Saturday, 4 January 2025

তাহার নামটি অঞ্জনা

 


অঞ্জনা অভিনীত যে সিনেমাটি আমি প্রথম দেখেছিলাম তার নাম ‘সুখের সংসার’। নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ভীষণ মেলোড্রামাটিক সিনেমা। তখন আমি সবেমাত্র বাঁশখালির অজপাড়া থেকে মহকুমা শহর পটিয়ায় এসে সেখানকার মডেল হাইস্কুলে ক্লাস টেনে ভর্তি হয়েছি। পটিয়াতে একটি সিনেমা হল আছে – শুধুমাত্র এই কারণেই পটিয়াকে নির্দ্বিধায় শহর বলে মেনে নিয়েছি। হাতে কোনরকমে পাঁচ টাকা জমলেই তৃতীয় শ্রেণির টিকেট কেটে সিনেমা হলে ঢুকে পড়া যেতো। শুধুমাত্র পুরনো সিনেমাগুলিই সেই হলে মুক্তি পেতো – তাতে আমার কোনো সমস্যা ছিল না। কারণ আগে না দেখা যেকোনো সিনেমাই আমার কাছে নতুন এবং আকর্ষণীয়। সেই সময় আমি যে মনযোগ দিয়ে সিনেমা দেখতাম – অত মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া করলে জীবনটা অন্যরকম হতো। সিনেমার প্রত্যেকটি সংলাপ, গান, এমনকি আবহসঙ্গীত পর্যন্ত আমার মুখস্থ হয়ে যেতো। শুধুমাত্র নায়ক-নায়িকা নয়, সিনেমার ছোট-বড় সব চরিত্রই মনে গেঁথে যেতো নাটকীয় সংলাপের কারণে। এখন যেসব সংলাপকে অতিনাটকীয় বলে মনে হয়, সেই সময় সেইসব সংলাপসর্বস্ব চরিত্রগুলোকেই আমার কাছে ভীষণ আকর্ষণীয় মনে হতো।

সেই সময় প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারে একাধিক নতুন সিনেমা মুক্তি পেতো। ঢাকায় মুক্তি পাবার পরের সপ্তাহে চট্টগ্রামের সিনেমা হলে নতুন সিনেমা আসতো। পটিয়ায় সেই সিনেমা আসতো আরো কয়েক মাস পর। সুখের সংসার দেখার জন্য ততদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। বড়ভাই তার বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখার জন্য শহরের বাসে ওঠার সময় নির্লজ্জভাবে একপ্রকার জোর করেই আমি বাসে উঠে গিয়েছিলাম। পটিয়া থেকে বাস আসতো তখন অনেক ঘুরে কালুরঘাটের ব্রিজ পার হয়ে। বহদ্দার হাট, মুরাদপুর পার হয়ে চকবাজারের গুলজার সিনেমার সামনে দিয়ে কলেজ রোড ধরে আন্দরকিল্লা চলে যেতো বাসগুলি। মনে আছে, গুলজার সিনেমার সামনে প্রায় চলন্ত বাস থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম সিনেমার টিকেট কাউন্টারে।

সুখের সংসার-এর নায়ক ফারুক এমএ পরীক্ষা দিয়ে পত্রিকার হকারি করছে। বড়লোক নায়িকা রোজিনার সাথে পরিচিত হচ্ছে তাদের বাড়িতে পেপার দিতে গিয়ে ঝগড়ার মাধ্যমে। নাটকীয়তায় ভরপুর। সেখানে অঞ্জনা ছিল ফারুকের ছোট বোন। তার বিয়ে হয় বড়লোকের ছেলে প্রবীর মিত্রের সাথে। প্রবীর মিত্র সারাক্ষণ বই পড়ে। বিয়ের পর স্ত্রীর সাথে কীভাবে কথা বলবে সে বিষয়েও সে বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করে। এত বইপড়া মানুষ এত হাবাগোবা কীভাবে হতে পারে সেই প্রশ্ন সেদিন মনেও আসেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সেই সিনেমার অনেক সংলাপ আমার এখনও মনে আছে। অঞ্জনার অভিনয় দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। অঞ্জনার অভিনয়ের প্রতি আমার মুগ্ধতা এরপর আরো যত সিনেমায় তাঁর অভিনয় দেখেছি – কোনোটাতেই কমেনি। যেকোনো চরিত্রেই অঞ্জনা তাঁর অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতেন।

