-----------------------------------
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫
___________________________________
২১
তারা বানুর ঘরে পরিবারের
সবাই এসেছে। বিশাল
কামরার একপাশে শহর থেকে
আনা ব্র্যান্ডের ফার্নিচারের দোকান
থেকে কেনা কিংসাইজ খাটের
একপাশে চারপাশে বালিশ দিয়ে
বসানো হয়েছে তারা বানুকে। একপাশের সোফায় আর চেয়ারে
তার ছেলে-মেয়ে, পুত্রবধূ
ও জামাতারা বসেছে।
বড় ছেলে
আফজাল প্রথম মাকে বলল, "আম্মা জানেনতো বড়দাদী কাইল
মারা গেছেন, রাইতে মাডি
অইছে।"
"হ আফজু,
জানুম না ক্যান। শক্তি
থাইকলে আমিও যাইতাম। একসময়
কত মহব্বত কইরছে আমাগোরে। তোমার বাপেরে কাকুরা, চাচীরা
বহুত মায়া করত। মাস্টার
বইলা ইজ্জত করত।"
"হ, আম্মা
সেসব জানি। কিন্তুক
এখন কথা হইল আল্লায়
আমাগোরে ধনসম্পদ দিছে। একদিন
গরীব আছিলাম। আব্বায়
লেখাপড়া করনে দাদা-দাদীরা
ইজ্জত করত। কিন্তু
এইডাওতো হাঁছা কতা আমাগো
ইস্টিকুডুমরা ওনাগো কামলা খাটছে। আমার দাদাও হেগো বর্গাদার
আছিল। কিন্তুক এখন সময় ভিন্ন। আল্লায় আমাগো দিন দিছে,
হেগো থেইকা আইজ আমাগো
কম নাই, বরং বেশি
আছে।"
"না বাপ,
এমন কইরা কইও না। হেরা বহুত মানী বংশ। বংশের একটা গুণ
আছে না। আল্লা
নারাজ অইব।"
হ, তারাবানুর আল্লারে
বড় ভয়। সেই ছোডব্যালা
থাইকা কষ্টতো কম করেনি। মা-বাপের সংসারে ভাতকাপড়ের
কষ্ট, স্বামীর সংসারে আইসাও
হে কষ্টের কমতি অয় নাই। স্বামী ল্যাখাপড়া শিখ্যা মাস্টর
অইছিল, গেরামে সনমান
আছিল। কিন্তুক টাকাপয়সার
টানাটানি। অভাবের কমতি
আছিল না। তার উপর পোলার
বাপ চাকরি করত শহরে। তারাবানুরে সামলাইতে হইত সব দিক।
তয় এইডা ঠিক,
আল্লার রহমত আছিল। তারাবানুর
মাইয়ারা মায়ের রূপ পাইছিল। রূপের সুনামেই ভালা ঘরে ভালা
বরে বিয়া অইল। আর পোলারা
বাপের কাছে থাইকা লেখাপড়া
শিইখ্যা চাকরি বাকরি, ব্যবসায়
নামল। বড় পোলা
আফজাল কষ্ট কইরা ঢাকায়
দোকান লইল। কাপড়ের
ব্যবসা, হের পর গার্মেন্স
আর অহনতো চাকরি ছাইড়া
সব ভাই ব্যবসা করে। শুধু দুঃখ একটাই,
পোলাগো বাপ এত সুখ দেইখা
গেল না। ঢাকা শহরে পোলারা ফেলাট কিনছে।
মায়েরে নিতে চায়।
পোলাগো মুখ চাইয়া গেলেও শহরে বেশিদিন ভালা লাগে না তারাবানুর।
ঘরের মইদ্যে বন্দী, এসির বাতাসে গা ব্যাথা করে।
নিঃশ্বাস বন্দ হইয়া আইতে চায়।
অহনও গেরামই ভালা লাগে।
ছেলেরা অবশ্য নতুন বাড়ি কইরা শহরের সব সুবিধা কইরা দিছে।
গরমপানি ঠান্ডাপানি কোন কিছুর কষ্ট নাই। কিন্তুক
এত সুখ কি আর সয়?
