__________________________________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪
গল্প - মুখোশ
__________________________________________
মুখোশ
তিন দিন হলো লোকটি এ বাড়িতে
এসেছে। এখনো লোকটিকে ভাল করে দেখার সুযোগ পায়নি। বৈঠকখানার ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে
উঁকি দিল রাবিয়া। এই মুহূর্তে লোকটা একা বসে আছে।
গত তিন দিন উপচে পড়া ভীড় ছিল এ ঘরে। বাড়ির অন্য মেয়েদের সঙ্গে
রাবিয়াও উঁকিঝুকি দিয়েছে। কিন্তু সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মানুষের মাথা ছাড়া আর
কিছুই দেখা যায়নি। লোকটি নাকি ঘোষণা দিয়েছে, সে আজ একা থাকবে। তার খুব নির্জনতার
দরকার। বাবা আর মাসুদভাই আজ তাই কাউকে এ ঘরের আশেপাশে ভিড়তে দেয়নি। রাবিয়া এ
সুযোগটুকু নিয়েছে।
বেড়ার ফাঁকটুকুকে আঙুলে খুঁচিয়ে ভিতরে বেশ সুবিধাজনক করে
দৃষ্টি দিয়েছে। কাঠের চৌকিটার ওপর একটি হাঁটু তুলে তার ওপর হাত ছড়িয়ে বসে আছে ফকির।
হাতে লোহার শিকল, পায়েও। পরনে প্যান্ট আর ফতুয়া। গলায়ও একটা শিকল আর অনেকগুলো
তসবিহ্। লম্বা চুল জট লেগে পাকিয়ে পাকিয়ে কাঁধের ওপর নেমে এসেছে। মাথাটা নিচু হয়ে
থাকাতে মুখটা দেখা যাচ্ছে না ভাল করে। রাবিয়া কৌতূহলে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে কখন মুখ
তুলে তাকাবে লোকটি।
গত পরশু দিন গঞ্জের হাট
থেকে আসার সময় লোকটাকে সাথে করে এনেছে মাসুদ। রাবিয়ার চাচাতো ভাই। গঞ্জে তাদের বড়
দোকান আছে, সে দোকান চালায়। বাবার বয়স হয়েছে, তাই এখন সবসময় দোকানে যায় না।
মাসুদভাই সব দেখা শোনা করে।
মাসুদের বাবা মারা গেছে
সেই ছোটবেলায়। মায়ের বিয়ে হয়ে গেছে অন্য জায়গায়। তারপর থেকে রাবিয়ার বাবা-মায়ের
কোলে সে আর মাসুদ এক সঙ্গে বড় হয়ে উঠেছে। যত বড় হয়েছে দু’জনের
মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বাবা-মাও সেটা মেনে নিয়েছে।
চোখ
তুলে তাকালো লোকটি। আর তাকাতেই চোখাচোখি। কোন্ বেড়ার ফাঁকে চোখ রেখেছে তাও দেখে
ফেলল! রাবিয়ার বুকটা ধক্ করে উঠলো।
লোকটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের
দৃষ্টিটাও যেন কেমন। শরীরটা কাঁপতে লাগলো। কোনমতে সরে এল রাবিয়া। লুকিয়ে দেখতে
গিয়ে কী বিপদ ঘটলো। লোকটা টের পেল কীভাবে? এত ছোট একটা ফুটো দিয়ে দুটো চোখ দেখছে
তাও চোখে পড়ল! সত্যিই কি ফকিরি আছে?
