Wednesday 31 July 2024

Why do powerful people act stupid?

 




The behaviour of powerful individuals might sometimes appear foolish or irrational due to a variety of psychological, social, and contextual factors:

Overconfidence: Power can lead to overconfidence, causing individuals to believe their decisions are always correct, even when they are not.

Isolation: Powerful people often become isolated from dissenting opinions and critical feedback, leading to poor decision-making.

Echo Chambers: They might surround themselves with people who agree with them, reinforcing their beliefs and behaviours, no matter how misguided.

Pressure and Stress: The high stakes and stress associated with power can impair judgment and lead to hasty or ill-considered actions.

Entitlement: Power can create a sense of entitlement, leading individuals to believe they are above the rules or norms that govern others' behaviour.

Cognitive Dissonance: When faced with evidence that contradicts their beliefs or actions, powerful individuals may double down on their original stance to avoid the discomfort of cognitive dissonance.

Groupthink: In hierarchical organizations, subordinates might be reluctant to challenge the ideas of those in power, leading to poor decisions being made without proper scrutiny.

Moral Licensing: Some powerful individuals might engage in unethical or irrational behaviour because they feel their position or past good deeds give them a license to do so.

Hubris Syndrome: Some psychologists argue that long-term holding of power can lead to hubris syndrome, a disorder of the possession of power, particularly power which has been associated with overwhelming success, held for a period of years.

These factors can combine to create a situation where powerful people make decisions or take actions that seem foolish or counterproductive.


Hubris Syndrome

 




What is Hubris syndrome?

Hubris Syndrome is a term used to describe a disorder of the possession of power, especially power that has been held for a significant period and has been associated with overwhelming success. The syndrome is characterized by a range of behaviours and attitudes that reflect excessive pride, overconfidence, and a sense of invincibility.

Key Characteristics of Hubris Syndrome:

Excessive Pride and Self-Confidence: Individuals with hubris syndrome exhibit an exaggerated belief in their own abilities and judgment.

Disdain for Others: They often show a contemptuous attitude toward others, especially those who are seen as inferior or opposed to them.

Isolation from Reality: There is a tendency to become isolated from reality, ignoring or dismissing advice, criticism, and dissenting opinions.

Imprudence: The decision-making process is often rash and lacking in proper consideration of the consequences.

Use of Power for Personal Gain: They might use their position of power to pursue personal agendas rather than the common good.

Moral Rectitude: A belief that their actions are morally justified, regardless of the legality or ethics of those actions.

Messianic Belief: Some individuals may develop a belief that they are uniquely destined to save or lead their organization or country.

Loss of Contact with Reality: There can be a progressive detachment from reality, leading to increasingly unrealistic assessments and expectations.

Causes:

Prolonged Tenure in Power: Extended periods of power without significant checks and balances.

Lack of Accountability: Environments where powerful individuals are not held accountable for their actions.

Overwhelming Success: A history of significant achievements that reinforces the belief in personal infallibility.

Cultural and Organizational Factors: Cultures and organizations that idolize leaders and discourage dissent can contribute to the development of hubris syndrome.

Consequences:

Poor Decision Making: Decisions may be made based on personal whim rather than rational analysis.

Organizational Damage: The organization or institution may suffer due to the leader's misguided actions.

Loss of Support: Over time, the leader may lose the support of colleagues, subordinates, and the public.

Scandals and Failures: Actions driven by hubris can lead to scandals, ethical breaches, and significant failures.

Hubris Syndrome has been discussed in the context of political leaders, business executives, and other individuals in positions of significant power. Understanding and mitigating the risks associated with this syndrome is crucial for maintaining effective and ethical leadership.

______________

*** Image is generated by AI. 

Wednesday 3 July 2024

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

 


“পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?”

১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্যাগাজিনের সম্পাদকের এই প্রশ্নে আবারো কিছুটা আত্মগ্লানিতে ভুগলেও খুব বেশি অবাক হননি আলবার্ট আইনস্টাইন। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞের পর থেকেই আইনস্টাইনকে এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে নিয়মিত। সাংবাদিকরা তো বটেই, পৃথিবীর শান্তিকামী জনগণের অনেকেই যাঁরা আইনস্টাইনকে একজন পরম শান্তিকামী মানুষ বলে জানতেন তাঁরাও পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের জন্য আইনস্টাইনকেই দোষারোপ করছেন। সে তুলনায় জাপানের এই বয়স্ক সাংবাদিকের প্রশ্নে সরাসরি দোষারোপ ছিল না, ছিল অনেকটাই হতাশার সুর। তিনি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না আইনস্টাইনের মতো মানুষ পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন যে বোমা ধ্বংস করে দিয়েছে হাজার হাজার নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের জীবন, ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে দুটো আধুনিক শহর।

