Friday, 28 February 2025

রিফাৎ আরার 'চট্টগ্রাম শাহীনের স্মৃতিময় দিনগুলি' - পর্ব ৪

 



 

আমার শাশুড়ি ছিলেন পর্দানশীন। সবসময় নামাজ-কলেমা-তেলাওয়াত এসব নিয়ে থাকতেন। তাই ভিতরের রুমটা ওনাকে দেয়া হল। একটা সিঙ্গল খাটে উনি আর ডাবল খাটে মলি আর আমার দুই কন্যা রাকা-দিঠি। সামনের বড় রুমটাতে টিভি, ফ্রিজ, একটা পড়ার টেবিল, দুটো বসার চেয়ার, একটা স্টিলের আলমারী, একটা ওয়ার্ডরোব ও একটা কাঠের আলমারীও দিব্বি এঁটে গেল এর ওপর ছিল দেয়ালে একটা চওড়া পাকা তাক দেয়াল কেটে তৈরি। সেখানেও জিনিস রাখা যায়। বেশিরভাগ বইই রাখা হল। সামনের বারান্দায় একপাশে একটা সিঙ্গেল খাঁট, একটা বুককেস, মাঝারি শোকেস, অন্যপাশে সোফাসেট। দুটো বেতের মোড়া এবং এয়ারফোর্সের দুটো ইজিচেয়ারও এঁটে গেল বেশ জায়গা রেখে। পিছনের বারান্দায় ডাইনিং টেবিল, প্লেটবাটির একটা ছোট শোকেস একপাশে, অন্যপাশে সংসারের ভাঁড়ার আর মিটসেফ। রান্নাঘরের ছোট্ট পরিসরে একটা তাক ছিল, বাসন-কোসনের জন্য একটা টেবিলও রাখা হল। মনে পড়ছিল সেই প্রবচন- যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় ন'জন।

          ঘাঁটি-অভ্যন্তর যেহেতু নিরাপদ তাই সংসারের টুকিটাকি ফ্যালনা জিনিস বাইরে রাখতেও অসুবিধা ছিল না। পাকা উঠানে আমার ভাগে পড়েছিল তিন তিনটি আমগাছ। যার একটির আম অত্যন্ত সুস্বাদু ছিল, বাকি দুটো ছিল ভীষণ টক, আচার ছাড়া কিছু করা যেত না। উঠানের একপাশে কলতলা, মাঝামাঝিতে ছাদে ওঠার জন্য একটা লোহার মই। বারান্দার ছাদগুলো ছিল নিচু আর মূল ছাদ অনেকটা উঁচুতে। এতে ছাদে উঠতে গেলে অনেক উঁচু খাটে ওঠার মত আগে বুক আর হাঁটু উজিয়ে তারপর উঠতে হত। নিচের ছাদে একটা ছোট্ট ঘর ছিল, হাঁস-মুরগির খোপের মত। আর ওপরের ছাদটা বিশাল খেলার মাঠের মত। আমাদের মেহমান এলে বাচ্চারা একছুটে ছাদে উঠে যেত। আমার ভাইয়ের ছেলে রুবায়েতের প্রিয় খেলার জায়গা ছিল এই ছাদ আর সিঁড়ি। দুপাশের ছাদ নিচু ও প্রশস্ত হওয়াতে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল না।

          এই বারটি কোয়ার্টারের ৬নং কোয়ার্টারে অফিসার্স মসজিদের একজন ইমাম সাহেব থাকতেন। ৭নং কোয়ার্টারে থাকতেন ব্যাচেলর শিক্ষকবৃন্দ- সর্বজনাব আবদুর রশীদ, আবু সাঈদ (পরবর্তীতে উপাধ্যক্ষ) ও বনি আমিন স্যার। এরা কেউ তখনো বিয়ে করেননি। শিক্ষক বিমল চক্রবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেই এখানে কলেজে জয়েন করেছিলেন গণিতের প্রভাষক হয়ে। তাঁকে প্রথমে আমার কোয়ার্টারটি দেয়া হয়েছিল। পরে তাকে ৮নংটি দিয়ে আমাকে তিন নম্বরটি দেয়া হয়। তারপর তাহমিনা চৌধুরী, আসমত আরা, আবুল কাসেম ও ১২ নম্বরে মনোয়ার হোসেন ভূঞা।

