Friday, 7 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - একদিন হঠাৎ

 


_____________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - বোধন ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৯

গল্প - একদিন হঠাৎ
__________________________

একদিন হঠা

 

সকালবেলা ঘুম ভাঙলো মায়ের বকুনি শুনে। এ এক মহা সমস্যা রাতুলের। কোন দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। যার জন্যে প্রতিদিন বকুনি শোনাটা রুটিন হয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ বিছানায় গোঁজ হয়ে বসে রইল সে। ভাল্লাগেনা এত বকাবকি।

          রাতুলের সাড়া না পেয়ে বকতে বকতেই ঘরে ঢুকলেন মা¾ কী লাট সাহেবের পুত্র, ঘুম ভেঙ্গেছে? লজ্জা করে না প্রতিদিন এত দেরি করে ঘুম থেকে উঠতে? অথচ দেখ তোমারই পিঠেপিঠি ভাই কোন সকালে উঠে পড়তে বসে গেছে। কুড়েঁর বাদশাকে দিয়ে যদি কিছু হয়। মা একটানা বকে যেতে যেতে মশারির দড়ি খুলতে লাগলেন।

          রাতুল হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে আড় চোখে তাকালো পাশের বিছানার দিকে। সুন্দর পরিপাটি বিছানা। শিমুল কখন যে বিছানা থেকে উঠে সবকিছু ঠিকঠাক করে পড়তে বসেছে। অবশ্য ঘুমের ঘোরে একবার মনে হয়েছিল তাকে কেউ ডাকছে। নিশ্চয় শিমুল উঠে যাওয়ার সময় ডেকেছে। কিন্তু রাতুলের কেন যে এত ঘুম পায়।  চোখের পাতা দুটো এমন জড়িয়ে থাকে যে কিছুতেই খুলতে পারে না। আর প্রতিদিনই এ নিয়ে মায়ের গঞ্জনা সইতে হয়।

          ¾ এখনো উঠে গেলি না? মশারি গুটিয়ে বিছানার চাদরে টান দিয়ে মা হাঁক দিলেন। নাহ্‌, আর বসে থাকা যায় না। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠল সে। মা এখনো বকে চলেছেন¾ পাজী ছেলে, অসভ্য ছেলে। যেমন স্বভাবে তেমন লেখাপড়ায়। যদি কোন কিছুতে একটু শান্ত সুবোধ হতো।

          ব্রাশে পেস্ট লাগাতে লাগাতে মায়ের বকুনি শুনছিল রাতুল। এ এক জ্বালা। ভাইয়াটা পড়ালেখায় বেশি ভাল হয়ে তার আরেক বিপদ। সারাক্ষণই শুনতে হয়¾ শিমুল ভাল, শিমুল হেন, শিমুল তেন। আর সে চঞ্চল, পড়াশোনায় অমনযোগী, আরো আরো কত যে হাজার দোষের ফিরিস্তি। একেক সময় ইচ্ছে করে কোথাও চলে যেতে। যেখানে চলে গেলে মা নেই, বকুনি শুনতে হবে না।   কিন্তু কোথায় যাবে? এই বার-তের বছর বয়স পর্যন্ত মা-বাবার সাথে দাদার বাড়ি আর নানার বাড়ি ছাড়া আর কোথাও যায়নি সে। তাও দুতিন বছরে একবার। একটা নিঃশ্বাস ফেলে দাঁত মাজা, হাত মুখ ধোয়ায় মন দিল সে। এখানে দেরি করলে আবার বকুনি খেতে হবে।

          বাথরুম থেকে বের হয়ে তাড়াতাড়ি পরিপাটি হয়ে খাওয়ার টেবিলে এসে বসল রাতুল। মা সবার প্লেটে নাস্তা সাজিয়ে দিচ্ছেন।

          ¾ পানি খেয়েছ? মা জিজ্ঞেস করলেন রাতুলকে।

          ¾ না।

          ¾ কেন খাওনি? তোমাকে না কতদিন বলেছি সকালে ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস পানি খাবে।

          ¾ আমার বমি আসে।

          ¾ কেন বমি আসে? কই শিমুল, আমি, তোমার বাবা আমরা সবাই পানি খাই, আমাদেরতো বমি আসে না। তোমার সব কিছুতেই গোঁয়ার্তুমি। পাজী কোথাকার।

          ইচ্ছে করছে না তবুও হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিতে গেল রাতুল। কিন্তু কীভাবে যেন হাত লেগে গ্লাসটা শুদ্ধ পানি গড়িয়ে পড়ল সারা টেবিলে। আর অমনি বলা নেই, কওয়া নেই গুম গুম করে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিলেন মা রাতুলের পিঠে।

          ¾ অপদার্থ কোথাকার। আবার বকুনি দিলেন মা। নাস্তার প্লেটটা সরিয়ে রেখে দুম-দাম করে উঠে এলো রাতুল। এসেই নিজের ঘরে শুয়ে পড়ল। মা তখনো বকে চলেছেন খাবার ফেলে উঠে আসার জন্য।

