Friday, 28 February 2025

রিফাৎ আরার 'চট্টগ্রাম শাহীনের স্মৃতিময় দিনগুলি' - পর্ব ৫

 

কলেজ পর্ব

 

তখন এস এস সি পরীক্ষা হতো মার্চ-এপ্রিলের দিকে এবং পরীক্ষার রেজাল্ট দিতে কমপক্ষে তিনমাসের মত সময় লাগত। তারপর কলেজের ভর্তি, ক্লাস শুরু হতে অনেক সময় অক্টোবর পেরিয়ে নভেম্বর এসে যেত। কিন্তু শিক্ষাবর্ষ ছিল জুলাই থেকে জুলাই। এর ফলে এইচএসসির দুবছরের অনেকটা সময় ক্লাস শুরুর আগেই কেটে যেত এবং বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থীরা বিশাল সিলেবাস এবং সময় স্বল্পতা নিয়ে হিমশিম খেত। মূলত তারা ক্লাস করত এক বছর।

          কলেজে প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হল শহরের এবং দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। মানবিক শাখায় এক সেকশান এবং বিজ্ঞান শাখায় দুই সেকশান। প্রথমদিন এ্যাসেম্বলি ডেকে তাদেরকে নিয়ম কানুন বোঝানো হল। নিয়ম শৃঙ্খলা, উপস্থিতি, পরীক্ষা, কলেজের পোশাক ইত্যাদি সম্পর্কে লিখিত নির্দেশনা দেয়া হল যেটা অভিভাবকের স্বাক্ষর নিয়ে শ্রেণিশিক্ষকের কাছে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হল।

          আমার ধারণা ছেলেমেয়েরা যখন কলেজে ভর্তি হত তার আগে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে তিনমাস কাটাত। এই তিন মাসে তারা মনের দিক থেকে অনেক বড় হয়ে যেত। আমাদেরও হয়েছিল। কলেজে পড়ি, বড় হয়ে গেছি- এমন একটা ভাব। এসব শিক্ষার্থীদের মাঝেও এই পরিবর্তন আসাটা ছিল স্বাভাবিক। এমনকি যারা শাহীন কলেজ থেকে এস এস সি পাশ করত তাদের দু-একজনও নতুন শিং ওঠা ষাঁড়ের মত উল্টোপাল্টা চলতে চাইত আর নতুনদেরতো কথাই নেই। দু-একজন একটু ভয় টয় পেলেও বেশিরভাগ শহরের দূর-দূরান্ত থেকে আসত এবং আসা-যাওয়ার পথে বন্ধু-সংসর্গে দুষ্টুমি শেখার ষোলকলা পূর্ণ হত। বিশেষ করে কলেজের নির্দিষ্ট হেয়ার কাট (ছোট করে চুল ছাঁটা) তাদের বেশির ভাগেরই পছন্দ হত না। তখন বিনোদনের মাধ্যম সিনেমার নায়কদের বড় বড় চুল, এসব নায়কের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে তারা কিভাবে চুল ছোট করে! আর অধ্যক্ষের কড়া নির্দেশ চুল ছোট করতে হবে। গঞ্জনা শোনার ভয়ে আমরা শিক্ষকরা ততোধিক কড়াভাবে চোখ রাঙিয়ে শাসন করতাম এবং যারা এরপরও শুনত না - একদিন কাঁচি নিয়ে পিয়ন সাথে আকস্মিক চুলকাটায় নামতেন স্যাররা। তারা তো সুন্দর নর হলেও নরসুন্দর ছিলেন না! তাই মাথার যে কোন জায়গায় একগোছা চুল ধরে ঘ্যাঁচ করে কেটে দিতেন। এই কাটার এমনই কুফল ছিল নাপিতের কাছে গেলেও আর চুল সেট হত না। সুতরাং হয় ন্যাড়া নয় কদম ছাঁট!

          পিটি সু পরা নিয়ম থাকলেও অনেকে কেডস পরে আসত। আমাদের কাজ ছিল ক্লাসে ঢুকেই ক্লাস পর্যবেক্ষণ করে যাদের পায়ে কেডস থাকত তাদের পা থেকে সেটা খুলিয়ে নিয়ে পিয়নকে দিয়ে স্টোরে পাঠিয়ে দেয়া। মনে মনে মায়া লাগলেও নিয়ম রক্ষার্থে বাইরে কাঠিন্যের মুখোশ পরে থাকতে হত। কারণ এরা জুতোর জন্য পিছনে পিছনে ঘুরঘুর করে প্যান প্যান করত- আর করব না ম্যাডাম, এবার মাফ করে দিন।

          অনেক বলে কয়ে মাফ করে জুতো ফেরত দিলে কদিন পর আবার সেই একই পুনরাবৃত্তি। এখনো মনে হয় অধ্যক্ষের স্টোরে সেই আশি-নব্বই দশকের কেডস খুঁজলে দু-চার জোড়া পাওয়া যাবে!

          আসলে তারুণ্যের এই বয়সটা উচ্ছলতা আর দুরন্তপনার। তারপর বাইরের ঢিলেঢালা নিয়ম শৃঙ্খলার স্কুল থেকে এসে এগুলোতে অভ্যস্ত হতে হত তাদের পরীক্ষার সময় এসে যেত। আবার এসব শিক্ষার্থীরাই পাশ করে গিয়ে নিজের ভাই-বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নীকে ভর্তি করানোর জন্য নিয়ে আসত।

          প্রশ্ন করতাম- তোমার না এখানকার নিয়ম-কানুন ভাল লাগত না তাহলে আবার ওদের দিতে চাচ্ছ কেন?

          তখন তাদের অকপট স্বীকারোক্তি, ম্যাডাম, এখন বুঝি এটার কতটা দরকার ছিল। না হলে আজ হয়তো এতটুকু আসতে পারতাম না। তখন শুনে ভাল লাগত।

          বাইরে থেকে আসা শিক্ষার্থী বিশেষত ছেলেদের নিয়ে আরেকটা সমস্যা ছিল ঘাঁটির অভ্যন্তরে রাস্তাঘাটে এলোমেলো চলা। প্রায়ই ওপর থেকে অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ আসত ছাত্র-ছাত্রীরা অফিসারদের গাড়ি দেখেও রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ায় না এবং তাদের সালাম দেয় না। অধ্যক্ষ এ নিয়ে মিটিং করে আমাদের বার বার সতর্ক করতেন, আমরা যেন শিক্ষার্থীদের এগুলো শেখাই। কিন্তু আমরা শেখালে কি হবে ওরা তো গুরুত্ব বোঝে না।

          পুরনো লাল দালানে তখন জানালায় কোন শিক বা গ্রীল ছিল না। সুতরাং ওরা থ্রিল অনুভব করল, ক্লাস করবে না। তো দরজা দিয়ে শিক্ষককে ঢুকতে দেখে দুষ্টুর দল জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে যেত। ওদের বাঁধার জন্য পরে জানলায় গ্রীল লাগানো হল।

