__________________________________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪
গল্প - অপ্রত্যাশিত আগন্তুক
__________________________________________
অপ্রত্যাশিত আগন্তুক
গলির মুখটাতে যখন ট্যাক্সি
থেকে নামলো ওরা তখন রাত সাড়ে এগারোটা। রায়হান আর রুমানা। মন পরিতৃপ্তিতে ভরাট।
অনেকদিন পর আজ একটি নিটোল সন্ধ্যা কাটল।
বিয়ের পর থেকে সংসার আর চাকরির টানা-পোড়েনে যেন ভুলতে বসেছিল মাত্র ছ’মাস আগে বিয়ে করেছে ওরা। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে রান্নাবান্না আর ঘর-দোর গুছিয়ে অফিসে ছোটা আর রাতে ফিরে এসে কোনমতে বিছানায় যাওয়া। জীবন বড় রুক্ষ আর কর্কশ হয়ে উঠেছিল।
অথচ এই জীবন নিয়ে ক্লাস পালিয়ে দু’জন কত স্বপ্ন দেখত। আজ সন্ধ্যার আনন্দ যেন গত ছ’মাসের কষ্ট আর মালিন্যকে ধুয়ে মুছে মনের ওপর
স্নিগ্ধতার প্রলেপ দিয়েছে।
ছ’বছর প্রেম করে ছ’মাস আগে বিয়ে করেছে ওরা। সেশন জট না থাকলে হয়তো
আরো দু’বছর আগেই করত। বাবার হিসেবে
রুমানার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছিল তাই পরীক্ষার পর পরই বিয়ের কথা বলেছেন।
বাধ্য হয়ে তখন মায়ের মাধ্যমে রায়হানের আবেদন পেশ করতে হয়েছিল।
কিন্তু বেকার ছেলের কাছে মেয়ে দিতে রাজী ছিলেন না বাবা। উপরন্তু তার শর্ত ছেলেকে
সরকারী চাকুরে হতে হবে। মেয়ের জীবনের নিরাপত্তা তাঁর কাছে ওটাই। তাই বাধ্য হয়ে
বাবা-মাকে ছেড়ে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়েটা সারতে হল।
মফস্বল থেকে পড়তে আসা রায়হানের আপন আত্মীয় বলতে কেউ ছিল না এই
শহরে। কী ভীষণ সঙ্কট। চাকুরি নেই, থাকার জায়গা নেই। কিন্তু রুমানাকে ছাড়া বাঁচবে
না।
সেই দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছিল ফারুক।
গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক মামাকে ধরে ওদের দু’জনকে
চাকরি জুটিয়ে দিল। একই গার্মেন্টস-এ সুপারভাইজার ওরা। সকাল ন’টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত একটানা কাজ। ইচ্ছে ছিল বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি
নেবে। কম্পিউটার শিখবে দু’জনে। আজকাল কম্পিউটার
না জানলেই নয়। মনে মনে একটা জেদও ছিল রায়হানের। বিসিএস অফিসার হয়ে রুমানার বাবার
সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু কিছুই করা হচ্ছে না।
মাঝে মাঝে সাপ্তাহিক ছুটির দিনটাও মাঠে মারা যায় কাজের চাপে।
তবু ফারুকের প্রতি, বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞ রায়হান। ওরা না থাকলে এ জীবনে রুমানাকে
পাওয়াই হতো না। সেই থেকে বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে ছিল মন। দু’জনে পরিকল্পনা করে ছ’মাস
ধরে একটু একটু করে সঞ্চয় করেছে।
আজ সন্ধ্যায় বন্ধুদের চাইনিজে ডেকেছিল। বিয়ের দাওয়াত দিতে না
পারার ক্ষোভটা পুষিয়ে নিয়েছে। রিজার্ভেশন করা টেবিলে রাত আটটা থেকে এগারোটা