          রাতুলের ইচ্ছে করল কোথাও পালিয়ে যেতে যেখানে গেলে মা-বাবা, শিমুল কেউ আর কোনদিন তাকে খুঁজে পাবে না। খুঁজে খুঁজে যখন হয়রান হবে তখন আচ্ছা জব্দ। কিন্তু কোথায় যাবে? আবারও নিজেকে প্রশ্ন করল সে। যেখানে হোক চলে যাবো। বিছানা থেকে উঠে পড়ার টেবিলের সামনে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে জ্যামিতি বাক্স খুলে টিফিনের জমানো সঞ্চয় তের টাকা পঞ্চাশ পয়সা পকেটে পুরল। যেখানে হোক চলে যাবে সে। ঘর থেকে বেরিয়ে মাকে লক্ষ্য করল। রান্না ঘরে ব্যস্ত আছেন। শিমুলও নেই।

          বাইরে যাওয়ার দরজাটা খুলে বেরিয়ে এল রাতুল। হাঁটতে হাঁটতে বাসা থেকে বেশ কিছু দূরের পুকুর পাড়টিতে এসে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। সকালবেলার মিষ্টি রোদ আর ঝিরঝিরে বাতাস। মনটা জুড়িয়ে গেল। টলটলে স্বচ্ছ পানির এ পুকুরটি রাতুলের অত্যন্ত প্রিয়। যখনই কোন কিছুতে মন খারাপ হয় এখানে এসে বসলে মনটা আপনাআপনি ভাল হয়ে যায়। বসে বসে ভাবতে লাগল রাতুল। কী করা যায়? কোথায় যাওয়া যায়? ইশ্‌ যদি এমন কোথাও যাওয়া যেত যেখান থেকে মা আর কোনদিন তাকে খুঁজে পাবেনা। কিন্তু রাতুল লুকিয়ে থেকে দেখতে পেত তাকে হারিয়ে মা কেমন আছে। ঠিক মায়ের শেখানো রবীন্দ্রনাথের লুকোচুরি কবিতার সেই খোকাটির মতো।

          ¾ আচ্ছা আমি হারিয়ে গেলে মা কি কাঁদবে, খুব কষ্ট পাবে? রাতুল নিজেকে প্রশ্ন করে। ¾ না পাবেনা, মা আমাকে একটুও ভালবাসে না। যদি ভালবাসতো তাহলে কি সবসময় এত বকাঝকা করত? কেবল রাতুল এটা কেন করলে, ওটা কেন করলে? নাহ্  তোমার মত দুষ্টু ছেলে আমি জীবনে দেখিনি। হুঁ, এবার কেমন শিক্ষা¾ রাতুল তোমাদের কেউ নয়। নিজের অজান্তে ঠোঁট দুটো অভিমানে বেঁকে উঠে তার।

          হ্যাঁ কষ্ট হত একজনের। কিন্তু তিনি এখন অনেক দূরে। রাতুল আর কখনো তাকে দেখতে পাবেনা। মায়ের বকুনি শুনে কোলের ভেতর লুকোতে পারবেনা। নানুভাইয়া কী যে আদর করতো রাতুলকে। কত সুন্দর সুন্দর গল্প যে বলত, খেলনা জামা কিনে দিতো। অথচ এত আদরের  মানুষটি কত তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেল। মানুষ কেন মরে যায়? রাতুল ভাবতে লাগল। আচ্ছা মা যদি মরে যায়¾ বুকটা ধক্‌ করে উঠল। না কখনো না। মা মরে গেলে রাতুল বাঁচবে কি করে। মা তাকে যত বকা দিক রাতুলতো মাকে ভালবাসে। শুধু একটু কষ্ট দিতে চায়, একটু দেখতে চায়, তাকে হারিয়ে মা কি করে।

          আচমকা একটা দোয়েলের শিসে সম্বিত ফিরে এল রাতুলের। পুকুর পাড়ের উপর একটা দোয়েল লেজ তুলে শিস দিচ্ছে। রোদ তেঁতে উঠেছে। এখানে আর বসে থাকা যায়না। বেশ ক্ষিদে পেয়েছে। সকালে খেতে বসেই ঝামেলার সূত্রপাত ঘটায় আর কিছুই খাওয়া হয়নি। পকেটে হাত দিল¾ টাকা আছে। রাস্তার মোড়ের রহিম মিয়ার দোকান থেকে কিছু কিনে খাওয়া যায়। আস্তে আস্তে পা বাড়াল সে।

          রহিম মিয়া রাতুলকে দেখেই জিজ্ঞেস করল¾ কি খোকা কিছু কিনবে? আজ স্কুল বন্ধ? তোমার মুখটা এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন?

