__________________________________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪
গল্প - কমল দিঘি
__________________________________________
কমল দিঘি
দিঘিটা
এই এলাকার গৌরব। বিশাল এই দিঘির নামেই এলাকার নামকরণ। কমল দিঘি আর কমল দিঘির পাড়।
শহরের রিক্সা-ট্যাক্সি থেকে শুরু করে যে কাউকে কমল দিঘি বললেই হল - এক নামেই
চিনবে। এলাকার বাসিন্দাদেরও যদি কেউ জিজ্ঞেস করে - কোথায় থাক - তাহলে তারা জবাব
দেয় - কমল দিঘি। পাড় বলারও দরকার মনে করে না - যেন দিঘিতেই তাদের বসবাস।
দিঘিটি নিয়ে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত। সুযোগ পেলে এলাকাবাসী সে রকম দু'চারটি
গল্প এলাকার নবাগতকে অথবা বেড়াতে গেলে সেখানকার মানুষকে শোনাবেই।
যেমন অনেক আগে এই দিঘি যখন নিঃসন্তান রাজা কমলকুমার পুত্র কামনা করে খনন
করান তখন দিঘিতে পানি উঠছিল না। রাজা পুত্র-কামনায় প্রচুর দান-ধ্যান করলেন। কিন্তু
পুত্রলাভ হলো না। শেষে এক সন্ন্যাসী বললেন, রাজা যদি তার সবথেকে প্রিয় জিনিস বিসর্জন দেন তাহলেই শুধু পাতাল
থেকে পানি উঠবে।
রাজা ভাবতে বসলেন - কী অথবা কে তার সবচেয়ে প্রিয়? ছোটরানি না বড়রানি।
ছোটরানি বেশি প্রিয়, কিন্তু বড়রানিও কম নয়। কাকে বিসর্জন দেবেন?
চোখ খুলে দিল কিশোরী বধূ ছোটরানি। কিশোরী বধূটি তেজের সঙ্গে রাজাকে বলল,
"বিসর্জন দেবার বেলায় আমরা কেন? বড়রানি যদি প্রিয় হত তবে আমাকে বিয়ে করলে
কেন? সন্তানের জন্য আমাকে বিয়ে করেছ। ভাবো রাজা। তোমার কাছে তোমার চেয়ে প্রিয় কেউ
নয়। আমাকে বিশ্বাস না করলে নিজেকে প্রশ্ন করো।"
রাজার মনশ্চক্ষু খুলে গেল। আসলেইতো নিজের চেয়ে প্রিয় আর কে আছে মানুষের? তাছাড়া পানি না উঠলে রাজার মান থাকে নাকি? আর মান হারালে
রাজা কি আর রাজা থাকে?
রাজা শপথ নিলেন। তারপর বিশেষ দিনে দিঘিতে নামলেন। রাজা নামেন, পানি ওঠে - এভাবে
পানিতে তলিয়ে গেলেন। সেই দিনগত রাতটি ছিল পূর্ণিমা তিথির। রাতে মানুষ দেখল
জ্যোৎস্না-প্লাবিত দিঘির জলে রাজার শরীর ভাসছে। পরদিন সকালে কেউ সে দেহ খুঁজে
পায়নি।
আজও পূর্ণিমার গভীর রাতে রাজার শরীর ভেসে ওঠে। আর এলাকার কেউ না কেউ তা
দেখে।
এভাবে সে
কোন্ পুরনো
কাল থেকে আজ কম্পিউটারের যুগেও রাজা কমলকুমারের নামে স্মরণ্য এ কমল দিঘিকে নিয়ে
এলাকার মানুষ গল্প করে। কেউ অবিশ্বাস করলে তাকে ভয় দেখায়।
এলাকায় আগত এক লরিড্রাইভার এ গল্প নিয়ে হেসেছিল। আর ঠিক দু'দিনের মাথায় তার
ট্রাকটি রাস্তা থেকে সরাসরি দিঘিতে নেমে গিয়েছিল। মানুষ তো দূর, ট্রাকটাই শত
খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া গেল না। তাছাড়া এই দিঘিতে বছরে একবার একটা
দুর্ঘটনা ঘটবেই। কোন বছর শিশু, কোন বছর নারী - কাউকে না কাউকে গ্রাস করবেই কমল
দিঘি। আর তাই এলাকায় ঘরে ঘরে প্রতিদিনই এটিকে ঘিরে গল্প কথা চলতে থাকে।
আজ ক'দিন
হল চম্পা এখানে এসেছে। দিঘির উত্তর পাড়ে যে ব্যারাকের মত সারি সারি বেড়া দেয়া
টিনের ঘর সেখানে চম্পাকে নিয়ে কামাল উঠেছে। কামাল অবশ্য অনেক আগে থেকে এখানে থাকত।
তখন সবার সাথে মেসে থাকত। এখন বউ নিয়ে বাসায় থাকে।
চম্পার বিয়ে হয়েছে ছ'মাস আগে। কুমিল্লার যে গ্রামে চম্পার বাড়ি সেই
মকসেদপুরে স্কুল-কলেজ সবই আছে। চম্পা ক্লাস এইটে উঠেছিল। লেখাপড়ায় মোটামুটি ভাল
ছিল। ইচ্ছা ছিল আরো অনেক পড়ার, কিন্তু ট্যাক্সি-ড্রাইভার বাবার এক কথা -
"ছয়টা ছেলেমেয়েকে পেট ভইরা খাওয়াইতে আমার জান বাইরায় আবার পড়া! তাছাড়া
বয়সকালে বিয়া না দিলে পরে বেশি বয়সের মাইয়া বিয়া দিতে বিপদে পড়ুম। জামাইপক্ষ যৌতুক
চাইব বেশি।"
চম্পা বাবার পায়ের উপর পড়ে কেঁদেছিল - "আব্বা, আমারে বিয়া দিয়েন না,
আমি পড়তাম ইচ্ছা করি।"
না কোন
কথাই বাপ শোনেনি।
কামাল ছোটবেলা থেকে চট্টগ্রামে থেকে ট্রাকের কাজ শিখেছে। আগে হেলপার ছিল,
এখন ড্রাইভার হয়েছে। ওর কাছে বিয়ে দিলে মেয়ের ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না।
অনেক কেঁদে-কেটেও শেষ পর্যন্ত বিয়েটা বন্ধ করতে পারেনি। সেই থেকে নিজের ওপর
সংসারের ওপর চম্পার কোন মায়া বসেনি।
বিয়ের পর কিছুদিন শ্বশুরবাড়ি বাপের বাড়ি করে কেটেছে। কামাল মাঝে মাঝে যেত।
সেদিন বড় ভয় করত চম্পার। মনে হত রাতটা না আসুক। কিন্তু রাত আসতই। আর চম্পার চৌদ্দ
বছরের শরীরটাকে দুমড়ে মুচড়ে সবটুকু রস নিংড়ে নিত কামাল।
একেকদিন চম্পার মনে হত কামালের এই পাশবিকতা থেকে কোথাও পালিয়ে যেতে।
এখানে এসে আরেক জগৎ। গ্রামে দিন ছিল, ছিল রাত। এখানে রাত-দিনের কোন ফারাক
নেই।
ট্রাক নিয়ে কামালকে প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও যেতে হয়। এসব খেপ
বেশিরভাগই রাতের বেলায়। যেদিন যায় অনেক সময় ফিরে আসে তার তিন-চার দিন পরে।
চম্পা জানতে চাইলে বলে, "আরিচা ঘাটে জামে পড়ছিলাম। চান্দিনায় জামে
পড়ছিলাম।"
কখনো বলে "টেরাক দিনে চলে না।"
মেজাজ খারাপ থাকলে বলে, "তর এত খবর নিয়ে কাম কী? কোন অসুবিদা আছে? তরে
ত কোন অসুবিদায় রাখি নাই।"
হ্যাঁ,
অসুবিধা নেই এটা ঠিক। কিন্তু ঘরের মানুষের সম্পর্কটা কি কেবল সুবিধা-অসুবিধার?