          ১৯৮৫ থেকে ৯০ এসময়কালে অধ্যক্ষ ছিলেন গোলাম মহীউদ্দীন আহমেদ উনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন ঢাকায় আদমজী ক্যান্ট পাবলিকে শিক্ষকতা করেছেন। যার ফলে হুজুরের মতে অমত কার, হুজুর যা বলেন অতি চমৎকার নজরুলের কবিতার এই বাক্যের মত তিনি যে কোন অফিসারের প্রতি দন্ডবৎ ছিলেন। অন্যদিকে শিক্ষকদের এত বেশি চাপে রাখতেন যে অল্পবয়সী শিক্ষকরা বিশেষত পুরুষ শিক্ষকরা অনেকেই চাকরিতে যোগ দিয়ে পালাবার পথ খুঁজত। শাহীনের অভিজ্ঞতায় তারা ভাল চাকরিও পেত। তাই প্রথম দিকে শিক্ষকদের চাকরিতে যোগদান আর রেজিগনেশান নিয়ম হয়ে গিয়েছিল।

          আশির দশকের শুরুতে (সম্ভবত) শাহীন কলেজ (চট্টগ্রাম) একজন ভাল অধ্যক্ষ পেয়েছিলেন। তিনি ইয়াকুব আলী স্যার। তিনি শিক্ষকদের উৎসাহিত করতেন। দিকনির্দেশনা দিতেন। কিন্তু যতটা শুনেছি উদার মনের এ মানুষটিও বিশ্বাসের মূল্য দিতে গিয়ে হিসাব নিকাশের গ্যাঁড়াকলে পড়ে চাকুরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। এটা আমার কলিগদের মুখে মুখে শোনা কথা। তবে স্যারের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ ছিল অটল। শিক্ষকদের কাছে তিনি অভিভাবকের মত ছিলেন।

          গোলাম মহীউদ্দীন স্যার প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বিমান বাহিনীর শিক্ষা উইংয়ের কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট নিয়মের ধারা উপধারা প্রয়োগ করতেই থাকতেন। অনেকটা রাজা যত বলে পরিষদ দল বলে শতগুণ। সর্বত্রই চাকরির নিয়মে নৈমিত্তিক ছুটি বিশদিন। আমাদের ছিল ১৫ দিন। ম্যাডামদের মেটারনিটি লিভ ছিল মাত্র ৩০ দিন। আজ মনে হলে অবাক লাগে এসব নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে অনেক যুক্তিতর্কের লড়াইয়ের পর ২ মাস করেছিল। আর এখন সরকার প্রসূতি ছুটি ছয় মাস করেছে যা একান্ত যুক্তিযুক্ত।

          মহীউদ্দীন স্যার একবার নিয়ম করলেন নৈমিত্তিক ছুটি নিতে হলে কলেজে এসে ছুটি অনুমোদন করে তারপর ছুটি কাটাতে হবে। কিন্তু এটাতো আকস্মিক ছুটি! আমার হঠাৎ জ্বর উঠল বা ডায়ারিয়া হল, অথবা বাচ্চা খুব অসুস্থ তখন আমি কলেজে এসে ছুটি অনুমোদন করলে আর ছুটি নিয়ে লাভ কি? এটা ছুটি নয় শাস্তি। অনেককেই তিনি এভাবে হেনস্থা করেছিলেন। এমনকি শোকজও করেছিলেন। অবশ্য পরবর্তীদের অনেকও এরকম করতেন। সেটা সময়মত বলব। তবে তাঁর সময়ে কলেজে যে শৃঙ্খলা ও পারিপাট্য ছিল, পড়ায় এবং পড়ানোতো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতা ছিল প্রশ্নাতীত।  

          অফিসার্স কোয়ার্টারের সীমানার ভিতর টিনের ছাদ দেওয়া পাকা দালান ছিল। রুপসা কোয়ার্টার নামের সেই কোয়ার্টারগুলোতে সাধারণত জুনিয়র অফিসারদের ফ্যামিলির জন্য বরাদ্দ দেয়া হত। আমাদের অধ্যক্ষ মহীউদ্দীন স্যারকে সেখান থেকে দুটো কোয়ার্টার বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে। তখন তাঁর একমাত্র ছেলে স্কুলে পড়ত, মেয়ে কলেজে এবং সবার বড়জন সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। স্যার অফিসারদের সাথে বাসে আসা-যাওয়া করতেন। আর আমরা বাচ্চাদের জন্য বরাদ্দ গাড়িতে যাতায়াত করতাম। সিনিয়র অফিসারদের সন্তানরা নিজস্ব গাড়িতে আসত।

          অফিসার্স কোয়ার্টার এবং বারকোয়ার্টার থেকে একটু হাঁটলেই চট্টগ্রাম বিমানবন্দর। এটা তখন একেবারেই ডোমেস্টিক ফ্লাইটের জন্য ছিল আর মধ্যপ্রাচ্য থেকে সপ্তাহে দু-একটি ফ্লাইট আসা যাওয়া করত। চট্টগ্রামে দুবাইওয়ালা আর সিলেটে লন্ডনী ছিল বিখ্যাত। দুবাই বা মধ্যপ্রাচ্যের কোন ফ্লাইট থাকলে বোঝা যেত জনসমাগম দেখে। প্রবাসফেরত আপনজনটিকে অভ্যর্থনা জানাতে আত্মীয়স্বজনরা কয়েকটি বাস ভাড়া করে ফুলের মালাটালা নিয়ে এয়ারপোর্টে হাজির হত। সেদিন এয়ারপোর্ট থাকত জমজমাট।

          আবার ঈদে মিলাদুন্নবীতে পাকিস্তান থেকে আসত তাহের শাহ নামের জনৈক বুজুর্গ। কথায় আছে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না আর কোথাকার কোন তাহের শাহ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এসে অভিজাত এবং ধনীদের গৃহে আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন, তারপর যাবার বেলায় প্রচুর টাকা পয়সা সওগাত হিসেবে বোঁচকা বেঁধে নিয়ে যেতেন।

          যেদিন তাহের শাহ আসত সেদিন এয়ারপোর্টে তিল ধারণের ঠাঁই থাকত না। ধনী গরীব নির্বিশেষে হাজির হত তাকে একনজর দেখতে। একটি খোলা ট্রাক সাজানো থাকত আর গদিনশিন হয়ে তিনি সেই ট্রাকে আগে পিছে বিশাল বহর নিয়ে শহরের দিকে রওনা দিতেন। অবাক হয়ে ভাবতাম এত লোক কোত্থেকে আসে, কেন আসে? এদের কি কাজকর্ম নেই?

