১
অবশেষে মারা
গেলেন তৌহিদা বেগম চৌধুরানী। চুরানব্বই বছর বয়সের স্বাভাবিক
মৃত্যু। দীর্ঘ দশ বছরের
ওপর বিছানাতেই কেটেছে। কিন্তু
সংজ্ঞা হারাননি কখনও। এবারই হাসপাতালে আনার
আগে প্রথম জ্ঞান হারিয়েছিলেন। সেই প্রথম। তবুও
ডাক্তার যখন লাইফ সাপোর্ট
মেশিন সরিয়ে নিলো তখন কেবিনে উপস্থিত তার দুই কন্যা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো আর তিন ছেলে যার যার মতো পায়চারি করতে লাগলো। মুহূর্তের
মধ্যে মোবাইলে মোবাইলে খবর ছড়িয়ে
পড়ল আত্মীয়-বন্ধু সবার
কাছে। যেহেতু শনিবার সে কারণে ঢাকা
শহরে যানজট অনেকটাই কম। তাই অল্প সময়ের
মধ্যেই অনেক বেশি জনসমাগম
ঘটল।
তৌহিদার
জ্যেষ্ঠপুত্র, বুদ্ধি এবং অর্থবলে যিনি ভাইদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তিনি হাসপাতালের লবিতে
গিয়ে হাতের মুঠোয় রাখা স্মার্টফোনে সার্চ দিলেন। ফোনের মেমোরি থেকে বের করলেন আগে
থেকেই সেট করা করণীয় কাজগুলোর তালিকা। মায়ের অবস্থা গুরুতর দেখে কয়েকদিন আগেই
লিস্টটা করে রেখেছেন। তাই টু-ডু লিস্টের বাটনে আঙুল ছোঁয়াতেই ভেসে উঠলো - ১। লাশ
বাসায় নেয়া ২। মোল্লা
মৌলভী ডেকে খতম পড়ানো ৩। গোসল
দেয়া ৪। গ্রামের
বাড়িতে কবর খোঁড়া ও অন্যান্য
আয়োজনের জন্য অধীনস্থদের খবর দেয়া ৫। বাড়ি
যাওয়ার জন্য গাড়ি, মাইক্রো আর লাশবহনকারী গাড়িটি নিশ্চিত করা ৬। সংবাদপত্রে
বিজ্ঞাপন পাঠানো।
যাকে যে কাজ দিয়েছেন
সে উপস্থিত থাকলে তাকে
ডেকে আবার নির্দেশ দিলেন
যেন কোন ত্রুটি না হয়। অন্যদের মোবাইলে come at once জাতীয় হুকুম
দিলেন। তারপর কিছুক্ষণ
পায়চারি করে লবি থেকে
কেবিনে ঢুকতেই সবাই পথ ছেড়ে
দিল।
বোনদের কান্না এতক্ষণে অনেকটাই
প্রশমিত হয়ে এসেছে। তারা
এখন আত্মীয়দের কাছে মৃত্যু
মুহূর্তের বর্ণনা দিচ্ছে।
"আপনি পানি
খাওয়াতে পেরেছেন তো?”
"না কীভাবে খাওয়াব? নাকে
মুখে তো নল লাগানো
ছিলো।"
"আহারে
একটু পানি পেল না" মহিলাটি আর্ত হাহাকার করে উঠলেন।
"আমার
কাছে জমজমের পানি ছিল গতবার
হজ্বে গিয়েছিলাম তখন অনেক
নিয়ে এসেছি।"
আত্মীয়ার এ কথা শুনে
তৌহিদার ছোট মেয়ে লীলা ওড়নার খুঁটে চোখ ঢেকে
ডুকরে কেঁদে উঠল।
জহিরুল ইসলাম
চৌধুরী অর্থাৎ তৌহিদার জ্যেষ্ঠপুত্র
মায়ের পায়ের কাছে এসে দাঁড়ালেন। একজন তাড়াতাড়ি একটা চেয়ার
টেনে দিল। আরেকজন
বসার জন্য বিনীত অনুরোধ
জানাল। মায়ের মৃত্যুতে
জহিরের শোক না স্বস্তি
তা তিনি বুঝতে পারছেন
না।
ব্যবসায়িক এবং সম্পত্তি
বিষয়ক কারণে তারা তিন ভাই বহুবছর
একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন। এই ঢাকা শহরের অভিজাত
এলাকার প্রাসাদোপম বাড়িতে বাস করেও
তারা কেউ কারো মুখ দেখেনি। আজ মায়ের মৃত্যুতে তাদের পাঁচ ভাইবোনের উপস্থিতি তাকে যেন বর্তমান
থেকে অতীতে নিয়ে যাচ্ছে। মা কত চেয়েছেন ছেলেরা
এক হোক। আর কিছু
না হোক অন্তত ঈদ-পরবে
দেখা হোক। কিন্তু
তার জীবদ্দশায় তা আর হয়ে উঠল না।
হাসপাতালের বেডের রডের উপর হাত রেখে মাথাটা নিচু করলেন জহির। আত্মীয়দের
একজন জানতে চাইল, "দাফন এখানে হবে, না বাড়িতে?"