রাবিয়াদের পরিবারে
সবাই খুব পীর-ফকিরের ভক্ত। বাবা তো কবে কোথায় কোন্ ওরশ হবে, কোথায় জিকিরের মাহফিল আছে খুঁজে খুঁজে চলে যাবে। আবার
লোকজনও এসে এসে দাওয়াত দিয়ে যায়। এসবের ঝোঁকেইতো বয়স না হতেই বাবা ব্যবসা-পাতি
ছেড়ে দিল। কিন্তু হলে কী হবে। যার কাঁধে দিয়েছে সেও চাচার সাগরেদ। তাই দেখা যায়
প্রতিদিন সন্ধ্যায় দু’একটা পীর-ফকির মাসুদের
সঙ্গে বাড়িতে এসে হাজির হয়।
তাদের পরিবারের পীর-ফকিরের বাতিক থাকার পেছনে কিছু ইতিহাস
আছে। সিকদার বংশ তারা। রাবিয়া তার বাবার কাছে শুনেছে এই সিকদার বংশে নাকি সাতপুরুষ
আগে এক অলৌকিক কান্ড ঘটেছিল। পূর্বপুরুষদের
একজনের বংশে নাকি একটি সাপের জন্ম হয়েছিল। সে সাপটি জন্মের পরপরই মায়ের কোল ছেড়ে
বনে চলে গিয়েছিল। মায়ের সে কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। কিন্তু যখন সম্পত্তি ভাগ করতে
গিয়েছে তখন নাকি যতবার ছয়ভাগ করে ততবারই সম্পত্তি সাত ভাগ হয়ে যায়। অবশেষে সেই
সপ্তম ভাগের ওপর নাকি একদিন সাপ এসে বসেছিল। সেই থেকে সাপের অন্তর্ধানের পর সেখানে
নাকি মাজার হয়েছিল। মানুষ বাতি দিত, নিয়ত-মানত করতো। এখন অবশ্য পূর্বপুরুষদের সে
স্মৃতি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পরবর্তী বংশধরেরা এখানে এসে ডেরা বেঁধেছে। তারপর
রাবিয়ার দাদার আমল থেকে ব্যবসা করে অবস্থা ফিরেছে।
তারও ইতিহাস আছে। দাদা অল্প
বয়সে দোকান দিয়েছে সবেমাত্র। তখন নাকি একদিন এক ফকির এসে বলেছিল- "এক্ষুনি
একটা টাকা দে।"
তখনকার সময়ে এক টাকা অনেক মূল্যবান হলেও দাদা ফকিরকে টাকাটা
দিয়েছিলেন। তারপর ফকির নাকি বলেছিল- "তোর অনেক হবে।" আর আশ্চর্য, তারপর থেকেই নাকি দাদার
ব্যবসার দিন দিন কেবল বাড়বাড়তি হয়েছে। ব্যবসা যত বেড়েছে পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো ফকিরের
আগমনও তত বেড়েছে।
রাবিয়ার কাছে ব্যাপারটা কেমন অবিশ্বাস্য লাগে। একটা সাপ! একজন
ফকির! তবুও ছোটবেলা থেকে শুনতে শুনতে কথাটা ভাবলেই কেমন গা ছম্ ছম্ করে। তখন
নিজের পেছনে তাকাতেও ভয় হয়। মনে হয় এই বুঝি একটা সাপ দেখবে।
রাতে দোকান থেকে এসে খাওয়ার
পর মাসুদ সবাইকে ডাকল- “চাচী, রাবিয়া, তোমরা
এসো। ফকির তোমাদের সাথে কথা বলবে”।
এটাই নিয়ম। ফকির এলে ভীড় কমলে মহিলাদের সঙ্গে দেখা করে দোয়া
করেন। মা-তো পারলে ছোট-বড় সবাইকে সালাম করে। রাবিয়ার ইচ্ছে করে না। তবু বয়স্ক হলে
করে। না হলে মায়ের বকুনি শুনতে হয়।
ঘরে ঢুকতেই ফকিরের
