Tuesday, 18 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - অতিথি


 __________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - দহনের কাল।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭।

গল্প - অতিথি
_________________________________________

অতিথি


শহীদ মিনারের উঁচু বেদীতে পথনাটক হচ্ছে রমনা পার্ক থেকে বেরিয়ে এক ঠোঙা বাদাম কিনে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে এসে এক টুকরো ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়ে রফিক। তারপর চারপাশে তাকায়।

          অনেক মানুষ আশেপাশে। বেশিরভাগ আমজনতা। রীনার ভাষায় ক্লাশলেস। টোকাই, আমড়া-শশা, ভুট্টা, বাদামওলা কী নেই। ব্যবসাও করছে আবার নাটকও দেখছে।

          রফিক কাছে দূরে ভাল করে দ্যাখে। দেখতেই তার ভালো লাগে। একটু আগে রমনাপার্কের বেঞ্চে বসে আকাশ দেখেছে, গাছপালা দেখেছে। দেখে দেখে যখন মনটা ভরেছে তখন এখানে এসেছে। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্ররা নাটক করবে সংবাদপত্রের সংস্কৃতি বিভাগে দেখেছে। তাই এখানে আসা।

          মানুষ দেখতেও ভালো লাগে তার। কতরকম মানুষ, বিচিত্র তাদের শারীরিক গঠন চেহারা, আচার-আচরণ, পোশাক। আবার সব মিলিয়ে কেমন এক।

          ছুটির বিকেলটা এমনি করেই কাটে। আশে-পাশে দেখতে দেখতেই বাদামেরর ঠোঙাটা খুলল। একটা বাদাম ভেঙে তালুর ওপর রেখে ফুঁ দিয়ে লাল খোসাটা উড়িয়ে দিতে দিতে দেখল পাশের কিশোর ছেলেটি তাকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। দেখবেই তো। এখানে যারা সমাগত দর্শক তাদের চেয়ে সে আলাদা। তার বাইরের লেবাসই বলে দিচ্ছে সে ভদ্রলোক।

          -বাদাম খাবি?

          ছেলেটা কথা বলল না। মাথা নাড়াল। রফিক বাদাম তুলে নিজের জন্য রেখে ঠোঙাটা ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিল।

          -তোর নাম কী রে?

          -জুয়েল। বাদাম চিবাতে চিবাতে জবাব দিল।

          -বাহ, সুন্দর নাম তো। লেখাপড়া করিস?

          -হ।

          -কোথায়?

          -ব্যারাক (ব্র্যাক) ইশকুলে।

          -কোন ক্লাশে পড়িস?

          -কেলাস ফোরে।

          রফিক তাকিয়ে দেখল। ক্লাস ফোরের হিসেবে বয়স একটু বেশি। এই বয়সী তার মেয়ে অনিন্দিতা ক্লাস সেভেনে পড়ে।

          নাটক শুরু হচ্ছে। রফিক নড়েচড়ে বসল। রানা প্লাজার ঘটনা নিয়ে নাটক। এতক্ষণের হৈ-হুল্লোড়ে দর্শক একদম চুপ। শুধু আশেপাশের যানবাহনের শব্দ। তন্ময় হয়ে দেখছিল।

          হঠাৎ পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠল। রফিক একটু বিব্রত বোধ করে পকেট থেকে যন্ত্রটা বের করল। যা ভেবেছিল ঠিক তাই- রীনা। দর্শক সারি থেকে উঠে এসে কিছুক্ষণ ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকল। এখন কি ধরা ঠিক হবে? নাটকের শব্দ যদি রীনা বুঝতে পারে সে পথনাটক দেখছে তার ভাষায় যত্তোসব ছোটলোকদের সঙ্গে, তাহলে এক্ষুনি তার মুখ ছুটবে যে ফোন কেটে দিলেও তা থেকে রেহাই নেই। আবার করবে আবার করবে। আবার বাজছে ফোন। ধরতেই হবে। রিসিভ বাটন টিপে ফোনটা কানের কাছে ধরল।

          -হ্যালো।

          -তুমি কোথায়?

