২
১ জুলাই ১৯৮৫। বৃষ্টিভেজা সকাল। আষাঢ়ের সেই
মেঘবৃষ্টির আধো আলো, আধো ছায়া ঘেরা সকালে শুরু হল আমার নতুন জীবন। বিমান বাহিনী
পরিচালিত শাহীন কলেজগুলোর অন্যতম বি এ এফ শাহীন কলেজ চট্টগ্রামের বাংলাভাষা ও
সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে আমার কর্মজীবনের সূচনা হয়েছিল। শিক্ষক পরিচয়ের পাশাপাশি
পরিচয়পত্রে পেলাম আরেকটি পরিচয় ‘সিভিলিয়ান’ অর্থাৎ
সামরিক বাহিনীর বেসামরিক কর্মী।
ঔপনিবেশিক আমল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে
সামরিক বাহিনী ও জনগণের মাঝে একটি বিভাজন রেখা তৈরি হয়েছিল- আর্মি আর সিভিলিয়ান।
ভাগ্যের এমনই দুর্দৈব যে রাজকীয় বৃটিশ বাহিনীর বর্ণবাদী প্রশিক্ষণ, অস্ত্র আর জৌলুসের
জোরে এদেশের আপামর জনসাধারণ সামরিক বাহিনীর কর্মীদের কাছে খেতাব পেয়েছিল ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’। ইংরেজ শাসক বিদায় নেওয়ার
পর পাকিস্তানী সামরিক শাসক আইয়ুব খানের আমলেও তৎকালীন বাঙালীদের ললাটে এ কলঙ্কতিলক
আরো স্থায়ীভাবে সেঁটে গিয়েছিল। কিন্তু এ ব্লাডিরাই ৬৯-এ আইয়ুবের মত ‘লৌহমানব’কে হটিয়ে গণতন্ত্রের
পথে একধাপ এগিয়ে গেল। চাইল স্বায়ত্তশাসন, চাইল গণতন্ত্র এবং নির্বাচন। কিন্তু
রূপকথায় পড়া গল্পে যেমন একটি দৈত্যের রক্তবীজ থেকে আরো অসংখ্য দৈত্যের জন্ম হয়
তেমনি আইয়ুব গেলে আসে ইয়াহিয়া আর তার সঙ্গী হয়ে আসে টিক্কাখান, রাও ফরমান আলী,
নিয়াজী এবং নব্বই হাজার পাকিস্তানী সেনা। তারপর ৭১এর মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে
রক্তস্নাত বাংলাদেশ অর্জন করল স্বাধীনতা। বিশ্বের বুকে নতুন মানচিত্র, নতুন পতাকা,
নতুন পরিচয় আর নতুন লক্ষ্য - জাতীয়তা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা। শুরু
হল হাজার বছরের বঞ্চনার শেষে নতুন স্বপ্নযাত্রা।
কিন্তু হায়। আবার নেমে এল নিকষকালো
অন্ধকার। জাতির জীবনে ভীষণ ভয়াল এক কালরাত্রি ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫। সামরিক বাহিনীর কিছু
বিশ্বাসঘাতক অফিসার এবং সৈনিক সপরিবারে হত্যা করল জাতির পিতাকে। ‘অদ্ভুত এক আঁধার’ নেমে এল দেশে। আবার
সামরিক শাসন। এবার আর বিদেশি নয় স্বয়ং বাঙালি শাসক। ভয়ে-বিস্ময়ে স্থবির জাতি চেয়ে
চেয়ে দেখল খোলনলচে বদলালেও মুখোশপরা সেই মানুষটি ও তার অনুচরেরা চিরদিনের
রক্তপিপাসু সেই মানুষ, সাধারণ মানুষ বা আমজনতা যাদের কাছে সেই ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’।
১৯৮৫ সালে আমি যখন চাকরিতে যোগদান করি