পর্যন্ত বন্ধুদের নিয়ে ভীষণ আনন্দে কেটেছে। একটু বেশিই খরচ হয়েছে, তবু আফসোস নেই।
কারণ আনন্দটা তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল।
ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে দু’জনে
হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল সরু গলিটার ভিতর দিয়ে। সরু গলিতে রিক্সা ছাড়া আর কিছু
চলাচল করতে পারে না। তাই এ রাস্তাটুকু হেঁটে আসতে হয়। দু’পাশের
বাড়িগুলো দেখে মনে হয় যেন এক্ষুনি রাস্তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আশ্চর্য শহরের
মানুষগুলো নিজেদের বাঁচার জন্যেও একটু আলো বাতাস আসতে দিতে রাজি নয়।
বাসা খুঁজতে গিয়ে দেখেছে বেশির ভাগ প্রাইভেট এরিয়ার বাড়িগুলো
এমনি। পাশের দু’একটি বাড়িতে আলো জ্বলছে,
টেলিভিশন চলছে। দু’একটি বাড়ির জানালা দিয়ে আসা
তেরছা আলোয় ওরা সাবধানে পথ চলতে লাগল। একটু অসাবধান হলে পাশের ড্রেনে পড়া বিচিত্র
নয়।
রাস্তা যত খারাপই হোক তবু বাসাটা যে পেয়েছিল সেটাই ভাগ্য বলে
মানে রায়হান। মনে পড়ল, কাজি অফিসে বিয়ে পড়ানোর পর রুমানা গিয়েছিল হলে ওর বান্ধবীর
সঙ্গে ডাবলিং করতে আর সে বন্ধু মারুফের মেসে।
সে রাতে কি যে আকুলি বিকুলি করছিল মনটা! কোথায় বাসর! কোথায়
এতদিনের প্রতীক্ষার মধুর সমাপ্তি। তা নয়, একজন আরেকজন থেকে যোজন যোজন দূরে। তার
ওপর দু’জনের পরিবারই অসন্তুষ্ট।
নিজের পায়ে দাঁড়াবার আগে এভাবে হুট করে বিয়ে করা- সারাটা রাত একটুও ঘুম হয়নি।
কেবলই মনে হচ্ছিল- ধন নয়, মান নয়, একটুকু বাসা। যেখানে তাদের যৌথ জীবন শুরু হবে।
তারপর পর পর দু’দিন
বন্ধুরা মিলে সারা শহর চষে এ বাসাটা পেয়েছিল। হাতে টাকা নেই। ছোট বাসা পাওয়া
মুশকিল। গলির ভেতরের ছোট্ট এ বাসাটাকেই মনে হয়েছিল কল্পনার স্বর্গ।
"কী এত ভাবছ?"
রুমানার প্রশ্নে ঘোর ভাঙে রায়হানের। বাসার সামনে এসে গেছে।
বারান্দায় উঠে ব্যাগ হাতড়ে চাবিটা বের করে ওর হাতে দিল রুমানা। অভ্যস্ত হাতে
অন্ধকারেই চাবি ঘুরিয়ে তালা খুলল। দরজার পাল্লাটা খুলতেই এক ঝট্কা বাতাসে বিশ্রী
একটা গন্ধ নাকে এসে লাগল। সারাদিনের মেজাজটাই নষ্ট হয়ে গেল।
"উহ্! কিসের এমন গন্ধ!" বলতে বলতে নাকে হাতচাপা দিল।
"মাগো! মন হচ্ছে ইঁদুর-বিড়াল কিছু
একটা মরেছে। ওয়াক থু।"
ছুটে গিয়ে বারান্দার ধারটাতে দাঁড়াল রুমানা। ততক্ষণে দরজায়
দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বাতি জ্বালিয়েছে রায়হান।
ঘরে ঢুকেই অনুসন্ধানী
হয়ে উঠল রুমানা। দুর্গন্ধের উৎস আবিষ্কার করতে বেশিক্ষণ লাগল না। ময়লা ফেলার ঝুড়ি
থেকেই আসছে।
গতকাল সন্ধ্যায় বাজার করার পর জিনিসপত্র
গুছাতে গিয়ে অনেক রাত হয়ে পড়েছিল। মনে করেছিল, সকালে বাইরে যাওয়ার সময় একেবারে
নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলবে। সকালে তাড়াহুড়োয় আর মনে ছিল না। মাছ-সবজির খোসা পচে উৎকট
গন্ধ বেরুচ্ছে।
"আজ ঘরে থাকা যাবে না। পেটের খাবারগুলো যেন বেরিয়ে আসতে
চাইছে।"
