_____________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - বোধন ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৯
গল্প - মায়ের জন্য
__________________________
মায়ের
জন্য
পার্টি থেকে ফিরেই কানের
দুল জোড়া খুলে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখতে রাখতেই বাবাকে বকুনি লাগালেন মা¾ তুমি একটা আস্ত
অপদার্থ।
¾ কেন অপদার্থের মত কী
আচরণ করলাম? বাবার হতভম্ব প্রশ্ন।
¾ কেন দেখলে না আজকের
পার্টিতে মেজভাবী কি সুন্দর একটা হীরার নেকলেস পরেছে। তুমি কখনও আমাকে এরকম একটা
নেকলেস কিনে দিয়েছ? অথচ কত শখ আমার ম্যারেজ ডে’র
পার্টিতে একটা হীরার নেকলেস পরব। সবাই দেখবে। তুমি সত্যি সত্যি একটা গাধা, ভোম্বল
দাস। বলতে বলতে হাতের নবরত্ন বসানো বালা খুলে ঠন্ করে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখতেই
সেটা গড়িয়ে আলমারির নিচে ঢুকে গেল।
¾ এই পুপু ওটা তুলে
আন।
পুপু এতক্ষণ শুনছিল বাবা মায়ের কথা।
এবার মায়ের আদেশে তাড়াতাড়ি উবু হয়ে আলমারির নিচে হাত ঢুকিয়ে দিল। কিন্তু কই কোন
কোণায় ঢুকেছে? ছোট্ট হাতটি যতটুকু ঢোকানো যায় তার চেয়েও বেশি ঢুকিয়ে পুপু খুঁজতে
চেষ্টা করল। তার ভয় লাগছে। আর কিছুক্ষণ দেরি হলে মা হয়তো তার চুল ধরে টান দেবেন।
মাকে ভীষণ ভয় পায় পুপু। যে রাগী মা। রেগে গেলে মাঝে মাঝে পুপুকে হাতের কাছে যা পান
তাই দিয়ে মারেন।
¾
ছেলেটার কাপড় চোপড় নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া এভাবে হাত ঢুকিয়ে দেখতে গেলে ও হাতে
ব্যথাওতো পেতে পারে। তোমার সবটাতেই বাড়াবাড়ি, অসভ্য মহিলা।
¾
কী, কী বললে তুমি!
¾
যা বলেছি শুনতে পাওনি? অসভ্য বলেছি, অসভ্য। তুমি একটা অসভ্য মহিলা। যার যা¾
বাবার কথাটা শেষ না হতেই মা ঝাঁপিয়ে
পড়লেন বাবার ওপর।
¾
তুমি আমাকে অসভ্য বলেছ?
¾ তো কী বলব? মহিয়সী?
বাবার বুকের কাছে জামাটা মা খামচে ধরতে
এক ঝটকায় মা-কে সরিয়ে দিলেন। টাল সামলাতে না পেরে মা খাটের কোণায় হুমড়ি খেতে খেতে
নিজেকে সামলে নিয়ে ওখানেই বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
পুপুর হাতটা সত্যি সত্যি আটকে গেছে। স্টিলের আলমারির নিচের
ফাঁকা অংশটুকুতে প্রায় কাঁধ পর্যন্ত ঢুকে যাওয়াতে এখন বের করতে পারছে না সে।
কিন্তু মুখে কোন শব্দও করতে পারছে না। হাতের ব্যথায় চোখে পানি এসে যাচ্ছে। ভয়ও
লাগছে। এই আলমারি না সরানো পর্যন্ত তাকে কি এখানেই এভাবে থাকতে হবে? বাবাতো ঘর
থেকে বেরিয়ে গেছেন। মা-তো মুখ ঢেকে কেঁদেই চলেছেন। পুপুর দিকে একবারও ফিরে
তাকাচ্ছেন না। পুপু এখন কী করবে? এত কষ্টের পরও বালাটা হাতের নাগালে এল না। ওটা
পেলে মা-কে ডাকা যেত। মা খুশি হত।
পুপুরা একটি বিশাল দোতলা বাড়িতে থাকে।
সে বাড়িতে দাদী, বড়চাচ্চু, মেজকাকু আর পুপুরা থাকে। পুপু এখন ক্লাস টু-তে পড়ে।
ওদের তিনটে গাড়ি আছে। বাবার গাড়িটা শুধু বাবা নিজে চালায়। অন্য গাড়ির ড্রাইভার
আছে। পুপুরা সব ভাই-বোন মিলে একসাথে স্কুলে যায়। চাচাতো ভাই বোনেরা সবাই পুপুর
চেয়ে বড়ো। ছোট বলে ওরা পুপুকে ভীষণ আদর করে। সবার বড়ো রুপু পুপুকে আদর করে মাঝে
মাঝে গাল টিপে বলে¾ আমাদের এই পুপুটা এত মিষ্টি
হয়েছে, আর এত লক্ষ্মী। আমার ভাই দুটোতো হাড়ে হাড়ে শয়তান। একটুও দেখতে পারি না
ওদের। তারপর পুপুকে রুপু-আপু আইসক্রিম কিনে দেয়, আইসক্রিম খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করে¾
কাল কী নিয়ে ঝগড়া করলো রে কাকিমা?
