-----------------------------------
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫
___________________________________
২৫
এ কান ও কান করে কানাকানি
হতে হতে কথাটা আফজালদের
কানে এসেও পৌঁছাল। তারিকচাচা
আর শরীফচাচা বড়কাকার সঙ্গে
রাগারাগি করেছে। একদিন
যারা তাদের রায়ত ছিল,
যাদের বাড়ির লোকজনেরা চৌধুরী
বাড়িতে কামলা খেটে খেয়েছে
আজ তাদের বাড়ির ভাত খেতে
হবে। আফজাল দাওয়াত
জানিয়ে আসার পর দুই ভাই নাকি
ভেতর বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি করে বড়ভাইকে
গালিগালাজ করে এখন বাজারে
লোক পাঠিয়েছে। মোল্লাবাড়ির
ভাত তারা খাবে না।
আফজাল
ভাইবোনদের ডেকে বলল, "মায়েরে
এই কতা কোন রকমে জানানো যাইব না।
বইনরা তোমরা ভুলেও একথা মার সামনে কইবা না।"
ভাইদের বলল, "তোমরা
তোমাগো যার যার বউদের কইয়া দিও।
জানলে মায়ের কষ্ট অইব। চৌধুরীবাড়ির
বিষয় নিয়া আমার মায়ে কেন কষ্ট পাইব।
আর দাওয়াত আমরা দিছি, বড়কাকা কবুল করছেন আমরা খানা পাঠামু।"
বোন সকিনা
হঠাৎ বলে উঠল, "কিন্তুক ভাইজান এইডা কী আমাগোর
অপমান না। হেগো
বংশ বড় দেইখা যারে
যা খুশি তা কইব। খানা না পাডাইলে কী হয়।"
"নারে বইন,
কতা একবার কইয়া ফালাইছি
যখন তখন পাডাইতে অইব। তারপরে তারা নিজেরা খাইল,
না কুত্তা-বিলাইরে খাওয়াইল
হেইডা আমাগো বিষয় না।"
"আপনে যে কী কন,
ভাইজান, গেরামে মানুষ আছে না। মাইনষে হুনলে কী কইব।"
"কইলে কইব। অহন কিছু করার নাই। আর মাইনষে আমাগোরে কইব না, হেগোরে কইব। মাইনষে
কী জানে না তারা
ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রুতা। কাইল
বড়দাদীর জানাযার সময়ও তো তিনভাই
এক হইল না। মাইনষে
কী দেখে নাই। মানুষ
এখন আর আগের মত বেকুব
নাই।"
"হ, এইটা
ঠিক কতা। ভাইজান
মিছা কয় নাই। এক শহরে
থাইকাও যে তারা ভাইয়ে
ভাইয়ে ঈদে-চান্দে, ভাল-মন্দে
কেউ কারো মুখ দেখে
না এই কতা হগগলে
জানে।"
"হ,
সম্পত্তির লাইগ্যা হেগো লোভ লালসার কথা কে না জানে। হে গো শরীকের চাচা
মইনুদ্দীন দাদার থেইকা নাকি
কবরস্থানের অংশটাও কিন্যা লইছে। এই লইয়া তো শরীকেরা
তাগোর উপর খুব অসন্তুষ্ট।" ছোটবোন জমিলা
বলে।
জমিলার বিয়ে
হয়েছে পাশের গ্রামে। বোনদের
মধ্যে সেই গ্রামের প্রাইমারী
স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত
পড়েছে। বুদ্ধিমতিও বটে। আর সেটা জানানোর জন্যই
কথাগুলো বলে।
"আর অহন তো লীলা
ফুপু বাড়িত থাইকা
সব দেখাশুনা করে। একসময়
হীরণকাকার পোলাগো ইচ্ছামত খাটাইছে। শহর থাইকা গেসের সিলিন্ডার
থাইকা সবকিছু দরকারে কান্দে
কইরাও আনছে। দিন রাইত
নাই যেদিগে দরকার হেদিগে
দোড়াইছে। আর অহন শরীকের
অংশ লইয়্যা সামাইন্য
বিবাদ হইতে না হইতে
ওয়ারেন্ট দিয়া গেরাম ছাড়া
করছে। অথচ হীরণ
কাকার পোলারা ফুপু কইতে
অজ্ঞান আছিল।"
"কাইল জানাযার
সময় হীরণ চাচার ছোডপোলা
হারুন আমাগো আমানের বাপেরে
কইছে, ‘দাদু মারা গেছে,
আমরা ঢাকায় কিন্তুক কাকারা
আমাগোরে একটু জানায় নাই। আমি বাড়ির থাইকা ফোন পাইয়া
কোনরকমে বাস ধইরা আইলাম। আম্মা কানতে আছিল, আনতে
পারি নাই।"
"হ,
তারা তো এমনই। ছোড দাদা-দাদী
শীলাফুপুরে এত আদর যত্নে
মানুষ কইরল অথচ শেষকালে
ওনারে সম্পত্তি দেওয়া লইয়া
দাদারে কি অপমান কইরল। মনে কত কষ্ট নিয়া
দাদা মইরা গেল।"
সকিনার কথার মাঝখানে আফজাল আচমকা জ্ঞিজ্ঞাসা করে, "আইচ্ছারে বইন শীলাফু কি আইছে?"
