Sunday, 6 April 2025

নিউক্লিয়ার ঘড়ি

 




মানব সভ্যতা বিকাশের শুরু থেকেই সময় সম্পর্কে মানুষ সচেতন হতে শুরু করেছে। সময়ের সাথে সাথে মানুষ যতই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগতভাবে আধুনিক হচ্ছে ততই সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতরভাবে সময় মাপার কলাকৌশল উদ্ভাবিত হচ্ছে। প্রাচীনকালে প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি পর্যবেক্ষণ করেই চলতো সময় মাপার কাজ – যেমন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এক দিন, সূর্যাস্ত থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত এক রাত। চাঁদ পর্যবেক্ষণ করে মাসের হিসেব, ঋতু পরিবর্তন দেখে বছরের হিসেব। তারপর দিনের সময়কে বিভিন্নভাবে ভাগ করে মাপার জন্য সূর্যের ছায়া ব্যবহার করে উদ্ভাবন করলো সূর্যঘড়ি। পানির প্রবাহের হারের সাথে তুলনা করে প্রাচীন মিশর, চীন, মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবহার করা হতো জলঘড়ি। ত্রয়োদশ শতকে উদ্ভাবিত হয় যান্ত্রিক ঘড়ি। ১৬৫৬ সালে ওলন্দাজ (ডাচ) পদার্থবিজ্ঞানী খ্রিসচিয়ান হাইগেনসের উদ্ভাবিত পেন্ডুলাম ঘড়ি সময় পরিমাপে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। উনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে চালু হয় ব্যক্তিগত সময় মাপার জন্য ছোট আকারের পকেট ঘড়ি ও হাতঘড়ি। বিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানীরা মনযোগ দেন – সময়ের পরিমাপকে যথাসম্ভব ত্রুটিমুক্ত করার দিকে। সেই পথ ধরেই উদ্ভাবিত হয় পারমাণবিক ঘড়ি বা অ্যাটমিক ক্লক।

পারমাণবিক ঘড়ি কাজ করে পরমাণুর স্বাভাবিক দোলনকে কাজে লাগিয়ে। পারমাণবিক ঘড়ি পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনের শক্তি স্তর পরিবর্তনের সময় নির্গত বা শোষিত মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের কম্পাঙ্ক পরিমাপ করে। এই কম্পাঙ্ক সুনির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনীয়। পারমাণবিক ঘড়ির আদর্শ পরমাণু হিসেবে ব্যবহৃত হয়  সিজিয়াম পরমাণুর সিজিয়াম-১৩৩ আইসোটোপ। সিজিয়াম-১৩৩ পরমাণুকে কিছুটা উত্তপ্ত করে গ্যাসে পরিণত করে একটি ধাতব প্রকোষ্ঠে চালনা করা হয়। সেখানে মাইক্রোওয়েভ জেনারেটর থেকে নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের মাইক্রোওয়েভ পাঠানো হয়। মাইক্রোওয়েভের কম্পাঙ্ক পরমাণুর কম্পাঙ্কের সাথে মিলে গিয়ে পরমাণু শক্তি শোষণ করে এবং উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। পরমাণু কতটুকু শক্তি শোষণ করলো এবং কতগুলি পরমাণু উচ্চতর শক্তিস্তরে প্রবেশ করলো তা একটি ডিটেক্টর দ্বারা পরিমাপ করা হয়। মাইক্রোওয়েভের কম্পাঙ্ক এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যেন পরমাণুর কম্পাঙ্ক এবং মাইক্রোওয়েভের কম্পাঙ্ক মিলে সর্বোচ্চ রেজোন্যান্স বা অনুনাদ পাওয়া যায়। রেজোনেন্স ফ্রিকোয়েন্সি বা অনুনাদ কম্পাঙ্ক নির্দিষ্ট হবার পর সেই কম্পাঙ্কের মাইক্রোওয়েভ ব্যবহার করে কোয়ার্টজ দোলক চালু করা হয় – যা ঘড়ির দোলক হিসেবে নির্ভুলভাবে কাজ করে।

পারমাণবিক ঘড়ি এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভুলভাবে সময়ের পরিমাপ করে। এর অনিশ্চয়তার মাত্রা এতই কম যে সিজিয়াম পারমাণবিক ঘড়ির সময়ের ক্ষেত্রে এক কোটি বছরে মাত্র এক সেকেন্ড তারতম্য ঘটে।

পরিমাপের যে সাতটি মৌলিক একক আছে তাদের মধ্যে সময়ের একক ‘সেকেন্ড’-এর সর্বশেষ সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে পারমাণবিক ঘড়ির ভিত্তিতে এভাবে: “এক সেকেন্ড হলো সেই সময়কাল যা্তে সিজিয়াম-১৩৩ পরমাণুর গ্রাউন্ড স্টেটের দুটি অতি সূক্ষ্ম মাত্রার মধ্যে পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত বিকিরণের ৯১৯,২৬,৩১,৭৭০টি (নয় শ উনিশ কোটি ছাব্বিশ লক্ষ একত্রিশ হাজার সাত শ সত্তর) পূর্ণ দোলন সম্পন্ন হয়।

বর্তমান তথ্যযোগাযোগের যুগে নেটওয়ার্কের সময়ের সমন্বয়, জিপিএসসহ অত্যন্ত সময়সংবেদী সমস্ত বৈজ্ঞানিক কাজকর্মে পারমাণবিক ঘড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে।  

কিন্তু বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক ঘড়ির এত সঠিক মাপেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। পরমাণুর ইলেকট্রনের শক্তিস্তরের বিকিরণের কম্পাঙ্ক যদি কাজে লাগানো যায়, তাহলে নিউক্লিয়াসের প্রোটন বা নিউট্রনের শক্তিস্তরের বিকিরণকেও যদি একইভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে তো নিউক্লিয়ার ঘড়ি তৈরি করা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা এই ধারণাকেই বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য কাজ করছেন গত বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী একেহার্ড পেইক এবং ক্রিসচিয়ান টাম ২০০১ সালে সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেছিলেন পারমাণবিক ঘড়ির চেয়েও সঠিকভাবে সময় মাপার সক্ষমতা সম্পন্ন নিউক্লিয়ার ঘড়ির। তাঁরা আশা করেছিলেন অতিদ্রুত নিউক্লিয়ার ঘড়ি তৈরি করা সম্ভব হবে। প্রাথমিক ধারণা সম্পর্কিত গবেষণাপত্র তাঁরা প্রকাশ করেছিলেন ২০০৩ সালে [১]।  কিন্তু এরপর বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে হাজার রকমের পরীক্ষানিরীক্ষার পর অবশেষে ২০২৪ সালে এসে নিউক্লিয়ার ঘড়ির ধারণা বাস্তবে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে [২,৩,৪]।

নিউক্লিয়ার ঘড়ি তৈরি করতে গেলে কী ধরনের নিউক্লিয়াস দরকার তা বোঝার জন্য দেখা যাক নিউক্লিয়ার ঘড়ির কলকব্জা এবং কার্যপদ্ধতি কী। নিউক্লিয়ার ঘড়ির মূলনীতিও পারমাণবিক ঘড়ির মূলনীতির মতোই। যথোপযুক্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে লেজারের মাধ্যমে  উত্তেজিত করার পর উত্তেজিত শক্তিস্তর থেকে বিকিরণ নির্গত হবে। সেই বিকিরণের পরিমাণ গামা রে ডিটেক্টরের মাধ্যমে শনাক্ত এবং পরিমাপ করে একই শক্তির কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট একটি কোয়ার্টজ দোলক দোলানো হবে – যা থেকে ঘড়ির সময় মাপা যাবে।

পারমাণবিক ঘড়ির ক্ষেত্রে সিজিয়াম-১৩৩, রুবিডিয়াম-৮৭, হাইড্রোজেন, স্ট্রনশিয়াম, ইটারবিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম আয়ন, মারকারি আয়ন ইত্যাদি বেশ কয়েকটি পরমাণু অথবা পরমাণুর আইসোটোপ ব্যবহার করে সফলভাবে পারমাণবিক ঘড়ি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু নিউক্লিয়াসের যে শক্তিস্তর ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার ঘড়ি তৈরি করা যাবে সেরকম নিউক্লিয়াসের সংখ্যা খুবই কম। এপর্যন্ত আবিষ্কৃত ১১৮টি মৌলের প্রায় সাড়ে তিন হাজার আইসোটোপের নিউক্লিয়াসের মধ্যে এক লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার রকমের উত্তেজিত শক্তিস্তর বিশ্লেষণ করে এখনো পর্যন্ত মাত্র একটি পারমাণবিক নিউক্লিয়াস পাওয়া গেছে যার উত্তেজিত শক্তিস্তর থেকে নিউক্লিয়ার ঘড়ি তৈরি করা সম্ভব [৫]। সেই নিউক্লিয়াসটি হলো থোরিয়াম-২২৯।

 

নিউক্লিয়ার ঘড়ির মূলনীতি


ক্যালসিয়াম ফ্লোরাইড ক্রিস্টালের মধ্যে থোরিয়াম-২২৯ পরমাণু যুক্ত করে সেখানে আলট্রাভায়োলেট লাইটের কম্পাঙ্ক এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লেজার বিম প্রয়োগ করা হয়। লেজার থেকে শক্তি শোষণের  ফলে থোরিয়াম-২২৯ নিউক্লিয়াসের প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। থোরিয়াম-২২৯ নিউক্লিয়াসের উত্তেজনা আইসোম্যারিক স্টেট তৈরি করে অর্থাৎ উত্তেজিত অবস্থায় এরা কিছুক্ষণ থাকার পর শক্তি নির্গমনের মাধ্যমে উত্তেজনা কমায়, অর্থাৎ গ্রাউন্ড স্টেটে ফিরে আসে। নিউক্লিয়াস থেকে শক্তি নির্গমণ ঘটে গামা রে বিকিরণের মাধ্যমে। একটি গামা রে ডিটেক্টর এই শক্তি নির্গমনের হার পরিমাপ করে। এই নিউক্লিয়ার গামা রশ্মির শক্তি পারমাণবিক বিকিরণের শক্তির চেয়ে অনেক বেশি। ফলে তাকে কম্পাঙ্কে পরিণত করলে কম্পাঙ্কের পরিমাণ হয় পারমাণবিক কম্পাঙ্কের চেয়ে প্রায় দশ হাজার গুণ বেশি। এই কম্পাঙ্কের সাথে অনুরণন ঘটিয়ে যখন একটি কোয়ার্টজকে দোলানো হয় – তখন সেই দোলন পারমাণবিক দোলকের চেয়ে দশ হাজার গুণ বেশি দোলে। এই দোলনকে যখন ঘড়ির সময় মাপার কাজে লাগানো হয় – তা স্বাভাবিক ভাবেই পারমাণবিক ঘড়ির সময়ের চেয়েও বেশি সঠিক হবে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন –  চৌদ্দ শ কোটি বছরেও এক সেকেন্ডেরও তারতম্য ঘটবে না নিউক্লিয়ার ঘড়ির সময়ে।

নিউক্লিয়ার ঘড়ি কী কাজে লাগবে? আমরা যারা সাধারণভাবে যেকোনো ঘড়িতে সময় দেখে জীবন চালাতে অভ্যস্ত, যাদের কাছে সেকেন্ডের হেরফেরে তেমন কিছু যায় আসে না, তাদের জন্য নিউক্লিয়ার ঘড়ির অবদান খুব একটা দৃশ্যমান হবে না। কিন্তু নিউক্লিয়ার ঘড়ি তৈরি সম্ভব হলে, বৈজ্ঞানিকভাবে অনেক কিছু বিষয়ে খুবই উন্নতি ঘটবে। যেমন স্যাটেলাইট নেভিগেশন সিস্টেমের অনিশ্চয়তার মাত্রা অনেক কমে যাবে। সাধারণ জিপিএস সিস্টেমে কোনো বস্তুর অবস্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তিন থেকে দশ মিটারের একটা অনিশ্চয়তা থাকে। এই অনিশ্চয়তার পরিমাণ অনেক কমে যাবে জিপিএস সিস্টেমে নিউক্লিয়ার ঘড়ি ব্যবহার করা গেলে।

বিজ্ঞানীরা আশা করছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানে নিউক্লিয়ার ঘড়ি বিরাট ভূমিকা রাখবে। বর্তমান মহাবিশ্বের রহস্য সন্ধানে নিয়োজিত স্যাটেলাইটগুলি পারমাণবিক ঘড়ির সময়ের সাথে সংযুক্ত। ফলে মহাবিশ্বের তড়িতচৌম্বক ক্ষেত্রের একটা সূক্ষ্ম প্রভাব পড়ে অতি সূক্ষ্ম  মাত্রার হলেও মাঝে মাঝে কিছু বিচ্যুতি ঘটে সময়ের পরিমাপে। নিয়মিতভাবে তার সংশোধনের দরকার হয়। নিউক্লিয়ার ঘড়ি এসব থেকে মুক্ত হবে। ফলে ভবিষ্যতের স্যাটেলাইটগুলি হবে আরো অনেক বেশি সুসংবেদী এবং সুচারু।

ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি শনাক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে উৎক্ষেপিত স্যাটেলাইটগুলি। পারমাণবিক ঘড়ির নেটওয়ার্কের সাথে সেগুলি সংযুক্ত। নিউক্লিয়ার ঘড়ি সেসব ক্ষেত্রে আরো অনেক বেশি সঠিক মাত্রার ভূমিকা রাখতে পারবে।

নিউক্লিয়ার ঘড়ি এখনো তৈরি হয়নি, তবে আশা করা যাচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রথম নিউক্লিয়ার ঘড়ি তৈরি করা সম্ভব হবে।

 

তথ্যসূত্র

[১] ইউরোফিজিক্স লেটার, ভল্যুম ৬১, ২০০৩।

[২] ন্যাচার, ভল্যুম ৬৩৬, ১৯/২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, পৃ ৫৪৪-৪৫।

[৩] ন্যাচার, ভল্যুম ৬৩৩, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, পৃ ৪৩-৪৫।

[৪] ফিজিক্স ওয়ার্ল্ড, নভেম্বর ২০২৪, পৃ ৩।

[৫] জার্নাল অব ফিজিক্স বি, ভল্যুম ৫২, পেপার ২০৩০০১, ২০১৯।

____________________

বিজ্ঞানচিন্তা জানুয়ারি ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত







Monday, 31 March 2025

বাবা - ৭

 


