২০
কলেজের পিকনিক
কলেজ শুরু হওয়ার প্রথম
দিকে প্রতিবছর ছাত্র-ছাত্রীদের পিকনিক হত। এই পিকনিকের দায়িত্বে থাকতেন
শ্রেণিশিক্ষকবৃন্দ এবং তাঁকে সহযোগিতা করতেন বিষয়-শিক্ষকেরা। সব শিক্ষকের যাওয়া
বাধ্যতামূলক ছিল না। তখন এত প্যাকেট-খাবারের সংস্কৃতি শুরু হয়নি। তাই বড় বড়
ডেকচিতে রান্না করে নিয়ে যাওয়া হত। অথবা ওখানে গিয়ে রান্না করা হত। অনেক হ্যাপার
ব্যাপার ছিল এসব পিকনিক।
চট্টগ্রাম থেকে পিকনিকে যাওয়ার সমস্যা
ছিল চট্টগ্রামের বাইরে কাপ্তাই, বান্দরবান অথবা সীতাকুন্ড এবং মুহুরী প্রজেক্ট। এর
বাইরে গেলে দিনে দিনে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না। ক্লাসটিচার হিসেবে বান্দরবানে
পিকনিকে গিয়ে আমাদের ফিজিক্স ম্যাডাম আয়েশা আপা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বহুদিন
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতাল বা মেডিক্যাল সেন্টারে ছিলেন। বিভিন্ন
পরীক্ষানিরীক্ষায়ও ম্যালেরিয়া ধরা পড়ছিল না। এই অসুখটা বেচারীকে অনেক কাবু করে
দিয়েছিল। এরপর থেকে রোগে ভুগেই গেছেন। কিন্তু ডায়াবেটিস ও একটা কিডনী
ট্রান্সপান্টের পরও তাঁর যে মনোবল ছিল তা দেখে অবাক মানতাম। শেষ পর্যন্ত রোগের
সাথে লড়াই করে চাকরি করেছেন। ছেলে মুফতি ডাক্তার হয়েছে। ছোট্ট ফাইজা শাহীন কলেজে
বড় হয়ে বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। তবে ওনার জীবনের পরম পাওয়া ওনার
লাইট হাউজ মুফতি-ফাইজার বাবা ইঞ্জিনিয়ার সিদ্দিকুর রহমান। খুব কম মেয়ের ভাগ্যেই
এমন জীবন সঙ্গী জোটে। অকাল বিধবা মায়ের বড় ছেলে হিসেবে ভাই বোনদের মানুষ করা, বিয়ে
দেওয়া, ক্যান্সার আক্রান্ত মায়ের সেবা করা এবং সবশেষে প্রায় একযুগেরও বেশি অসুস্থ
স্ত্রীকে সবকিছুতে বুক দিয়ে আগলে রাখা এমন কজন পারে জানি না, কিন্তু সিদ্দিক ভাই
পেরেছেন।
কলেজে প্রথম দু-চার বছর
ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে পিকনিক হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ চট্টগ্রামে পিকনিক
মানেই পাহাড়ি রাস্তায় যাতায়াত, সুতরাং অ্যাক্সিডেন্টের ভয়। তাই ছাত্রসংখ্যা বাড়ার
সাথে সাথে পিকনিক বাদ পড়ল।
মজিদ স্যার আসার পর তিনি শিক্ষকদের নিয়ে
পিকনিক করতে উদ্যোগী হলেন। তাঁর উদ্যোগে আমরা কাপ্তাই গেলাম। ওখানে গিয়ে রান্না
হল, মজাও হল। বিকেলে কাপ্তাই ড্যাম দেখতে গেলাম কিন্তু সময় শেষ আর এতজনকে ঢুকতে
দেয়া হল না। মজিদ স্যার দমবার পাত্র নন। ক্যাডেট কলেজে চাকরি করেছেন। তিনি আমাদের
নিয়ে চললেন কাপ্তাই নৌবাহিনী ঘাঁটিতে। সেখানকার ডিউটি অফিসাররা আমাদের অভ্যর্থনা