"হুনছি আইছে।
রাইতের বেলা তো এত মাইনষের মইদ্যে খেয়াল করি নাই।
আইজ বিকালে গেলে দেখা করুম নে।"
"আইচ্ছা অহন আসল কতায় আস।
শেষ কতা অইল আমরা খানা পাডামু।
খাইব কি খাইব না হেইডা তাগো ব্যাপার।
আছরের ঠিক পরে পরে খানা রওনা করি দিতে হইব।
মাগরিবের আগে যাতে চৌধুরী বাড়িত পৌঁছে।
আর
একখান কতা মনার দাদী কাইল রাইতে মারা গেছে।
মনাগো ঘরেও খাওন যাইব।
সকিনা তোমরা সবকিছু খেয়াল করবা।"
"আইচ্ছা ভাইজান।"
"আর আবারও কইয়া দিলাম মায় যেন কোন কিছু না শুনে।
সাবধান। ভুলেও
মায়েরে কেউ কষ্ট দিবা না।" আফজাল নিচের
উঠানে রান্নার তত্ত্বাবধানে বেরিয়ে
যায়। ভাই-ভগ্নীপতিরাও
তার পিছু নেয়।
২৬
চৌধুরী বাড়ির
সীমানা পার হয়ে অভী তার দলবল
নিয়ে মাঠে নেমে যায়। হেমন্তের ফসল কাটা মাঠে
ধানগাছের গোড়াগুলো শক্ত এবং খাড়া হয়ে আছে। শহুরে
ছেলেমেয়েদের চলতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সেদিকে তাদের
খেয়াল নেই। গল্পে
হাসিতে মেতে ওঠা কিছু কিশোর-তরুণ নতুন জগৎকে দুচোখ মেলে
দেখছে। খোলা আকাশ
আর প্রান্তর হেমন্তের আপাত
নরম আলোয় স্নিগ্ধ সুন্দর
হয়ে আছে।
মালিহা বলল,
"really গ্রাম
যে এত সুন্দর হয় আগে দেখিনি।"
"কেন তুমি
এর আগে বাড়ি আসনি?"
অভী প্রশ্ন করল।
"এসেছি - but বাবাতো বাড়ির
সীমানার বাইরে যেতে দেয়নি। তাছাড়া তখন অনেক
ছোট ছিলাম। আজকেতো
বাবা বাড়িতে ছিল না তাই এই outing possible হয়েছে।"
"উহ। অভী
তুমি কোথায় নিয়ে এলে?" বলে অরিন উবু হয়ে মাটিতে বসে পড়ল। অভী
পিছন ফিরে ছুটে এল। আরিয়ানা
চেঁচিয়ে উঠল, Did you watch? Yet yesterday অভীভাইয়াকে অরিন তুই করে বলত, আজ হঠাৎ তুমি।
What
happened in one night that changed you হ্যাঁ, অরিন?"
অরিন পায়ে ধানগাছের
খোঁচা খেয়ে নিচু হয়ে পা দেখছিল। আরিয়ানার হঠাৎ আক্রমণে তার মুখে একঝলক
রক্ত খেলে গেল। মাথাটা
আরও নিচু করে মনোযোগ
দিয়ে ব্যাথার জায়গাটা দেখতে
লাগল।
অভী
এসে দেখার চেষ্টা করল, "কই দেখি দেখি।"
"না, দেখতে হবে না।
আমার ব্যাথা আমি দেখব।" হাত দিয়ে পা ডলে এবার উঠে দাঁড়াল অরিন।
আবার ওদের সাত-আটজনের দলটা হাঁটতে শুরু করল।
ইফতি মাঠ থেকে কুড়িয়ে একটা ঢেলা দূরে ছুঁড়ে দিল।
তারপর সেদিকে দৌড়াতে লাগল।
মালিহার খালাত ভাইও ইফতির পিছন পিছন দৌড়াতে শুরু করল।
অনেকটা মাঠ পেরিয়ে ওরা নদীর তীরে এল।
রোদ পড়ে নদীর জল চিকচিক করছে।
কিছুদূর পর পর দু একটা টংঘর দেখা যাচ্ছে।
নদীর জলে মৃদু ঢেউ।
শান্ত বাতাস।
দৃশ্যটা কেমন ছবির মত।
এরকম দৃশ্য ছোটদের অনেকেই এর আগে দেখেনি।
একটি সাত-আট বছরের শিশু বলে উঠল, "নদী, নদী- river.
