____________________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - অবিশ্বাস।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭
গল্প - অবিশ্বাস
__________________________________
অবিশ্বাস
টেবিলে মাথা নিচু করে
বসে আছে ডা: আতিক। কাল থেকে নিশা তার সাথে কোন কথা বলেনি। বাঘিনীর
মত ফুঁসছে। আতিক নিরুপায়। নিজের কর্মফলে সাজানো সংসার মুহূর্তে তাসের ঘরের মত ভেঙে
পড়ছে। ইচ্ছে করছে মাথার চুলগুলো একটা একটা করে ছিঁড়তে। গায়ের চামড়া খামচে তুলতে।
ইচ্ছে করছে নিশার পা ধরে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু নিশাতো ক্ষমা করবে না। শুধু সন্দেহের
বশে এমন একটা কাজ করেছে যার কথা অন্য কাউকে বলতে পারছে না। অথচ বিষয়টা সবাই জেনে
গেছে।
আতিক কীভাবে নিশাকে বোঝাবে- সন্দেহের
বিষ তার মনে ঢুকেছে নিশার হাসিতে। তার উচ্ছলতায়। মনে হয়েছে একটা প্রায় দ্বিগুণ
বয়সী পুরুষকে বিয়ে করে কোন মেয়ে কী এত খুশি হতে পারে? নাকি সবটুকুই ভান!
চেম্বার, পড়াশোনা, হাসপাতাল সব নিয়ে
আতিকের ব্যস্ত সময়। তবু ঘরে ফিরে দেখেছে নিশার প্রশান্ত মুখ। মাঝে মাঝে ফিরে দেখত
বসার ঘরে মিলন আর নিশা গল্প করছে। নিশার উচ্ছল হাসি বাইরে থেকে শোনা যেত। মনে
হয়েছে তবে কি ওরা আমাকে মাঝখানে রেখে নিজেদের সম্পর্কটাই উপভোগ করছে!
আতিক জীবনে কখনো এমন করে হাসেনি। হাসতে
পারেনি। সুযোগও হয়নি। সেই কোন শৈশবে বাবার মৃত্যুর পর মায়ের একটাই চাওয়া ছিল পড়া,
পড়া, পড়া। লেখাপড়া শিখে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। ভাইবোনদেরও একই কথা। এভাবে পড়তে পড়তে
কখন যে নিজের গন্ডিটা ছোট থেকে ছোট হয়ে গেছে বুঝতেও পারেনি। বিদেশে থাকতেই মায়ের
মৃত্যু তাকে যেন আরো বেশি বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল সবার থেকে। ডিগ্রী নিতে নিতে বয়স
যে কখন চল্লিশ ছুঁয়ে গেছে নিজেও জানতে পারেনি।
দেশে ফেরার পর বড়বোনের তাগিদেই বিয়ের
কথা ভাবছিল। বয়সের কারণে উপযুক্ত পাত্রী পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রথমে ডাক্তার মেয়ে
খুঁজেছিল। কিন্তু এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আগে থেকেই জুটিবদ্ধ। একজনের সাথে প্রায়
পাকাপাকি হয়ে ছিল কথাবার্তা। অভিভাবক রাজি। কিন্তু মেয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, এত বয়স্ক
লোককে সে বিয়ে করবে না।
আর নিশা তাকে বিয়ে করেই কেমন হাসিখুশি,
আনন্দে সংসার করছে। কই! সে নিজেতো এমন প্রাণখোলা হাসি কোনদিন হাসেনি। একসময়
অর্থকষ্ট ছিল আজ তাও নেই। তবুও সেভাবে হাসতে পারে কই। মনের কোণে সন্দেহের বীজ উপ্ত
হয়েছে। তবে কি ওরা দুজন আমাকে ঠকিয়েছে? নিশা কনসিভ করার পর সন্দেহে নিজেকে
বিভ্রান্ত করেছে। একসময় মাথায় এসেছে ডিএনএ টেস্টের ভাবনা ভেবেছে সন্দেহ থেকে
মুক্তির এটাই উপায়।
বাচ্চার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিশা ঘুরে
দাঁড়ালো আতিকের দিকে -
-আমি চলে যাচ্ছি।
-না যেওনা।
আর্তচিৎকার করে উঠল আতিক।
-যেখানে বিশ্বাসের ভিত্তি নেই সেখানে
থেকে কী হবে? প্রতি মুহূর্তের অবিশ্বাস কাঁটার মত বিঁধবে।