জানিয়ে অতিথি কক্ষে বসালেন। কিন্তু সবার মন তখন লেকের অপর পাশে সূর্যাস্তের দিকে।
লেকের নীরব গাম্ভীর্য, অস্তগামী সূর্যের রঙের খেলা গোধুলী ও আগত সায়াহ্নের সেই মন
কেমন করা প্রকৃতি মনে কেমন যেন একটা অবর্ণনীয় আলোড়ন তুলেছিল। সেটা ঠিক আনন্দের নয়-
হারাবার বেদনা। আজও সেই স্মৃতি মনে পড়লে আমার সেই অনুভূতি হয়।
স্যার আশা করেছিলেন ওরা আমাদের চা দিয়ে
আপায়্যন করবে। কিন্তু ওদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। তাই আমরা একদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য
অন্যদিকে মানুষের গড়া নেভাল বেসের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পাখির মতই কলরোল করে
সন্ধ্যাকালে বিদায় নিলাম।
গাড়িতে উঠেই হাসাহাসি। প্রদীপ সবাইকে
বলল, আশা করি আপনারা সবাই ‘বায়বীয় চা’ পান করে সারাদিনের
ক্লান্তি অপনোদন করেছেন। শুনে হাসতে হাসতে সবার পেটে খিল ধরে যাবার উপক্রম। এদিকে
গাড়ি ছাড়তেই সোলায়মানভাই গান শুরু করলেন। উনি নাকি বিরাশিটা গান জানেন। আমরাতো অবাক!
তাকে শুরু করতে অনুরোধ করা হল। তিনি প্রত্যেক গানের প্রথম দু লাইন গান। হায় আল্লাহ।
এই তবে বিরাশি গানের মাজেজা। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি।
পিকনিকের কথা উঠলেই কেউ কেউ কক্সবাজার,
রাঙামাটি, বান্দরবান এসব জায়গায় যাওয়ার বায়না ধরত। বিশেষ করে কক্সবাজার। এটা আসলে
মোটেও সম্ভব ছিল না। দিনে গিয়ে দিনে আসা। তার পরদিন আবার ক্লাস। অন্যদিকে চাঁদা
একটু বাড়লে কিছু স্যারের আপত্তি, তাই আমরা যারা যেতে চাইতাম তারা কাছে পিঠে যেতে
চাইতাম।
একবার তাহসিনা আপাকে প্রস্তাব দিলাম আর
কোথাও যখন যেতে পারছি না, আপনাদের পদ্মা অয়েলে যাই। এত কাছে এত সুন্দর জায়গা অথচ
সবারতো ‘দেখা হয় নাই
চক্ষু মেলিয়া’।
তাহসিনা আপা সাথে সাথে রাজি। কিন্তু
তাঁর শর্ত আমরা ম্যাডামরাই যখন যাব তখন কোন চাঁদাবাজি নেই, তাঁর মেহমান হয়েই যাব।
প্রথমে দোনোমনা করলেও পরে ওনার চাপে পড়ে রাজি হয়ে যাই। পদ্মা অয়েলের অফিসারদের
বাংলোগুলো ছিল খুব সুন্দর। ওনারা সাজিয়ে রাখতেন আরো সুন্দর করে। ক্লাব, খেলার মাঠ,
পুকুর সেই পুকুরের ওপর ব্রিজ, গাছ গাছালি এবং প্রচুর ফুলের বাগান। সবার বাসার
সামনে বাগান। বাংলোর বারান্দায় বসলে শহরে যাওয়ার রাস্তা, তার পাশেই কর্নফুলি নদী।
সেই বারান্দায় বসে মনে হচ্ছিল- এভাবে বসে থেকে বোধহয় সারাজীবন কর্ণফুলি দেখে
কাটিয়ে দেয়া যাবে।
আপা-দুলাভাই (আজিজ সাহেব) আতিথেয়তার
ত্রুটি রাখলেন না। আজিজ ভাই মাছ ধরায় পটু। পদ্মা অয়েলের পুকুরের তাঁর শিকার করা
