__________________________________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪
গল্প - জানা অজানা
__________________________________________
জানা অজানা
ভবানী ফার্মেসি এই
নবগ্রাম এলাকায় বিখ্যাত। যদিও এলাকার নাম নবগ্রাম আসলে এটা শহরের একেবারে মাঝখানে।
বিশুবাবু যাকে এলাকার সবাই এক নামে বিশুদা বলে চেনে তার বাবা পরেশ দত্ত সেই
স্বাধীনতার আগে থেকে ফার্মেসিটা চালাতেন। তিনি ছিলেন সরকারি হাসপাতালের
কম্পাউন্ডার।
কিন্তু তখনও এলাকাটা এত জমজমাট
হয়ে ওঠেনি আর এত ডাক্তারও ছিল না তাই পরেশ দত্তকে সবাই ডাক্তার বলেই ডাকত। ছোটখাটো
কাটাছেঁড়া সেলাই করা থেকে জ্বর গলাব্যথা চুলকানি ইত্যাদি নানা অসুখ বিসুখে সবাই
পরেশ দত্তর কাছেই ছুটে আসত। আর এভাবেই দিনে দিনে ভবানী ফার্মেসির পরিচিতি ও ব্যবসা
দুটোই বেড়েছে। কিন্তু হঠাৎ স্ট্রোক করে পরেশবাবুর মৃত্যুর পর তার ছেলে বিশু দত্তকে
কলেজের পড়া ক্ষান্ত দিয়ে সংসারের প্রয়োজনে দোকানে বসতে হয়েছে। সেও আজ প্রায়
বিশ-বাইশ বছর।
এখন শহরে অনেক পাশ করা
ডাক্তার। প্রচুর বিশেষজ্ঞ। কিন্তু ভবানী ফার্মেসির ব্যবসা আরো জমজমাট। একে তো পাড়া
থেকে বের হতে রাস্তার মুখে দোকান তারপর বিশুদাও এখন বিশু ডাক্তার।
এলাকার রিক্সাওয়ালা, বাসার
কাজের লোক এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকে সামান্য অসুখ বিসুখে বিশু ডাক্তারের
পরামর্শেই তার দোকান থেকে ওষুধ কিনে নেয়। এতে দুদিক থেকে তাদের লাভ - ঠেকলে ওষুধের
দামটা বাকি রাখা যায় আবার ডাক্তারের ফি বাবদ টাকাটাও বেঁচে যায়।
এভাবে ওষুধের দোকানটা আর
বিশুডাক্তার এত বিখ্যাত যে এলাকায় অপরিচিত কেউ এলেও রিক্সা, সিএনজির ড্রাইভাররাই
তাকে ভবানী ফার্মেসি চিনিয়ে নিয়ে আসতে পারে। এমনকি পাড়ার লোকে কাউকে ঠিকানা দিতে
গেলেও বলে - "ভবানী ফার্মেসির সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে চিনিয়ে দেবে"।
হ্যাঁ, বিশুদা এ কাজটা করেন।
ছোটবেলা থেকে এ পাড়ায় থাকতে থাকতে পাড়ার প্রত্যেকটি বাড়ি বলতে গেলে তার চেনা।
তাছাড়া ব্যক্তিস্বভাবে নম্র ভদ্র বিশুদা যে কোন প্রয়োজনে আসা মানুষকে ফিরিয়ে দেন
না। যত ব্যস্ততাই হোক অপরিচিত মানুষকে সাহায্য করা তার
ধর্ম।
