Tuesday, 18 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - ক্ষুধা


_____________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পসংকলন - দহনের কাল ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭।

গল্প - ক্ষুধা
_____________________________________________

ক্ষুধা

  

কিছুদিন থেকেই শারীরিক দুর্বলতায় আক্রান্ত মাহমুদ হাসান। উঠতে-বসতে এমনকি শুয়ে থাকার সময়ও শরীর এত ক্লান্ত মনে হয় যে পাশ ফিরতেও কষ্ট হয়। ওষুধ ডাক্তার চিকিৎসা কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। শহরের সেরা ডাক্তাররা বোর্ড বসিয়েও তেমন কোন সমস্যা নির্ণয় করতে পারেননি। অথচ দিন দিন শরীরের ওজন কমছে। খেতে পারেন না, চোখ গর্তে বসে গেছে, রাতে ঘুম হয় না। সারা শরীর মাঝে মাঝে এমন চুলকায় ইচ্ছে করে দাঁতাল বুরুশ দিয়ে মনের ঝাল মিটিয়ে চুলকাতে।

          কী কারণ এ রোগের? মাহমুদ হাসান আকাশ পাতাল ভেবেও বুঝতে পারেন না কেন তার এ দশা। অথচ একদিন কত সুখের দিন কেটেছে। খাদ্য বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তার নিজের ঘরের ভাঁড়ারে খাবারের অভাব কি? বস্তায় বস্তায় আটা, ময়দা, ঘি, তেল, চাল-চিনি কত খেয়েছেন কত নষ্ট হয়েছে তিনি যেমন জানেন না তেমনি তার স্ত্রীও জানত না। পদোন্নতি পেয়ে যত উপরে উঠেছেন দেশের সকল জেলা উপজেলা থেকে নানারকম খাবার এসেছে। তৈরি খাবার থেকে ছানা মাখন, দুধ, দই যে এলাকার যেটা বিখ্যাত সবই এসেছে। প্রচুর খেয়েছেন। প্রায় ছফুট দীর্ঘ শরীরে এত খাবার হজম করেছেন অথচ আজ?

          চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। হায় শুধু কি খাওয়া আরও কত উপঢৌকন। সাদা, খাকি, গোলাপী কত খাম। এসব প্রাপ্তির জন্য তাকে খাটতেও কম হয়েছে? সবচেয়ে বড়ো মাথা খাটাতে হয়েছে। কতটা বুদ্ধি করে সরকারের ঘরের খাদ্যবস্তু চালান করে নিজের উপার্জন বাড়ানো যায়। হ্যাঁ, এটা সত্যি উপার্জন করেছেনও। আর দোসর হিসেবে যাকে পেয়েছেন তিনি এসব ব্যাপারে তার চেয়েও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। বিশেষ করে খামগুলো তার কাছে আসত।

          নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম নিলেও মেধার জোরে সরকারী অফিসারের পদ অর্জন করেছিলেন। এ ব্যাপারে তার গর্বও ছিল পরিবারের কেউ তাকে হাত ধরে তোলেনি। অবশ্য বিচক্ষণ পিতা একটি মই জোগাড় করে দিয়েছিলেন। মইটি তার স্ত্রী। সম্পন্ন ব্যবসায়ী ঘরের মেয়েকে বউ করে এনেছিলেন। যে ঘরের গৃহকর্তাদের লক্ষ্য ছিল সরকারী কর্মকর্তার কাছে মেয়ে বিয়ে দেওয়া।

          নিজেরা ব্যবসা করতে গিয়ে বুঝেছিলেন এতে লাভ লোকসান আছে, প্রচুর খাটতে হয়। টাকা আসে আবার হঠাৎ সে টাকা উধাও হয়ে যায়। তখন পথের ফকির হতে দেরি হয় না। তাই শ্বশুর সাহেব তাঁর পাঁচ পাঁচটি মেয়ের প্রত্যেকটিকে সরকারের চাকর দেখে বিয়ে দিয়েছেন যাতে কোন ভাবনা ছাড়াই পায়ের উপর পা রেখে খেতে পারে। আবার কানেকশানের সূত্র নিজেদেরও লাভ। দুই মেয়েকে দিয়েছিলেন পুলিশের ঘরে। সেই সুবাদে শ্বশুর আর শালাদের সবরকম ব্যবসাই রমরমা।

          মাহমুদ হাসানের মনে পড়ে চাকরির প্রথম দিকে বাঁহাতের ব্যাপারটাতে একটু দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল। একটু লজ্জাও করত। কিন্তু সহকর্মীরাই পিঠ চাপড়ে সাহস দিতেন। বলতেন, আরে ভাই আমাদের ডিপার্টমেন্টের নামইতো খাদ্য বিভাগ। তো আমরাই যদি না খাই, খাবে কে?