তখন জিয়াহত্যার পর এরশাদের সামরিক শাসন চলছে। তাই সেই বৃষ্টিভেজা সকালে এসব ভাবনা
আমাকে দ্বিধা ও কিছুটা শঙ্কান্বিত করলেও মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল আমার নতুন পথচলা।
মেঘাচ্ছন্ন বৃষ্টিঝরা সেই সকালে
চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জহুর ঘাঁটির এমবারকেশন ইউনিট দিয়ে
গাড়ি ঢুকতেই আমি মুগ্ধতায় আবিষ্ট হলাম। পরিপার্শ্বের সুপরিকল্পিত পরিবেশ,
পরিচ্ছন্নতা আর রাস্তা দিয়ে কালো বর্ষাতি গায়ে অফিসগামী বিমানসেনাদের দেখে আমার
কেবলই কৈশোর-যৌবনে দেখা ‘সোভিয়েত
ইউনিয়ন’ পত্রিকার ‘ক্রেমলিন স্কোয়ারের’ কথা মনে পড়ছিল। সেসব
ছবিতে দেখতাম অসংখ্য মানুষ প্রচন্ড শীত এবং তীব্র তুষারপাতেও বর্ষাতি গায়ে দৃপ্ত
পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। মন ভরে উঠল অপার আনন্দে। এত সুন্দর আর সুশৃঙ্খল পরিবেশে আমি
কাজ করব।
বিশাল ঘাঁটির অভ্যন্তরে বাসটা এসে থামল
একটি একতলা লাল দালানের সামনে। বি এ এফ শাহীন কলেজ চট্টগ্রাম- আমার কর্মক্ষেত্রে।
একদিন যা হয়ে উঠবে আমার জীবনের পরমতীর্থ। বাস থেকে নেমে আরো ক'জনসহ ধীর পদক্ষেপে
সেই ভবনে প্রবেশ করলাম।
চৌকো আকৃতির ভবনটির ভিতরে প্রবেশ করে
আরো একবার মুগ্ধ হবার পালা। ভবনের সর্বত্র পরিচ্ছন্ন পারিপাট্যের ছাপ। মেঝেগুলো
ঝকঝকে তকতকে, জানালা-দরজা-সিলিং কোথাও ধুলোবালি নেই। মাঝখানে সবুজ মাঠ চারপাশের
লনে ফুলের বাগান। আকাশনীল শার্ট আর খাকি রঙের প্যান্টে ছেলেগুলো যেমন পরিপাটি
তেমনই একই রঙের ফ্রক আর সাদা সালোয়ার এবং ভি ভাঁজের ওড়নার মেয়েরাও দৃষ্টিনন্দন।
ছোট-বড় সবার পায়ে বাটা কোম্পানীর পিটি জুতা। ছেলেদের বুকের ডান পাশে আর মেয়েদের
ওড়নায় লাগানো নেমট্যাগ। সুতরাং পরিচয়ের আগেই নাম জানা হয়ে যাচ্ছে। সবার পকেটে
কলেজের মনোগ্রাম যেখানে লালসুতো দিয়ে লেখা, ‘শিক্ষা-সংযম-শৃঙ্খলা’। মনে হল
এতদিন আমাদের সিভিলিয়ান জগতে যা দেখে এসেছি এটা তার চেয়ে ভিন্নতর। এই শৃঙ্খলা,
নিয়মানুবর্তিতা আর পরিচ্ছন্নতার সৌন্দর্যে শাহীন আমার মন-হরণ করল। মনের সবটা জুড়ে
বসল।
কিন্তু
গোলাপের সাথে কাঁটার মত আনন্দের পাশাপাশি দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং কিছুটা আশঙ্কা মনের
ভিতর উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। সে ভয় সেনাবাহিনীর রক্তচক্ষুর ভয়। আশৈশব দেখে আসা আইয়ুব
খানের সামরিক শাসন থেকে আজ পর্যন্ত সামরিক শাসনের বদৌলতে আমাদের রক্তপ্রবাহের মধ্য
দিয়ে যা মস্তিষ্কের কোটরে প্রবেশ করে পুরো জাতির মানসিকতাকে পঙ্গু করে দিয়েছে।