আমি তখন ক্লাস থ্রি। এসএসসি পাস করার পর দিদি কলেজে পড়ার জন্য শহরে চলে গেল। আমার আনন্দ এবং বিপদ একসাথে হাজির হলো। সে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া মানে আমার মুক্তির আনন্দ। সারাক্ষণ তার খবরদারি থেকে মুক্তি।  ইচ্ছেমতো পুকুরে দাপাদাপি করার স্বাধীনতা, স্কুল ছুটির পর সোজা বাড়িতে না এসে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলে ধুলোকাদায় মাখামাখি হবার স্বাধীনতা। প্রতিবেশীদের নালিশ শুনে যার দোষই হোক, আমার পিঠেই দমাদম কিল মারতো সে। সেইসব নালিশকারী প্রতিবেশীদের লাউগাছ-সীমগাছ এবার কীভাবে আস্ত থাকে দেখবো। কিন্তু বিপদ দেখা দিল অন্যদিকে। দিদি চলে যাবার দুদিনের মধ্যেই আমার পাঁচ বছরের বড় দাদা যে আমার দন্ডমুন্ডের মালিক হয়ে উঠবে সেটা জানা ছিল না। আগে দুইভাই দিদির শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে একজোট হতাম। এখন দিদি চলে যাবার পর দাদাই আমাকে শাসন করার ক্ষমতা দখল করল। আগে দাদার অগোচরে দিদির কাছে তার নামে নালিশ করে তাকেও কত মার যে খাইয়েছিলাম। ভেবেছিলাম দাদা আমার ষড়যন্ত্রের কথা জানতো না বা জানলেও মনে রাখেনি। কিন্তু আমার ভুল ভাঙতে দুদিনও লাগলো না। দিদির অনুপস্থিতিতে বুঝতে পারলাম এতদিন সে শাসন করলেও দাদার অপশাসন থেকে রক্ষাও করতো। এখন বাবা বাজার করে দিলে বাজারের ব্যাগ আমাকেই বয়ে নিয়ে আসতে হয় বাড়িতে। আর দাদা হাফপ্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে হেলেদুলে হাঁটে। বড় ভাইবোনদের অত্যাচারে বাড়ির ছোটদের যে কী যন্ত্রণা হয় তা তো বড়রা বুঝতেই চাইবে না। বাবা বেশিরভাগ সময়েই বাড়িতে থাকে না, ফলে দিদির অনুপস্থিতিতে দাদার শাসন দুঃশাসনের মতো লাগতে শুরু করলো। দিদিকে মিস করতে শুরু করলাম।

বার্ষিক পরীক্ষার পর বাবার সাথে শহরে চললাম দুই ভাই। দিদির হোস্টেলে গিয়ে দিদির কাছে দাদার নামে কী কী নালিশ করবো তার একটি তালিকা মনে মনে করে নিয়েছি। অবশ্য পরে দাদার হাত থেকে কে রক্ষা করবে সে ব্যাপারে তখনও কিছু ভাবিনি। সেটা পরে ভাবা যাবে। আপাতত লঞ্চের ভীড়ে যত কান্ড ঘটছে সবকিছুই চোখ দিয়ে গিলতে শুরু করলাম।

নাপোড়া থেকে শহরে যাবার সবচেয়ে সহজ পথ ছিল নদীপথ। সড়ক পথে যেতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। নাপোড়া থেকে গুনাগরি পর্যন্ত হেঁটে বা  রিকশায় যেতে হতো। তাও সরাসরি যাবার উপায় ছিল না। শিল্কুপের পর একটা পাকা ব্রিজ একাত্তরে পাকিস্তানি মিলিটারিদের জিপ নিয়ে ভেঙে পড়েছিল বলে একাত্তরে আমাদের গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারিরা যেতে পেরেছিল যুদ্ধ শুরু হবার অনেক পরে। এই ব্রিজটির পাশ দিয়ে জমির উপর হাঁটা পথ ছিল। সেটা পার হয়ে আবার রিকশা নিতে হতো। গুনাগরি থেকে লক্কর ঝক্কর জিপ যেতো পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সাতকানিয়ায়। সেখান থেকে আরাকান সড়ক ধরে বাস অথবা সেই জিপ নিয়ে কালুরঘাট ব্রিজ হয়ে শহরে যেতে যেতে সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়ে যেতো। নদীপথ তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল বলে বাবা আমাদের নিয়ে নদীপথেই রওনা হলেন।

নাপোড়া থেকে রিকশা নিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই চাম্বল বাজার। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে ছোট একটি পায়ে চলা পথে বাংলাবাজার ঘাট। আমার বাবার একটি দুই ব্যাটারির টর্সলাইট ছিল। আমি খুব আহ্লাদ করে টর্সটি বাবার হাত থেকে নিয়ে কয়েক কদম যাবার সাথে সাথেই অন্ধকারে আমার হাত থেকে টর্সটি কেড়ে নিয়েছিল দাদা। অন্ধকারে আলো দেখানোর দায়িত্ব নাকি ছোটদের হাতে থাকতে নেই। বারো বছর বয়সেই সে বিরাট জ্ঞানী হয়ে বসে আছে – ক্ষমতালোভী শয়তান। তালিকায় আরো একটি অভিযোগ যোগ করে নিলাম।

কত্তোবড় নৌকা – বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেই আমার সবজান্তা দাদা কোটের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো, ‘এটা নৌকা নয়, লঞ্চ। আর এটা তেমন কোন বড় লঞ্চ নয়। এর চেয়েও বড় লঞ্চ আছে।‘ এর আগে আর একবার মাত্র আমরা লঞ্চে চড়েছিলাম – তাও একসাথে। তবে সে কীভাবে এর চেয়েও বড় লঞ্চ দেখলো জানি না। কিন্তু প্রশ্ন করে জুলপির চুলে টান খাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। তাই তার জ্ঞান নিরবে মেনে নিয়ে লঞ্চের টুলে বাবার পাশে বোচকাটা রেখে আমার কোটের গলার কাছের বড় বোতামটাও লাগিয়ে নিলাম। নাপোড়া বাজারে বুধবার ও শনিবার বাজার বসে। ঠেলাগাড়িতে করে অনেক শীতের জামাকাপড় বিক্রি করতে এসেছিল গত বুধবার। সেখান থেকে আমাদের দুজনের জন্য দুটো কোট কেনা হয়েছে শহরে যাওয়া উপলক্ষে। কোটে বুকের শীত মানলেও হাফপ্যান্ট পরা থাকার কারণে পায়ে ঠান্ডা লাগছে। বোচকার মধ্যে একটা কাঁথা আছে। সেটা বের করবো কি করবো না বুঝতে পারছিলাম না।

লঞ্চে খুব ভীড়। লম্বা বেঞ্চে ঠেলাঠেলি করে বসে আছে সবাই। মাঝখানে বিশাল কালো রঙের তেল আলকাতরা মাখা ইঞ্জিন গমগম করে প্রচন্ড শব্দে চলছে। কথা বলতে হচ্ছে জোরে জোরে। লঞ্চের খোলা জানালা দিয়ে হুহু করে ঠান্ডা বাতাস আসছে। দাদা ইতোমধ্যেই তার কোটের আভিজাত্য ভুলে গিয়ে বোঁচকা থেকে কাঁথা বের করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে ফেলেছে। আমাকেও কোন রকমে সেই কাঁথার ভেতর ঢুকতে হবে।

লঞ্চের অনেক যাত্রীই বাবাকে চেনে। বাবার সাথে কথাবার্তা বলছে। লঞ্চ ছেড়ে দেয়ার পরও অনেকে বাবার কাছে এসে “বদ্দা, আইবান কত্তে?” “পোয়া অলরে লই যন দে নে শহর দেখাইবার লাই?” “মাইয়ারে ত গভমেন কলেজত দিয়ন হুন্নি। মাইয়া পোয়া পরাই এরে কন লাভ নাই। আঁরইবারে বিয়া দি ফেলাইয়ি।“ বাবা কোন কথা বলছেন না দেখে বুঝতে পারছি এই লোকের কথাবার্তা তাঁর পছন্দ হয়নি।

দিদিকে আর পড়াশোনা না করানোর জন্য গ্রামের অনেকেই নিজে থেকে এসে বাবাকে উপদেশ দিয়েছিলেন। আমি দোকানে দাঁড়িয়ে অনেক কথাবার্তা শুনেছি। গন্যমান্য একজন শিক্ষক এসে বাবাকে বলেছিলেন, “মেয়েদের বেশি লেখাপড়া করালে তাদের পাখা গজাবে। তুমি শহরের কলেজে মেয়েকে পড়তে দিলে সেই মেয়ে আর ঘরে আসবে না।“ বাবা মিনমিন করে বলেছিলেন, “মেয়ে আমার ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করেছে। আমাদের এই স্কুল থেকে তার আগে আর কোন মেয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করেনি। মেয়ের আগ্রহ আছে আরো পড়াশোনা করার। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেয়ে সরকারি কলেজে চান্স পেয়েছে। হোস্টেলে সিট পেয়েছে। আমি তাকে পড়াবো না? আমার মেয়ে যতদূর পড়তে চাইবে, আমি যেভাবেই হোক পড়াবো।“ মাস্টারমশাই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিলেন, “পরে পস্তাবে।“ আমার বাবা আর কিছু বলেননি। গ্রামের জমিদারমশাই এসেও বাবাকে বলেছিলেন, “তুমি দোকান চালাচ্ছো  এর ওর কাছ থেকে টাকা ধার করে।  দুদিন পরে যে মেয়ে শ্বশুরবাড়ির ভাত রাঁধবে তাকে পড়াচ্ছো শহরের কলেজে। “পোঁদত নাই ত্যানা, মিঢা দি ভাত খানা!”” বাবা জমিদারমশাইর কথার কোনো জবাব দেননি। শুধু নিরবে তাকিয়ে ছিলেন তার মুখের দিকে।

চাঁদের আলোয় সাগরের পানি চিকচিক করছে। ঘাড় ফিরিয়ে কিছুক্ষণ তাকালাম। কিন্তু ঘুমে তলিয়ে গেলাম একটু পরেই। ঘুম ভাঙলো ভোরবেলায়। লঞ্চ তখন সদরঘাটের লঞ্চঘাটায় ভিড়ছে। যাত্রীরা জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করেছে। মনে আছে গতবার লঞ্চ থেকে আবার ছোট নৌকায় উঠতে হয়েছিল। এবার লঞ্চ সরাসরি লম্বা কাঠের এক সেতুর পাশে ভিড়েছে। কাঠের লম্বা সিঁড়ি দিয়ে সেখানে উঠে যাচ্ছে যাত্রীরা। বাবা উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়েই ভীষণ চঞ্চল হয়ে আশেপাশে বেঞ্চের নিচে দ্রুত কী যেন খোঁজ করতে শুরু করলেন। বোঁচকার ভেতর, আমাদের কাঁথা যা একটু আগেই ভাঁজ করেছি তার ভেতর – কী যেন খুঁজছেন। এই শীতেও তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ফর্সা মুখ থমথম করছে। আমি ঘাটের সিঁড়ি সম্বন্ধে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, দাদা আমার হাত ধরে টান দিলো। অর্থাৎ কোন কথা বলবি না।

লঞ্চের সবাই নেমে গেছে। ড্রাইভার আর সহকারিরা বাবার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল বাবার পকেটমার হয়েছে। তাঁর সব টাকা তিনি একটি লম্বা কাপড়ের ব্যাগের ভেতর রেখে কোমরের সাথে বেঁধে রেখেছিলেন। ঘুম আর ভীড়ের সুযোগে পকেটমার তাঁর সব টাকা নিয়ে গেছে। লঞ্চের ড্রাইভার বা হেলপারদের কারো কিছু করার নেই। কাপড়ের থলে কাঁধে আর বোঁচকা হাতে নিয়ে লঞ্চের সিঁড়ি দিয়ে ঘাটের সিঁড়িতে ওঠার সময় বাবাকে কেমন যেন সর্বস্বান্ত মনে হচ্ছিলো। ঘটনার গুরুত্ব আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তবে দাদা সম্ভবত বুঝতে পারছিল। অন্য সময় হলে সে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে কীভাবে পা টিপে টিপে হাঁটতে হবে সে সম্পর্কে অনেক উপদেশ দিতো। কিন্তু এখন একটাও শব্দ করছে না।

ঘাটের কাঠের সেতুর উপরেই কয়েকটা ছোট ছোট চায়ের দোকান। লম্বা একটি টুলে বসে পড়লেন আমাদের সদ্য সর্বস্ব হারানো বাবা। আমার ভীষণ বাথরুম পেয়েছে। চেপে বসে রইলাম।

“বদ্দা, কী অইয়ে দে?” – বলে বাবার পাশে এসে যিনি বসলেন তাঁকে আমরা চিনি। লঞ্চে তিনিও ছিলেন। বাবার সাথে অনেকক্ষণ কথাও বলেছেন। আমরা তাঁকে চাচা ডাকি। “এভাবে কেন বসে আছেন? আমার ভাইপোদের নিয়ে শহরে এসেছেন, মন খারাপ করে থাকলে চলবে?”

বাবা হঠাৎ তাঁর হাত দুটো ধরে কেমন যেন কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, “অ ভাই!”

চাচা তাঁর লুঙ্গির কোঁচড় থেকে বের করে দ্রুত বাবার হাতে তুলে দিলেন তাঁর হারানো টাকার থলে। বাবার মুখে আলো জ্বলে উঠলো। চাচাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কত আছে জানো?”

“জানি। দশ হাজার এক শ। দুইটা নোট ছেঁড়া আছে। সতীশ বহদ্দারের কাছ থেকে ধার করেছেন, তাই না?”

“জানার পরেও ফেরত দিচ্ছো?”