সেই মাছ কিছুই বাদ গেল না। এখনো মনে করলে সেই টাটকামাছের স্বাদ টাকরায় ফিরে আসে।
আমাদের বাচ্চারা গিয়েছিল। আবহাওয়া ছিল একটু ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আবার একটু মেঘ ভাঙা
রোদ। ক্লাবের সামনে ছাতা দেয়া বসার জায়গা একবার বসলে কেউ বেদখল হওয়ার ভয়ে উঠতে চায়
না। মেঘ-বৃষ্টি-রোদের খেলায় মেতে ওঠা সেই দিনটির স্মৃতি চিরদিনের জন্য আনন্দময়।
তখনো গ্রুপক্যাপ্টেন শাহজাহান সরকার যখন
আমাদের অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন তখন তিনি আমাদের পিকনিকে নিয়ে গিয়েছিলেন
বিমানবাহিনীর ৭৪ স্কোয়াড্রনে। অফিস, থাকা খাওয়া, পাহাড়ে বসে চারপাশের প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য দেখা সবকিছু মিলিয়ে জায়গাটা খুব সুন্দর ছিল। এই একজন র্যাংক পরা
উচ্চপদস্থ অফিসার চট্টগ্রাম শাহীনের শিক্ষকদের যথেষ্ট সম্মান দিয়েছিলেন। তিনিই
প্রথম রোজায় ইফতার পার্টি করেছিলেন কলেজের পক্ষ থেকে। তখন ঘাঁটি অধিনায়ক ছিলেন
কুদ্দুস স্যার (সম্ভবত এয়ার কমোডর দুঃখিত মনে নেই)। তিনি শাহজাহান স্যার বললে কোন
কিছু না করতেন না। শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন মিটিং-এ দেখেছি। শাহজাহান
স্যারও আন্তরিকভাবেই শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া পূরণ করতে চাইতেন, যদিও চেয়ারে বসলে
চেয়ারপ্রধানের সীমাবদ্ধতা বেড়ে যায়।
আমাদের অর্থাৎ বিমানবাহিনীর এডুকেশন
ডিরেক্টর গ্রুপক্যাপ্টেন মোহাম্মদ শাহজাহানও রিটায়ারমেন্টের পর বেশ কিছুদিন আমাদের
অধ্যক্ষ ছিলেন। পরে ঢাকায় এসে অন্য একটি স্কুলে প্রিন্সিপ্যাল হন। সেখানে শিক্ষক
নিয়োগ বিজ্ঞাপনে অধ্যক্ষের অভিজ্ঞতায় দেখেছিলাম প্রাক্তন অধ্যক্ষ শাহীন কলেজ।
কিন্তু তিনি যে শাহীন চট্টগ্রামের অধ্যক্ষ ছিলেন তা উল্লেখ না করে শুধু শাহীন কলেজ
লিখেছিলেন এতে আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম।
তো শাহজাহান স্যার একটু ধীর স্থির
গম্ভীর স্বভাবের হলেও একবার ঠিক করলেন এক শনিবারে হাফ ক্লাসের পর শিক্ষকদের নিজ
খরচে খাওয়াবেন এবং যারা গান জানে তার গান গাইবে। সোজা কথা একটু আনন্দ করা। আমাদের
মিতা চট্টগ্রাম রেডিও-টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী এবং সবরকম গানই গাইতে পারে। কিন্তু
তখন আমাদের মন ভাল ছিল না। কারণ বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ তখনো আমাদের নতুন পে-স্কেল
ঘোষণা করেনি। অথচ সরকার পে-স্কেল অনুমোদন করেছে বছর ঘুরতে চলেছে।
তবু কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন। গান চলছে।