পুপু চকোলেট বারের কাঠিটা জিভ দিয়ে লেহন
করতে করতে বলে ¾ কী জানি, কী গয়না টয়না নিয়ে।
¾
ও বুঝেছি, তোর মা-টা না একদম হিংসুটে, সারাক্ষণ কাকুর সাথে ঝগড়া করে।
হিংসুটে শব্দটা পুপুর ভালো লাগে না। মা
তো মা-ই। না হয় একটু রাগী। এই যে সেদিন রাতে মায়ের বালা খুঁজতে গিয়ে হাতে যে ব্যথা
পেয়েছে সে কথা কাউকে বলেনি সে। হিংসুটে তো হয় ডাইনি বুড়ি আর সুয়োরাণীরা। পুপু বইতে
পড়েছে না। তাছাড়া মা দেখতে কেমন সুন্দর আর মন ভাল থাকলে পুপুকে কত্তো আদর করে।
রুপুর কথার উত্তর না দিয়ে পুপু আচমকাই আইসক্রিমের কাঠিটি ছুঁড়ে ফেলে।
¾ কি রে রাগ করলি?
রুপু জিজ্ঞেস করে। ¾আচ্ছা, আর বলব না।
চল্, বাড়ি চল।
আজ স্কুল ছুটি। পুপু পড়ার টেবিলে। হঠাৎ কানে লাগল পু-পু-।
পুপু চারদিকে তাকাল। ঘরে কেউ নেই। তারপর একছুটে জানলার ধারে গিয়ে জিজ্ঞেস করল¾ কি রে পল্টু ডাকছিস
কেন?
¾তুমার জইন্য খুব মজার
একটা জিনিস আন্ছি।
পুপু একছুটে বাইরে এল¾ কী এনেছিস রে পল্টু?
¾ এসো না। পল্টু হাত
ধরে টানতে টানতে বোগেনভেলিয়ার ঝোপটা যেখানে মাটিতে নেমে এসেছে সেখানে নিয়ে এল
পুপুকে। তারপর একটা পুরণো চটের ব্যাগ থেকে জিনিসটা বের করল। পল্টু হাতে তুলে নিতেই
কুকুরছানাটা কুঁই কুঁই করে উঠল।
পুপু অবাক হয়ে বলল¾
এটা তো কুকুরের বাচ্চা।
¾
হ, বিদেশী। পল্টু খুব গর্ব করে বলল ¾
বাবা উই যে বিদেশীগো বাড়িতে কাম করে না, ঐখান থেইকা
আনছি।
¾
কীভাবে আনলি?
¾
কেন, লুকাইয়া।
¾
তুমি চোর?
¾
আরে ধুর। আমি চোর হমু ক্যান? সাহেবগো কুকুর বাচ্চা দিছে। আমি তার থাইকা একটা
লুকাইয়া নিয়া আইলাম। ঐ বাড়ির দারোয়ান চাচা আমারে কইছে এসব কুত্তার অনেক দাম। কিনবা
তুমি?