সঙ্গে চোখাচোখি হয়। রাবিয়ার মনে হয় ফকির যেন তাকে চিনতে পেরেছে। কেমন করে তাকিয়ে
আছে। মনে হয় ভিতরটাও দেখা যাচ্ছে।
মা ফকিরকে সালাম করতে নিচু হতেই ফকির দু’হাতে মায়ের হাত ধরে ফেলল। তার শরীরের শিকল ঝন্ঝন্
করে উঠল। “এ কী করছেন মা! আমি আপনাকে
সালাম করবো।”
মা ভয়ে-লজ্জায় জড়ো-সড়ো হয়ে গেলেন। মনে
হচ্ছে পড়েই যাবে। এবার রাবিয়া এগিয়ে গেল। ফকির তার মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে
রইল।
পরদিন সকালেই একটা সাংঘাতিক
ব্যাপার ঘটল। গ্রামের রহমত আলী মাঝির দু’বছরের বাচ্চা একটা
পয়সা গিলে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। বাড়িতে কান্না-কাটি। শেষে ভীড়ের মধ্যে কে একজন
বুদ্ধি দিল- মাসুদদের বাড়ির ফকিরের কাছে যাও, কিছু একটা উপায় হবে।
সঙ্গে সঙ্গে মাঝি আর মাঝি-বৌ বাচ্চা নিয়ে ফকিরের পায়ে এসে
পড়ল। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রাবিয়া দেখল ঐ ছোট্ট বাচ্চাটাকে মাটিতে শুইয়ে তার গলার
উপর পা রাখলো ফকির। তারপর বেশ হুঙ্কার দিয়ে বলল- "দে, পয়সা ফিরিয়ে দে।"
একঘর লোক নিঃসাড় হয়ে দেখল ফকির বাচ্চাটিকে পায়ের তলা থেকে
তুলে নিয়ে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝাঁকাতে শুরু করেছে। ভয়ে বিস্ময়ে রাবিয়ার নিঃশ্বাস
বন্ধ হয়ে আসছিল। তবু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল- ফকির দু’তিনবার
ঝাঁকাতেই টং করে পয়সাটা মেঝের ওপর পড়ল। আর বাচ্চাটাকে সোজা করে ধরতেই সে ফকিরের
দিকে তাকিয়ে খল খল করে হেসে উঠল। একঘর মানুষ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মাঝি আর মাঝি-বউ
ফকিরের পায়ে গড়াগড়ি।
রাবিয়ার মনে হলো এত কিছুর মধ্যেও ফকির
যেন তাকে লক্ষ্য করছে। রাবিয়া দ্রুত সরে এল। ফকির হোক আর যাই হোক - পুরুষের এমন
তীব্র দৃষ্টি সহ্য করা যায় না।
সারাদিন ব্যাপারটা
নিয়ে ভাবে রাবিয়া। কেমন একটা আশ্চর্য ঘটনা। বাচ্চাটা একটু আগে মারা যাচ্ছিল আর
তারপরই পয়সাটা গলা থেকে বের করে দিয়ে খিলখিল হাসি। স্কুলের জামান স্যারের কথা মনে
পড়ল রাবিয়ার। একদম বিশ্বাস করতেন না এসব পীর-ফকিরে। বলতেন, "মানুষকে ঠকাবার
জন্যে এরা নানা কলাকৌশল বের করে।"
রাবিয়াকে আরো বেশি বলতেন- "সাবধান থাকিস মা। দূরে থাকিস।"
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসা অন্ধকার ঘরে বসে রাবিয়া ভাবতে থাকে সকালে
ঘটে যাওয়া ঘটনা আর জামান স্যারের কথা। কোন্টা সত্যি?