ছোট ছোট চিরকুটে অনুরোধও আসছে শিক্ষকদের কাছ থেকে। আমি মনের খেদে অনুরোধ পাঠালাম-
পরাণের বন্ধুরে বুড়ি হইলাম তোর কারণে- কাঙালিনী সুফিয়ার এই গানটি গাওয়ার জন্য।
হয়তো বিষয় অনুধাবন করে মিতা গানটি শুরু করলে উপস্থিত সবার মধ্যে মুখ চাওয়া চাওয়ি
হতে লাগল। হঠাৎ যেন ধাক্কা লাগল। তারপর অনুষ্ঠান বেশি জমল না। অঞ্জনদা স্টেজে উঠে
ঘোষণা দিলেন, “এখন সবার জৈবিক
ক্ষুধা পেয়েছে”। অনুষ্ঠানে বজ্রপাত, কি বলছে দাদা! কেউ কারো দিকে
তাকায় না।
সবাইকে খেতে ডাকার পর স্যার উঠে গেলে আর
যায় কোথায়। হাসতে হাসতে চোখে পানি। সেদিনের এই বাণী প্রবাদসম হয়ে উঠেছে। ক্লাস থেকে কমনরুমে
এসে টিফিন খাবার আগে আমরা বলতাম। তারপরই হাসাহাসি।
আমি থাকাকালীন আমাদের সবশেষ পিকনিকটি হয়েছিল
তৎকালীন ‘মেরিন একাডেমী’তে যা এখন ‘ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম
ইউনিভার্সিটি’। শাহীনের আদ্যিকাল
থেকেই মেরিন একাডেমির অফিসারদের সন্তানরা শাহীন কলেজে পড়তে আসত। একসময়ের
ডেপুটি কমান্ড্যান্ট ফতেহ লোহানী সাহেবের স্ত্রী হুমায়রা ইয়াসমিন বাচ্চাদের আনা
নেয়ার সুবাদে কলেজের অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন ঢাকা
হলিক্রসের ছাত্রী। স্বাধীনতাপূর্ব আমলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়া এবং বোর্ডে স্ট্যান্ড
করা ছাত্রী। কিন্তু এত বেশি বিনয়ী যে খুব নৈকট্য না থাকলে কারো সঙ্গে কখনো এসব
নিয়ে কথা বলতেন না।
মেরিন একাডেমির বোট ছিল বাচ্চাদের জন্য।
অফিসারদের শহরে যাওয়া আসে ও কেনাকাটার জন্য। হুমায়রা আপা যত বাচ্চা আসত তাদের সবার
দেখভাল করতেন। কোনদিন একাডেমির বিশাল গাড়িটা না এলে হেঁটে এয়ারপোর্ট এসে টেম্পো
ভাড়া করে সবাইকে বোটক্লাবে নদীতীরে নিয়ে যেতেন।
আমরা ম্যাডামরা অনেকে ছুটির দিনে তাঁর
বাসায় যেতাম। কারণ মেরিন একাডেমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিকল্পিত স্থাপনাগুলো এত
দৃষ্টিনন্দন ছিল যে মনে হতো দেশের ভিতর বিদেশ।
আমার চাকরি জীবনের শেষ পিকনিকটিও ছিল এই
মেরিন একাডেমিতে। একাডেমির কমান্ড্যান্ট তখন সাজিদ হোসেন। যিনি একজন কিশোর
মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর এক ছেলে দুই মেয়েও শাহীনে পড়েছে। মনে নেই কার মাধ্যমে
অধ্যক্ষ অর্থাৎ নাসিরভাই তাঁর সাথে যোগাযোগ করেছিলেন এবং তিনি সানন্দে সম্মতি দিয়ে
আমাদের পিকনিক করার অনুমতি এবং স্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কর্ণফুলি নদী আর
বঙ্গোপসাগরের মোহনায় উঁচু-নিচু পাহাড়ি টিলার উপরে নিচে সাজানো ঘর বাড়ি আর প্রাচীন