¾
আমার যে অতো টাকা নেই। আমার কাছে ঈদি আছে মাত্র তিনশো টাকা। তাও মায়ের ড্রয়ারে।
কথাটা বলতে বলতে চকিতে মাথায় একটা বুদ্ধি এল ¾
এ কুকুরটা পল্টুর কাছ থেকে কিনে তারপর আরো বেশি দামে বিক্রি করলে কেমন হয়! বাবাতো
প্রায়ই বলেন, ব্যবসা মানেই কম দামে কিনে বেশি দামে বেচা।
কাল রাতেও মা-বাবার ঝগড়া হয়েছে। পুপু
ঘুমানোর ভান করে মটকা মেরে পড়েছিল। মা বার বার বলছিল¾
কই নেকলেস তো দূরে থাক, তুমি আমাকে একটা হীরের আংটিও তো দিলে না। তোমাকে বিয়ে করে
আমি একটা সাংঘাতিক ভুল করেছি। অথর্ব কোথাকার।
অথর্ব মানে কী পুপু জানে না। কিন্তু
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাবা ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। মাকে লোভী- আরও কী কী বলে বকা
দিয়েছেন।
মাও শাসিয়েছে ¾ থাকব না তোমার সংসারে। একদম চলে যাব।
বাবাও বলেছিলেন ¾ যাও না। তুমি গেলেই তো আমি
বাঁচি।
শুনে পুপুর ভীষণ ভয় করছিল। সত্যি সত্যি
মা চলে গেলে পুপু কার কাছে থাকবে? তারপর ঝগড়া শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল।
এখন আবার সেই কথাটা মনে পড়ল। কম দামে কিনে বেশি দামে বেচা এটাই তো ব্যবসা। পুপু
ঠিক করল কুকুরটা কিনে সে ব্যবসা করবে। তারপর মায়ের জন্য একটা হীরের গয়না কিনবে। কত
টাকা লাগে গয়না কিনতে?
পল্টুর সাথে কুকুরটা নিয়ে কিছুক্ষণ দরাদরি হল। সে কিছুতেই
পঞ্চাশ টাকার কমে দেবে না।
কুকুরটা কিনে পল্টুর কাছেই রেখেছে পুপু।
পল্টু খুব বুদ্ধিমান। অনেক কিছু জানে। অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করে। ওর মা একটা বাসায়
আয়ার কাজ করে। আর বাবা এ পাড়ার বিদেশী বাসাগুলোর বাগানে মালির কাজ করে। বাবার সাথে
পল্টু আসে। বাগানে কাজ করে আর পুপুর সাথে দুনিয়ার গল্প করে। পল্টু ক্লাস ফোরে পড়ে
কিন্তু স্কুলে যায় না। বলে¾ ইস্কুলে গিয়া কি
হইব? আরেকটু বড় হইলে আমি বাড়ি থেইকা চইলা যামু। এহানে থাকতে আমার ভালা লাগে না।
বস্তিতে খালি কাইজা আর কাইজা। দিন রাত নাই। শুনে পুপু অবাক হয়ে যায়। সব মানুষই
তাহলে ঝগড়া করে!
¾
কেন এত ঝগড়া করে ওরা? পুপু জানতে চায়।
¾
কি জানি। কেউ পানি লইয়া, কেউ খানা লইয়া, আরো কত রকম আছে। ওইসব তুমি বুঝবা না।
তোমরাতো বড়লোক। কত সুন্দর বাড়িতে থাকো।
পুপু চুপ করে থাকে। তার বলতে লজ্জা লাগে
যে, তার বাবা-মাও খুব ঝগড়া করে।
কুকুরটা পল্টুর কাছেই জমা থাকে। ওকে আরো
দশ টাকা দেয় পুপু। তারপর দুজনে মিলে ঠিক করে শুক্রবার ছুটির দিনে কুকুরটা বিক্রি
করতে ওরা কারওয়ান বাজার যাবে। পল্টু শুনেছে ওখানে নাকি সবকিছু বিক্রি হয়।
শুক্রবার ভোরবেলা কাউকে কিছু না বলে
কুকুরটা নিয়ে পল্টুর সাথে বের হয়ে পড়ে পুপু। পল্টু লাল-নীল কাগজ দিয়ে কুকুরের গলার
দড়িটা রঙিন করেছে। একটা ঘন্টিও বেঁধেছে। সাদা ধবধবে কুকুরটার ঘাড়ের কাছে কুচকুচে
কাল। দেখতে খুব সুন্দর লাগছে।
¾
আচ্ছা পল্টু, কত হতে পারে কুকুরটার দাম?
