-----------------------------------
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫
___________________________________
২
সিদ্ধান্ত হল লাশের
গাড়ির সঙ্গে আরও দশটা
মাইক্রো যাবে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব যারা যেতে
চায় যাবে। লাশ ধোয়ানোর
ব্যবস্থা হাসপাতালেই আছে। জহিরুল
ভাবলেন সত্যিই চমৎকার ব্যবস্থা। আজকাল টাকা থাকলে কোন কাজেই
সমস্যা হয় না। শুধু
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের হাতে
দিয়ে দিলেই হল।
“শেলিআপা”- বড় বোনকে
ডাকলেন জহির। শেলি
আপা আর্থ্রাইটিসের ব্যাথায়
হাঁটতে পারেন না, তবু সোফা
থেকে শশব্যস্তে উঠে আসার
চেষ্টা করলেন। এসে বক্রভাবে
কোনমতে দাঁড়ালেন। বয়সে
ছোট হলেও কার্যকারণে তাকেই
সম্মান দেখাতে হয় ভাইকে।
"আপনারা
যারা যাবেন সবাইকে বলেন
দুপুর তিনটার মধ্যে আমার
বাসায় চলে আসতে। সব গাড়ি
একসাথে যাবে। আপনি
শরীফ আর তারিককে জ্ঞিজ্ঞাসা
করেন তারা কীভাবে যাবে। জানাজার আগে তো সবাইকে
ওখানে পৌঁছাতে হবে। রাত দশটায়
জানাজা হবে মাইকিং করতে
বলে দিয়েছি। আপনি
ওদেরকে জানিয়ে দিন।"
"আচ্ছা’ বলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আবার সোফার দিকে যেতে চেষ্টা করলেন। মাঝপথে বড়মেয়ে এসে মাকে ধরে নিয়ে সোফায় বসাল।
"তোর মেজমামা
ছোটমামাকে ডাক" বলতে
বলতে তাকিয়ে দেখলেন স্ত্রীকে
নিয়ে জহির বেরিয়ে যাচ্ছে।
৩
জহিরের বনানীর বাসায় প্রথম জানাজা
শেষে লাশ বহনকারী গাড়ির
আগে পিছে করে আরো দশটি
মাইক্রো একযোগে রওনা দিল যখন তখন বেলা
প্রায় তিনটা। অগ্রহায়নের
রোদ অনেকটা কমলা
রঙ ধরেছে। আরিয়ানা, রাইয়ান, আইমন, অরিন, অভী
আরও সব কাজিনরা এক গাড়িতে
উঠল। জহির বাধা
দিতে চাইলেন, কিন্তু
ততক্ষণে তার স্ত্রী সাবেরা
বাধা দিলেন, "থাক না। সবকিছুতে
বাধা দাও কেন? কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়া ছেলেমেয়ে ওরা তো অত ছোট না।"
সবাই উঠেছে কিনা
রফিককে ডেকে তত্ত্বাবধান করতে
বলে সিরিয়ালের সাত নম্বর
গাড়িটাতে তিনি স্ত্রী এবং শাশুড়িকে
নিয়ে উঠলেন। গাড়ি স্টার্ট দিতেই আরিয়ানা
আর আয়মন
দুই কাজিন
মোবাইলে গান ছেড়ে হেডফোনের
দুই মাথা দুজনে শেয়ার
করল।
"এই তোরা
খাবার দাবার কিছু আনিসনি?"