জাপানের কাইজো ম্যাগাজিনের কতৃপক্ষের সাথে অনেক বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আইনস্টাইনের। এদেরই আমন্ত্রণে ১৯২২ সালে জাপান সফর করেছিলেন আইনস্টাইন। সেবার জাপানে পৌঁছেই আইনস্টাইন পেয়েছিলেন তাঁর নোবেল পুরষ্কার পাবার খবর। জাপানের মানুষের প্রচন্ড শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছিলেন আইনস্টাইন। তাঁর জাপান সফরের সমস্ত বিবরণ, জাপানের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে দেয়া তাঁর বিজ্ঞান-বক্তৃতার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল এই কাইজো ম্যাগাজিনেই। আইনস্টাইন ভীষণ অনুশোচনায় ভুগছিলেন জাপানের এত বড় ক্ষতিতে। অথচ বোমা তৈরিতে তাঁর ভূমিকা ছিল সামান্যই। তিনি অন্যসব প্রচার-মাধ্যমকে এ ব্যাপারে যা বলেছিলেন, কাইজো ম্যাগাজিনের সম্পাদককেও একই কথা বললেন:

“পারমাণবিক বোমা তৈরির কোনো গবেষণা আমি কোনোদিন করিনি। এক্ষেত্রে আমার একমাত্র দোষ এই যে ১৯০৫ সালে আমি পদার্থের ভর এবং শক্তির একটি সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছিলাম। ওটা ছিল খুবই সাধারণ একটি প্রাকৃতিক সত্য সম্পর্ক। সামরিক বাহিনি এই সম্পর্ক কোনোদিন কাজে লাগাতে পারে তা আমার চিন্তাতেই কোনোদিন আসেনি। পারমাণবিক বোমা তৈরিতে আমার একমাত্র অংশগ্রহণ ছিল এই যে ১৯৩৯ সালে আমি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে লেখা একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলাম। সেখানে আমি উল্লেখ করেছিলাম এরকম একটি বোমা তৈরির সম্ভাবনার কথা – যে সম্ভাবনা জার্মানরা কাজে লাগাতে পারে। আমি ওটা আমার কর্তব্য বলে মনে করেছিলাম, কারণ জার্মানরা সত্যিই ওরকম বোমা বানানোর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো এমন প্রমাণ সেসময় পাওয়া গিয়েছিল।“

জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এর জন্য অনুশোচনা করেছেন আইনস্টাইন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে ১৯৫৪ সালের ১৬ নভেম্বর লিনাস পাউলিংকে আইনস্টাইন বলেছিলেন, “প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে আমার চিঠি লেখাটি ছিল আমার জীবনের একটি মস্তবড় ভুল।“ লিনাস পাউলিং তার কিছুদিন আগে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। আইনস্টাইনের কথা তাঁর মনেও প্রচন্ড দাগ কেটেছিল। এরপর লিনাস পাউলিং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৬২ সালে এই কাজের তিনি দ্বিতীয়বার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন – শান্তিতে।

পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রকল্পে আইনস্টাইন সরাসরি যুক্ত ছিলেন না এই কথা সত্য। কিন্তু তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ E = mc2-ই যে পারমাণবিক শক্তির বিপুল উৎস নির্দেশ করেছিল – তাও সত্য। আজ বিশ্বের মোট শক্তির চাহিদার শতকরা দশ ভাগ মেটানো হচ্ছে পারমাণবিক শক্তির মাধ্যমে। পৃথিবীতে এখন প্রায় সাড়ে চারশ ছোট-বড় নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। নিউক্লিয়ার শক্তি-ই একমাত্র শক্তি যার শুরুটা হয়েছিল একটি ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে। ভয় এবং ধ্বংসের পথ পরিবর্তন করে আজ এই শক্তি কাজে লাগানো হচ্ছে নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে। এই উত্তরণের ইতিহাস সময়ের হিসেবে খুব বেশি দীর্ঘ নয়, অথচ খুবই ঘটনাবহুল। অন্য কোন শক্তির ক্ষেত্রে এত বেশি বিজ্ঞানী একসাথে কাজ করেননি যতজন করেছেন পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কারের ক্ষেত্রে। পৃথিবীর প্রথম সফল পারমাণবিক বোমা তৈরি হয়েছে যে ম্যানহ্যাটন প্রকল্পের মাধ্যমে – সেই প্রকল্পে যেসব নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী কাজ করেছিলেন তাঁরা তো ছিলেনই,  তরুণ বিজ্ঞানীদের মধ্যেও আরো ষোলজন বিজ্ঞানী পরবর্তীতে নিজ নিজ ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।

পরমাণুর ভেতরের বিপুল শক্তির উৎস সম্পর্কে খুব একটা পরিষ্কার ধারণা উনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকেও বিজ্ঞানীদের ছিল না। পরমাণুর সঠিক গঠন জানার আগেই পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানীরা চার্জের প্রমাণ পেয়েছেন। ইলেকট্রন তখনো সঠিকভাবে আবিষ্কৃত না হলেও ঋণাত্বক ও ধ্বনাত্বক চার্জের মধ্যকার কুলম্বের সূত্র, ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচুম্বকের সমীকরণ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীর পুরোটা এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশক পর্যন্ত ইওরোপই ছিল পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার উর্বর ভূমি।