প্রধান নায়িকা হিসেবেও তিনি অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। নায়করাজ রাজ্জাকের সাথেও তিনি তিরিশটির বেশি সিনেমায় নায়িকা হয়েছেন। প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দুবার জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন। তিনি যে তিন শ’র বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন সেই তথ্য আমার জানা ছিল না। আজ অঞ্জনার মৃত্যুসংবাদ পাবার পর আমার নিজের সেই কৈশোরের সিনেমা দেখার দিনগুলির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। অঞ্জনা অভিনীত অনেকগুলি চরিত্রের কথাই মনে পড়ছে। তিনি খারাপ অভিনয় করেছেন এরকম কোন চরিত্র মনে পড়ছে না। বাংলাদেশের সেরা ক্ল্যাসিক নির্মাতা আলমগীর কবীর অঞ্জনাকে নিয়ে তৈরি করেছিলেন শরৎচন্দ্রের পরিণীতা। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি পরিণীতায় ললিতার চরিত্রে অভিনয় করে। এর আগে ১৯৮১ সালেও তিনি জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন ‘গাংচিল’ সিনেমায় ‘নীলা’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য।

বাংলাদেশের সিনেমায় যাঁরা অভিনয় করতেন সেই সময়  প্রায় প্রত্যেকেই অতিঅভিনয় করতেন। সেক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হয়েছে অঞ্জনা ছিলেন অনেকটাই ব্যতিক্রম। তিনি যথাসম্ভব স্বাভাবিক অভিনয় করার চেষ্টা করতেন। অঞ্জনার অভিনয় প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন হয়েছে কি না আমি বলতে পারছি না। কারণ আমাদের দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে দীর্ঘদিন ধরে অন্যদেশের সিনেমার সাথে কোন ধরনের প্রতিযোগিতা করতে হয়নি। তারপরও ইন্ডাস্ট্রিটি ধ্বংস হয়ে গেছে। শুনেছি ২০০৮ সালের পর অঞ্জনা আর কোন সিনেমাতে অভিনয় করেননি। অভিনয় করার মতো হয়তো তেমন কোন সুযোগই ছিল না। আমাদের পরের প্রজন্মের কেউ অঞ্জনার অভিনয় দেখেছেন বলেও মনে হয় না। সুতরাং অভিনয় শিল্পী হিসেবে তিনি অমর হয়ে থাকবেন এরকম দুরাশা আমি করি না। তবে আমার মনে থাকবে তাঁর অভিনয়ের কথা।

৪ জানুয়ারি ২০২৫ অঞ্জনা মারা গেছেন। তাঁর সত্যিকারের বয়স কত হয়েছিল তা বুঝতে পারছি না। আমাদের দেশের সিনেমার নায়ক নায়িকারা কেন যেন বয়স লুকিয়ে রাখেন। উইকিপিডিয়াতে কেউ একজন লিখেছেন তাঁর জন্ম ১৯৬৫ সালের ২৭ জুন। কিন্তু সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ ১৯৭৬ সালে তিনি দস্যু বনহুর সিনেমায় সোহেল রানার বিপরীতে নায়িকা হয়েছেন। মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি নায়িকা হয়েছেন? দস্যু বনহুরে তাঁকে দেখে কিছুতেই এগারো বছরের শিশু বলে মনে হয় না।


Wednesday, 1 January 2025

ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের নায়ক - লর্ড র‍্যালে

 