¾
কি জানি¾ একহাজার, পাঁচহাজার। অনেক হইতে পারে। তুমি কিন্তু
আমারে পাঁচশো টাকা দিবা। আমি তোমার জইন্য এত কষ্ট করতাছি।
¾ দেব, দেব। তুমি না
হলেতো আমার ব্যবসাই হতো না।
মনে মনে হিসেব কষে পুপু, একটা হীরের নেকলেস কত হতে পারে।
নানাজনকে জিজ্ঞেস করে ওরা একসময় কারওয়ান বাজার এসে পৌঁছে।
সকালে বাজার করতে আসা লোকজন কিছুটা অবাক হয়ে ওদের দেখতে দেখতে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
সকালের রোদ এখন অনেকটা চড়া। পুপুর কষ্ট
হচ্ছে। রোদের তাপে তার মুখটা লাল হয়ে আছে। সকাল থেকে ওরা কিছু খায়নি। জীবনে এতটা
পথ হাঁটেনি কখনো। সেই বনানী থেকে কারওয়ান বাজার আসতে আসতে পা দুটো ব্যথা হয়ে গেছে।
কিন্তু কষ্ট আর ক্ষুধার কথা পল্টুকে বলতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া এতদূর এসেও পল্টুর
লাফালাফি কমছে না। সেও কুকুরটার সাথে সমান তালে লাফাচ্ছে।
বাজারে ঢুকতেও বাধা। একজন মাথায় করে
বস্তা নিয়ে আসছিল। ওরা সামনে পড়ে যাওয়াতে খেঁকিয়ে ওঠে ¾ এই ছ্যামরা এহানে কী
করস। যা এহান থাইক্যা। রংবাজি করার জায়গা পাসনা, কুত্তা লইয়া বাজারে আইছে। যা যা।
পল্টু কুকুরটাকে কোলে নিয়ে পুপুর হাত ধরে টানে¾ চল অন্যদিকে যাই।
কিন্তু কোন দিকে যাবে দু’জনের কেউই বুঝতে পারে
না।
বাজার থেকে বেরিয়ে এবার ফুটপাতে ওঠে ওরা। হঠাৎ পল্টু বলে¾ খুব খিদা পাইছে। চল
কিছু খাই। ঐ যে চা’র দোকান, চল ঐখানে যাই।
পুপুরও খিদেয় পেট জ্বলছে। পল্টুর কথামতো তারা দু’জনেই বাজারের পাশের চায়ের দোকানে ঢুকল। পুপু
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। এত বিরাট থালা সে আগে কখনো দেখেনি।
¾ এত বড় থালায় পরোটা
ভাজে?
পুপুর
কথা শুনে পল্টু হেসে ওঠে¾ আরে
এটা থালা না, তাওয়া, তাওয়া।
চারদিকে অবাক চোখে তাকাতে তাকাতে পল্টুর
হাত ধরে একটা খালি বেঞ্চে এসে বসে ওরা। সামনে টেবিল। টেবিলে গ্লাস। বসতে না বসতেই
কাঁধে গামছা একজন লোক এসে জানতে চায়¾
কি মিয়ারা, কী খাইবা তোমরা? পরটা, তেহারি? ওমা তোমাগো
লগে আবার একটা কুত্তার বাচ্চা ক্যান?
¾
ওটা আমরা ¾
পুপু কথাটা শেষ করার আগেই পল্টু একটা রাম চিম্টি
বসায় তার বাম উরুতে। পুপু কথাটা শেষ না করেই ‘উহ্’
বলে অস্ফুট একটা শব্দ করে।
¾ আঙ্কেল, দুইটা পরটা
আর দুই কাপ চা দ্যান।
পল্টুর আঙ্কেল ডাকে
ওয়েটার কিছুটা খুশি হয়ে ওদের জন্য চা পরোটা আনতে যায়। পল্টু পুপুর কানের
কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ব্যবসার কথা কাউরে কইবা না। তাইলে ওরা আমাগো
কুত্তাটা ছিনাইয়া নিব। জান না, দ্যাশে এখন খালি ছিনতাইকারী।
না পুপু এসব কিছুই জানে না। আজ সকাল থেকে এক নতুন পৃথিবী তার
সামনে একের পর এক বিস্ময়ের দরজা খুলে দিচ্ছে। ছোট্ট পুপু যেন একদিনে অনেকগুলো
বইয়ের পাতা উল্টে দেখতে দেখতে অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে।