"অভী ভাইয়া,
এই নদীটার নাম কী?"
"তাতো জানি
না, ভাইয়া" অভী বলল। তারপর আরিয়ানার দিকে তাকিয়ে
বলল, "খুব তো পটর পটর করিস। তুই জানিস এ নদীটার
নাম কী? এটাতো তোদের
নদী।"
"না জানি
না। এসব জানতে
আমার এত curiosity নাই। তুমি জানো
তোমাদের নদীর নাম কী? খুব তো অন্যের
উপর মাস্টারী কর।"
"হ্যাঁ
জানি। আমার নদীর
নাম শীতলক্ষ্যা। কি সুন্দর
নাম তাই না?"
বলতে বলতে এক ঝলক তাকিয়ে
দেখল অরিনকে। আশ্চর্য
একটা রাতের মধ্যে এত বদলে
গেল মেয়েটা। কালও
সারাটা রাস্তা কত দুষ্টুমি
করেছে। কথার
পিঠে কথা বলেছে। আজ একদম
চুপ।
"এ্যাই
অরিন।"
"হুঁ।" অরিন
চোখ তুলল।
"নদী দেখছিস
না! তোদের এত সুন্দর
নদী।"
"দেখছি
তো" বলে অভীর
চোখের দিকে তাকাল অরিন। তারপর আস্তে করে বলল,
"আমার ভালবাসার নদী,
যে নদীতে কাল রাতে
ডুবলাম।"
"অ।" অভী তৎক্ষণাৎ
কথা খুঁজে পেল না।
মালিহা আর আরিয়ানার
মধ্যে ভাব জমে গেছে। তারা ফেসবুক নিয়ে কথা বলছে। এখন থেকে তারা ফেসবুক
বন্ধু। ঢাকা গেলে
যোগাযোগ থাকবে। এতদিন
কেন যে এত দূরে
ছিল সেটাই তাদের বিরক্তির
কারণ। মুখে বলতে
পারে না কিন্তু দুজনেই
বাবাদের দুষতে থাকে।
শিশুরা নদীর
তীরে ছুটতে থাকে। দূরে
গাঙচিল ঝুপ করে পানিতে
ডুব দিলে অবাক হয়ে দেখে। ওপারে এখনও কাশফুল ফুটে
আছে। একজন এসে আবদার
করে, "চল না অভীভাইয়া
আমরা নদীর ওপারে যাই।"
অভী আদুরে গলায়
তাকে বোঝায়,
"আজ নয় ভাইয়া। কাল যাব আমরা। আজ তো দুপুর হয়ে গেছে
বাড়ি ফিরতে হবে।"
"কাল তো চলেই
যাব। চলো না।"
"আচ্ছা এখনতো
ঘাটে নৌকা নেই। বিকেলে
নৌকা নিয়ে আমরা সবাই
ওপারে যাব।"
সূর্য মাথার
ওপর। বেলা দুপুরের
দিকে গড়াচ্ছে। অভী সবাইকে
ডেকে নিয়ে বাড়ির
দিকে রওনা দেয়। হাঁটতে
হাঁটতে সবাই গল্প করছে। অভী আর অরিন পিছিয়ে
পড়ে।
আরিয়ানা হাঁক
দেয়, "Come hurry. Boss জানলে রক্ষা নেই।"
অভী হেসে ওঠে। Boss এর কন্যার
যখন মন গলেছে তখন তাকে
কেয়ার করে কে? তারপর
আচমকা অরিনকে প্রশ্ন করে, "তোর বাবা-কাকারা
এত ঝগড়া করে কেন রে?"
অরিন রেগে যায়, "তাতে তোর কী?
তোর কাকা নেই।
থাকলে দেখতিস তারাও ঝগড়া
করত। Because property is one kind of poison.
অভী হেসে ওঠে। "বুঝতে পারলাম
রেগে গেলে তুই আমাকে
ঠিকই তুই তোকারি করবি। একটু আগে কি সুন্দর
‘তুমি’ বলছিলি।"
এবার
অরিনও হেসে উঠল।
****
No comments:
Post a Comment