লর্ড র‍্যালে নামটি আমাদের কাছে যতটা পরিচিত, জন উইলিয়াম স্ট্রুট ততটা নয়। অথচ নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী লর্ড র‍্যালের আসল নাম হলো জন উইলিয়াম স্ট্রুট। ইংল্যান্ডের এসেক্স কাউন্টির একটি শহরের নাম র‍্যালে। সেখানকার লর্ড ছিলেন বলেই জন উইলিয়াম স্ট্রুটকে সবাই লর্ড র‍্যালে বলে ডাকতো। তিনি ছিলেন তৃতীয় লর্ড র‍্যালে। ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের অনেক কিছুর সাথেই লর্ড র‍্যালের নাম যুক্ত হয়ে আছে তাঁর আবিষ্কার এবং অবদানের জন্য। শব্দ, তাপ, আলোক, তড়িৎচুম্বক, এবং নিষ্ক্রিয় গ্যাস – সবকিছুরই অনেক তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে লর্ড র‍্যালের হাতে। নিষ্ক্রিয় গ্যাস আর্গন আবিষ্কারের জন্য তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছেন ১৯০৪ সালে। লর্ড র‍্যালেকে আমরা এই উপমহাদেশের মানুষ হিসেবে আরো একটি কারণে বিশেষভাবে স্মরণ করি – সেটা হলো তাঁর কাছে পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ নিয়েছিলেন আমাদের স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। 

জন  উইলিয়াম স্ট্রুটের জন্ম ১৮৪২ সালের ১২ নভেম্বর ইংল্যান্ডের এসেক্সে। তাঁর বাবা জন জেমস স্ট্রুট ছিলেন দ্বিতীয় লর্ড র‍্যালে। র‍্যালে শহরের ব্যারন বা লর্ডশিপ পদটি সৃষ্টি করা হয়েছিল ইংল্যান্ডের রাজা চতুর্থ জর্জের ইচ্ছায়। তাঁর রাজত্বের সময় কর্নেল জোসেফ হোল্ডেন স্ট্রুট ছিলেন সাসেক্স কাউন্টির পার্লামেন্ট মেম্বার। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের যুদ্ধে খুব বীরত্ব দেখিয়েছিলেন কর্নেল জোসেফ হোল্ডেন স্ট্রুট। রাজা চতুর্থ জর্জ কর্নেলকে পুরষ্কার স্বরূপ র‍্যালে শহরের ব্যারন করতে চাইলেন। ব্যারন পদটি ছোটখাট আঞ্চলিক রাজার মতো - খুব সম্মানজনক, এবং পুরুষানুক্রমিকভাবে অধিকারযোগ্য। অর্থাৎ একবার কেউ ব্যারন হলে তার পরবর্তী প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই পদের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ও উপাধি ভোগ করবে। কিন্তু কর্নেল জোসেফ হোল্ডেন স্ট্রুট নিজে ব্যারন হতে চাইলেন না। কারণ ব্যারন হয়ে গেলে পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করতে হবে। তিনি ভোটের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। আবার রাজার দেয়া সম্মান ঠেলে ফেলতেও চাইলেন না। তিনি অনুরোধ করলেন তাঁর বদলে পদটি যেন তাঁর স্ত্রীকে দেয়া হয়। রাজা চতুর্থ জর্জ তাঁর ইচ্ছা পূরণ করলেন। প্রথম ব্যারনেস র‍্যালে হলেন শার্লট মেরি গারট্রুড। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম সন্তান জন জেমস স্ট্রুট হলেন দ্বিতীয় লর্ড র‍্যালে। ১৮৭৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম সন্তান জন উইলিয়াম স্ট্রুট হলেন তৃতীয় লর্ড র‍্যালে – যিনি আমাদের আজকের আলোচ্য পদার্থবিজ্ঞানী। [তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে রবার্ট জন ছিলেন চতুর্থ লর্ড র‍্যালে, রবার্ট জনের ছেলে জন আর্থার ছিলেন পঞ্চম লর্ড র‍্যালে, আর বর্তমানে ষষ্ট লর্ড র‍্যালে হয়েছেন জন আর্থারের ছেলে জন জেরাল্ড স্ট্রুট।]

