_____________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - বোধন ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৯
গল্প - নামকরণ
__________________________
নামকরণ
অনি¾
বাবার ডাক শুনে ঘুম চোখেই হুড়মুড় করে উঠে বসে অনি। দু’হাতে চোখ কচলাতে থাকে। ঘুমের ঘোরেও এর আগে তিনবার
বাবার ডাক শুনতে পেয়েছে সে। এবার না উঠলে আর রক্ষা নেই। কারণ এর পর বাবা এসে
অতর্কিতে কান ধরে তুলে দেবেন। তখন সারাদিনই অনির কানটা ব্যথা করতে থাকবে। ঘুমের
ঘোর কাটতে কিছুক্ষণ পাশে ঘুমিয়ে থাকা ভাইকে দেখল। ইস্ কী মজা করে ঘুমুচ্ছে ভাইয়া।
লেপ মুড়ি দিয়ে গুটিশুটি হয়ে। অথচ এই ভাইয়ার জন্যই অনির আজ যত ভোগান্তি। গত বছর
ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল ভাইয়া। তাই এ বছর অনির উপর বাবার কড়া
আদেশ¾ তোমাকেও বৃত্তি পেতে
হবে। পড়তে খারাপ লাগে না অনির। কিন্তু একটানা অনেকক্ষণ পড়ার টেবিলে বসে থাকতে পারে
না সে। ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে বলটা নিয়ে লোফালুফি করতে, বন্ধুদের সঙ্গে
ক্রিকেট-ফুটবল খেলতে।
অনি¾
এবার বেশ জোরেই ডাকলেন বাবা। ভয়ে বুক গুরগুর করে উঠলো। এক লাফে বিছানা থেকে নামতে
নামতে জবাব দিল¾ জ্বী বাবা, উঠছি। বাথরুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুখ-হাত মুছতে মুছতে হঠাৎ
চুন্নু মিয়ার কথা মনে পড়লো। কেমন আছে চুন্নু মিয়া? এখনতো বেশ শীত। ঠান্ডা লেগে
আবার জ্বর-টর আসেনি তো! ভাবতে ভাবতেই
বারান্দার কোলাপসিবল গেটটা খুলে উঠোনে নেমে এলো অনি।
ভোরের এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস চোখে মুখে
এসে লাগতে শরীর কুঁকড়ে গেল। কুয়াশায় চারদিক অস্পষ্ট হয়ে আছে। এখনো সূর্য উঠেনি।
হাত দুটো বুকের কাছে আড়াআড়ি ধরে নিজেকে ওম দেবার চেষ্টা করলো। তারপর বাড়ির পিছন
দিকের পরিত্যক্ত ছোট্ট ঘরটায় এসে ঢুকল।
বাড়ি
করার সময় সিমেন্ট লোহা এসব রাখার জন্যে বাবা এ ঘরটা তুলেছিলেন। তারপর বাড়ি শেষ হয়ে
গেলেও আর ভাঙা হয়নি। মা সংসারের ফেলনা এটা-সেটা ঘরটাতে জমিয়ে রাখেন। জানালাবিহীন
দেয়াল ঘেরা ঘরটাতে ঢুকে প্রথমে কিছুক্ষণ সময় লাগলো ঘরটার কোথায় কী আছে দেখে নিতে।
এর মধ্যে টুপ্ টুপ্ করে কয়েক ফোঁটা
শিশির টিনের চাল থেকে অনির গায়ে মাথায় পড়তে গা কাঁটা দিয়ে উঠল। জামার হাতা দিয়ে
পানি মুছতে মুছতে ঘরের কোণে রাখা বাক্সের দিকে এগিয়ে গেল সে। পুরোনো কাঁথা কাপড়ের
মাঝে বেশ আরাম করেই শুয়ে আছে চুন্নু মিয়া। ভাইয়া যত্নের ত্রুটি করেনি। অনি কাছে গিয়ে
দাঁড়াতেই চুন্নুমিয়া ডেকে উঠল¾ মিয়াঁও! অনির মনে
হলো যেন চুন্নু মিয়া ওকে বললো ¾ সুপ্রভাত।
¾ ইয়েস, গুড মর্নিং
চুন্নু মিয়া। কেমন আছো তুমি? ঠান্ডা লাগছে না তো? বলতে বলতে চুন্নু মিয়ার গায়ে আদর
করে হাত বুলিয়ে দিল। অনির আদরে চুন্নুমিয়া মাথাটা এলিয়ে দিয়ে আরো দু’একবার ডাকল মিয়াঁও, মিয়াঁও। নাহ্ আর দেরি করা যায়
না। তাহলে বাবার বকুনি শুধু নয়, পিটুনিও খেতে হবে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো সে।
বারান্দায় উঠতেই মায়ের সঙ্গে দেখা।
¾ এই ভোর ভোর কোথায় গিয়েছিলি অনি? এখনো পড়তে বসিস
নি!
