__________________________________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪
গল্প - খোঁচা
__________________________________________
খোঁচা
এই নিয়ে আজকের দিনে তিনবার।
তাহলে গত পাঁচদিনে কত বার হল? অসংখ্যবার অসংখ্যবার। সোহানার আর সহ্য হচ্ছে না।
কিন্তু দোষটাতো তারই। সে তো একটা রাক্ষুসী।
"হ্যাঁ হ্যাঁ আমি
রাক্ষুসী। নিজের মেয়েকে নিজের হাতে মেরে ফেলেছি। বেশ করেছি। বে-শ করেছি। আমার
মেয়েকে আমি মেরেছি তাতে কার কী? দাও দাও আমাকে পুলিশে দাও। কেন এখনো ঘরে রেখেছ?
থানায় নিয়ে চল, নিয়ে চল আমাকে" - বলতে বলতে বিছানা ছেড়ে চেয়ারে বসা শওকতের
কোলের কাছে লুটিয়ে পড়ে।
এতক্ষণ একটার পর একটা সিগারেট
শেষ করে যাচ্ছিল শওকত। সোহানার আচমকা ধাক্কায় সিগারেটটা টেবিলের ওপর পড়ল। তাড়াতাড়ি
সেটা নিভিয়ে দিতে দিতে এক হাতেই টেনে তুলতে চেষ্টা করল স্ত্রীকে। "ওঠো ওঠো।
কেন এত পাগলামী করছ?"
"পাগলামী? তুমি কি মনে করেছ আমি পাগল হয়ে গেছি? মোটেও না,
মোটেও না। আমি পাগল নই। আমি খুনী, খুনী। বুঝেছ, আমি একটা খুনী।"
এলোমেলো একঢাল চুল আর জবালাল চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ভয় পেলো শওকত।
সত্যিই কি পাগল হয়ে গেল সোহানা?
কিন্তু বাবাকে থামাবে কে? শওকত
তো পারছে না। আর শুভার্থীর ছদ্মবেশে গত ক'দিনে এত লোকের যে ঢল নেমেছে তাও তো
থামাতে পারছে না। আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী আসছে আর বাবা প্রতিবারই সেই একই
ঘটনার পূর্ণ বিবরণ দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ ঘটনার সময় বাবা ঘরেই ছিলেন না।
শওকত স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে বাবা বলে যাচ্ছেন - "বৌমা সেদিন
দশটার দিকে স্কুলে গেল নীতিকে আনতে আর সাথে নিয়ে গেল রীতিকে। হ্যাঁ, নীতি আমার বড়
নাতনি। ওর বয়স সাড়ে চার আর রীতি সবে তিনে পা দিল। এখন অক্টোবর মাস না, আর গেল
মার্চেই সে তিনে পা দিল। তাহলে তার বয়স কত হল -"
"এই আড়াই হল আর কী" শ্রোতাদের একজন বলল।
"হ্যাঁ হ্যাঁ আড়াই। তো নীতিকে স্কুলে আনতে যাবার সময় বৌমা
প্রতিদিন রীতিকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আমার কাছে রেখে যায় না কেন জিজ্ঞেস করছ? আরে
রীতিটা বড্ড চঞ্চল। আমি বুড়ো মানুষ তো ওকে সামলাতে পারি না। তার ওপর আমার আবার
হাঁপানি আছে - "
বলতে বলতে খুক্খুক করে কেশে
উঠলেন।
"তারপর বুঝলে তো সেদিন
আবার আমি আমার মেয়েকে দেখতে চাঁন্দগাও গিয়েছিলাম। মেয়েটারও আমার মত হাঁপানি আছে
তো। এই তো ক'দিন আগেই হাসপাতাল ঘুরে এল। ওর হাঁপানি কিন্তু আমার চেয়েও বেশি। তখন
হাসপাতালে নিতে হয়। অক্সিজেন দিতে হয়। তো সোহানা মানে আমার বৌমা নীতিকে আনতে
রীতিকে নিয়ে স্কুলে গিয়েছিল। নীতিতো নার্সারীতে পড়ে। আজকালতো আগের
মত বাচ্চাদের একা স্কুলে পাঠানো যায় না। চারদিকে এত অপরাধ আর বাচ্চাচুরি এত ঘটছে
যে মায়েরা বাচ্চাকে একা ছাড়তেই সাহস পায় না। দেখনা স্কুলের সামনে আজকাল মায়েরা
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বসে থাকে। আরো কি জানো এসব জায়গায় কাপড় চুড়ি থেকে শুরু
করে হেন বস্তু নেই যা কেনাবেচা হয় না। কিন্তু আমার বউমা বসে থাকতে পারে না। সে