          এ পাশে আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন আলফাজ উদ্দীন স্যার, মোস্তফা কামাল স্যার। দিলরুবা কিছুদিন পর মকসুদ সাহেব রূপসা কলোনীতে বাসা পাওয়ার পর সেখানে চলে গেলে ঘাঁটির কর্মচারী একজনকে বরাদ্দ দেয়া হয় যিনি ছিলেন ঘোরতর তাবলিগী এবং তার স্ত্রী ছিলেন অসূর্যস্পর্শা পর্দানশীন।

          বারকোয়ার্টারের জীবনটা আমাদের সবার জন্য ছিল অত্যন্ত আনন্দের। হোসনে আপা এক নম্বর ম্যাডাম, আমি তিন নম্বর এরকম ছিল। বাসার সামনে পিছনে খালি জায়গায় সবাই সবজি, এটা ওটা লাগাত। এবার শুরু হল সামনে ফুলের চাষ আর পেছনে সবজি।

          আমার গৃহকর্তাটির বাগান করার আগ্রহ ছিল। এর আগেও আমরা ঢাকায় থাকতে তার হাতে ডালিয়া থেকে নানারকম ফুল ফুটতে দেখেছি। এবার ডালিয়া, গাঁদা, কাশ্মিরী গাঁদা, কসমস এগুলোর চাষ হল। তার সাথে আমার বোন মলিও যোগ দিল। হোসনে আপার বাসায়ও আপা দুলাভাই আগে থেকে করতেন। এবার সবাই নতুন উদ্যমে ফুল আর সবজি চাষে মন দিল।

          পিছনের মাঠে সবচেয়ে বেশি ফলত টমেটো, শাক, ঢেঁড়স এগুলো। এসব টমেটো আকারে এবং সংখ্যায় এত বেশি হত যে শহর থেকে যারা বেড়াতে আসত যাওয়ার সময় তাদেরকে প্রচুর সবজি দেয়া হত। তখন সারা পতেঙ্গায় টমেটো আর তরমুজ বেশি ফলত। সিজনের শেষ দিকে ১ টাকা/২টাকা কেজিতে টমেটো বিক্রি হত।

          বারকোয়ার্টারে আমরা চারজন ম্যাডাম ছিলাম তখন। এদের মাঝে তাহমিনা ও আসমত আরা এবং আমি আর হোসনে আরা আপার মধ্যে অন্তরঙ্গতা বেশি থাকলেও বেশিরভাগ সন্ধ্যায় আমরা ঘরের বাইরে শানবাঁধানো চাতালে আড্ডা দিতাম। একসাথে টিভি দেখতাম। স্যাররাও আসতেন। আমার গৃহকর্তা সিরাজুল ইসলাম সাহেব ছিলেন একে নোয়াখাইল্যা তায় সুরসিক। তাই স্যার-ম্যাডাম সবাই আমরা আড্ডায় বসতাম, আর তিনি মাঝে মাঝে চুটকি শুনিয়ে রসের যোগান দিতেন।

          ছেলেমেয়েরা শিক্ষকদের সন্তান হওয়ার কারণে কোয়ার্টারেও নিয়মকানুন মেনে চলতে অভ্যস্ত ছিল। লেখাপড়ায় সবাই ছিল মনোযোগী-অধ্যবসায়ী। আজ সবার সন্তানই সুপ্রতিষ্ঠিত। এটা বার কোয়ার্টারের এবং শাহীন কলেজের আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিশ্ব নারী দিবস ২০২৫

  এবছরও ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০২৫ সালের নারী দিবসের মূল স্লোগান – For All women and girls: Rights, Equality and Emp...

Popular Posts