বছর দুই আগে স্টোক কইরা শরীলের একদিকটা অচল হইয়া গেল।
পোলারা বিদেশে নিয়াও চিকিচ্ছা করাইল।
কপাল তারাবানুর, ভাল আর হইল না।
অহন মায়ের উঠানামার লাইগা লিফট লাগাইছে।
চাক্কার চেয়ারে বইসা তিনতলা বাড়ি, উঠান, বাগান হগগল জাগা ঘুইরা বেড়ায়।
"মা।" বড়মেয়ে সকিনা ডাক দিল।
তারাবানু এতক্ষণ কোন ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল।
মেয়ের ডাকে যেন হুঁশ ফিরে পায়।
"কও মা।"
"মিয়াভাইরা বইসা আছে।
আপনের লগে পরামর্শ করনের লাইগা।"
"হ,
হ। কও বাজান।"
এসব ক্ষেত্রে
সাধারণত আফজালই কথা বলে।
"মা, বড়দাদী
এন্তেকাল করছেন অহন তো আমাগো
কিছু করা লাগে নাকি?"
"কী করতে
চাও তোমরা?"
"আমরা মউতা বাড়িত আইজকা রাইতে খানা দিতে চাই।
আপনে কইলে আমি বড়কাকার লগে কথা কইয়া ওনাগোরে দাওয়াত দিমু।"
"এইডাতো খুব ভালা কথা।
আল্লায় তওফিক দিছে দিবা না ক্যান।
তয় হেগো সম্মান মত দিও বাজান।"
আফজাল মনে মনে একটু বিরক্ত হয়।
মা খালি হেগো সম্মানের কথা কয়।
আমাগো কি সম্মান নাই? লেখাপড়া শিখ্যা, ব্যবসা বাণিজ্য কইরা টাকাপয়সাতো কম হয়
নাই। গেরামের
উন্নতির লাইগা কম খরচ করে নাই।
তবু খালি হেরা মানী বংশ, বহু বড়মানুষ এসব মায়ের মন থাইকা যায় না।
"আপনে ভাইবেন না মা।
আমরা তিনভাই আছি, বইনের জামাইরা আছে হগলে মিল্যাই করুম।"
"আইচ্ছা বাপ।
তয় আগে তোমরা বড়মিয়ার অনুমতি লইও।"
"হ, আমি যাইতাছি।"
****
২২
সকালে
মায়ের কবর জেয়ারত করে কাছারী বাড়ির বারান্দায় বসে লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন জহির চৌধুরী।
এমন সময় আফজাল এসে উপস্থিত হল।
যারা জহিরকে ঘিরে টুল-বেঞ্চে বসা ছিল তারা সবাই প্রায় সমস্বরে সালাম দিল আফজালকে।
একবারেই সবার সালামের প্রত্যুত্তর দিয়ে জহিরের দিকে তাকিয়ে সালাম দিল, "আসসালামুআলাইকুম, কাকা।"
"ওয়ালাইকুম।
কী খবর আফজাল, কেমন আছ?"
"আপনাগো দোয়ায় ভালই কাকা।"
"তোমার ব্যবসা-বাণিজ্য কেমন চলছে? ঢাকায় তো দেখাই কর না।"
"আসলে
কাকা সময় পাইনা।"
"হ, সময় পাইব
ক্যামনে। আফজল মিয়া
এখন কাপড়ের মিল বসাইছে। গেরামের বহুত পোলাপাইনরে কাম দিছে।"
জহির হাত তুললেন। বক্তা নির্দেশের মর্ম বুঝে
থতমত খেয়ে চুপ করে গেল। আফজাল বুঝতে পারে চৌধুরী
সাহেব এসব কথা শুনতে
চায় না। পরিস্থিতি
বুঝে সে তাড়াতাড়ি বলল,
"কাকা, মা পাঠাইছেন
আমারে।"
"কী ব্যাপার?"