আরেকজন বলল,
"না না, বাড়িতে। এখানে কেন হবে?
কত বনেদী বংশ ওদের।"
দুঃখের মধ্যেও
হাসি পেল জহিরের। বনেদী
বংশ। শেষপর্যন্ত ঐ বংশটাইতো
ছিল আর কিছু কি ছিল?
ঐ বংশের গৌরবে বাবা-কাকারা
কোন কাজ না করেই
পায়ের উপর পা তুলে
দিন কাটিয়ে গেছেন। যাক এখন এসব ভাবার
সময় নয়। তাঁর
সকল কাজের ডানহাত রফিককে
ডাকলেন, "লাশ বাসায়
নেবার ব্যবস্থা কর।"
"জী ভাইজান, সব রেডি।"
"ঠিক আছে। বিলটিলগুলো দেওয়ার ব্যবস্থা কর।"
ছোটভাই শরীফুল
স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর
বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, আমিই
দিই না। কিন্তু
বলার মত অবস্থা কই?
এ ক'দিন হাসপাতালে
আনার আগে গত দশ বছরে
সে কি মাকে দেখতে
একবারও গিয়েছিলো? না যায়নি। তার জীবনের পরম শত্রুর বাসায় একবারের জন্যও
মাকে দেখতে যাওয়া হয়নি।
এখন মায়ের মৃত্যুর প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে প্যান্টের
দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে
স্ত্রীকে ইশারা করলো কাছে
আসতে। দুজনে একসাথে
বেরিয়ে এসে হাসপাতালের বাইরে
দাঁড়িয়ে কথা হল "বাড়ি যেতে হবে তো। বাসায় গিয়ে রেডি হও। ছেলেমেয়েদেরকেও বলো রেডি হতে। আমি ড্রাইভারকে ফোন করছি।"
ছেলেমেয়ে দুটি
কিশোর বয়সী। তারা এর আগে বড় হয়ে
কখনো বাড়ি যায়নি। মায়ের
কাছে শুনেছে বাড়িতে তাদের
বিশাল চারতলা বিল্ডিং আছে। আছে পুকুর, মসজিদ অনেক
বিষয় সম্পত্তি। মেয়ে
মালিহা কিছুটা উল্লসিত হয়ে উঠলো, "খুব মজা হবে তাই না মম?"
"চুপ! চুপ!"
ঝামটে উঠল মালিহার মা আন্না। আচমকা মায়ের মুখ ঝামটায়
চুপ করে গেল সে। দিদাকে তিন চার বছর বয়সের
পর আর দেখেনি সে। মনেও নেই। তার মৃত্যুতে
মালিহার মনে তাই তেমন
বেশি কষ্ট হচ্ছে না। তাছাড়া এত বয়স হয়েছে। মৃত্যুটা তাঁর জন্য প্রয়োজন। এইতো কদিন আগে ওর বন্ধু
শাফ্কাতের
পাপা হঠাৎ করে মারা
গেল স্ট্রোক করে। তখন সাতদিন
পর স্কুলে এসেও শাফকাতের
কান্না দেখে ওদের বন্ধুদের
সবারই কান্না পাচ্ছিলো।
"চল বাসায়
চল।" মায়ের
ডাকে আরেকবার সবার দিকে
ভাল করে তাকাল মালিহা। এর মধ্যে কেউ ফুপু,
কেউ চাচা অথবা কাজিন
কিন্তু মালিহা কাউকে চেনে
না। এত শত রিলেটিভস, কই কাউকে তো এর আগে দেখেনি। আজ ওর কিশোরী মনটা
কৌতূহল নিয়ে
সবাইকে দেখতে চায়।
No comments:
Post a Comment