“বদ্দা। লোভ সামলাতে পারিনি প্রথমে। পরে আপনাকে দেখে কেমন যেন খারাপ লাগলো। নিজেকে নেমক হারাম বলে মনে হলো। আপনার মনে আছে কি না জানি না, যুদ্ধের আগে প্রচন্ড তুফানের সময় আমার বাড়িতে এক দানাও চাল ছিল না, হাতে একটা টাকাও ছিল না। গভীর রাতে আপনার কাছে আমি গিয়েছিলাম। আপনি সেই ঝড়তুফানের মধ্যে দরজা খুলে আমাকে চাল দিয়েছিলেন। সেই চালের ভাত খেয়েছি আমি, ভাত খেয়েছে আমার ছেলেমেয়েরা। আর আমি আপনাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছিলাম।“ “আঁরে মাফ গরি দিয়ন বদ্দা।“

চাচা চলে গেলেন। বাবার মুখে হাসি ফিরে এলো। আমরা নদীর দিকে তাকালাম। সকালের কুয়াশা ভেদ করে সূর্য উঠছে। 

Monday, 24 March 2025

মহিউদ্দিন মোহাম্মদের ‘টয়োটা করোলা’




 ___________________________

টয়োটা করোলা ।। মহিউদ্দিন মোহাম্মদ ।। জ্ঞানকোষ প্রকাশনী ।। প্রকাশকাল জানুয়ারি ২০২৩ ।। প্রচ্ছদ - সব্যসাচী মিস্ত্রী ।। মূল্য ২৮০ টাকা ।। ১০৪ পৃষ্ঠা।।
____________________________


মহিউদ্দিন মোহাম্মদের মুক্তগদ্যের প্রথম সংকলন ‘আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র’ পড়ার সময় তাঁর শক্তিশালী গদ্যে মুগ্ধ হয়েছি। তাই জ্ঞানকোষ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় বই ‘টয়োটা করোলা’র প্রতি প্রত্যাশা ছিল আরো বেশি। তেরোটি নাতিদীর্ঘ গল্পের সংকলন ‘টয়োটা করোলা’। আমি সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র নই, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ আছে – আনন্দের জন্যই আমি সাহিত্য পড়ি। তাই সাহিত্যের শাখাপ্রশাখার খটমট সংজ্ঞা নিয়ে আমার তেমন কোন মাথাব্যথা নেই। ছোটগল্পের সংজ্ঞা কী? ছোটগল্প হয়েছে কি না দেখার জন্য রবীন্দ্রনাথের “ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা, নিতান্তই সহজ সরল“ জাতীয় বৈশিষ্ট্যগুলি মিলিয়ে দেখার কোন দরকার আছে  বলে আমি মনে করি না। “নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ। অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করে মনে হবে, শেষ হইয়াও হইল না শেষ।“- মিলিয়ে নিতে গেলে দেখা যাবে এই বইয়ের সবগুলি গল্পেই বর্ণনার ছটার ছড়াছড়ি, ঘটনার ঘনঘটাও কম নয়। আর তত্ত্ব এবং উপদেশ তো আছেই। তবুও লেখার গুণে এই তেরোটি রচনাই আলাদা আলাদা ছোটগল্প হয়ে উঠেছে।

প্রথম গল্প “একটি পুকুর কী বলিতে চায়?” পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ঘাটের কথা” মনে পড়ে যায়। ভাষাগত শুধু নয়, আবহও একই রকমের। শুধু সেকাল আর একালের পার্থক্য। অবশ্য লেখক নিজেও এটা স্বীকার করেছেন বইয়ের ভূমিকায়। আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছেন,”রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন তাঁর নিজের সময় ও সমাজকে, আর আমি ব্যবহার করেছি পুরো একুশ শতকের সময় ও সমাজকে।“ রবীন্দ্র-আশ্রিত এই রচনাকে তাই পুরোপুরি মৌলিক রচনা বলা যাচ্ছে না। তবুও কিছু কিছু বাক্যে বিদ্যুৎ চমকায় – যেমন, “সূর্যেরও কী দয়া, নিজ হাতে মেঘ পরিষ্কার করিয়া তাহাদিগকে খরতাপ বিলাইয়া যাইতো।“ [পৃ ২৫]।

একটি পুরনো মসজিদের আত্মকথা ‘মসজিদের চিঠি’। কাল্পনিক এই চিঠিতে মসজিদের জবানিতে লেখক ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে বেশ কিছু সাহসী বাক্য উচ্চারণ করেছেন যেগুলি আমাদের বর্তমান সমাজের দুঃখজনক অথচ সঠিক প্রতিফলন। “ইউটিউবে ওয়াজ শুনিয়া আপনাদের মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে। নানা আনর-বানরের কথা শুনিয়া ইহুদিদের বকাবকি করিতেছেন, বৌদ্ধদের বংশচয়নিকা উদ্ধার করিতেছেন। গত শুক্রবার এক ফেসবুক পোস্ট পড়িয়া মিছিল লইয়া ছুটিয়া গেলেন শান্তিপুর গ্রামে, গিয়া জ্বালাইয়া দিলেন আট-দশটি হিন্দু ঘরবাড়ি।“ [পৃ ২৮]। “ধীরে ধীরে নবীর উম্মত হইতে খারিজ হইয়া আপনারা সমাজের উম্মতে পরিণত হইতেছেন। আল্লাহর নামে কোরবানি দেওয়ার কথা বলিয়া সমাজের নামে কোরবানি দিতেছেন। সমাজকে ভয় পাইয়া শুক্রবারে নামাজ পড়িতেছেন।“ [পৃ ৩০]। শুধুমাত্র হিন্দু পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের বই মসজিদের লাইব্রেরি থেকে বাতিল করে দেয়ার ঘটনারও সমালোচনা করেছেন লেখক। বর্তমান বৈরি সময়ে এটুকু করতেও অনেক বেশি সৎ সাহস লাগে। লেখক সে সাহস দেখাতে পেরেছেন।

‘দেশটি নষ্ট হইয়া গেলো’ গল্পটি বাংলাদেশের একদিন প্রতিদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরগুলিকে কেন্দ্র করে লেখকের ধারাবাহিক সমালোচনা। বাংলাদেশে প্রতিদিন এতবেশি আজেবাজে ঘটনা ঘটে যে সেগুলি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে লেখকের মতে তা একটা ময়লার গাড়ির মতো মনে হয়। তাই লেখক সংবাদপত্রের নাম দেন ‘ময়লাপত্র’। সমাজের নানা দুর্নীতি, অন্যায়-অনাচার প্রতিদিন দেখতে দেখতে মানুষ এতই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে তাতে কারোরই মনে হয় না দেশ নষ্ট হয়ে গেলো। কেবল কোন মেয়ে যদি একটু সাহসী পোশাক পরে রাস্তায় বের হয় সাথে সাথে সবাই চিৎকার দিয়ে ওঠে – দেশটি নষ্ট হয়ে গেল। লেখকের সমাজ-পর্যবেক্ষণের এখানে প্রশংসা করতেই হয়।

‘মানুষ ও বানরের পার্থক্য’ গল্পের নায়ক যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স করে একটি ব্যাংকে আশি হাজার টাকা বেতনে কর্মরত। একদিন নায়ক কোনো এক জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে জঙ্গলের বানরের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারেন মানুষ ও বানরের মধ্যে আসল পার্থক্য কী। এখানে মানুষ ও বানরের জীববিজ্ঞানিক পার্থক্যের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মানুষের লোভ এবং অন্যায়ের প্রতি সীমাহীন আনুগত্যের প্রতি লেখকের তীব্র শ্লেষ। “কিছু কিছু রূপক ও  বাক্যবিন্যাস অপূর্ব। উদাহরণ – ‘ছড়িটিতে তিনটি পাকা কলা রোদের ঘষা খাইয়া চকচক করিতেছে।“ [পৃ ৪০]। “যেন চাঁদের আলো পাইয়া কোনো দীঘির জল মোমবাতির মতো গলিয়া পড়িতেছে।“ [পৃ ৪১]।

বাংলাদেশের এক শ্রেণির পুরুষ নারীদের ভীষণ অসম্মানের চোখে দেখে। ওয়াজ মাহফিল থেকে অপমান করে নারীদের বের করে দেয়া হয়। এরকম সমাজের নানাস্তরে নারীর অপমানের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী গল্প ‘ভণিতা’। সোজাসুজি বলা যায়, এই গল্পে লেখকের বক্তব্য – আমাদের অনেকেরই বক্তব্য – যেখানে কোন ভণিতা নেই। কয়েকটা উদাহরণ দিই – “শূকর যেমন ময়লাভান্ডে হঠাৎ গোলাপের দেখা পাইলে আঁতকিয়া ওঠে, ইহারাও তেমনি স্বসৃষ্ট মলের ভাগাড়ে কোনো সৌন্দর্যের দেখা পাইলে পাগলা কুত্তা হইয়া ছোটে।“ [পৃ ৪৬]। “মনে হইতেছে, লজ্জাদেবী ট্রেন দুর্ঘটনায় দুই পা হারাইয়া ভগিনীকুলের স্কন্ধে খুব শক্ত করিয়া চাপিয়া বসিয়াছেন। ওইদিকে গৌরবপুত্ররা, ঢিলা-কুলুপ লইয়া, লুঙ্গি উঁচা করিয়া পথেঘাটে নাচানাচি করিতেছে, বিড়ি টানিতেছে, শিস মারিতেছে, এবং রাস্তায় কোনো মেয়েলোকের দেখা পাইলে উঁহু শব্দে উচ্চারণ করিতেছে: শালী এই সন্ধ্যাবেলা একা একা কোথায় যায়?” [পৃ ৪৭]। “এ আসমানী দ্বিপদমন্ডলী চারপাশে উলঙ্গ নারী আবিষ্কার করিতেছে। দৃষ্টি-অভেদ্য জিন্স-প্যান্ট টি-শার্ট সালওয়ার-কামিজ ভেদ করিয়া নারীকুলের সর্বাঙ্গ দেখিতেছে। বোধ হইতেছে, ইহারা জোঁকের চোখ লইয়া জন্মাইয়াছে। জোঁক তা-ও মুখ লাগাইয়া রক্ত চোষে, কিন্তু এই নারীকাতর নেমাটোডগণ চোখ লাগাইয়াই সর্বস্বাদ লুটিয়া লয়।“ [পৃ ৪৮]

ধর্ম এবং ঈশ্বরের ব্যাপারে নেতিবাচক মন্তব্য করা তো দূরের কথা, যৌক্তিক সমালোচনা করলেও সমূহ বিপদ বাংলাদেশে। মুক্তচিন্তার একটি ঢেউ খেলেছিল বাংলাদেশে বছর দশ আগে।  মুক্তচিন্তকদের অনেককেই নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে, বেশিরভাগকেই করা হয়েছে ঘরছাড়া, দেশছাড়া। সেখানে সরাসরি ঈশ্বরের সমালোচনা করা কিংবা বিরোধিতা করা এখন মারাত্মক বোকামি। “ঈশ্বরের টেলিফোন”-এ লেখক সেই ভুল করেননি। তিনি ঈশ্বরের কাল্পনিক টেলিফোনে ঈশ্বরের মুখ দিয়েই বলিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশের ধর্মান্ধ মানুষ ঈশ্বরের নামে কীসব কুকীর্তি করে বেড়াচ্ছে। দুটো উদাহরণ উল্লেখ করা যাক। “কিছু নফর আমাকে দানব সাজাইয়াছে। নিজেদের প্রতিশোধপরায়ণতা আমার ওপর আরোপ করিয়াছে। ভাবিতেছে, তাহাদের শত্রু নিশ্চয়ই আমারও শত্রু। মূলত এরা নিষ্ঠুর বলিয়াই কল্পনা করিয়াছে আমিও নিষ্ঠুর।“ [পৃ ৫২] “আমি নাকি নারীদিগকে সর্বদা হাত, মুখ, চোখ ঢাকিয়া চলিবার নির্দেশ দিয়াছি! একটি নারী নিজেকে লুকাইয়া রাখিলে উহাতে ঈশ্বরের কী সুবিধা হয়, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। মনে হয় গোলামেরা নিজেদের সুবিধার কথা ভাবিয়াই এ রূপ হুকুম আমার নামে জারি করিয়াছে।“ [পৃ ৫৩]। গল্পচ্ছলে লেখক ধর্মান্ধতার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন ঈশ্বরে পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখেই। তবে তিনিও ঈশ্বরকে খুবই অসহায় এক স্বত্ত্বা হিসেবে চিত্রায়ন করেছেন – যে ঈশ্বরের ক্ষমতা নেই তার বান্দাদের বদমায়েশি বন্ধ করার, কেবল টেলিফোন করে নিজের সাফাই গাওয়া ছাড়া।

মোসায়েবি বাংলাদেশে এক ছোঁয়াচে রোগের নাম। কোনো এক অজানা কারণে এদেশের মানুষের মজ্জাগত বৈশিষ্ট্যে দাঁড়িয়ে গেছে মোসায়েবি। নিজের চেয়ে যেকোনোকিছুর মাপকাঠিতে একটু উঁচু কাউকে দেখলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোসায়েবি শুরু হয়ে যায়। কে কত শৈল্পিকভাবে এই কাজটি করতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলে বাংলাদেশে। ভয়াবহ রকমের দুর্নীতিপরায়ণ স্বৈরাচারী সরকারকেও তেল দেয়ার প্রতিযোগিতা চলে সর্বত্র। এই দগদগে সমস্যাটির আংশিক প্রতিফলন ঘটেছে ‘দরখাস্ত’ গল্পে যেখানে জনৈক আলি কামাল বর্ণনা দেন কত নির্লজ্জভাবে তিনি সরকারকে তেল দিতে পারবেন যদি তেল মারার দায়িত্ব পান।

‘আমাদের দাদী’ গল্পে বাস্তবের সাথে কিছুটা পরাবাস্তব কল্পনা [দাদী চাঁদের বুড়িকে বলে মেঘ সরিয়ে দিতেন…] মিশিয়ে বেশ কিছু আপ্তবাক্যের সমন্বয় ঘটিয়েছেন [স্বর্ণ মূল্যবান, এ বিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে দিলে পিতলের সাথে স্বর্ণের আর কোনো পার্থক্য থাকে না। স্বর্ণ দামি, এ কথা প্রচার করে একদল চতুর তোমাদের কাছ থেকে সম্পদ হাতিয়ে নিচ্ছে।]। গল্পের দাদীর উচ্চমার্গের দর্শনের সাথে কোনো তর্ক চলে না।

বইয়ের অন্যান্য গল্পগুলির তুলনায় বেশ দীর্ঘ গল্প ‘পাখির বাসা’। কোনো এক রমজান মাসে কোনো এক বাড়ির ছেলেরা তাদের বাড়ির ছোট্ট আমগাছে একটি পাখির বাসা আবিষ্কার করে। তারপর পাখিদের ঘিরে মানুষের জীবনের নানারকম ঘটনার দার্শনিক বিশ্লেষণ। “আমাদের শিশুরা, আমাদের বুড়োরা, কখন যে বন্দুকের ভক্ত হয়ে গেলো, আমরা টেরই পেলাম না। একটি বইয়ের চেয়ে একটি বন্দুক তাদেরকে বেশি উত্তেজনা দেয়। আকাশে ঘুড়ি দেখে এখন আর কেউ খুশি হয় না। শিশুরাও বুঝে গেছে, বন্দুকই আসল।“ [পৃ ৬৯]। “মানুষ কিছুতেই তার জন্মদিনের কথা মনে করতে পারে না। হয়তো এ শোকেই সে ঘটা করে জন্মদিন পালন করে।“ [পৃ ৭৫]। বর্ণনা শৈল্পিক হলেও মাঝেমাঝে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। কমলকুমার মজুমদারের ‘সুহাসিনীর পমেটম’-এর কথা মনে পড়ে।

