মনে মনে সময়-ভ্রমণ বা টাইম ট্রাভেল আমরা সবাই করি। অতীতের
স্মৃতি রোমন্থন, ভবিষ্যতের স্বপ্ন, ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার পূনর্বিন্যাস করে ফলাফল বদলে
দেয়ার প্রবল আকাঙ্খা – এর সবকিছুই আসলে সময়-ভ্রমণেরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ। কিন্তু কল্পনায়
আমরা যা করতে পারি তার সবকিছুই কি বাস্তবে করা সম্ভব? বাস্তবে টাইম ট্রাভেল কতটা সম্ভব
বা আদৌ সম্ভব কী না সেটাই আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে টাইম ট্রাভেল আমরা হরহামেশাই দেখতে
পাই। তারও আগে মানুষের কল্পনায় যখন বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নানারকমের লোককাহিনি
রচিত হয়েছে সেখানেও সময়-ভ্রমণের ব্যাপারটি এসেছে নানাভাবে। জাপানের লোককাহিনিতে উরাশিমা
তারো নামে এক জেলে গভীর সমুদ্রে এক কচ্ছপের প্রাণ বাঁচায়। সেই কচ্ছপটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের
জন্য উরাশিমাকে নিয়ে যায় সমুদ্রের নিচে এক প্রাসাদে। সেখানে কয়েকদিন আরাম-আয়েশে কাটিয়ে
যখন সমুদ্রের উপরে ভেসে উঠে তখন উরাশিমা দেখতে পায় ইতোমধ্যে অনেক বছর কেটে গেছে পৃথিবীতে।
হাজার বছর আগের এই কল্পকাহিনিই যেন ফিরে এসেছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বে।
আমরা জানি ১৮৯৫ সালে এইচ জি ওয়েল্স এর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি
‘টাইম মেশিন’ প্রকাশিত হবার পর থেকে বিজ্ঞানীরাও গবেষণা করতে শুরু করেছেন টাইম-ট্রাভেলের
সম্ভাবনা নিয়ে। সাহিত্যে টাইম ট্রাভেল এসেছে এইচ জি ওয়েল্স এরও আগে। আমেরিকান লেখক
ওয়াশিংটন ইরভিং-এর গল্প রিপ ভ্যান উইঙ্ক্যাল
প্রকাশিত হয়েছিল ১৮১৯ সালে। সেখানে আমরা দেখেছি রিপ ভ্যান উইঙ্ক্যাল এক ঘুমেই কাটিয়ে
দেয় বিশ বছর। টাইম ট্রাভেলে সে বিশ বছর পরের পৃথিবীতে চলে গিয়েছে সেই গল্পে। ১৮৪৩ সালে
চার্লস ডিকেন্সও টাইম ট্রাভেল সম্পর্কিত গল্প রচনা করেছেন “এ ক্রিস্টমাস ক্যারোল”।
তবে এইচ জি ওয়েল্স এর “টাইম মেশিন” টাইম ট্রাভেলের গল্পে বাস্তবতার সম্ভাবনা উস্কে
দেয়ার পর থেকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে মহাজাগতিক সময়-ভ্রমণের পালে বাতাস লাগে। বিংশ
শতাব্দীতে অসংখ্য গল্প উপন্যাস সিনেমা তৈরি হতে থাকে টাইম ট্রাভেলকে গুরুত্ব দিয়ে।
পদার্থবিজ্ঞানে টাইম ট্রাভেলের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণার শুরুটা
হয়েছে আইনস্টাইনকে দিয়ে বিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুর দশক থেকে। দেখা যাক পদার্থবিজ্ঞানের
কোন্ কোন্ তত্ত্ব টাইম ট্রাভেলকে সমর্থন করে।
টাইম ট্রাভেল সমর্থক তত্ত্বগুলি
আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব (স্পেশাল থিওরি)
এবং সার্বিক তত্ত্ব (জেনারেল থিওরি) দুটোই কোনো না কোনোভাবে টাইম ট্রাভেলকে সমর্থন
করে। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুসারে সময় পর্যবেক্ষকের গতির উপর নির্ভরশীল। কেউ যদি