১৮৮৮ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী হেনরিক হার্টজ পরীক্ষাগারে তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ উৎপাদন করতে সক্ষম হবার পর অদৃশ্য তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের ব্যাপারে প্রচন্ড আগ্রহ তৈরি হয় সারাপৃথিবীর বিজ্ঞানীদের মধ্যে। তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ তৈরির কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হতো ক্যাথোড রে টিউব। ১৮৯৫ সালের শেষের দিকে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী উইলহেল্‌ম রন্টজেন (বিলহেল্‌ম রন্টগেন) ক্যাথোড রে টিউব নিয়ে কাজ করছিলেন তাঁর বুর্জবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে। বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকুয়াম টিউবের ভেতর ক্যাথোড রে কী ধরনের মিথষ্ক্রিয়া করে তা পরীক্ষা করে দেখছিলেন তিনি। একটি বিশেষ পরীক্ষার জন্য তিনি ক্যাথোড রে টিউবটিকে কালো মোটা কাগজে এমনভাবে ঢেকে দিয়েছিলেন যেন কোন আলো বাইরে বের হয়ে যেতে না পারে। ক্যাথোড রে টিউবে উচ্চ বিদ্যুৎপ্রবাহ চালনা করার সাথে সাথেই তিনি দেখলেন টিউব থেকে কিছুটা দূরে রাখা একটি কার্ডবোর্ড থেকে উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটছে। অন্য একটি পরীক্ষার জন্য এই কার্ডবোর্ডটিতে তিনি ফসফরেসেন্ট কম্পাউন্ড (অনুপ্রভ যৌগ) মাখিয়ে রেখেছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন ভ্যাকুয়াম টিউব থেকে কোন রশ্মি বের হয়ে অনুপ্রভ যৌগে আলো তৈরি করছে। এধরনের রশ্মি তিনি আগে কখনো দেখেননি। বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করে দেখলেন এই রশ্মির ধর্ম অন্য সব জানা রশ্মির চেয়ে ভিন্ন। এই রশ্মি কাগজ, কাঠ ইত্যাদির ভেতর দিয়ে সহজে চলে যেতে পারে, তবে মোটা পুরু ধাতব পদার্থের ভেতর দিয়ে যেতে পারে না। এই রশ্মি চালনা করে দিয়ে তার সামনে হঠাৎ হাত নাড়াতে গিয়ে খেয়াল করলেন তাঁর হাতের হাড় দেখা গেলো অনুপ্রভ যৌগ মাখানো কার্ডবোর্ডে। আবিষ্কৃত হলো একটি অজানা রশ্মি। রন্টজেন তার নাম দিলেন এক্স-রে। কয়েক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানের মূল দরজা খুলে গেছে রন্টজেনের এক্স-রে আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। ১৯০১ সালে প্রথম নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় উইলহেল্‌ম রন্টজেনকে এক্স-রে আবিষ্কারের জন্য।

এক্স-রে তৈরির পদ্ধতি জানার পর পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানীদের অনেকেই এক্স-রে নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করলেন। কিন্তু তখনো কেউ জানেন না কেন এক্স-রে তৈরি হচ্ছে। এক্স-রের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তখনো অজানা।

পরের বছর ১৮৯৬ সালে ফ্রান্সের পদার্থবিজ্ঞানী হেনরি বেকুয়েরেল সীসার মতো ভারী ধাতুর ধর্ম সম্পর্কে গবেষণা করার জন্য কিছু ইউরেনিয়াম অক্সাইড এনে তাঁর গবেষণাগারের ড্রয়ারে রেখেছিলেন। ইওরোপে ইউরেনিয়াম নিয়ে গবেষণা চলছিল অনেক বছর থেকেই। জার্মান রসায়নবিদ মার্টিন ক্ল্যাপরোথ ইউরেনিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন ১৭৮৯ সালে। নতুন মৌলটির নাম ইউরেনিয়াম রেখেছিলেন আট বছর আগে আবিষ্কৃত ইউরেনাস গ্রহের নামানুসারে। ইউরেনিয়াম অক্সাইডের পুটলি ড্রয়ারে রেখে বেশ কিছুদিন অন্য গবেষণায় ব্যস্ত ছিলেন হেনরি বেকুয়েরেল। এক্স-রে নিয়ে গবেষণা করার জন্য তিনি কিছু ফটোগ্রাফিক ফিল্ম এনে রেখেছিলেন। ড্রয়ার থেকে ফিল্মগুলি বের করে দেখলেন সেখানে ছোপ ছোপ দাগ। মনে হচ্ছে এক্স-রের দাগ। কিন্তু তিনি তো এই ফিল্মে এক্স-রে প্রয়োগ করেননি। তবে এই রশ্মির উৎস কী? প্রমাণ পাওয়া গেল যে ইউরেনিয়াম অক্সাইড থেকে অজানা রশ্মি বের হয়ে ফটোগ্রাফিক ফিল্মে দাগ ফেলেছে। আবিষ্কৃত হলো রেডিও-অ্যাকটিভিটি। রেডিওঅ্যাকটিভিটি নামটি দিয়েছিলেন মেরি কুরি। বেকুয়েরেল তখনো জানেন না কী কারণে ইউরেনিয়াম থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে এরকম কণা নির্গত হচ্ছে।

এদিকে ইংল্যান্ডে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে পদার্থবিজ্ঞানী জোসেফ জন থমসন ১৮৯৭ সালে আবিষ্কার করলেন স্বতন্ত্র ইলেকট্রন। ইলেকট্রনের ধারণা ছিল অনেক বছর আগে থেকেই। কিন্তু ইলেকট্রন যে ক্ষুদ্রতম ভর সম্পন্ন কণা তা প্রতিষ্ঠিত হলো ১৮৯৭ সালে। এর ভর পাওয়া গেল সবচেয়ে হালকা মৌল হাইড্রোজেনের ভরের দুই হাজার ভাগের এক ভাগ। ইলেকট্রন সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হতে শুরু করলো। পরমাণুর কোয়ান্টাম তত্ত্ব আস্তে আস্তে দানা বাঁধতে শুরু করলো। জোসেফ জন থমসন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯০৬ সালে।