          -বাইরে।

          -বাইরে- এটা কোন উত্তর হল। বাইরে কোথায়? যেখানে আছ সে জায়গার নিশ্চয় একটা নাম আছে। নাকি সেটা পৃথিবীর বাইরে জাহান্নামে?

          -না।

          সোহেল রানা ধরা পরেছে। হেলমেট পরা রানাকে দুপাশ থেকে পুলিশ ধরে আছে। বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। দর্শক জোরে হাততালি দিয়ে উঠল। উচ্ছ্বাসে দুই-একজন চিৎকার করে উঠল।

          -অ্যাই কথা বলছ না কেন? তুমি কি সার্কাস দেখছ, কথা বলছ না কেন? এত হাততালি শোনা যাচ্ছে কেন?

          -শহীদ মিনারের সামনে আছি।

          -কী হচ্ছে ওখানে?

          -পথনাটক।

          -তুমি পথনাটক দেখছ যত্তোসব আজেবাজে লোকদের সঙ্গে বসে? তোমার অধঃপাতে যেতে আর কতটুকু বাকি। যাও যাও অধঃপাতেই যাও। কিন্তু তার আগে শোন, তোমার ছেলে আমার কম্পিউটার নষ্ট করেছে, কাল এসে ওটা দোকানে দিয়ে আসবে।

          -আমার অফিস আছে তো।

          -অফিস আমারও থাকে। তাই বলে তোমার বাচ্চাদের দায় তুমি এড়াতে পারো না। দায়িত্বহীন একটা বাপ। তারপরও শয়তান দুটো সারাক্ষণ বাবা, বাবা করবে। গাধার বাচ্চা কতগুলো।

          -কাকে বলছ?

          -তোমাকে না।

          -আচ্ছা।

          -মনে থাকবেতো কি করতে বলেছি।

          -থাকবে।

          -ঠিক আছে রাখি। ঝাঁঝালো গলায় কথাটা বলে ফোনটা কেটে দিল।

          বন্ধ ফোনটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সেটা পকেটে ঢোকাল রফিক। কথায় বলে কম্বল ছাড়ে তো কমলী ছাড়ে না।

          বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে পড়ত রীনা আর রফিক। রফিক চিরদিনই একটু উদাসীন ভাবালু প্রকৃতির। ছোটখাটো গড়নের, শান্তশিষ্ট। বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় সারাক্ষণই আছে কিন্তু থেকেও যেন নেই। ক্লাসেও উপস্থিত কিন্তু পেছনের বেঞ্চে বসে বই আর কবিতা লেখাই তার কাজ। সেই রফিকই একদিন ক্লাস থেকে বেরুতে গিয়ে লাগল একটা ধাক্কা। টিউটোরিয়াল থেকে পালাচ্ছিল। খেয়াল করে নিজের সামনে সেই দুর্দান্ত মেয়েটি যার কথার হুলে ইতিমধ্যে অনেক ছেলেই জর্জরিত। হাত থেকে ছিটকে পড়া বইগুলো নিচু হয়ে তুলে মেয়েটার হাতে তুলে দিতে গিয়ে দেখল কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো অগ্নিকন্যার দুচোখে আগুন ঝরছে।

          -মেয়ে দেখলেই ধাক্কা দিতে ইচ্ছে করে বুঝি?

          -তা কেন হবে- মিন মিন করে বলেছিল রফিক।

          -তাহলে ধাক্কা দিলেন যে। কৈফিয়ত চাইল।

          -দিলাম কোথায় লেগে গেল।

          -ইহ, দিলাম কোথায়? লেগে গেল। কী ভদ্রতা। ভবিষ্যতে সাবধানে দেখেশুনে পথ চলবেন। সারাক্ষণতো দেখি ভাবের জগতে আছেন। লেখাপড়াতো করেন বলে মনে হয় না।

          -হ্যাঁ। রফিক কোনমতে পালিয়ে বাঁচতে চায়।

          -হ্যাঁ, হ্যাঁ আবার কি।

          -তাহলে কি বলব?