          পরে বুঝেছিলাম- কর্মসংস্থানের অভাবে বেশিরভাগ মানুষ ছিল বেকার। তাই তামাশা দেখার লোকের অভাব ছিল না। বাঙালীর তামাশাপ্রিয়তার অনেক গল্প আছে। তার মধ্যে একটি ছিল এরকম- কলকাতার রাস্তায় কোন লোক যদি কিছুক্ষণ আকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যে দাদা, কী দেখছেন? প্রশ্ন করতে করতে হাজার লোক জড়ো হয়ে যেত।

          ফ্লাইটের গমনাগমনের সময় ছাড়া এয়ারপোর্ট প্রায় শুনশান পড়ে থাকত। দু একজন স্থানীয় রিক্সাওয়ালা ছাড়া শহরে যাতায়াতের জন্য ট্যাক্সি পাওয়াও দুর্লভ ছিল। বিমানবন্দরের একপাশে কয়েকটি দোকান ছিল- এর মাঝে দুটি মুদি দোকান, দুটি চা-নাস্তার দোকান এবং কয়েকটি দোকান শাড়ি-কসমেটিক্স ইত্যাদির। কাঁচাবাজারের জন্য ছিল ঘাঁটির বাইরে পদ্মা অয়েলের পিছনে কইল্যার হাট যার প্রকৃত নাম ছিল কমল মহাজনের হাট কিন্তু চট্টগ্রামের ভাষায় অপভ্রংশ হয়ে এটির আসল নাম মনে হয় বিলীন হয়ে গেছে। সবচেয়ে সমস্যা ছিল এই কাঁচাবাজার নিয়ে। ঘাঁটিতে চতুর্থশ্রেণির কর্মচারীরা অনেকে গরু পালত এবং দুধ বিক্রি করত কিছু বাড়তি আয়ের জন্য। এসব দুধ ছিল একেবারে খাঁটি। অফিসাররা অবশ্য ঘাঁটির গরুর খামার থেকে খুব সস্তায় দুধ রেশন পেতেন।

          একদিন হঠাৎ দেখলাম আমাদের অধ্যক্ষ কলেজে আসছেন পায়ে হেঁটে। কি ব্যাপার! পরে জানা গেল বিমান বাহিনীর অফিসারদের গাড়িতে সিভিলিয়ন অধ্যক্ষের না চড়ার অলিখিত নিয়ম জারি হয়েছে। খুব খারাপ লাগত যখন দেখতাম একজন প্রবীণ অধ্যক্ষ হেঁটে আসছেন আর নবীন অফিসাররা তার পাশ দিয়ে সাঁই করে বাসে চলে যেতেন।

          কিছুদিন পর আমাদের বেলায়ও তাই হল। নির্দেশ এল, বাচ্চাদের গাড়িতে শিক্ষকরা চড়তে পারবেন না। কি যে মুশকিলে পড়ে গেলাম। সকালে তিনজন ম্যাডাম মিলে একসাথে যাতায়াত করতাম কিন্তু দুপুরে আমি একা। একটা রিক্সাও পাওয়া  যায় না। কখনো সখনো পাওয়া গেলে প্রভোস্ট ভিতরে ঢুকার অনুমতি দিত না। তখন গাছপালাও এত ছিল না। বিশাল রানওয়ে পার হয়ে, এমআই রুম, সার্জেন্ট মেস ইত্যাদি পেরিয়ে কমপক্ষে মাইলখানেক হাঁটা লাগত (আনুমানিক)। এসময় খুব কান্না পেত- কেন এখানে এলাম মরতে!

          তারপর একদিন কলেজের সচিব উইংকমান্ডার শিহাব উদ্দীন ভূঞা স্যারকে কলেজে পেয়ে আবেদন করলাম- স্যার আমারতো এই দুর্দশা। উনি সঙ্গে সঙ্গে পারমিশান দিলেন, আমার জান বাঁচল।

          পরে একজন ঘাঁটি অধিনায়ক গ্রুপক্যাপ্টেন আনিস বা আমিন (দুঃখিত নামটি মনে আসছে না, তবে আনিসই হবেন) শিক্ষকদের আবেদনে সাড়া দিয়ে অনুমতি দিলেন শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের বাসেই আসবেন।

          এদিকে দুই শিফট চালাতে প্রশাসনিক সমস্যা হচ্ছিল। তাই কলেজ কর্তৃপক্ষ কলেজের উল্টো দিকে বিমানবাহিনীর হ্যাংগারের পাশের দুটি ভবন কলেজের জন্য ছেড়ে দিল। এখানে বিমান সেনাদের ক্লাস হত। একটির একতলা দোতলা দুটোই, অন্যটির শুধু দোতলা।

          এখানেও হ্যাপা কম ছিল না। বাচ্চাদের সামলানো এক কষ্টকর ব্যাপার। দেখা গেল এই পুরনো ভবনে ক্লাস নিয়ে হ্যাঙারে যেতে যেতে শিক্ষকদের বেশ কিছু সময় লেগে যাচ্ছে। ততক্ষণে ওখানে হয় মহোৎসব, নয় ধুন্দুমার নতুবা দু-একটা এ্যাকসিডেন্ট।

          তখন বিটিভিতে টিপু সুলতান সিরিয়াল দেখাত। নিচের ক্লাসের শিশুরা সুযোগ পেলেই স্কেল দিয়ে তলোয়ারবাজি করত। বিশেষ করে ছেলেরা। এর ফলে কখন পরাজিত সৈনিকের মত আহত হত তার কোন ঠিক ছিল না। একবারতো একটা ছোট্ট মেয়ে বেঞ্চের নিচে পড়ে হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল মাথায় আঘাত পেয়ে নুসরাত জাহান নামে সেই মেয়ের কপালে কাটা দাগ এখনো আছে

          এবার দেখা দিল আরেক ফ্যাসাদ কলেজের ছাত্রদের নিয়ে ছাত্ররা দিন দিন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠছিল শিক্ষকদের আসা-যাওয়ার ফাঁকে তারা সিগারেট খাওয়া থেকে নানা অকর্ম করে বসত এতে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রায়ই অভিযোগ আসত আমরাও শাসন করতাম শিক্ষকের সামনে শান্তশিষ্ট হয়ে থাকলেও তাঁদের অনুপস্থিতিতে তাদের অনেকে নতুন শিং গজানো ষাঁড়ের মত গুঁতোগুঁতি করত মেয়েরা ছিল শান্তশিষ্ট 

          একদিনতো এক ছেলে ঘুষি মেরে বাথরুমে আয়না ভেঙে বসল আর যায় কোথায় ঘাঁটির ভিতরে কিছু ঘটলেই বোর্ড বসত, তদন্ত কমিটি করা হত শেষে কলেজ শাখাকে আবার ফিরিয়ে আনা হলো পুরনো ভবনে