মানুষের মন বলে কিছু নেই? যত খারাপই হোক এই কামালের সাথেই তাকে জীবন কাটাতে হবে।
তার বাচ্চাকাচ্চার মা হতে হবে এটাতো জানে। তো সেই মানুষটার ভালমন্দের খবর নেব না?
কামাল
যখন বাইরে যায় তখন হাজেরা খালাকে বাসায় রেখে যায়। হাজেরা খালা পাতানো খালা। এই
এলাকার ছেলেবুড়ো সবাই বুড়িকে খালা ডাকে। তিন কূলে কেউ নেই। আগে ধাইয়ের কাজ করতো।
এখন বয়স হয়েছে। কাজ এখন ট্রাকড্রাইভারদের খালি ঘরে বউ পাহারা দেয়া। যখন যার ঘরে
তখন খাওয়া-দাওয়া তার সাথে। রাত হিসেবে কিছু টাকা-পয়সাও পায়। নিজেরা যেখানেই রাত
কাটাক বউদের জন্য তারা এই ব্যবস্থাটা ভালই করেছে।
চম্পার সাথে এরই মধ্যে ভাব হয়ে গেছে খালার। আর হবে নাই বা কেন? এই বিশ-বাইশ
দিনে চৌদ্দ-পনের দিনই কামাল ছিল না। হাজেরা খালার পাশে শুয়ে চম্পা গল্প শোনে।
হাজেরা খালার সতিনের গল্প, সোয়ামির গল্প আর কমল দিঘির গল্প।
খালা বলে - "দিঘি পত্যেক বচ্ছর একজনরে নেয়।"
"এই
বছর কাউরে নিছে?" চম্পা কৌতূহলে প্রশ্ন করে।
"না,
এবছর অহনও লয় নাই। তবে নিব দেখিস।"
"গতবছর
কারে নিছে?"
"চার
নম্বর বাসার রহিমুদ্দীর পোলারে। দুই বছরের পোলা, মায়ের কোল থেইকা নাইম্যা খেইলতে
গেল আর ফিরা আইল না।"
"দিঘি
নিলে ত ভাইস্যা উঠত। মানুষ মইরলে তো পরে ভাইস্যা উঠে।"
"না,
এই দিঘিত পইড়লে কেউ ভাসে না। একজনই ভাসছিল হে কমলকুমার। কিন্তুক তার লাশও কেউ পায়
নাই।"
চম্পার
বিশ্বাস হয় না। এটা কীভাবে হবে? মানুষ মরবে আর লাশ ভেসে উঠবে না? "তাইলে আমি
একদিন ডুইবা দেখুম খালা।"
"অলক্ষ্মীর
লাহান কতা কইস না বউ" - হাজেরা ঝামটা দেয়। কিন্তু কথাটা চম্পার মাথা থেকে যায়
না।
চম্পাদের
ঘরটা ষোল নম্বর। চম্পা দেখেছে বিশ নম্বর ঘরে একটা ছেলে বইয়ের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে
পড়তে যায়। হাজেরা খালার কাছে জেনেছে - কাসেম ড্রাইভারের ছেলে আরিফ। কলেজে পড়ে।
শুনে চম্পার ইচ্ছা করে ওর সাথে পরিচয় করতে। বুঝতে পারে না কীভাবে কোন
সূত্রে পরিচয় করবে। আর কামাল জানতে পারলে যদি রাগ করে! করুক।
চম্পার মনে হয় - তবু সে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলবে। তার কাছ থেকে যদি থাকে
পড়ার মত একটা-দুটো বই চেয়ে নেবে। সংসারের কাজ করার পর সারাদিন একা একা একটা বই
পেলে পড়া যেত।
আরিফের
সাথে পরিচয়ের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চম্পা একদিন তাদের বাসায় যায়। আরিফের মায়ের সাথে পরিচয় করে। মিছেমিছি