প্রচন্ড বেগে ছুটতে থাকে (আলোর বেগের কাছাকাছি বেগ) তাহলে তার সময় কাটবে অত্যন্ত ধীরে।
এই ব্যাপারটাকে আমরা টাইম ডাইলেশান বা সময় প্রসারণ বলে জানি। সময় প্রসারণে সময় দীর্ঘায়িত
হয় – অর্থাৎ যদি আমরা পৃথিবীতে স্থির অবস্থায় সময় মাপি তাহলে এক সেকেন্ডে এক সেকেন্ড
হয়। কিন্তু সময় পর্যবেক্ষকের গতি যখন বাড়তে থাকে – তখন এক সেকেন্ড আর এক সেকেন্ডে হয়
না। অনেক দীর্ঘ সময় নিয়ে তখন এক সেকেন্ড হয়। উদাহরণ হিসেবে দেয়া যায় – কোনো নভোচারী
যদি আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে কোন নভোযানে চড়ে এক বছর মহাকাশে কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরে
আসেন, তাহলে দেখা যাবে পৃথিবীর মানুষের বয়স তার তুলনায় অনেক বছর বেড়ে গেছে। যেহেতু
তার সময় কেটেছে অত্যন্ত ধীরে – তার এক বছর সময় হয়ে যায় পৃথিবীর বহু বছর সময়ের সমান।
এখানে নভোচারী মহাকাশ থেকে যখন পৃথিবীতে ফিরে আসছে – তখন সেই পৃথিবী তার কাছে ভবিষ্যতের
পৃথিবী।
আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বে যখন মহাকর্ষ আর ত্বরণ অন্তর্ভুক্ত
হলো – তখন দেখা গেলো সময়ের আর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকলো না। সময় জুড়ে গেলো স্থানের
সাথে। শুরু হলো স্পেস-টাইম বা স্থান-কালের সমন্বিত রূপ। গ্রাভিটি বা অভিকর্ষ যখন বাড়তে
থাকে তখন স্থান-কালের বক্রতা বেড়ে যায়, অর্থাৎ তখন সেখানে সময় দীর্ঘায়িত হয়। এই ঘটনাকে
গ্রাভিটেশনাল টাইম ডাইলেশান বা মহাকর্ষজ সময় প্রসারণ বলা হয়। মহাকর্ষ ক্ষেত্রবলের পরিমাণ
যেখানে বেশি সেখানে সময় ধীরে চলে। ব্ল্যাকহোলের কাছে মহাকর্ষ ক্ষেত্রবলের পরিমাণ অত্যন্ত
বেশি। সেখানে সময় এতটাই ধীরে চলবে যে তার তুলনায় দূরের কোন নক্ষত্রের সময় বয়ে যাবে
এত বেশি যে সেখানকার বর্তমান থেকে মনে হবে দূরের নক্ষত্র চলে গেছে সুদূর ভবিষ্যতে।
ওয়ার্মহোল তত্ত্ব
স্পেস-টাইম বা স্থান-কালের বক্রতার ভেতর দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের
মধ্যে “বৈজ্ঞানিক সেতু” তৈরি করার প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন আইনস্টাইন নিজেই তাঁর সহযোগী
গবেষক নাথান রোজেনের সাথে ১৯৩৫ সালে এক গবেষণাপত্রে। আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের
সমীকরণগুলির সমাধান হিসেবে তাঁরা সুড়ঙ্গ আকৃতির কাঠামোর ধারণা দেন যার ভেতর দিয়ে স্থান-কালের
বক্রতার বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন সম্ভব। স্থান-কালের বক্রতার এই বিভিন্ন অংশ
মহাকর্ষজ সময় প্রসারণের কারণে অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ যে কোনোটাই হতে পারে। পরবর্তীতে এই
কাঠামো “আইনস্টাইন-রোজেন” ব্রিজ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
১৯৫০-এর দশকে আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী জন হুইলার “ওয়ার্মহোল”