          তখন ইউনিফরম পরার ব্যাপারে অনেক ছাত্রেরই প্রবল আপত্তি এখন যেমন সব স্কুল-কলেজের নিদির্ষ্ট ড্রেস আছে তখন এতটা ছিল না চট্টগ্রামে কলেজিয়েট, মুসলিম হাইস্কুল আর চট্টগ্রাম কলেজেরই নির্দিষ্ট ড্রেস ছিল মেয়েদের স্কুল কলেজে অবশ্য সবসময় ছিল এছাড়া শহরের বেশিরভাগ স্কুলে ইউনিফরমের ব্যাপারে ঢিলেঢালা ভাবই ছিল তাই দুষ্টু ছেলের দল ব্যাগের ভিতর একটা করে শার্ট বা টিশার্ট নিয়ে আসত, ক্লাস শেষ হওয়ার পর কলেজ থেকে বেরিয়েই জামা বদলে ফেলত

          যেহেতু ছাত্রদের পোশাক ঠিক না থাকলে ক্লাসটিচারকেও জবাবদিহি করতে হত সে কারণে আমরাও ছিলাম কড়া একদিন জিনসপ্যান্ট পরে আসাতে একছাত্রকে ক্লাস থেকে বের করে দিলাম কিছুক্ষণ পর দেখি সে দরজায় দাঁড়িয়ে ইউনিফরম পরা অবস্থায় বলছে, মে আই কাম ইন ম্যাডাম আমার সকল গাম্ভীর্য টুটে হাসতে হাসতে দম আটকাবার জোগাড় পুরো ক্লাস হাসছে

          হাসির ছররা কমে আসার পর জানতে চাইলাম, তুমি এত তাড়াতাড়ি প্যান্ট কোথায় পেলে?

     তার উত্তর, জানিতো ম্যাডাম আপনি ধরবেন তাই ভিতরে পরে এসেছিলাম এবার দ্বিতীয়বার হাসির পালা

          ছাত্রদের বেপরোয়া ভাব বেড়ে যাওয়াতে কর্তৃপক্ষ আবার তাদের পুরাতন ভবনে নিয়ে আসার পর KG-3 পর্যন্ত ক্লাস নিয়ে গেলেন ষোল কোয়ার্টারের দিকে বিমানবাহিনীর আরেকটি ভবনে শিক্ষক এবং ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা সকালে ঐ ভবনে চলে যেত ক্লাস শেষ হলে শিক্ষার্থীদের বিদায় করে শিক্ষকরা আবার মূল ভবনে আসতেন সিনিয়র শিক্ষক হোসনে আরা ম্যাডাম এই ক্লাসের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন বৃষ্টি বাদলার দিনে বিশেষ করে বর্ষাকালে এসব ভবনে যাতায়াত শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়ত দেখা যাচ্ছে ঝুম বৃষ্টি অথবা মুহুর্মুহু বাজ পড়ছে আর আমরা কাকভেজা হয়ে ক্লাস নিতে যাচ্ছি এবং আসছি

          তখন বিমান বাহিনীর হ্যাংগার ভবনে (সম্ভবত) বড় করে উৎকীর্ণ ছিল আমেরিকার নিহত প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডীর একটি বাণী- Don’t ask what your country do for you, but ask what you can do for you country. বাণীটি খুব ভাল লাগত

          আমাদের কলেজের বিভিন্ন জায়গায় গোলাম মহিউদ্দীন স্যার কিছু বাণী চিরন্তণী লিখে লাগিয়েছিলেন যেমন- শিক্ষার শেকড় তেতো হলেও এর ফল মিষ্টি আবার- জ্ঞানের সন্ধানে এসো, সেবার জন্য যাও এরকম আরো অনেক উদ্ধৃতি

 

অধ্যক্ষ গোলাম মহিউদ্দিন এবং অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে

         

আমি ক্লাস নিতে গেলে মুখোশ ধারণ করে যেতাম এবং আমার মনে হয় বেশিরভাগ শিক্ষকই তাই করেন মুখোশটি গুরুগম্ভীর এবং রাগী রাগী ভাবের কারণ দুষ্টু ছেলেদের বশে আনতে এই ভাব না ধরলে কাজ হত না অবশ্য এমনিতেও রাগ হতাম, কারণ এত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে এবং বেশি বেতন (তখন বাইরের অন্যান্য কলেজের তুলনায় শাহীনে টিউশন ফী বেশি ছিল) ভর্তি চার্জও। তারপর আসা-যাওয়া টিফিন ইত্যাদি মিলিয়ে অনেক খরচ পড়ত

          আমাদের নিজেদের সন্তানরাও লেখাপড়া করে। আমরাতো বুঝি ওরা কিশোর। জীবনের জটিলতা ওদের স্পর্শ করেনি, বাবা-মায়ের কষ্ট বোঝার বয়স হয়নি। তাই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য, মানুষ হওয়ার জন্য লেখাপড়াটা যে কত আবশ্যিক সেটা অনেকেই বুঝত না তাই কেউ কেউ ক্লাসে আসত না। আবার এলেও মনোযোগ থাকত না বিশেষত, তাদেরই সহপাঠিনীরা যখন বেণী দুলিয়ে হাসতে হাসতে, গল্প করতে করতে চলে যেত তখন প্রাকৃতিক নিয়মেই অনেকের দৃষ্টি এবং মন সেদিকে ছুটত অনেকে ক্লাসে বসেই পাশের সারিতে বসা সহপাঠিনীর দিকেই মনোযোগ দিত বেশি। বেশি অমনোযোগ লক্ষ করলে আমি মাঝে মাঝে আমাদের এক স্যারের উদ্ধৃতি দিতাম। ক্লাসে ছাত্রদের সহপাঠিনীর দিকে অধিক মনোযোগ লক্ষ করে তিনি বলেছিলেন- শোন ছাত্ররা, তোমরা যাহাদের তরে তাহারা স্কুলে পড়ে, আর উহারা যাহাদের তরে, তাহারা চাকরি করে" এটা শুনে ছেলেমেয়েরা হেসে উঠত

          যতই রাগ দেখাই, ক্লাস উপভোগ্য করার জন্য আমি পাঠ্যবিষয়ের বাইরেও বাচ্চাদের গল্প শোনাতাম কারণ আমার অভিজ্ঞতায় ছোটবেলায় মায়ের মুখে গল্প শুনে শুনে আমার বই পড়ার আগ্রহ জন্মেছিল আমার বিশ্বাস, যে বই পড়ে সে কখনো খুব খারাপ কাজ করে না কারণ যে কোন গল্পেই ভাল-মন্দের একটা দ্বন্দ্ব থাকে এবং পড়তে পড়তেই আমরা ভালর দিকে ঝুঁঝে যাই, তাকে সমর্থন করি এবং আমাদের ভিতরে ন্যায়বোধ জেগে ওঠে