"না, মা তো অচল। না হইলে নিজেই আসতেন। দাদীজানরেও
শেষ দেখাটা দেখতে পারলেন
না। তয় মায়ের
খুব ইচ্ছা আইজ রাইতের
খানাটা আমরা দিই। হের লাইগা
আমারে পাঠাইল। আপনে
কবুল করলে আমি বাড়িত
গিয়া মায়েরে জানামু।"
জহির অবাক হয়ে ভাবেন,
আফজালরা তৌহিদা বেগম চৌধুরানীর
মৃত্যুতে তাঁর পরিবারকে একবেলা
খাওয়াতে চায়! তারা কী ভুলে
গেছে এই বাড়ির ভাত খেয়ে
আর হালচাষ করে তাদের
চৌদ্দপুরুষের জীবন কেটেছে!
মুহূর্তে
নিজেকে সামলে নিলেন। দিনকাল
পালটে গেছে। মোল্লাবাড়ির
মাস্টারের ছেলেরা আজ অনেক
ধনী। তাদের মত টাকা
কড়ি আজ চৌধুরীদেরও নেই। ঢাকা শহরে ব্যবসার পার্টিতে
এক আসনে এক সঙ্গেই
খেতে হয়। আফজাল
এখন শিল্পপতি। সুতরাং
পুরণো বংশমর্যাদা মনে রেখে
দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার
দিন আজ আর নেই।
ভিতরের উদ্বেগটা
চাপা দিতে চাইলেও ভাইদের
কথা মনে করে একটু
বিব্রত হলেন। ওরা কি গ্রহণ
করবে এ দাওয়াত? উপস্থিত
লোকজন তাদের দুজনকে দেখছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন। আফজালকে বললেন, "তোমার
মাকে বলবে তার দাওয়াত
আমি কবুল করলাম।"
"তা হইলে,
কাকা আপনে মেজকাকা আর ছোটকাকারে
জানাই দিয়েন। আমি বিকাল
নাগাদ খানা পাডাইয়া দিমু। আইচ্ছা কাকা যাই। আসসালাআলাইকুম।"
ভিতর বাড়িতে
দাওয়াতের খবর যেতেই তারিক
হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিল।
"কে দিল এই দাওয়াত
আর কে নিল? যে নিছে
হেই খাইব এই খানা। মোল্লাবাড়ির মানুষ চৌধুরী বাড়িতে
দাওয়াত দিতে আসে! পয়সা
দুইটা হইলে সব সমান
হইয়া যায়?"
মেজভাইয়ের হৈ চৈ শুনে
ওপর থেকে নেমে আসে শরীফ। সব শুনে তারও
মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। চিৎকার করে ওঠে সেও। "কিসের দাওয়াত?
কে কারে দাওয়াত দেয়। দুনিয়াতে মান মর্যাদা বংশ এসবের
কী কোন দাম নাই?
কে নিল দাওয়াত,
কারে দিল?"
"আর কে? বড়মিয়ারে দিছে।"
"অহ, ঐ চোরে
নিছে দাওয়াত। তাতো
নিবেই। চুরি চোট্টামী
করে করে তার কি
মান ইজ্জত আছে?
এই রফিক, হারামজাদারে
বল আফজালরে জানাই
দিতে, আমরা এ দাওয়াত
নিলাম না।"
এতক্ষণ কাজের
বুয়াদের যে কলকলানি আর হাঁড়ি
পাতিলের শব্দ হচ্ছিল এখন সব থমকে
আছে। মেহমানরা যে যেখানে
ছিল এসে জড়ো হয়েছে। তারা জানে ভাইয়ে ভাইয়ে
শত্রুতা, তাই বলে মায়ের
মৃত্যুর পরদিনই এভাবে গালিগালাজ! কিন্তু ছোটবড় সবাই
চুপ। মুরুব্বী যারা
আছে তাদেরও সাহস নেই এদের
নিবৃত্ত করার। সবারই
ভয় পাছে নিজেকে অপমানিত
হতে হয়।
বাড়ির শরীকের
লোকজনও এসেছে। রফিক
ভোর ভোরই এসেছিল। সব শুনে
উঠানে চুপ করে দাঁড়িয়ে
আছে। এটা ঠিক বড়ভাইয়ের
প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বলে তার যে কোন কাজে
তাকে দৌড়াতে হয়, একরকম
চাকর খাটার মত। তাই বলে এরকম
গালি? টাকার কাছে আত্মীয়তার
কোনও দাম নাই।
সাবেরা, আন্না,
আয়না সবাই চুপ করে আছে। সাবেরার সাহস হয় না কিছু
বলতে। এরা সুযোগ
পেলেই জহিরকে অপমান করে,
পারলে জেল খাটাতে চায়,
এরা কি তাকে মানবে?