আরেকটা কাজ করেন বিশুদা - কখনও
কোন ভিক্ষুককে বিমুখ করেন না। অসুখে ওষুধ দিয়ে, অনাহারে খাবারের টাকা দিয়ে যতটুকু
পারেন সাহায্য করেন। এজন্য এলাকার ভিক্ষুক সমিতির কাছে বিশুদা সম্প্রদায়
নির্বিশেষে দেবতা অথবা ফেরেশতা।
এতে
অবশ্য বিশুদার নিজেরও যে একটু সুবিধা হয় না তা নয়। তবে উপকারের তুলনায় তা অতি
সামান্য। দিনের শেষে ভিক্ষুকেরা তাদের ভাংতি টাকা-পয়সাগুলো বিশুদার ক্যাশে জমা
দিয়ে গোটা টাকা নিয়ে যায়। ফলে ভাংতি টাকার জন্য বিশুদাকে আর ব্যাংকে দৌড়াতে হয় না।
কেউ কেউ আবার টাকাগুলো তার কাছেই জমা রাখে। বাড়ি যাওয়ার সময় নিয়ে যায়। কিন্তু এদেরই একজনের টাকাপয়সা
নিয়ে বিশুদা বেশ কিছুদিন থেকে চিন্তিত আছেন।
রমজান মিয়া। এই এলাকার সবচেয়ে
পুরনো ভিক্ষুক। সারাদিন কোথায় কোথায় ভিক্ষা করে সন্ধ্যায় ভবানী ফার্মেসির সামনে
হাজির হত। তারপর ঝুলি উপুড় করে সারাদিনের টাকা-পয়সাগুলো মাটিতে ঢালত। তারপর একটা
একটা করে গুণে গেঁথে নিজের খাই খরচটা রেখে বাকিগুলো বিশুদার কাছে জমা রাখত। ছ'মাসে
ন'মাসে বাড়ি যাওয়ার সময় টাকাগুলো নিয়ে যেত।
আজ প্রায় পনের বছর এভাবে চলছে।
যেদিন দোকানে খদ্দের কম থাকত অথবা বৃষ্টি-বাদলা সেদিন রমজান বিশুদার পায়ের কাছে
বসে গল্প করত। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা বারোমাসই কাটাত দোকানের বাইরের চাতালে। বর্ষাকালে
একটা মাত্র পলিথিনের বস্তামুড়ে শুয়ে থাকত।
একটাই নেশা ছিল - প্রতিদিন
টাকাগুলো গুণত। তারপর বিশুদাকে দিয়ে একটা কাগজে লিখিয়ে নিত। গোণা-গুনতি শেষ হলে
হিসেবের কাগজটায় মুড়ে টাকাগুলো আবার বিশুদার কাছে জমা দিত। যখন বাড়ি যেত কিছু টাকা
নিয়ে যেত আবার কিছু টাকা রেখে যেত। লালসুতা দিয়ে বেঁধে রেখে যাওয়া টাকাটা বিশুদার
ক্যাশবাক্সের এক কোণে পড়ে থাকত। কিন্তু এবার যাওয়ার পর প্রায় চারমাস হতে চলল রমজানের কোন খবর নেই।
আগে বাড়িতে গেলে তিন-চারদিনের মধ্যেই ফিরে আসত। এসেই একগাল হেসে বলত - আইলাম ফির্যা।
ঢাকা শহর ছাইড়া থাকতে এক্কেরে ভালা লাগে না।
শুনে বিশুদার হাসি পেত। হায়!
যার একটা বিছানাও নেই ঢাকা শহরে তার ঢাকা শহর ছেড়ে থাকতে ভাল লাগে না। মৃদু হেসে
বলতেন - "ঢাকা শহর তোমারে কী দিল যে এ শহরের জন্য এত ভালবাসা তোমার!"