          ছোটদের এ্যাডজাস্টমেন্ট ক্লাসে গেলে তো বটেই বড়দের ক্লাসেও সুযোগ পেলেই ছেলে-মেয়েরা আমার কাছে গল্প শুনতে চাইত। আমিও চাইতাম ওদের ভিতরের আগ্রহকে গল্প দিয়ে জাগিয়ে তুলতে। বড়দের অনেকেই গল্প শোনার পর আমার কাছে জানতে চাইত কোন বই পড়বে বা কার লেখা পড়বে।  আমি ক্ল্যাসিক বই- যেমন শরৎ, বিভূতিভূষণ, সুনীল, শীর্ষেন্দু, জহির রায়হান, শাহরিয়ার কবির এঁদের সবার কথাই বলতাম। আশির দশকে তখন হুমায়ুন আহমেদ মাত্র জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করেছেন- তাঁর কথা বলতাম। বিশেষ করে বলতাম জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলির কথা।

          বঙ্কিম চন্দ্র ভাষাগত পরিবর্তনের কারণে ওরা পড়তে পারত না। আবার দেশভাগের কারণে শরৎচন্দ্রের বইয়ের পুজো আচ্চার যেসব বর্ণনা থাকত সেগুলোও অনেকসময় তারা বুঝতে পারত না। খুব খারাপ লাগত বাঙালী হয়েও আমরা নিজের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টির অনেকটাই হারিয়ে ফেলছি। অবশ্য এখন কোলকাতার সিরিয়াল এবং হিন্দি সিরিয়াল দেখে শিশুরা ধর্মীয় কূপমন্ডুকতা শিখছে অন্যদিকে জাকির নায়েক এবং দিগন্ত টিভির মত কয়েকটি টিভি হিন্দু-মুসলিম উভয়পক্ষের  মধ্যে ধর্মীয় উগ্রতাকে উসকে দিয়েছে এবং দিচ্ছে।

          আমরা যখন স্কুলে পড়েছি সেই সময় পাকিস্তান পিরিয়ডে ধর্ম ছিল ঐচ্ছিক বিষয়। আমার মনে আছে আরবী পড়ার ভয়ে আমি ইসলামিয়াত নিইনি। কারণ আমি আরবীতে কাঁচা ছিলাম, লিখতেতো পারতামই না। তখন মিউজিক ইত্যাদিও মানবিক শাখার বিষয় ছিল। আবার অনেকে আর্টস নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে কলেজে সায়েন্স নিতে পারতকিন্তু শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্যিক এমনকি কৃষিশিক্ষার পৃথক পৃথক শাখায় ভাগ হয়েছিল। পরবর্তীতে লে জে হো মো এরশাদ ক্ষমতায় এসে রাষ্টধর্ম ইসলাম ঘোষণা করলেন এবং তৃতীয় থেকে দশমশ্রেণি পর্যন্ত শাখা নির্বিশেষে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য নিজ নিজ ধর্মের বই আবশ্যিক পাঠ্য বিষয় করলেন। এর ফলে যেটা হল শিশুদের কোমলমনে ধর্মীয়ভীতি এবং ধর্মের প্রতি অতিমাত্রায় মোহ জন্মাতে শুরু করল। এই মোহ এখন উন্মাদ্গ্রস্ততায় পরিণত হয়েছে।

          সেসময় কলেজে পাঠ্য ছিল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু এবং স্কুলে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালীর কিছুটা সংক্ষেপিত উপন্যাসটি। পরবর্তীতে পথের পাঁচালীর পরিবর্তে কাজী এমদাদুল হকের আবদুল্লাহ উপন্যাসটি এসএসসিতে পাঠ্য হল। যা কিশোরদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল না। যদিও এ উপন্যাসেও ধর্মের কূপমন্ডুকতার নেতিবাচক দিকগুলো দেখানো হয়েছিল। কিন্তু কিছু লেখা আছে সর্বকালীন। যাকে আমরা বলি ধ্রুপদী বা ক্ল্যাসিক আর কিছু সাময়িক। আবদুল্লাহ উপন্যাসের সময়কাল থেকে অনেকটা এগিয়ে আসায় কিশোরদের কাছে সেটিও অনেকটা অপিরিচিত পরিবেশই ছিল। শিশু আনন্দ চায়। সে আনন্দ তাকে দেবে সাহিত্য। কিন্তু আনন্দ-বেদনার কাব্য বাদ দিয়ে সমাজ-সমস্যা ও তার স্বরূপ সে কতটুকু অনুধাবন করতে পারে!

          স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল দেয়া হলে জানুয়ারী মাসে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা শেষে মেধাভিত্তিক পুরষ্কার ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পুরষ্কার দেয়া হত জমজমাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে। সাংস্কৃতিক এবং ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হত ছাত্র-ছাত্রীদের চারটি হাউজে ভাগ করে। এই চারটি ভাগের হাউজের নাম ছিল: ১। আনসার ২। বাশার ৩। মাসুদ ৪। হামিদ হাউজ। এ হাউজগুলো নিশ্চয় এমন কারো নামে ছিল যাঁরা হয় মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ নয়তো অন্যকোন বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য স্বীকৃতি পেয়েছেন যে কারণে তারা স্মরণীয়। কিন্তু এঁদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য কখনো কেউ সেভাবে দিতে পারেনি।

          যাই হোক, চারটি হাউজে ভাগ করে প্রতিযোগিতা হত যেমন রোল ১ যদি আনসার, ২ বাশার, ৩ হামিদ, ৪ মাসুদ। এসময় হাউজ প্রতীকের জন্য হাউজ শিক্ষকদের কিছু কাপড় দেয়া হত তারা সেগুলো স্ট্যাম্প সাইজ করে কেটে ছাত্র-ছাত্রীদের দিতেন। ছাত্র-ছাত্রীরা সেগুলো বাসায় নিয়ে ইউনিফরমের বাঁ হাতের উপরে সেলাই করে জুড়ে দিত। এতে বুঝা যেত কে কোন হাউজেরকিন্তু যারা জানত না তারা আবার এটাকে তালি মনে করে অবাক হত।

          একবার রেডক্রসের একটি প্রোগ্রামে আমাদের মেয়েরা অংশগ্রহণ করে। সেখানে জামার এই তালি দেয়া টুকরো দেখে অনেকেই প্রশ্ন করেছিল। সেবার আমাদের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের মেয়ে রিফাত আখতার দিনা (যাকে আদর করে টুনি ডাকা হত) এরকম প্রশ্নের উত্তরে বলে এসেছিল, আমাদের সবার জামা ছেঁড়া তাই এখানে তালি দেয়া। শুনে অন্য মেয়েরা নাকি অবাক হয়েছিল !

