_____________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - বোধন ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৯
গল্প - বিপন্ন বিস্ময়
__________________________
বিপন্ন বিস্ময়
ক্লাসে ঢুকেই বেঞ্চটার দিকে
চোখ গেল ফারহানা হাসানের। সিট খালি। অর্থাৎ আজো আসেনি মেয়েটা। মন
খারাপ হয়ে গেল। নিশ্চয় কোন অসুখ-বিসুখ করেছে। গত দু’দিন
থেকেই আসছে না। ওর আশেপাশের তেমন কাউকে জানেন না যে খোঁজ করবেন। নতুন বছর শুরু
হওয়ার পর যারা নতুন ক্লাসে উঠেছিল তাদের মধ্যে এই মেয়েটির প্রতি আশ্চর্য একটা মায়া
পড়ে গেছে। অবশ্য, তার একটা বড় কারণ মেয়েটির মিষ্টি চেহারা আর মায়াময় দুটো চোখ।
এমনিতে ফারহানা প্রায় প্রত্যেকটি শিশুকে
আদর করেন। ওদের দিকে তাকালে মনে হয়, পৃথিবীতে সরলতা, পবিত্রতা কিছু থাকলে এখনো
ওদের মধ্যেই আছে। প্রাণ চঞ্চল শিশুদের ভালবাসেন বলেই যাই যাই করেও এখান থেকে যাওয়া
হয়নি। পরীক্ষা দেয়ার পরপরই এক আত্মীয় বলেছিল¾ বসে না থেকে একটা
কাজে লেগে যাও।
ফারহানাও
হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। তাছাড়া একটা কিছু করার গরজ ভেতর থেকে তাড়া দিচ্ছিল। বাবা বুড়ো
হচ্ছেন, তার ওপর বসে বসে খাওয়া, ছোট ভাইবোনগুলো লেখাপড়া করছে। তাছাড়া মাও যেন
ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই স্কুলের কাজটার খোঁজ পেয়ে যোগাযোগ করতে
অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরিটা হয়ে গেল। অবশ্য কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছে, এবার তাকে
স্থায়ী নিয়োগ দেয়া হবে। তার কাজে তারা
সন্তুষ্ট।
কিন্তু
ফারহানা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাড়িতে বাবা চিন্তিত বিয়ে নিয়ে। মেয়ের বয়স হয়ে
যাচ্ছে। ফারহানা এ নিয়েও মাথা ঘামায় না। বিয়েটা আসলে একটা সমস্যা। আজকাল
যৌতুক-ফৌতুকের ব্যাপারগুলো এমন হয়েছে যে, এসব না দিতে পারলে বিয়ে হয়েও শান্তি নেই।
শ্বশুর বাড়িতে শিক্ষিত বউ হওয়াতে লাথি-ঝাঁটা খাওয়ার ভয় না থাকলেও সবার কাছে ছোট
হয়ে থাকতে হবে। তার ওপর ফারহানা নিজেও বোঝে সে মোটেও
সুন্দরী নয়। ইদানিং ছেলেদের একটা বাই চেপে বসেছে¾ আর কিছু না হোক বউ সুন্দরী হওয়া চাই। দু’একটা
ইন্টারভিউ ইতোমধ্যে নিউমার্কেটে, রেস্তোরাঁয় বাবার দিকে
চেয়ে তাকে দিতে হয়েছে। কিন্তু ফলাফল একই¾
পত্রপাঠ বিদায়। মনে মনে ঘেন্না ধরে গেছে। একেবারে অপছন্দ করার মত কুশ্রীতো সে নয়।
কিন্তু ফারহানা জানে, বাবা মনে মনে খুব চিন্তিত¾
মেয়ের বয়স বেড়ে যাচ্ছে। এই বাবাটাই আরেক মাথা ব্যথা ফারহানার। বাবাকে কষ্ট দিতে মন
চায় না। আর বিয়ে করলেই যে সুখী হবো গ্যারান্টি আছে? কিন্তু বাবার ভালবাসা কাতর
দৃষ্টির সম্মুখে দাঁড়িয়ে মনে মনে কথা গুলো আওড়ালেও মুখ ফুটে বলতে পারে না।
¾ টিচার। বাচ্চাটির
ডাকে সম্বিত ফিরে পায় ফারহানা। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন তিনি। সারা ক্লাস জুড়ে সবগুলো
বাচ্চা হুড়োহড়ি শুরু করে দিয়েছে। একজন এসেছে নালিশ করতে¾ পাশের বন্ধু সারাহ্
তার পেন্সিলের শিস্ ভেঙে দিয়েছে। সারাহ্কে ডাকলেন ফারহানা। জানতে চাইলেন কেন
ভেঙেছে?