"ওগুলো একটা পলিথিনে করে দাও। আমি ডাস্টবিনে ফেলে আসি।"
- ফ্যানের রেগুলেটর বাড়াতে বাড়াতে বলল রায়হান।
"দাঁড়াও আগে কাপড়টা ছেড়ে আসি। এই দামি শাড়িটা পরে ময়লা
ধরতে পারব না।"
ভাল করে ময়লার প্যাকেটটা বেঁধে রায়হানের হাতে দিল রুমানা।
"দরজা বন্ধ করে দাও। আমি নাম ধরে না ডাকলে দরজা খুলবে
না। আমি এই যাবো আর আসবো।"
রায়হানের সামনেই দরজা বন্ধ করল রুমানা। রায়হান হাঁটতে হাঁটতেই
ঘড়ি দেখল - বারোটা দশ। চারপাশটা আরো নীরব হয়ে গেছে।
দ্রুত পা চালিয়ে গলি পার হয়ে রাস্তায় পড়তেই আবছা আলোতে যেন
মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে এল তিনজন। ছায়ামূর্তির মত ঘিরে ধরল তাকে।
"এই কোথায় যাচ্ছিস?" - একজন জিজ্ঞেস করল।
মাথার তালু পর্যন্ত ঝাঁ করে গরম হয়ে উঠল
রায়হানের। একজন ভদ্রলোককে তুই তোকারি করা! মুখ তুলে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করতে চাইল।
কিন্তু লাইটপোস্টটা বেশ দূরে। তেমন স্পষ্ট হলো না কারো চেহারা। কিন্তু যেটুকু
অনুভব করল তাতে একটু আগের গরম হয়ে ওঠা মাথার ভিতর থেকেই একটা শিরশিরে অনুভূতি সারা
শরীর বেয়ে নিচের দিকে ছুটে গেল।
"এমন করে দেখছিস কী?
চোখ তুলে ফেলব। কোথায় যাচ্ছিস?"- আবার প্রশ্ন।
"ময়লা ফেলতে যাচ্ছি।" - যন্ত্রচালিতের মত হাতের পিলিথিনের ব্যাগটি তুলে
ওদের দেখাতে চেষ্টা করল রায়হান।
"কেন? ময়লা ফেলবি কেন?" - বলতে বলতে একজন পাঁজরের কাছে শক্ত কিছু একটা
ঠেসে ধরল।
"তাহলে কী করব?" - কিছু বুঝতে না পেরে নির্বোধের মত প্রশ্ন করে
রায়হান।
"কেন তুই খাবি, তোর বউ
খাবে" - বলতে বলতে একজন তার বাঁ হাতের কব্জিতে বাঁধা
ঘড়িটার দিকে হাত বাড়ায়।
রায়হান নড়ে না। ডান
পাঁজরের কাছে জিনিসটা এখনো শক্ত করে ধরা। ওটা কী? ছোরা না রিভলবার? রায়হান বুঝতে
পারে না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছে একটু এদিক ওদিক করা মানেই সাংঘাতিক একটা কিছু।
পকেটে হাত ঢুকিয়ে একজন
মানিব্যাগটা বের করে আনে। অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করে যা পেল তাতে খুশি হতে পারল না।
হোটেলের বিল আর ট্যাক্সিভাড়া দিয়ে তেমন কিছুই ছিল না। রেগে গেল মানিব্যাগ
অনুসন্ধানী - "এতরাতে ময়লা ফেলতে বেরিয়েছ
আর আমাদের জন্য কিছু রাখোনি। এরপর যদি এমন কর জান নিয়ে ঘরে ফিরতে দেব না। শা--লা" - বলতে বলতে কলার ধরে ঝাঁকুনি দিল।
"তাহলে কিন্তু
ময়লাগুলো সত্যি সত্যি খাইয়ে দেব। মনে থাকবে তো?"
কলের পুতুলের মত ঘাড় কাত
করল রায়হান - মনে থাকবে। তারপর যেমন আচমকা এসেছিল তেমনি আচমকা মিলিয়ে গেল ওরা।
রায়হান বুঝতে পারে না কোনদিক থেকে ওরা এসেছিল, কোথায় গেল।
ময়লা মোড়ানো পলিথিনটা দেখল। ওটা এখনো
হাতে ধরা। আর কয়েক পা এগোলেই ডাস্টবিন। কিন্তু সারাদিনের আনন্দ মুছে শরীর আর মন এত
বিষন্ন অবসাদে ভরে উঠেছে যে রায়হান বুঝতে পারে না ডাস্টবিনে ময়লা ফেলে সে আজ ঘরে
ফিরতে পারবে কি না।
ঘরে রুমানা একা। রাত বাড়ছে।
No comments:
Post a Comment