বাংলাদেশের কাঠমোল্লারা দিনরাত বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করে। মাঝে মাঝেই ঘোষণা দেয় বিজ্ঞান বর্জনের। গলা ফুলিয়ে বিজ্ঞানের বিরোধিতা করে আবার একই গলায় ঘোষণা করে বিজ্ঞানের সব আবিষ্কার তাদের ধর্মের পবিত্র বই থেকেই হয়েছে। এসংক্রান্ত অনেক শক্তিশালী গদ্য রচিত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়। ‘বিজ্ঞান ছাড়া একদিন’ গল্পে লেখক সুনিপুণভাবে এঁকেছেন ধার্মিক আলিম মিয়ার বিজ্ঞান ব্যবহার না করে একটা দিন কাটাবার নিষ্ফল চেষ্টার রেখাচিত্র। “টাইলসের মেশিন নিশ্চয়ই কোনো ইহুদির বাচ্চা তৈরি করেছে। ওই ইহুদির বাচ্চা মহা ইবলিশ। মসজিদে মসজিদে সে টাইলস ঢুকিয়ে দিয়েছে। সবার নামাজ সূক্ষ্মভাবে বরবাদ করে দিচ্ছে।“ [পৃ ৭৯] বিজ্ঞানছাড়া একটি দিনও কাটাতে ব্যর্থ হয়ে আলিম মিয়ার বোধোদয় হয়, “ধর্মগ্রন্থ কোনো বিজ্ঞানগ্রন্থ নয়। মানুষ হীনম্মন্যতা থেকে ধর্মগ্রন্থকে বিজ্ঞানগ্রন্থ দাবি করে থাকে। পৃথিবীতে যখন কোনো কোরান শরীফ ছিলো না, তখনও বিজ্ঞান ছিলো। মানুষের মাঝে বৈজ্ঞানিক চিন্তার চর্চা ছিলো।“ [পৃ ৮২] লেখককে ধন্যবাদ গল্পের ভেতর হলেও এই সত্যি সোজাসুজি বলার জন্য।

জাপানের একটি টয়োটা করোলা গাড়ির বাংলাদেশে গিয়ে কী কী অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয় – তারই একটি সকৌতুক বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে ‘টয়োটা করোলা’ গল্পে। গাড়ি যদি কথা বলতে পারতো এরকমভাবেই বলতো। “টোকিওতে দেখিতাম, অফিসগুলোতে কেবলই সেবা উৎপাদন হইতো; আর এখানে দেখিতেছি, প্রতিটি অফিসেই রাতদিন টাকা উৎপাদন হইতেছে। কিন্তু এত টাকা উৎপাদন করিয়াও দেশটির টাকার অভাব কেন ঘুচিতেছে না, এ উত্তর খুঁজিয়া পাইলাম না।“ [পৃ ৮৮] বাংলাদেশের দায়িত্বজ্ঞানহীন পথচারীদের চরিত্রও ফুটে উঠেছে গাড়ির দৃষ্টিতে – “পথচারীদের কথা কী বলিবো! মশা যেমন কামড় মারিবার সময় কাহারও ঘুমের তোয়াক্কা করে না, এই পঙ্গপালেরাও তেমনি রাস্তা পার হইবার সময় নিজের জীবনের কোনো পরোয়া করে না। দৌড় মারিয়া, হেলিয়া দুলিয়া, কতো কসরত ও নাটক করিয়া যে ইহারা রাস্তার এ পাড় হইতে ওই পাড়ে যায়, তাহা বর্ণনা করিতে গেলে কয়েক দিস্তা কাগজ লাগিবে।“ [পৃ ৯০] “পায়ে হাঁটা দূরত্বেও গাড়ি-রিকশা ব্যবহার করিতেছে। পরিণামে অল্পদিনেই মোটাসোটা হইয়া ডায়াবেটিস বাঁধাইয়া অকেজো মাংস রূপে অন্ধকার ঘরে লুটাইয়া পড়িতেছে।“ [পৃ ৯১]

‘জার্নি বাই বাস’ গল্পটিকে প্রেমের গল্প বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন প্রকাশক বইয়ের শুরুতে ভূমিকায়। বাস ভ্রমণে সহযাত্রীর প্রেমে পড়ে যাওয়ার ঘটনা গল্পে নতুন নয়। এরকম গল্প হাজার জন হাজারবার লিখেছেন এর আগে। কিন্তু এই গল্পের বিবরণে নিজের তারুণ্যের সময়ে বাংলা সিনেমা দেখার কিছু উদাহরণ দেখে নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম। “নায়ক্ জসিম যে-কালে উপর্যুপরি লটারি জিতিয়া ভ্যানচালক হইতে আচমকা কোটিপতি পদে উন্নীত হইতো, বাড়িগাড়ি করিয়া আসমানে হুলস্থুল ফেলিয়া দিতো …” [পৃ ৯৩] নায়িকার দৃষ্টি আকর্ষণ করার আগ্রহে নিজের পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান জাহির করার উদ্দেশ্যও কেমন যেন পরিচিত মনে হলো – “একবার ভাবিলাম, মোবাইল কানে লাগাইয়া ফেইক-কলে কাহারও সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্স লইয়া আলাপ করি। আবার ভাবিলাম, জেনারেল রিলেটিভিটির কোনো ইউটিউব ভিডিও ফুল ভলিউমে ছাড়িয়া দিই।“ [পৃ ৯৫]

বইয়ের শেষ গল্প ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স’। বাংলাদেশে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবার জন্য কী কী করতে হয় তা আমার ছিল না। কিন্তু এই গল্প পড়ে আঁৎকে উঠেছি বিআরটিএ নামক প্রতিষ্ঠানটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুষ খাওয়ার আয়োজন দেখে। শুধু তাই নয়, গল্পের ভেতরই মারাত্মক প্রশ্ন উঠে এসেছে – “গাড়ি চালাইতে লাইসেন্স লাগিলেও দেশ চালাইতে কোনো লাইসেন্স লাগে না। একটি ছোট চার চাকার যান চালাইতে এত টেস্ট, এত আয়োজন, অথচ এমন বিশাল দেশখানা যাহারা চালাইতেছে, তাহাদিগকে কোনো পরীক্ষার ভেতর দিয়া যাইতে হইতেছে না। দেশের স্টিয়ারিংয়ে বসিবার যোগ্যতা তাহাদের আছে কি না, দেশটি খাদে পড়িলে টানিয়া তুলিবার কৌশল তাহারা জানে কি না, এ সত্য যাচাই না করিয়াই রাষ্ট্ররূপী গাড়িটিকে মন্ত্রী নামক ড্রাইভারদের হাতে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে।“ [পৃ ১০২]

ভাষাশৈলীর কারণে প্রত্যেকটি গল্পই উপভোগ্য এবং ভাবনা জাগানিয়া – এবং লেখক সেকারণেই সার্থক। তবুও বইয়ের শুরুতে প্রকাশকের কথা এবং লেখকের কথা নিয়ে দুএকটি কথা না বললে নিজের অনুভূতির সাথে প্রতারণা করা হবে।

প্রকাশকের কথায় জ্ঞানকোষ প্রকাশনীর প্রকাশক শাহীদ হাসান তরফদার ডক্টর আশিষ পালের জবানিতে লিখেছেন, “বাংলা সাহিত্য রবীন্দ্রনাথে থেমে আছে, এ কথাটি আজ এই পাণ্ডুলিপি পড়ে আমার ভেতর থেকে দূর হয়ে গেল।“ ডক্টর আশিষ পাল সম্ভবত এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি যে কজন পড়েছেন তাঁদের একজন। তাঁর লেখা কিছুই আমি পড়িনি। তাঁর সাহিত্যবিবেচনাবোধ সম্পর্কেও আমার কোন ধারণা নেই। কিন্তু তিনি যদি এই বইকে রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী অন্যসব রচনার উর্ধ্বে স্থান দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ বলে থাকেন, তাহলে তাঁর বিবেচনাবোধে আমার আস্থা নেই। প্রকাশক পাঠকদের সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন – “অনেক কাঁচা পাঠক আছেন, যারা নাম পুরুষে বর্ণনা করা গল্পের ভাষ্যকারের কন্ঠকে লেখকের নিজস্ব প্রাবন্ধিক কন্ঠ মনে করে তালগোল পাকাতে পারেন।“ – তার কি কোন দরকার ছিল? লেখা পাঠ করার পর পাঠক কে কী ভাববেন তাও ঠিক করে দিতে হবে? পাঠকের বোধশক্তি সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করলেই কি গল্পের গুণগত মান বেড়ে যাবে? আর গল্পগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণের সাথে যে পৃষ্ঠা নম্বর দেয়া আছে তার সাথে মূল পৃষ্ঠা নম্বরের মিল নেই।

লেখকের কথায় লেখক নিজের লেখার স্টাইল আর যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তার সপক্ষে কথা বলতে গিয়ে কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা বিনাবাক্যে মেনে নেয়া যায় না। তিনি লিখেছেন, “শিল্প সাহিত্যের শূন্য গোয়ালে গরু সেজে হানা দিচ্ছে ছাগল।“ প্রশ্ন হলো শিল্প-সাহিত্যে কে গরু, কে ছাগল তা নিরুপন করবেন কে? লেখক নিজেকে এই গোয়ালের উন্নততম গরু ঘোষণা করলেই কি তিনি হয়ে গেলেন, আর তাঁর সমসাময়িক সবাই ছাগল হয়ে গেল? এই বইতে তিনি সাধু আর চলিত ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি খিঁচুড়িভাষা তৈরি করেছেন এবং বলছেন তা অতীব সুস্বাদু এবং মসৃণ হয়েছে। এই জগাখিচুড়ির পক্ষে বলতে গিয়ে বলছেন, “আমি বিশুদ্ধবাদের দালাল নই। সবসময় বিশুদ্ধবাদিতার চাকর সেজে থাকা একজন সৃষ্টিশীল লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়।“ বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে লেখার নাম যদি বিশুদ্ধবাদের দালালি করা হয় বা বিশুদ্ধবাদিতার চাকরি করা হয়, তাহলে অশুদ্ধভাবে লেখার নামই কি হবে সৃষ্টিশীলতা? অন্য কেউও যদি যেকোনকিছু অশুদ্ধভাবে লিখে যদি দাবি করেন যে শুদ্ধবাদিতার চাকর তিনি নন – তাহলে কি মেনে নেয়া হবে?

লেখক সাহিত্য সমালোচকদেরও খাটো করেছেন তাঁদেরকে ‘কিছু নির্দিষ্ট নামের খাদেম’ বলে। তিনি আরও বলেছেন, “আমি অবাক হবো না, যদি এ বইয়ের আলোচনায় কেউ অপ্রাসঙ্গিকভাবে কোনো মিনি-ফ্রয়েড বা মিনি দস্তয়েভস্কিকে টেনে আনেন।“ আমার পড়াশোনা খুবই সীমিত। ফ্রয়েড এবং দস্তয়েভস্কি সামান্যই পড়েছি – তাতে এই লেখকের কোন গল্পেই তো তাঁদের নাম মনে পড়লো না। প্রচন্ড আত্মগরিমা থেকেই তিনি এসব লিখে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিজে দাবি করেছেন। তবে “কাঁচা পাঠক” যদি লেখকের নিজের কথা “বাঙালি যে-রূপে দুই কলম লেখাপড়া শিখিয়া রবীন্দ্রনাথের জন্মদাত্রী সাজে, ডিকনস্ট্রাকশন, পোস্ট-কলোনিয়াল, সাব-অল্টার্ন, ফ্যাটালিজম, প্রভৃতি জার্গন মুখস্থ করিয়া বুদ্ধিজীবীর উর্দি পরিধান করিয়া থাকে, সে-রূপে শুক্র গ্রহটি তাহার আসল রূপ লুকাইয়া স্টার হইয়া মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করিতেছে।“ [পৃ ৩৬] – ব্যতিক্রমহীনভাবে সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য মনে করে বসে!

Thursday, 20 March 2025

মহিউদ্দিন মোহাম্মদের 'আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র'

 




বেশ কয়েকদিন ধরে একটানা পড়ে শেষ করলাম মহিউদ্দিন মোহাম্মদের পাঁচটি বই। কোনো একজন লেখকের প্রকাশিত ছয়টি বইয়ের মধ্যে পাঁচটি পড়ে ফেলা – কম কথা নয় আমার জন্য। বিশেষ করে যেখানে দীর্ঘদিন বাংলা পরিমন্ডলের বাইরে থাকলে – বাৎসরিক বইমেলা থেকে দূরে থাকতে হলে – বই তো দূরের কথা, বইয়ের খবরও যথাসময়ে এসে পৌঁছায় না। 

হিশেব করে দেখা যাচ্ছে এই লেখকের প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে ২০২২ সালে। কম সময়ের মধ্যেই তিনি বিপুলভাবে আলোচিত হয়েছেন। বাংলাদেশি পাঠকদের মধ্যে আলোচনায় কীভাবে থাকতে হয় তা তিনি ভালো করে জানেন বলেই মনে হলো তাঁর বইগুলি পড়ে। 

কোনো বই পড়ে আমার নিজের কেমন লাগলো তা লিখে রাখি আমার নিজের জন্যই। কারণ আমার স্মৃতি খুব বেশিদিন সবল থাকবে এমন বিশ্বাস আমার নেই। মহিউদ্দিন মোহাম্মদের বইগুলি পড়েও কেমন লাগলো একে একে বলছি। 

লেখক কোন্‌ লেখা কখন লিখেছেন তা নিজে না বললে অন্য কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু পাঠক হিসেবে কোনো লেখকের যদি একাধিক বই হাতে আসে – আমি চেষ্টা করি প্রকাশকালের ক্রমানুসারে বইগুলি পড়তে। সেভাবেই শুরু করলাম ‘আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র’ দিয়ে। 

বই হাতে নিয়েই বুঝলাম আক্ষরিক অর্থেই বেশ মজবুত বই। শক্ত মলাট, মজবুত বাঁধাই, ঝকঝকে কাগজ। জ্ঞানকোষ প্রকাশনীর সব বইয়েরই অঙ্গসৌষ্টব এরকম জোরালো কিনা জানি না। তবে মহিউদ্দিন মোহাম্মদের সব বই বেশ সযত্নে প্রকাশিত। ভালো লাগলো আমাদের দেশের প্রকাশনা শিল্পের এই দিকটির উন্নতি দেখে।

‘আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র’র যে সংস্করণটি আমি পড়লাম তা ষষ্ঠ সংস্করণ। ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়ে ২০২৪ এর জুনে বইয়ের ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। এতগুলি সংস্করণে কী কী সংস্কার করা হয়েছে তা লেখা থাকে প্রতিটি সংস্করণের ভূমিকায়। কিন্তু এই বইতে একটিই ভূমিকা আছে এবং সেটার সময়কাল দেখে বুঝতে পারি তা প্রথম সংস্করণের। বোঝার উপায় নেই সংস্করণ আর পুনর্মূদ্রণের মধ্যে আসলেই কোন পার্থক্য ছিল কি না। 