¾
ইচ্ছে করে ভাঙিনি তো। ঠোট ফুলিয়ে উত্তর দিল সারাহ্। চোখ দুটো তখনই টলমল করছে। “ছবি আঁকতে একটু চাপ দিলাম
অমনি ভেঙে গেল”
¾অকপট
স্বীকারোক্তি। ফারহানার ইচ্ছে করলো এক্ষুণি কোলে নিয়ে ওর গালটা টিপে দেয়। খুব
আদুরে মেয়ে। এবার অভিযোগকারীকে মিষ্টি করে ধমক লাগালেন ¾ ছিঃ তানভীর। ওতো ইচ্ছে করে ভাঙেনি। বন্ধুর নামে
কেউ নালিশ করে? যাও, পেন্সিল নিয়ে এসো। আমি আবার সুন্দর করে তুলে দিচ্ছি। দু’জনে প্রজাপতির মতো গিয়ে
সিটে বসলো।
ফারহানা পড়ানো শুরু করলেন। আবারো খালি
সিটটার দিকে দৃষ্টি গেল¾ কী হয়েছে মেয়েটির কে
জানে। অসুখ-বিসুখ না-কি অন্যকিছু। মনে হতেই আবারো মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কোথায় যেন
মেয়েটির সাথে তার একটা মিল আছে। তাইতো আরো বেশি মায়া তার জন্য।
মনে পড়ে¾
একদিন ক্লাসে সবাইকে টিফিন খেতে দিয়েছেন, হঠাৎ
দেখলেন একটি বাচ্চা খাচ্ছে না। ফারহানা কাছে এসে জানতে চেয়েছেন¾
¾
তুমি খাচ্ছো না যে?
¾
টিফিন আনি নি।
¾
কেন? মামণি ঘুম থেকে উঠেনি বুঝি?
¾
মামণিতো নেই।
তার বুকটা হঠাৎ
আঁৎকে উঠে। মা নেই! নিজের ছোট বেলার কথা মনে পড়েছিল।
কতদিন সকালবেলা না খেয়ে স্কুলে যেতে হতো। মা মারা যাবার পর বাবাই সবকিছু গুছিয়ে
দিতেন। তারপর নতুন মা এলেন। বাবা আগের মত দেখেন না। মায়ের ঘুম থেকে উঠতে দেরি হতো।
কখনো কাজের লোক ছিল না। ফারহানাকে প্রায়ই না খেয়ে স্কুলে যেতে হত। একদিন টের পেয়ে
বাবা স্কুলে টিফিন খাওয়ার জন্য হাতে টাকা গুঁজে দিলেন। বাবার কথা মনে হতেই
ফারহানার মনটা কেমন করে ওঠে। নিজের অজান্তেই মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
তারপর থেকে শুরু। প্রায় প্রতিদিনই তার খোঁজ
খবর করা ফারহানার ডিউটি হয়ে গেল। নানা সময়ে এটা-সেটা গিফ্ট দেয়া, টিফিন খাওয়ানো,
পড়ানোর অবসরে ওকে ডেকে গল্প করা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল। দুঃখ আরো বাড়লো, যেদিন
মেয়েটি বললো ঘরে তার সৎ মা এসেছে। আরেকদিন হাতের চামড়া ওঠা দেখে জিজ্ঞেস
করাতে বলেছিল¾ মা থাপ্পড় দিতে পড়ে
গিয়ে চোট লেগেছে।
শুনে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল ফারহানার।
আহারে! কেমন মানুষ! ছ-সাত বছরের একটা বাচ্চাকে এভাবে মারতে আছে। ক্লাস ছুটি হওয়ার
পরও মনটা ভারী হয়ে থাকলো তার।
পরদিন ক্লাসে আবার চোখ পড়ল সিটটার ওপর।
অন্য ছেলেমেয়েরা কলরব করছে। কিন্তু ও আসেনি। ক্লাসের দু’একজনকে কাছে ডাকল ফারহানা¾
তোমরা কেউ জানো পিয়া কেন আসছে না?