          বিয়ের পর দেখলেন- স্ত্রীর খাওয়ার বাতিক আরও বেশি। তিনি খাদ্যের সাথে সাথে শাড়ি, বাড়ি, গাড়ি সবই খেতে চান। পুলিশকর্তার স্ত্রী বোনদের সঙ্গে সমানে সমানে হতে হবে না। অতএব, শুরু হল জোরে শোরে খাওয়া শুরু আবার খাওয়ানো শুরু। কারণ ততদিনে বুঝে গেছেন উপরওয়ালাকে না খাওয়ালে নিজের খাওয়াও বন্ধ।

          সেই থেকে খেতে খেতে এই ঢাকা শহরের মোহাম্মদপুর মিরপুরে পাঁচ পাঁচ দশ কাঠার উপর দুটো ছতলা বাড়ি করেছেন। গুলশানে দুটো ফ্ল্যাট করেছেন। গ্রামের বাড়িতে পাকা বাড়ি বিঘা বিঘা জমি। আর আজ সামান্য দুমুঠো ভাত খেতে তার অরুচি।

          কেন এমন হয়। হায় আল্লাহপাক তুমি আমার নসীবে শেষকালে এই রেখেছিলে?

          অনেক কষ্টে আবার পাশ ফিরেন। স্ত্রী হালিমা ঘরে ঢুকেন। হাতে স্যুপের বাটি।

          -এই স্যুপটুকু খাও। শক্তি পাবে।

          -ওয়াক থু! মুখ দিয়ে একটা বিকৃত শব্দ করলেন। এর থেকে এক থালা পান্তা দুটো পোড়ামরিচ মাখিয়ে খেতে পারলে আমি সুস্থ হয়ে যেতাম।

          -হ্যাঁ, ওসব খেয়েইতো বড় হয়েছে। কথায় বলে স্বভাব যায় না মরলে। নাও ওঠো, খেতে চেষ্টা করো, এভাবে হলে বাঁচবে কি করে।

          -বেঁচে আর কি হবে। বাঁচার মাথায় মুতি। বিড়বিড় করে বললেন।

          হালিমা বুঝতে না পেরে আবার তাগিদ দিলেন, ওঠো- খেয়ে নাও। কাছে এসে বললেন, আমাকে ধরে উঠবে?

          দশাসই শরীর নিয়ে বিছানায় নিচু হয়ে স্বামীর হাত ধরতে গেলেন।

          -ওরে বাবারে আমাকে ধরো না। ব্যাথা, ব্যাথা, ব্যথা পাব। কঁকিয়ে উঠলেন মাহমুদ।

          -কি ছেলেমানুষী করছ? আমি তোমাকে ব্যথা দেব?

          -না না আমার নিজেরই ব্যথা। মিনমিন করে জবাব দিলেন।

          আসলে চিরদিনই এমন হয়েছে স্ত্রী মুখঝামটা দিলেই তিনি মিইয়ে গেছেন। ছেলেমেয়েগুলোও মাকে দেখে দেখে একটু বড় হতে তাকে ধমক দিয়েই কথা বলতে শিখেছে। এখনও যে এত অসুস্থ তিনি ছেলে-মেয়ে দুটো দিনান্তে একবার তার ঘরে ঢুকে।

          ছেলেটাকে প্রাইভেট মেডিক্যালে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ডাক্তারি পড়িয়েছেন। ঘরে ঢুকলেই তার কথাবার্তা শেষ পর্যন্ত টাকার দিকে গড়ায়। ক্লিনিক করার পরিকল্পনা তার। মাহমুদ হাসান শুনে যান বলতে পারেন না। টাকা রোজগার করে কর না, কে মানা করছে।

          তা কি করে হয়। তারা তো জানে বাবার ব্যাংকে টাকার অভাব নেই। নামে-বেনামে, আত্মীয়-স্বজন এমনকি চাকর-ড্রাইভারের নামেও অ্যাকাউন্ট আছে।           মেয়েটাও তেমন। স্ত্রীর ইচ্ছা ছিল পুলিশ অফিসারের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়, কারণ যত টাকাই থাক বোনদের টাকা আর বাড়িগাড়ি, গয়নার ঝমঝমানি তার চেয়ে অনেক বেশি। তার ওপর আছে দাপট। যখন তখন যাকে তাকে হুকুম করা যায়।