“হ্যাঁ এনেছিতো" আরিয়ানার উত্তর।
"দে দে বের কর। তাড়াহুড়ার জন্য লাঞ্চটা
ভাল হয়নি।"
আরিয়ানা ব্যাগ
খুলে চিকেন রোল আর পেস্ট্রির
বক্স খুলে দিল। পিছনের
সিটে যারা ছিল তারাও
ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফলে হাতাহাতিতে
কারও হাতে কারও গালে
পেস্ট্রির ক্রিম লেগে একাকার।
"এ্যাই টিস্যু
দে।"
অরিন পিছনের সিটে
বসা রাইয়ানের দিকে একটা
টিস্যু এগিয়ে দিল।
সাথে সাথে বিরক্ত হল-“ফোর আওয়ার্স
জার্নি, তোরা এখনই
যা শুরু করেছিস।
মাই গড। জায়েন্ট
ইটার।”
"হ, তুমি তো সিলিম
থাইকা হলিউডের নায়িকা হবা। আমাদের তো ঐসব চিন্তা
নাই, আমরা খাইয়া
বাঁচতে চাই।"
মামাতো ভাই অভীর কথা শুনে
অরিন খেপে গেল, "মারব এক থাপ্পড়। আমি আমেরিকায় যাবো বলে তুই টিজ করছিস!
ইভ টিজিং কিন্তু horrible মনে রেখো
brother।"
একসঙ্গে সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
চালকের পাশে বসা এ্যাসিস্ট্যান্টটি চমকে পেছনে তাকাল,
"এরা কোথায় যাচ্ছে?" ড্রাইভার তার ডানহাতের ওপর একটা চাপ দিতেই সে তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে সামনে তাকালো।
৪
মাম এর ফ্রেশ
বোতল খুলে পানি খেলেন
জহির। এসি চলছে
তবু কেমন যেন অস্বস্তিকর
একটা গরম লাগছে। পেছনের
সিটে বসা কাজের লোকগুলোর
দিকে তাকালেন। ওরা কাঠের
পুতুলের মত বসে আছে। তাকে এত ভয় পায় ওরা?
না হলে গাড়ির ঝাঁকুনিতেও একদম সোজা
হয়ে বসে আছে কেন?
অবশ্য ভয় পাওয়া ভাল। ভয় না পেলে এতটা
খবরদারি করতে পারতেন
না। সাবেরা যে রকম সহজ সরল এবং নরম প্রকৃতির, এসব লোককে ম্যানেজ
করা তার জন্য কষ্টকর
হত। মোবাইলটা আনলক
করলেন। এবার একে একে সব গাড়ির
সাথে যোগাযোগ করলেন। বার বার বললেন, "কাছাকাছি থাকবে।"
লাশের গাড়িতে
তারই কর্মচারী আবার সম্পর্কে
চাচাতো ভাই আমিনুল আর প্রোপার্টি ডেভেলাপের কেয়ার
টেকার করিম আছে। আরিয়ানা
ফোন ধরতেই হৈ হুল্লোড়
হাসাহাসি শুনতে পেলেন। বিরক্ত
হলেন জহির। ছেলেমেয়েগুলোর
হলো কী? দাদির মৃত্যুতেও
ওদের আনন্দের অভাব নেই। সবাইকে নির্দেশ দিলেন পথে
‘হাইওয়ে ইনে’ হল্ট করার
জন্য। চা-টা খেয়ে
একটু ফ্রেশ হতে হবে। বাড়ি যেতে কতক্ষণ লাগে
বলা তো যায় না।
৫
বাসায় এসে শরীফ
স্ত্রী আন্না এবং কন্যা
মালিহাকে তাড়াতাড়ি রেডি হতে বলে ড্রাইভারকে