          রাতুল আমতা আমতা করে বলল¾ এক প্যাকেট চানাচুর আর কিছু মুড়ি দাও চাচা।

          প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল কোথায় বসে খাবে? বাইরে বসে এর আগে কখনো খায়নি সে। মা কখনো আজেবাজে খাবার, দোকানের খোলা খাবার খেতে দেন না।

          এখন কি মা তাকে খুঁজছে? আবারো প্রশ্নটা মনে আসতে থমকে দাঁড়ালো রাতুল। ধুর ভাবুকগে, আমার কি? মনের কথাটি ঝেড়ে ফেলার জন্যই হনহন সামনের বাড়ির বাগানের দিকে হাঁটতে লাগলো। ওখানে একটা চাপকল আছে। বাগানে বসে খাবারটা খেয়ে পানিও খাওয়া যাবে।

          মুড়ি আর চানাচুর চিবুতে চিবুতে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল রাতুলের। আচ্ছা চুপিচুপি বাড়ি ফিরে চিলেকোঠায় লুকিয়ে থাকলে কেমন হয়। অনেকদিন ধরে সেখানে পুরনো জিনিসপত্র জড়ো করে রাখা আছে। কেউ খুব একটা যায়না। সেই দাদুর আমলের কাঠের চেয়ার থেকে কি নেই ওখানে। দুপুরবেলা মা ঘুমুলে রাতুল মাঝে মাঝে ঘরটিতে গিয়ে বসে চেয়ারগুলো নিয়ে সিংহাসন বানিয়ে খেলা করে। 

          কিছুটা খেয়ে মুড়ি আর চানাচুরের প্যাকেটটা এক সঙ্গে বেঁধে নিয়ে চাপকল থেকে পানি খেলো সে। ¾ আহ্‌ শান্তি। এতক্ষণ পেটটার মধ্যে ক্ষিধে কিলবিল করছিল। এবার লম্বা পা ফেলে বাড়ির দিকে এগুলো। কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ভয় হতে লাগল। মা যদি দেখে ফেলে তাহলে তো কান ধরে এক্ষুণি ঘরে নিয়ে যাবে। রাতুলের আর মা-কে পরখ করে দেখা হবে না।

          কিছুটা দূর থেকেই বাড়ি লক্ষ্য করল সে। খুব চুপচাপ হয়ে আছে। মা নিশ্চয় রান্না ঘরে ব্যস্ত। আর শিমুল এতক্ষণে স্কুলে। বাবাতো ট্যুর থেকে আগামী সপ্তাহের আগে ফিরবে না। আবার চারিদিকে তাকিয়ে ভাল করে দেখলো¾ না, কেউ কোথাও নেই। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি টপকে উপরে উঠে এল রাতুল। খোলা ছাদের এক কোণে পরিত্যক্ত একটি রুম। পুরানো হয়ে আসা দরজা। সন্তর্পনে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল সে। দরজাটা বন্ধ করে দিল। ইস্‌ কী অন্ধকার। এখানে কেমন করে থাকবে?

          কিছুক্ষণ যেতেই অন্ধকারে চোখ দুটো সয়ে এল। হাতড়ে হাতড়ে তার খোলা সিংহাসনটার উপর এসে বসল। সামনে টেবিলের উপর মাথাটা রেখে ভাবতে লাগল¾ ইস্‌, এই ঘরটা যদি একটা গুহা হতো। খুব গভীর জঙ্গল আর পাহাড়ের মধ্যে গোপন একটি গুহা। রাতুল সেখানে গল্পের বইতে পড়া দুর্ধর্ষ পাহাড়ী সর্দার। কেমন মজাই না হতো তাহলে। একেবারে মুক্ত স্বাধীন। তার মাথায় থাকতো পাখির পালকের টুপি। গায়ে গাছের ছালের পোশাক আর হাতে তীর ধনুক। সারাদিন জঙ্গলে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো¾ কল্পনার জগতে ডুবে গেল রাতুল। আর স্বপ্ন দেখতে দেখতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

          ঘুম ভাঙতেই বাইরে লোকজনের কথাবার্তা আর চলাফেরা শুনতে পেল রাতুল¾ রাতুল সোনা আমার। কোথায় গেলি তুই। আমি তোকে ছাড়া বাঁচবো নারে¾ মা কাঁদছে। পাশের বাসার খালাম্মার গলাও শোনা যাচ্ছে¾ এত রাতে এখানে কোথা থেকে আসবে ও। তার চেয়ে চলুন আমরা পাড়ায় লোক পাঠাই। ওর বন্ধুদের খবর দিই। রেডিও স্টেশনে, পেপার অফিসে যোগাযোগ করি। তবে সবার আগে থানায় একটি ডাইরি করা দরকার।

          আরে বাপ্‌, এত কিছু ঘটে গেছে! চারপাশে ঘুটঘুটি অন্ধকার। রাত কটা, কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল সে? রাতুল বুঝতে পারে না। এবার মায়ের কান্না আরো জোরে শুনতে পায়¾ রাতুল, কোথায় গেলি বাবা, আমি যে তোর দুঃখে মরে যাব। কী বলে মা? রাতুলের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। মাকে ছাড়া সেও কি বাঁচবে? কান্নায় গলা বুঁজে আসে। অন্ধকারেই পথ হাতড়ে এসে দরজা খোলে রাতুল।

          ¾ মা ¾

          অবাক বিস্ময়ে রাতুল দেখতে পায় মা অসহায় ভঙ্গিতে ছাদে বসে দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। মায়ের চোখে কান্না মুখে হাসি।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩১-৩২

----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ __________________________...

Popular Posts