শব্দটির প্রচলন করেন। মাটির নিচে পোকারা যেমন করে সুড়ঙ্গ তৈরি করে তার অনুকরণে আইনস্টাইন-রোজেন
ব্রিজেরই অন্য নাম “ওয়ার্মহোল”। জন হুইলার তত্ত্বীয়ভাবে প্রমাণ করেন যে কোয়ান্টাম লেভেলে
ক্ষুদ্রাকৃতির ওয়ার্মহোল থাকতে পারে। এরপর অবশ্য ওয়ার্মহোল সংক্রান্ত খুব বেশি গবেষণা
হয়নি।
১৯৮৮ সালে ক্যালটেকের পদার্থবিজ্ঞানী কিপ থর্ন (২০১৭ সালে
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী) এবং তাঁর ছাত্র মাইকেল মরিস টাইম ট্রাভেল সংক্রান্ত গবেষণায়
ওয়ার্মহোলের ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। থর্ন ও মরিসের ওয়ার্মহোলের
সাথে আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজের বেশ কিছু পার্থক্য
আছে। তাঁরা দেখান যে ওয়ার্মহোলের মধ্য দিয়ে টাইম ট্রাভেল করতে হলে প্রচলিত পদার্থের
চেয়ে আলাদা এক বিশেষ ধরনের পদার্থের দরকার হবে যাদের শক্তির ঘনত্ব হবে ঋণাত্মক। অর্থাৎ
এই পদার্থগুলির প্রতি একক আয়তনের গড় শক্তি হবে শূন্যের চেয়ে কম। তত্ত্বীয়ভাবে এটা সম্ভব
হলেও বাস্তবে ঋণাত্মক শক্তি উৎপাদন করা খুব সহজ নয়। কিন্তু ওয়ার্মহোলের মুখ খোলা রাখার
জন্য ঋণাত্মক শক্তি-ঘনত্ব ছাড়া গাণিতিকভাবে আর কোন উপায় নেই। মহাকর্ষ বলের আকর্ষণে
স্পেস-টাইমের ভেতরের ওয়ার্মহোল দুমড়ে-মুচড়ে সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু
সুড়ঙ্গ দিয়ে টাইম-ট্রাভেল করতে হলে সুড়ঙ্গের দুটো মুখই খোলা থাকতে হবে। ঋণাত্মক শক্তি-ঘনত্ব মহাকর্ষ বলের বিপরীত বল অর্থাৎ
বিকর্ষণ মহাকর্ষ বল উৎপন্ন করে ওয়ার্মহোলের মুখ খোলা রাখতে পারে।
ঋণাত্মক শক্তি-ঘনত্ব পাওয়া কঠিন হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। ১৯৪৮ সালে নেদারল্যান্ডের
পদার্থবিজ্ঞানী হেনড্রিক ক্যাসিমির তড়িৎচুম্বক বলের একটি বিশেষ প্রভাব আবিষ্কার করেন।
তাঁর নামানুসারে এই প্রভাবের নাম হয় ক্যাসিমির ইফেক্ট। শূন্যস্থানে দুটো পাতলা ধাতব
পাত যাদের কারো ভেতরই কোন চার্জ নেই – পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা করে রেখে দিলে তাদের
ভেতর কোন পারস্পরিক আকর্ষণ কাজ করার কথা নয়। কিন্তু দেখা যায় চুম্বকীয় পদার্থ না হওয়া
সত্ত্বেও তাদের ভেতর আকর্ষণ বলের সৃষ্টি হয়। ক্যাসিমির ধারণা দেন শূন্যস্থানের ক্ষেত্রবলের
সূক্ষ্ম পরিবর্তন বা ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশানের কারণে এই আকর্ষণ বলের সৃষ্টি হচ্ছে।
পরবর্তী গবেষণা থেকে দেখা গেছে ক্যাসিমির ইফেক্টের ফলে সেখানে শক্তি-ঘনত্ব ঋণাত্মক
হয়।
কিন্তু ওয়ার্মহোলের মুখ খোলা থাকলেই যে সেখান দিয়ে অনায়াসে
অতীত থেকে ভবিষ্যতে টাইম-ট্রাভেল করা যাবে এমন নয়। এরকম টাইম ট্রাভেল করতে হলে ওয়ার্মহোলের
এক মুখ থেকে অন্য মুখে যাওয়ার গতি হতে হবে আলোর গতির কাছাকাছি। মানুষের পক্ষে এরকম
গতি অর্জন করা সহজসাধ্য নয়।
কসমিক স্ট্রিং বা মহাজাগতিক সূতা
