Tuesday, 7 January 2025

প্রবীর মিত্র: বড় ভালো লোক ছিল এবং অন্যান্য

 


অভিনেতা প্রবীর মিত্র মারা গেছেন ৫ জানুয়ারি ২০২৫।

১৯৪১ সালের ১৮ আগস্ট তাঁর জন্ম। সে হিসেবে তিরাশি বছর বয়সে জীবনাবসান কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। প্রবীর মিত্র  চার শ’র বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন এটা নিসন্দেহে একটি বিরাট গৌরবের বিষয়। চারশ সিনেমায় চারশ টি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের চিত্রায়ণ। শুধুমাত্র অভিনেতারাই এক জীবনে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে হাজির হতে পারেন মানুষের সামনে। [অবশ্য নষ্ট রাজনীতির কিছু কিছু মানুষ অভিনেতাদের চেয়েও বড় অভিনেতা, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।]

আমি যখন থেকে সিনেমা দেখতে শুরু করেছি – তখন থেকেই প্রবীর মিত্রের অভিনয় দেখেছি। একক নায়ক হিসেবে তিনি বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। একেবারে শুরুর দিকে ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমায় কবরীর বিপরীতে নায়ক হিসেবেই অভিনয় করেছিলেন প্রবীর মিত্র। অবশ্য সেই চরিত্রে তেমন বিশেষ কিছু করার ছিল না তাঁর। হঠাৎ করে কবরীকে বিয়ে করে ফেলা, নৌকায় ডাকাতের আক্রমণ হওয়া, কবরীকে হারিয়ে পাগল হয়ে যাওয়া। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ জেলেদের সরল জীবন নিয়ে লেখা হলেও সরল উপন্যাস বলা যাবে না কিছুতেই। তাকে সিনেমায় রূপান্তরকরণ ঋত্বিক ঘটকের পক্ষেই সম্ভব। তিনি যাকে দিয়ে যা আদায় করতে পারবেন – ঠিক ঠিক তাকে তাকেই সেসব চরিত্রের জন্য বেছে নিতেন। প্রবীর মিত্র ঋত্বিক ঘটকের চোখে পড়েছিলেন – এটা অবশ্যই তাঁর অভিনয় জীবনে বড় প্রভাব রেখেছিল। তখন প্রবীর মিত্রের ক্যারিয়ার সবে শুরু হচ্ছে।




তিতাস একটি নদীর নাম – আমি দেখেছি অনেক পরে। ততদিনে সিনেমার অভিনয় সম্পর্কে আমার ভালোলাগার ধরন বদলে গেছে। কৈশোরে এই সিনেমা দেখলে আমার সম্ভবত মোটেও ভালো লাগতো না। সেই সময় অতিনাটকীয় মেলোড্রামাই বেশি ভালো লাগতো।

বাংলাদেশে একক নায়ক হিসেবে বেশ কয়েকটি সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে বেবী ইসলাম তৈরি করেছিলেন ‘চরিত্রহীন’। না, শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের গল্প নয়। মীনা খান নামে এক নতুন নায়িকার বিপরীতে প্রধান নায়ক ছিলেন প্রবীর মিত্র। কিন্তু সিনেমাটি খুব একটা ব্যবসাসফল হয়েছিল বলে মনে হয় না। ঐ নায়িকাকেও পরে আর বেশি দেখা যায়নি।


শাবানার বিপরীতে তিনি নায়ক হয়েছিলেন এইচ আকবরের ‘জালিয়াত’ সিনেমায়। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল সিনেমাটি। কেমন ব্যবসা করেছিল জানি না। তবে একক নায়ক হিসেবে প্রবীর মিত্রকে যে কোন পরিচালকই আর সেভাবে সুযোগ দেননি তা বোঝা যায়।