-কোন অবিশ্বাস কোন সন্দেহ নেই। আমি ভুল
করেছি। ভুল। সাংঘাতিক ভুল। তবু এ শাস্তি আমাকে দিও না। আমি বাঁচব না। ক্ষমা চাইছি
তোমার কাছে। ক্ষমা করো, ক্ষমা করো।
-কিসের ক্ষমা? এত সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে
যাওয়ার পরও ক্ষমা! ক্ষমা মানুষকে মানুষ করে, কাপুরুষকে নয়। আমি তোমাকে ঘৃণা করি।
তোমার দিকে তাকাতে আমার ঘৃণা হয়। অবিশ্বাসী, বেঈমান।
-তুমি যা বলো। আমি সব মেনে নিচ্ছি। আমি
আসলে তাই। তবু তুমি চলে যেও না। তোমাকে ছেড়ে অনীককে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। আমি
মরে যাব। বিশ্বাস করো আমি সত্যিই মরে যাব।
-অনীক কি তোমার ছেলে? তুমিতো বিশ্বাসই
কর না অনীক তোমার ছেলে।
-বলছিতো আমি ভুল করেছি। অনীক আমার ছেলে।
-তাহলে ডিএনএ টেস্ট করিয়েছো কেন? তোমার
সন্দেহ হয়েছিল আমার সঙ্গে অন্য কারো সম্পর্ক আছে সে সম্পর্কের ফসল অনীক। এত জঘন্য
চিন্তা তুমি করেছ এবং সেটা প্রমাণের জন্য ছেলের ডিএনএ টেস্ট করেছ, এই তোমার চরিত্র
ছিঃ। আমি থুতু দিই তোমার মুখে।
-দাও,দাও। তবু আমার ছেলেকে তুমি কেড়ে
নিও না।
-তোমার ছেলে- বলতে লজ্জা করে না? এবার
বলো, কাকে তুমি সন্দেহ করেছ মিলনকে?
-প্লিজ, আর বলো না। আমি লজ্জিত, দুঃখিত।
-দুঃখিত!
ব্যঙ্গ ঝরল নিশার
কন্ঠে।
-তুমি মানুষ নাকি যে দুঃখিত হবে। তুমিতো
একটা জন্তু।
বলতে বলতে
দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ওঠে নিশা। সে কান্নায় যন্ত্রণার আর্তি। কাঁদতে কাঁদতেই বলে
নিশা, তুমি জানতে না মিলনের কথায় বিশ্বাস করে আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। না হলে তোমার
মতো একটা বুড়ো হাবড়াকে কে বিয়ে করে।
-জানি, জানি, সব জানি। তারপরও ভুল
করেছি।
-শুধু ভুল নয়। বিশ্বাসঘাতকতা করেছ
মিলনের সাথে, আমার সাথে এমনকি অনীকের সাথেও। ঐ ছোট্ট শিশুটি জানে না জন্মের পরই
তার বাবা তাকে অবিশ্বাস করেছে। ডিএনএ টেস্ট করে পিতৃত্বের প্রমাণ চেয়েছে। হায়
আল্লাহ, আমি কোথায় যাব, কাকে বলব একথা।
বুকভাঙা কান্নায় বিছানায় লুটিয়ে পড়ে
নিশা। আতিক ছুটে আসে চেয়ার ছেড়ে।
-সাবধান। তুমি আমাকে ছোঁবে না।
হঠাৎ খাপ খোলা তলোয়ারের
মত ঝিকিয়ে ওঠে নিশা।
আতিক থেমে যায়। যে ঘৃণা নিশার দুচোখে
ঝরছে তার দিকে তাকাতে ভয় পায়। কাঁদতে কাঁদতেই নিশা বলতে থাকে,
-তুমি জানো না, মিলন আমার ভাই! দেড়বছর
বয়সে মা হারানোর পর আমার খালা মিলনের মা আমাকে বড় করেছে। ওদের তিন ভাইবোনের সাথে
আমি বড় হয়েছি। মিলন আমার ভাই। হ্যাঁ মিলন আমার বন্ধু। সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু আর তাই মিলনের
কথায় আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। তুমি ডাক্তার, ভাল ছাত্র, দেশ বিদেশের
বড় বড় ডিগ্রি তোমার। আমি মিলনকে প্রশ্ন করেছিলাম, এত ডিগ্রী, এত নাম যশ, তার কি বিয়ে
করার মেয়ের অভাব আছে? আমাকে কেন বলছিস? তোর ঐ বুড়ো স্যারকে আমি
কেন বিয়ে করব যে আমার চেয়ে আঠারো-বিশ বছরের বড়। আমি না করেছি। কিন্তু মিলন
দিনের পর দিন আমাকে বুঝিয়েছে মানুষের সঙ্গী দরকার। স্যার বড়ো একারে।
-তাতে আমার কী?