¾ এই তো বসবো মা।
চুন্নু মিয়াকে দেখতে গিয়েছিলাম ওর ঠান্ডা লেগেছে কিনা।
মা হেসে উঠলেন¾ ওদের এতো তাড়াতাড়ি ঠান্ডা লাগে না। গায়ে লোম আছে না!
মা রান্না ঘরের দিকে গেলেন। অনি এসে
পড়ার টেবিলে বসল। আজ ছুটির দিন। বাবা নিজেই ওকে পড়াবেন। কাল রাতেই পড়া দিয়েছেন।
দুটো ইংরেজি রচনা শিখতে হবে আজ সকালের মধ্যে। তারপর দুই প্রশ্নমালা অংক।
রচনা একটি My pet animal। অনি বই খুলে দেখল বইতে যে
রচনাটি আছে সেটি বিড়াল নিয়ে। পোষা প্রাণী বিড়াল। আরে খুব মজা তো! অনিদের চুন্নু
মিয়াও তো বিড়াল। বইতে লেখা রচনাটা পড়ে
অনির বেশি ভাল লাগল না। বিড়ালের আকার আকৃতির বর্ণনা, বিড়াল কী খায়, তার স্বভাব
কেমন¾ এসব কথাই কেবল লেখা। কিন্তু অনি যদি চুন্নু মিয়ার
কথা লেখে! এই যেমন¾ কিছুদিন আগে ওরা দু’ভাই অনি আর অভি মিলে অনেক
কষ্ট করে ছাদের আলসে থেকে বিড়ালটাকে কত কৌশল করে কীভাবে ধরল।
কয়েকদিন থেকে ওরা লক্ষ্য করছিল কোত্থেকে
একটা বিড়াল এসে আলসে শুয়ে রোদ পোহায়। মাঝে মাঝে মিয়াঁও, মিয়াঁও ডাক ছেড়ে আড়মোড়া
ভেঙে আবার গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে। অনেক কষ্ট করে পাইপ বেয়ে উঠে দু’ভাই মিলে ধরার চেষ্টা করতেই টের পেয়ে গিয়েছিল।
শেষের দিন ভাইয়া কোথা থেকে একটা পুরনো জাল জোগাড় করে পিছন থেকে ছুঁড়ে মারতে
বিড়ালটা আটকে গিয়েছিল। জালসহ জড়িয়ে কত সাবধানে ওদেরকে পাইপ বেয়ে নামতে হয়েছে।
তারপর রান্নাঘর থেকে মায়ের ডানো দুধের টিন থেকে দুধ নিয়ে গুলে দিতে বিড়ালটা চুক
চুক করে সব টুকু দুধ খেয়ে ফেলল।
¾‘নিশ্চয় খুব ক্ষিধে পেয়েছে ওর’ ভাইয়া বলেছিল। অনিও সায় দিয়েছিল। কারণ বিড়ালটা
তখন আর পালাতে চায়নি। তার পর ছোট্ট ঘরটাতে নিয়ে মায়ের পুরনো কাপড়ের গাঁটরি থেকে