চা পরোটা খেয়ে ওরা দোকান থেকে বেরিয়ে আসে। পুপুর মনে হয় এমন
মজার পরোটা আর এত মিষ্টি চা সে জীবনে খায় নি। তাছাড়া বাসায় তো সে চা খায় না
কোনদিন।
হাঁটতে হাঁটতে বাজারে ঢোকার আগে পল্টু
কী মনে করে কুকুরটার জন্য একটা পাউরুটি কিনে। তারপর ছিঁড়ে ছিঁড়ে কুকুরটাকে খাওয়ায়।
বাচ্চা কুকুরটা লাফিয়ে লাফিয়ে পল্টুর হাত থেকে পাউরুটি মুখে পুরে। পুপু অবাক হয়ে
দেখে পল্টু কত কিছু জানে, কত কিছু পারে।
এবার দু’জনে এসে একটা ফাঁকা জায়গায়
বসে। পল্টু দু’একবার
চিৎকার করে¾
কুত্তা কিনবেন, কুত্তা, আসল বিদেশী কুত্তা।
বাজার
করতে আসা লোকজন ওদের দিকে একটু অবাক হয়ে দেখে তারপর চলে যায়। পুপু দেখে সাঁ করে
গাড়ি ঢুকছে, বেরিয়ে যাচ্ছে। বস্তা আর ঝুড়িতে করে কত জিনিস আনা হচ্ছে। দোকানীরা কেউ
দোকানে কেউ আবার মাটিতে পলিথিন বিছিয়ে তরকারি বিক্রি করছে। হাঁকাহাঁকি, দরাদরি।
বাজার তাহলে এমন! পুপু মায়ের সাথে শপিং-এ গেছে কিন্তু সেখানে তো সবকিছু প্যাকেট
করা। এরকম খোলাবাজার দেখে পুপু কুকুরের কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় সে যে ব্যবসা করতে
এসেছে। ইতোমধ্যে কুকুর কেনা, চা-নাস্তা খাওয়ায় তার তিনশো টাকার পঁচাত্তর টাকা বের
হয়ে গেছে।
¾
এই পুপু, বইসা থাকলে চলব? চিৎকার কইরা লোক না ডাকলে
কেমনে বেচবা?
¾
বলো কী করবো। একটু থতমত খেয়ে পল্টুর কাছে জানতে চায় সে।
¾
আসো চিক্কুর পাড়ি ¾ কুত্তা নিবেন, কুত্তা। বিদেশী কুত্তা। পাঁচ হাজার
টাকা। পাঁচ হাজার টাকা।
পল্টুর সাথে প্রাণপণে গলা মেলায় পুপু। রোদ বাড়তে থাকে। দু’জনের গাল বেয়ে ঘাম ঝরতে থাকে। পুপুর গেঞ্জিটা ঘামে
ভিজে যেতে থাকে।
সকালে নাস্তা খেতে গিয়ে টেবিলে খোঁজ পড়ল। পুপু কোথায়? পুপুর
মা ঘুম থেকে উঠে না দেখতে পেয়ে মনে করেছিল হয়তো ভাই-বোনদের সাথে খেলছে অথবা পড়তে
বসেছে। এমনিতে পুপু অত দুষ্টুমী করে না। মা যা বলে তা-ই শোনে। কিন্তু আজ সকাল থেকে
পুপুকে কেউ দেখেনি।
খাবার ঘরের বিশাল টেবিল ঘিরে সবাই এসে বসে পড়েছে। মাঝখানের
চেয়ারে দাদী। পুপুদের দাদীর হুকুম, ছুটির দিনে সকালে সবাইকে একসঙ্গে নাস্তা খেতে
হবে। টেবিলে বসে রুপুই প্রথম প্রশ্ন করে¾পুপু কোথায় কাকীমা?
¾ কী জানি পড়ার ঘরে
নাকি।
¾ না তো। পড়ার ঘরে তো
সকাল থেকে আমি ছিলাম।
¾ তা হলে টিভি রুমে।
না, পুপু কোথাও নেই। খাওয়া রেখেই সবাই
ছুটল পুপুকে খুঁজতে। দাদী না খেয়েই বিছানায় শুতে গেলেন। বুক ধড়ফড়ানির জন্য তিনি
বসতে পারছেন না। দোতলা বাড়ির প্রতিটি ঘর,
বাথরুম তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। রুপু বাগানে ঝোপঝাড়ের আড়ালে খুঁজতে লাগল। বাবা
কাকারা তাদের বিশাল ড্রইং রুমে বসে আলাপ করছেন কী করা কর্তব্য। আশ্চর্য, ছোট্ট
একটা ছেলে বাড়ি থেকে কোথায় যেতে পারে। এই বিশাল ঢাকা শহরের কিছুইতো চেনে না সে। তবে
কি ছেলেধরা নিয়ে গেল। কিংবা টাকার জন্য কেউ তাকে জিম্মি করল?