পাঠাল গাড়িতে তেল ভরতে। আম্মার মৃত্যুটা যে আজকেই
হবে তা বুঝতে পারেনি
সে। আন্না কিন্তু
হসপিটাল থেকে এসে গত তিন চারদিন
থেকে বলছিল,
"দেখো আম্মা কিন্তু আর বেশিদিন
বাঁচবে না।"
"হ্যাঁ,
তোমাকে বলেছে।"
"বলতে হবে কেন? আমি আমার দাদী-নানি, আরও আত্মীয়স্বজনের মৃত্যু
দেখিনি! আমরা কি তোমাদের
মত? মায়ের মুখ ছেলে
দেখে না। ভাইয়ের
মুখ ভাই দেখে না।"
অন্য সময় হলে বিশাল
শরীর আর বাজখাঁই গলায়
ঝগড়া শুরু করে দিত শরীফ। কিন্তু এখন অবস্থা
দেখে এসে নিজেকে আটকাল। আন্নাকে তাড়া দিল,
"তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র গোছাও। কমপক্ষে তিন চার দিন তো থাকতে
হবে।"
মেয়ে মালিহা আর ছেলে
ইফতিকে বললো টুকিটাকি যা লাগে
সেগুলো নিয়ে নিতে। দরজা
জানালাগুলো সব ঠিকঠাক বন্ধ
আছে কিনা দেখে প্রত্যেক
রুম লক করে নিচের
তলায় নামল শরীফ। বুয়াও
রেডি। বাড়ি বন্ধ
থাকবে। শুধু দারোয়ান
আর কেয়ারটেকার থাকবে। বড় পাজেরো গাড়িটাই
যাবে। নাহলে মালপত্র
নিয়ে সমস্যা হবে। আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঘরের দরজা
জানালা সব চেক করে নিল। এটা তার চিরদিনের অভ্যাস।
এসব ব্যাপারে আন্না কোন দায়িত্ব নেয় না। কারণ নিলেও কাজ হবে না।
আন্নার মনে হয় শরীফুল পৃথিবীতে নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই বিশ্বাস করে না।
এই মানুষটাকে আন্না পছন্দ করে বিয়ে করেছে।
এবং এত বছর পার হবার পরেও ব্যাপারটা ভাবতে এখন নিজের কাছেই অবাক লাগে।
গাড়ি ছাড়ার সঙ্গে
সঙ্গে শরীফ কোটটা খুলে
টাইটা একটু ঢিলা করে দিল।
"পাপা, এই Hot weather এ তুমি স্যুট পরেছ কেন? আরও গরম লাগবে না? আর তুমি তো যাচ্ছ তোমার নিজের বাড়িতে।" মালিহা শরীফকে বলল।
আন্নার হাসি
পেল। একটা তের চৌদ্দ
বছরের মেয়ে যা বোঝে
এই মানুষটা তাও বোঝে
না। তার সবকিছুতে
একটা লোক দেখানো প্রবণতা। এই তো কিছুদিন আগে আন্নার ভাইয়ের
মেয়ের বিয়েতে এমন ঝকমকে
জারদোউসি কাজ করা এক শেরওয়ানি
পরে গেল যে দেখে
আন্নার কান্নাই পাচ্ছিল। মালিহা
কানে কানে মাকে বলেছিল, "মা পাপাকে
একটুও ভাল দেখাচ্ছে না। এটা পরতে মানা করো না।"
আন্না বলেছিল, "তোমার পাপা
কোনদিনই কারো মতামতের তোয়াক্কা
করে না। তার কাছে
যেটা ভাল লাগে সেটাই
করে।"
"মা, তুমি
সহ্য কর কীভাবে?
