_____________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - বোধন ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৯
গল্প - বোধন
__________________________
বোধন
¾ পাপা
¾ কিরে বল।
¾ এবারের ছুটিতে আমি চাটগাঁয়ে নানুর বাড়িতে যাব।
¾ কেন তুই আমাদের সাথে ব্যাংকক যাবি না?
¾ না, পাপা।
¾ এটা কেমন কথা হল!
তুই আমাদের একমাত্র মেয়ে আর তোকে ফেলে আমরা একা একা বেড়াতে যাব? না তা হবে না।
তাছাড়া তোর মাম তোর জন্য সারাক্ষণ টেনশান করবে আর আমিও তোকে মিস্ করব মাই সুইট
ডটার।
¾ প্লিজ পাপা।
বিদেশেতো প্রতি বছরই যাই। এবার আমার ইচ্ছে আমি নানুর বাড়িতে যাব। কত দিন নানুকে
দেখি না।
¾ বাট্ ব্যাংককে গেলে
তুই কতো নতুন নতুন জিনিস দেখতে পাবি যা আমাদের বাংলাদেশে নেই। তারপর আমরা কত্তো
শপিং করব। আমাদের গুলশানের নতুন ফ্ল্যাটটার ডেকোরেশানের জন্য তোর মামতো একটা লম্বা
লিস্ট করেছে।
¾ সরি বাবা। আমার
সত্যি সত্যি ভাল লাগছে না দেশের বাইরে যেতে। আমার নানুর বাড়িও কি কম সুন্দর!
কর্ণফুলি নদী, দেয়াং পাহাড় আর পার্কি বিচের সমুদ্র ফ্যান্টাস্টিক! তাছাড়া ছোট মামা
আছে। সুমনা আন্টি আছে।
¾ ঠিক আছে আমরা
ব্যাংকক থেকে ফিরে এসে একদিন না হয় তোমার নানুর বাড়িতে যাব। ওখানেতো আজকে গিয়ে
কালকেও আসা যায়।
¾ না পাপা, আমি বেশি
সময় থাকতে চাই। নানু ভাইয়া আর নানুর কাছে। প্লিজ পাপা, প্লিজ ¾
এবার সোফা ছেড়ে এসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরল
টিনা।
¾ ঠিক আছে, তোমার মাম কী বলে দেখ। আমিতো চাই
দেশ-বিদেশে ঘুরে তুমি অনেক কিছু শেখ। অনেক বেশি স্মার্ট হও। একদিনতো আমার এসব
বিজনেস তোমাকেই দেখতে হবে। তাছাড়া ও-লেভেলটা পাস করলেই আমি তোমাকে লন্ডন পাঠিয়ে
দেব। ওখানেই পড়াশোনা করবে তুমি।
¾ সে তো অনেক দেরি
পাপা। আমিতো মাত্র এবার নাইন-স্ট্যান্ডার্ডে উঠব। এখন আমাকে শুধু এবারের ছুটিতে
নানু বাড়ি যেতে দাও।
এতক্ষণ রিমোর্ট কন্ট্রোলে চ্যানেল টিপতে টিপতে বাবা-মেয়ের কথা
শুনছিলেন টিনার মা রুমানা। এবার ঘুরে বসলেন টিনার বাবার দিকে ¾ মেয়েটা যখন যেতে
চাচ্ছে না থাক না। পরাগকে ফোন করলে ও এসে টিনাকে নিয়ে যাবে। আমরাতো দশদিনের মত
থাকব। থাকুক না ও মায়ের কাছে। এর পরতো পড়াশোনার চাপ বাড়বে তখন ইচ্ছে করলেও যেতে
পারবে না।
¾ কী বলছ! ভিসা টিকেট
সব হয়ে গেছে। এসময় এরকম কথা বললে চলে!