টাইম ট্রাভেল সমর্থক আরেকটি তত্ত্ব হলো কাল্পনিক কসমিক স্ট্রিং
বা মহাজাগতিক সূতা। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন মহাবিশ্বের উৎপত্তির শুরুতে মহাবিশ্বের
তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে যে ফেইজ ট্রানজিশান বা দশার পরিবর্তন হয়েছে (তরল থেকে কঠিনে
পরিবর্তন) তাতে কিছু ব্যতিক্রমী কসমিক স্ট্রিং তৈরি হতে পারে। এগুলোকে স্থান-কালের
খুঁত বলে ধরে নিলেও এদের ঘনত্ব সাংঘাতিকভাবে বেশি। ফলে এদের বিপুল মহাকর্ষ বলের প্রভাবে
মহাবিশ্বের স্পেস-টাইম এতটাই বেঁকে যায় যে অতীত ও ভবিষ্যৎ খুবই কাছাকাছি চলে আসতে পারে।
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জন রিচার্ড গট স্পেস-টাইমের এরকম একটি অবস্থার নাম
দেন ‘ক্লোজড টাইমলিংক কার্ভ’ যেখানে দুটো কসমিক স্ট্রিং পরস্পরকে কোন এক জায়গায় অতিক্রম
করে চলে যায় – তখন অতিক্রান্ত বিন্দুতে টাইম-লিংক বা সময়-সংযোগ ঘটে। সেখানে স্পেস-টাইমের
বক্রতা এমন হয়ে যায় যে অতীত ও ভবিষ্যতের সংযোগ ঘটে যায়। কিন্তু এসবের সবকিছুই এখনো
তত্ত্বতেই সীমাবদ্ধ।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কিন্তু ব্যতিক্রমী ধারণা থেকেও টাইম
ট্রাভেলের কিছুটা সমর্থন পাওয়া যায়। কোয়ান্টাম এনট্যাংগেলমেন্ট বা কোয়ান্টামের জটাজালের
ধারণায় আছে একটি কোয়ান্টাম কণা আরেকটি কোয়ান্টাম কণার সাথে অদৃশ্যভাবে বাঁধাপড়ে থাকে।
তাদের মধ্যকার দূরত্ব কিংবা অবস্থান কিংবা সময় কোনোকিছুই এই বন্ধনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়
না। সেক্ষেত্রে সমান্তরাল মহাবিশ্বে সমান্তরাল সময়-প্রবাহ সম্ভব। অর্থাৎ একই সময়ে কোন
মহাবিশ্বে যা বর্তমান, তা অন্য কোনো মহাবিশ্বে অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ। আবার কোয়ান্টাম
মেকানিক্স ও জেনারেল রিলেটিভিটির সমন্বয়ে যে কোয়ান্টাম গ্রাভিটির তত্ত্ব তৈরি হচ্ছে
– সেখানেও খুব ক্ষুদ্র মাত্রায় অত্যন্ত জটিল কিছু পরিবর্তন স্পেস-টাইমে ঘটতে পারে যেখানে
টাইম ট্রাভেল তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব হতে পারে।
তত্ত্ব ও বাস্তবতার পার্থক্য
কিন্তু টাইম ট্রাভেল সমর্থক তত্ত্বগুলির বাস্তব প্রয়োগে নানারকমের
সমস্যা দেখা যায়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যুক্তির অসামঞ্জস্যতার ফলে তৈরি হওয়া প্যারাডক্স।
টাইম ট্রাভেল সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় প্যারাডক্স হলো – গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স। ধরা
যাক কোন এক ব্যক্তি অতীতে গিয়ে তার বাবার জন্মের আগেই তার বাবার বাবাকে খুন করে ফেললো।
সেক্ষেত্রে তার বাবার জন্ম নেয়ার কোন সম্ভাবনাই আর থাকলো না। তার বাবার জন্মই যদি হতে
না পারে – তাহলে তার জন্ম হওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। সেক্ষেত্রে তার যদি জন্মই না হয়
– তাহলে সে অতীতে গেলো কীভাবে?