এটাতো অ্যানার্কি।"
সহ্য! আন্নার
সেদিন মনে হয়েছিল জীবনের
শুরুতে যে ভুলটা সে করেছিল
সেটা সহ্য করতে করতে
এখন আর আগের মত অসহ্য
লাগে না।
অনেক আগে সাজলেও
বহুদিন থেকে আন্নার সাজতে
ভাল লাগে না। এটা নিয়েও
শরীফের অনুযোগ কম নেই। অথচ কিশোরী কন্যার মা আন্নার
বয়স পঁয়ত্রিশেও যেন পঁচিশে
থমকে আছে।
গাড়িতে একটা
ঝাঁকুনি লাগতেই ড্রাইভারকে ধমক দিল শরীফ, "দেখে চালাও।" তারপর ঘড়ি দেখল। মায়ের লাশ রওনা করার
প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট
পরে তারা যাত্রা করেছে
যাতে কারো সাথে কারো
দেখা না হয়। তাছাড়া
ফ্রেশ হওয়ার জন্য
কোন রেস্টুরেন্টে থামলে
ওই চোরের সাথে দেখা
হয়ে গেলে আরেক ঝামেলা। আর রেস্টুরেন্টগুলোর যা দশা, ওয়াশরুমের কোন সুবন্দোবস্ত
নেই। তবু তাদের
এলাকায় একটা প্রবাদ আছে
‘হাগায় ধরলে বাঘারে ডর নাই’। ডায়েবেটিসটা
ইদানিং কন্ট্রোলে থাকছে না। সুতরাং তাকে কোথাও না কোথাও
থামতে হবে।
আত্মীয় স্বজনদের
সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ না রাখাতে
দেখা হলেও তারা দূরে
দূরে থাকে। শরীফও
এসব under
status মানুষের সাথে মিশতে চায় না। আন্নার স্বভাব অবশ্য উল্টো। মানুষ দেখলেই কথা বলার
জন্য পাগল হয়ে যায়।
দাউদকান্দি ব্রিজটা
পার হওয়ার পর চান্দিনাতে
এসে জ্যাম লাগল। শরীফের
মাথাটা রাগে চিড়বিড়িয়ে উঠল। দেশটার এতটুকু যদি উন্নতি
হতো! আসলে শরীফ ভুলে
গেছে এই দাউদকান্দির বিশাল
মেঘনা গোমতী ফেরি
ছাড়াও আরও তিনটা ফেরি পার হয়ে সকালে
বাড়ি থেকে যাত্রা করে রাতে
ঢাকা পৌঁছাতে
হতো। বাসের রড ধরে ঝুলতে
ঝুলতে যেতে হতো। এখনও
লক্ষ লক্ষ মানুষ এভাবেই
যাতায়াত করে। কিন্তু
শরীফের চোখে আজ তারা
আমজনতা। তাই বাসের
ভেতর আর দরজায় ঝুলতে
থাকা মানুষগুলোকে দেখে মনে মনে গজরাল।
ছেলে মেয়ে দুটো
কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। দুজনেরই চোখ বন্ধ। আজকালকার
টিনেজ ছেলেমেয়েগুলোর এই ধরন। ওরা ওদের
জগত নিয়ে আছে। চারপাশের
জীবন সম্পর্কে কোন কৌতূহল
নেই।
হাতের তসবিটা
টিপতে টিপতে রাস্তার দুপাশে
চোখ রাখল আন্না। কত বদলে
গেছে সবকিছু। সেই দুই হাজার সালে
চাচাশ্বশুরের মৃত্যুর
পর ছোট
মালিহাকে
নিয়ে একবার যাওয়া হয়েছিল। তারপর এবার। কতবার
শরীফকে বলেছে,
"চল না এবার
আমরা বাড়িতে ঈদ করি। ছেলেমেয়েরাও গ্রামের বাড়ি চিনল। আত্মীয়স্বজনও চিনল।"
শুনলেই রেগে
যেত শরীফ,
"বোগাস। এসব বাজে
কথা বলবে না। গ্রামের আত্মীয়স্বজন এত চেনার
কী আছে। সব ফকির,