১৮৯৮ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত নিরলস পরিশ্রম করে পিচব্লেন্ড থেকে দুটো নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার করলেন মেরি ও পিয়ের কুরি। মৌল দুটোর নাম দেয়া হলো পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম। রেডিও-অ্যাকটিভিটির জন্য ১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন হেনরি বেকুয়েরেল, পিয়ের কুরি ও মেরি কুরি।

এগুলি সব পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানের আবিষ্কার। তখনো কিন্তু পরমাণুর কোন সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পরমাণুর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন নিউজিল্যান্ডে জন্ম নেয়া ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড।

রাদারফোর্ড ছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে জোসেফ জন থমসনের ছাত্র। থমসন ইলেকট্রনের ভর নির্ণয় করে পরমাণুর সবচেয়ে মৌলিক উপাদান হিসেবে ইলেকট্রনকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। রাদারফোর্ড তখন কানাডার মন্ট্রিয়েলে ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে চলে গেছেন। সেখানে তিনি সদ্য আবিষ্কৃত রেডিও-অ্যাকটিভিটি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করলেন। ১৮৯৯ সালে তিনি দুই ধরনের তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করলেন। গ্রিক অক্ষর অনুসারে তাদের নাম দিলেন আলফা ও বিটা। ১৯০২ সালে প্রমাণিত হলো যে বিটা কণা আসলে ইলেকট্রন। ১৯০৩ সালে আরেক ধরনের তেজস্ক্রিয় রশ্মি আবিষ্কৃত হলো – যার ধর্ম একেবারে এক্স-রের ধর্মের মতো। তার নাম দেয়া হলো গামা রশ্মি। এক্স-রে ও গামা রের মধ্যে মিল থাকলেও – তাদের উৎপত্তি হয় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। এক্স-রে উৎপন্ন হয় ভ্যাকুয়াম টিউবে অ্যানোড ও ক্যাথোডের মধ্যে উচ্চ ভোল্টের বিদ্যুৎপ্রবাহ চালনা করলে। কিন্তু গামা রশ্মি তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে নির্গত হয়। ১৯০৫ সালে রাদারফোর্ড আবিষ্কার করলেন তেজস্ক্রিয় ভারী মৌল স্বতস্ফূর্তভাবে কণা বিকিরণ করে অপেক্ষাকৃত হালকা মৌলে পরিণত হতে থাকে। আলফা কণা যে আসলে হিলিয়াম মৌল তাও তিনি আবিষ্কার করেন। এজন্য ১৯০৮ সালে তিনি রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পান।

এদিকে জার্মানির বার্ন শহরের প্যাটেন্ট অফিসের তৃতীয় শ্রেণির ক্লার্ক আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে একের পর এক চারটি তত্ত্বীয় পেপার লিখে ফেললেন যেগুলি পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই সমস্ত পদার্থবিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব বদলে দিলো। ভর এবং শক্তির সমীকরণ E = mc2 প্রতিষ্ঠা করলেন আইনস্টাইন – যাতে দেখা গেলো অতি সামান্য ভর থেকেও বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হতে পারে। বস্তুর ভরকে আলোর বেগের বর্গফল দিয়ে গুণ করলে শক্তি পাওয়া যায়। এই সমীকরণ অনেকটা নিউটনের গতিশক্তির সমীকরণের মতো; E = 1/2mv2. কিন্তু আইনস্টাইন শুধু শক্তি নয়, ভরের চিরায়ত ধারণাও বদলে দিয়েছেন। ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানে বস্তুর গতির সাথে ভরের পরিবর্তনকে হিসেবেও ধরা হয় না। কিন্তু আইনস্টাইন দেখালেন বস্তুর আপেক্ষিক ভর বস্তুর গতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। সেদিন অবশ্য কারো মাথাতেই আসেনি যে একদিন আইনস্টাইনের এই সমীকরণকে বাস্তবে কাজে লাগানোর কৌশল মানুষ আবিষ্কার করে ফেলবে। আইনস্টাইন নিজেও তা ভাবেননি সেদিন।

তখনো পরমাণুর কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়নি। রাদারফোর্ড কানাডা থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়েছেন।  ১৯১১ সালে রাদারফোর্ড পরমাণুর নিউক্লিয়াস এবং প্রোটন আবিষ্কার করলেন। সেই সময় ডেনমার্কের নীলস বোর পিএইচডি শেষ করে একটি রিসার্চ ফেলোশিপ নিয়ে ইংল্যান্ডে আসেন। রাদারফোর্ডের তত্ত্বাবধানে পোস্টডক্টরাল গবেষণা করার সময়েই তাঁর পরমাণুর কোয়ান্টাম তত্ত্ব দানা বাঁধতে থাকে। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের বাইরে ইলেকট্রনের কক্ষপথের শক্তিস্তর এবং কোয়ান্টাম বিন্যাস সম্পর্কে প্রচুর গবেষণা চলতে থাকে। আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠিত হয় বোরের পারমাণবিক মডেল।