আমি যখন থেকে বাছবিচারহীনভাবে সিনেমা দেখতে শুরু করেছি – সেই আশির দশকের শুরুতে – সিনেমার পোস্টারে প্রবীর মিত্রের নাম তখন সাধারণত থাকতো তিন কিংবা চার নাম্বারে। সহনায়ক হিসেবে কিংবা অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে প্রবীর মিত্র অভিনয় করতেন। চরিত্রাভিনেতা হিসেবে তিনি খুবই নির্ভরযোগ্য ছিলেন। সেই সময়ে অন্য সবার মতো তিনিও খুব লাউড অভিনয় করতেন। অভিব্যক্তিতেও তেমন কোন স্বাতন্ত্র্য ছিল না। তিনি যেসব চরিত্রে অভিনয় করেছেন, আমার কখনোই তাঁকে সেইসব চরিত্রের জন্য অপরিহার্য বলে মনে হয়নি। তবে সেই সময় বেশিরভাগ অভিনেতাই খুব টাইপড হয়ে গিয়েছিলেন। যেমন আনোয়ার হোসেন – সৎ, গরীব, দুঃখী টাইপ। এটিএম শামসুজ্জামান – খল এবং কৌতুক। অভিনেতা দেখেই আমরা দর্শকরা শুরু থেকেই চরিত্র সম্পর্কে একটা ধারণা করে নিতাম, এবং সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিলে যেতো। কিন্তু প্রবীর মিত্র সেক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। তিনি নেগেটিভ রোলেও অভিনয় করেছেন মাঝে মাঝে।

এ জে মিন্টুর প্রায় সব সিনেমাতেই প্রবীর মিত্র অভিনয় করেছেন বেশ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। সিনেমাগুলি খুবই ব্যবসাসফল হয়েছিল – কারণ দেখতাম সিনেমাহলে সেগুলি কয়েক সপ্তাহ ধরে হাউজফুল হতো। বলিউডের হিন্দি সিনেমা ‘জনি মেরা নাম’-এর হুবহু নকল করে এ জে মিন্টু তৈরি করলেন ‘মিন্টু আমার নাম’। সেখানে সোহেল রানার সাথে সমানে সমানে অভিনয় করেছেন প্রবীর মিত্র  এবং মাঝে মাঝে সোহেল রানাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন। মারপিট নাচগান আর অত্যন্ত উচ্চস্বরে বলা নাটকীয় সংলাপ ছিল এসব ‘নকল’ সিনেমার প্রাণ। তখনো কিন্তু জানতাম না যে এই সব সিনেমা কোনো ধরনের কৃতজ্ঞতাস্বীকার ছাড়াই ফ্রেমের পর ফ্রেম হিন্দি সিনেমা থেকে নকল করে বানিয়েছেন বাংলাদেশের পরিচালকরা। অভিনেতারা কি জানতেন? জানলে কি অভিনয় করতেন? জানি না।


মিন্টু আমার নাম-এ রাগী, পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যুবকের চরিত্র থেকে এ জে মিন্টুর পরের সিনেমা ‘প্রতিজ্ঞা’য় প্রবীর মিত্র সম্পূর্ণ আলাদা হাবাগোবা এক কৌতুকপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করলেন। এই সিনেমা দুটো আমি দেখেছি পুরনো হয়ে যাবার পর পটিয়ার সিনেমা হলে – তৃতীয় শ্রেণির টিকেট কেটে ছারপোকা সমৃদ্ধ কাঠের চেয়ারে বসে।

চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় চট্টগ্রাম শহরের এমন কোন সিনেমা হল ছিল না যেখানে আমি সিনেমা দেখিনি। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একটি সিনেমা দেখতাম, মাঝে মাঝে একাধিক। সেই অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি – বেশিরভাগ সিনেমাতেই কোনো না কোনোভাবে প্রবীর মিত্র থাকতেন। এ জে মিন্টুর ‘প্রতিহিংসা’ ছবিতে যদিও সোহেল রানাকেই নায়ক বলা হচ্ছে, আমার মতে সেখানে আসল নায়ক প্রবীর মিত্র। এই সিনেমাটি এ জে মিন্টু কোন্‌ সিনেমা থেকে নকল করেছেন জানি না, তবে কাহিনি, মেকিং বেশ চমৎকার ছিল। জসীম সেই সময় খলনায়ক থেকে ক্রমশ নায়ক হয়ে উঠতে শুরু করেছেন।