পুপুর মা আর সহ্য করতে পারছে না। হাউমাউ করে কাঁদছে।
পুপুর বাবাকে বার বার বলছে¾ আমার পুপুকে এনে দাও। কোথায় পুপু। ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো
না। বলতে বলতে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে।
বড়চাচী
মেজচাচী ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেন। কিন্তু পুপুর মা পাগলের মত করছে।
একবার পুপুর বড়চাচার কাছে যাচ্ছে¾ বড়ভাই আমার পুপুকে এনে দেন। বড়ভাই¾ বলতে বলতে তার পায়ের কাছে
লুটিয়ে পড়েন। বড়চাচা ধৈর্য ধরতে
বলেন¾
আরে কোথায় যাবে। এই তো থানায় ফোন
করছি। তুমি একটু শান্ত হও। বলতে বলতে তিনি উঠে যান ফোন করতে। পুপুর বাবা হতবিহ্বল।
বুঝতে পারছেন না কী করবেন। তার ইচ্ছে করছে পুপুর মায়ের মত লুটিয়ে কাঁদতে, চিৎকার
করে ডাকতে¾
পুপু ফিরে আয়।
আত্মীয়-স্বজন এমনকি পুপুর বন্ধুদের
বাসায়ও ফোনে যোগাযোগ করা হলো। কোথাও কোথাও বাবা-কাকারা নিজেরা গেলেন। থানায় ডায়রি
করা হল। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হল পুপুর কোন খোঁজ নেই। কেউ দ্যাখেনি কখন পুপু
নামের ছোট্ট ছেলেটি সবার চোখের আড়ালে হারিয়ে গেল।
বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, পুপুর ক্লাসের
বন্ধুদের বাবা-মায়েদের কেউ কেউ এলেন খবর নিতে। সেই যে সকালে সবাই নাস্তা খেতে
মাত্র বসেছিল তারপর পুপুকে খুঁজতে গিয়ে সারাদিনে কারো পেটে একদানা খাবারও পড়েনি।
পুপুর মা পাগলের মত যাকে পাচ্ছেন তাকেই বলছেন¾
পুপুকে এনে দাও। আমার পুপুকে এনে দাও। রুপু দাদীর সাথে জায়নামাজে বসে দোয়া ইউনুস
পড়ছে¾ হে আল্লাহ, আমার ভাইটিকে ফিরিয়ে দাও। পুপুকে
হারিয়ে আজ রুপু বুঝতে পারছে শান্তশিষ্ট এ ভাইটিকে সে কতটা ভালবাসে। যত বেলা বাড়ছে
ততই সবাই হতাশ হয়ে পড়ছে। সবার ভেতরে একতাই প্রশ্ন¾
পুপু কি তবে হারিয়ে গেল?
দুপুরের গনগনে সূর্যটা মাথায় যেন আগুন
ঝরাচ্ছে। পুপুর বড্ডো পিপাসা পেয়েছে। অনেকক্ষণ পল্টুর কথামতো চিৎকার
করেছে¾ কুকুর কিনবেন, বিদেশী
কুকুর। সকালের পাঁচহাজার টাকা থেকে এখন দাম পাঁচশ টাকায় এসেছে। তবু কেউ আগ্রহ
দেখাল না। একজন তো বকাই দিল¾ মাইনসে
পায় না খাইতে আর তোরা কুত্তা বেচস? মগের মুল্লুক পাইছস? যা হালার পুত হালায়।
এরকম খারাপ কথা পুপুকে কেউ কখনো বলেনি।
খুব মন খারাপ হয়েছিল। পল্টু বুঝিয়েছে ¾
ব্যবসা করতে আইলে কতজনে কত কী কইব। ঐসব শুইনলে কি চলে?