নিউক্লিয়াস আবিষ্কৃত হবার পর বেশ কয়েক বছর কেটে গেলেও নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের আলাদা কোন অস্তিত্ব তখনো স্বীকৃতি পায়নি। কিন্তু নিউক্লিয়াসের সাথে নিউক্লিয়াসের মিথষ্ক্রিয়া ঘটানোর গবেষণা চলছিল। ১৯১৯ সালে রাদারফোর্ড তাঁর গবেষণাগারে নাইট্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসের প্রবেশ ঘটিয়ে অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন উৎপাদন করতে সক্ষম হন। তাতে এটা প্রমাণিত হলো যে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা বদলে গেলে মৌল বদলে যায়।

১৯৩০ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ওয়াল্টার বোথে এবং তাঁর গবেষণা-ছাত্র হারবার্ট বেকার বেরিলিয়াম পরমাণুর সাথে আলফা কণার মিথষ্ক্রিয়া ঘটান। মেরি ও পিয়ের কুরি পোলোনিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন প্রায় তিরিশ বছর আগে। তখন থেকেই বিজ্ঞানীরা পোলোনিয়াম ব্যবহার করে আসছেন আলফা কণার উৎস হিসেবে। বোথে ও বেকার দেখলেন যে বেরিলিয়ামের সাথে আলফা কণার মিথষ্ক্রিয়ায় একটি নতুন ধরনের বিকিরণ নির্গত হচ্ছে। এই বিকিরণ চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হয় না। অর্থাৎ যে কণাগুলি বের হচ্ছে সেগুলি চার্জহীন। তাঁরা ভাবলেন কণাগুলি সম্ভবত গামা রশ্মি। কিন্তু খটকা রয়ে গেল। কারণ গামা রশ্মির ভর নেই, অথচ এই কণাগুলি বেশ ভারী।

এদিকে ফ্রান্সে মেরি কুরির কন্যা আইরিন কুরি এবং তার স্বামী ফ্রেদেরিক জুলিও-কুরি তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নিয়ে গবেষণা করছিলেন অনেক বছর থেকে। তাঁরা বোথে ও বেকারের পরীক্ষাটি নিজেদের মতো করে করলেন তাঁদের প্যারিসের গবেষণাগারে। তাঁরাও দেখলেন যে চার্জহীন ভারী কণা বের হচ্ছে। তাঁরা ভাবলেন এই কণাগুলি আসলে কম্পটন বিক্ষেপণের ফলে হচ্ছে। ১৯২৩ সালে আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী আর্থার হলি কম্পটন এক্স-রের সাথে পরমাণুর মিথষ্ক্রিয়া থেকে কম্পটন ইফেক্ট আবিষ্কার করেন। পরমাণুর সর্বোচ্চ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনগুলির সাথে এক্স-রে ফোটনের মিথষ্ক্রিয়া ঘটলে ফোটন থেকে কিছুটা শক্তি শোষণ করে ইলেকট্রন পরমাণু থেকে ছিটকে বের হয়ে আসে। আর ফোটন যেহেতু কিছুটা শক্তি হারায়, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যায় এবং দিক পরিবর্তন করে। ফলে বিক্ষেপণ ঘটে। এই ইফেক্ট আবিষ্কারের জন্য কম্পটন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯২৭ সালে।

আইরিন ও ফ্রেদেরিক তাঁদের পরীক্ষালব্ধ ফলের ভুল ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন বেরিলিয়াম ও আলফা কণার মিথিষ্ক্রিয়ায় যে কণা নির্গত হচ্ছে তা কম্পটন ইফেক্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ফলে ভরযুক্ত যে কণা নির্গত হচ্ছে তা আসলে কম্পটন ইলেকট্রন।

এই খবর যখন ইংল্যান্ডে রাদারফোর্ডের কাছে পৌঁছলো – তাঁর মনে হলো এখানে নতুন কিছু আছে। তিনি তাঁর গবেষক-ছাত্র জেমস চ্যাডউককে পরামর্শ দিলেন পরীক্ষণটি আবার করতে। যে কণা নির্গত হলো তার ভর হিসেব করে দেখা গেলো তা প্রোটনের ভরের চেয়ে সামান্য একটু বেশি। চার্জহীন এই কণার নাম রাখা হলো নিউট্রন। নিউট্রন আবিষ্কারের জন্য চ্যাডউইক পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন ১৯৩৫ সালে।

নিউট্রন আবিষ্কারের পর থেকেই বলা চলে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের মহাযাত্রা শুরু হলো। পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউট্রন প্রবেশ করিয়ে নতুন নতুন তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ তৈরি করার পথ খুলে গেল। এই পথ দেখানোর পথিকৃৎ ছিলেন আইরিন কুরি ও ফ্রেডেরিক জুলি-কুরি। ১৯৩৫ সালে তাঁরা দুজন রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পান।

নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য দরকার হয় উচ্চক্ষমতার পার্টিক্যাল এক্সিলারেটর বা কণা-ত্বরকের। ১৯৩২ সালে এরকম কাজের জন্য প্রথম সাইক্লোট্রন উদ্ভাবন করেন আমেরিকার পদার্থবিজ্ঞানী আর্নেস্ট লরেন্স। এজন্য তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান ১৯৩৯ সালে।