মিছেমিছি অপদস্থ হওয়ার কি দরকার। আন্নারও
একই ভাবনা। কিছু
বলতে গেলে শরীফ হয়তো
এমন গাঁকগাঁক করে উঠবে
যে বাড়িভরা লোকজনের সামনে
ছোট হতে হবে।
আয়না একদম
চুপ। সে তো জানে
এদের অহংকার কত বেশি। আয়নার ছোটভাই নিচু বংশে
বিয়ে করেছে এই রাগে
আজ দশবছর তারিক শ্বশুরবাড়ি
যায়নি, এমনকি আয়নাকেও যেতে
দেয়নি। একটিমাত্র ভাই তার,
তার সঙ্গেই দেখা হয় না কতবছর!
কাল বেয়ানের মৃত্যুর খবর পেয়ে
বাবা-মা এসেছে। কিন্তু
এতদিন পর তাদের দেখেও
আয়নার কোন ভাবান্তর নেই। তারিকের সাথে সংসার করতে
গিয়ে দিনের পর দিন তার খবরদারি
সহ্য করতে করতে সে নিজেই
যেন পাথর হয়ে গেছে। সুখ-দুঃখ কোন কিছুতেই
আর তেমন প্রতিক্রিয়া হয় না।
মেয়ের কাঁধের
ওপর ভর দিয়ে এতক্ষণে
শেলী আপা অনেক কষ্টে
নিচে নেমে আসেন। আন্না
তাড়াতাড়ি একটা চেয়ার
টেনে দেয়। চেয়ারে
বসেও কিছুক্ষণ হাঁপাতে থাকেন। শরীফ তখনও চিৎকার করে যাচ্ছে,
"আমি এখনই বাজারে
যাব। কে বলছে
মউতা বাড়িতে ভাত দিতে
হবে। এসব ফালতু
নিয়ম। যার তার বাড়ির
ভাত আমি খাব না। এই রফিক্যা, তুই তোর বস্রে জানাই দিস।"
"তারিক, শরীফ তোরা এরকম করছিস কেন? আশেপাশের লোক কী মনে করবে?"
"কে কী মনে করবে তাতে আমার কী আসে যায়? আমি কি কারো হুকুমের চাকর? আপনি আবার এর মধ্যে কথা বলতে আসলেন কেন?"
"তাই বলে তোরা এরকম চিৎকার চেঁচামেচি করবি? মাত্র কালকে রাতে আম্মার কবর হল।
এখনওতো চব্বিশঘন্টাও হয়নি।" শেলী আপা বললেন।
"আমরা কী
করুম? ঐ বড়চোরাই
তো সব নটঘট পাকায়। হে মোল্লাবাড়ির দাওয়াত নিতে
গেল কেন? আমাদের জিগাইছে?"
"কিন্তু এত চিল্লাচিল্লিতে কি মান বাড়বে? বাড়ির
লোক শুনছে না?"