          টুনির গানের গলা ছিল অপূর্ব। বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত শিখত সে সম্ভবত চট্টগ্রামের মার্গারেট সাহা বা আইরীন সাহার কাছে। রবীন্দ্রনাথের শারদোৎসব নাটক পড়ানোর সময় নাটকের গানগুলি আমি ওকে দিয়ে গাওয়াতাম আর অন্যদের ভাগ করে দিতাম চরিত্রের সংলাপগুলো। এতে ছেলেমেয়েরা অন্যরকম আনন্দ পেত। তাদের উৎসাহ বেড়ে যেত।

          আমি সংস্কৃতির সকল শাখাতেই সাধারণ শ্রোতা। কিন্তু বাংলার শিক্ষক হওয়ার কারণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। একটাই পারতাম কাকে দিয়ে কোনটা করাতে হবে, আর ডান্ডাবাজি মানে রাগী রাগী চেহারা নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কন্ট্রোল করা। তারপরও ওরা কেন জানি না আমাকে ভালবাসত। হয়তো বাইরের মুখোশটাই সব নয় এটা তারা বুঝে যেত।

          সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হত কমপক্ষে একসপ্তাহ সময় নিয়ে। কারণ জাতীয় পর্যায়ে শিশু একাডেমীর যতগুলো প্রতিযোগিতা ছিল তার প্রায় সবগুলোই আমরা করতাম। এর ফলে বন্দর থানার প্রতিযোগিতার প্রায় সব পুরস্কারই আমরা পেতাম। নেভী কলেজ, বেগমজান স্কুল, স্টিল মিল, কাটগড়, রিফাইনারী আমাদের সাথে পাল্লা দিয়ে পারত না। থানা থেকে জেলা এবং বিভাগীয় হয়ে জাতীয় পর্যায়েও আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রায়ই কিছু পুরস্কার নিয়ে আসত। মাঝে মাঝে কিছু ছেলে-মেয়ে বিশেষত মেয়েরাই এত ভাল নাচ, গান, আবৃত্তি করত যাদের কথা এখনও ভুলতে পারি না। গানে যেমন টুনি ছিল, তেমনি  ফারহানা তসলিমা (বর্তমানে ডাক্তার), মল্লিকা পারিজাত, রূপা (ভাল নাম মনে আসছে না) রাজশাহী বেতারের শিল্পী ছিল (এখন শিক্ষক), আসিফ সৈকত (ডাক্তার) এরকম আরো অনেকে ছিল। আবৃত্তিতে কলেজের সঞ্জয় বণিক, হারুন-উর-রশীদ (সোহেল), শাহাদাত হোসেন সবুজ (এখন VOAতে), ফাহমিন খালেক নীপা, তার বোন বর্ণা ও তানিয়া এরকম অনেকেই সেরা ছিল। এঁদের অনেকের অভিভাবকরা তখনো পতেঙ্গা থেকে শহরে গিয়ে বাচ্চাদের অনেক কষ্ট করে নাচ-গান শেখাতেন।

          নাচে প্রথমেই মনে পড়ে হোসনে আরা ম্যাডামের মেয়ে শারমিনা হাসিন সুমী (বর্তমানে সরকারী কর্মকর্তা), পরবর্তীতে নাজমুস সেহার অন্তরা (কানাডা প্রবাসী), তান্নিয়া খানম তারা, কোহিনূর ও তার বোন (বর্তমানে দুজনেই সেনা অফিসার) এরকম অনেকেই ছিল যাদের নাম এই মুহূর্তে স্মরণে আসছে না বলে দুঃখিত। তবে এদের কারো কারো নাচ, গান, আবৃত্তি, কোরান তেলাওয়াত এখনো মনে পড়লে দৃষ্টিতে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

          যাদের কথা বললাম এরা আশি থেকে নব্বইয়ের দশকের ছাত্র-ছাত্রী। পরবর্তীতে আরো অনেকে এসেছে। যেমন ধ্রুপদী নাচের আসমা-উল হুসনা, সাধারণ নাচে খিং খিং প্রু জুসি, গানে কবিতায় তো অজস্র। উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক, বিষয়ভিত্তিক বক্তৃতা ও লিখিত রচনা প্রতিযোগিতায়ও অনেক ছেলেমেয়ে এত ভাল করত যে অবাক মানতাম। ওদের লেখা থেকে অনেক নতুন তথ্য পেয়ে আমি নিজেও সমৃদ্ধ হয়েছি।

          আমাদের শিক্ষকদের অনেকের ছেলে-মেয়ে লেখা-পড়ার পাশাপাশি এসব বিষয়েও ছিল একেকটি রত্ন। হোসনে আরা ম্যাডাম, আয়েশা ম্যাডাম, তাহসিনা ম্যাডাম এবং বিশেষত নাহার ম্যাডামের দুই ছেলে আসিফ সৈকত ও আশিক ছিল সত্যিকারের রত্ন। সৈকতের তেলাওয়াত, আবৃত্তি, গান এখনো কানে বাজে। এখন ফেসবুকের কল্যাণে দেখি নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজানো, লেখালেখি, বাগান করা ইত্যাদি সবকিছুতে সে সমান পারদর্শী। আবার বাবা হিসেবেও অত্যন্ত সন্তানবৎসল।

          হারুন-উর-সোহেলের কন্ঠে কবি শামসুর রাহমানের আফ্রিকা কবিতা এখনো আমার শ্রুতিতে জীবন্ত। ফাহমিন খালেকের অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল অপূর্ব লাগত। হঠাৎ একজন উঠে এল বুলবুল ইসলাম- একটা সোনার মেডেল দিবানি পূর্ণেন্দু পত্রীর এই কবিতা দিয়ে আমাদের ভীষণভাবে চমকিত করেছিল। তেমনি বাঁধন-বিন্তি নামের দুবোনের আবৃত্তি, নাজমুস সেহার অন্তরার দোল দোল দুলুনি নাচ এবং তার সাথে মিলিয়ে পোশাক এবং সাজসজ্জা কি যে দৃষ্টিনন্দন ছিল!

          টুনি, রূপা, ফারহানা এদের গান শুনলে কেবলই মনে হত শুনতে থাকি। রূপা যখন আরতি মুখোপাধ্যায়ের অথবা চিত্রা সিং এর বাংলা গান গাইত তখন মনে হত মূল গানের শিল্পীদের চেয়েও শ্রুতিমধুর।

          সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা শেষে তৎকালীন RTS অডিটোরিয়াম বেশ জাঁকজমকের সাথে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং পুরস্কার বিতরণ হত। সাধারণত ঘাঁটি অধিনায়ক পুরস্কার দিতেন।

          স্টেজ সাজানো হত খুব সুন্দর করে। ড্রইং টিচাররা এ দায়িত্বে থাকতেন। তাদের সহযোগিতা করতেন অঞ্জন স্যার এবং তাঁর সাথে ছাত্ররা। ৮০র দশকে জুলিয়া এত সুন্দর স্টেজ সাজাত যে, অনুষ্ঠানের অর্ধেক নান্দনিকতা তাতেই সম্পন্ন হত। ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে প্রতিবারই দু একজনকে পাওয়া যেত যারা খুব ভাল পারফর্ম করত। শিশুদের অনুষ্ঠানগুলো হত অত্যন্ত উপভোগ্য। আসলে তখন যাই করত তাতেই দর্শক আনন্দ পেত। কলেজের ছাত্ররা কৌতুকে পারদর্শী ছিল। রিহার্সালে একরকম কিছু দেখা গেল, স্টেজে উঠে মাঝে মাঝে তারা এমন নতুন কিছু যোগ করত যে পুরো অডিটোরিয়াম হাসিতে-হুল্লোড়ে ভেঙে পড়ত।