বলে, "চাচী, আপনে দেখতে আমার ছোড খালার মত। আপনেরে দেখলেই আমার খালার কথা মনে
হয়। আর খালা কইয়া ডাকতে ইচ্ছা করে।"
আরিফের মা হাসে- "আচ্ছা কইও। খালা যা চাচীও তা।"
মায়ের কাছে জানতে পারে আরিফ কলেজে আই-এ পড়ে। আগামী বছর পরীক্ষা দেবে।
এই তিন
মাসে আরিফের মায়ের সাথে অন্তরঙ্গতা বেড়েছে চম্পার। ঘরের কাজ শেষ করে প্রায় প্রায়ই
ওদের ঘরে গিয়ে গল্প করে।
এরই মাঝে দু'একদিন আরিফের সাথেও কথা হয়েছে। সে যে এইট পর্যন্ত পড়েছে সেটা
জানানোর পর কিছুটা তার প্রতি মনযোগী হয়েছে আরিফ। এই সুযোগে তার কাছে বই পড়ার বায়না
ধরেছে।
কথায় কথায় জানতে পেরেছে আরিফ নাকি একটা গাড়ি থেকে সপ্তায় সপ্তায় বই নেয়।
সে বই চাইলে চম্পাও পড়তে পারে। চম্পা খুব খুশি। আরিফের মা-কে খুশি করার জন্য কাঁথা
সেলাই করে দেয়।
একদিন
কথা উঠল কমল দিঘি নিয়ে। চম্পা জিজ্ঞেস করল - "আরিফভাই আপনি বিশ্বাস করেন?"
আরিফ
কিছু না বলে মাথাটা দু'দিকে নাড়ায়।
"তয়
লোকে যে কয় দিঘি বছরে একটা মানুষ নেয়?"
"বিরাট
দিঘিতো তাই গল্প বানাইবার সুযোগ বেশি।"
"ইস্
আমি যদি একখান গল্প বানাইতে পারতাম!"
"তুমি
কী গল্প বানাইবা?"
"এই
ধরেন একদিন এই দিঘিতে আমি ডুইবা গেলাম। কেউ আর আমারে খুঁইজ্যা পাইল না। কমলকুমারের মত আমার শাড়িখান শুধু দিঘিতে ভাসব পূর্ণিমার রাতে। সবাই দেখব ঐ ত
চম্পার শাড়ি দেখা যায়। আমারে আর কেউ দেখব না" - একটানা কথাগুলো বলে হি হি করে
হাসিতে ভেঙে পড়ে চম্পা আর আরিফ অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
এত যে
গল্প, এত যে ভয় দিঘিকে ঘিরে সবার মনে তারপরও তাদের দিন যাপনে এই দিঘি অপরিহার্য।
শহরে পানির যে সংকট ধনবানরাই ঠিক মত পানি পায় না আর এখানে এই দরিদ্র-পল্লিতে পানির
লাইন থাকলেও পানি কবে এসেছিল তা এলাকাবাসী মনে করতে পারে না। এই দিঘি তাদের
দৈনন্দিন জীবনে পানির উৎস। বহুযুগ আগে করা ভাঙাচোরা এই ঘাটেই তারা গোসল করে, কাপড়
কাচে, ধোয়া-পাকলা সারে এবং যাবার সময় কলসি বালতি ভরে ঘরের জন্য পানি নিয়ে যায়।
দিঘির অপর পাড়ে বিশাল আবাসিক এলাকা। তারা এ নিয়ে মাথাও ঘামায় না। বাকি তিন পাড়ের
বাসিন্দারা কিন্তু এ দিঘিকে তাদের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না বেঁচে থাকার
প্রয়োজনে।
চম্পার
মাথার ভেতর গল্প ঘোরে। দিঘির শ্যাওলা ধরা ঘাটের কোণা ধরে ডুব দিতে দিতে ইচ্ছে করে