"শুনুক। ঐ চোরের
জন্যইতো জিন্দা মায়ের মুখ দেখিনি। যখন দেখলাম তখন মায়ের
হুঁশ নাই। লাশ হয়ে পড়ে ছিল। শুধু নিঃশ্বাস ছাড়া
আর কিছু ছিল? এতদিন
মায়েরে নিয়ে মাতব্বরি করছে। এখন বাকিদের উপর শুরু
করছে। শেলী আপা,
আপনি তারে বলে দিবেন
আমরা এ দাওয়াত নিলাম
না।"
তাৎক্ষনিকভাবে
কথা খুঁজে না পেয়ে শেলী আপা বললেন, "আচ্ছা।"
দোতলায় বসে দুইভাইয়ের
সব কথাই শুনতে পাচ্ছিল
শীলা। জানালার পাশে
বসে এতক্ষণ সে বাইরের
দিকে তাকিয়ে ছিল। স্মৃতি,
স্মৃতি অজস্র স্মৃতি তার মাথায়
সেলুলয়েডের ফিতার মত ছুটছে। কখনও সামনে কখনও পেছনে। জানালা দিয়ে শীলাদের একতলা
দালানটা দেখা যাচ্ছে। কেমন
জীর্ণশীর্ণ পুরনো হয়ে গেছে। মানুষ না থাকলে যা হয়। তার উপর সত্যি সত্যি
গরু রাখা হলে ওটাতো
এখন গোয়াল ঘরই।
শীলার অবাক
লাগে এই মানুষগুলো একদিন
তার কত আপন ছিল। তার জন্মদাত্রী আর জীবনধাত্রী দুজনই এদের
মায়ের আপন বোন। সেই সূত্রে
রক্তের সম্পর্কের বাঁধন। তারপর
একসাথে বড় হওয়া। কত স্নেহ
করেছেন খালাম্মা, শেলী
আপা আর লীলা। লীলা
শীলার বয়সে কিছুটা বড় হলেও
নাম ধরেই ডাকত। বন্ধুইতো
ছিল তারা। অথচ এখন তাকে
দেখলেও শীলার মুখে কথা আসে না। না, সম্পত্তির দেনা-পাওনা
নিয়ে কোন ক্ষোভ নেই শীলার। আম্মা-বাবা তার জন্য
যা করেছেন পৃথিবীতে সেটাইতো
তার পরম পাওয়া। ওদেরতো অনেক সম্পদ অথচ
পাঁচ ভাই-বোন একজন
আরেকজন থেকে বিচ্ছিন্ন। ভাইয়েরা
একে অপরের শত্রু,
বোনদের কোনও মূল্য নেই।
আর লীলাতো
একদম একা। নামমাত্র
বিয়ে হওয়ার পর টানা
একসপ্তাহও আসাদের বাড়িতে
থাকেনি। সম্পর্কটা ঝুলে
থাকতে থাকতেই আসাদ
অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলো। লীলা আর কিছুতেই
বিয়ে করতে রাজি হল না। সেই থেকে মায়ের সাথে
জহির ভাইয়ের বাসাতেই থাকত। তিন চার বছর থেকে
বাড়িতেই নাকি থাকে। বাড়িঘর
সম্পত্তি দেখাশোনা করে। দেশের
মানুষ জায়গা-জমি বিক্রি
করবে জানলে জহির ভাইকে
ফোন করে। এখন আর
এক কড়াক্রান্তি জায়গাও নাকি
গ্রামের অন্যরা কিনতে পারে
না। এক আত্মীয়ের
কাছে শুনে শীলা বলেছিল
তাহলে সুবর্ণগ্রামের নাম পালটে
জহিরাবাদ রাখলেই হয়।
শরীফ এখনও হৈ চৈ করছে। কাল রাতে একটুখানি
দেখা হয়েছিল শরীফের সাথে। জানতে চেয়েছিল, "কেমন আছেন?"
শীলাও সংক্ষেপে
জবাব দিয়েছিল, "ভাল।"
তারপর আর কথা এগোয়নি। কথা বলতে ইচ্ছেও করেনি। অথচ একদিন এই ছোটভাইটা
পিঠেপিঠি ভাইয়ের মত কত আপন ছিল।
শীলার বিয়ের
পর পর তখন মামুন ঢাকায় চাকরি করত। বাসায় রাগারাগি করে একটা
ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে একদিন হুট করে শীলার বাসায় এসে উঠেছিল। প্রথমে মনে হয়েছিল বেড়াতে
এসেছে বুঝি। তারপর
সেই বেড়ানো বছরের ওপর গড়িয়েছিল। শীলার নতুন বিয়ে হয়েছে,