নীতিকে স্কুলে দিয়ে বাসায় চলে আসে। রীতি তখনো ঘুমে থাকে। এই যে আমার বিছানার
এখানটিতে ওকে রেখে যায়। দুপুরে রীতিকে সাথে নিয়ে নীতিকে আনতে যায়। তারপর এসে
রান্না করে। হ্যাঁ - সেদিন - সেদিন - সেদিন যখন এ ঘটনা ঘটল-।"
"সেদিন কখন?" শ্রোতাদের একজন জিজ্ঞেস করল।
"ঐ যে বউমা এল। তারপর নীতি আর রীতিকে নাস্তা খাইয়ে ঐ যে টিভি
দেখছ ঐ বসার ঘরে দেখতে পাচ্ছ? ওখানে ওদের বসিয়ে টিভি ছেড়ে দিয়েছিল।”
“বাচ্চাদের এত বেশি
টিভি দেখতে দেয়া উচিত নয়। তাতে পড়ালেখায় মন বসে না।"
"আমি তো বাপু আমার বাচ্চাদের টিভির সামনে বসতে দিইই না" -
একটা নারীকন্ঠ শোনা গেল।
"কম্পিউটার আছে। পড়া শেষ
হলে তারা কম্পিউটারে গেম খেলে।"
"কম্পিউটার গেমও খুব ভাল
জিনিস না" আরেকজন মন্তব্য করে - "পেপারে পড়েন নি কম্পিউটারের সামনে বসে বসে গেম খেলে খেলে আর
বার্গার খেয়ে খেয়ে আমেরিকান বাচ্চারা কেমন মুটিয়ে যাচ্ছে।"
শওকত বুঝতে পারে বাবার একটানা
বয়ান শুনতে শুনতে শ্রোতাদের বিরক্তি লাগছে। এবার তারাই একঘেয়েমি কাটানোর জন্য
রিলিফ তৈরি করছে।
"হ্যাঁ তারপর কী হল
শোন" - বাবা আবার বলতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু শ্রোতারা তখনও কথা বলে
যাচ্ছেন - "আর বলবেন না। বাচ্চাদের এই মুটিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা এখন একটা
সোশাল ডিজিজ হয়ে যাচ্ছে। এর জন্য মায়েরাই দায়ী। আদর করে বেশি খাইয়ে বাচ্চাদের মরার
রাস্তা তৈরি করে দিচ্ছে।"
"হ্যাঁ তারপর কী হল শোন" - বাবা আবার বলার চেষ্টা করছেন।
"এই, আপনারা এবার একটু চুপ করেন তো। আংকেলকে কথা বলতে
দেন" - একজন শ্রোতার অসহিষ্ণু কন্ঠস্বর।
"সরি সরি। কী কথা থেকে কোন্ কথায় চলে গেলাম সবাই। আংকেল বলেন,
তারপর কীভাবে ঘটনাটা ঘটল?"
"তার পর এই -" একটু বিরতি দিয়ে বাবা আবার বলতে শুরু
করলেন। এবার তার কন্ঠ আরো জোরালো।
"বউমা তো ওদের টিভি ছেড়ে
দিল। আর নীতিকে বলল রীতির দিকে একটু খেয়াল রেখো। মা রান্না করতে যাচ্ছি। আর এদিকে
নীতিতো টিভির সামনে বসলে দুনিয়া ভুলে যায়।"
"বুড়োরাই ভুলে যায়। আর নীতিতো ছোট বাচ্চা। তাছাড়া এতটুকুন মেয়ে
নিজের খেয়াল রাখতে পারে না, আবার বোনের খেয়াল কী রাখবে। ওকে এই দায়িত্ব দেয়াই ঠিক হয়নি।"
"আসলেই। মা-গুলো কেন যে মাঝে মাঝে এমন বোকামী করে। হ্যাঁ যদি
এভাবে রেখে না যেত তাহলে এরকম একটা প্যাথেটিক ঘটনা -" শ্রোতার কন্ঠ শুনে শওকত
বুঝতে পারে না সমালোচনা না সহানুভূতি।
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই এতক্ষণ তার কোলের কাছে লুটিয়ে থাকা সোহানা আরো
জোরে হু হু করে কেঁদে ওঠে।
ওপাশে শ্রোতারা কান্না শুনে এক
মুহূর্তের জন্য নিশ্চুপ। শওকত সোহানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
শওকত বুঝতে পারে না এই বয়ান আর
কত দীর্ঘ হবে। বাবা কি বোঝেন না এই বর্ণনা সোহানাকে আরো দগ্ধ করছে। আকস্মিক একটা
দুর্ঘটনার জন্য নিজেকে অপরাধী ভাবছে। কিন্তু শওকত কী করতে পারে? মেয়ের মৃত্যুতে
সমবেদনা জানাতে বন্ধু স্বজন আর প্রতিবেশীরা আসবেই। শওকত কি বলতে পারে - দয়া করে
আপনারা আসবেন না! আপনাদের এই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা বুকের ভিতরের ঘা-টাতে কেবল
নুন ছিটিয়ে জ্বালা বাড়াচ্ছে। অন্যরা হয়তো থামত কিন্তু বাবাকে থামাবে কে?