          -বলুন ঠিক আছে এবার থেকে ঠিকমত লেখাপড়া করব।

          -আচ্ছা। এবার থেকে ঠিকমত লেখাপড়া করব।

          -এবার যান। কিন্তু এখন থেকে আমার নজরদারিতে থাকবেন আপনি।

বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেল মেয়েটি। ক্লাসে অন্য ছেলেমেয়েরা তখন দূরে দাঁড়িয়ে হাসছিল। রফিক লজ্জায় মাথা তুলতে পারছিল না।

          মেয়েগুলো সরে যেতে বন্ধুরা এগিয়ে এল।

          -কিরে রফিক অগ্নিকন্যার অগ্নিবাণে তুইতো ধরাশায়ী হয়ে গেলি।

          -হ্যাঁ, হলাম তো। কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। আমি ধাক্কা দিলাম না আমাকে ধাক্কা দিল। পরে রীনা তাকে বলেছিল, ধাক্কাটা আসলে সেই দিয়েছিল।

          -কেন?

          রফিক জানতে চেয়েছিল। ক্লাসের মধ্যে একটা ছেলে উদাসী যোগী যোগী ভাব নিয়ে বসে থাকে কোন মেয়ের দিকে তাকায় না এটা দেখে তার জিদ চেপে গিয়েছিল। এই ছেলের গুমোর ভাঙতে হবে।

          হায় রীনা। একটা বোহেমিয়ান মানুষের গুমোর ভাঙতে গিয়ে তুমি নিজেই ভেঙে টুকরো টুকরো হলে। অথচ কি ভীষণ সংসারী তুমি। দায়িত্ববান। কিন্তু তোমারই সংসার খন্ডিত হল তোমার আপন খেয়ালে। রফিক আপন মনে উচ্চারণ করে।

          হাততালি পড়ল। রফিক চমকে তাকাল। নাটক শেষ হয়েছে। দর্শকের মেলা ভাঙছে। আবার চারপাশ সরগরম আমড়া, বাদাম, ভুট্টা বিক্রেতাদের কোলাহলে। এখন ডেরায় ফিরতে হবে। হ্যাঁ, নিজের বাসাটাকে সে ডেরাই বলে।

          দেড়রুমের ছোট্ট একটা বাসা। মোবাইল অন করে সময় দেখল। এখনও কিছুক্ষণ সময় আছে। শাহবাগের বইয়ের দোকানগুলো একবার ঘুরে যাওয়া যায়। আর্ট কালচারের ওপর কিছু বই-ম্যাগাজিন দরকার।

          আবার ফোন বাজছে- আবার রীনা। রফিক শংকিত হয়ে ফোন ধরল।

          -হ্যালো বাবা। মেয়ে অনিন্দিতার চাপাস্বর শোনা গেল।

          -কি মামণি?

          -শোন মা এখন রান্না ঘরে, তাই তোমাকে ফোন করছি। দীপ্র কম্পিউটারটা নষ্ট করে ফেলেছে। মায়ের মেজাজ খুব খারাপ। তুমি কাল সকালেই এসে ওটা ঠিক করে দিও।

          -সকালে যে আমার অফিস আছে।

          -আরে ধুর! তুমি কি সবসময় অফিসে যাও নাকি। মা বলে তুমি অফিস ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়াও, আকাশ দ্যাখো, গাছ দ্যাখো। সত্যি বাবা!