গ্রিসের নাট্যমঞ্চের আদলে পাহাড় কেটে গ্যালারী করে মাঝখানে মেরিনারদের পাসিং আউট
প্যারেড গ্রাউন্ডটিও প্রথম দেখায় অভিনব মনে হত। আর ছিল জেটি থেকে লম্বা ব্রিজ তার
পাশে প্যারাবন যা জোয়ার ভাটায় ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যপট তৈরি করত। দূরে দিগন্তে মিশে
যাওয়া আকাশ ওপরে পালতোলা নৌকার মত ভাসমান মেঘ, সবুজ পাহাড় সব নিয়ে মেরিন একাডেমি
আসলেই প্রকৃতি ও মানুষের সৃজনশীলতার অনন্য দৃষ্টান্ত। একাডেমি কর্তৃপক্ষের
সহযোগিতা এবং আমাদের শিক্ষকদের সুন্দর ব্যবস্থাপনায় চাকরিজীবনের এই শেষ পিকনিকটি
আমার স্মৃতিপটে অমলিন হয়ে থাকবে।
২১
আমাদের কর্তৃপক্ষ
আমাদের কর্তৃপক্ষ ছিল
তিন ধাপের। একটি কলেজের স্থানীয় প্রশাসন অর্থাৎ অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ। উপাধ্যক্ষকে
বলা যায় ঠুঁটো জগন্নাথ। এক নোটিশ লেখা ছাড়া তার বা তাদের তেমন কোন নির্বাহী ক্ষমতা
ছিল না। কলেজের গন্ডীতে যা কিছু তর্জন গর্জন বা হালুম-হুলুম করতেন অধ্যক্ষ। তাঁর
নির্বাহী ক্ষমতা ছিল কিন্তু সেটা সীমাবদ্ধ গন্ডীতে। কারণ ‘সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’- এর মত আসলে সকল
ক্ষমতার উৎস ঘাঁটি কর্তৃপক্ষ এবং তারও উপরে বিমান বাহিনী সদর দপ্তর।
তাই শিক্ষকদের মত সিভিল অধ্যক্ষও
বেশিদিন টিকতেন না। এতবড় কলেজ অথচ অধ্যক্ষের জন্য কোন কোয়ার্টার নেই, নেই কোন
যানবাহন। সম্প্রতি জেনেছি কলেজের কাজের জন্য (বোর্ডে যাওয়া, ব্যাংক ইত্যাদি
আনুষঙ্গিক কাজের জন্য) একটা গাড়ি দেয়া হয়েছে। কিন্তু অধ্যক্ষের আলাদা কোয়ার্টার ‘দিল্লী হনুজ দূর অস্ত”। অথচ একজন অধ্যক্ষকে যেভাবে
টেনশান এবং এটেনশানে রাখে তাতে তাঁকেও কিছু বাড়তি সুবিধা দেয়া উচিত।
আমার কর্মজীবনে প্রথম অধ্যক্ষ পেয়েছিলাম
গোলাম মহীউদ্দীন স্যারকে-এটা আগেই বলেছি। উপরের চাপ সামলাতে তিনিও শিক্ষকদের
সার্বক্ষণিক চাপে রাখতেন। আমরা যে সিভিলিয়ান, সেনাবাহিনীর সদস্যদের মত সবসময়
স্ট্যান্ডবাই থাকতে পারি না বা পারব না এটা উনিও যেমন বুঝতেন না, তেমন কর্তৃপক্ষও
বুঝত না। একবারতো স্যার প্রস্তাব দিলেন, কর্তৃপক্ষকে বলে আমাদের ‘ওয়ারেন্ট অফিসার’ পদবী দেবার ব্যবস্থা
করবেন। আমরা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। কারণ এ কাঁটার মুকুট আমাদের মাথাকে
বুদ্ধি শূন্য করে দেবে। জানি না স্যারের মাথায় কেন এ বুদ্ধি এসেছিল।
তারপর এলেন এবং গেলেন আকরাম হোসেন। তিনি
এলেন এবং গেলেন। বড়সড় মানুষটা চেয়ারে তাঁর বসার দাগ ছাড়া আর কোন দাগ বা স্মৃতি
রেখে গেলেন না।