সাত হাজার একরের একটি বিশাল স্টেটের মালিক এবং ব্যারনের  ছেলে হওয়াতে খুবই আরাম আয়েশে কেটেছে জন উইলিয়ামের ছোটবেলা। কিন্তু এত বিত্তবৈভব আরাম-আয়েশের মধ্যে থেকেও খুব একটা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন না জন উইলিয়াম। বাড়িতে গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে পড়ালেখার শুরু। দশ বছর বয়সে বিখ্যাত ইটেন কলেজে ভর্তি করানো হয়েছিল তাকে। কিন্তু হুপিং কাশিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তাকে স্কুল ছাড়তে হয় এক টার্মের পরেই। তারপর একটু সুস্থ হয়ে উইম্বলডনের ছোট্ট একটা বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা ১৮৫৪ থেকে ১৮৫৬ পর্যন্ত। এখান থেকে তাঁকে ভর্তি করানো হলো ইংল্যান্ডের বিখ্যাত হ্যারো স্কুলে। কিন্তু দুই টার্ম পরে সেখান থেকেও চলে আসতে হলো শারীরিক অসুস্থতার কারণে। এরপর তার লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হয় ইংল্যান্ডের দক্ষিণে সমুদ্রতীরবর্তী ডেভন কাউন্টির একটি প্রাইভেট স্কুলে যার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন রেভারেন্ড জর্জ টাউনসেন্ড ওয়ার্নার। ১৮৬০ সালে স্কুল ফাইনাল পাস করলেন জন উইলিয়াম। 

১৮৬১ সালে ভর্তি হলেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজে। স্কুলে থাকতে তেমন কোন বিশেষ মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি জন উইলিয়াম। খুবই সাধারণ মানের ছাত্র ছিলেন তিনি। কিন্তু কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তিনি গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করলেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের গাণিতিক দক্ষতা প্রমাণের জন্য প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা আছে যা ম্যাথমেথিক্যাল ট্রাইপোস নামে পরিচিত। অনেকগুলি অত্যন্ত জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে হয় এই প্রতিযোগিতায়। এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য পাঁচ বছর কঠোর পরিশ্রম করলেন জন উইলিয়াম। এসময় তাঁর গণিতের প্রশিক্ষক ছিলেন কেমব্রিজের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ এডোয়ার্ড জন রাউথ। ১৮৬৫ সালে ম্যাথমেথিক্যাল ট্রাইপোস পরীক্ষায় সর্বোচ্চ র‍্যাংক “সিনিয়র র‍্যাংলার” অর্জন করলেন। সেই সময়ের বিশাল অর্জন এটা জন উইলিয়ামের জন্য। কারণ তাঁর সিনিয়র জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল কিংবা লর্ড কেলভিনও ম্যাথমেটিক্যাল ট্রাইপোসে “সিনিয়র র‍্যাংলার” পাননি, পেয়েছিলেন “সেকেন্ড র‍্যাংলার” র‍্যাংক। একই বছর গণিত ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে বিশেষ দক্ষতার পুরষ্কার “স্মিথ প্রাইজ” লাভ করলেন জন উইলিয়াম। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রাক্তন অধ্যাপক রবার্ট স্মিথের টাকায় এই পুরষ্কার প্রবর্তিত হয়েছিল। 

১৮৬৬ সালে জন উইলিয়াম ট্রিনিটি কলেজের ফেলো নির্বাচিত হন। তখনো পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক গবেষণাই হতো। পরীক্ষণ গবেষণা যা হতো সবই ব্যক্তিউদ্যোগে নিজেদের বাড়িতে বা অন্য কোন ব্যক্তিগত গবেষণাগারে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়েও কোন পরীক্ষাগার ছিল না। ১৮৬৮ সালে জন উইলিয়াম আমেরিকা ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষণ গবেষণাগারের কাজকর্ম দেখে এসেছেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাগার তৈরি করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। কিন্তু তিনি নিজের টাকায় বৈজ্ঞানিক গবেষণার যন্ত্রপাতি কিনে নিজের বাড়ি টার্লিং প্যালেসে ব্যক্তিগত গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করে গবেষণা শুরু করলেন। 