উৎসর্গের পাতাতেই চমকে দিয়েছেন লেখক – বইটি আল্লাহকে উৎসর্গ করে। আল্লাহকে এর আগে আর কেউ কোন বই উৎসর্গ করেনি এমন নয়। তবে মহিউদ্দিন মোহাম্মদ যে যুক্তি দেখিয়েছেন – ‘কারণ তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করা যায় না’ – তা অভিনব। কেন দ্বিমত করা যায় না – সে প্রশ্ন এখানে তোলা নিরর্থক, কারণ উৎসর্গের ব্যাপারটি লেখকের এতটাই নিজস্ব যে সেখানে পাঠকের কোন কিছু বলার থাকে না, বলা উচিতও নয়। 

প্রকাশক শাহীদ হাসান তরফদার একটি দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন এই বইয়ের। অবশ্য তার বেশিরভাগ পাতা জুড়ে আছে লেখকেরই দীর্ঘ কবিতা ‘মাংস নয়, হাড়ের মুক্তি চাই’। কবিতাটিও এই বইয়ের অংশ হয়ে উঠেছে যদিও বইটি লেখকের আধুনিক গদ্যের সংকলন। 

প্রকাশক তাঁর কথার শুরুতেই লিখছেন, “মগজে গুঁতো খাওয়ার ভয়ে অনেকে মহিউদ্দিন মোহাম্মদের লেখা পড়তে চান না।“ খটকা লাগলো। এই বই যদি লেখকের প্রথম বই হয়, তাহলে পাঠকদের মগজে গুঁতো দেয়ার ব্যাপারটি লেখক কোথায় করলেন? হয়তো অনলাইনে কিংবা ফেসবুকে – যা সেইসময় আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। বইতে যেসব বিষয়ে লেখা সংকলিত হয়েছে তার সবগুলিই সমসাময়িক, এবং ধারণা করা যায় তার কিছু কিছু হয়তো বইতে সংকলিত হবার আগে অন্য কোথাও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সে সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়া হয়নি। প্রকাশক লেখক সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। কোনো বই সম্পর্কে সেই বইয়ে প্রকাশিত প্রকাশকের কিংবা আলোচকদের প্রশংসাবাণীতে খুব বেশি ভরসা রাখা যায় না। কারণ এই প্রশংসা মূলত ব্যবসায়িক। কোনো প্রকাশক নিশ্চয় তাঁর নিজস্ব প্রকাশনার কোন বই সম্পর্কে নিন্দা করবেন না। তবুও এটা ভালো লাগলো যে প্রকাশক তাঁর লেখকের বই প্রকাশ করার আগে পড়ে দেখেছেন। আমি বাংলাদেশের একাধিক প্রকাশককে গর্ব করে বলতে শুনেছি যে তাঁরা বই পড়তে পছন্দ করেন না। জ্ঞানকোষ প্রকাশনীর প্রকাশক সেরকম নন জেনে খুশি হলাম। 

বইয়ের দুটি অংশ – সংজ্ঞাবলীর পদাবলী এবং সূর্যগ্রহণ। প্রথম একুশটি রচনা সন্নিবেশিত হয়েছে সংজ্ঞাবলীর পদাবলীতে এবং দশটি রচনা সন্নিবেশিত হয়েছে সূর্যগ্রহণ অংশে।

প্রথম অংশের লেখাগুলি সংক্ষিপ্ত কিন্তু জোরালো বক্তব্যের বারুদে ঠাসা। প্রসঙ্গ পরিচিত – কিন্তু উপস্থাপনার ভাষা নতুন এবং নিপুণ। ‘ভুঁড়ি হলো একজনের শরীরে বেড়ে ওঠা আরেকজনের মাংস’, ‘বাঙালি শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে ব্যাঙ থেকে’, ‘মানুষ প্রভুভক্তিতে কুকুরদেরও ছাড়িয়ে গেছে’, ‘প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র গাধাই যুক্তিবাদী’, ‘শয়তান তার গাড়িতে বিশেষ স্টিকার লাগিয়ে রাখে। স্টিকারে লেখা থাকে – “শয়তান”, ‘সত্যকে ঢিল মারলে পাওয়া যায় লোভনীয় পুরষ্কার’, ‘সময়ই একমাত্র শিক্ষক, যিনি পাঠদান শেষে তার ছাত্রদের মেরে ফেলেন’, ‘কৃষক হলেন ধানক্ষেতের ক্রীতদাস’, ‘শিক্ষক হবো – এই স্বপ্ন এখন আর কেউ দেখে না’, - এসব বাক্য ঝকঝকে ছুটির ফলার মতো, যেমন চকচকে তেমনই ধারালো। 

মানুষের বোধ জাগ্রত করাই লেখকের দর্শন, কিন্তু গতানুগতিক একঘেঁয়ে দার্শনিক তত্ত্বের বদলে তাঁর উপস্থাপনা ব্যতিক্রমী এবং আকর্ষণীয়। “সমাজকে যেদিন আমি একটি লাথি কম দিই, সমাজ সেদিন আপনাদের ঘাড়ে একটি কামড় বেশি দেয়।“ 

“তারুণ্যের প্রধান কাজ – বুড়ো মানুষের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা।“ যে সময়ে এই বাক্য রচিত হয়েছিল – তার তিন বছরের মধ্যেই যে তরুণরা অশীতিপর বুড়োদের ডেকে নিয়ে আসবে কর্তৃত্ব করার জন্য – তা কি লেখক জানতেন?

আধুনিক গরু-রচনা সমগ্রে সত্যি সত্যিই ‘গরু’ শিরোনামের একটি অভিনব রচনা আছে যেখানে বর্ণিত হয়েছে কঠিন সত্য – ‘ক্ষমতাহীন সকল প্রাণীই গরু’। 

সবগুলি রচনাই সুখপাঠ্য, চিন্তা জাগানীয়া। লেখক এখানে সফল। যেসব কথা সরাসরি বলতে চাননি – রূপক ব্যবহার করে বলেছেন। “মুরগিদের নিয়ে অসুবিধা হলো – তারা তাদের জনসভায় সবসময় প্রধান অতিথি করে থাকে একজন শিয়ালকে।“ – পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না, মুরগি কারা, আর শেয়াল কোন্‌জন। 

“বাদুড়ের দাঁত” রচনায় একটি তথ্যগত ভুল আছে। লেখক প্রচলিত বিশ্বাসকে তদন্ত না করেই লিখে ফেলেছেন “বাদুড় যে-পথে মলত্যাগ করে সে-পথেই খাবার গ্রহণ করে”। বাদুড় মাথা নিচু করে ঝুলে থাকে বলে অনেকেই মনে করে এরকম। আসলে বাদুড় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সব রকম শারীরিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণি। তাদের মলদ্বার আছে এবং মলদ্বার দিয়েই মল ত্যাগ করে, মুখ দিয়ে নয়। 

সূর্যগ্রহণ পর্বের প্রবন্ধগুলি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ। ‘মানুষ ও অন্ধকারের প্রশংসা’ নিজেই একটি স্বতন্ত্র বই হতে পারতো কয়েক ফর্মার। এই প্রবন্ধের মানুষগুলি মূলত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষ, যারা বিশ্বাস করে অলৌকিক ক্ষমতায়। বিভিন্ন ধরনের গোঁড়ামির গোলামি তারা করে ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। “যে সমাকে গোঁড়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সে সমাজ চিলের সমাজ। ওখানে বাঁচতে হয় মুরগির ছানার মতো লুকিয়ে লুকিয়ে।“ কী চমৎকার সত্য বলেছেন আমাদের সমাজ সম্পর্কে আমাদেরই সমাজ থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো এই লেখক।

মানুষ সম্পর্কে লেখকের পর্যবেক্ষণ অসাধারণ। “মানুষ যে সম্পদ অর্জন করে, তার নব্বই শতাংশই সে ভোগ করতে পারে না। কিন্তু এই অতিরিক্ত সম্পদ অর্জন করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে মূল্যবান স্বাস্থ্য ও সুখ। সে বাঁচে পঞ্চাশ বছর, কিন্তু টাকা উপার্জন করে এক হাজার বছরের।“ 

এই লেখায় লেখক মানুষ হিসেবে নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে উন্নততর বলেও দাবি করেছেন। লেখক হিসেবেও নিজেকে অন্য লেখকদের চেয়ে ভালো দাবি করে লিখেছেন, “লেখক হিশেবে আমাকে যারা হিংসা করেন, তারা জানেন যে, তাদের চেয়ে আমার লেখার দীর্ঘায়ু হওয়ার সক্ষমতা বেশি।“ [পৃ ১২৪] এটিকে অহংকার বলবো কি না জানি না। কারণ এই দাবি বড়ই ব্যক্তি নির্ভর। তিনি কোন্‌ লেখকের সাথে নিজের তুলনা করছেন তা খোলাসা করেননি। প্রয়াত হুমায়ূন আজাদও যখন তখন নিজেকেই সেরা দাবি করতেন। 

প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য খুবই বিরূপ এবং তীব্র। শিক্ষাকে তিনি রাজনীতির হাতিয়ার বলে মনে করেন। মনে করেন “জাতীয় সংগীত ধীরে ধীরে শিশুদের চিন্তা ও প্রতিবাদ করার শক্তি কেড়ে নেয়।“ কিন্তু তিনি যেভাবে বলেছেন জাতীয় সংগীতের কারণেই শিশুরা ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে , ভালো ও খারাপের মধ্যে, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে, ঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না, তা কি পুরোপুরি ঠিক? জাতীয় সংগীতের ফলেই মানুষ হিসেবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও চিন্তার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে [পৃ ১৩৩] – তা কি অতিশয়োক্তি নয়? 

বাংলাদেশের সরকারি স্কুলের শিশুপাঠ্য বইগুলির তীব্র সমালোচনা করেছেন লেখক। তা করতেই পারেন। তবে ঠিক কোন্‌ দেশের বইকে তিনি আদর্শ বই বলে মনে করেন তা বোঝা গেল না।  বইগুলির লেখক সম্পাদকদের নাম সরাসরি উল্লেখ না করে বিভিন্ন অপমানজনক বিশেষণ প্রয়োগ করে কঠোর ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন (পৃ ১৪৯) যা সুরুচির পরিচয় বলে আমার মনে হয়নি। 

জিপিএ ফাইভ ও জুতোর ফ্যাক্টরি প্রবন্ধে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি এবং গ্রেডিং সিস্টেমকে তুলোধুনা করেছেন লেখক। লিখেছেন, “কিছু কাগজ ও চকের ধুলো ছাড়া এ পদ্ধতিতে শিক্ষক ও ছাত্রের মাঝে আর কিছুর বিনিময় ঘটে না।“ [পৃ ১৬৭]। কিন্তু আদর্শ পদ্ধতি বলে কি কিছু আছে? যদি না থাকে, তাহলে কিসের ভিত্তিতে কোন পদ্ধতিকে ভালো কিংবা খারাপ বলা হবে – সে প্রশ্ন লেখক এড়িয়ে গেছেন। 

লেখক গবেষণার প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি – পিএইচডির উৎপত্তির ইতিহাস এবং পিএইচডি ডিগ্রি সম্পর্কে অত্যন্ত ঋণাত্মক মতবাদ দিয়েছেন “ছাগল ও তার পিএইচডি ডিগ্রি” প্রবন্ধে। বাংলাদেশের অনেকে টাকা দিয়ে এই ডিগ্রি নিয়েছেন, অন্যের লেখা নকল করে থিসিস লিখেছেন এরকম কলংকের আলোকে এরকম সমালোচনা করার যুক্তি লেখকের আছে। কিন্তু ঢালাওভাবে ডিগ্রিটাকেই অদরকারি বলে ফেললে অতিরিক্ত বলা হয়ে যায়।

‘আমাদের ইশকুল, আমাদের গোরস্থান’ রচনায় লেখক কীরকম স্কুল চান, কেমন স্কুল আদর্শ স্কুল তার কিছুটা বর্ণনা দিয়েছেন। বলেছেন বাংলাদেশে যে স্কুলিং প্রথা চালু আছে তা পুরোপুরি বদলে ফেলতে হবে। “বর্তমান ইশকুলগুলোকে বিক্রি করে, অথবা ভেঙে ফেলে, নতুন ইশকুল নির্মাণ করা”- যাতে শিশুরা স্কুলে যেতে আনন্দ পায়। ভালো স্কুল এবং স্কুলিং বোঝানোর জন্য লেখক অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের একটি স্কুল পরিদর্শন করার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। ঘটনাচক্রে আমি অনেক বছর থেকে এই শহরটিতে থাকি এবং এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে আমার কিছুটা পরিচয় আছে। সে সূত্রে আমি বলতে পারি লেখক মেলবোর্নের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে তুলনায় এগিয়ে রাখতে গিয়ে একটু বেশি প্রশংসা করে ফেলেছেন। লেখক ঠিক কী হিসেবে মেলবোর্নের বিদ্যালয় পরিদর্শন করলেন এবং প্রিন্সিপাল তাঁকে এত দীর্ঘ সময় নিয়ে সবকিছু দেখালেন – তা পাঠকদের বললে বুঝতে সুবিধা হতো। বলাবাহুল্য মেলবোর্নের সরকারি স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমরাও এখানে উদ্বিগ্ন। এখানকার স্কুলের শিক্ষকরা এত কম বেতন পান যে – সুযোগ পেলেই শিক্ষকতা ছেড়ে অন্য কোন পেশায় চলে যান এখানকার শিক্ষকরা। 

বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষ এখনও মনে করে নারীর পোশাকের কারণেই ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে সেখানে। অথচ ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এর পক্ষে কোন সুযুক্তি পাওয়া যায় না। লেখক এসমস্ত ব্যাপারের যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন “ধর্ষণের সাথে পোশাকের সম্পর্ক” প্রবন্ধে। “ধর্ষণ তখনই ঘটে, যখন ধর্ষক বুঝতে পারে যে ধর্ষণ করার পরও সে নিরাপদে থাকবে। এ জন্য সে প্রথমেই যাকে ধর্ষণ করবে তার ক্ষমতা মেপে নেয়“ [পৃ ২০৪]। “বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে ক্ষমতা কাঠামো আছে, তাতে একজন মন্ত্রীর মেয়ের ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা, একজন কৃষকের মেয়ের ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে অনেক কম” [পৃ ২০৫]। খুবই নির্মম সত্য কথা। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু ব্যতিক্রমও কেন ঘটে যায়, যেমন ১৯৯৮ সালে ঘটা শাজনীন হত্যার ঘটনা, তার ব্যাখ্যা মেলে না। 

“আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েরা” রচনায় যৌক্তিকভাবেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সমালোচনা করেছেন লেখক। সংগতকারণেই জোরালো শ্লেষাত্মক প্রশ্ন করেছেন, “একটি সেতু নির্মাণ করতে রাষ্ট্র খরচ করেছে চল্লিশ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য এক থালা ভালো ভাত ও একটি ভালো কক্ষের ব্যবস্থা রাষ্ট্র করতে পারেনি [পৃ ২২১]”। 

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমালোচনা করার ক্ষেত্র তৈরি করার উদ্দেশ্যে লেখক তাইওয়ানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ ঔদার্যপূর্ণ সুনাম করেছেন লেখক। বিদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে কিংবা হঠাৎ দেখতে গেলে সবকিছু সুন্দরই মনে হয়, ফাঁকফোকরগুলি চোখে পড়ে না। ওখানেও যে অনিয়ম – বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম মাত্রার হলেও – চলে তা হঠাৎ দেখায় দেখা যায় না। উন্নত দেশের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে পরিমাণ বেতন দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়তে হয়, সেই তুলনায় আমাদের দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মোটামুটি অবৈতনিক – এটি অস্বীকার করলে অন্যায় করা হয়। 

সবশেষের অধ্যায় “আঠারোটি পাউরুটি” আসলে হুমায়ূন আজাদের প্রবচনগুচ্ছের অনুকরণে আঠারোটি প্রবচন। যার আঠারো নম্বর “আইন জিনিসটি বেশ অদ্ভুত। যেমন – রাস্তায় কুকুর হিস্যু করতে পারবে, কিন্তু মানুষ থুথু ফেলতে পারবে না।“ – ঠিক কী কারণে এটি বলা হলো বুঝতে পারলাম না। লেখক কি মানুষের রাস্তায় থুথু ফেলার অধিকার চাচ্ছেন? 