আমেরিকান তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী জোসেফ পলচিনস্কি একটি ঘটনা
কল্পনা করেছেন এভাবে: একটি বিলিয়ার্ড বলকে ওয়ার্মহোলের মধ্য দিয়ে পাঠানো হলো অতীতে
যেখানে সে আগে ছিল। সেখানে গিয়ে সে তার নিজের সাথেই ধাক্কা খেলো- ফলে সে আর ওয়ার্মহোলে
ঢুকতে পারলো না। সে যদি ওয়ার্মহোলে ঢুকতেই না পারে তাহলে ওয়ার্মহোল দিয়ে সে অতীতে কীভাবে
গেলো? এই প্যারাডক্স পলচিনস্কির প্যারাডক্স হিসেবে পরিচিত।
এধরনের আরো অনেক প্যারাডক্স আছে টাইম ট্রাভেল সংক্রান্ত যেখানে
যুক্তির জট লেগে যায়। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং টাইম ট্রাভেল সংক্রান্ত এরকম প্যারাডক্স
ঘটার সম্ভাবনা বাতিল করার জন্য তত্ত্ব দিয়েছেন যে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলি মাইক্রোস্কোপিক
পর্যায়ে সীমিত পরিসরে টাইম ট্রাভেল সমর্থন করলেও ম্যাক্রোস্কোপিক পর্যায়ে টাইম-ট্রাভেল
সমর্থন করে না। সেক্ষেত্রে কোন মানুষের পক্ষে অতীতে গিয়ে তার বাবার বাবাকে মেরে ফেলা
তো দূরের কথা, অতীতে যাওয়াও অসম্ভব। আরো সোজাসোজি বললে বলা যায় – টাইম ট্রাভেল করে
ঘটনার ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বদলে দেয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
শুধু প্যারাডক্সের কারণে নয়, আরো অনেকগুলি ব্যবহারিক সমস্যা
আছে টাইম ট্রাভেল তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগে। স্থান-কালের বক্রতার ভেতর দিয়ে টাইম-ট্রাভেল
ঘটার জন্য ভ্রমণকারীর গতি হতে হবে আলোর গতির কাছাকাছি। কিন্তু আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে
পৌঁছা এবং সেই গতিতে ছুটে চলার জন্য যে শক্তি এবং প্রযুক্তি দরকার তা প্রচলিত পদ্ধতিতে
অর্জন করা অসম্ভব। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুসারে কোন বস্তু যদি আলোর
গতির কাছাকাছি গতিতে পৌঁছায় তার আপেক্ষিক ভর অসীম হয়ে যায়, যার জন্য দরকার হয় অসীম
পরিমাণ শক্তি। কোন পদার্থের পক্ষেই অসীম শক্তি অর্জন করা সম্ভব নয়।
কসমিক স্ট্রিং-এর সম্ভাবনার কথা যদি ধরি তাহলে দেখা যাচ্ছে
টাইম ট্রাভেলারকে যেতে হবে প্রচন্ড শক্তির মহাকর্ষক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে। এধরনের অতিউচ্চমাত্রার
মহাকর্ষক্ষেত্রে – যেমন ব্ল্যাকহোলের আশেপাশে – কোন মহাকাশযান কিংবা ভ্রমণকারীর পক্ষেই
যাওয়া সম্ভব নয়, কিংবা পৌঁছালেও অক্ষত থাকার কথা নয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে আমাদের প্রচলিত মহাবিশ্বের প্রচলিত প্রযুক্তির
সাহায্যে প্রকৃত অর্থে টাইম-ট্রাভেল সম্ভব
নয়।
ভিন্ন মাত্রার মহাবিশ্বে টাইম-ট্রাভেল
তবে কি অন্য কোন মাত্রার ভিন্ন কোন মহাবিশ্বে টাইম ট্রাভেল
সম্ভব? স্ট্রিং থিওরি এবং এম থিওরির সমর্থক
বিজ্ঞানীরা গাণিতিকভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে এগারো মাত্রার মহাবিশ্বে প্রচলিত তিন
মাত্রার অতিরিক্ত মাত্রাগুলি এমনভাবে ভাঁজ করা থাকে যে সেখান দিয়ে টাইম-ট্রাভেল সম্ভব
হতেও পারে। কিন্তু স্ট্রিং থিওরি কিংবা এম-থিওরির এখনো কোন বাস্তবিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সুতরাং সেখানকার ট্রাইম ট্রাভেলের তত্ত্ব শুধুমাত্রই তাত্ত্বিক সম্ভাবনা।
মাল্টিভার্স কিংবা সমান্তরাল মহাবিশ্বের ধারণাতেও টাইম ট্রাভেলের
সম্ভাবনা আছে। সেখানে প্রচলিত পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলি একক মহাবিশ্বে যেভাবে প্রযোজ্য
হয় সেভাবে প্রয়োগ করা যাবে না। সেখানে দরকার হবে নতুন তত্ত্ব, নতুন সমীকরণ। সেসব নতুন