না, তারা কেউ জানে না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বার
বার মুখটা ভেসে উঠলো মনের পর্দায়। কি জানি কী হল মেয়েটার। যদি কোন অসুখ হয়ে থাকে
তাহলে কে দেখছে? এ ক’দিনে
যতটুকু জেনেছে তাতে এটুকু বোঝা গেছে, নতুন
মা তাকে মোটেও আদর করে না। কখনো ঠিকমতো খেতে দেয় না, আবার কখনো মারে।
ছুটির পর ফারহানা ঠিক করল, যেমন করে হোক পিয়াকে দেখতে যাবে। বাচ্চারা ঠিকানা না
জানলেও স্কুলের রেজিস্টার দেখে ঠিকানা খুঁজে নেবে। তাই হল। পরদিন স্কুল ছুটির পর
পরই ফারহানা ঠিকানা হাতে একটা রিক্সা নিল। পথে দোকান থেকে কিছু ফল আর চকলেট কিনল।
যেতে যেতে বার বার মনে হলো ¾ গিয়ে
না জানি কী দেখতে হয়।
কলিং
বেল টিপতেই দরজা খুললেন যিনি, তাকে দেখে এই ভরদুপুরেও মোহনীয় স্নিগ্ধতায় মন ভরে
গেল ফারহানার।
¾
এটা কি পিয়াদের বাসা?
¾
জ্বী, আপনি?
¾ আমি পিয়ার টিচার।
ওকি অসুস্থ? ক’দিন থেকে স্কুলে আসে না।
¾ আসুন, আসুন। আপনি
নিশ্চয় ওদের ক্লাস টিচার ফারহানা হাসান? পিয়ার গত ক’দিন
থেকে খুব জ্বর। জ্বরের মধ্যে ও আপনার কথা বার বার বলছিল।
¾ আপনি? কিছুটা
বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করে ফারহানা।
¾ আমি ওর মা। আরে,
আপনাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। আসুন, ভেতরে আসুন।
মহিলা সরাসরি তাকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেলেন। যেতে যেতেই ডাকলেন¾ পিয়া, কে এসেছে
দ্যাখ। তোর ফারহানা টিচার। তুই না খুব বলছিলি।
ঘরে ঢুকতেই দেখলেন, পিয়া উপুড় হয়ে
বালিশে মুখ গুঁজে আছে। মা টানাটানি শুরু করে দিলেন। ওমা! এ ক’দিন টিচারের জন্য কান্নাকাটি, আর এখন মুখ গুঁজে
আছে।
ফারহানা মাথায় হাত রাখলেন। এখনো অল্প
অল্প জ্বর। আবেগ মাখা কন্ঠে ডাক দিলেন¾ পিয়া। পিয়া ঘুরে তাকাল।
চোখে জ্বরের কারণে লালচে ভাব, অথচ কী আশ্চর্য মায়া। আরো আশ্চর্য পিয়ার চোখমুখ
অবিকল ওর মায়ের মত!
পিয়ার মা এ ভরদুপুরে কিছুতেই না খেয়ে
ছাড়বেন না। অগত্যা ফারহানাকে থাকতে হল। বলবো কি বলবো না দ্বিধা নিয়েও শেষ পর্যন্ত
ফারহানা পিয়ার মাকে জিজ্ঞেস করলেন¾ যদি কিছু মনে না করেন- একটা কথা বলব?
হেসে উঠলেন ভদ্রমহিলা¾ নিশ্চয় জিজ্ঞেস
করবেন, আমি পিয়ার সত্যি সত্যি মা কিনা? অথবা পিয়ার মা কখন মারা গেছে?
ফারহানা গম্ভীর স্বরে বললেন¾ হ্যাঁ।
এবার
বাঁধভাঙা হাসিতে ভেঙ্গে পড়লেন তিনি¾ এ
প্রশ্ন পাড়ায় নতুন এলে যে কেউ জিজ্ঞেস করে। পিয়া নাকি বলে তার মা নেই। সৎ
মা খুব কষ্ট দেয়। বলুন, নিজের মেয়ের এসব পাগলামী দেখে শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো?