শাশুড়ী ছিলেন, শ্বশুর বাড়ির
লোকজন আসত। মাঝে
মাঝে লজ্জাও লাগত।
মামুনকে বলতো, "অনেকদিন তো হল,
এবার আমি ওকে চলে যেতে
বলি।"
মামুন মানা
করত। বলত, "দ্যাখো ও চিরদিন তোমার
কাছে থাকবে না। একদিন
তো যাবেই। কিন্তু
তুমি কিছু বললে কষ্টটা
চিরদিন মনে গেঁথে থাকবে।"
মামুনের ভদ্রতা
আর ধৈর্য দেখে অবাক
মানত শীলা। কত টানাটানির
সংসার অথচ কোন আফসোস
নেই। আবার চাকরি
ছেড়ে ব্যবসা করতে গিয়ে
মামুন যখন বিপদে পড়ল তখন শরীফই
উদ্যোগী হয়ে তাকে ভাল চাকরি
দিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছিল। কিন্তু আম্মার মৃত্যুর পর শীলা
এত একা হয়ে পড়েছিল
যে দু'বছরের
মাথায় মামুনকে ফিরে আসতে
হয়েছিল। টাকা-পয়সার
চাইতে তার সঙ্গটাই তখন শীলার
কাছে মূল্যবান মনে হয়েছিল। আর শরীফ! যে শীলাকে
নিজের বোনদের চেয়েও বেশি
ভালবাসত সেইই
বাবার অসুস্থতার সময় এত দুর্ব্যবহার
করেছিল যা মনে হলে আজও তার কান্না পায়।
চট্টগ্রামের চিকিৎসায় যখন উন্নতি হচ্ছিল
না তখন ডাক্তারের পরামর্শেই
বাবাকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া
হয়েছিল। জহির ভাইয়ের
সাথে সম্পত্তি বিক্রির বিষয়ে
মনোমালিন্য হওয়ার কারণে ওনার
বাসায় উঠেননি। জহির
ভাইও তখন সিংগাপুর না ব্যাংকক
কোথায় যেন গিয়েছিলেন।
মামুন তখন একটা
নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে। বাবাকে ঢাকায়
রেখে সে ফিরে গিয়েছিল
চট্টগ্রাম। আর কলেজ
থেকে ছুটি নিয়ে শীলা
মহুল মনিকাকে নিয়ে শরীফের
বাসায় উঠেছিল।
শীলাকে দেখে
বাবার সে কি ফুঁপিয়ে
কান্না। কেন যেতে
দেরি হল। মামুন
আর শীলার আসা-যাওয়ার
গ্যাপ ছিল মাত্র তিনদিন। এতেই রাশভারী চিরদিনের চাপাস্বভাবের
বাবা এতটা ভেঙে পড়বেন
শীলা ভাবতেও পারেনি। নিজেকে
সেদিন অপরাধী মনে হয়েছিল।
শরীফের শ্বশুরের
বন্ধু চিকিৎসা করেছিলেন বাবার। শীলা মামুনের খালাতো ভাই ঢাকা
মেডিকেলের ডাক্তার রাব্বীকে ডেকেছিল। সে এসে দেখার পর ক্যানসার
স্পেশালিস্ট ডা: এনামকে দেখাতে
বলেছিল। এতে শরীফ
ভীষণ রেগে গিয়েছিল। এটাকে
সে তার প্রেসটিজ ইস্যু
হিসেবে নিয়েছিল। হয়তো
মনে করেছিল শ্বশুরের কাছে
সে ছোট হয়ে যাবে। আরেকটা ভয় ছিল মনে হয় তার মনে,
বাবা অসুস্থ, কতদিন
চিকিৎসা করাতে হবে, তার বাসায়
রাখতে হবে, আরাম আয়েশের
সংসারে এত ঝামেলা ভাল লাগছিল
না আর তাই -
সেদিন দুপুরে, হ্যাঁ সেদিন
দুপুরে, আজও সেই দুপুর
ভাবতে গেলে শীলার এত বেশি
কষ্ট হয় যে, ভাবতে
ইচ্ছে করে না। মনে হয় কোন একটা
ইরেজার দিয়ে মনের ভেতরকার
এই দুঃসহ স্মৃতিটা যদি মুছে দেয়া যেত।
ডাক্তারের কাছে
যাবে বলে খেতে বসেছিল
ওরা। শীলা আর লীলা। হ্যাঁ লীলা সেদিন সঙ্গী
ছিল। হঠাৎ শরীফের
চিৎকার, চেঁচামেচি। অন্য
ডাক্তার দেখানো হলে তার শ্বশুরের
বন্ধুকে ডাকা হল কেন?