          -হ্যাঁ মা কিছুটা সত্যি। তবে অফিস ফাঁকি দিয়ে নয়। যখন আমার চাকরি থাকে না, তখন ওসব করি।

          -আচ্ছা বাবা, তুমি বলেছিলে একদিন আমাদের ধলেশ্বরী নদীতে বেড়াতে নিয়ে যাবে, কই নিলে না তো।

          -বড় হও তারপর নেব। এখন তোমার মা ভয় পায়। তাই যেতে দিতে চায় না।

          -মা ডাকছে। এখন রাখছি। বাই বাবা।

          মেয়ে ফোন কেটে দিল। এক টুকরো মলিন হাসি ফুটে উঠল রফিকের মুখে, তার সাথে চোখে দুফোঁটা জল। রফিক চোখ মুছে নিল। সংগোপনে। অনেক পরিচিত লোকজন আছে এখানে। দেখলেই হয়তো প্রশ্ন করবে।

          ছবির বইয়ের খোঁজ করল। না এখনো আসেনি। দু একটা সাময়িকপত্রের পাতা ওল্টাল। কিছুই ভালো লাগছে না। মেয়ের ফোন রেখে দেয়ার ত্রস্ত ভাবটা মনে পড়ছে। হায়! ছেলে-মেয়ে দুটোও কি রীনার ভয়ে কেঁচো হয়ে যাবে। যেমন রফিক হয়েছে। আপন মনেই হাসল। কেঁচো হবে কি। তার তো কেঁচো জন্ম। তিন বউ নিয়ে সংসার করা বাবার ঘরে জড়িয়ে মাড়িয়ে তারাতো কেঁচোর জীবনই যাপন করেছে। তার ওপর আবার মেজোমায়ের সন্তান। না এদিক, না ওদিক সতের আঠারোজন ভাইবোনের সংসারে কে কাকে চেনে। বাবা জন্ম দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন, ঘরে খাবার আছে, ব্যবসার টাকা আছে, যে পারছে খাচ্ছে নিচ্ছে, যে পারছে না সেটা তারই দোষ।

          এই বিশাল সংসারে রফিকও বেড়ে উঠেছে নিজের মত করে। কর্ণফুলীর তীর আর পাহাড় দেখতে দেখতে। কখনও সাম্পানে ভেসে যেতে দিনে দিনে সংসারে থেকেও সে যেন একা হয়ে গেল। মায়ের মৃত্যু তাকে আরো একা করে দিল। এই একাকিত্বই কি তাকে উদাসী, বিবাগী করে তুলেছে? সে নিজেও বুঝতে পারে না।

          কলিং বেল টিপতেই অনিন্দিতা ছুটে এসে দরজা খুলে দিল, গলা জড়িয়ে ধরল, বাবা আমি জানতাম তুমি এক্ষুনি আসবে।

          দীপ্র বলল, হ্যাঁ আমিও তাই না বুবু।

          রফিক সোফায় বসে দীপ্রকে কোলে টেনে নিল। দীপ্র একটু লজ্জা পেল। ওকি বাবার মত হয়েছে? নিজেকে প্রশ্ন করল রফিক। তাহলে ভবিষ্যতে তোরও বিপদ আছে রে বাপ। ব্যাগ থেকে বই, রং পেন্সিল আর চকোলেট বের করতেই দু ভাইবোন হামলে পড়ল। অনিন্দিতা চেঁচিয়ে উঠল উচ্ছ্বাসে- হ্যাঁ, মুহম্মদ জাফর ইকবালের এই নতুন বইটাই তো আমি চেয়েছিলাম। আরে এটাতো সত্যজিৎ রায়ের বাছাই বারোথ্যাংক ইউ বাবা। দীপ্র ছবির বইগুলো নেড়ে চেড়ে দেখছে।

          -চলো কম্পিউটার দেখি।

          -হ্যাঁ চলো।

          -মা কোথায়?

          -মা তো বাইরে গেছে। রীপা খালামনির বাসায়।

          রফিক জানতো রীনা থাকবে না। আজ শনিবার রীনার ছুটির দিন। তবু রফিক আসবে বলেই রীনা চলে গেছে। ফোনে কথা বললেও সে আসবে জানলে রীনা থাকে না।

          কম্পিউটার নিয়ে আসার সময় আবার আবদার জুড়ে দিল অনিন্দিতা- বাবা আমরা একদিন রমনা পার্কে যাব। তোমার সাথে গাছ দেখব।

          -দীপ্র, তুমি যাবে না?