¾ প্লিজ পাপা, প্লিজ। এবার টিনার কন্ঠে আর্তি।
¾ ঠিক আছে তোমার যা খুশি করো ¾ বলে বাবা রাগ করে
বেডরুমের দিকে পা বাড়ালেন।
সকালে উঠেই টিনা রেডি হয়ে গেল।
কাপড়-চোপড় কালকেই গোছানো হয়ে গেছে। ছোট মামা মানে পরাগ মামা পরশুদিন ঢাকা এসেছেন।
আজ আবার টিনাকে নিয়ে চাটগাঁ রওনা দেবেন। পাপা আর মাম রাতের ফ্লাইটে ব্যাংকক যাবে।
পাপাও ঘুম থেকে উঠে গেছে। সচরাচর এত
তাড়াতাড়ি ওঠে না। টিনা ওর ফ্রেন্ড মাইশাকে ফোন করল।
¾
মাইশা, চিটাগং যাচ্ছি। নানুর বাড়ি।
মাইশা অবাক হল¾
তোর না ব্যাংকক যাবার কথা!
¾
না এবার নাইক্ষংছড়ি যাব। টিনা মজা করল। তারপর মাইশাকে উইশ করে ব্যাগ কাঁধে আয়নার
সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আরেকটু দেখে নিল। বাইরে আসতেই মা কপালে চুমু খেলেন। বাবা
জড়িয়ে ধরলেন¾ ভালো থাকিস, বেবি।
গাড়িতে
সারাটা রাস্তা মামার সঙ্গে গল্প করে আর রাস্তার দু’পাশের সবুজ দেখতে দেখতে সময়
কেটে গেল টিনার। সত্যি বাংলাদেশটা কত সুন্দর!
মামা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট দিয়ে আসার
সময় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গল্প বললেন। গল্প নয় সত্যি ঘটনা। টিনা অবাক হয়ে শুনল।
এসবতো তার বইতে নেই। সে শুনেছে সেভেন্টি ওয়ানে ফ্রিডম ফাইটারটা যুদ্ধ করেছিল।
কিন্তু ডিটেইলস কিছু জানে না। তার স্কুলে পড়ানো হয় ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর
কানাডার জিওগ্রাফি আর হিস্ট্রি। স্কুলে ফলো করে ওয়েস্টার্ন কালচার। নিউইয়ার্স ইভ-এ
কালচারাল প্রোগ্রাম হয়। অথচ নিজের দেশের লিবারেশান ওয়ার-এর কথা জানে না। কই বাবা
মাও তো কখনো তেমন করে বলেন নি। বাবা অবশ্য ব্যস্ত থাকেন তাঁর বিজনেস নিয়ে।
¾ বাট মামও তো কখনো
বলেনি তোমার মত করে। মামাকে বলল টিনা।
¾ আরে তোর বাবা-মা তো
ব্যাংরেজ হবার স্বপ্ন দেখে। ওদের কি আর এসব মনে আছে? অথচ তোর নানু মানে আমার মা
এখনো বড়্দার জন্য কাঁদে। এখনো আশা করে তার যুদ্ধে যাওয়া ছেলে ফিরে আসবে। এই করে
করেতো চোখ দুটোই গেল কাঁদতে কাঁদতে।
নানুর জন্য মনটা ব্যথায় ভরে ওঠে টিনার।
আহারে নানুর বড় আদরের ছেলে ছিল বড় মামা। যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। ভাবতে ভাবতে
এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে টিনা। গাড়ির সিটে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে যেন দেখতে পাচ্ছে বাংলাদেশের
লাল-সবুজ পতাকাটা আকাশে ওড়াচ্ছে বড় মামা।
গাছ গাছালি ছাওয়া বাড়িটার গেট দিয়ে গাড়িটা ঢুকতেই সুমনা আন্টি,