তাছাড়া চাচার জন্য তার এত দায় কিসের? চাচা কি কোনদিন
চারআনা দিয়ে সাহায্য করেছে?
এখন তাকে কেন এত ঝামেলা
পোহাতে হবে?
বাবা চুপ করে শুনছিলেন।
প্লেটে মাত্র ভাত নিয়েছিল শীলা।
শরীফের তান্ডব দেখে বলেছিল, "দেখিস
না তুই।
আসব না আর তোর কাছে।" এটুকু বলতে গিয়েই কান্নায় গলা বন্ধ হয়ে এসেছিল।
বেসিনে হাত ধুয়ে তক্ষুনি বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে রওনা করেছিল। আর মহুল মনিকাকে ছোটবোন আন্নির কাছে পাঠিয়ে
দিয়েছিল। সেদিন
লীলা সঙ্গী ছিল শীলার।
ডাক্তার আসতে
তখনও দেরি ছিল। ওরা অপেক্ষা
করছিল। প্রচন্ড ব্যাথায়
কুঁকড়ে যেতে যেতে বাবা
বার বার বলছিলেন, "তুমিতো দুপুরে কিছু খাওনি। আশেপাশে খাবারের দোকান থাকলে
তোমরা কিছু খেয়ে আসো। আমি এখানেই থাকি।"
নাহ্,
খাবারের রুচিই সেদিন ছিল না। আর শীলা তখনও বুঝতে
পারেনি তার জীবনে পিতার
চেয়ে অধিক পিতা আর কদিন
পরেই চিরতরে তাকে ছেড়ে
চলে যাবেন। অথচ তারপরই
শুরু হল নাটকের পর নাটক। রোগীর খাবার দেয়া হয় বলে ডাক্তারকে
অনুরোধ করে হলি ফ্যামিলি
হাসপাতালে বাবাকে ভর্তি করেছিল
শীলা। নয়তো বাসা
থেকে খাবার পাঠাতে হবে আর তাতে
শরীফদের বিরক্তি বাড়বে ভেবে
শীলা সেদিন এ সিদ্ধান্ত
নিয়েছিল। কত আত্মীয়-স্বজন
ছিল ঢাকা শহরে কিন্তু
সেদিন লীলা ছাড়া আর কাউকে
পাশে পায়নি শীলা।
ডাক্তার বোর্ড
গঠন করলেন। তারপর
শীলা ও লীলাকে ডেকে
জানালেন, "রোগীর অগ্ন্যাশয়ে
ক্যান্সার এবং শেষ অবস্থা।"
মামুনও ছিল না। সেদিন মাথায়
যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল। জহির ভাই ফিরে
আসার পর জানতে পারলেন
রোগীর আয়ু আর মাত্র
দশ দিন। সবাইকে
জানালেন। আত্মীয়রা ভীড় করতে
লাগল। কেবিন-বারান্দা ভিজিটরে থিক থিক করছে। বাবা কারো দিকে তাকান
না। শুধু শীলাকে
পাশে না দেখলে খুঁজে
বেড়ান। জানতে চান, "শীলা কই?"
শীলা সামনে গেলে
আবার চোখ বন্ধ করে চুপ করে পড়ে থাকেন। মামুনও এসেছে। শীলা
পরম নির্ভরতায় মামুনের ওপর সব ছেড়ে
দিল। মনে হল এবার
সে ইচ্ছেমত কাঁদতে পারে।
এদিকে জহিরভাই
ঘোষণা দিলেন, "এখানে
চিকিৎসা না হলে কাকাকে
সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক নিয়ে
যাব।"
শুনে এত দুঃখেও
সেদিন হাসি পেয়েছিল শীলার। মানুষ যে কত নাটক
করতে পারে। যার মৃত্যু
পরোয়ানা লেখা হয়ে গেছে
দিনক্ষণ দিয়ে, তাকে
বিদেশে নিয়ে যাবেন এর চেয়ে
বড় হঠকারিতা
আর কী হতে পারে। মনে হয়েছিল জহির ভাইয়ের
পলিটিক্স করা সার্থক।
নাটক কি আরো বাকি
ছিল? হ্যাঁ, ছিলই তো। কত নাটক কত দৃশ্য
শীলার চোখের ওপর দিয়ে
ভেসে যাচ্ছে। বাসা
থেকে খাবার আসছে। দু'জনের জন্য দশজনের
খাবার। কত ভাল ভাল খাবার। কিন্তু বাবাকেতো তখন নাকে
নল দিয়ে খাবার দেয়া
হচ্ছে। আর শীলার
গলা দিয়ে ভাত নামতে
চায় না।
একদিন বিকেলে
জহিরভাই হঠাৎ ক্যামেরাম্যান নিয়ে
হাজির। কাকার ছবি তোলা
হবে। কাকাকে ঘিরে
ওরা ভাই-বোনরা। শীলা
বারান্দার এককোণে পিলারের আড়ালে
দাঁড়িয়ে কান্নার ঢেউ সামলাচ্ছে। লীলা ডাকতে এল, "আয়, ভাইজান ছবি তুলতে
ডাকছে।"
শীলা গেল না। এই স্মৃতি এই ছবি তার প্রয়োজন
নেই। হঠাৎ রুম থেকে
ছুটে এসে মামুন বলল,
"তাড়াতাড়ি চল, বাবা
তোমাকে ডাকছে।"
শীলা
ছুটে যেতে সবাই জায়গা
করে দিল।
"বাবা, বাবা" বলে ডাকল। বাবা
সাড়া দিল- "হুঁ।"
সেই শেষ। পরে মামুন
বলেছিল হঠাৎ চোখ মেলে
চারপাশে সবাইকে দেখে বাবা
বলেছিল, "শীলা, শীলা
কই?"
আর বাবার মৃত্যুর
পর তার জানাযার আগে তারিকভাই
ঘোষণা দিল, "আমার
কাকার কোন আওলাদ নাই। আমরাই তার উত্তরাধিকারী। উপস্থিত
সকলের কাছে তার পক্ষে
আমরা মাফ চাই। যদি কেউ কোন পাওনা-দেনা
থাকেন তা হইলে আমাদের
সাথে যোগাযোগ কইরেন।"
এই ঘোষণায়
উপস্থিত আত্মীয়রা মুখ চাওয়া
চাওয়ি করেছিল। আর শীলার
ভিতরে বুকভাঙা আর্তনাদ
উঠেছিল, 'আমি তবে কে গো?
কে আমি?"
"শীলা আপা,
তুমি এখানে? দুলাভাই তোমাকে
খুঁজছে।" চাচাতো
বোন নীরুর একথা শুনে
শীলা সম্বিৎ ফিরে পেল।
"আরে তাইতো, কখন সকাল হয়েছে, যেতে হবে না?"
"আজকেই চলে যাবে? থাকো না দুই-একদিন।
কতদিন তুমি বাড়ি আস না।"
"থাকতে ইচ্ছে করে না যে।"
নীরু চুপ করে থাকে।
বুঝতে পারে শীলার দুঃখ কোথায়।
আবার বলে, "তাহলে আজ আমার বাড়িতে চল।
আজকের দিনটা থেকে যাও।"
"নারে আজ থাকব না।
পরে একবার এসে তোর বাড়িতে বেড়াব।"
"হুঁ, তুমি আর আসছ।
থাকো না শীলা আপা, আমি না তোমার ছোটবোন।"
"তুই তো এখনও
আমার ছোটবোনই আছিস।"
বলে নীরুকে জড়িয়ে ধরে। এই বোনটিকে ছোটবেলা থেকে
নিজের বোনের মত করে স্নেহ-ভালবাসা
দিয়েছে শীলা। আম্মাও
ওকে খুব ভালবাসতেন। গ্রামে
থাকার কারনে বেশি লেখাপড়ার
সুযোগ না পেলেও আম্মা
ওকে বই পড়িয়ে, কাজ শিখিয়ে
নিজের মনের মতো করে গড়েছিলেন। শীলা হোস্টেলে থাকার ফলে নীরুই
ছিল আম্মার সঙ্গী।
নীরুর হাত ধরেই
শীলা বেরিয়ে এল। গেট পেরিয়ে
ওরা বাইরে এল। বাড়ির
আর কেউ জানল না,
"শীলা চলে যাচ্ছে।"
****
No comments:
Post a Comment