          অনুষ্ঠান ভাল হলে ঘাঁটিকর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হত। পরবর্তীতে অধ্যক্ষ শিক্ষকদের নিয়ে মিটিং করে ভুলত্রুটি নিয়ে আলোচনা করে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতেন।

 

 

         

 

কথায় আছে দশচক্রে ভগবান ভূতআমি কোন পাকে চক্রে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পেয়ে গেলাম জানি না। কারণ নাচ, গান, কবিতা সবকিছুতেই আমার উঠান বাঁকা ছিল। গলায় সুর নেই যে গুনগুন করে গাইব। অথচ গানের প্রতি প্রচন্ড দুর্বলতা, কবিতা,নাচ এসব উপভোগ করতাম কিন্তু হাত পা সুন্দর করে নাড়াতেও জানতামনা। একটাই পারতাম কথা বলতে। পুরস্কার বিতরণ, খেলারমাঠের ঘোষণা অথবা মিটিং এ কর্তৃপক্ষের সাথে দেন-দরবারে সত্যি কথা বললে, আমার মত কথা শাহীন কলেজের অন্য শিক্ষকরা বলতে চাইতেন না। অবশ্য আমার চাওয়া বা দাবীতে তাদের পূর্ণ সমর্থন থাকত। এভাবে কথা বলতে বলতে কখন যেন বাকপটু হয়ে উঠলাম।

          অথচ আমার অতীত ইতিহাস ভিন্ন। একবার এক বড় বোনের বিয়েতে গান গাওয়ার জন্য আমাকে আর আমার এক বড় বোনকে নির্বাচন করা হল। গানের মাস্টার আরেক বোন শহরে স্কুলে পড়ে। তখন এখনকার মত টাটকা ফুলের মালা সুলভ ছিল না। বিয়ে-শাদিতে কাগজের মালা দিয়ে বরকে অভ্যর্থনা জানাতে হত। বাড়ি সাজানো হতো তেকোনা রঙিন কাগজ আর কাগজের তৈরি শিকল দিয়ে। ময়দার আঠা বানিয়ে বড়ভাইয়েরা এসব কাজ করতেন। গেটের দুপাশে কলাগাছ দিয়ে রঙিন কাগজ পেঁচিয়ে যতটা পারা যায় সৌন্দর্যবর্ধনের চেষ্টা করা হত। ওপরে কাগজে বা কাপড়ে লেখা হত স্বাগতমকিন্তু ঠিকমত গেটমানি না দিলে যারা কষ্ট করে বানাত তারাই পারলে হ্যাঁচকা টানে সব ভেঙে নতুন বরের মাথার ওপর ফেলার তান্ডব শুরু করত। তখন গুরুজনরা এগিয়ে এসে মিটমাট করত।

          শৈশব-কৈশোরে এরকম বেশ কয়েকটি গেট ভাঙা দেখেছি এবং যারা বানানো এবং ভাঙাতে পারদর্শী তারা রাগ করে বিয়ের খাওয়া বর্জন করে কোথায় কোথায় চলে যেত। মুরুব্বীরা মাথা ঘামাতেন না। কারণ তাদের ধারণা ছিল- যাবে কোথায় ঠিকই আসবে। গেটে টেবিল-চেয়ার থাকত, টেবিলে সরবত ঢাকা থাকত বরের জন্য। তখন গ্রামে বলত দুলা মিয়া বা নওশা।

          সেদিনও কিছুক্ষণ এই তান্ডব চলে ফিতা কাটা হল। এবার গান গেয়ে মালা দিয়ে বর-বরণ। কিছুটা দূর থেকে গান গাইতে গাইতে গেটে গিয়ে গান শেষ হলে বরের গলায় মালা পরিয়ে দিত গায়িকারা!

          আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, আমার সহযাত্রী বোনটিও তাই। আর আমাদের কয়েকদিন ধরে পুকুর পাড়ে, বাড়ির সিঁড়িতে, বড় আমগাছের গুঁড়িতে প্রচুর রিহার্সাল করিয়েছিল আমাদের বড় বোনটি।

          আমি শৈশবে ভীষণ লাজুক ছিলাম। একে লজ্জা, তায় এতসব গন্ডগোলে আমরা দুইবোন গান ভুলে মালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তখন আমাদের এক ভগ্নীপতি গানের কাগজটা খুঁজে এনে পিছন থেকে প্রম্পট করতে শুরু করলেন। তিনি একলাইন বলেন, আমরা বলি। দুর্ভাগ্যক্রমে তার হাতে ছিল একটা চিকন ছড়ি। এতে মনে হচ্ছিল তিনি দুটো গরুকে কোনরকমে ঠেলেঠুলে মাঠ পার করছেন। যাক, কোনরকমে মালা দিলাম।

          এবার ফিরে এসে ভাই-বোনদের হাসিঠাট্টা গঞ্জনা। পরে পুরোন হয়ে দুলাভাইও যোগ দিলেন- কি গান গাইলা, একটা শব্দও তো শুনলাম নাতার এ উক্তিতে মনে হত গায়ের ছাল উঠিয়ে লবণ লাগিয়ে দিচ্ছে।

          সবচেয়ে কষ্ট ছিল এক বড়ভাই যখন দুজন ভাই-বোনকে নিয়ে এটা অভিনয় করে দেখাতেন। তখন মনে হত ধরণী দ্বিধা হও। আর রবীন্দ্রনাথের গিন্নী গল্পের শিশুটির মত এ বিদ্রুপে সবার সাথে হাসিতে যোগ দিলেও, লুকিয়ে অনেক কাঁদতাম।

          কিন্তু আমার সংস্কৃতি চর্চার শখ কখনো যায়নি। রেডিও শুনতাম, খবর পড়তে ইচ্ছে করত, নাটক করতে ইচ্ছে করত। অডিশন দিয়ে করেছি। চট্টগ্রাম বেতারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনুষ্ঠানে, নবকল্লোল, ঢাকা বেতারে উত্তরণ বলে একটা প্রোগ্রাম হত সেখানে। কিন্তু অনুষ্ঠানের প্রথম কয়েক সেকেন্ড আমার কান-মাথা গরম হয়ে ঝাঁ ঝাঁ করত, মনে হত ভুলে যাব। তারপর আস্তে আস্তে ঠিক হত।