          -হ্যাঁ যাব।

          -ঠিক আছে সামনের সপ্তায় আমরা যাব। আরেকদিন বলধা গার্ডেনে নিয়ে যাব। সেখানেও অনেক গাছ আছে।

          রিক্সা ডেকে কম্পিউটারটা নিয়ে আসার সময় দেখল ছেলেমেয়ে দুটো তখনও হাত নাড়াচ্ছে। রফিকের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল।

          ঘরে ফিরেই রীনা দেখল মেয়ে নতুন বইয়ে ডুব দিয়েছে আর ছেলে রঙতুলি নিয়ে মেতেছে। মানুষ কি এভাবেই পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার বহন করে? নাহলে ছেলেটার তিনবছর বয়স থেকেই ছবি আঁকার দিকে ঝোঁক। কেমন একা একা আপন মনে থাকে। ছেলেটা বাবার মত হবে এটা ভাবলেই রীনার মাথাটা গরম হয়ে যায়।

          একটা অপদার্থ লোকের মোহে পড়ে তার জীবনটা বরবাদ হল এখন ছেলে যদি বাপের স্বভাব পায় তাহলে তার জীবনটা কয়লা থেকে ছাই হবে। আজও রীনা বুঝতে পারে না এত মানুষ পৃথিবীতে থাকতে এই উড়নচন্ডী হতভাগাটার দিকে কেন তার মন পড়েছিল। ক্লাশে আরও তো কত ছেলে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়েও। অথচ উদাসী উদাসী ভাব নিয়ে থাকা এ ছেলেটাকে নিজের দিকে ফেরাতে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতেও পিছপা হয়নি। তারপরও যেখানে সেখানে দেখলেই তার ওপর দখলদারিত্বের চেষ্টায় কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল।

          কেন যে হয়েছিল আজও বুঝতে পারে না রীনা। ছেলেটা ছবি আঁকে, বাঁশি বাজায়। অনেক পড়াশুনা করে কিন্তু কারো সঙ্গে মিশে না। মেয়েদের দিকেও তেমন তাকায় না। হায় প্রথম যৌবনের রোমান্টিকতায় এসবে মুগ্ধ হয়ে একধরনের জেদ চেপে গিয়েছিল রীনার।

          ছোটবেলা থেকেই বাবার আদরের একমাত্র মেয়ে রীনা জেদি স্বভাবের ছিল। মেনে নেয়া তার স্বভাবের মধ্যে ছিল না। তাইতো ন বছর সংসার করার পর ওই বোহেমিয়ানটাকে সংসারের হাল ধরাতে ব্যর্থ হয়ে রীনা নিজেই তাকে আলাদা করে দিয়েছে। আর কি আশ্চর্য! স্কাউন্ড্রেলটা প্রতিবাদ না করে সবকিছু মেনে নিয়েছে। আরও বলে কি- তোমার মতো ভালতো এ জীবনে কেউ বাসিনি তাই তুমি যেভাবে সুখী হও আমিও তাতেই সুখী।

          ইঃ! সুখী। তখন মুখের ওপর একটা কিছু ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে করছিল। ভাগ্যিস। হাতের কাছে ছিল না। নাহলে নিজের মেজাজ রীনা জানে, হয়তো মাথাটাই ফাটিয়ে দিত। এখনো সেকথা মনে হলে মাথাটা চিড়বিড় করে ওঠে। কিন্তু--- না ওসব কিন্তু কিন্তু আর রীনার জীবনে নেই। বাচ্চারা আছে। চাকরি আছে। এই যথেষ্ট

          বাবা-মা মারা গেছেন লোকটাকে ছেড়ে আসার আগে। ভাগ্যিস মারা গেছেন। নাহলে দুঃখের সীমা থাকত না তাদের, আর ভাই দুটো বিদেশে স্থায়ী নিবাস গড়েছে। সুতরাং রীনাকে নিয়ে মাথা ঘামাবার মতো কেউ নেই।

