্রহগুলির ভেতরে কোন স্যাটেলাইট ল্যান্ড করানো সম্ভব নয়, কারণ ল্যান্ডিং-এর জন্য
ল্যান্ডই তো নেই তাদের। বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন – চারপাশে শুধুই গ্যাস। প্রায়
পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার ভেতরে গেলে গ্যাসের ঘনত্ব একটু বাড়তে থাকে, তাপ বাড়তে থাকে।
তারপর তরল গ্যাস। হাইড্রোজেন গ্যাসের সমুদ্র। ঘনত্ব এত বেশি যে হাইড্রোজেনকেই মনে হবে
গলন্ত ধাতু। একেবারে কেন্দ্রে একটি গোলাকার পিন্ড থাকতেও পারে – কিন্তু সেটাও কোন শক্ত
কিছু হবে না। গলন্ত লাভার মতো নমনীয় কিছু। ইউরেনাস নেপচুনে উত্তপ্ত পানির সমুদ্র আছে
কিন্তু একফোঁটা ডাঙা নেই কোথাও। সামান্য কিছু এমোনিয়া ও মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি আছে।
সেগুলি প্রচন্ড চাপে ডায়মন্ডে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। ১৯৯৫ সালে গ্যালিলিও প্রোব বৃহস্পতির
বায়ুমন্ডলে ঢুকেছিল। মাত্র ৫৮ মিনিট টিকেছিল সেই প্রোব। ১৫৬ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকেছিল।
চাপ ও তাপে ধ্বংস হয়ে গেছে তারপর। এই গ্রহগুলির রহস্য রহস্যই থেকে যাবে সম্ভবত। হয়তো
কোনদিনই জানা যাবে না নেপচুনে আসলেই হীরা আছে না কি।
নেপচুনে হীরার খনি
সৌরজগতের সবচেয়ে দূরের গ্রহ নেপচুন। পুরো গ্রহটি স্বচ্ছ হালকা
তুষারের মতো গ্যাসে তৈরি। পুরো গ্রহটিকে জলীয় গ্রহ বলা যায়। পানিতে ভর্তি। কিন্তু কিছু
মিথেন গ্যাস আছে সেই পানিতে। নেপচুনের ভেতর প্রচন্ড চাপ। সেই চাপে মিথেনের কার্বন ডায়মন্ডে
পরিণত হয়। সেই ডায়মন্ড গ্রহের ভেতরের দিকে নামতে থাকে অনবরত। ক্যালিফোর্নিয়ার ল্যাবে
শক্তিশালী লেজার ব্যবহার করে নেপচুনের গ্রহের ভেতরের চাপের সমপরিমাণ চাপ প্রয়োগ করে
দেখা গেছে মিথেন ডায়মন্ডে পরিণত হচ্ছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি প্রচুর
হীরা আছে নেপচুনের ভেতর।
বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের আরো রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন। ধারণা করা
হচ্ছে সৌরজগতের শেষ সীমানায় আরো বড় কোন গ্রহ লুকিয়ে আছে।
সৌরজগতের শেষ সীমানায় কি আরো বড় বড় গ্রহ লুকিয়ে আছে?
মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে – মহাবিশ্বের রহস্য
তত খুলে যাচ্ছে। ১৯৯২ সালের পর থেকে ধরলে নেপচুনের পরে আরো দুই হাজারেরও বেশি বরফরাজ্য
খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ২০০৬ সালে প্লুটো তার গ্রহত্ব হারায়। সে হয়ে পড়ে কুইপার
বেল্টের আরো সব বস্তুর মতো। এগুলি এত ছোট যে কুইপার বেল্টের সবগুলি গ্রহাণুকে একসাথে
করলেও সেটা পৃথিবীর চেয়ে বড় কিছু হবে না। এই বস্তুগুলির ভেতর কিছু রহস্যজনক ব্যাপার
ঘটতে দেখা যাচ্ছে। কুইপার বেল্টের ছোট্ট গ্রহাণু, কিন্তু দেখা যাচ্ছে তাদের ঘূর্ণন
পথ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি লম্বা। মনে হচ্ছে কাছাকাছি অন্য কোন বিশাল গ্রহের গ্রাভিটেশনের
মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ক্যালটেকের প্রফেসর কনস্টান্টিন ব্যাটাইগিন ও প্রফেসর মাইক
ব্রাউন এই অনাবিষ্কৃত গ্রহকে প্ল্যানেট-নাইন বলে ডাকতে শুরু করেছেন। ২০০৬ সালের আগপর্যন্ত
সৌরজগতের প্ল্যানেট-নাইন ছিল প্লুটো। তাঁরা হিসেব করে দেখেছেন এই অনাবিষ্কৃত গ্রহটি
প্লুটোর চেয়ে তিন হাজার গুণ ভারী, পৃথিবীর চেয়ে দশ গুণ।
এই নতুন গ্রহ কি আবিষ্কৃত হবে কোনদিন? যদি হয়, রহস্যময় সৌরজগতের
রহস্য আরো বাড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
তথ্যসূত্র
১। হিথার কুপার ও নিজেল হেনবেস্ট, দ্য ইউনিভার্স এক্সপ্লেইনড,
ফায়ারফ্লাই বুক্স, নিউইয়র্ক, ২০১৮।
২। পল মারডিন, দ্য সিক্রেট লাইভস অব প্ল্যানেটস, হোডার অ্যান্ড
স্টাফটন, লন্ডন, ২০১৯।
৩। রিচার্ড করফিল্ড, লাইভস অব দ্য প্ল্যানেটস, ব্যাসিক বুকস,
নিউইয়র্ক, ২০০৭।
৪। অ্যান্ড্রু কোহেন ও ব্রায়ান কক্স, প্ল্যানেটস, উইলিয়াম
কলিন্স, লন্ডন, ২০১৪।
৫। প্রদীপ দেব – অর্ক ও সূর্যমামা (২০১৫), পৃথিবী সূর্যের
তৃতীয় গ্রহ (২০১৬), চাঁদের নাম লুনা (২০১৭), বুধ যে গ্রহের একদিন সমান দুই বছর (২০১৮),
শুক্র যে গ্রহে সূর্য উঠে পশ্চিম দিকে (২০১৯), লাল গ্রহ মঙ্গল (২০২০), মীরা প্রকাশন,
ঢাকা; মঙ্গলে অভিযান (২০২০), প্রথমা, ঢাকা।
No comments:
Post a Comment