এখন দেখছি স্কুল পর্যন্ত গড়িয়েছে। আসুক ওর বাবা। এর একটা বিহিত এবার না করলেই নয়।
ভিতরে
ভিতরে একটা প্রচন্ড ধাক্কা খেলেন ফারহানা। আশ্চর্য। এত সুন্দর মেয়েটার পেটে পেটে
এত দুর্বুদ্ধি! আর একেই কিনা ক্লাসে সবচেয়ে বেশি আদর করেছেন তিনি।
অনেকক্ষণ গল্প হলো পিয়ার মা’র সাথে। আদর-আপ্যায়ন করলেন যথেষ্ট। মহিলার সব
কিছুতে একটা আন্তরিকতার ছোঁয়া আছে। কিন্তু ফারহানা বাইরে সৌজন্য দেখালেও ভেতরটা
রাগে দুঃখে জ্বলে যাচ্ছিল। এত প্রতারক! আর অবাক কান্ড! মা অনেক টানাটানি করলেও
পিয়া একবারও তার সামনে এল না।
কয়েকদিন পর। ক্লাসে ঢুকতেই ফারহানার দৃষ্টি গেল আসনটার দিকে।
পিয়ার চোখে চোখ পড়তেই তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। না, ও মেয়ের দিকে আর তাকানোর
দরকার নেই। মিথ্যেবাদী।
ছুটির ঘন্টা পড়তেই দরজায় ছুটে গিয়ে দাঁড়াতে হলো। এ সময় বাচ্চারা
এত হুড়োহুড়ি করে বের হয় যে, ওদেরকে না ঠেকালে যে কোন মুহূর্তে একটা এক্সিডেন্ট
ঘটতে পারে। সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর ফারহানা দেখলেন পিয়া ওর সিটে মাথা নিচু করে বসে
আছে।
¾ কি তুমি গেলে না?
কন্ঠে বেশ রাগ ঝরিয়ে প্রশ্ন করলেন ফারহানা।
¾ বাবা আসবে আমাকে
নিতে।
¾“তাহলে আমার ডিউটি আরও কতক্ষণ বাড়লো”। রাগে গজ্ গজ্ করতে করতে স্বগতোক্তি করলো
ফারহানা। তারপর সময় কাটাতে পড়ে থাকা হোম টাস্কের খাতাগুলো দেখায় মন দিলেন।
¾ টিচার। একটা ক্ষীণ
কন্ঠের ডাক যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলেন, পিয়া কখন তার
চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফারহানা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
¾ টিচার। আবারো সেই
ক্ষীণ কন্ঠের ডাক। ফারহানা ঘুরে বসে তাকালেন।
¾ কিছু বলবে? অসুখে
ভুগে মুখটা কেমন ফ্যাকাশে, গাল দুটো ভেঙে গেছে। আগের টুলটুলে ভাব আর নেই। কিন্তু
কোলবসা চোখ দুটোতে আশ্চর্য মায়া। বুকের ভেতর কি যেন নড়েচড়ে উঠলো।
¾ তুমি আমার সঙ্গে এমন
মিথ্যে বললে কেন? মাথা নিচু করে রইল পিয়া।
¾ বলো পিয়া, কেন এমন
মিথ্যে কথা বললে? তোমার মা-বাবা সবাই আছেন, অথচ¾
¾ টিচার সত্যি কথা
বলবো?
¾ বলো।
¾ সেবার দাদী বেড়াতে
এসে অনেক গল্প শুনিয়েছিল। সিন্ডারেলা রাজকন্যা কাঞ্চণমালা। আমার এত ভাল লেগেছিল।
খালি মনে হয় আমি যদি সিন্ডারেলা হতাম। আমি আপনাকে বানিয়ে বানিয়ে ওসব বলেছি। আপনি
আমাকে বেশি আদর করবেন, সবাই জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু আমি আর কক্ষণো এসব করবো না। মা
বকেছে, বাবা বকেছে। আমার খুব মন খারাপ টিচার।
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো পিয়া। দু’হাত
বাড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলেন ফারহানা।
¾ তুমি সত্যি খুব
খারাপ কাজ করেছ। আর কোনদিন এ রকম বলবে না।
¾ না, আর কোনদিন বলবো
না। হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। কিন্তু আপনি আমাকে আদর করবেন তো।
¾ হ্যাঁ পিয়া, হ্যাঁ।
আমি তোমাকে খুব আদর করবো। খুব খুব।
মনের সব জ্বালা বান-ভাসি হয়ে ফারহানার চোখেও জল।
No comments:
Post a Comment