          কিন্তু কপালে জুটল না। শেষ পর্যন্ত সরকারী আমলা। কিন্তু সে ব্যাটা আরেক ভ্যাদামাছ। বই পড়ে, কাজ করে, অফিসে যায়, বেতন আনে- টাকা আনতে জানে না। মা-মেয়ে এখন জামাইয়ের চৌদ্দ পুরুষ তুলেই গালি দেয়। হারামজাদা গন্ডারের বাচ্চা ভ্যাঁও করে না ভোঁও করে না। এদিকে এমন বিয়ের জন্য মা-বাপকে দায়ী করে মেয়েও ফ্ল্যাট দখল করে বসে আছে। ওদিকে মিরপুরের বাড়িটা মেয়েকে লিখে দিয়েছেন তারপরও তার দাবি গুলশানের একটা ফ্ল্যাট তাকে দিতেই হবে। দিতে হবে ক্যাশ টাকার ভাগও।

          এখন মাহমুদ হাসানের মনে হয়- কি দরকার ছিল এত সম্পত্তির, এত টাকা পয়সার। যাদের নামে ব্যাংক আমানত রেখেছেন তারা যদি অস্বীকার করে তিনি কিভাবে প্রমাণ করবেন আর করলে- দুর্বল শরীরটা কেঁপে ওঠে। নির্ঘাত হাতে হাতকড়া।

          অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তার জানালেন- ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে মাহমুদ হাসানের। হালিমা শুরু কান্নাকাটি শুরু করলেন। ছেলে-মেয়ে দুটি বিমর্ষ হয়ে পড়লো। আত্মীয়-স্বজন হাট বসাল হাসপাতালে, বাসায়।

          চিকিৎসায় প্রচুর খরচ। টাকা লাগবে। বাঁচার দুর্দমনীয় আকাঙ্খায় সিঙ্গাপুর যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।

          সিঙ্গাপুরের ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য টাকার প্রয়োজন। বড়ভাইকে খবর দিলেন। বেসরকারী চাকরিজীবি এ নির্বিরোধী ভাইটি নিজে সৎ জীবনে অভ্যস্ত হয়েও ছোটভাইয়ের বাড়িঘর সম্পত্তি আগলেছেন কোন প্রশ্ন ছাড়াই।

          বড়ভাই মাসুদ হাসান সবার সাথে যোগাযোগ করলেন। ব্যাংকে কার নামে কত টাকা আছে লিস্ট করলেন।

          হাট ভেঙ্গে গেছে। যাদের নামে টাকা তারা দেব দিচ্ছি বলে ধরা দিচ্ছে না। ড্রাইভার পালিয়েছে। দীর্ঘদিনের কাজের বুয়া মায়ের অসুখ বলে বাড়ি চলে গেছে। সংসারে ঝামেলা বেড়েছে। স্ত্রীর মেজাজ খারাপ। কদিক সামলাবেন। মাহমুদ হাসান নিরুপায়, তিনি শুধু বাঁচতে চান। শেষ পর্যন্ত ভাইকে ডেকে পরামর্শ করলেন, একটা ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেবেন।

          ছেলে ঝাঁজিয়ে উঠল- বাড়ি করেছ মায়ের নামে, আরেকটা দিয়েছ আদরের কন্যাকে এখন ফ্ল্যাট বিক্রি করলে আমার কি থাকে? এসব চলবে না।

          তাহলে আমার চিকিৎসা- আবারও মিনমিন করে বললেন।

          তার আমি কি জানি। মাকে বল বাড়ি বিক্রি করুক।

          -হ্যাঁ, আর কথা পাস না। উনিও মরবেন আবার আমাকেও পথে বসাবে।           বাড়িতে এত সম্পত্তি কিনেছে সেগুলো বেচে দাও।

          -সেগুলো তো বেশিরিভাগ বেনামিতে কেনা। এতক্ষণে কথা বললেন, মাসুদ হাসান।

          -তাহলে আর কি, মরণতো আছেই মরুক। হালিমা জবাব দিল।

          -কি বললে, কি বললে তুমি- কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতে বলতে উত্তেজনায় উঠে বসতে গেলেন মাহমুদ হাসান এবং তৎক্ষণাৎ ঢলে পড়লেন বিছানায়।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩১-৩২

----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ __________________________...

Popular Posts