প্রায় দু’মাস হয়ে গেছে ফকির বাড়িতে আছে। ইতোমধ্যে বাড়ির
সবার সাথে খুব সহজ হয়ে গেছে। মা-বাবা তো ফকির বলতে অজ্ঞান। গ্রামের লোকের মুখে
মুখে ফকিরের শিকল নিয়ে নানা গল্প। আরো নানান কথা।
কেউ বলে ফকির কলেজে মাস্টারি করতো। তারপর কীভাবে একদিন
রাতারাতি তার পরিবর্তন হয়ে গেল। আবার কেউ বলে এই শিকল আসলে তার পীরসাহেব তাকে
পরিয়ে দিয়েছে। তার সাধনা যতদিন চলবে ততদিন এই শিকলে বন্দী। শুনে রাবিয়া একদিন
জিজ্ঞেস করেছিল। জবাবে ফকির শুধু হেসেছে।
রাবিয়ার একটাই অবাক লাগে- দিনের বেলা ফকির কোথাও বের হয় না।
সারাদিন শুয়ে বসে থাকে। মাঝে মাঝে রাবিয়াকে মা-কে ডেকে গল্প করে। কিন্তু ধর্মের
কথা, আল্লাহ্র কথা বলে না। কোথায় কবে কখন চুরি-ডাকাতি হয়েছে, মানুষ খুন হয়েছে
এসবই গল্প। আর সবচেয়ে অবাক লাগে কথা বলতে বলতে হঠাৎ চমকে চমকে ওঠে। মাঝে মাঝে
রাবিয়ার দিকে এমন ভাবে তাকায় যে রাবিয়ার কেমন অস্বস্তি হয়। অকারণে গায়ের কাপড়
টানতে থাকে।
কয়েকদিন আগে দুপুরবেলা যখন
মা ঘুমিয়ে তখন পানি দিতে ডেকেছিল। দিন-দুপুরে সে অন্ধকার ঘরে ঢুকতে তার গা কেমন
ছমছম করছিল। পানির গ্লাসটা হাতে নিতে গিয়ে কিছুক্ষণ ধরে রেখেছিল। তারপর বলেছিল- "তোমার
সাথে মাসুদের বিয়ে হবে তাই না রাবিয়া? ভাল ভাল।" বলেই অদ্ভুত ভাবে হেসে
উঠেছিল।
রাবিয়ার একটুও ভাল লাগেনি। তক্ষুণি চলে এসেছিল। মনে হচ্ছিল
ফকিরের চোখ দুটো যেন পেছন থেকে তাকে নিঃশব্দে গিলছিল। এমন অস্বস্তি হচ্ছে অথচ কাউকে
বলারও জো নেই। বাবা-মা এমনকি মাসুদও এমন গলে গেছে যে রাবিয়ার কথাটা তারা পাত্তা
দিতে চাইবে না।
রাবিয়া নিজেও বোঝে না- ফকিরের আচার-আচরণ কেমন যেন রহস্যময়।
আবার যখন দুর্ধর্ষ গল্প বলে তখন দু’কান পেতে শুনতে ইচ্ছে
করে। এমনভাবে বর্ণনা করে যেন সব তার নিজের চোখে দেখা।
আজ দুপুরেও ডেকেছে তাকে ফকির।
রাবিয়া কাছে যেতেই তার হাত ধরে বলেছে, “আমার মাথাটা একটু
টিপে দেবে রাবিয়া?”
এক ঝট্কায় হাত ছাড়িয়ে চলে এসেছে রাবিয়া। তারপর থেকে মনের
মধ্যে একটা জ্বলুনি। মাসুদকে কীভাবে বলবে! মাসুদের সঙ্গে বিয়ে হবে কিন্তু এখনো
এতটা সহজ হয়নি। তাছাড়া যদি সে অন্য কিছু মনে করে! অবিশ্বাস করে! আবার মা-কে বললে
বাবা শুনলে কী ভাববে। রাবিয়া বুঝতে পারে না।
গভীর রাতে মায়ের ধাক্কা
খেয়ে ধড়মড়িয়ে ওঠে- "ওঠ্ ওঠ রাবিয়া। বাড়িতে পুলিশ এসেছে।"
"পুলিশ!"
"হ্যাঁ হ্যাঁ ফকির নাকি ডাকাত দলের
সর্দার। খুন করে পালিয়ে এসেছে। ওঠ্ আমার বুক কাঁপছে।"
মা সত্যি সত্যি বিছানায় পড়ে
গেলেন। রাবিয়া মা-কে জড়িয়ে ধরলো। তার এখন ভয় করছে। মনে হচ্ছে পেছনে তাকালেই সাপ
দেখতে পাবে। যে সাপের চোখ দুটো ঠিক প্রথম দিন দেখা ফকিরের চোখের মত।
No comments:
Post a Comment