এনরিকো ফার্মি


নিউট্রন আবিষ্কারের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গবেষণা করেছেন যিনি – তিনি হলেন ইতালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি। একই সাথে তত্ত্বীয় এবং পরীক্ষণ উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষ ফারমি পর্যায়সারণীর সবগুলি মৌলের নিউক্লিয়াসেই নিউট্রনের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তাদের আইসোটোপগুলির কার্যকারিতা এবং ধর্ম পরীক্ষা করে দেখেছেন তিনি। নিউট্রনের বিকিরণের মাধ্যমে নতুন তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ তৈরির পথ দেখানোর জন্য এনরিকো ফার্মি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৩৮ সালে। রাদারফোর্ডকে যেমন নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের জনক বলা হয়, তেমনি এনিরিকো ফার্মিকে বলা হয় নিউক্লিয়ার যুগের স্থপতি।

 ইওরোপ আমেরিকা জুড়ে যে সময়ে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের গবেষণা বেগবান হচ্ছিলো সেই সময় ইওরোপে বেড়ে চলছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। ১৯৩৩ সালে জার্মানির ক্ষমতায় আসে হিটলার। ইহুদিদের উপর নানারকম অত্যাচার শুরু হলে আইনস্টাইনসহ ইওরোপের অনেক বিজ্ঞানী নিজেদের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে বিশেষ করে আমেরিকায় গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের স্থান হয়। আইনস্টাইন যুক্ত হন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব এডভান্সড স্টাডিতে। হ্যান্স বেথে যোগ দেন কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। এনরিকো ফার্মি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, জর্জ গ্যামো ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে আমেরিকার বিখ্যাত নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায় – ইওরোপ থেকে পালিয়ে আসা বিজ্ঞানীদের নিয়ে।

হাঙ্গেরি থেকে আমেরিকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন লিও শিলার্ড, ইউজিন উইগনার এবং এডোয়ার্ড টেলার। আমেরিকায় প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এই তিনজন পদার্থবিজ্ঞানী।

বোমা তৈরির প্রকল্পে আসার আগের কয়েক বছর নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার মাত্র কিছুদিন আগে জার্মান বিজ্ঞানী অটো হান, লিসা মেইটনার, এবং ফ্রিৎজ স্ট্রাসমান নিউক্লিয়ার ফিশান পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। লিসা মেইটনার এবং অটো হান দুজনই ছিলেন বার্লিনের কাইজার উইলহেলম ইন্সটিটিউটের প্রফেসর। লিসা পদার্থবিজ্ঞানের, আর অটো রসায়নের। তাঁদের সমন্বিত গবেষণা চলছিলো অনেক বছর থেকে। ১৯১৮ সালে তাঁরা ভারী মৌল প্রোট্যাকটিনিয়াম আবিষ্কার করেছেন। ১৯৩৪ সালে তাঁরা যৌথভাবে শুরু করেছিলেন নিউক্লিয়ার ফিশানের গবেষণা। কিন্তু হিটলার ক্ষমতায় আসার পর লিসাকে তাঁর পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। কিছুদিন পর লিসাকে জার্মানি থেকে পালিয়ে যেতে হয়। তরুণ রসায়নবিদ স্ট্রসম্যান যোগ দেন অটো হানের সাথে নিউক্লিয়ার ফিশানের গবেষণায়। ১৯৩৯ সালে ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসে নিউট্রন প্রবেশ করিয়ে তারা দুটো হালকা মৌলের সাথে আরো নিউট্রন বেরিয়ে আসা শনাক্ত করেন। সেই নিউট্রন আবার ইউরেনিয়ামের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে চেইন রিঅ্যাকশন তৈরি করে। এই ফিশান পদ্ধতিতে প্রচুর শক্তি নির্গত হয়। ফার্মিসহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরা নিউক্লিয়ার শক্তির বিপুল সম্ভাবনা দেখলেন আইনস্টাইনের E = mc2 সমীকরণের এই বাস্তব রূপ থেকে।  

আইনস্টাইনের বয়স তখন ষাটের উপর। তিনি এসব গবেষণার খুব একটা খবর রাখেননি। তিনি ব্যস্ত পৃথিবীর রাজনৈতিক অস্থিরতায় কিভাবে শান্তির পক্ষে কাজ করা যায় সেসব নিয়ে।

ফিশান প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হবার সাথে সাথে নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানীদের মধ্যে উৎসাহের জোয়ার বয়ে গেল। লিও শিলার্ড এবং এনরিকো ফার্মি নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটরের প্রথম ডিজাইন তৈরি করে ফেললেন। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন, নিউক্লিয়ার চেইন রিঅ্যাকশান থেকে পারমাণবিক বোমা তৈরি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। এসময় হিটলারের বাহিনি যদি পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলতে সক্ষম হয় তাহলে পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলবে। তাদেরকে থামানোর জন্য হলেও আমেরিকার উচিত পারমাণবিক বোমা তৈরির ব্যাপারে উদ্যোগী হবার। লিও শিলার্ড পরামর্শ করলেন ইউজিন উইগনার এবং এডোয়ার্ড টেলারের সাথে। ঠিক হলো তাঁরা আইনস্টাইনকে রাজি করাবেন জার্মানিকে বোমা তৈরির কাজে কীভাবে বাধা দেয়া যায়, আর আমেরিকাকে কীভাবে বোমা তৈরিতে রাজি করানো যায় সে ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে।