১৮৬৯ সালে প্রকাশিত হলো তড়িতচুম্বকের ধারণার উপর তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র। পরবর্তী দুবছরের মধ্যে শব্দের রেজোন্যান্স, আলোর বর্ণ, বিচ্ছুরণ ও প্রতিফলন সংক্রান্ত আরো এগারোটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।

কেমব্রিজে জন উইলিয়ামের সহপাঠী ছিলেন আর্থার ব্যালফোর, যিনি পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আর্থার ব্যালফোরের বোন ইভলিনের সাথে প্রেম হয় জন উইলিয়ামের। ১৮৭১ সালে ইভলিন ও জন উইলিয়াম বিয়ে করেন। বিয়ে করার সাথে সাথে জন উইলিয়ামের ট্রিনিটি কলেজের ফেলোশিপ বাতিল হয়ে গেল। কারণ বিবাহিতদের জন্য ঐ ফেলোশিপ নিষিদ্ধ ছিল। 

এদিকে তাঁর শরীরও হঠাৎ প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। রিউম্যাটিক ফিভারে আক্রান্ত হয়ে প্রচন্ড কাহিল হয়ে গেলেন জন উইলিয়াম। ডাক্তারের পরামর্শে ইওরোপের শীত থেকে বাঁচতে ১৮৭২ সালের ডিসেম্বরে তিনি স্ত্রীকে সাথে নিয়ে চলে গেলেন মিশরে। সেখানে নীল নদের উপর একটি নৌকা ভাড়া করে থাকতে শুরু করলেন। নৌকায় বসেই তিনি লিখতে শুরু করলেন শব্দবিজ্ঞানের উপর প্রথম পূর্ণাঙ্গ বই “দ্য থিওরি অব সাউন্ড”। ১৮৭৭ সালে দ্য থিওরি অব সাউন্ডের প্রথম খন্ড এবং ১৮৭৮ সালে দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে অনেক বছর ধরে অনেকগুলি সংস্করণ প্রকাশিত হয় এই বইয়ের। 

১৮৭৩ সালে মিশর থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন জন উইলিয়াম। তার কিছুদিন পরে তাঁর বাবা দ্বিতীয় লর্ড র‍্যালে মৃত্যুবরণ করলে উত্তরাধিকারসূত্রে তৃতীয় লর্ড র‍্যালে হলেন জন উইলিয়াম স্ট্রুট। এরপর থেকে ইংল্যান্ডের প্রথা অনুযায়ী আসল নামের পরিবর্তে উপাধিতেই তিনি পরিচিতি লাভ করতে শুরু করলেন – লর্ড র‍্যালে হিসেবে। 

১৮৭৩ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হলেন লর্ড র‍্যালে। আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক গবেষণাও চালিয়ে গেছেন তিনি সমান দক্ষতায়। তখনো পর্যন্ত তিনি তাঁর স্টেটের উপার্জন ছাড়া অন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কোন সম্মানী নেননি। বৈজ্ঞানিক গবেষণার সবকিছুই করছিলেন নিজের বাড়ির গবেষণাগারে নিজের টাকায়। সবকিছু ঠিকই চলছিল। ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত শব্দ, আলো, তাপ, তড়িৎচুম্বক ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর ষাটটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়ে গেছে। 

কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পরপর তিন বছর পর্যাপ্ত ফসল না হওয়াতে র‍্যালে স্টেটের উপার্জন কমে গেলো। লর্ড র‍্যালে বাধ্য হলেন প্রাতিষ্ঠানিক কাজের বিনিময়ে সম্মানী গ্রহণ করতে। 