"কী কন দাদা! ঢাকা শহরে
ট্যাহা ওড়ে। কত্তো কত্তো বড় লোক দেহি। কত্ত গাড়ি। আগে তো এত্ত ছিল না। এই ক'বছরে
দেখলাম কত্ত নতুন নতুন বাড়ি উঠল। আর সাহেব বেগম সাহেবাগো চলন-বলন তো এক্কেরে
বদলাইয়া গেছে। খালি আপনেরেই দেখলাম আগের মতন আছেন। ক্যান গো দাদা, ওষুধের ব্যবসায়
বেশি লাভ নাই? তাইলে অইন্য ব্যবসা করেন না ক্যান? হ, কত ছাওয়াল-পাওয়ালরে দেখলাম
কাইল আইস্যা আইজ গাড়ি দৌড়ায়।"
কথা শুরু করলে আর থামতে চাইত
না রমজান। শেষে একরকম ধমক দিয়ে চুপ করাতে হত - "যাওতো রমজান কাজের সময় বকবক
করো না।"
তবুও কি রমজান চুপ করত? এখান
থেকে উঠে গিয়ে ওখানে কর্মচারীদের ওপর খবরদারি করত। এভাবে কখন যেন এ দোকানের একজন
হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু এবার বাড়ি যাবার পর আর
কোন খবর নেই। টাকাগুলো পড়ে আছে। বাড়ি যাওয়ার সময় তার কাপড়চোপড়গুলো দোকানের পিছনে
স্টোরে রেখে যেত। যাবার দিন ভাল লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরত। তারপর নিজেই বিশুদাকে বলত -
"আইজকাল সাহেবগো মনডাও অনেক বড় হইছে। জাকাতের লুঙ্গি কাপড় আগের থেইকা অনেক
ভাল দেয়। দ্যাখেন এবারের পাঞ্জাবিটা কেমন সোন্দর। বুকের কাছে নকশা আবার পিঠেও
-" বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে পিঠটা দেখাত।
যাওয়ার দিন কাঁধে ব্যাগ হাতে
ফলমূলের প্যাকেট আর বগলে ছাতা নিয়ে একগাল হেসে বলত - "বাড়িত থেইকা ঘুইরা আসি।
ভালা থাইকেন দাদা।" এবারও যাওয়ার সময় বলেছিল - "আসি দাদা।" ব্যস্ত
ছিলেন বলে মুখ না তুলেই বিশুদা বিদায় জানিয়েছিলেন।
ক্যাশ খুলে টাকাটা হাতে নিলেন।
সুতা খুলে কাগজটা পড়লেন - মোট তের হাজার ছয়শ' নব্বই টাকা। বাড়ি যেতে নিয়েছে পাঁচ
হাজার টাকা। জমা আট হাজার ছয়শ' নব্বই টাকা। এতগুলো টাকা! একজন ভিক্ষুকের জন্য এ
টাকা অনেক।
কী করা যায়। ঠিকানাও জানা নেই।
একবার বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে বলেছিল গফরগাঁও এর নিমতলী গ্রাম।
সন্ধ্যাবেলায় ফুটপাতে
ভিক্ষুকদের আড্ডায় খোঁজ করেন বিশুদা।
না, তারা কেউ বলতে
পারে না। সবাই তারা ভাসমান মানুষ। কেউ নদীভাঙা, কেউ ভূমিহীন, কেউ জন্মপরিচয়হীন -
নিজের ধান্দায় দিন কাটে কে কার খোঁজ রাখে?
একটা মানুষ এভাবে হারিয়ে যাবে?
হোক না ভিখিরি। এতদিন ধরে লোকটা ছিল হঠাৎ উধাও হয়ে গেল! তাছাড়া আজকাল রাস্তাঘাটে
এত দুর্ঘটনা ঘটছে - তাতেই মরে গেল নাকি? তবে টাকাগুলো? তার পরিবার হয়তো কত কষ্টে
আছে। টাকাগুলো তাদের কাজে লাগত।
নানান কথা ভেবে সুতায় বাঁধা
টাকা আর থলের ভিতর রাখা পুরনো জীর্ণ কাপড়গুলো একটা শপিং ব্যাগে ভরে বিশুদা
গফরগাঁওগামী ট্রেনে চড়ে বসেন।
গফরগাঁও স্টেশনে নেমে একটা
রিক্সা নিলেন। জিজ্ঞেস করলেন - "নিমতলী গ্রাম চেন?"
"হ চিনুম না? এই অঞ্চলে
হগ্গল গেরাম চিনি। কার বাড়িত যাইবান হেইডা কন।"
"নিমতলীর রমজানের বাড়ি।
চেন?"
"চিনি। ঢাকায় চাকরি কইরত
হেই রমজান না? হে তো মইরা গেছে আইজ পরায় তিন চাইর মাস।"
"না না ঢাকায় চাকরি করত
না। ভিখ্....." বলতে গিয়ে
চুপ করে যান।
"নিমতলীতে আর তো কোন
রমজান নাই। এই একজনই তো ঢাকায় চাকরি করত। চাকরি কইরাইতো অবস্থা ফিরাইল। নতুন বাড়ি
বাঁধল। আপনে তাইলে ভুল করছন।"
"নারে ভাই। আমি ভুল
করিনি। আচ্ছা, তুমি ঐ বাড়িতেই আমাকে নিয়ে যাও।"
রিক্সাওয়ালা প্যাডেলে চাপ
দিয়েই বকর বকর শুরু করে দিলো। বিশুদার মনে হলো এই এলাকার সব মানুষই কি এরকম বাচাল?