শওকত বুঝতে পারে না দুর্ঘটনার পর থেকে যত মানুষ আসছে তাদের কাছে
ঘটনার পূর্ণ বিবরণ দিতে বাবার দুঃখ না আনন্দ হচ্ছে। বাবা কি বুঝতে পারছেন না ঘটনার
পুনরাবৃত্তি সোহানাকে উন্মাদগ্রস্ত করে দিচ্ছে। নাকি দীর্ঘদিন গুরুত্বহীন হয়ে
বেঁচে থাকার পর ঘটনার বিবরণদাতা হিসেবে নিজের উপযোগিতা বাড়াতে চেষ্টা করছেন। অথচ
দুর্ঘটনার সময়টাতে বাবা বাসায়ও ছিলেন না। কিন্তু এমনভাবে সবকিছুর বর্ণনা দিচ্ছেন
মনে হয় যেন তার সামনেই ঘটেছে সবকিছু।
শ্রোতারা আবার সরব হয়ে উঠল -
"নীতি রীতি তো বসার ঘরে টিভি দেখছিল। তাহলে রীতি বাথরুমে গেল কখন?"
"ঐ তো। নীতি মজা করে টিভি দেখছে। রীতির আবার পানি নিয়ে খেলার
নেশা। জানো নাতো গোসল করতে খুব ভালবাসত। বউমাতো ওকে গোসল দিতে নিলে বাথরুম থেকে
আনতে পারত না। চিৎকার চেঁচামেচি করে হাত পা ছুঁড়ত - 'আমি পানি নিয়ে খেলা কববো' -
কথাটাও স্পষ্ট হয়নি। আধো আধো বোল - কী মিষ্টি যে শোনাত।"
"আহ-হা রে" - এক জনের কন্ঠে আফসোস।
"বেশির ভাগ বাচ্চাই পানি নিয়ে খেলতে ভালবাসে। কিন্তু মা খেয়াল
করবে না? তাছাড়া যে ঘরে ছোটবাচ্চা আছে সে ঘরে বাথরুমের দরজা দেখে শুনে বন্ধ রাখবে
না? এটাতো মায়েরই খামখেয়ালি আর অবহেলা। আর দুর্ঘটনাতো ঘটেই অবহেলার জন্য।"
একজন বক্তৃতার ঢঙে একটানা বলে যাচ্ছেন।
"আহা চাচার কথাটা শুনতে দেন না" - বক্তৃতায় বিরক্ত একজন
তাকে থামালেন।
"কিন্তু বাথরুমে সে যে ঢুকল এতক্ষণেও মায়ের একবারও মনে হল না
বাচ্চাদুটোকে একবার দেখা দরকার। অন্তত নীতিকে ডাকলেও তো জানতে পারত।"
"কী জানি কেমন মা। এমন ভুলো মন হলে চলে? মা হওয়া কি অত
সোজা?"
"না, বউমা খেয়াল করেনি বাথরুমের দরজা খোলা।"
"ঘরে ছোটবাচ্চা আছে। বালতিগুলো পানিভর্তি করে রাখার দরকার কী
ছিল?"
"কী বলছ? পানি না রাখলে কীভাবে হবে? ওয়াসার পানি তো রাতে আসে।
তাও কোনদিন আসে আবার কয়েকদিন আসেও না। বউমা রাত জেগে পানি ধরে রাখে। সেদিনও
রেখেছিল। কিন্তু রীতি পানি নিয়ে খেলতে গিয়ে বালতিতে উল্টে যায়। আশ্চর্য কি জানো -
বালতিটা কিন্তু বেশি বড় নয়। বউমা যখন ওকে খুঁজতে গেল তখন ওর পা দুটো উপরের দিকে।
সেগুলো তখনো গরম ছিল- তুমি তো দেখনি - কী যে মিষ্টি ছিল দেখতে রীতিটা। একটু ভুলের
জন্য মরে গেল - মরে গেল আমার নাতনীটা - "
শওকতের কোলের ওপর থেকে আচমকা চিৎকার করে মাথা তুলল সোহানা।
"হ্যাঁ ভুল, আমার ভুলের
জন্য আমার মেয়ে মরেছে। আমি বালতিতে পানি ভর্তি করে মৃত্যুর ফাঁদ পেতেছি। আমি খেয়াল
করিনি। আমার অবহেলায় আমার মেয়ে মরেছে। কিন্তু এবার আপনি একটু চুপ করেন। আপনার
মেহমানদের বিদায় করেন। আমি শুনতে শুনতে আর সইতে পারছি না। দোহাই, আমাকে একটু
কাঁদতে দিন। আমার মেয়েটার জন্য কাঁদতে দিন। আমি বুক উজাড় করে শুধু কাঁদতে চাই। সব
দোষ আমার। তবু আমার মেয়েটার জন্য আমি কাঁদতে চাই, কাঁদতে চাই -"
বলতে বলতে টলতে টলতে দরজার
কাছাকাছি এসেই জ্ঞান হারিয়ে ভূমিতে আশ্রয় নিল সোহানা।
No comments:
Post a Comment