১৯৩৯ সালের গ্রীষ্মকালে আইনস্টাইন ছুটি কাটাচ্ছিলেন লং আইল্যান্ডে এক বন্ধুর বাসায়। লিও শিলার্ড এবং ইউজিন উইগনার গেলেন সেখানে। তাঁরা আইনস্টাইনকে বোঝালেন নিউক্লিয়ার ফিশানের অগ্রগতির কথা এবং জার্মানির হাতে তার সম্ভাব্য অপপ্রয়োগের সম্ভাবনার কথা। আইনস্টাইন খুব কম সময়ের মধ্যেই বুঝে গেলেন কী হতে চলেছে। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল আইনস্টাইন বেলজিয়ামের রানিকে চিঠি লিখবেন যেন রানি বেলজিয়ান কঙ্গোর ইউরেনিয়াম জার্মানির কাছে বিক্রি না করে। বেলজিয়ামের রানির সাথে আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। আইনস্টাইন রাজি হয়ে গেলেন। ঠিক হলো লিও শিলার্ড চিঠির খসড়া তৈরি করে নিয়ে আসবেন। আইনস্টাইন তা দেখে স্বাক্ষর করে দেবেন। সেই চিঠি বেলজিয়ামের রানির কাছে পাঠাতে হলে তা আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে পাঠাতে হবে।


আইনস্টাইন ও লিও শিলার্ড

লিও শিলার্ড চিঠির খসড়া তৈরি করার সময় তাঁর এক বন্ধুর পরামর্শে ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লেহম্যান কর্পোরেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার শেক্‌স-এর সাথে দেখা করলেন। আলেকজান্ডার শেক্‌স এর সরাসরি যোগাযোগ আছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন রুজভেল্টের সাথে। শেক্‌স এর পরামর্শে ঠিক হলো আইনস্টাইনের চিঠিটি বেলজিয়ামের রানির বদলে সরাসরি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকেই লেখা হবে। কয়েকদিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে পাঠানো হলো আইনস্টাইনের চিঠি – যেখানে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেছেন জার্মানির আগেই যেন আমেরিকা পারমাণবিক বোমা তৈরির ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের সহযোগিতা করার জন্য সরকারিভাবে পদক্ষেপ নেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর পক্ষপাতি ছিল না। তাই ১৯৩৯ সালে আইনস্টাইনের চিঠি পাবার পরেও খুব বেশি তৎপরতা দেখায়নি আমেরিকান সরকার। লিও শিলার্ডের নিউক্লিয়ার গবেষণা চালু রাখার জন্য মাত্র ছয় হাজার ডলারের একটি গ্রান্ট দেয়া হয়েছিল। অবশ্য পরে আরো পঞ্চাশ হাজার ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করার পর আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৪২ সালের শুরুতে আইনস্টাইন আরেকটি চিঠি লেখেন আমেরিকার ইউরেনিয়াম কমিটির কাছে – বোমা তৈরির তৎপরতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে।

১৯৪২ সালের ১৩ আগস্ট সরকারিভাবে গঠন করা হয় ‘ম্যানহ্যাটন প্রজেক্ট’ – যা ছিল খুবই গোপনীয় উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন সামরিক এবং বৈজ্ঞানিক প্রকল্প – যার মূল উদ্দেশ্য পারমাণবিক বোমা তৈরি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট আইনস্টাইনের চিঠিকে গুরুত্ব দিয়ে এত বড় একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছিলেন, যে প্রকল্পে সেই ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ এর মধ্যে খরচ হয়েছিল সেই সময়ের দুই বিলিয়ন ডলার (যার বর্তমান মূল্যমান প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার)। সেই প্রকল্পে তদানীন্তন সব বড় বড় পদার্থবিজ্ঞানী কাজ করলেও আইনস্টাইনকে প্রকল্প থেকে সম্পূর্ণ দূরে রাখা হয়েছিল। এই প্রকল্পের সামরিক পরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল লেসলি গ্রোভস এবং বৈজ্ঞানিক পরিচালক ছিলেন রবার্ট ওপেনহেইমার। ওপেনহেইমার আমেরিকার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় তরুণ বিজ্ঞানীদের নিয়োগ দিয়েছিলেন এই প্রকল্পে। পরবর্তীতে এই প্রকল্পের ষোলজন বিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পান নিজ নিজ ক্ষেত্রে।