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম গবেষণাগার ‘ক্যাভেন্ডিস ল্যাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৮৭৩ সালে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন চ্যান্সেলর উইলিয়াম ক্যাভেন্ডিসের নিজস্ব অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত এই গবেষণাগারের প্রথম ‘ক্যাভেন্ডিস প্রফেসর’ হিসেবে যোগ দিয়েছেন বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। কিন্তু ১৮৭৯ সালে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ম্যাক্সওয়েলের মৃত্যু হলে ক্যাভেন্ডিস প্রফেসরের পদ খালি হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে এবং কিছুটা আর্থিক প্রয়োজনে ক্যাভেন্ডিস প্রফেসর পদে যোগ দিতে রাজি হন লর্ড র‍্যালে। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কাজের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণের পক্ষপাতি ছিলেন না তিনি। তাই তাঁর এস্টেটের উপার্জন প্রয়োজনীয় স্তরে পৌঁছানোর সাথে সাথে ১৮৮৪ সালে তিনি ক্যাভেন্ডিস প্রফেসর পদে ইস্তফা দিয়ে নিজের এস্টেটে ফিরে যান স্বাধীন গবেষণায়। 

মাত্র পাঁচ বছরের জন্য ক্যাভেন্ডিস প্রফেসর এবং ল্যাবের পরিচালক হিসেবে কাজ করলেও – এই পাঁচ বছরের মধ্যেই লর্ড র‍্যালে কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবের যুগান্তকারি পরিবর্তন ঘটান। এতদিন বিজ্ঞানের ক্লাস ও গবেষণাগারে মেয়েদেরকে ঢুকতে দেয়া হতো না। লর্ড র‍্যালে মেয়েদের জন্য সমস্ত বিজ্ঞান ক্লাস ও গবেষণাগার উন্মুক্ত করে দিলেন। গবেষকদের ভেতর সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য চালু করেন বৈকালিক চায়ের ব্যবস্থা – যেখানে চা খেতে খেতে গবেষকরা একে অন্যের সাথে বৈজ্ঞানিক ধারণা বিনিময় করেন। লর্ড র‍্যালের তত্ত্বাবধানে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম চালু হয় তাপ, বিদ্যুৎ, চুম্বক, আলো, শব্দ, এবং পদার্থের ধর্ম সংক্রান্ত পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানের পাঠদান। ক্যাভেন্ডিস ল্যাবের পাঁচ বছরে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ৫৪টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। 

লর্ড র‍্যালের সময়ে ১৮৮০ সালে কেমব্রিজে পড়তে এসেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। লর্ড র‍্যালের কাছ থেকেই তিনি উৎসাহ পেয়েছিলেন পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায়। 

১৮৮৪ সালে ক্যাভেন্ডিস প্রফেসরের পদ ত্যাগ করে নিজের স্টেটে ফিরে গিয়ে নিজস্ব গবেষণাগারে আজীবন স্বাধীনভাবে গবেষণা চালিয়ে গেছেন লর্ড র‍্যালে। ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের এমন কোন শাখা নেই যেখানে লর্ড র‍্যালের উল্লেখযোগ্য অবদান নেই। প্রায় সাড়ে চার শ গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন তিনি। আবিষ্কার করেছেন পদার্থবিজ্ঞানের অনেক সূত্র এবং তত্ত্ব। 

গ্যাসের উপাদান ও ঘনত্ব সম্পর্কে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন লর্ড র‍্যালে। স্কটিশ রসায়নবিদ উইলিয়াম রামজির সাথে যৌথভাবে তিনি আবিষ্কার করেছেন নিষ্ক্রিয় গ্যাস আর্গন। এজন্য ১৯০৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন লর্ড র‍্যালে, এবং রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন উইলিয়াম রামজি। সেই ১৯০৪ সালের নোবেল পুরষ্কারের সাত হাজার পাউন্ড (বর্তমানের দশ লক্ষ পাউন্ড) পুরোটাই তিনি দান করে দিয়েছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে। পাঁচ হাজার পাউন্ড দিয়েছিলেন ক্যাভেন্ডিস ল্যাবের উন্নয়নের জন্য, বাকি দুই হাজার পাউন্ড দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য। 