এরপর উপাধ্যক্ষ আখতার-উন-নেসা ম্যাডাম
বেশ কিছুদিন চলতি দায়িত্বে থাকার পর এলেন মজিদ স্যার। তার সম্পর্কে আগেই বলেছি।
এবার এলেন মোয়াজ্জেম হোসেন। যিনি কলেজে
দুর্নীতির যত ফাঁক ফোকর আছে দু-একজন শিক্ষককে নিয়ে তার সবগুলো কাজে লাগিয়ে কলেজের
সুনামের চৌদ্দটা বাজালেন। ভর্তিবাণিজ্য করে নিজের পকেট ভারী করলেন। কিন্তু এসব
কাজে দাতা এবং গ্রহীতা উভয়েই কোন প্রমাণ রাখে না। তাই যারা করেছিল তাদের ধরা সম্ভব
হয়নি। মোয়াজ্জেমের তদন্ত কমিশন আমাকেও সাক্ষী মেনে ট্রেনিং উইং এ ডেকে পাঠিয়েছিল।
কিন্তু শোনা কথা বা দৃশ্যমান হলেও সবকিছু প্রমাণ করা যায় না। তবু কলেজের স্বার্থে
তাঁকে পদচ্যুত করা হয়েছিল।
তারপর সুলতান আহমেদ, ক্রিস্টোফার
অধিকারী আরো দু-একজন উইং কমান্ডার বা স্কোয়াড্রন লীডার খুব সাময়িক সময় কলেজে
আসা-যাওয়া করেছেন। ক্রিস্টোফার অধিকারী ভদ্র ও বিনয়ী ছিলেন।
এর মাঝে আখতার-উন-নেসা আপা চাকরি ছেড়ে
দিলে শিরিন সুলতানা ম্যাডাম সিনিয়রিটি ভিত্তিতে ভাইস প্রিন্সিপ্যাল (একাডেমিক) এবং
নাসির ভাই উপাধ্যক্ষ (প্রশাসন) হলেন। এটা সম্ভবত মজিদ স্যার করেছিলেন। একাডেমিক
এবং প্রশাসনিক বিভাজন। এরপর এলেন তালেবুল ইসলাম স্যার। মজিদ স্যার শাহীন থেকে
দুবাই না আবুধাবী বাংলা স্কুলের অধ্যক্ষ হয়ে গিয়েছিলেন আর তালেব স্যার সেখান থেকে
বাংলাদেশে ফিরে শাহীন কলেজে জয়েন করেছিলেন। বর্তমানে শাহীন থেকে গিয়ে উত্তরা রাজউক
স্কুল ও কলেজের উপাধ্যক্ষ হয়েছিলেন।
তালেবুল ইসলাম স্যার প্রশাসক হিসেবে
যথেষ্ট কড়া ছিলেন। দীর্ঘদিন যথাযথ ও
অভিজ্ঞ অধ্যক্ষের অভাবে কলেজের একটা বিশৃঙ্খলা বা নিয়ম কানুনের যে অবনতি ঘটেছিল
তিনি অল্প সময়ে তার অনেকটাই ফিরিয়ে এনেছিলেন। শিক্ষার্থীরাও তাঁকে ভয় পেত। কিন্তু
একদিন হঠাৎ করেই তাঁর সাথে আমার লেগে গেল মানে পার্সোনালিটি ক্ল্যাশ হল।
এর আগে কলেজে ছুটি কাটিয়ে আমরা অনেক সময়
পরে ছুটির দরখাস্ত জমা দিতাম। ছাপানো ফরম না থাকলেও দিতে দেরী হত। সে সময় কি কারণে
যেন ছুটি কাটিয়ে আমিও দরখাস্ত জমা দিতে দেরি করেছিলাম। উনি আমাকে একটা শো-কজ ধরিয়ে
দিলেন। আমি মেনে নিলাম। চাকরিবিধি অনুযায়ী এটা আমার ত্রুটি এবং ত্রুটি মার্জনার
আবেদন জানালাম।
এরপর যেটি ঘটল সেটি আমার জন্য একেবারেই
অনাকাঙ্ক্ষিত। পরীক্ষার হলে আমরা পরিদর্শক (ইনভিজিলেটর) হিসেবে থাকতাম। সত্যি কথা
বললে শিক্ষার্থীরা আমাকে এবং ফারুকী স্যারকে খুব ভয় পেত। অনেকে ডিউটি রোস্টারে
আমাদের নাম দেখলে হা হুতাশ করত। সেদিন পরীক্ষার হলে ডিউটি করছি। দাঁড়িয়ে হেঁটে
ঘুরে ঘুরে চারদিকে চোখ রাখছি। এমন সময় তালেব স্যার এলেন পরীক্ষার হল পরিদর্শনে।