রমজানও কথা বলতে শুরু করলে থামতে চাইত না। কিন্তু রিক্সাওয়ালার কথায় একটা কৌতূহল
হচ্ছে। এই রমজানই কি সে রমজান? দেখা যাক। না হলে ফিরে যাবেন।
রিক্সা এসে একটা বাড়ির সামনে
থামে। রিক্সাওয়ালা হাঁক দেয় - "আনুমিয়া বাড়িত আছনি? তোমাগো মেহমান
আইছে।"
"না, ভাই ত বাড়িত নাই।
মাঠে গেছে" - বলতে বলতে সালোয়ার কামিজ পরা একটি কিশোরী ঘর থেকে উঠানে নামে।
মেয়েটার মুখের দিকে এক পলক
তাকিয়ে বিশুদার সন্দেহ থাকে না যে এটা রমজানেরই বাড়ি। মেয়েটার মুখ অবিকল রমজানের
মত।
"দ্যাখতো চিনতে পার কিনা
এনারে?" রিক্সাওয়ালা বলে। তারপরি তাগিদ দেয় - "নেও, ঘরে নিয়া বসাও।
ঢাকার থাইকা আইছেন।"
রিক্সাভাড়া মিটিয়ে মেয়েটার
পিছুপিছু ঘরে ঢুকেন বিশুদা। কাঠের পাটাতনের ওপর টিনের ঘর। বেড়া দেওয়া রুমটাতে
একপাশে একটা চৌকিতে বিছানা পাতা। অন্যপাশে একটা টেবিল, দুটো চেয়ার। টেবিলের ওপর বই
খাতা।
কিন্তু আরো বিস্ময় অপেক্ষা
করছিল। বেড়ার খুঁটিতে আটকানো ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন - ঐ তো
রমজান। আর কোন সন্দেহ নেই এটা রমজানের বাড়ি। মেয়েটা ঘরের ভিতরের দিককার দরজায়
দাঁড়িয়ে মুখ নিচু করে পায়ের নখ দিয়ে মেঝের মাটি খুঁটছে।
"তোমার নাম কী?"
"পারুল" - একবার চোখ
তুলেই নামিয়ে নেয়।
"তুমি পড়?"
"জ্বি"
"কোন ক্লাসে?"
"কেলাস এইটে"
"একটু পানি খাওয়াতে
পার?"
"জ্বি" - বলেই পারুল
ঘরের ভিতর ছুটে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাচের গ্লাসে একগ্লাস পানি এনে টেবিলে
রাখে।
"কিসের পানি?
চাপাকলের?"
"জ্বি"
ঢক ঢক করে পানিটা পান করে
টেবিলে রাখতে রাখতেই জানতে চান - "তোমার ভাই কখন আসবে? আমাকে যে আবার ফিরতে
হবে।"
"না আপনে বসেন। আম্মায় চা
বানায় আর কইছে ঢাকার থেইকা আইছেন ভাত না খাইয়া যাইতে পারবান না।"
"না না এত ঝামেলার দরকার
নেই। আমাকে সন্ধ্যার আগে ফিরতে হবে।"
"এখন তো গাড়ি নাই। গাড়ি
সেই বিকালে। ভাই অক্ষনি হাল ছাইড়া আইব।"
হঠাৎ ভিতরের দরজায় খসখস শব্দ
শুনে পারুল পিছনে তাকায়। তারপর ঘুরে চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকে। পারুলের মা আড়াল
থেকে বলেন, "পারুল, মেহমানরে কও ভাত না খাইয়া যাওয়া যাইব না।"
রমজানের ছেলে কাঁধে লাঙল নিয়ে
বলদ দুটোকে হট্ হট্ করতে করতে উঠানে এসে দাঁড়ায়। লাঙল নামিয়ে বলদগুলোকে উঠানে
জাবনার গামলার পাশে আমগাছের সাথে বাঁধে। তারপর হাঁটুর ওপর থেকে লুঙ্গিটা ছেড়ে
ঠিকঠাক করে। দরজায় দাঁড়িয়েই সালাম দেয়। তারপর অনুমতি চায় - "আমি হাত-মুখটা
ধুইয়া আসি?"