          বিয়ের আটমাসের মাথায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে এল লোকটা। কেন? অফিসের বসের সাথে শ্রমিকদের বিষয়ে বাদানুবাদ করে রেজিগনেশন দিয়ে এসেছে।

          তারপর সংসারের কি হবে? রীনা গলাইয় ঝাঁঝ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল।

          -আরেকটা চাকরি খুঁজে নেব।

          -চাকরি এত সহজ! ছেলের হাতের মোয়া! তীক্ষ্ণ তীব্র কণ্ঠে রীনা বলেছিল।

          -না তা হবে কেন? চাকর, চাকরি একটা গেলে আরেকটা পাওয়া যায়।

          তারপর রীনা সারাদিন রাগে যত চিৎকার চেঁচামেচি করেছে লোকটা তত নিরীহ ভাব নিয়ে সব কিছু স্বাভাবিকভাবে করে গেছে।

          বিকেলে রীনাকে বলেছে, চল রিক্সা নিয়ে ঘুরে আসি। ফাল্গুনের এলোমেলো বাতাসে শহরটাও কেমন উদাসী হয়ে আছে, দেখবে চলো।

          রীনার তখন রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারানোর অবস্থা। তার আগুনরাঙা মুখ দেখে মিনতি করে বলেছিল- এরকম রাগ করলে প্রেশার বেড়ে মারা পড়বে তো। চলো তোমার মুখ ধুইয়ে দিই।

          রীনা প্রবল ধাক্কায় বিছানা থেকে উঠে লোকটাকে হিড়হিড় করে টেনে বাইরে ঠেলে দিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। তারপর আজ সুন্দরবন ঘুরতে যাওয়া, কাল বান্দরবান আবার কোনদিন হাওর-বাওরে পাখি দেখার মাঝেই দুম করে চট্টগ্রাম চলে যাওয়া কি যে দুর্বিষহ জীবন যাপন।

          মেজাজ মর্জি ভাল থাকলে নিবিড় কোন মুর্হূতে কোমল হয়ে রীনা জানতে চাইত- এত ভবঘুরে কেন গো তুমি?

          রীনার মুখের চূর্ণ চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলত, আমি যে কর্ণফুলিতে ভেসে যাওয়া ছেলে। পাহাড় প্রকৃতি যখন আমায় ডাকে তখন ঘরে থাকতে পারিনা। দ্যাখনা, আবার তোমার টানে ফিরে আসি।

          তারপর একদিন লোকটাকে সত্যি সত্যি ছেড়ে আসতে হয়েছিল। দু দুটো ছেলে মেয়ে হওয়ার পরও লোকটার স্বভাব বদলাল না। অফিসে সামান্য খটাখটি হলে চাকরি ছাড়া, যখন তখন হারিয়ে যাওয়া।

          তখন মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক এত বিস্তৃত ছিল না। ফলে ছুটতে হত বন্ধু-বান্ধবের কাছে। তারা হাসাহাসি করত আর সেটা দেখে দাঁতে দাঁত ঘষা ছাড়া উপায় থাকত না রীনার। আর বাচ্চা দুটো! বাবাকে পেল তো মা আর চেনে না। বাবার সঙ্গে বই পড়ছে, কার্টুন দেখছে, ছবি আঁকছে।

          কিন্তু রীনা আর পারছিল না। শেষে একদিন আলাদা হওয়ার প্রস্তাব দিলে নির্বিবাদে মেনে নিয়েছিল।

          কাপুরুষ স্টুপিড একটা- শরীরের সমস্ত বিতৃষ্ণা নিয়ে রীনা উচ্চারণ করল।

          -আম্মু।

          চমকে উঠল রীনা- দীপ্র।

          কাচুমাচু মুখে ছেলে এসে পাশে দাঁড়াল। মায়ের রাগকে ভীষণ ভয় পায় ছেলেমেয়েরা। তবে ছেলেটা বেশি ভয় পায়। ওর মুখটার দিকে তাকালে রীনার বুকটা হু হু করে ওঠে। একদম বাপের আদল। স্বভাবটাও মুখচোরা। রীনার বুকের ভেতর একটা চোরা স্রোত বয়ে যায়। হায়! কিভাবে জীবন নিয়ে এত বড় একটা বাজি ধরেছিল সে। কেন জিদ করেছিল- এই মানুষটাকে তার চাইই চাই।

          -আম্মু। দীপ্র আবার ডাকল।

          হাতের তেলোয় চোখ মুছে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল- কী বাবা?