তিনি এসে আমাকে ডাকলেন। আমি করিডোরে গেলাম। উনি আঙুল দিয়ে নির্দেশ দিলেন- এটা
তুলেন।
আমি অবাক হয়ে গেলাম, মাথায় রাগ চড়ে গেল।
বললাম- আমি কেন তুলব, আপনি পিয়ন ডাকুন।
ততক্ষণে রাগে গায়ে আগুন জ্বলছে। উনি যদি
ভদ্রভাবে বলতেন, ম্যাডাম, দেখেনতো এটা কি। আমি হয়তো অনায়াসে তুলে নিতাম।
-আপনার রুমের পাশে। উনি বললেন।
হতে পারে। কিন্তু এখান দিয়ে সারাক্ষণ
ছাত্ররা ওয়াশরুমে যাচ্ছে। তাদের কেউ যে ফেলে যায়নি সেটা কে বলবে। আর আমার রুমের
ছাত্ররাও ছুঁড়ে ফেলতে পারে অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু ছাত্রদের সামনে উনি এভাবে আমাকে
হুকুম করতে পারেন না। বরং ওনার সাথে বাক-বিতন্ডায় যে সময় যাচ্ছে তাতে পরীক্ষার
হলের ছাত্ররা সুযোগ নিতে পারে। কিন্তু তারাও নিস্তব্ধ।
পিয়ন ইদ্রিস এলো। কাগজটা তুলে ওনার হাতে
দিল। এক টুকরা নকল। ভীষণ মেজাজ খারাপ করে ডিউটি শেষ করে এলাম। বসে আছি। এমন সময়
কুরিয়ার সার্ভিসের লোক একটা প্যাকেট নিয়ে এল। খুলে দেখি জি এইচ হাবীবের অনুবাদে
নেদারল্যান্ডের একজন লেখকের দর্শনভিত্তিক উপন্যাস “সোফির জগৎ”। প্রেরক আমাদের ৮৮ ব্যাচের ছাত্র রবিউল ইসলাম সবুজ। বইয়ের
ভিতরে লেখা- “আপনার
অনুপ্রেরণায় বই পড়তে শিখেছি। এই বইটি আমার খুব ভাল লেগেছে, আশা করি বইটি আপনারও
ভাল লাগবে”।
আহ! বাঁচলাম। ঐ তিরস্কার নয়, এই
পুরস্কারই আমার প্রাপ্য। সেদিন ছিল ১২ ডিসেম্বর, সম্ভবত ২০০২ বা ২০০৩ সাল।
অধ্যক্ষ তালেবুল ইসলাম বেশিদিন থাকেননি।
কারণ কর্তৃপক্ষ অধ্যক্ষের জন্য যে দীন-হীন ব্যবস্থা রেখেছেন সেটা তার পছন্দ হয়নি।
পরে তিনি উত্তরা রাজউকের স্কুলে উপাধ্যক্ষের চাকরি নিয়ে চলে যান।
পরবর্তীতে যখন কোন অধ্যক্ষ চলে যেতেন
তখন শিরিন আপা চলতি দায়িত্বে থাকতেন। যশোর শাহীন এবং চট্টগ্রাম শাহীনে দীর্ঘ বাইশ
বছর চাকরি করে ওনার হাসবেন্ড ঢাকায় পোস্টিং হলে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। পরে তাঁর
স্বামী গ্রুপক্যাপ্টেন জাফরউল্লাহ বিমান বাহিনীর এডুকেশন ডাইরেক্টর হয়ে রিটায়ার
করেন। শিরিন আপা ঢাকায় এসে “শহীদ আনোয়ার গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে চাকরি করে সম্প্রতি
অবসর নিয়েছেন। কিন্তু ২২ বছর চাকরি করে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ছাড়া বিমান বাহিনী
থেকে তিনি পারিতোষিক হিসেবে কিছুই পাননি।
এভাবে বেশ কিছুদিন গ্রুপক্যাপ্টেন
হুমায়ুন স্যার এবং আরো দু-একজন (ঠিক মনে নেই) ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে স্বল্প