গেলেই সাহায্য চাইতে আসবে। এদের দেখলে ছেলেমেয়েরা বরং আমাকেই
বাজেভাবে ইভ্যালুয়েট করবে। তারচেয়ে
চল এবার সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া
যাই।"
"তুমি যাও। আমি যাব না। হোটেলে
বসে বসে ঈদের দিন কাটানোর
মত বোরিং ব্যাপার আমার
সহ্য হয় না।"
প্রায় পয়তাল্লিশ
মিনিট পর দীর্ঘ জ্যামে
স্থবির হয়ে থাকা গাড়িগুলো
চলতে শুরু করেছে। যাক একটু
তবু স্বস্তি।
৬
জহিরের বাহিনী
রেস্টুরেন্টে নামলো। সারবাঁধা
গাড়িগুলো ঢাকা-কুমিল্লা রোডের হাইওয়ে ইনে যখন থামল
তখন গাড়ি থেকে নামা
নিয়ে শিশু এবং তরুণ-তরুণীদের মধ্যে হুলুস্থুল
পড়ে গেল। হুলুস্থুল
পড়ে গেল রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার
ওয়েটার সবার মধ্যেও।
কারণ তারা জানে কারা
আসবে, কী খাবে। তাই আগে থেকেই
দোতলার রুমটা রেডি। একটু
বেশি ঝাড়পোঁছ করা। সাহেবের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বাতিক। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার যেখানেই যান ফ্রেশ
হওয়ার জন্য তিনি এখানেই
ওঠেন।
এই হোটেল কাম রেস্টুরেন্টটা
আসলেই সুন্দর। গাছপালা
ঘেরা বিরাট আঙিনা, স্থাপত্যেও
খানিকটা দৃষ্টিনন্দন ছায়াঘেরা এই পরিবেশ। যারা এর আগে আসেনি
তাদের কেউ কেউ অবাক
হল। দশটা গাড়ির
প্রায় ষাট-সত্তর জন লোক মিলে
ওপরে নিচে খাবার পরিবেশন
করা হল। একটা
হৈ হল্লা পড়ে গেল।
দোতলার চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে পরোটার টুকরো ছিঁড়ে একটুকরো মাংস মুড়ে মুখে দিয়েই অভী শব্দ করে উঠল, "ওয়াও।
দারুন টেস্টি!"
তার এইভাবে খাওয়া
দেখে আরিয়ান বলল,
"তুমি তো একটা ঢাকাইয়া
ঘোস্ট। মনে করো
ঢাকার বাইরে আর পৃথিবী
নেই।"
“কেন আমেরিকা আছে না?” বলে অরিনের
দিকে একটা চোখ টিপ দিল। অরিনও জিভ বের করে বোনকে
দেখিয়ে মুখ ভেংচি দিল।
ভিতরে যখন হুলুস্থুল
বাইরে লাশবহনকারী গাড়িটার ইঞ্জিনটা
তখনও গুমরাচ্ছে। গাড়ি
বন্ধ হলেও এসি চলছে। শ্বেতশুভ্র কাফনে ঢাকা তৌহিদা
বেগম চৌধুরানী নিথর শুয়ে
আছেন। তাঁর কি মনে পড়ছে
চুরানব্বই বছরের জীবনের পৃথিবী
পরিভ্রমণ? বিশ শতকের
বিশের দশকে জন্ম তাঁর। আইনজীবী বাবা ছেলেমেয়েদের জন্মের
পরপরই তাদের নাম জন্মক্ষণ
বাংলা-ইংরেজি সন, তারিখ,
মাস ও দিনের নাম লিখে
রাখতেন। সে অনুযায়ী
আজ তাঁর বয়স তিরানব্বই
বছর আটমাস এগারো দিন। মায়ের তিন নম্বর সন্তান
তিনি। বোনদের মধ্যে
দ্বিতীয়। এগারো ভাইবোনের
সঙ্গে একান্নবর্তী পরিবারে চাচা
জ্যাঠাদের মিলিয়ে ভাই বোন ছিল তেইশ
জন। ছোট চাচার মাত্র একটা ছেলে।
পোক্ত মাটির