ব্যবসা এরকম? পুপু বুঝতে পারে না। বাবা
আর চাচ্চুরাও তো ব্যবসা করে। ইস্ কুকুরটা বিক্রি করতে পারলে মায়ের হাতে টাকাটা
দিয়ে বলতে পারত¾ মা, এবার তুমি একটা হীরের
গয়না কেন। তুমি দেখতে কত সুন্দর। হীরের গয়নায় নিশ্চয় আরো অনেক সুন্দর দেখাবে
তোমাকে।
পল্টু
এর মধ্যে বার দুয়েক বিরিয়ানি খেতে হোটেলে যেতে বলেছে। এখানে হোটেলে নাকি খুব
সস্তায় বিরিয়ানি বিক্রি করে। কিন্তু পুপুর কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। এখন মনে
হচ্ছে বাড়ি ফিরে গেলেই ভাল। ইচ্ছে করছে পল্টুকে ফেলেই বাড়ি চলে যেতে। কিন্তু বাড়ি
গেলে মা কি আস্ত রাখবে?
বাজারের সামনে দিয়ে গাড়িটা যেতে যেতেই লালবাতি জ্বলল। গাড়ি
থামিয়ে হাসান সাহেব চারপাশে তাকালেন। সামনে পেছনে গাড়ি আর গাড়ি যেন পিঁপড়ের সারি।
তার মনটা ভাল নেই। তার বন্ধু রফিকের ছেলেটা নাকি আজ সকাল থেকে নিখোঁজ। অফিসের কাজে
সাভার থেকে ফিরে বাসায় গিয়ে ঘটনাটা শুনেই ওখানে যাচ্ছেন তিনি। স্টিয়ারিং-এ হাত
রেখেই ভাবতে থাকেন। আজকাল অপরাধ এত বেড়েছে যে কার জন্য কখন কোথায় ফাঁদ পাতা আছে
কেউ জানে না। শিশুদেরও রেহাই নেই।
হঠাৎ বাজারে ঢোকার পথে চোখ পড়তে দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল
তাঁর। এ কাকে দেখছেন, সত্যি দেখছেন কি? দুটো ছেলে পাশাপাশি বসে আছে। সামনে একটা
কুকুর। ওদের একজন কি রফিকের ছেলে পুপু না! হ্যাঁ পুপুই তো। মুখের ডানপাশে নাকের
কাছে কালো জড়ুলটা। হাসান ভেবে পান না কী করবেন। আহ্ সিগন্যাল পড়ছে না কেন? সবুজ
বাতি কখন জ্বলবে!
গাড়িটা একটু দূরে পার্ক করে রেখে হাসান সাহেব এসে দাঁড়ালেন
পুপুর সামনে। ডাক দিলেন¾ পুপু। পুপু যেন অথৈ সাগরে কূল পেল¾ আঙ্কেল।
সন্ধ্যের পর সারা বাড়িতে স্বস্তি ফিরে এল। বড়চাচা থানায়
গেলেন। মেজচাচা ফোনে আত্মীয়-স্বজনকে খবর দিতে বসলেন। দাদী এখনো জায়নামাজে। পুপুকে
জড়িয়ে ধরে মা বসে আছেন আর বার বার জিজ্ঞেস করছেন¾ লক্ষ্মী সোনা পুপু
বল, কেন একাজ করতে গিয়েছিলি।
পুপু বাড়ি ফিরে এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। এবার মায়ের কানের
কাছে মুখ নিয়ে বললো¾ সত্যি কথা বললে রাগ
করবে না তো মা।
¾ না, একটুও রাগ করবো
না। আর কোনদিন রাগ করব না।
¾ পল্টু বলেছিল ¾
¾ কী বলেছিল? চুপ করে
আছিস কেন ব-ল।
¾ বলেছিল কুকুরটা
বিক্রি করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে।
¾ তো এত টাকা দিয়ে কী
করবি? তোর বাবার তো টাকা কম নেই।
¾ তোমার জন্য একটা
হীরের নেকলেস কিনতে চেয়েছিলাম। একটা হীরের নেকলেসের কত দাম মা?
মায়ের দু’চোখে
জলের জোয়ার নামে। পুপুকে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কেঁদে ওঠেন¾ পুপু আমি আর হীরার
নেকলেস চাই না। তুই আমার সাতরাজার ধন হীরামানিক। পুপুরে¾
পুপু সেই কবে ছোটবেলায় মায়ের বুকের উষ্ণতা পেয়েছিল। আজ আবার
সেই ওমে তার সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটা মায়ের বুকে ঘুমে নুয়ে এল।
No comments:
Post a Comment