কাপড় আর ভাইয়ার ছোটবেলার স্মৃতি হিসেবে রাখা কম্বলটা নিয়ে একটা পুরনো বাক্সের ভিতর
ওর থাকার জায়গা করে দিয়েছিল। মা টের পেয়েছিলেন দু’দিন
পরে। টিনে দুধ রাখতেই দুধ নেই! ব্যাপার কী? তখন ওরা দু’ভাই
মিলে অনেক সাধ্য সাধনা করে মাকে রাজি করিয়েছে বাবাকে না বলার জন্য।
অনেক চিন্তা ভাবনা করে দু’ভাই মিলে বিড়ালটার নাম
রেখেছে ‘চুন্নু
মিয়া’।
মা শুনে হেসেছিলেন¾ এটা কী নাম? পোষা প্রাণীর নাম বুঝি মানুষের নাম
হয়? ভাইয়া তখন বলেছিল¾ জিম, টম, প্যাট যদি হয় তাহলে চুন্নু মিয়া হবে না
কেন? এখন অবশ্য বাসার সবাই এমন কি পাড়ায় ওদের বন্ধুরাও বিড়ালটাকে চুন্নুমিয়া বলে
ডাকে, এমন কি বাবাও।
ধবধবে সাদা বিড়ালটা নাদুস নুদুস হয়ে এত
সুন্দর হয়েছে! চালাকও হয়েছে খুব। বল নিয়ে লোফালুফি করতে পারে। লাঠি কামড়ে ধরে।
পিছনে মায়ের পায়ের শব্দ শুনে অনির খেয়াল হল¾
সে পড়ছে না। তাড়াতাড়ি বইয়ের পাতায় চোখ রেখে গুন গুন করে পড়তে থাকে I have a pet
cat. It has.....।
মা টেবিলে দুধ আর বিস্কুট রেখে যায়।
অনির ইচ্ছে করে একটু দুধ চুন্নু মিয়াকে খাওয়াতে। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। ঘরের
সবাই উঠে গেছে। কাজের বুয়াটাও এসে গেছে। ও দেখলেই ফোড়ন কাটবে¾
“মাইনষের ছাওয়ালই দুধ
পায় না। আর আপনেরা বিলাইরে দুধ খাওয়ান”।
বুয়ার কথা শুনে মাও রেগে যাবেন। এমনিতে
মা সহজে রাগ করেন না। বিষয়টা চিন্তা করে মনে মনে অকারণে বুয়ার উপর রেগে যায় অনি।
অথচ সেবার বুয়ার ছেলের অসুখের সময় ওরা মাটির ব্যাংকটা ভেঙে সবগুলো টাকা বুয়াকে
দিয়েছিল। মাও দিয়েছিলেন। একদম কৃতজ্ঞতা নেই। এমন ফেউয়ের মত পেছনে লাগে। অকৃতজ্ঞ!