ঘর ছিল তাদের। বিশাল
বাড়ির উঠানের দুপাশে সারিবদ্ধ
ঘর। মাঝখানটা খোলা, অনেকটা খেলার মাঠের
মত। বাড়ির দক্ষিণপাশে
পুকুর আর তিন পাশ ঘিরে
গড় কাটা। গড়ের
আগ পর্যন্ত জায়গাতে অসংখ্য
গাছগাছালি। সেসব গাছগাছালির
ছায়ায় আর ফাঁকে ফাঁকে
সব ভাইবোনদের মাটি নিয়ে
বালি নিয়ে নারকেলের মালায়
করে লতাপাতা পিষে কত রান্নাবাটি
খেলা।
দুষ্টের একশেষ
ভাইগুলো কোনটা গাছে উঠতো
তো কোনটা পাখির বাসা
খুঁজত, ফাঁদ পাতত। কিন্তু বনেদী বাড়ির ছেলেমেয়েদের
বাইরের ইতর অসভ্যজনের ছেলেপিলের
সাথে খেলা কড়া নিষেধ
ছিল। বাড়ির সামনে
বৈঠকখানা। মসজিদ,
বড়দীঘি আর দীঘির সাথে
লাগোয়া একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। ছেলেরা
সেখানে পড়তে যেত। কিন্তু
মেয়েদের পড়াতে আসতেন মক্তবের
মৌলবি আর স্কুলের প্রধান
শিক্ষক। পর্দা
দেয়া ঘরে একপাশে তারা
বই খুলে পড়াতেন,
অন্যপাশে ছাত্রীরা আস্তে আস্তে
তা উচ্চারণ করত।
মা বিখ্যাত মাওলানার
মেয়ে ছিলেন। আরবী,
ফার্সি আর কিছু বাংলা
পড়তে পারতেন। বাবা
শহরে থাকতেন বলে সন্ধ্যারাতে
খাওয়াদাওয়ার পর চিমনি দেয়া
সেজবাতির লালচে আলোয় মাকে
ঘিরে ঘরের সব মেয়েরা
বসত। মা সুর করে পড়তেন
নূরনামা, ইউসুফ জোলেখা, জঙ্গনামা। আব্বা বাড়ি এলে মেয়েদের
বাংলা পড়াতে বসতেন। বলতেন, "পড়তে শিখলে
তোমাদের শহরে নিয়ে স্কুলে
ভর্তি করে দেব। শহরে
মেয়েরা স্কুলে যায়।"
মেয়েরা স্কুলে যায়!
ধূর আব্বার বানানো কথা। তবুও আব্বা চেয়েছিলেন।
কিন্তু দাদা-দাদী তখনও
মাথার ওপর পরিবারের কর্তা। তাঁরা কিছুতেই রাজি হননি।
"ছেলেদের নিয়ে
যাও। ওরা চাকরি
বাকরি করবে তাই লেখাপড়ার
দরকার আছে। কিন্তু
মেয়েদের নিয়ে টানাটানি কেন? তওবা আস্তাগফিরুল্লা।" সুতরাং
মাহমুদা-তৌহিদাদের আর যাওয়া
হয়নি। পরের তিন বোন অবশ্য
দাদা-দাদীর মৃত্যুর পর শহরের
স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। অফিসে
মাথা ঘুরে পড়ে কয়েক
মিনিটের মধ্যে যখন আব্বার
মৃত্যু হলো তখন পুরো
একান্নবর্তী পরিবারটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
আব্বা তার আয়ের পুরোটাই
সংসারে দিতেন। আব্বার মৃত্যুর পর চাচারা সম্পত্তি
ভাগ করে যে যার মত আলাদা
হয়ে গেল। মা তখন বড়ভাইকে নিয়ে
শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরলেন। বড়বুবুর বিয়ে আব্বাই
দিয়েছিলেন, তৌহিদারও। তাঁর
মৃত্যুর পর এক এক করে ছোটবোনদেরও
বিয়ে হল। কিছু
কিছু জমিজমাও বিক্রি করতে
হয়েছিল।
তৌহিদার বিয়ে
হয়েছিল সেই ১৯৩৭ সালের