সময় থেকে পোস্টিং-এর কারণে ভারমুক্ত হয়ে চলে যেতেন।
অবশেষে মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন অর্থাৎ
নাসির ভাই অধ্যক্ষ হলেন। বিজ্ঞজনের একটা মতামত আছে- তৃণমূল থেকে যে নেতা উঠে আসে
সে নেতা স্থায়ী হয়। কারণ প্রশাসন চালানোর অন্ধিসন্ধি বা খুঁটিনাটি সে রপ্ত করে এবং
তার উপরমহলের মন মানসিকতার হাল হলিকত এবং তবিয়ত বুঝে চলতে পারে।
নাসির ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
সদ্য পাশ করে শাহীন কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তারপর সহকারী অধ্যাপক
উপাধ্যক্ষ প্রশাসন হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করে অবশেষে ইন্টারভিউ দিয়ে অধ্যক্ষের পদলাভ
করেন। এখন তিনি দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে শাহীন কলেজের প্রশাসন চালাচ্ছেন। চৌকো
লাল দালানের ছোট্ট শাহীন থেকে আজ চট্টগ্রাম শাহীন আয়তনের বিশালত্বে, শিক্ষার্থী ও
শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধিতে, বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন যে বিরাটত্ব অর্জন করেছে
নাসিরভাই তার সবকিছু সামাল দিচ্ছেন।
তাঁর সময়ে তাঁর এবং ঘাঁটি অধিনায়কের
উদ্যোগে ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারীর ২৬ তারিখে কলেজে প্রথম অনেক বড় করে রি-ইউনিয়ন হল।
আবার ২০১৮ সালের ২ মার্চ কলেজের চল্লিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান হল অত্যন্ত জাঁকজমকের
সাথে। গত চল্লিশ বছরে শাহীনের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত
হয়েছে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ অনুষ্ঠানকে সাফল্যমন্ডিত করেছে। এদের মাঝে
সুজাউদ্দীন বাবু, সাইয়েদুল বাকিন, মাহমুদুল হাসান, এনাম-উল-হক, সৈয়দা নারগিস
সুলতানা বিনু, হালিমা খাতুন এরা মূল কান্ডারী ছিল।
নাসির ভাই অধ্যক্ষ হওয়ার পর একদিন বেস
হেডকোয়ার্টার থেকে মহীউদ্দীন ভাই, সাঈদ ভাই, ফারুকী ভাই, বিমলদা ও আমাকে ডাকা হল।
একজন একজন করে ডেকে জ্ঞিজ্ঞেস করা হল আমরা উপাধ্যক্ষ হতে আগ্রহী কি না। মহীউদ্দীন
ভাই, ফারুকী ভাই ও আমি এক বাক্যে না করে দিলাম। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলে, ‘আঁরে ভূতে পাইয়ে না!’ মনে মনে তাই বলে বিদায়
হলাম।
এরপর সাইদ ভাই উপাধ্যক্ষ হলেন। নাসির
ভাই মাধ্যমিক, প্রাথমিক ও ইংরেজি ভার্সনের প্রত্যেক শাখায় একজন করে সহকারী প্রধান
শিক্ষক নিয়োগ দিলেন। নাহার আপা মাধ্যমিক শাখার এ্যাসিস্টেন্ট হেডমিস্ট্রেস হলেন।
আমরা খুব খুশী হলাম।
No comments:
Post a Comment