পৃথিবীর আকাশ নীল কেন – এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর প্রথম দিয়েছিলেন লর্ড র‍্যালে। আজ আমরা সবাই জানি বাতাসের ধূলিকণার সাথে আলোর স্ক্যাটারিং বা বিক্ষেপনের কারণে আকাশে নীল রঙ বেশি ছড়িয়ে পড়ে বলে দিনের বেলা আকাশ নীল থাকে। এই স্ক্যাটারিং – র‍্যালে স্ক্যাটারিং নামে পরিচিত। 

ব্ল্যাক-বডি রেডিয়েশন বা কালো পদার্থের বিকিরণ সংক্রান্ত র‍্যাইলে-জিনস সূত্র আবিষ্কৃত হয়েছে ১৮৮৯ সালে। মূলত এই সূত্র থেকেই ১৯০১ সালে ম্যাক্স প্ল্যাংক আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্বের ধারণা পেয়েছেন। সে হিসেবে বলা চলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূচনা হয়েছে র‍্যালের আবিষ্কার থেকে। 

অণুবীক্ষণ, দূরবীক্ষণ, প্রিজম ইত্যাদি আলোকসংবেদী যন্ত্রপাতির রিজলভিং পাওয়ার সংক্রান্ত র‍্যালের আবিষ্কারের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে আলোকবিজ্ঞানের কারিগরি দিক। মাইক্রোস্কোপের সাহায্য এত ছোট বস্তু কীভাবে এত বড় আকারে দেখা যায়, কিংবা টেলিস্কোপের সাহায্যে এত দূরের গ্রহ-নক্ষত্র কীভাবে এত কাছে দেখা যায় – অর্থাৎ এসব সূক্ষ্ম আলোকসংবেদী যন্ত্রপাতিতে কীভাবে ছবি তৈরি হয় – সে সংক্রান্ত প্রথম তত্ত্ব দেন লর্ড র‍্যালে। 

বৈজ্ঞানিক সংগঠক হিসেবেও পদার্থবিজ্ঞানের অনেক উন্নয়ন ঘটিয়েছেন লর্ড র‍্যালে। ১৮৮৫ থেকে ১৮৯৬ পর্যন্ত তিনি রয়েল সোসাইটির সেক্রেটারি এবং ১৯০৫ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন লর্ড র‍্যালে। ১৮৮২ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত রয়েল ইন্সটিটিউশানের ন্যাচারাল ফিলোসফির চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ১৯০৮ সাল থেকে ১৯১৯ সালে তাঁর মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। 

এত আবিষ্কার, সম্মান, পুরষ্কার সবকিছুর চেয়েও তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পদার্থবিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে নিজের কাছে ভালোলাগা। তিনি সারাজীবন গবেষণা করে গেছেন নতুন কিছু জানার প্রতি ভালোবাসা থেকে। ১৯১৯ সালের ৩০ জুন তাঁর মৃত্যু হয়।


তথ্যসূত্র

১। রবার্ট ব্রুস লিন্ডসে, লর্ড র‍্যালে দ্য ম্যান অ্যান্ড হিজ ওয়ার্ক, পারগ্যামন প্রেস, অক্সফোর্ড, ১৯৭০।

২। ব্যারি আর মাস্টার্স, লর্ড র‍্যালে অ্যা সায়েন্টিফিক লাইফ, ওপিএন জুন ২০০৯।

৩। পিটার ওয়েল্‌স, লর্ড র‍্যালে জন উইলিয়াম স্ট্রুট থার্ড ব্যারন র‍্যালে, আইইই ট্রানজেকশান, সংখ্যা ৫৪(৩), মার্চ ২০০৭। 

_______________
বিজ্ঞানচিন্তা নভেম্বর ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত







Latest Post

তাহার নামটি অঞ্জনা

  অঞ্জনা অভিনীত যে সিনেমাটি আমি প্রথম দেখেছিলাম তার নাম ‘সুখের সংসার’। নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ভীষণ মেলোড্রামাটিক সিনেমা। তখন আমি সবেমাত্র ...

Popular Posts