          মুখটা কিছুক্ষণ নামিয়ে রেখে ছলছলে চোখ দুটো মায়ের দিকে তুলে বলল, অনেকদিন বাবা আসছে না। বলতে বলতে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

          আসলেই তো। প্রায় দুসপ্তার বেশি লোকটা আসেনি। কোথায় গেল আবার। ভালো আছে তো। রীনার বুকটায় হঠাৎ মোচড় দিল।

          দুসপ্তার বেশি হতে চলল ভাওয়ালের এই জঙ্গুলে জায়গায়টায় এসেছে। রূপগঞ্জের চাকরিটা হঠাৎ করে চলে যাওয়ায় কিছুটা বিপদে পড়েছিল রফিক। লেখাপড়ার ভিতটা শক্ত ছিল বলে চাকরি পেতে কখনও খুব একটা কষ্ট হয়নি। কিন্তু এখন বয়স হচ্ছে। আগের মত চাকরি খুঁজতে ইচ্ছে করে না।

          রূপগঞ্জের নিটিং ফ্যাক্টরির মালিকের সাথে বেশ কিছুদিন থেকে বনিবনা যাচ্ছিল না। কারখানা লাভে আছে তবুও শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা, বোনাস নিয়ে হুজ্জোত করবে। বিদেশী কাস্টমারকে চিঠি লেখা থেকে শুরু করে শ্রমিক অসন্তোষ সবকিছুতে রফিককে ডাকা হত। শেষে একদিন তর্কাতর্কির মাঝখানে হঠাৎ বলেছিল- মানুষের জন্য মায়া-দয়া, বিদ্যাবুদ্ধি কিছুইতো নাই। শুধু টাকার জোরে আর টাকার লোভে কতকাল ব্যবসা করবেন?

          অতএব, সেই দন্ডেই চাকরি নট। রফিকও পরোয়া না করে বেরিয়ে এসেছিল।

          রীনাকে বিষয়টা জানায়নি। জানালে বিদ্রুপের হুল ছাড়া আর কিছু জুটত কি? তারপর এই চাকরিটা। ভাওয়ালের জংলা ভর্তি এই জায়গায় এক ভদ্রলোক জায়গা কিনে রিসোর্ট করবে। এক বন্ধুর মারফত প্রস্তাবটা পেয়ে আর দেরি করেনি। বাসা ছেড়ে তল্পিতল্পা নিয়ে এখানে এসে উঠেছে। ভালই লাগে।

          এই অঞ্চলে ইতিহাসের একটা গন্ধ আছে। এ সম্পর্কিত অনেকগুলো বই সংগ্রহ করে রাত জেগে পড়ছে। রাতে মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক, নানারকম রাতজাগা পাখির ডাক শুনতে শুনতে ঘুম এসে যায়। ভোরে গাছের শাখায় আলোর খেলা, ভূমিতে আলো আঁধারি কেটে আলের পতন সব মিলিয়ে নিজের মাঝে কবিতা, সুর আর ছবির টান অনুভব করে। রীনা তাকে ছেড়ে যাবার পর ওসবে আর মন লাগত না। একলা জীবনে রীনা আর ছেলে মেয়ে দুটোই তার একমাত্র বাঁধন অথচ সে বাঁধনও কেমন আলগা। রীনা চাইলেই ছিঁড়ে দিতে পারত। এখনো পারে। তবু যে ধরে রেখেছে এতেই কৃতজ্ঞ।