প্রতিহিংসা সিনেমায় জসীম একজন কুখ্যাত ডাকাত। বিচারক বিচার করার সময় মন্তব্য করেন যে ডাকাতের ছেলে ডাকাতই হবে – এর কোন ব্যতিক্রম হতে পারে না। জসীম তার সদ্যোজাত ছেলের সাথে বিচারকের সদ্যোজাত ছেলেকে বদলে ফেলে। বিচারকের ছেলে ডাকাতের ছেলে হিসেবে বড় হয়ে ঠিকই গুন্ডা প্রকৃতির হয় – যে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রবীর মিত্র। আর ডাকাতের ছেলে বিচারকের ছেলে হিসেবে সৎ পুলিস অফিসার হয় (আশির দশকে বাংলাদেশের কোন সিনেমায় পুলিসকে অসৎ দেখানো যেতো না।) – যে চরিত্রে অভিনয় করেন সোহেল রানা। সিনেমাতে সোহেল রানার চেয়েও প্রবীর মিত্রের অভিনয় অনেক বেশি ডায়নামিক ছিল।


এ জে মিন্টুর ঈদের ছবি ছিল মানসম্মান। তখন আমাদের এইচএসসি পরীক্ষা বেশ কাছে চলে এসেছে। কিন্তু তাতে সিনেমা হলে যাওয়া বন্ধ হয়নি আমার। মানসম্মান দেখে ফেলেছিলাম ঈদের দিন মর্নিং-শোতে। সেই সময় শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে একটি শো চলতো। বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানি উপন্যাস থেকে সৈয়দ শামসুল হক ‘মান সম্মান’-এর চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন তা এখন চিন্তা করলে কেমন যেন অস্থির লাগে। অথচ তখন কী দারুণ উত্তেজনা নিয়ে মানসম্মান দেখেছি। প্রবীর মিত্র সেখানে রাগী পুলিস অফিসার – যে ডাকু শাবানাকে ধরার জন্য দিনরাত এক করে ফেলে। কিন্তু ধরতে পারে না।


প্রবীর মিত্রের আরো কিছু সিনেমার কথা মনে পড়ছে যেগুলি দেখে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। সুচন্দা তাঁদের তিনবোনকে নিয়ে একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন – তিনকন্যা। সেখানে সুচন্দা, ববিতা, চম্পা অভিনয় করেছিলেন। সুচন্দার নায়ক হয়েছিলেন প্রবীর মিত্র।


 আঁখি মিলন নামে একটি সিনেমা তৈরি হয়েছিল – যেখানে সুরকার ছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। সেই সিনেমার একটি গান – ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে…’ এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে অনেকে ঐ গানটি দেখার জন্যও একাধিকবার সিনেমাটি দেখেছে। আমি সিনেমাটি দেখেছি নতুন সিনেমা এলেই দেখতাম বলে। সিনেমার গল্প আমার কাছে বেশ নতুন মনে হয়েছিল সেই সময়। [পরে অবশ্য জেনেছি এটাও একটি হিন্দি সিনেমার নকল।] রানী নামে নতুন একজন নায়িকা এসেছিলেন সেই সময়। এই সিনেমায় রানীর নায়ক হয়েছিলেন প্রবীর মিত্র। সিনেমায় প্রবীর মিত্রের সাথে রানীর বিয়ে হয়। প্রবীর মিত্রের ছোটভাই ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে রানীর ছোটবোন সুচরিতার প্রেম হয়ে যায়। রানী দুর্ঘটনায় মারা যায়। রানীর ছোট্ট শিশুকে মাতৃস্নেহ দেয়ার জন্য সুচরিতার সাথেই প্রবীর মিত্রের আবার বিয়ে ঠিক হয়। ইলিয়াস কাঞ্চন বা সুচরিতা কেউই মুখ ফুটে বলতে পারে না তাদের প্রেমের কথা। ইত্যাদি ইত্যাদি। খুবই মেলোড্রামাটিক হলেও প্রবীর মিত্রের অভিনয় খুব ভালো লেগেছিল সেখানে।