সব মিলিয়ে বলতে গেলে বলা যায় – বেশ ভালো লেগেছে মহিউদ্দিন মোহাম্মদের আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র। লেখকের ভাষা চমৎকার, বক্তব্য পরিচ্ছন্ন। বইয়ের সম্পাদনায় কিছু ত্রুটি আছে, মনে হয়েছে যা কিছু লেখা হয়েছে সবই বইতে ঠেসে দিয়ে দেয়া হয়েছে – তাই কিছু কিছু জায়গা খাপছাড়া লেগেছে। 

লেখক পরিচিতিতে এসে লেখক নিজের ছবির বদলে তাঁর মায়ের ছবি দিয়েছেন। আর বলেছেন লেখকের পরিচয় তাঁর লেখা থেকেই খুঁজে নেয়া উচিত। তিনি কী কী ডিগ্রি অর্জন করেছেন, কী করেন তাতে কিছুই যায় আসে না। এক্ষেত্রে লেখকের সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করতে বাধ্য হচ্ছি। লেখক যদি সৃজনশীল কোন সাহিত্য রচনা করেন তাতে তাঁর ভাষা এবং শৈল্পিক নির্মাণদক্ষতাই তাঁর পরিচয়। সেখানে তাঁর নামও যদি না থাকে কোন সমস্যা হয় না। অনেকেই ছদ্মনামে লেখেন। জেন অস্টিনের সবগুলি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর নাম ছাড়াই। তাতে কারো কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু লেখক যখন প্রবন্ধ লেখেন, বিজ্ঞান লেখেন, দর্শন লেখেন, এবং লেখায় নিজের সম্পর্কে কোনো কিছু দাবি করেন – পাঠকের অধিকার জন্মায় সেগুলির সত্যতা যাচাই করে দেখার। লেখক যদি জ্ঞান দেন, পাঠকের অধিকার আছে যাচাই করে দেখার যে লেখকের জ্ঞান দেয়ার যোগ্যতা কীভাবে অর্জিত হয়েছে। মহিউদ্দিন মোহাম্মদ তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় হিসেবে যেসব কথা লেখার মধ্যে লিখেছেন – যেমন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপার্জন করা তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন [পৃ ৯০], লুঙ্গি পরে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, বিমানে উঠেছেন [পৃ ৯২], ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাল প্যান্ট পরে যেতেন [পৃ ৯৪], শৈশবে মাদ্রাসায় পড়েছেন [পৃ ৯৭] – এগুলির সত্য-মিথ্যা কীভাবে প্রমাণিত হবে যদি মূল পরিচয় গোপন করা হয়? 

Friday, 14 March 2025

জামাল নজরুল ইসলাম: মহাবিশ্বের নিয়তির সন্ধানে

 




বিজ্ঞানজগতে বাংলাদেশের গর্ব বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও কসমোলজিতে তাঁর যুগান্তকারী অবদান রয়েছে। তাঁর মৌলিক গবেষণাগুলিকে প্রধানত পাঁচটি ধাপে ভাগ করা যায়: কণা পদার্থবিজ্ঞানের ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশানের গাণিতিক বিশ্লেষণ, জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল সমীকরণের সঠিক সমাধান, মহাজাগতিক ধুলোকণার ক্ষেত্র সমীকরণের সমাধান, মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি, এবং গাণিতিক অর্থনীতি।

জামাল নজরুল ইসলামের মৌলিক গবেষণা শুরু হয় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি শুরু করার সময় থেকে। তাঁর পিএইচডি সুপারভাইজার ছিলেন জন ক্লেটন টেইলর। ব্রিটিশ গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী জন টেইলর ছিলেন প্রফেসর আবদুস সালামের ছাত্র। ১৯৫৬ সালে প্রফেসর আবদুস সালাম এবং রিচার্ড ইডেনের তত্ত্বাবধানে তিনি কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরিতে পিএইচডি করেছেন। এরপর যোগ দিয়েছিলেন লন্ডনের ইম্পেরিয়েল কলেজে প্রফেসর আবদুস সালামের ডিপার্টমেন্টে। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত সেখানে অধ্যাপনার পর ১৯৬১ সালে যোগ দিয়েছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্স ও থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে লেকচারার হিসেবে। সেই বছরই সেখানে পিএইচডি গবেষণা শুরু করলেন জামাল নজরুল ইসলাম। জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন জন টেইলরের প্রথম পর্যায়ের ছাত্রদের একজন। জামাল নজরুল ইসলাম তখন মাত্র ২২ বছরের তরুণ, আর তাঁর সুপারভাইজার জন টেইলর তখন ৩১ বছরের যুবক।

জামাল নজরুল ইসলাম পিএইচডি গবেষণার কাজ শুরু করলেন ১৯৬১ সালে। গাণিতিক দক্ষতায় তুখোড় জামাল নজরুল ইসলামের আগ্রহ পার্টিক্যাল ফিজিক্সের সমসাময়িক গাণিতিক সমস্যার সমাধানের প্রতি। কাজ শুরু করলেন মাত্র তিন বছর আগে ১৯৫৮ সালে উদ্ভাবিত “ম্যান্ডেলস্ট্যাম ভ্যারিয়েবল নিয়ে গবেষণা।

যাঁর নামে এই ভ্যারিয়েবল – সেই প্রফেসর স্ট্যানলি ম্যান্ডেলস্ট্যাম তখন ইংল্যান্ডেই ছিলেন। বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিক্সের প্রফেসর ছিলেন তখন। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে  জন্ম স্ট্যানলি ম্যান্ডেলস্ট্যামের। বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন ১৯৫৬ সালে। ১৯৫৮ সালে পোস্টডক্টরেট ফেলোশিপ করার সময়েই তিনি কণা পদার্থবিজ্ঞানে রিলেটিভিস্টিক তথা আপেক্ষিকতার আলোকে গাণিতিক হিসেবের সুবিধার্থে উদ্ভাবন করেছেন একটি বিশেষ সুবিধাজনক পদ্ধতি যা তাঁর নামেই পরিচিতি লাভ করেছে – ‘ম্যান্ডেলস্ট্যাম ভ্যারিয়েবলস। দুটো কণার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ঘটার সময় তাদের শক্তি, ভরবেগ এবং পারস্পরিক কৌণিক অবস্থান সবগুলিকে কার্যকরভাবে গাণিতিক সমীকরণে প্রকাশ করার জন্য ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশান খুবই কার্যকরী।

ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশান উদ্ভাবনের দশ বছর আগে ১৯৪৮ সালে আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের হিসেবনিকেশ সহজ করার জন্য উদ্ভাবন করেছেন ‘ফাইনম্যান ডায়াগ্রামএর। ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশানও অনেকটা সেরকম পদ্ধতি হলেও ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর প্রথম গবেষণাতেই চতুর্মাত্রিক ফাইনম্যান ডায়াগ্রামের সাথে ম্যান্ডেলস্ট্যাম পদ্ধতির সমন্বয় ঘটালে কী হয় – তা গাণিতিকভাবে করে দেখাতে সমর্থ হলেন। ১৯৬২ সালের ১৮ মে তিনি জার্নাল অব ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিক্সে প্রকাশের জন্য পাঠালেন তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র Modified Mandelstam Representation for Heavy Particles। সেবছরই নভেম্বর-ডিসেম্বর সংখ্যায় তা প্রকাশিত হয়। [Journal of Mathematical Physics, Volume 3, Number 6, November-December 1962, pages 1098-1106.]

জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর প্রথম গবেষণাপত্রে ম্যান্ডেলস্ট্যামের পদ্ধতি অনেক ভারী কণার উপর প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন যে ভারী কণার ক্ষেত্রে ফোর্থ অর্ডার ফাইনম্যান অ্যামপ্লিটিউড কাজ করে না। এই গবেষণায় তিনি বার্গম্যান-ওয়েইল ফরমুলা ব্যবহার করেছেন। অনেকগুলি গাণিতিক চলক বা ম্যাথমেটিক্যাল ভ্যারিয়েবলকে একসাথে সমন্বয় করে ইন্টিগ্রেল ফরমুলায় ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বার্গম্যান-ওয়েইল ফরমুলা খুবই কার্যকর গাণিতিক পদ্ধতি। ১৯৩৫ সালে ফরাসি গণিতবিদ আঁন্দ্রে ওয়েইল এবং ১৯৩৬ সালে পোলিশ-আমেরিকান গণিতবিদ স্টিফেন বার্গম্যান আলাদা আলাদাভাবে এই ফরমুলা আবিষ্কার করেন।

প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর দ্বিতীয় গবেষণাপত্র ‘ Acnodes and Cusps and the Mandelstam Representation’ প্রকাশের জন্য পাঠান জার্নাল অব ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিক্সে। ১৯৬৩ সালের জুলাই সংখ্যায় তা প্রকাশিত হয়। [Journal of Mathematical Physics, Volume 4, Number 7, pages: 872-878, July 1963.] এই গবেষণাতেও তিনি ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম এবং ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশান এর সমন্বয়ের সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ করেন ল্যান্ডাউ সমীকরণে প্রয়োগের মাধ্যমে। কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরিতে কণার বিক্ষেপণের মাত্রা হিসেব করার জন্য ফাইনম্যান ইন্টিগ্রেলের শর্তগুলি নির্ধারিত হয় ল্যান্ডাউ সমীকরণের মাধ্যমে। সোভিয়েত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী লেভ ল্যান্ডাউ ১৯৬২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন তরল হিলিয়ামের সুপারফ্লুইডিটি আবিষ্কারের জন্য।

১৯৬২ সালে প্রফেসর জন টেইলরের গ্রুপে যোগ দেন সদ্য পিএইচডি অর্জন করা ব্রিটিশ তরুণ পিটার ভিনসেন্ট ল্যান্ডশফ। জামাল নজরুল ইসলামের গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় অংশ নিতে পিটারও খুব আগ্রহী। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই জন টেইলর, পিটার ল্যান্ডশফ এবং জামাল নজরুল ইসলাম যৌথভাবে তৈরি করে ফেললেন গবেষণাপত্র ‘Singularity of the Regge Amplitude’.

ইতালির তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী টুলিও রেজ্জে ১৯৫৯ সালে স্ক্যাটারিং মেট্রিক্স প্রপার্টিজ গবেষণাপত্রে প্রকাশ করেছেন উচ্চশক্তির কণার বিক্ষেপণের সূত্র – রেজ্জে থিওরি। রেজ্জে অ্যামপ্লিচিউড হিসেব করা হয় বিক্ষেপণের মাত্রা থেকে। কণাপদার্থবিজ্ঞানের একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ছিল এই গবেষণাপত্রটি যেটা পরবর্তীতে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি, স্ট্রিং থিওরি এবং অন্যান্য ভারী কণার মিথষ্ক্রিয়ার হিসেব কষতে ব্যবহৃত হয়। জামাল নজরুল ইসলাম রেজ্জে অ্যামপ্লিচিউডের সীমাবদ্ধতা নির্ণয় করেছেন ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশান বিশ্লেষণের মাধ্যমে। ১৯৬৩ সালের জুন মাসে ফিজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত হয় এই গবেষণাপত্র। [Physical Review, Volume 130, Number 6, pages: 2560-2565, 15 June 1963.]

১৯৬৩ সালের এপ্রিলে জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর পরের গবেষণাপত্র Leading Landau curves of some Feynman diagrams পাঠালেন ইতালির নোভো সিমেন্টো জার্নালে। এই গবেষণায় ল্যান্ডাউ কার্ভের সাথে ফাইনম্যান ডায়াগ্রামের উপযোগিতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশান পরীক্ষা করে দেখা হয়। অবশ্য এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে অক্টোবর মাসে [Nuovo Cimento, Volume 30, pages: 259-265, 1963]। তার আগেই তিনি তাঁর পিএইচডি থিসিস জমা দিয়েছেন।

১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যতটুকু গবেষণা করেছেন জামাল নজরুল ইসলাম, সেটুকুই যথেষ্ট ছিল তাঁর পিএইচডি থিসিসের জন্য। ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি তাঁর পিএইচডি থিসিস ‘Analytic Properties of S-Matrix Elements’ জমা দেন। মাসখানেক পরেই তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

তবে পিএইচডির রেজাল্ট প্রকাশিত হবার আগেই তিনি আমেরিকার মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমি বিভাগে যোগ দেন রিসার্চ ফেলো হিসেবে। কোরিয়ান বংশদ্ভূত পদার্থবিজ্ঞানী ইয়ং সু কিম মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে ১৯৬২ সালে যোগ দিয়েছেন মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে। ইউ এস এয়ারফোর্স আর ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশানের দুটো রিসার্চ-গ্রান্টের আওতায় তিনি তাঁর প্রথম রিসার্চ ফেলো হিসেবে বেছে নিয়েছেন জামাল নজরুল ইসলামকে।

মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে দুবছর ছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। কণাপদার্থবিজ্ঞানের দুরুহ গণিত নিয়েই গবেষণা চালিয়ে গেছেন সেখানেও। ১৯৬৫ সালের জুন মাসে ফিজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত হলো ডক্টর কিমের সাথে তাঁর যৌথ গবেষণাপত্র Analytic property of three-body unitarity integral [Physical Review, Volume 138, Number 5B, pages: B1222-B1229, 7 June 1965।] এই গবেষণাটি তাঁর আগের গবেষণাগুলি থেকে কিছুটা আলাদা হলেও বিষয়ের দিক থেকে পুরোপুরি স্বতন্ত্র নয়। বিক্ষেপণের সময় তিনটি কণার মধ্যে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার জটিল গাণিতিক শর্তাবলী নির্ণয়ে ম্যান্ডেলস্ট্যাম প্রেজেন্টেশান এবং ফাইনম্যান ডায়াগ্রামের বিশ্লেষণ এই গবেষণাতেও আছে।