তারপর বোনের দিকে তাকিয়ে
প্রশ্ন করে - "কিরে পারুল, মেহমানরে চা-পানি কিছু দিছস?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ সব
দিয়েছে" - পারুলের আগে বিশুদাই উত্তর দেন। হাত-মুখ ধুয়ে বাড়ির ভিতর যায় আনু।
মেহমানের আদর আপ্যায়ন তদারক করে। তারপর এসে চৌকিটাতে বসে।
"আপনে আব্বারে
চিনতেন?"
"হ্যাঁ, অনেক বছর ধরে
চিনতাম।"
"দ্যাখেন কি দুঃখের কথা।
বাড়িত আইল আর তিনদিনের জ্বরে ভালামানুষ আত্কা মইরা গেল। একটু যে চিকিৎসা করামু
হেই সুযোগও দিল না।"
"ঢাকায় একটা খবর দিলে না
কেন?"
"কেমনে খবর দিমু?
আব্বায়তো কোনদিন ঠিকানা দেয় নাই। কইত একটা ফ্যাক্টরিতে কাম করে। জিগাইলে কইত আমিতো
বাড়িত আহি। ঠিকানা দিয়া কী করবি? ঢাকা শহরে ঠিকানা দিয়া মানুষ খুঁজি পাওন যায়
নাকি? ঢাকা শহরে মানুষ থাকে?"
বিশুদার অবাক লাগে - এই
মানুষটাই ঢাকা গিয়ে তাকে বলত - "আইলাম দাদা। ঢাকা শহর ছাইড়া বেশিদিন ভালা
লাগে না।"
ছেলেটা বলতে থাকে -
"আইজকা পনর ষোল বছরের বেশি আব্বায় ঢাকা ছিল। আমারে আর মায়েরে খালি কইত আমি
কষ্ট করি তোমরা একটু একটু করি জমি জিরাত কর। একখান নয়া বাড়ি বান্ধ, হের পর আমি
আইস্যা তোমাগো লগে থাকুম। তয় সবই হইল। ঘরভিটা ছিল না ঠিকমত - আর এখন নতুন বাড়ি
বান্ধলাম, জমি-জিরাত হালের গরু সবই অইল- কিন্তুক আব্বায় সুখ করতে পারল না।"
বলতে বলতে আনুর চোখ দুটো ছল ছল
করে ওঠে। বিশুদার ঘোর লাগে। একটা মানুষের আশ্চর্য দুটো রূপ। এখানে সে সংসারী
দায়িত্ববান মানুষ আর ওখানে ফুটপাতে রাত কাটানো ভিখারী। অথচ ঘুণাক্ষরেও কোনদিন এসব
কথা মুখে আনে নি।
ওরা কিছুতেই ছাড়ল না। ঘরের
মুরগি জবাই দিয়ে ভাল করেই আতিথেয়তা করল। বিশুদাকে বার বার বলল "আব্বায় থাকতে
আইলে কত্ত খুশি অইত।"
তার আক্ষেপ শুনে গলার কাছে ভাত
আটকে যায় বিশুদার। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারেন না।
বিদায় নেবার আগে আনুকে ডাকেন
বিশুদা। সুতার বাঁধাটা খুলে আগেই হিসাবের মলিন কাগজটা সরিয়ে রেখেছিলেন। শুধু
টাকাটা তুলে দেন আনুর হাতে - "তোমার আব্বার কিছু টাকা আমার কাছে ছিল সেগুলো
দিতে এসেছিলাম।"
আনু হাত পেতে টাকাটা নেয়।
সকালের রিক্সাটা উঠানে
দাঁড়িয়ে। বিশুদা শপিং ব্যাগটা তুলে নেন টেবিল থেকে। রমজানের ভিক্ষা করার জীর্ণ
কাপড়গুলো এনেছিলেন। কিন্তু এগুলো এদের না দেয়াই ভাল। এত জীর্ণ কাপড় দেখে ওরা কষ্টই
পাবে। ওরা সুখে আছে সুখেই থাক না।
প্যাকেটটা হাতে করে রিক্সায়
উঠে হাত নাড়েন বিশুদা।
উঠানে দাঁড়িয়ে আছে পারুল আর
আনু। আরো একজন আছে দরজার আড়ালে। থাক ওরা সুখে থাক।
No comments:
Post a Comment