          এখানে নেটওয়ার্ক দুর্বল। ফোন করাও যায় না। দুসপ্তার ওপরে সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। হঠাৎ ছেলেমেয়েদের আর রীনার জন্য মনে কেমন করে উঠল। মনে পড়ল জন্মদিনে অনিন্দিতা বাবাকে চারকোল গিফট করেছিল ছবি আঁকার জন্য। রফিক ভেবে রেখেছিল কর্ণফুলির তীরে গিয়ে নদী আর পাহাড়ের ছবি এঁকে মেয়েকে দেবে। কিন্তু সে তো অনিশ্চিত। নতুন চাকরিটা নিয়ে আর গড়বড় করতে চায় না। বয়স হচ্ছে। থিতু হতে মন চায়। যে ঘর একদিন হেলায় হারিয়েছে তার জন্যই মনটা আকুলিবিকুলি করে। রফিক বুঝতে পারে না তার এ পরিবর্তন কি মোহ, মায়া নাকি বয়সের অনিবার্য পরিণতি।

          বুকের ভেতরটায় চিনচিনে ব্যথা। কার জন্য? হাইপারটেনশান থাকলেও নিয়মিত ওষুধ খাওয়া হয় না। কদিন রসুন, তারপর কালেজিরার গুড়ো আর এখন মাশরুমের গুঁড়ো খাচ্ছে। এক হারবাল বিশেষজ্ঞ বলেছে, মাশরুম খেলে আর কোন ওষুধই খাওয়া লাগবে না। কৌতূহলী হয়ে রফিক ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আজকে বুকটা এত ব্যাথা করছে কেন? মরে যাবে নাকি? না না এখনই মরতে চায় না সে। বাচ্চারা এখনো ছোট। কি অপদার্থ পিতা সে। তাদের জন্য কিছুই করেনি সে। এবার যাওয়ার সময় অনিন্দিতার জন্য এই জঙ্গলের একটা ছবি এঁকে নিতে হবে। হঠাৎ নিজের ভিতরে একটা তাগিদ অনুভব করে। বিছানার পাশে রাখা ব্যাগ খুলে চারকোল খুঁজতে থাকে।

          অফিসে বসে দশটার দিকে ফোনটা পায় রীনা। হারুন করেছে। ওদের কমন ফ্রেন্ড।

          -রীনা, তুই কি খবরটা পেয়েছিস?

          -না, কি খবর?

          -আশ্চর্য! রফিকের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তুই জানিস না।

          -না তো! কোথায়? কখন?- রীনার স্বরটা কেঁপে যায়।

          -আরে জঙ্গলে গিয়েছিল না। ওখানেই।

          -জঙ্গলে? আচ্ছা যাক। এখন কোথায় বল।

          -সেন্ট্রাল হসপিটালে। আমি আছি এখানে।

          -আচ্ছা তুই থাক। আমি আসছি।

          কোনরকমে অফিসে বলে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছুটতে থাকে হসপিটালের দিকে।

          তিনদিন পর চোখ বুঁজেই রফিক যেন শুনতে পায় রফিক রফিক বলে রীনা তাকে ডাকছে। চোখ খুলতে ইচ্ছে করে না। স্বপ্নে হলেও রীনার কন্ঠ তাকে উদ্বেলিত করে। চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়ায়। ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে। রীনা তার একটা হাত মুঠোয় ধরে রেখেছে। আস্তে আস্তে রফিক তাকায়- অনিন্দিতা আর দীপ্র তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। চোখের জল লুকাতে রীনা হাত ছেড়ে উঠে এল।

          দীপ্র এসে বাবার কানে কানে বলল, বাবা মা বলেছে, তোমাকে আর কোথাও যেতে দেবে না। আরও কি বলেছে জানো- হাত পা ভেঙে তোমাকে ঘরে বসিয়ে রাখবে।

          দুর্বল হাত বাড়িয়ে ছেলের হাতটা ধরে তারপর আবার ঘুমের প্রশান্তিতে তলিয়ে যায়।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩১-৩২

----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ __________________________...

Popular Posts