জামাল নজরুল ইসলাম ম্যান্ডেলস্ট্যাম প্রেজেন্টেশান সংক্রান্ত অত্যন্ত জটিল যেসব গাণিতিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন সেগুলি পরবর্তীতে কণাপদার্থবিজ্ঞানের গাণিতিক বিশ্লেষণ এবং কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির গণিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যে স্ট্রিং থিওরি তখনো জন্ম লাভ করেনি, সেই স্ট্রিং থিওরিতেও এসব গাণিতিক বিশ্লেষণ ব্যবহার করা হচ্ছে।

১৯৬৫ সালের শরৎকালে মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে আবার কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ফিরে এলেন জামাল নজরুল ইসলাম। এবার যোগ দিলেন প্রফেসর ফ্রেড হয়েলের কসমোলজি গ্রুপে। গাণিতিক কসমোলজির গবেষণা শুরু করলেন জামাল নজরুল ইসলাম।

১৯৬৪ সালে রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ পরপর তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন ফ্রেড হয়েল এবং জয়ন্ত নারলিকার [Proceedings of Royal Society, Volume A282, pages: 178-183, 184-190, 191-207, 1964.] এই তিনটি গবেষণাপত্রে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির আলোকে স্টেডি-স্টেট থিওরির সমর্থনে তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন ফ্রেড হয়েল এবং জয়ন্ত নারলিকার। স্টেডি-স্টেট থিওরির সমর্থনে তাঁরা একটি কাল্পনিক ক্রিয়েশান ফিল্ড বা সি-ফিল্ডের ধারণা প্রবর্তন করলেন। স্টেডি-স্টেট থিওরি সঠিক হলে মহাবিশ্ব প্রসারিত হলেও তার গড় ঘনত্ব সবসময় অপরিবর্তিত থাকবে। সেক্ষেত্রে অনবরত নতুন পদার্থের উদ্ভব হতে হবে। সি-ফিল্ডের প্রভাবে শূন্য থেকে হাইড্রোজেন পরমাণুর উদ্ভব হতে থাকে যতটুকু দরকার হয়, যখন দরকার হয়। গ্রিন ফাংশানের সাহায্যে সি-ফিল্ডের গাণিতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকার। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের সাহায্যে তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্র এবং জেনারেল রিলেটিভিটির  প্রয়োগে ভর-ক্ষেত্রের গাণিতিক বিশ্লেষণও তাঁরা করেন গ্রিন ফাংশানের মাধ্যমে। এজন্য গ্রাভিটেশানের একটি নতুন তত্ত্বও তাঁরা দেন [F. Hoyle and J. V. Narlikar, A New theory of gravitation. Proceedings of the Royal Society, Volume A282, pages: 191-207, 1964]. জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির সাথে কোন বিরোধ নেই তাঁদের এই নতুন তত্ত্বে। কেবল পার্থক্য হলো জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির ব্যাখ্যায় এবং মহাকর্ষ ধ্রুবকের মান নির্ধারণে। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির সমীকরণের বিশেষ পর্যায়ে [যখন Rik = 0] শূন্য মহাবিশ্ব বা মহাশূন্য অবস্থা তৈরি হতে পারে – যেখানে শূন্যস্থানের জন্যও স্থান দরকার হয়। ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকারের গ্রাভিটেশানের নতুন তত্ত্ব অনুসারে – শূন্যস্থান একেবারেই শূন্য – তাকে স্থান দেয়ার কোন দরকার নেই। শুধু তাই নয়, যে কোনো স্থানে কমপক্ষে দুটো কণা থাকতে হবে এই নতুন তত্ত্ব অনুসারে।

জামাল নজরুল ইসলাম ফ্রেড হয়েলের গ্রুপে যোগ দিয়েই প্রথম যে গবেষণাটি করলেন সেটা হলো হয়েল ও নারলিকারের সি-ফিল্ড, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক-ফিল্ড ও ম্যাস-ফিল্ডে যেভাবে গ্রিন ফাংশান প্রয়োগ করা হয়েছে – সেভাবে ডিরাক-ফিল্ডে গ্রিন ফাংশানের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করা।

ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকারের সাথে অনেক আলোচনা পর্যালোচনার পর জামাল নজরুল ইসলাম রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ প্রকাশ করলেন Green function formulation of the Dirac field in curved space [Proceedings of the Royal Society of London, Series A, Mathematical and Physical Sciences, Volume 294, Number 1439, pages: 437-448, October 1966.] বলা যায় এই গবেষণাপত্রের মাধ্যমে শুরু হলো জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণার নতুন ক্ষেত্র – জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি। জামাল নজরুল ইসলামই সর্বপ্রথম গ্রিন ফাংশানের মাধ্যমে ডিরাক ফিল্ডের গাণিতিক ফরমুলা আবিষ্কার করেন।

১৯৬৬ সালে ফ্রেড হয়েল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ইন্সটিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তত্ত্বীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের এটাই ছিল প্রথম ইন্সটিটিউট। এর আগে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি অবজারভেটরি স্থাপিত হয়েছিল ১৮২৩ সালে। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সোলার ফিজিক্স অবজারভেটরি। ১৯৭২ সালে এই তিনটি বিভাগকে একত্রিত করে প্রতিষ্ঠা করা হয় কেমব্রিজ ইন্সটিটিউট অব অ্যাস্ট্রোনমি। থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হলেন ফ্রেড হয়েল। প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিলেন জয়ন্ত নারলিকার। জামাল নজরুল ইসলামও এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলেন গবেষণা বিজ্ঞানী হিসেবে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত বিজ্ঞানী হিসেবে গবেষণা করেছেন।

১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি ইন্সটিটিউটে গবেষণা করে সাতটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন জামাল নজরুল ইসলাম। এই সময় তাঁর গবেষণার মূল বিষয় ছিল জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি এবং গ্রাভিটি। যেগুলি ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজির মৌলিক গাণিতিক ভিত্তি।

১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করে আবার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি দুটো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।

ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকারের নতুন মহাকর্ষ তত্ত্বের আলোকে বিভিন্ন ধরনের ফিল্ড ইকুয়েশনের ক্ষেত্রে গ্রিন ফাংশান ফরমুলা কেমন হবে সে সম্পর্কিত জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণাপত্র যে ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে তা আগেই উল্লেখ করেছি। এবার তিনি যেকোনো ধরনের মহাকর্ষ ক্ষেত্রে কণাগুলির মিথষ্ক্রিয়ার গ্রিন ফাংশান ফরমুলা প্রকাশ করলেন তাঁর ‘Green function formulation of interactions of arbitrary fields’ গবেষণাপত্রে [Mathematical proceedings of the Cambridge Philosophical Society, Volume 65, Number 3, pages: 759-771, May 1969.]।

প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে কাজ করার সময় ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকারের নতুন মহাকর্ষ তত্ত্ব সংক্রান্ত ক্ষেত্র-সমীকরণের উপর জামাল নজরুল ইসলামের শেষ গবেষণাপত্র ‘Conformal frames and field equations in a conformal theory of gravitation’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে [Mathematical Proceedings of the Cambridge Philosophical Society, Volume 67, Number 2, pages: 397-414, March 1970.]। ততদিনে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশান এবং অন্যান্য প্রমাণ সামনে আসার পর ফ্রেড হয়েলের স্টেডি-স্টেট ইউনিভার্সের ধারণা নিষ্প্রভ হয়ে যেতে শুরু করেছে। জামাল নজরুল ইসলাম এবার তাঁর গবেষণায় সরাসরি নক্ষত্রের দিকে মনযোগ দিলেন।

নক্ষত্রের গঠন সংক্রান্ত গবেষণাপত্র পড়তে শুরু করলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ানের  ‘Introduction to the study of stellar structure’ বইটি শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৯ সালে। নক্ষত্রের গঠন সম্পর্কে জানার জন্য এর চেয়ে নির্ভরযোগ্য বই সেসময় আর ছিল না। জামাল নজরুল ইসলাম এই বই পড়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্যের পদার্থবিজ্ঞান – কসমোলজির গবেষণায় আত্মনিয়োগ করলেন।

১৯৬৯ সালের মে মাসের মধ্যে জামাল নজরুল ইসলাম শেষ করলেন তাঁর ‘’Some general relativistic inequalities for a star in hydrostatic equilibrium” গবেষণাপত্রের প্রথম খন্ড। প্রফেসর ফ্রেড হয়েল তা পাঠিয়ে দিলেন রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিতে। ১৯৬৯ সালে সোসাইটির মান্থলি নোটিশে তা প্রকাশিত হলো [Monthly notices of the Royal Astronomical Society, Volume 145, Number 1, pages: 21-29, July 1969.] । ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করলেন এই গবেষণার দ্বিতীয় খন্ড। জয়ন্ত নারলিকারের মাধ্যমে সেটা প্রকাশিত হলো ১৯৭০ সালে [Monthly notices of the Royal Astronomical Society, Volume 147, Number 4, pages: 377-386, April 1970.] । নক্ষত্রগুলির অভ্যন্তরীণ গ্যাসের চাপ এবং বাইরের মহাকর্ষ বলের চাপের মধ্যে সমতা রক্ষার জন্য জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির যেসব গাণিতিক চলক বিভিন্ন ধরনের শর্ত মেনে চলে – সেগুলিকে সহজীকরণ করেছেন জামাল নজরুল ইসলাম এই দুটো গবেষণাপত্রে। আইনস্টাইনের ক্ষেত্র-সমীকরণ সমাধানে তাঁর এই পদ্ধতি খুবই কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি ইন্সটিটিউটে তাঁর চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে (ক্যালটেক) যোগ দেন ভিজিটিং অ্যাসোসিয়েট হিসেবে। এক বছর ছিলেন তিনি সেখানে। তখন তাঁর হোস্ট ছিলেন প্রফেসর কিপ থর্ন। বিশ্ববিখ্যাত এই ইন্সটিটিউটে তখন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের সাথে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয় জামাল নজরুল ইসলামের।

১৯৭২ সালে জামাল নজরুল ইসলাম ক্যালটেক থেকে শিয়াটলের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে অ্যাস্ট্রোনমির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তাঁর হোস্ট ছিলেন প্রফেসর জর্জ ওয়ালেরস্টেইন এবং ফিলিপ কার্ল পিটারস। প্রফেসর ওয়ালেরস্টেইন নক্ষত্রের গঠন ও তাদের রাসায়নিক বিবর্তনের নিউক্লিওসিন্থেসিস নিয়ে গবেষণা করছিলেন সেই সময়। আর প্রফেসর পিটারস কাজ করছিলেন উইক ফিল্ড গ্রাভিটেশনাল স্ক্যাটারিং সম্পর্কে। তাঁদের সান্নিধ্যে থেকে জামাল নজরুল ইসলাম কসমোলজির বিভিন্ন বিষয় শিখেছেন যা তাঁর গবেষণাকে সমৃদ্ধ করেছে।

ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে আবার কয়েক মাসের জন্য প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে গেলেন জামাল নজরুল ইসলাম। সেখানে সেবার তাঁর সাথে দীর্ঘ আলোচনা হয় গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসনের সাথে। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত জামাল নজরুল ইসলামের নক্ষত্রের হাইড্রোস্ট্যাটিক ইকুইলিব্রিয়াম সংক্রান্ত গবেষণাপত্রগুলি পড়ে ফ্রিম্যান ডাইসন জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণার প্রতি খুবই আগ্রহী এবং শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে তৈরি হয় খুবই সম্মানজনক বন্ধুত্বের সম্পর্ক।

১৯৭৩ সালে আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের লেকচারার পদে যোগ দেন জামাল নজরুল ইসলাম। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত তিনি কসমোলজিতে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির প্রায়োগিক দিকের ব্যাপারে ব্যাপক পড়াশোনা করেন।

১৯৭৫ সালে জামাল নজরুল ইসলাম যোগ দেন কার্ডিফের ইউনিভার্সিটি কলেজের (বর্তমানে কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি) অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্‌স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমি ডিপার্টমেন্টে। ডিপার্টমেন্টে প্রফেসর হিসেবে যোগ দিয়েছেন শ্রীলংকান বংশদ্ভূত ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নলিন চন্দ্র বিক্রমসিঙ্গে এবং লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েছেন আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী বারনার্ড সুৎজ। কার্ডিফে জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণা-সহযোগী ছিলেন বার্নার্ড শুৎজ। তাঁরা একসাথে গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেছেন।

১৯৭৮ পর্যন্ত কার্ডিফ কলেজে ছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। এই সময় তাঁর গবেষণার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় জেনারেল থিওরি অব রিলেটভিটির আইনস্টাইনের সমীকরণের সঠিক সমাধান খুঁজে বের করা। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে তাঁর নয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বিষয়ে, বিশেষ করে আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল সমীকরণের সমাধান বিষয়ে।

মহাবিশ্বের স্থান-কালের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয় মহাকর্ষ বলের দ্বারা। এর সঠিক গাণিতিক ব্যাখ্যার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব হলো আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি যা মহাকর্ষ বলের ফিল্ড ইকুয়েশান দ্বারা প্রকাশ করা যায়। অন্যদিকে মহাবিশ্বের বস্তু ও শক্তিগুলির মধ্যে যে অবিরাম জটিল মিথষ্ক্রিয়া চলছে তা ব্যাখ্যা করার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সমীকরণ হলো ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ যেগুলি তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্রের প্রভাব রিপ্রেজেন্ট করে। মহাবিশ্বের গণিত বুঝতে হলে এই দুটোর কোনোটা ছাড়াই চলবে না। আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ মহাবিশ্বকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে। জামাল নজরুল ইসলাম আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের বিভিন্ন অবস্থার সমাধান করার চেষ্টা করেছেন তাঁর অনেকগুলি গবেষণাপত্রে।

১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হলো আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ সমাধানে তাঁর গবেষণাপত্র ‘A class of approximate stationary solutions of the Einstein-Maxwell equations’ [General Relativity and Gravitation, Volume 7, Number 8, pages: 669-680, January 1976.] ।

আইনস্টাইনের ভ্যাকুয়াম ফিল্ড ইকুয়েশানের ঘূর্ণায়মান অবস্থার সমাধান তখনো পাওয়া যায়নি। জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালে আইন্সটাইনের সেইসব সমীকরণের সমাধান প্রকাশ করলেন তাঁর ‘A class of approximate exterior rotating solutions of Einstein’s equations’  গবেষণাপত্রে [Mathematical Proceedings of the Cambridge Philosophical Society, Volume 79, Number 1, pages: 161-166, January 1976.]। 