অনির ইচ্ছা করে পরীক্ষায় এক কথায় প্রকাশ “যার কৃতজ্ঞতা নেই তাকে কী
বলে” এই প্রশ্ন এলে লিখে
দেবে “আমাদের
বাসার কাজের বুয়া”।
এখন দুপুর। অনি অংক কষছে। ভাইয়া বারান্দায় চুন্নুমিয়ার সাথে
বল নিয়ে লোফালুফি করছে। এই সময় ওদের বন্ধুদের অনেকে মাঠে খেলছে। কিন্তু আজ ছুটির
দিন। বাবা বাসায়। ওদের এক পাও বাইরে দেবার উপায় নেই। অন্যদিন তবুও মাকে বুঝিয়ে
রাজি করানো যায়। এখন বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। সবাই মজা করে খেলছে। কিন্তু বাবার সামনে
দাঁড়ালেই বুক দুরু দুরু করে। জিভ শুকিয়ে যায়। অনি একদম কথা বলতে পারে না। ভাইয়া
তবু মাঝে মাঝে গাঁই গুই করে আর মার খায়। অনি মার খাওয়ার ভয়ে কিছুই বলে না।
জানালা
দিয়ে বাইরে দেখলো অনি। আকাশটা পরিষ্কার। মিষ্টি রোদে ভরে আছে। কারা যেন ঘুড়ি
ওড়াচ্ছে। আকাশে বেশ কয়েকটা লাল-নীল ঘুড়ি। একটা মনে হচ্ছে কাটা পড়লো। নিচের দিকে
নামছে...।
¾
এই অনি ঘুমাচ্ছিস! ভাইয়ার ডাক কানে যেতে ধড়মড় করে উঠে
বসল অনি। হাত থেকে পড়ে যাওয়া কলমটা টেবিলের নিচ থেকে কুড়িয়ে নিল। খাতায় কয়েক বার
আঁকিবুকি টানল। নাহ্ কলমের বলটা ঠিক আছে।
আজ অনির
বৃত্তি পরীক্ষা। সকালে বাংলা, বিকেলে ইংরেজি। আশ্চর্য, বাংলা রচনা এসেছে ‘তোমার পোষা প্রাণী’। অনি ঠিক করল চুন্নু মিয়ার
কথাই লিখবে।
পরীক্ষা শেষে অনির অবসর। চুন্নু মিয়াকে
নিয়ে খেলতে কোন বাধা নেই। অনি লক্ষ্য করল এ ক’দিনে চুন্নু মিয়া আরো মোটা
সোটা হয়েছে। আবার অলসও হয়ে গেছে। আগের মত লাফাতে ঝাঁপাতে চায় না। কিছুক্ষণ পর পর
মাথাটা এলিয়ে শুয়ে থাকে। অনি ব্যস্ত হয়ে যায়। মাকে বলে¾
মা দ্যাখতো, চুন্নু মিয়ার কী হলো। ওকে কি ডাক্তার দেখাবো মা? তা হলে কি পশু
ডাক্তার দেখাব? উনি কোথায় বসেন? মা হাসেন। কিছু বলেন না। মাঝে মাঝে বেশি বিরক্ত
করলে বলেন¾ আচ্ছা আর ক’টা দিন দ্যাখ।
স্কুলে
গিয়ে অনি শুনতে পেল বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। এসেম্বলিতে হেডস্যার ঘোষণা
দিলেন¾ ‘আমাদের
স্কুল থেকে এবার পাঁচজন বৃত্তি পেয়েছে। একজন ট্যালেন্টপুলে, তার নাম শাহরিয়ার কবির
অনি।
অনির মনে হল সে উড়ে যাচ্ছে। হেডস্যার
ডাকছেন¾ কই তোমরা সামনে এসো।
কিন্তু অনি হাঁটতে পারছে না। এর চেষ্টা করছে অথচ পা দুটো নড়ছে না। পিছন থেকে একজন
ধাক্কা দিল¾ এই অনি, যা না। এবার
অনি দৌড়ে গিয়ে অন্যদের পাশে দাঁড়াল। সবাই তালি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে রংধনুর
রং ঝরছে।
একটা কেমন ঘোরের মধ্যে ভাইয়ার হাত ধরে বাড়ি ফিরল অনি।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন মা। অনি জড়িয়ে ধরলো মাকে¾ ‘আমি বৃত্তি পেয়েছি মা, ট্যালেন্টপুলে’। মা চুমু খেলেন কপালে। তারপর হঠাৎ হাসতে হাসতে বললেন¾ ‘তোদের জন্য আরো একটা সুখবর আছে’।
¾ কী সুখবর মা?
¾ কাল রাতে তোদের
চুন্নু মিয়া তিনটে বাচচা দিয়েছে। তোরা সকালে স্কুলে যাওয়ার পর আমি গিয়ে দেখি এই
কান্ড। আমি অবশ্য জানতাম। তাই অপেক্ষা করছিলাম।
মাকে জড়িয়ে ধরে অনি অভি এক সঙ্গে
জিজ্ঞেস করল¾ ‘তাহলে চুন্নু মিয়ার নাম কী হবে মা?’
No comments:
Post a Comment