ছবি মামী আর ছোট ফুল্লরা ছুটে আসে। নানুভাই আর নানু বারান্দায় বসা। নানু দু’হাত বাড়িয়ে আছেন। টিনা ছুটে
গিয়ে নানুর গলা জড়িয়ে বুকের মাঝে মুখ লুকায়। মায়ের গন্ধ পায়। কিছুক্ষণ ঝিম হয়ে
থাকে দু’জনে।
তারপর একে একে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে। ফুল্লরা হাত ধরে টানে।
¾
এসো টিনা আপু, পুকুরে হাঁস দেখবে। আমাদের হাঁসগুলো কি তুলতুলে বাচ্চা দিয়েছে দেখবে
এসো। বাবা বলেছে তুমি এলে আমাদের বেড়াতে নিয়ে যাবে বান্দরবান। আমরা চিম্বুক পাহাড়ে
উঠব।
ফুল্লরা
পরাগ মামার মেয়ে, ক্লাস থ্রিতে পড়ে। সারাক্ষণ কথা বলে। মামী বাধা দেন¾
ফুল্লরা, তোমার আপু ঢাকা থেকে এসেছে। এখন ক্লান্ত।
বিশ্রাম করতে দাও। সন্ধ্যেবেলা আমরা বাগানে বসে গল্প করব।
ঘুম
ভাঙতেই টিনা বুঝতে পারল না সে কোথায়। জানালা দিয়ে এক ঝলক বাতাসের সঙ্গে বেলফুলের
গন্ধ পেয়ে মনে পড়ল সে এখন নানুর বাড়িতে। মনে পড়ল রাতে পাপাদের ফ্লাইট। মাম ¾
তুমি থাকলে কি মজা হত।
¾ টিনা ওঠো মামণি। সবাই
তোমার জন্য বাগানে বসে আছে। আমরা চা খাব।
মামীর ডাকে টিনা উঠে পড়ল। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল বাগানে পাটি
বিছিয়ে সবাই বসেছে। নানা-নানুও। গাছের পাতার ফাঁকে চাঁদের আবছা আলো। দূরে জোনাকী
পোকারা জ্বলছে নিবছে। বাতাসে ফুলের গন্ধ। এই গন্ধ টিনার অপরিচিত। মামা বললেন¾ ছাতিম ফুল। দূর থেকে
ভাল লাগে। কাছে গেলে তীব্র গন্ধে মাথা ধরে।
মামী ঘরে গিয়ে গান ছেড়ে দিলেন। গানের
সুর ভেসে আসছে। টিনা সব কথা বুঝতে পারে না। আকাশ ভরা সূর্য তারা ¾। কিন্তু সুরটা মনকে
আলোড়িত করে। বাড়িতে এ গান টিনা কখনো শোনেনি। বাবা ইংরেজি গান শোনে মাঝে মাঝে। মা
কখনো কখনো বাংলা গান আর টিনার বন্ধুরা হিন্দি গানের ভক্ত। অবশ্য টিনাদের স্কুল
কম্পাউন্ডে ইংরেজি ছাড়া অন্য কোন ভাষার পারমিশান নেই। কেউ বললে মিস্রা
রেপ্রিমান্ড করেন। স্কুলের চার দেওয়ালের ভিতর টিনারা কখনো বাংলা বলে না। তাই কোন
কোন বাংলা শব্দ টিনার কাছে অসম্ভব হার্ড মনে হয়। তবু আজ এই এনভারনমেন্টে টিনার
কাছে মাতৃভাষাই সত্যি হয়ে ওঠে। মনে হয় এর চেয়ে আপন আর কিছু হতে পারে না।
রাতে ঘুমুতে গিয়ে ফুল্লরা সুমনার কাছে বায়না ধরে ¾ ফুপ্পি, গল্প বলো।
সুমনা গল্প বলে। লক্ষিন্দরের লোহার বাসর, বেহুলার ভাসান যাত্রা আর চাঁদ সওদাগরের
সাহসের গল্প। টিনা একমনে শোনে। শুনতে শুনতে একসময় প্রতিজ্ঞা করে, এবার পাপা এলে
টিনা বলবে¾ সে ও-লেভেল পড়বে না।
বাংলা স্কুলে পড়বে। বাংলা ভাষা শিখবে। টিনা এ দেশে জন্মে বিদেশী হতে চায় না।
No comments:
Post a Comment