এর কয়েক মাস পরেই প্রকাশিত হলো আইনস্টাইনের সমীকরণের সার্বিক ঘূর্ণনের সমাধান সমৃদ্ধ গবেষণাপত্র ‘On the existence of a general rotating solution of Einstein’s equations’ [General Relativity and Gravitation, Volume 7, Number 10, pages: 809-815, 1976.] ।

আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির স্ট্যাটিক ফিল্ড ইকুয়েশানের সমাধান করেছেন জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর ১৯৭৭ এবং ১৯৭৮ সালের দুটো গবেষণাপত্রে। স্ট্যাটিক ফিল্ড সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় না। শুধু তাই নয়, স্ট্যাটিক ফিল্ডে কোন ঘূর্ণন থাকে না, অর্থাৎ স্পেস-টাইমে কোন ভাঁজ পড়ে না। সেখানে মহাকর্ষ ক্ষেত্র সময়ের অপেক্ষক নয়। আইনস্টাইনের ভ্যাকুয়াম ফিল্ডকে স্ট্যাটিক ফিল্ড ধরে তার জেনারেল রিলেটিভিস্টিক সমাধান করেছেন জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘On the static field in general relativity’ গবেষণাপত্রে [Mathematical Proceedings of the Cambridge Philosophical Society, Volume 81, pages: 485-496, 1977.]। পরের বছর প্রকাশিত হয়েছে এই গবেষণার দ্বিতীয় খন্ড [On the static field in general relativity: II, Mathematical Proceedings of the Cambridge Philosophical Society, Volume 83, Number 2, pages: 299-306, March 1978.] যেখানে স্ট্যাটিক ফিল্ড তথা ভ্যাকুয়াম ফিল্ড ইকুয়েশানের সমাধান করা হয়েছে আগের চেয়ে ভিন্ন পদ্ধতিতে।

সেই সময় (১৯৭৭-৭৮) জামাল নজরুল ইসলামের মতো আর কেউই এত বিস্তারিত এবং বহুমাত্রিক গণিতের মাধ্যমে আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি তত্ত্বের সমাধান করেননি। স্টিফেন হকিং এব্যাপারে নিজে আগ্রহী হয়ে জামাল নজরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলেন তাঁর পেপারগুলি রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ প্রকাশ করার জন্য।

জামাল নজরুল ইসলামের পরবর্তী গবেষণাপত্র “A Class of Exact Interior Solutions of the Einstein-Maxwell Equations” রয়েল সোসাইটিতে প্রকাশের জন্য পাঠালেন স্টিফেন হকিং [Proceedings of the Royal Society of London. Series A, Mathematical and Physical Sciences, Volume 353, Number 1675, pages: 523-531, April 21, 1977. Communicated by S. W. Hawking, F. R. S.]

১৯৭৮ সালে লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটির গণিত বিভাগে যোগ দেন জামাল নজরুল ইসলাম। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন। এই সময়ে তিনি কসমোলজি এবং মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে যুগান্তকারী গবেষণাপত্র রচনা করেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে তাঁর ছয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এই গবেষণাপত্রগুলির মধ্যে আছে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ পরিণতির গাণিতিক রূপরেখা, আদিপৃথিবীর ব্ল্যাকহোলগুলির বর্তমান অবস্থান কী হতে পারে, চার্জিত কণার উপর জেনারেল রিলেটিভি থিওরির সমীকরণ এবং তাদের সম্ভাব্য সমাধান।

১৯৭৭ সালে রয়েল এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির কোয়ার্টারলি জার্নালে একটি ছোট্ট টেকনিক্যাল পেপার – ‘পসিবল আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স প্রকাশ করেছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। এরপর নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়াইনবার্গ, ফ্রিম্যান ডাইসন, স্টিফেন হকিং, জয়ন্ত নারলিকার প্রমুখ বিজ্ঞানী তাঁকে অনুরোধ করলেন এই টেকনিক্যাল পেপারের একটি জনপ্রিয় ভার্সান রচনা করতে – যা সাধারণ পাঠকের বোধগম্য হবে। এর আগে এরকম বিষয়ে হাতেগোণা কয়েকটি মাত্র বই প্রকাশিত হয়েছে। স্টিভেন ওয়াইনবার্গের ‘ফার্স্ট থ্রি মিনিটস প্রকাশিত হয়েছে মাত্র এক বছর আগে। জামালস্যার সবার অনুরোধে রচনা করলেন ‘দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স

১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে এই বই প্রকাশিত হবার পর মহাবিশ্বের ভবিষ্যত পরিণতি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তো বটেই, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। পরে জামাল নজরুল ইসলামকে অনুসরণ করে এরকম বই আরো অনেকে লিখেছেন। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত স্টিফেন হকিং-এর আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম-এর আইডিয়া  ‘দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স থেকে উৎসৃত। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী পল ডেভিস ১৯৯৪ সালে প্রকাশ করলেন তাঁর জনপ্রিয় বই – ‘দি লাস্ট থ্রি মিনিটস – যা জামাল নজরুল ইসলামের বইটির পরের অধ্যায় বলা চলে। পল ডেভিস তাঁর বইয়ের সাব-টাইটেলে উল্লেখ করেছেন ‘কনজেকসার্স অ্যাবাউট দি আলটিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’।

আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে রোটেটিং ফিল্ড বা ঘূর্ণায়মান ক্ষেত্রের গাণিতিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছেন জামাল নজরুল ইসলাম। তাঁর গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে তিনি রচনা করেছেন তাঁর আরেকটি মাইলফলক গবেষণা-গ্রন্থ ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি। ১৯৮৫ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এই বইটি মূলত গবেষক এবং শিক্ষার্থী-গবেষকদের জন্য লেখা। এই গবেষণার জন্য কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি জামাল নজরুল ইসলামকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি দেয়।

জনপ্রিয় বিজ্ঞান মানুষের কৌতূহল মিটায়, হয়তো বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহও কিছুটা তৈরি করে। কিন্তু সত্যিকারের বিজ্ঞান-শিক্ষার জন্য দরকার বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থ। জামাল নজরুল ইসলাম ‘আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স-এ মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় ব্যাখ্যা করা হয়েছে গণিত ব্যবহার না করে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের মূল ভাষা হলো গণিত। মহাবিশ্বের উৎস, গঠন, বিবর্তন এবং পরিণতির গণিত বুঝতে হলে একটা নির্ভরযোগ্য বইয়ের দরকার ছিল। সেই দরকার মিটিয়েছেন জামাল নজরুল ইসলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে তিনি রচনা করেছেন ‘এন ইন্ট্রোডাকশান টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি’। ১৯৯২ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হবার পর থেকে পৃথিবীর সব সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কসমোলজির শিক্ষার্থীদের জন্য এই বইটি প্রধান বইতে পরিণত হয়েছে। ২০০১ সালে এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে এর অনলাইন সংস্করণ।

দেশের টানে দেশে ফিরে এসে তিনি স্থাপন করেছেন আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সেখান থেকে শতাধিক গবেষক তৈরি হয়েছে। কর্মজীবনের শেষের দিকে তিনি গাণিতিক অর্থনীতির গবেষণায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সঠিক অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারিত হলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হতে পারবে। ২০০৮ থেকে ২০১৩ – এই পাঁচ বছরে তিনি গাণিতিক অর্থনীতি বিষয়ে ২০টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।

 

তথ্যসূত্র

১। জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণাপত্র ও গ্রন্থাবলি [তালিকা দেখুন: এই লেখকের সপ্তর্ষি, বাতিঘর, ঢাকা, ২০২৪, পৃষ্ঠা ২১৬-২২৩]

২। ফ্রিম্যান ডাইসন, টাইম উইথআউট এন্ড:  ফিজিক্স অ্যান্ড বায়োলজি ইন অ্যান ওপেন ইউনিভার্স, রিভিউ অব মডার্ন ফিজিক্স, বর্ষ ৫১, নম্বর ৩, ১৯৭৯।

৩। পল ডেভিস, দ্য লাস্ট থ্রি মিনিটস, বেসিক বুক্‌স, লন্ডন, ১৯৯৭।

____________

বিজ্ঞানচিন্তা ডিসেম্বর ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত










Saturday, 8 March 2025

বিশ্ব নারী দিবস ২০২৫

 




এবছরও ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০২৫ সালের নারী দিবসের মূল স্লোগান – For All women and girls: Rights, Equality and Empowerment. সকল নারীর জন্য অধিকার, সমতা এবং ক্ষমতায়ন।

যতই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা থাকুক না কেন,  নারীর সম্মান এবং নারীর অধিকার দুটো ভিন্ন বিষয়। পৃথিবীর প্রায় সব সংস্কৃতিতেই নারীদের সম্মান দেয়া একটি লোকদেখানো ব্যাপার। উন্নয়নশীল অনেক দেশেই নারীর সম্মান রক্ষার অজুহাত দেখিয়ে নারীর অধিকার হরণ করে নেয়া হয়। “আপনার সম্মান বজায় রাখার জন্যই আপনার উচিত হবে নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে ফেলা”, “ঐ কমিটিতে আপনি থাকলে আপনার মানসম্মান থাকবে না”, “নারী যদি প্রকাশ্যে ধুমপান কিংবা চা-পান করে তাহলে তো নারীর সম্মান থাকে না” – এরকম আপাতসুশীল অজুহাতের কোন অভাব নেই প্রবল পুরুষালি মনোবৈকল্যে আক্রান্ত সমাজে। এগুলির সাথে আমরা আজন্ম এতটাই পরিচিত যে এর কোন ব্যতিক্রম হলেই বরং আমাদের – নারী পুরুষ উভয়েরই - অস্বস্তি লাগে।

তো আন্তর্জাতিক নারী দিবস যে ঘটা করে ঘন্টার পর ঘন্টা বকর বকর করে পালন করা হয় – তার মূল হেতু কী? হেতুর সেতু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বছর বছর লম্বা হয়, কিন্তু তাতে পৃথিবীর সকল নারীর অধিকার ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। আমাদের বিশাল উপচে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক (৪৯%) নারী। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষের স্বাভাবিক ফল প্রয়োগ করে বাংলাদেশের জনগণের সামগ্রিকভাবে বেঁচে থাকার গড় আয়ু বেড়েছে, গড় আয়ও কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র নারী হবার কারণে তাদের মানবিক নাগরিক রাষ্ট্রিক অধিকারগুলির সূচক থেকে তারা পিছিয়ে পড়ছে।

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আলাদাভাবে আমাদের নারীগোষ্ঠীর তেমন কোনো ভূমিকা নেই। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নারীরা পুরুষের সমান বেতন মজুরি পাবার দাবিতে এবং ভোটের অধিকার পাবার দাবিতে একজোট হয়ে আন্দোলনে নেমেছিল। ইতিহাস ঘাঁটলে এখনকার আমেরিকানরা লজ্জা পাবেন কি না জানি না, তবে সত্য এই – যে আমেরিকা ব্রিটিশদের চেয়ে ভালো সভ্য হবার দাবিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই, সংবিধান রচনা করেছে ১৭৮৭ সালে, সংবিধান অনুসারে দেশ চালানো শুরু করেছে ১৭৮৯ সাল থেকে – সেই  স্বাধীন আমেরিকায় ১৪৪ বছর ধরে নারীদের কোন ভোট দেয়ার অধিকার ছিল না। সেখানে নারীর সম্মান ছিল না – সেটা বলা যাবে না, কিন্তু তাদের মূল নাগরিক অধিকার – ভোট – সেটা প্রয়োগ করার অধিকার ছিল না। সংবিধানের ১৯তম সংশোধনী এনে ১৯২০ সালে আমেরিকান নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হয়। এর অনেক আগেই পৃথিবীর অনেক দেশের নারীরা ভোটাধিকার পেয়ে গিয়েছিলেন।

প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়েছিল ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ ইওরোপের অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে। নারীদিবস পালনের দাবি জোরদার হয় মূলত সোভিয়েত বিপ্লবের সময় সোভিয়েত নারীদের মাধ্যমে। ১৯১৭ সালের ৮ মার্চ রাশিয়ার নারীরা “রুটি ও শান্তি”র দাবিতে জোর আন্দোলন করেছিলেন। ১৯২১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ৮ মার্চকে নারী দিবস ঘোষণা করে। তারপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারী দিবস পালিত হয়েছে। তবে ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে প্রতিবছর নারীর অধিকার উন্নয়নের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সূচক প্রকাশ করা হয়। এই সূচকগুলিকে আক্ষরিকভাবে বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলির উন্নয়নের সূচকে সংখ্যাগত উন্নয়নের চিহ্ন দেখে আমোদিত হবারও কিছু নেই। কারণ এগুলি সরকারিভাবে সরবরাহ করা হয় সরকারের তোষামোদকারি সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলির মাধ্যমেই।

তাহলে নারীর অধিকারের উন্নয়ন হয়েছে কি না কীভাবে বুঝবো? আপনি যে দেশে থাকেন, আপনি যদি নারী হন, নিজের অধিকার কেমন আছে আপনার পুরুষ সহ-নাগরিকের তুলনায় – তা দেখেই আপনি বুঝবেন। আপনি যদি পুরুষ হোন, তাহলে আপনি  কোন্‌ দেশের ক্ষেত্রে আপনার মা-বোন-স্ত্রী-কন্যাসহ নারী আত্মীয়দের নিরাপত্তার ব্যাপারে কেমন উৎকন্ঠা অনুভব করেন – সেটা দিয়েই আপনি বুঝতে পারবেন সেই দেশের নারীদের কী অবস্থা। আপনার স্ত্রী, আপনার বোন, আপনার কন্যা কী পরে বাইরে বের হচ্ছে – তা নিয়ে যদি তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আপনার উদ্বেগ- বেড়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে সেই দেশে নারীর অধিকার বলতে কিছুই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারণ নিরাপত্তাহীন অধিকার কেবল মূল্যহীন কথার কথা।

যে দেশে কন্যা-শিশুরাও ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পায় না, যে দেশে নারীর হেনস্তাকারিকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়, যে দেশে যৌন হেনস্তাকারির বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার আছে – কিন্তু মামলা করার পর মামলাকারিকে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয় -  সে দেশের নারীর অধিকার উন্নয়নের সূচক যদি বাড়তে বাড়তে হিমালয়েও উঠে যায় – তা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। সে দেশে কথার ফুলঝুরি ঝরিয়ে বর্ণাঢ্য নারীদিবস পালন অসহায় অপমানিত নারীর মুখে চপেটাঘাত ছাড়া আর কিছুই নয়। 



Latest Post

নিউক্লিয়ার ঘড়ি

  মানব সভ্যতা বিকাশের শুরু থেকেই সময় সম্পর্কে মানুষ সচেতন হতে শুরু করেছে। সময়ের সাথে সাথে মানুষ যতই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগতভাবে আধুনিক হচ্ছে ত...

Popular Posts