সমীকরণে টাইম ট্রাভেল ঘটতে পারে এক মহাবিশ্ব থেকে অন্য মহাবিশ্বে। কিন্তু সেসব এখনও
কাল্পনিক তত্ত্ব।
তবে প্রচলিত ত্রিমাত্রিক মহাবিশ্বের সাথে সময়ের মাত্রা যোগ
করে আইনস্টাইন যখন চতুর্থ মাত্রার মহাবিশ্বের গাণিতিক সমীকরণগুলি প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন
– তখন ১৯২৬ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী থিওডর কালুজা এবং সুইডিশ পদার্থবিজ্ঞানী অস্কার
ক্লেইন মহাকর্ষ এবং তড়িতচুম্বকত্বকে সমন্বয় করার প্রয়াসে পঞ্চম মাত্রার ধারণা দেন যা
কালুজা-ক্লেইন থিওরি নামে পরিচিত। এই তত্ত্ব যদি ব্যবহারিকভাবে সঠিক হয়, তাহলে হয়তো
টাইম-ট্রাভেল সম্ভব হলেও হতে পারে।
১৯৪৯ সালে অস্ট্রিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী কুর্ট গুডেল আইনস্টাইনের
ক্ষেত্র সমীকরণের একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধান দেন। যেখানে তিনি একটি ঘূর্ণায়মান মহাবিশ্বের
গাণিতিক ধারণা দেন। এধরনের মহাবিশ্বে বদ্ধ স্থান-কালের কিছু অংশে দেখা যায় স্থান-কালের
বক্রতা চক্রাকারে সামনে গিয়ে আবার পেছনের দিকে এসে মিশেছে। এর অর্থ হতে পারে ভবিষ্যৎ
এসে মিশেছে অতীতের সাথে। অর্থাৎ ঘূর্ণায়মান মহাবিশ্বের স্থান-কালের বক্রতায় টাইম-ট্রাভেল
সম্ভব।
কিন্তু এই গাণিতিক তত্ত্বগুলি সঠিক হলেও তার বাস্তবায়নের
জন্যও আলোর কাছাকাছি গতি এবং প্রচন্ড মহাকর্ষ-ক্ষেত্রের দরকার যার কোনটিতেই ভ্রমণকারীর
টিকে থাকা অসম্ভব তা আমরা আগেই দেখেছি।
তাহলে আমরা কী সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছলাম? টাইম ট্রাভেল কি সম্ভব?
এক্ষেত্রে সম্ভাবনাকে আমরা তিনটি পর্যায়ে বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি - লজিক্যালি: যৌক্তিকভাবে সম্ভব কি না, ফিজিক্যালি:
ভৌতভাবে সম্ভব কি না, এবং প্র্যাকটিক্যা্লি: ব্যবহারিকভাবে সম্ভব কি না। লজিক্যালি
ব্যাপারটি তখনই সম্ভব যখন যৌক্তিকভাবে কোন অসামঞ্জস্যতা বা প্যারাডক্স ধরা না পড়ে।
কিন্তু টাইম ট্রাভেলের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের প্যারাডক্স বর্তমান। সেক্ষেত্রে যৌক্তিকভাবে
টাইম ট্রাভেল অসম্ভব।
কোনকিছু আমরা ফিজিক্যালি সম্ভব তখনই বলবো যখন প্রচলিত ভৌতধর্মের
কোন বিচ্যুতি না ঘটে। আমরা দেখেছি পদার্থবিজ্ঞানের কিছু বিশেষ বিশেষ তত্ত্বে টাইম ট্রাভেল
সম্ভব। তাই বলা যায় টাইম ট্রাভেল ফিজিক্যালি অসম্ভব নয়।
কিন্তু প্র্যাক্টিক্যালি বা ব্যবহারিকভাবে টাইম-ট্রাভেল কি
সম্ভব? আমরা দেখলাম টাইম ট্রাভেলের জন্য প্রয়োজন আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে ছুটে চলা,
যা কোন মানুষের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। আবার তীব্র মহাকর্ষ ক্ষেত্রে টিকে থাকার সম্ভাবনাও
মানুষের নেই। তাই আমাদের পরিচিত প্রাত্যাহিক পৃথিবীতে টাইম ট্রাভেল প্র্যাক্টিক্যালি
অসম্ভব।
তথ্যসূত্র:
১। স্টিফেন হকিং, এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম, ২য় সংস্করণ,
ব্যান্টাম প্রেস, আমেরিকা, ১৯৯৬।
২। অ্যাড্রিয়ান বার্ডন, এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব দ্য ফিলোসফি
অব টাইম, ২য় সংস্করণ, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০২৪।
৩। সারা স্কোলিস, ইজ টাইম ট্রাভেল পসিবল?সায়েন্টিফিক আমেরিকান,
এপ্রিল ২৬, ২০২৩।
৪। জেমস গ্লেইক, টাইম ট্রাভেল এ হিস্ট্রি, প্যান্থিয়ন বুক্স
নিউইয়র্ক, ২০১৬।
৫। ব্রায়ান ক্লেগ, বিল্ড ইওর ওউন টাইম মেশিন, ডাকওয়ার্থ ওভারলুক,
লন্ডন, ২০১১।
বিজ্ঞানচিন্তা আগস্ট ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment