২৬
শিক্ষকদের ফেয়ারওয়েল
একজন নতুন শিক্ষক যখন
কলেজে যোগদান করতেন তখন তাঁকে দেখতে দেখতে শিক্ষার্থীরা তাঁর পরিচয় জানত, চিনত,
সম্পর্ক হত। কিন্তু একজন দীর্ঘদিন শিক্ষাদান করা প্রবীণ শিক্ষক যখন চলে যেতেন তখন
বেশিরভাগ সময় শিক্ষার্থীরা জানতই না। পরে অন্য শিক্ষকদের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নিত।
যাবার বেলায়ও তাঁকে সেদিনের শেষ ক্লাসটা নিয়ে ব্যস্তসমস্ত ভাবে কলেজ ছাড়তে হত।
বিশেষত শিশু ক্লাসের শিক্ষকদের তাঁদের ছাত্ররা খুঁজত। আমাদের সিনিয়রদের একজন
আমাদের মাঝে সবচেয়ে প্রবীণ লাইলুন নাহার ম্যাডাম যখন রিটায়ার করে যান তারপর অনেক
বাচ্চারা এসে জানতে চাইত- ম্যাডাম কোথায়? আসেন না কেন?
আমরা শিক্ষকরা বিদায়ী শিক্ষকদের কোন এক
শনিবারে বিদায়ী শিক্ষককে আমন্ত্রণ জানিয়ে সংবর্ধনার আয়োজন করতাম। সামান্য খানাপিনা
ও স্মারক হিসেবে কিছু একটা দিতাম। সবচেয়ে ভাল লাগত আমাদের সার্বক্ষণিক সহকর্মী
যারা খাতা-বই বহন করত, কলেজের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করত অর্থাৎ নিয়তি,
ইদ্রিস, খায়ের, নাজমা, রেহানা, মনোয়ারা এবং আরো অনেকে মিলে শিক্ষকদের বিদায়
উপলক্ষে উপহার দিত।
অথচ কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা পাঁচ টাকা
করে দিয়েও যদি একজন শিক্ষকের বিদায় উপলক্ষে সামান্য কিছু স্মারক হিসেবে দিত অথবা
একটি অনুষ্ঠান করে তাঁর সম্পর্কে কিছু বলত এটাই হত তাঁর বাকি জীবনের মধুর স্মৃতি,
অমূল্য সম্পদ। অথচ কোন অজ্ঞাত কারণে এটি নিষেধ ছিল। তারপরও আখতার-উন-নেসা আপা,
আবদুল কাইয়ূম নিজামী এবং আবুল কাশেম স্যারের বিদায় উপলক্ষে অনেক চেষ্টা তদবির করে
শিক্ষার্থীদের দিয়ে ফেয়ার ওয়েল দেওয়া হয়েছিল। অথচ একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূল
ফ্যাক্টরই হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
২০০৬ সালে যখন আমার নাতনী পূর্বার জন্ম
হল তখন আমি ভীষণ দোটানায় পড়ে গেলাম। মেয়ে চাকরি করে। যত সাহায্যকারী মানুষই থাক
দাদী-নানী বা একজন অতি আপনজন ছাড়া একটা শিশুর যত্ন-পরিচর্যা ও বেড়ে ওঠা কি কখনো
সঠিক ভাবে হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম ছুটাছুটি করি, কখনো একরাতের তূর্ণা নিশীথায় যাই আবার
পরের রাতে সেই একই ট্রেনে চড়ে ফিরে এসে কলেজ করি। আর দু-একদিন ছুটি পেলেতো কথাই
নেই। অথচ এর আগে ২০০৪ সালে আমার একবার PLID অপারেশন হয়ে
গেছে। চলতে ফিরতে কষ্ট। কিন্তু ইচ্ছা থাকলে পঙ্গুতে গিরি লঙ্ঘিতে পারে আমিতো মাত্র
ঢাকা-চট্টগ্রাম।
পূর্বাকে রেখে এসে ছটফট করি কিছুই ভাল লাগে
না। ওদিকে মেয়ে কান্নাকাটি
করে। আপনজন কেউ কাছে নেই, অফিসে গেলেও সে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকে। শেষে পরিবারের
সবার সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে অধ্যক্ষ (নাসির ভাই) কে জানালাম চাকরি
ছেড়ে দেব।
নাসির ভাই বললেন, ম্যাডাম চাকরি ছাড়বেন
কেন? আপনার নাতনীতো একদিন বড় হয়ে যাবে। স্কুলে যাবে, তার আলাদা জগৎ হবে। তখন
আপনিতো একা হয়ে যাবেন। অবসর কাটবে না।
আমি বললাম, আমার অবসরের ভাবনা নেই, আমি
বই পড়ি, গান শুনি, টুকিটাকি লেখালেখি করি এবং আমার সময় কাটানোর মত বন্ধুবান্ধব ও
আত্মীয়-স্বজন প্রচুর আছে।
নাসিরভাই বললেন, আপনাকে আমরা পঁয়ষট্টি
বছরের আগে ছাড়বই না।
ওরে বাবা- আমি তখন কল্পনায় দেখলাম
সত্যজিৎ রায়ের ‘শাখা
প্রশাখা’ সিনেমার
একটি দৃশ্য। বাড়ির সবচেয়ে প্রবীণ, স্মৃতিভ্রষ্ট বৃদ্ধটি হঠাৎ তার রুম থেকে বেরিয়ে
এলে তার দুজন পাহারাদার তাকে পাকড়ে ধরে কাঁধে করে রুমে ঢুকিয়ে দেয়।
আমার মনে হল, আমিও পঁয়ষট্টিতে সব ভুলে
ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসব আর আমাদের ইদ্রিস-খায়ের অথবা রেহানা-নাজমা আমাকে
কোলে-কাঁধে করে চেয়ারে বসিয়ে দেবে। হা-হা-হা মনে মনেই হাসলাম। হে বিধাতা তুমি
রক্ষা করো।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত অধ্যক্ষ আমাকে যে
সুযোগটি দিলেন তার জন্যে আমি তাঁর কাছে ঋণী হয়ে আছি।
তিনি বললেন, আপনি যখনই দরকার ছুটি নেন।
নাতনীকে দেখে আসেন। কিন্তু চাকরি ছাড়তে আমরা আপনাকে দেব না। অতএব তাই সই। কোন
কারণে দু-একদিন ছুটি হলে তার সাথে আরো দু-একদিন যোগ করে ঢাকা দৌড়াও।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে দুহাজার সালের পর
থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ এসে শিক্ষাক্ষেত্রেও একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটল। শিক্ষকবৃন্দ
অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক হয়ে উঠলেন, ছাত্ররা ডিজিটাল নকলে পারদর্শী হয়ে উঠল।
শিক্ষার একেকটা ধাপ আছে। সে ধাপগুলো
কিছুটা হলেও জেনে-বুঝে এবং শিখে না এলে উচ্চতর ধাপে এসে শিক্ষার্থী পাঠ্যবিষয়
সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। ফলে ক্লাসে বা লেখাপড়ায় তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা
কষ্টকর হয়ে পড়ে।
পড়ানোর যে আনন্দ নিয়ে শাহীনে পড়িয়ে
যাচ্ছিলাম সেটা যেন দিনে দিনে কমে যাচ্ছিল। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রী যে আগ্রহী ছিল না
তা বলা যাবে না। তবে বেশিরভাগই অমনোযোগী। কারণ জ্ঞানের বা জানার যে ধারাবাহিকতা
সেখানে তারা নোট আর গাইড মুখস্থ করে এসেছে এবং সত্যি বললে নকল করে পাশ করেছে। এদের
পড়াতে গিয়ে অনেকসময় খুব বোরিং লাগত। তার চেয়ে স্কুলের নবম-দশম শ্রেণির কিছু
ছাত্র-ছাত্রী অনেক প্রাণবন্ত ছিল। কিন্তু টাকার জন্য প্রতিষ্ঠান এমন সব ছাত্র
ভর্তি করাতে শুরু করল যারা আমরাতো কোন ছার ফারুকী স্যারকে পর্যন্ত মূল্যায়ন করতে
পারত না। আমার মনে হয়েছিল উনিও শিক্ষকতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। নাহলে
একদিন যাঁর পায়ের শব্দে ছেলে মেয়ে খাতা কলম নিয়ে বসে যেত, চারপাশ শুনশান থাকত
পরবর্তীতে তাঁরই ক্লাসে কিছু নির্বোধ ছাত্র হট্টগোল করত। এর একটাই কারণ ওরা ক্লাস
ডিঙ্গালেও ওদের বুদ্ধাঙ্কের বিকাশ ঘটেনি।
এরপর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত শিক্ষা
মন্ত্রণালয় হুট করে চাপিয়ে দিল সৃজনশীল পদ্ধতি। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার মত
পদ্ধতি চালু করে শিক্ষকদের টিচার্স ট্রেনিং কলেজ বা এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে
নিয়ে দুই কি তিনদিনের ট্রেনিং দিতে শুরু করল। আর উচ্চধাপের কর্তাব্যক্তিরা যাদের
শিশুশিক্ষার সাথে কোন যোগাযোগ নেই সেসব শিক্ষা অধিকর্তারা সরকারী অর্থে অস্ট্রেলিয়া,
আমেরিকায় গিয়ে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা দেখে এলেন। আসলে কি দেখলেন?
সেসব দেশে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত প্রাথমিক
শাখা এবং এই প্রাথমিক শাখায় কোন পরীক্ষা নেই। শিক্ষার্থীরা স্কুলে যায়, লেখাপড়া,
খেলাধুলা করে, শিক্ষক তাদের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে মূল্যায়ন পত্র দেন। আর আমাদের
কি হল দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে গাইড বই চালু হল। আমাদের টেবিলে বিভিন্ন প্রকাশকের দেয়া
গাদা গাদা গাইডবই জমা হতে লাগল। শিক্ষকরা সেগুলো থেকে প্রশ্ন করেন। শিক্ষার্থীও
একই গাইড পড়ে গোল্ডেন জিপিএ পায়।
আমি সুযোগ পেলে বা হাতের কাছে পেলে এখনও
প্রথম শ্রেণির বইও পড়ি। এতে একদিকে যেমন মজা লাগে অন্যদিকে ভুলে যাওয়া শিক্ষা
ঝালাই হয়। আর শিক্ষকরা গাইড বই অনুসরণ করে প্রাইভেট পড়ান, প্রশ্ন করেন
শিক্ষার্থী সেটা মুখস্থ করে খাতায় উগরে দেয়- প্রাপ্তি A+ গোল্ডেন। যথা পূর্বং তথা
পরং।
এত কিছুর পরও আমার কাছে মনে হয় চট্টগ্রাম
শাহীন একটু ভিন্ন ছিল। বিশেষ করে একজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে সকল শিক্ষকই আন্তরিকভাবে
সাহায্য করতেন যাতে সে আরো ভাল ফলাফল করে। এমন অনেক উদাহরণ আছে এস.এস.সি তে যে রেজাল্ট
নিয়ে একজন শিক্ষার্থী যে ভর্তি হত তার মাঝে আগ্রহ আর প্রচেষ্টা দেখলে শিক্ষকরা
তাকে উৎসাহিত করে শিক্ষা দিয়ে সাহায্য করতেন এবং এইচ.এস.সি তে তারা আরো ভাল
রেজাল্ট করত।
২০১১ সালে আমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম।
প্রচন্ড ব্যথা, হাঁটতে পারি না। বাম পা অবশ। ডাক্তার দেখালাম, বললেন অপারেশন
লাগবে। পরিচিত চিকিৎসকরাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, অপারেশন ছাড়া হবে না।
ঢাকার এ্যাপেলো হাসপাতালে অপারেশন হল।
এবার মেয়েরা এবং তাদের বাবার সিদ্ধান্ত- আর চাকরির দরকার নেই। কারণ দাঁড়িয়ে থাকা,
নিচু হওয়া, সিঁড়ি ভাঙা, ভারি কিছু বহন করা আমার জন্য নিষেধ।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে কলেজে গেলাম।
সহকর্মীরা সবাই ছুটে এলেন। ম্যাডামরা বুকে জড়িয়ে ধরলেন। নাসির ভাই বললেন, চাকরি
কেন ছাড়বেন, আপনি সুপারভিশনে থাকবেন, ক্লাস নেবেন না। ঘাঁটির কর্তৃপক্ষের সাথে
দেখা করলে তাঁরাও একই মত দিলেন।
কিন্তু আমিতো জানি শাহীনের প্রত্যেক
শিক্ষককে কতটা খাটুনি খাটতে হয়। সেটা কাজেও যেমন, সত্যি বললে কিছু কিছু অকাজেও
তেমন। আর আমি সুপারভিশনের নামে বসে বসে বেতন খাব! নাহ! এটা আমারও সইবে না। দুদিন
পরে অন্যেদেরও সইবে না। কারণ আমরা মানুষ।
অবশেষে বিদায়। ২০১১ সালে জুলাই থেকে
নভেম্বর নানা ঝামেলা, অসুস্থতা ও কাজকর্মের সমাপ্তি টেনে বিদায় নিলাম শাহীন থেকে।
আসার আগে শকুন্তলার মত শাহীনের চারপাশে
যেদিকে তাকাই কেবলই কান্না পায়। এই আমলকী, জলপাই, ওকে আর ঝাউগাছগুলো থাকবে, ঋতুতে
ঋতুতে রঙ বদলাবে, ফুল ফুটবে, ফল দেবে আমি দেখব না। কলেজের ভিতরের আঙিনায় কদম
গাছটায় বাদল দিনে প্রথম কদম ফুল ফুটবে- যে কদম আমাকে আমার শৈশবের বর্ষাস্নাত হালকা
রোদ ফোটা অপূর্ব বিকেলের কথা মনে করিয়ে দিত এখানে ফুল ফুটবে। আর কলেজের
গেটের কৃষ্ণচূড়া, ক্লাস করে এসে অফ পিরিয়ডে চেয়ার ঘুরিয়ে বসে চৈত্র-বৈশাখে যার
আগুন ঝরা রূপ দেখতাম। যত দেখতাম তত মুগ্ধ হতাম কি এক আশ্চর্য সম্মোহনে চোখ ফেরাতে
পারতাম না। আর শরতের কাশফুল ফোটা RTS মাঠে যখন শ্বেতবলাকারা
উড়ে এসে নামত তখন যে নীল আকাশ, সাদা মেঘ আর মাটির সবুজ ভেদ করে এই সাদা কাশফুল কি
অপূর্ব যে লাগত- এসব কি আমি ভুলতে পারব?
আর বসন্তে-“এই উদাসী হাওয়ার পথে মুকুল গুলি ঝরে”- আহা এই পাতা ঝরার
দিন, মুকুল ঝরার দিন আবার আসবে। শুধু “পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।”
২৭
স্মরণ
স্মৃতি আনন্দ-বেদনার মিশ্রণে
তৈরি এক অপূর্ব রসায়ন। কোন কোন স্মৃতি যেমন ঠোঁটের কোণে হাসি হয়ে আচমকা খেলা করে,
তেমনি কিছু বিষাদময় বিয়োগান্ত স্মৃতি মনের আকাশে জলভরা মেঘের মত বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। তখন মনে বলে- তোমরা নেই- তোমরা আছো। আমাদের স্মৃতিতে
তোমাদের কর্ম, তোমাদের সঙ্গ, বন্ধুতা সবকিছুই সতত জাগর।
এমনি কিছু বেদনার স্মৃতি, আমাদের মীর্জালাল
ম্যাডামের মৃত্যু। চট্টগ্রাম শাহীনের যাত্রালগ্ন থেকে অবসরগ্রহণ পর্যন্ত তিনি এখানে
শিক্ষকতা করে গেছেন। সদালাপী, শান্তিপ্রিয় আমাদের জালাল আপা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন
কাটাতে ভালবাসতেন। সহকর্মীদের সাথেও ছিল তাঁর হৃদ্যতার সম্পর্ক। খুব ভালবাসতেন
পত্রিকা পড়তে। ক্লাসের অবসরে দৈনিক পত্রিকা পড়ার খুব নেশা ছিল। শ্রদ্ধা আপনাকে
জালাল আপা।
চলে গেছেন মনোয়ার হোসেন ভূঞা। শাহীনের
প্রতিষ্ঠায় যার শ্রমের অবদান অবিস্মরণীয়। শুরুতে শাহীনে শিক্ষকতা করেছেন তারপর
কলেজের অফিসিয়াল কাজকর্ম সামলাতে সুপারেনটেন্ডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু
আমাদের কাছে তিনি ভ্রাতৃপ্রতিম ছিলেন।
মাহমুদা আক্তার রীণা- আমাদের মেধাবী
ছাত্রী। স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবে। বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার।
ভাঙা বুক নিয়ে লেখাপড়া করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিল। হয়েছিল। আমাদের সহকর্মী
হয়ে শাহীনে যোগদান করেছিল। বিনয়ী, স্বল্পভাষী এই মেয়েটি এক মুহূর্তের জন্য ভোলেনি-
আমরা তার শিক্ষক। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দুটো শিশু সন্তান রেখে অকালে
প্রয়াত হল। আজো মনে পড়ে তার সেই শান্তশ্রী মুখ।
রেহানা আক্তার হাসি-খুশি প্রাণবন্ত
তরুণী, একদিন এলো শিক্ষক হয়ে। শাহীনে শিক্ষক থাকাকালীন তার বিয়ে হল এবং আনন্দ করে
সে বিয়ে খেলাম। বিয়ের পর চাকরি ছাড়ল, বাচ্চা হল। তারপর হঠাৎ একদিন খবর এলো
উচ্চ-রক্তচাপে তার আকস্মিক মৃত্যুর। তার এই আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ আমাদের
ম্যাডামদেরকে ভীষণ শোকাহত করেছিল।
চলে গেছেন আয়েশা আপা। পদার্থবিজ্ঞানের
সহকারী অধ্যাপক আয়েশা সিদ্দিকা। কিডনী রোগের জটিলতায় দীর্ঘদিন রোগের সাথে লড়াই
করেছেন। কিন্তু জীবন-স্পৃহা এবং মুখের হাসি তাঁর কখনও মুছে যায়নি। সহকর্মী, ছোটবোন
এবং বন্ধুপ্রতিম আয়েশা আপাকে বলতাম, আপনি আমাদের বাঁচার অনুপ্রেরণা। আতিথেয়তা করতে
খুব ভালবাসতেন, ভালবাসতেন মানুষের সাথে মিশতে, ঘুরতে-বেড়াতে। আয়েশা আপার
অকালমৃত্যুতে শুধু শোকাহত নয়, পাঁজরের হাড় খসে যাওয়ার মত কষ্টদায়ক।
নূর মোহাম্মদ ভাই, নুরুল কাদের ভাই এঁরা
সবাই অসময়ে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে, শাহীনের আঙিনা ছেড়ে। চলে গেছেন বাঁশীদা- মোহন
বাঁশী। সমস্ত অবয়বে অসহায়ত্ব আর দারিদ্রের কষ্টকর ছাপ ফুটে ওঠা এ মানুষটাও চলে
গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। আজো চোখে ভাসে তাঁর বিনয়-নম্র নমস্কারের ভঙ্গিটি। এরা সবাই
শাহীন পরিবারের আমাদের পরমাত্নীয়। তাই এদের মৃত্যু আজও আমাকে ব্যথিত করে।
কিছু ছাত্র-ছাত্রীও আমাদের ছেড়ে গেছে
অকালে, নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায়, অসুস্থতায়। এদের মাঝে আমার একদা প্রতিবেশী মনোয়ার
ভাইয়ের মেয়ে হুরুম মাকসুরের হঠাৎ মৃত্যু এখনো কাঁদায়।
এই অপরিণত মৃত্যুগুলো বড়ো বেশি ব্যথা
দেয়। মনে হয় এখনতো যাবার সময় আমাদের। জীবনের সিন্ধুতীরে বালি নিয়ে খেলা সমাপনের
পথে। কিন্তু ওরা! ‘যে ফুল না
ফুটিতে ঝরিল ধরণীতে’ সেই অপরিণত
সন্তানদের অকাল প্রয়াণে মনোকষ্ট বেড়ে যায়। তাই কামনা করি যে যেখানে আছে সবাই যেন
ভাল থাকে।
মনে পড়ে ঈশ্বরী পাটনীর সেই উক্তি, নিজের
মত করে বলি- আমাদের সন্তানেরা যেন থাকে দুধে-ভাতে। অতীত-বর্তমান-অনাগত শাহীনের
সবার জন্য আমার ভালবাসা।
একদিন আমি ছিলাম কিন্তু
চিরদিন তারা আমার সত্তার অংশ হয়ে গেছে।
২৮
শাহীন তোদের ডাক
দিয়েছে, আয়রে ছুটে আয়, আয়, আয়
হ্যাঁ, ২০১৮ সালের ২
মার্চ চট্টগ্রাম শাহীনের চল্লিশ বছর পূর্তি হবে। ২০১৬-র প্রথম পুনর্মিলনীতে
উপস্থিত থাকতে পারিনি- এবার আমার বাঁধবে কে? না সেই বাঁধন কারো নেই। কারণ আমি
নিজেই যে বাঁধন-হারা।
ঠিক হল ট্রেনে যাব। সবাই যোগাযোগ করছে।
টিকেটের কথা জানতে চাইলাম, মনোয়ার ভাইয়ের ছেলে আমাদের ছাত্র বাছির জানাল, পুরো
কম্পার্টমেন্ট আমরা বুকিং দিয়েছি ম্যাডাম। প্রয়োজনে আরো নেব।
‘সুবর্ণ’ ট্রেনের
কম্পার্টমেন্টের অভিমুখে প্ল্যাটফরমে পৌঁছাতেই ঘিরে ধরল বেশ কিছু প্রিয় মুখ।
ট্রেনে আমি আর আমার ছাত্রী ছোটবোন মলি উঠতেই দেখলাম কম্পার্টমেন্টের ঠিক মাঝের সিট
আমাদের জন্য রাখা হয়েছে। এই সিটের সুবিধা সামনে একটা চৌকো ঝুলন্ত টেবিল আছে। ওমা!
সেই টেবিলে বিশাল কেকের বাক্স।
তারপর যাত্রাশুরু হতে দেখা গেল শুধু কেক
নয় সাতক্ষীরার সন্দেশ থেকে শুরু করে জোবায়দা, নাসরীনের ঘরে বানানো
পিঠা-পুলি-পুডিং, পোলাও-মাংস সবই আছে।
ট্রেন চলছে, ছেলে-মেয়েদের আনন্দ
উচ্ছ্বাস (আমিও কম যাই না, এত আনন্দে কখন যে ওদের স্রোতে মিশে গেছি নিজেও জানি না।)
গান-বাদ্যি, এর মাঝে সাবরিনার গান, সবার কোরাস, ছাত্রদের বন্ধু কুর্মিটোলা শাহীনের
ছাত্র আবু সাঈদ রিপন ও আরো কয়েকজনের ‘নাগিন নাচ’ পরিবেশনায়
হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল।
এর মাঝে ফেসবুকে ছবি চলে যাচ্ছে। অনেকে
মন্তব্য করছে তোমরা এত মজা করে আসবে জানলে আমরাও ম্যাডামের সাথে আসতাম।
আমার বিপদ- নার্ভের সমস্যার কারণে বেশি
হাসলে পাঁজরে টান পড়ে আর অনেকক্ষণ বসে থাকলে পায়ে টান পড়ে। এ ব্যথায় আমি খুব অসহায়
বোধ করি। বসে-দাঁড়িয়ে কোন ভাবে শান্তি নেই। ছুটে এল শাফায়াত জালাল সৌরভ। ওর হাতের
তালুতে আমার পায়ের পাতা কি যে আরাম করে চেপে চেপে ব্যথা কমিয়ে দিল। এখন আমার পায়ে
ব্যথা হলেই সৌরভের সেই আরামদায়ক সেবার কথা মনে পড়ে।
ট্রেন চট্টগ্রামে পৌঁছালে স্টেশনে নেমে
আবার ছবি তোল। এমন স্মৃতি কি আর পাওয়া যাবে। ওরা পাবে। আমার আশা কম। তাই দাঁড়িয়ে
যাই।
পরদিন সকালে মলির বন্ধু আমার ছাত্ররা
আমাদের গাড়িতে করে কলেজে নিয়ে যায়।
কলেজের এখন আলাদা গেট কিন্তু আমরা মনে
হয় এম্বারকেশন গেট দিয়ে নামলাম। কিছু মনে রাখার সুযোগ নেই- নামার আগেই – ম্যাডাম, ম্যাডাম।
সেই আরটিএস মাঠে বিশাল মঞ্চ, বিশাল
তাঁবু খাটিয়ে বসার আয়োজন। সহকর্মীরা ছুটে এলেন। ম্যাডামদের সাথে, ছাত্রীদের সাথে
উষ্ণ আলিঙ্গন। সবাইকে দেখে কেবলই মনে হচ্ছিল- এইতো আমরা। আমরা চট্টগ্রাম শাহীন
মায়া-মমতায়, সুখে-দুখে এক অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা।
মঞ্চে তখন ২০১৭ সালের বিদায়ী শিক্ষকদের সম্মাননা
দেয়া হচ্ছে। চেসা (Chattagram Shaheen ex student Association)-এর সাধারণ সম্পাদক
বর্তমানে এডভোকেট এনামুল হক শাহীনের ড্রেস পরে মঞ্চে ঘোষণা দিচ্ছে। সভাপতি সাইয়েদ্যুল
বাকীন অতিথি ও অধ্যক্ষের সাথে মঞ্চে উপস্থিত।
কিছুক্ষণ বসলাম। মন আইঢাই
করছে কলেজের ভিতরে যাওয়ার জন্য। এই ক'বছরে অনেক পাল্টে গেছে শাহীনের দৃশ্যপট। নতুন
ভবন হয়েছে। অনেক নতুন শিক্ষক শিক্ষিকা- একসময় আমরা যেমন ছিলাম। বিশাল কমনরুম
ম্যাডামদের, এ্যাটাচড ওয়াশরুম। মনে পড়লে কমনরুম নিয়ে আমাদের অনেক কষ্ট ছিল। ভাল
লাগল সুবিধা বেড়েছে দেখে। আসলে একদিনে বা কয়েক বছরে অনেককিছু হয় না। একটা
প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে অনেক দিন লাগে। আরো বড় হবে শাহীন কলেজ।
কিন্তু আমি যে পা বাড়াতে পারছি না। কলেজ
মাঠ থেকে শাহীনে ঢুকতে পথে পথে পা ফেলতেই কোন না কোন ছাত্রসমষ্টির সাথে দেখা, কুশল
বিনিময়, স্মৃতিচারণ। এভাবে RTS মাঠ থেকে কলেজে ঢুকতেই ঘন্টা
কাবার। আয়তন বৃদ্ধিতে কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলছি। চেনা-অচেনা
পথে ‘ছোট বউ’ মিলিন একরকম হাত ধরেই
নিয়ে চলল। সারাক্ষণ সে আমার দেখাশোনা করছে। নাসরীন, মোস্তারী, মিলিন আমাকে শাড়ি
দিল। চারজনে একরকম শাড়ি। বিকেলে সেটাই পরলাম।
খায়ের, ইদ্রিস, রেহানা যারা সারাক্ষণ
আমাদের সকল কাজের সঙ্গী ছিল তারাও খোঁজ নিচ্ছে। অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা চেসার (CESA) সদস্যরা খবর
নিচ্ছে খেয়েছি কিনা, সবকিছু ঠিকমত পেয়েছি কিনা। অধ্যক্ষ নাসিরভাইও
বার বার খবর নিচ্ছে। মাঠে ওনাদের সাথে বসে গল্প করছি।
অনেক ছাত্র-ছাত্রী সপরিবারে
এসেছে- ফারাহ শারমিন (পুতুল), নাজমুল হক এরকম আরো অনেক পরিচিত মুখ।
আউয়াল প্রবাসে থেকেও আমার ‘মেলবোর্নে দেশ বিদেশ’ বইটি বিশ কপি কিনে
হালিমাকে দায়িত্ব দিয়েছে তার সহপাঠী বন্ধুদের উপহার দেয়ার জন্য।
বিশাল স্টেজে এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা
নাচ-গান করছে, কিন্তু উপভোগ করার সুযোগ নেই। কারো না কারো সাথে দেখা হচ্ছে, কুশল
বিনিময় ইত্যাদিতে সময় চলে যাচ্ছে। মন বলছে এই প্রিয়মুখগুলো কি আবার দেখার সৌভাগ্য
আমার হবে। আমার যে সময় ফুরিয়ে আসছে। যদিও মৃত্যুর কোন দিনক্ষণ কেউ জানে না, তবু
বয়স বাড়লে ধরে নিতে হয় যাবার সময় হল।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হতে আরো জমকালো
আয়োজন। স্টেজের পেছনে বিশাল জায়ান্টস্ক্রিন, ব্যান্ডদলের গান। ছাত্র-ছাত্রীরা
বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ব্যান্ডের তালে নাচছে। যে লজ্জা পাচ্ছে তাকেও জোর করে টেনে
আনছে। ছোট-বড় সবাই মিশে গেছে। যেন প্রাণে প্রাণে ওরা গাইছে- প্রাণ ভরিয়ে, তৃষা
হরিয়ে, মোরে আরো আরো দাও প্রাণ।
আকন্ঠ সুরের মদিরায় ওরা উচ্ছ্বল। বয়স
ভুলে গেছে। আসলে মনের বয়স কি বাড়ে! আমাদের সবার মনেই কখনো চিরশিশু, কখনো চিরতরুণ
খেলা করে।
কলেজের দিকে তাকালাম। নানা রঙের আলো
অপরূপ সুন্দর হয়ে উঠেছে। আলোকসজ্জার পরিকল্পনা যে বা যারা করেছে তাদের শিল্পচেতনার
প্রশংসা করতে হয়। এই আলোর দিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ল এক রাতে কলেজের এই মাঠে আমি
ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকী দেখে অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। খাতা পুনঃনিরীক্ষণের কাজে
অধ্যক্ষের নির্দেশে সেদিন সন্ধ্যা কেটে গেলেও আমাকে কলেজে থাকতে হয়েছিল। কাজ শেষে
আমাকে বাহনের ব্যবস্থা করে দিতে সাথে ছিল অফিসের গাউচ ভাই। আমি সিঁড়িতে পা দিয়ে তাকে
বললাম দাঁড়াতে। অন্ধকারে দূড়ে কাছে হাজার হাজার জোনাকী আলো আমাকে দাঁড় করিয়ে
রেখেছিল অনেকক্ষণ। আমি ভুলে গিয়েছিলাম, রাত হচ্ছে একাকী ট্যাক্সি চেপে অনেকদূরে
ঘরে ফিরতে হবে।
সেদিন জোনাকীরা মনের সুখে আলোর জনা
মেলেছিল, আর আজ কলেজের চল্লিশ পূর্তির মিলনের আনন্দে আলোর দীপালী উৎসব। রাত হয়েছে-
এবার মিলন মেলা ভাঙবে। আমারও যাওয়ার সময় হয়েছে। জাফর আমাদের শহরে পৌঁছে দেবে।
রাতের খাওয়া শেষ করে বিদায়ের পালা।
চারপাশ ঘিরে আছে ছাত্র-ছাত্রীরা। বিদায় বেলার শেষ আলাপ শেষ হয়েও শেষ হতে চায় না। তবুও
‘শেষের গানের
রেশ নিয়ে প্রাণে’ গাড়িতে
উঠলাম। শাহীনকে পিছনে রেখে আমরা ছুটছি শহরের পানে।