-তোর কিছু না হলেও আমার আসে যায়। স্যার
আমাকে অনেক স্নেহ করে। কিন্তু তার বাসায় গিয়ে দেখেছি বেহাল অবস্থা। একটা পুরুষ
মানুষের ঘর যেমন হয় আর কী। তার উপর আবার ডাক্তার। শহরের নামকরা ডাক্তার। অথচ তাকে
দেখার কেউ নেই। বল এটা কষ্টকর নয়?
-তার মা-বাবা কোথায়? ভাই-বোন নেই?
-বাবাতো ছোটবেলায় মারা গেছেন। মাও মারা
গেছেন যখন স্যার বিদেশে। আর ভাই-বোন! সবাই যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত।
দিনের পর দিন মিলন এভাবে আমার মন গলাতে
চেষ্টা করেছে। বলেছে মানুষটাতো দেশেরও সম্পদ। এমন মানুষ যদি ভাল না থাকে আমাদেরও
ক্ষতি। মিলন বাসায় এলেই কেবল স্যারের গল্প। যেন তার স্যার এক মহান পুরুষ, তার
স্বপ্নের নায়ক। অথচ সে মিলন আমার ভাই, আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু এখন এ বাসায় আসে
না। আমার সঙ্গে দেখা করে না। তারও স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। তুমি, তোমার নোংরা মনের কালি
লেগে। আমরা দুটো ভাই-বোন দুজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।
কাঁদতে কাঁদতেই আগুনচোখে স্বামীর দিকে
তাকায় নিশা- তুমি কি ভেবেছিলে তোমার নোংরামির কথা কেউ জানবে না! নিজেকে এত চালাক
ভেবেছ? তুমি ছেলের চুল নিয়ে ওষুধ কোম্পানির লোককে দিয়েছ গোপনে টেস্ট করাতে। নিজেকে
গোপন রেখেছ। কিন্তু পাপ কি চাপা থাকে? তোমার সেই বিশ্বাসী লোকই সবার কানে কথাটা
তুলেছে। এখন তোমার সম্মান কোথায়? কী মূল্য তোমার এসব বড় বড় ডিগ্রির। ডাক্তাররা
তোমাকে নিয়ে হাসে। ছাত্ররা হাসাহাসি করে। তোমাকে দেখলে আমার সমস্ত শরীর ঘৃণায় রি
রি করে ওঠে। বল বল কেন তুমি এরকম করলে? তোমার মুখ থেকে একথা শুনেই আজ আমি যাব।
একটা মেয়ের আত্মসমর্পনেই কী বিশ্বস্ততার ইঙ্গিত থাকে না! আমি তোমাকে বিশ্বাস করে
নিজেকে উজাড় করে দিয়েছি আমার চব্বিশ বছরের তিল তিল করে জমানো ভালবাসা আর যৌবন।
তুমি কিভাবে অবিশ্বাস করলে? ও! আমি কাকে কি বলছি। তুমি তো একটা পশু। পশু ছাড়া এমন
কেউ করে। বলো, জবাব দাও। কেন এমন করেছ?
-আমি জানি না, জানি না। আমার নিজের ওপরই
বিশ্বাস ছিল না। মনে হয়েছে তুমি আমার চেয়ে কত ছোট, অথচ কত সহজে আমাকে বিয়ে করতে
রাজি হলে তাই সন্দেহ আমাকে এই জঘন্য কাজে লিপ্ত করেছে।
-ঢং করো না। এখন দোষ সন্দেহের। “সন্দেহ আমাকে লিপ্ত
করেছে” কি কথার
বাহার! সন্দেহ কেন করেছ? কোনদিন কি সন্দেহের কিছু দেখেছ?
-দেখিনি। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে এলে
দেখতাম তোমরা দুজন বসে গল্প করছ। হাসাহাসি করছ। আমার ভয় হত। সন্দেহ হত।
-দুজন মানুষ হাসাহাসি আর গল্প করলেই
তাদের শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ হয়? তাহলেতো বাইশ বছর আমি মিলনের সঙ্গে
কাটিয়েছি। কই আমাদেরতো এমন কথা মনে হয়নি। আর তুমি দুদিনেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে
নিলে! বাহ। একজন উচ্চ ডিগ্রীধারী ডাক্তারের কি অদ্ভুত সিদ্ধান্ত! আসলে তোমার নিজের
মনেই পাপ আছে ভন্ড, শয়তান।
বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ায় নিশা। একটু নিচু
হয়ে ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোয়।
-না যেও না, দোহাই তোমার যেও না। তোমার
পায়ে পড়ি -
বলতে বলতে আতিক ছুটে
এসে নিশার হাঁটু দুটো জড়িয়ে ধরে।
নিশা কঠিন ঘৃণায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
No comments:
Post a Comment