অতল তলে পৌঁছে কী আছে দেখতে। ঘরের কাজ সেরে গোসলের জন্য কাপড়চোপড় নিতে নিতে
বিদ্যুতের মত এক চিলতে হাসি ঝিলিক দিয়ে যায় ওর চোখে।
বছর না
ঘুরতে আবার হৈ চৈ উঠল এলাকায়। আজ দুপুরে একটা লোক পুকুরে নেমেছিল গোসল করতে। বিকেল
গড়িয়ে এলেও লোকটা আর ওঠেনি। তার লুঙ্গিটা ভাসছে মাঝদিঘিতে। তার সাবানের কেস, কাচা
গেঞ্জি সবই ঘাটের শানের ওপর পড়ে আছে। লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে ফায়ার ব্রিগেডে খবর গেল।
ডুবুরি নামল। নাহ্ কোন পাত্তা পাওয়া গেল না।
আবার গল্প শুরু হল। কেমন ছিল লোকটা? কোত্থেকে এল? এই এলাকার কেউ তো ডোবেনি।
তাহলে কে? গল্প বাড়তে থাকে।
শুধু চম্পা এক ফাঁকে আরিফকে বলে, "দেখলেন তো, কেমন গল্প বানাইলাম।"
"তুমি?"
আরিফ হা করে থাকে।
কানাঘুষাটা কামালের কানে পৌঁছে। তার বউ নাকি আরিফ ছেলেটার সাথে প্রায়ই
ফুসুর-ফুসুর গুজুর-গুজুর করে।
মেজাজ খিঁচড়ে যায় কামালের। হারামজাদিরে একটা উচিত শিক্ষা দিতে হবে। হাজেরা
খালাকেও ভাল করে কড়কে দিতে হবে। পয়সা খেয়ে নিমকহারামী করে বুড়ি।
তিনদিনের খেপ মেরে ফিরতেই আরব আলী বলে, "কিরে কামাইল্যা, তোর বউ দেখি
আরিফ্যার লগে ফস্টিনস্টি করে।"
ইচ্ছে
করে আরব আলীর গলাটা টিপে ধরতে। কিন্তু তাতে বদনাম আরো বাড়বে। মাগির বাচ্চা শহরে
আইস্যা পাখনা গজাইছে। রাখ আইজকাই তোর পাখনা দুইটা ভাইঙ্গা দিমু।
রাতে
অনেক দেরি করে ফিরে কামাল। না খেয়েই অপেক্ষা করে চম্পা। তিনদিন পরে মানুষটা ঘরে
ফিরছে, একলা খেতে মন চায় না। এদিকে পেটের ভেতর ইঁদুর-নাচন শুরু হয়েছে। যেন পারলে
নাড়িভুঁড়ি সহ খেয়ে ফেলবে। মুড়ি-বিস্কুটের টিনগুলো খুলে খুলে দেখে। না কিছু নেই। অগত্যা সময় কাটানোর জন্য আরিফের কাছ থেকে আনা বইটা তোষকের নিচে থেকে বের
করে। প্রথমে নামটা দেখে 'হাজার বছর ধরে'। লেখক - জহির রায়হান। বইটা খুলে পাতার
ঘ্রাণ নেয়। স্কুলের কথা মনে পড়ে যায়। এতদিনে দশম শ্রেণিতে উঠত। ওর বান্ধবীরা আগামী
বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ভেঙে বেরিয়ে আসে। সংসারের অভাব
জীবনটারে মাটি করে দিল।
ছোট্ট
বই। যতই পড়ছে ততই যেন নিজের গ্রামের কথা মনে পড়ছে। তাদের গ্রামের ফজলু চাচার বউও
তো চাচার মাইর খাইতে খাইতে একদিন গলায় ফাঁস দিছিল। বুড়া মকবুলের তিনটা বউ। আইচ্ছা
তিনটা বউ দিয়া কী করে বুড়া - ভেবে হাসি পায়। আবার মায়া হয় টুনির জন্য। বাচ্চা
মাইয়া বিয়া দিল দাদার সমান ব্যাডার লগে!
পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি। হঠাৎ দরজায় দড়াম দড়াম শব্দ হতে লাফ
দিয়ে উঠে দরজা খোলে। সামনে দাঁড়িয়ে কামাল। দাঁড়াতে পারছে না, টলছে। মুখ থেকে
বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে। নাকে আঁচল চাপা দিয়ে স্বামীকে হাত ধরে ঘরে ঢোকায় চম্পা।
"তুমি
এত দেরি করলা? একসাথে খামু বইলা আমি জাগতে জাগতে ঘুমাইয়া পড়ছি।"
"হ,
আমার লাইগ্যা জাগতে জাগতে ঘুমাইয়া পড়ছস, না আরিফ্যারে স্বপ্নে দেখতাছিলি?"
"মুখ
সামলাইয়া কথা কও। কী যা তা কও! মাইনষে হুনলে কী কইব?"
"মাইনষে
কী এমন ভালা কইতাছে? আমি সব শুনছি"
"তুমি
যা শুনছ তা সব মিছা কতা।
হে আমার ভাইয়ের মত"
"ভাই! বাংলাদেশের সব ব্যাডা তোর মায়ের
পুত, তাই না মাগির বাচ্চা?"
"কী
কইলা? কী কইলা তুমি? আরেকবার কও" বলতে বলতে চুলার পাশ থেকে বঁটিটা হাতে তুলে
নেয় চম্পা।
"আরেকবার কও, আরেকবার -"
ঘটনার আকস্মিকতায় কামাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। "তুই আমারে
কাটবি?"
"হ,
কাটুম। এই বঁটি দিয়া ফালা ফালা কইরা কাটুম। তিনদিন পর, দশদিন পর ঘরে ফিরা আইস্যা
মরদগিরি দেখাও। খালি কথায় কথায় মাইর-ধইর। করুম না তোমার ঘর।"
"হ, করিস না। তরে আমি তালাক দিমু। বেইশ্যা বেডি" - টলতে টলতে
আবার চম্পাকে মারতে আসে কামাল। পারে না, নেশার ঝোঁকে মাটিতে পড়ে সেখানেই শুয়ে
থাকে।
সারা রাত
আর ঘুমায়নি চম্পা। একঠাঁই বসে ছিল।
কামাল তেমনি উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে গোঙাচ্ছে।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় চম্পা - আর এখানে থাকবে না। কামাল তো তালাকের হুমকি
দিয়েই দিয়েছে। বাবার কাছে - না, চম্পা মরে যাবে তবু সেখানে যাবে না। সেখানে গেলে
এর বেশি কিছু পাওয়ার আশা নেই। আবার এখানেই পাঠাবে। নয়তো আরেকটা বিয়া। থুঃ বিয়ার
কপালে ঝাড়ু মারি। তার চেয়ে যেদিকে দু'চোখ যায় চলে যাবে।
এলাকাজুড়ে হুলুস্থুল পড়ে গেছে।
“কামাইল্যার বউ ভোরবেলা গোসল করতে
গিয়ে দিঘিতে ডুবেছে। শাড়িটা পানিতে ভাসছে।”
“কিন্তু লাশ?”
“এখানে ডুবলে কি আর লাশ পাওয়া যায়?”
কেবল আরিফের মনে হয় - চম্পা আরেকটা গল্প তৈরি করে গেল।
No comments:
Post a Comment