প্রবীর মিত্র অভিনীত আরো তিনটি সিনেমার কথা বলতেই হবে যেগুলি দেখে আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। কামাল আহমেদ রাজ্জাক শাবানাকে নিয়ে তৈরি করেছিলেন পুত্রবধু। কামাল আহমেদের সিনেমাগুলি পারিবারিক মেলোড্রামায় ভরপুর থাকে। গরীব গানের মাস্টারের মেয়ে শাবানাকে পরিবারের অমতে বিয়ে করে বড়লোকের ছেলে রাজ্জাক। রাজ্জাকের মা কিছুতেই পুত্রবধু হিসেবে মেনে নেন না শাবানাকে। রাজ্জাক বিদেশে গেলে সন্তানসম্ভবা শাবানাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। নানা পথ ঘুরে বিভিন্ন ঘটনার পর শাবানার আশ্রয় হয় এক বুটপালিসওয়ালার কাছে। এই বুটপালিসওয়ালা প্রবীর মিত্রের চরিত্রটি আমার খুবই পছন্দ হয়েছিল। তখনও আমার গ্রুপ থিয়েটারে হাতেখড়ি হয়নি। সিনেমা দেখে দেখে আমি অভিনয় শিখতাম। পুত্রবধু সিনেমায় প্রবীর মিত্রের চরিত্রটি আমার এতই পছন্দ হয়েছিল যে তার অনেক সংলাপ আমি খাতায় লিখে রেখেছিলাম – যেন ভুলে না যাই। সেই খাতাটি অনেক বছর পর আমার অনুপস্থিতিতে আরো অনেক কিছুর সাথে উঁইপোকার পেটে গেছে।

১৯৮৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল বেলাল আহমেদের ‘নয়নের আলো’। অন্যরকম একটি প্রেমের সিনেমা, গানের সিনেমা। আহমদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুর করা এই সিনেমার সবগুলি গান ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। কাহিনিও চমৎকার। গ্রামের গায়ক জাফর ইকবাল শহরে আসে। গ্রামে রেখে আসে তার প্রেমিকা কাজরীকে। শহরে এসে অনেক সংগ্রাম করতে হয় তাকে। শহরে তার আশ্রয় হয় ট্যাক্সি ড্রাইভার প্রবীর মিত্রের বাসায়। প্রবীর মিত্রের ছোটবোন সুবর্ণা মুস্তফা মনে মনে ভালোবেসে ফেলে জাফর ইকবালকে। অনেক ঘটনা ঘটতে থাকে। আমার যে অংশটা খুব বেশি মনে দাগ কাটে সেটা বেশ করুণ। ঘটনাচক্রে কাজরীও বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে শহরে চলে আসে। সেখানে পরিচয় হয় রাইসুল ইসলাম আসাদের সাথে। দুর্ঘটনায় কাজরী অন্ধ হয়ে যায়। এদিকে সুবর্ণার ক্যান্সার ধরা পড়ে। এই সময় সুবর্ণা আর প্রবীর মিত্রের অভিনয় ভীষণ অন্যরকম লেগেছিল আমার। সুবর্ণা মোস্তফা তখন আস্তে আস্তে সিনেমায় নিয়মিত হচ্ছেন। কিন্তু অন্যদের মতো অতিঅভিনয় করেন না বলে তাঁর সাথে অভিনয় করতে গিয়ে প্রবীর মিত্র ভীষণ ভালো অভিনয় করেছেন সেখানে। তাঁর অভিনয়ে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।

এ টি এম শামসুজ্জান যে সিনেমার কাহিনি চিত্রনাট্য লিখতেন তা আমার জানা ছিল না, কিংবা আগে কখনো খেয়াল করিনি। তাঁর লেখা কাহিনি, সংলাপ চিত্রনাট্যের সিনেমা ‘সীমার’ খুব ভালো লেগেছিল। সেই সিনেমায় প্রবীর মিত্রকে আলাদাভাবে ভালো লেগেছিল। সিনেমায় ফারুক একজন রাজনৈতিক গুন্ডা (ক্যাডার)। নেতাদের কথায় এমন কোন অপরাধ নেই যা সে করে না। প্রবীর মিত্র একজন বাম রাজনৈতিক সৎ নেতা। প্রবীর মিত্রের সংস্পর্শে আসার পর ফারুককে সৎ পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করে প্রবীর মিত্র। এই চরিত্রটিকে চমৎকার অভিনয় করেছিলেন তিনি।

সেই সময় বাংলাদেশের চলচিত্র পরিচালকদের মধ্যে আর্ট ফিল্ম নির্মাতা ছিলেন আলমগীর কবির। আলমগীর কবিরের সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ পাওয়া সবার পক্ষে সহজ ছিল না। শরৎচন্দ্রের পরিণীতা সিনেমাকে গল্প না বদলে ছবি তৈরি করেছিলেন আলমগীর কবির। [এর আগে শরৎচন্দ্রের কাহিনি নিয়ে ‘স্বামী’ এবং ‘বড়বাড়ির মেয়ে’ সিনেমা তৈরি হলেও সেখানে হিন্দু চরিত্রগুলিকে মুসলমান চরিত্র বানানো হয়েছিল। কারণ পরিচালকরা মনে করতেন বাংলাদেশের দর্শকদের মধ্যে হিন্দুবিদ্বেষ বর্তমান। পরে অবশ্য চাষী নজরুল ইসলাম ‘দেবদাস’ তৈরি করার পর সিনেমায় হিন্দু চরিত্রের মুসলমানিকরণ বন্ধ হয়।]

আলমগীর কবির পরিণীতায় ললিতা চরিত্রে অঞ্জনা, শেখরের চরিত্রে ইলিয়াস কাঞ্চন এবং গিরীনের চরিত্রে প্রবীর মিত্রকে নিয়েছিলেন। ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জনা জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য। প্রবীর মিত্রের চরিত্রটির দৈর্ঘ্য ইলিয়াস কাঞ্চনের চেয়ে কম হলেও প্রবীর মিত্র ইলিয়াস কাঞ্চনের চেয়ে সপ্রতিভ ছিলেন এই সিনেমায়।


সিনেমায় অভিনয়ের জন্য একবারই জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন প্রবীর মিত্র। সেটা হলো ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমায়। এই সিনেমাটি গতানুগতিক সিনেমার বাইরে। সৈয়দ শামসুল হক এই সিনেমার কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য, গান রচনা করেছেন। মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এই সিনেমাটি খুব যত্ন করে তৈরি করেছেন। প্রবীর মিত্র এই সিনেমায় রাজ্জাকের সহনায়ক। সিনেমা শুরু হয় প্রবীর মিত্রের হাহাকারের মধ্য দিয়ে। প্রথম দৃশ্যেই বোঝা যায় ট্রাক ড্রাইভার প্রবীর মিত্রের ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে একজন ফকিরবাবা মারা গেছেন। প্রবীর মিত্র গাড়ি চালাচ্ছিলেন না, তার হেলপার চালাচ্ছিল। চাপা দিয়ে হেলপার পালিয়ে গেছে। গল্প দানা বাঁধে ভিন্ন ভাবে। এই ফকিরের উপর জনগণের খুব বিশ্বাস ছিল। ফকির পানিপড়া দিলে লোকের অসুখ ভালো হয়ে যেতো। ফকিরের ছেলে রাজ্জাক এতদিন ফুফুর কাছে থেকে শহরে লেখাপড়া করেছে। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে গ্রামে আসে। প্রবীর মিত্র ধরা পড়ার ভয়ে কাউকে জানতে দেয় না যে তার ট্রাকের নিচেই প্রাণ গেছে ফকিরের। এদিকে রাজ্জাক খুঁজে বের করতে চায় তার বাবাকে কে মারলো। গ্রামের লোকজন ক্রমশ তাকেই ফকিরের সম্মান দিতে শুরু করে এবং তার কাছ থেকেই ফকিরি কেরামতি আশা করে। কিছু কিছু কাকতালীয় ব্যাপার ঘটেও যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের ঘটনাকাল। সিনেমার শেষে মুক্তিযুদ্ধও চলে আসে। কিন্তু ১৯৮২ সালে এরশাদের শাসনামলে তৈরি বলে সিনেমায় একবারও উচ্চারিত হয় না পাকিস্তানের কথা কিংবা রাজাকার বা মুক্তিযোদ্ধা। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য রাজ্জাক সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় পুরষ্কার পান, প্রবীর মিত্র পেয়েছেন সেরা পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে। পুরষ্কার পেয়েছেন তা অবশ্যই তাঁর অভিনয়ের স্বীকৃতি। কিন্তু এরচেয়েও অনেক ভালো অভিনয় প্রবীর মিত্র করেছেন আরো অনেক ছবিতে যেগুলির কয়েকটির কথা উল্লেখ করেছি।


পরিচালক চাইলে যে ভালো অভিনয় আদায় করে নিতে পারেন – তা এই সিনেমার অঞ্জু ঘোষের অভিনয় দেখলেই বোঝা যায়। অঞ্জু ঘোষ সেই সময় সিনেমাতে এসে প্রচন্ড নাচগানের চটুল চরিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন। কিন্তু বড় ভালো লোক ছিল সিনেমায় তাঁর অভিনয় খুবই সংযত এবং সাবলিল। রাজ্জাক, প্রবীর মিত্র, গোলাম মোস্তফার মতো দক্ষ অভিনেতার সাথে কী চমৎকার স্বাভাবিক অভিনয় করেছিলেন তিনি। 

পরিণত বয়সেও অনেক সিনেমায় বয়স্ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রবীর মিত্র। সেই সিনেমাগুলি অবশ্য দেখিনি। তাঁকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রেখে আজহারুল ইসলাম তৈরি করেছিলেন ‘রিক্সাওয়ালা’।



এরকম আরো অনেক সিনেমায় অভিনয় করে করেই তিনি চার শ সিনেমা অতিক্রম করেছিলেন। একজন অভিনেতার জন্য এটুকু নিশ্চয় অনেক তৃপ্তির।

কিন্তু অতৃপ্তির মাঝেই বেঁচে থাকে প্রকৃত শিল্পীর শিল্পসত্ত্বা। প্রবীর মিত্র সেরকম কোনো অতৃপ্তির কথা কোথাও বলেছেন কি না জানি না।   

============

সিনেমার পোস্টারগুলি বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে প্রকাশিত 'সিনেমার পোস্টার' বই থেকে নেয়া। 

1 comment:

  1. আপনার লেখাটি পড়তে পড়তেই ভাবছিলাম এত গুলো পোস্টার আপনি কোথায় পেলেন ! সবশেষে উত্তর টি জানা গেল। নিঃসন্দেহে তিনি অনেক প্রশংসার দাবিদার।
    চারশর বেশি সিনেমা!

    ReplyDelete

Latest Post

প্রবীর মিত্র: বড় ভালো লোক ছিল এবং অন্যান্য

  অভিনেতা প্রবীর মিত্র মারা গেছেন ৫ জানুয়ারি ২০২৫। ১৯৪১ সালের ১৮ আগস্ট তাঁর জন্ম। সে হিসেবে তিরাশি বছর বয়সে জীবনাবসান কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা...

Popular Posts