          কিন্তু শিক্ষক হব এ বাসনা আমার আশৈশব। মায়ের অনুপ্রেরণা, তাঁর সাহিত্য অনুরাগ, যে কোন বিষয় জানার আগ্রহ আমাকে এ পথে আসতে উৎসাহী করেছিল। তাই শাহীন কলেজের চাকরিটা পাওয়ার পর আমার অতীতের সেই ভীতি মুছে গেল। গ্রামে বড় হয়ে, আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেও গল্পের বই, রেডিওর নাটক (ঢাকা-কলকাতা) শুনতে শুনতে প্রমিত বাংলায় কথা বলতে মোটামুটি অভ্যস্ত ছিলাম। লেখালেখির ঝোঁক ছিল। সুতরাং কিছু না জেনেই শাহীন কলেজের সাংস্কৃতিক পুরস্কার বিতরণ, বিশিষ্ট জনদের অভ্যর্থনা জানানো এবং ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ধারাবিবরণীতে আমি মোটামুটি চোস্ত হয়ে উঠলাম।

          শ্রেণীকক্ষের গাম্ভীর্য অনুষ্ঠানেও কাজে লাগত। কেজি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে বেশ ভয় পেত। সুতরাং শৃঙ্খলার দায়িত্বটা আমি পালন করতাম। এ ছাড়া দায়িত্বভাগ করে দেওয়া হত। সৈয়দা শামসুন্নাহার শিশুদের দলীয় আবৃত্তি শেখাতেন। একাদশ-দ্বাদশ প্রতিবারই দু-একজন শিক্ষার্থী পাওয়া যেত যারা ভাল গান করত বা আবৃত্তি অথবা নাচে পারদর্শী ছিল। স্কুলেও থাকত। এদের মিলিয়ে অনুষ্ঠান ভালই দাঁড়াত। কোরাস বা আবৃত্তিতে দেখা যেত কিছুই পারে না এমন ছেলে-মেয়েও জুটে যেত। এর ফলে অনেক সময় বিশাল স্টেজেও জায়গা হত না। দুই সারিতে দাঁড় করানো হত। আবার এমনও ছিল- স্কুলে কোনদিন এর ধারে কাছে আসেনি সেসব ছাত্র-ছাত্রী কলেজে দেখা যেত কলেজে উঠে বেশ সপ্রতিভভাবে বন্ধুদের সাথে মিলে অনুষ্ঠান করছে। 

          কিছু কিছু দুষ্টু ছেলের দল মাঝে মাঝে এমন মজার কিছু করত যে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত। নব্বই ব্যাচের নাজমুল ও তার দলের কৌতুক, বিরানব্বই ব্যাচের আল-মামুন টিটুর মূকাভিনয় এখনও চোখে ভাসে।

          নাচে-গানে-আবৃত্তিতে অনেক ছেলে-মেয়ে ছিল। এদের কারো কারো কথা আগেও বলেছি। সবচেয়ে মজার ছিল প্রতিবার অনুষ্ঠানেই একটা গান হিট হত। স্কুলে ছেলে-মেয়েরা সারাবছরই সেটা গাইত। অনেক আগে সম্ভবত আশির দশকে একজন ছাত্র কবি জসীম উদ্দীনের নিমন্ত্রণ কবিতার কিছু অংশ পপ ঢং-এ গেয়েছিল। সে গান এমন মাতিয়েছিল ছেলেমেয়েদের যে সে হিরো হয়ে গিয়েছিল। বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হলে আমাদেরও মন খারাপ হত। কারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে আমাদেরও সে কটা দিন আনন্দে কাটত।

          সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ড্রেস রিহার্সেল আর মূল দিন আমাদের সারাদিন কলেজে থাকতে হত। এতে কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষক-কর্মচারীদের দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। এই খাবারের মেনু এবং বাজেট ঘাঁটি কর্তৃপক্ষের এ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট থেকে অনুমোদিত হয়ে আসত। সব অফিসেই এই বিভাগটির কৃপণতার দুর্নাম আছে। এখানেও তাই ছিল। খাবারের মেনু কার্টেল করতে করতে যতটা না হলেই নয় ততটাই তারা বরাদ্দ দিতেন। মনে পড়ে আশির দশকে মিটিং হলে শিক্ষকদের জন্য এককাপ চা আর একটা সিঙ্গাড়া বরাদ্দ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যারা হিসাব রক্ষণে এসেছিলেন তারা সেটাও ছেঁটে দিলেন। এই সামান্য খাওয়াটা কিছু নয় কিন্তু এতে যে অসম্মান তাতেই গায়ে জ্বালা ধরত।

 

 

 

 

বাচ্চাদের অবশ্য অনুষ্ঠানের দুদিন নাস্তা দেয়া হত। তবে এটা সত্যি সবকিছু ছাপিয়ে সম্মিলিত আনন্দটাই ছিল প্রধান। মজার ব্যাপার হচ্ছে যতই লাঠিয়ালগিরি করি, এসব অনুষ্ঠানের সুযোগে কিছু রোমিও-জুলিয়েট জুটিও তৈরি হত। এদের কেউ কেউ পরবর্তীতে সফল হয়েছে আবার কেউ ব্যর্থ প্রেমিক। আসলে বেশিরভাগেরই টিনএজের এ উচ্ছ্বাস পরবর্তীতে বেশি দিন স্থায়ী হত না।

          জুলিয়া চলে যাওয়ার পর এলো আইভি হাসান। সৌন্দর্যে, চলনে, বলনে, নাচ-গান-আবৃত্তি সবকিছুতে সে ছিল সমান পারদর্শী। আমার ভার অনেক লাঘব হল। তবে সিনিয়র হিসেবে ওরা আমার সম্মতি না নিয়ে কিছু করত না। এটা আসলে বড়র প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয়। আমিও পরম নির্ভরতায় সম্মতি দিতামকারণ আমার অবস্থাতো গোপাল ভাঁড়ের খট্টাঙ্গ পুরাণের মত পরতে পরতে ভাঁজ খুললে দেখা যাবে ভাঙা খাটের পায়া ছাড়া কিছু নেই অথচ এটা দিয়েই সে মস্ত গুরুকে বাকযুদ্ধে হারিয়েছিল কারণ এরকম বিদঘুটে পুরাণের নাম কখনো না শোনার ফলে গুরুজি প্রথমেই হার স্বীকার করে নিয়েছিলেন

          সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পুরস্কার দেয়া হত বই এই বই কেনা নিয়েও কর্তৃপক্ষ এমন বাজেট বা মূল্য নির্ধারণ করে দিতেন যা দেখে মনে হত এঁরা জীবনে বই কেনেনি এমনকি বইয়ের দোকানেও যায়নি। শিক্ষিত মানুষদেরও কতরকম মূর্খতা আছে তা তখন হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতাম।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিশ্ব নারী দিবস ২০২৫

  এবছরও ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০২৫ সালের নারী দিবসের মূল স্লোগান – For All women and girls: Rights, Equality and Emp...

Popular Posts