রবার্ট ওপেনহেইমার


ম্যানহ্যাটন প্রকল্প ছিল অত্যন্ত জটিল এবং অনেকগুলি সমান্তরাল প্রকল্পের সমষ্টি। এই প্রকল্পের  বেশিরভাগ কাজ আমেরিকায় হলেও বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক কাজ সম্পন্ন হয়েছিল যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং ফ্রান্সে।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এনরিকো ফার্মির তত্ত্বাবধানে নিউক্লিয়ার গবেষণার মূলকাজ সম্পন্ন হয়। লিও শিলার্ড, উইগনার এবং আরো অনেক পদার্থবিজ্ঞানী এখানে ইউরেনিয়ামের প্রথম নিয়ন্ত্রিত চেইন রিআকশান তৈরি করেন এবং পুরো প্রক্রিয়ার প্রত্যেকটি ধাপের তত্ত্বীয় হিসাব এবং ব্যবহারিক প্রয়োগের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেন।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে ক্যাম্পাসে আর্নেস্ট লরেন্সের তত্ত্বাবধানে ইউরেনিয়াম-২৩৫ আলাদা করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়। পরে সেই উদ্ভাবিত পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ইউরেনিয়াম-২৩৫ উৎপাদনের জন্য টেনেসির ওক রিজে কারখানা তৈরি করা হয় ১৯৪৩ সালে।


ম্যানহ্যাটন প্রজেক্টের মানবী-কম্পিউটার

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসোটোপ আলাদা করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়। নিউ মেক্সিকোর লস আলামোসে গবেষণাগার স্থাপন করা হয় রবার্ট ওপেনহেইমারের তত্ত্বাবধানে পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য।

১৯৪৫ সালের জুলাই মাসের শুরুতেই প্রথম প্লুটোনিয়াম পারমাণবিক বোমা তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়। লস আলামোস থেকে সাড়ে তিনশ কিলোমিটার দূরে নিউ মেক্সিকোর মরুভূমির আলামাগোরডো নামে এক জনমানবহীন প্রান্তরে ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই ভোরে পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটানো হয় বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমা। সূচনা হয় পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহ যুগের।


এখানেই বিস্ফোরিত হয়েছিল প্রথম পারমাণবিক বোমা। ট্রিনিটি পয়েন্টে লেখক (২০০২)


এর তিন সপ্তাহ পরেই ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা শহরে নিক্ষেপ করা হয় সাড়ে চার টন ভরের প্রথম ইউরেনিয়াম বোমা – যার নাম দেয়া হয়েছিল লিটল বয়। তার তিন দিন পর নাগাসাকি শহরে ফেলা হয় প্রায় পাঁচ টন ভরের প্লুটোনিয়াম বোমা – ফ্যাটম্যান।

নিউক্লিয়ার বোমার ভয়াবহতা দেখেছে বিশ্ববাসী। এরপর আরো অনেক দেশ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে মজুদ করেছে। বিশ্ববাসীকে ভয় দেখাচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপের। অনেকগুলি সংগঠন কাজ করে চলেছে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে।

নিউক্লিয়ার শক্তিকে ধ্বংসের বদলে দরকারি কাজে লাগানোর কাজ শুরু হয়েছে সেই ১৯৫০ সাল থেকেই। বিদ্যুৎ তৈরির লক্ষ্যে পৃথিবীর প্রথম নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর চালু হয়েছিল আমেরিকার আইডাহোতে ১৯৫১ সালের ডিসেম্বরে। বর্তমানে সারা বিশ্বের মোট শক্তির চাহিদার শতকরা দশ ভাগ মেটানোর পাশাপাশি নিউক্লিয়ার শক্তি আরো ব্যবহৃত হচ্ছে অসংখ্য সাবমেরিনে, মহাকাশে পাঠানো স্যাটেলাইটে, এবং ক্যান্সার চিকিৎসার রেডিও-আইসোটোপ হিসেবে।

নিউক্লিয়ার শক্তির অনেক সুফল থাকা সত্ত্বেও নিউক্লিয়ার শক্তির প্রতি মানুষের এক ধরনের ভয় এখনো কাজ করে – কারণ এর শুরুটা হয়েছিল ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে। পৃথিবী থেকে পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রকল্প যতদিন সম্পূর্ণ বন্ধ না হবে, ততদিন এই ভয় থেকে আমাদের মুক্তি নেই।

 

তথ্যসূত্র:

১। রজার টিলব্রুক, আরলি হিস্ট্রি অব নিউক্লিয়ার এনার্জি, নিক্লিয়ার এনার্জি এনসাইক্লোপিডিয়া, ২০১১।

২। জেমস মাহাফেই, অ্যাটমিক অ্যাওইকেনিং, পেগাসাস বুক্‌স, নিউইয়র্ক, ২০০৯।

৩। সিলভান শোয়েবার, আইনস্টাইন অ্যান্ড নিউক্লিয়ার ওয়েপন্‌স, আইনস্টাইন ফর দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৮।

৪। স্টিফেইন গ্রাউয়েফ, ম্যানহ্যাটন প্রজেক্ট, লিটন ব্রাউন বস্টন, ২০০০।

৫। ক্রেইগ নেলসন, দি এজ অব র‍্যাডিয়েন্স, স্ক্রাইবনার, নিউইয়র্ক, ২০১৪।

৬। জে এস কিড ও রেনে এ কিড, নিউক্লিয়ার পাওয়ার, কেলসার হাউজ, নিউইয়র্ক, ২০০৬।

___________________

বিজ্ঞানচিন্তা মে ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত









Latest Post

সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু - ১৫ আগস্ট ২০২৪

  শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শোচনীয় মৃত্যু ঘটেছে ৫ আগস্ট ২০২৪। কীভাবে কী হয়েছে তার নানারকম চুলচেরা বিশ্লেষণ আমরা পাচ্ছি এবং পেতেই থাক...

Popular Posts