দিকে। তখন তার বয়স ষোল পার হচ্ছে। রূপের খ্যাতি কানাকানি হতে হতে বহু দূরের
সুবর্ণ গ্রামের চৌধুরী বাড়িতেও
এসে পৌঁছেছিল। এ রূপের
খ্যাতিতেই বনেদী এবং সম্পন্ন
তালুকদার ইব্রাহিম চৌধুরীর বড় ছেলের
সঙ্গে বিয়ে হল তৌহিদার। মায়ের তুহি এবার শরাফত
চৌধুরীর স্ত্রী হিসেবে পদবী
প্রাপ্ত হলেন তৌহিদা বেগম
চৌধুরানী।
সেই শরাফত চৌধুরীও
মারা গেলেন বাংলাদেশ স্বাধীন
হবার পর পর। দেশের
পরিস্থিতিও তখন টালমাটাল। পঞ্চাশ
সালের দিকে তালুকদারী স্বত্ব
চলে গেলে সম্পত্তির আয়ে ভালভাবে
চললেও স্বাধীনতার পর অজন্মার কারণে ফসল কমে গেলে কয়েকটা বছর বড় কষ্টে কেটেছে।
বড় মেয়ের ম্যাট্রিক
পাশের পর বিয়ে হয়ে গেলেও
ছেলেরা তিনজন আর
ছোট মেয়ে লীলা তখনো লেখাপড়া করছে। ছোটছেলে
শরীফতো তখনও স্কুলে। সদ্য
স্বাধীন দেশ। বড়ছেলে
জহির মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। যুদ্ধ করতে করতে কলেজ
পড়ুয়া ছেলেটা নয় মাসে
অনেক বদলে গেল। অনেক
বড় হয়ে গেল।
‘জহির, জহির, আমার জহির’ দেহ বিযুক্ত
তৌহিদার প্রাণটা যেন ভাসমান
শূন্যতায় কেঁদে কেঁদে
ফিরতে লাগল। প্রথম কন্যাটির জন্মের পর মৃত্যু হলে দ্বিতীয় সন্তান শেলীর পর তার বহু আকাঙ্ক্ষিত ছেলে জহির। বংশের
প্রথম বাতি,
তৌহিদারও কর্তৃত্বের ভিত্তি।
খাবার পর রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে জহিরের সিগারেট খেতে
ইচ্ছে করলো। রফিককে বিল মিটিয়ে দিতে বলে আবার ওয়াশরুমে ঢুকলেন জহির।
খাওয়ার পর অন্তত সিগারেটে দুটো টান না দিলেই নয়।
দুবার হার্ট অ্যাটাক
হয়েছে। সিঙ্গাপুরে
চিকিৎসা নিয়েছেন। অথচ সেই কোন শিশুকালে গ্রামের সমবয়সীদের সাথে পাতার বিড়ি খাওয়া ধরেছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে তা অনেক দামী সিগারেটে বিবর্তিত হলেও অভ্যাসটা ছাড়তে পারেননি।
আচ্ছা এখন বিড়ি
খেতে কেমন লাগবে? এবার
গিয়ে একবার লুকিয়ে খেয়ে
দেখবেন নাকি। হঠাৎ
নিজের কাছেই লজ্জিত হলেন। আজ সকালে তার মা মারা
গেছেন আর এখন তিনি
বিড়ি খাওয়ার কথা ভাবছেন।
বের হয়ে দেখলেন
ছেলেমেয়েরা তখনও কলকলাচ্ছে। ধমক লাগালেন, "শিগগির ওঠো সবাই।"
গাড়িতে উঠতে
উঠতে সাবেরা শুনতে পেল দু-তিনটা
ওয়েটার বলাবলি করছে,
"বড়লোকের মরণও আলাদা। দ্যাখছস কেমন উৎসব
উৎসব ভাব, যেমন
পিকনিকে যাইতাছে।"
সাবেরার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। রাগের মাথায় বুয়াকে তাড়াতাড়ি
উঠার জন্য লাগাল এক ধমক। সবাই উঠলে গাড়িগুলো আবার
সারিবদ্ধভাবে চলতে শুরু করল।
No comments:
Post a Comment