তখনও এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়নি। তাই
প্রথম দিন স্কুলের ক্লাস। অধ্যক্ষের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত শেষে উপাধ্যক্ষের কাছ
থেকে রুটিন নিয়ে শিক্ষিকাদের কমনরুমে ঢুকতেই দেখি প্রচন্ড রকম হুড়োহুড়ি। সেদিন আমরা
তিনজন একসাথে জয়েন করেছিলাম। বর্তমানে অধ্যক্ষ জনাব নাসির উদ্দিন, সমাজতত্ত্বের
প্রভাষক রওশন আকতার এবং আমি। এদের মধ্যে বয়সে আমি সিনিয়র কিন্তু যোগদান একসাথে।
আমি আর রওশন অবাক হয়ে দেখলাম, আমরা দুজন নবাগত শিক্ষকের আগমনে পুরনোদের কারো তেমন
কৌতূহল নেই। একতাড়া কাগজ নিয়ে একটা ছককাটা বক্সবোর্ডে ঝুঁকে সবাই লিখছে আবার ঘন্টা
পড়ার সাথে সাথে চক-ডাস্টার নিয়ে ক্লাসে ছুটছে। যারা ক্লাস শেষে ফিরছেন তারা আবার
সেই একই কাজে ব্যাপৃত হচ্ছেন।
চুপচাপ বসে হুড়োহুড়ির কারণটা বোঝার
চেষ্টা করলাম। বিষয় লেসন প্ল্যান বা পাঠ-পরিকল্পনা। দ্বিতীয় মেয়াদের এই পরিকল্পনা
শেষ করে জমা দেবার ডেটলাইন আগামীকাল ২ জুলাই। মনে মনে ঘাবড়ে গেলাম, আমাকেও দেবে
নাকি। আমি আর রওশন উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম। দেখে মনে হল সেকেন্ড
টার্মের পাঠ্যসূচী অনুযায়ী দিন তারিখ মিলিয়ে পাঠদানের পরিকল্পনা বা বিবরণী।
যা ভেবেছিলাম তাই। কলেজ ছুটির খানিক আগে
উপাধ্যক্ষ আমাদের দুজনকে ডেকে একতাড়া কাগজ আর একটা বক্সবোর্ড ধরিয়ে দিলেন।
নির্দেশ- আগামীকাল এটা সম্পূর্ণ করে আনতে হবে। হাত বাড়িয়ে জিনিসগুলো নিলাম কিন্তু
কিভাবে এটা তৈরি করতে হবে সে নির্দেশনা পেলাম না।
ভাগ্যিস আমার ঘরের মানুষটি একসময়ে ঢাকা
শাহীনে শিক্ষকতা করেছিলেন। তাই ঘরে ঢুকে যখন আমার অজ্ঞতাজনিত অভিজ্ঞতার বর্ণনা
দিলাম তিনি হেসে অভয় দিলেন।
আমি রেগে গেলাম, তুমি হাসছ!
-হাসছি এ জন্যে যে এগুলো আমার জানা আছে।
তুমি বিশ্রাম নাও, আমি আজ রাতেই তোমার লেসন প্ল্যান রেডি করে দেব।
-সত্যি!
-হ্যাঁ সত্যি।
-কিন্তু যদি প্রিন্সিপ্যাল স্যার ধরে?
-কী ধরে?
-অন্যকে দিয়ে লিখিয়েছেন কেন- যদি প্রশ্ন
করে?
-আরে ধুর। এগুলো দিন তারিখ মিলিয়ে যে
কেউ লিখে দিতে পারে। এসব নিয়ে ধরার কিছু নেই।
তবু দুশ্চিন্তা একেবারে গেল না। কিন্তু
যিনি দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি আমার চেয়ে ভাল জানেন। এই আস্থায় তাঁর কাছে কাগজপত্র
সঁপে দিয়ে আমি ঘুমাতে গেলাম।
পরদিন সকালে রেডি হয়ে লেসন প্ল্যান হাতে
নিলাম এবং ঘর থেকে বের হতে হতে বললাম, দোয়া করো যেন ফাঁড়া কাটে।
তিনি হেসে বরাভয় দিলেন।
*****
No comments:
Post a Comment