৯
নেভী সেন্টার
নেভী আমাদের কলেজের পরে
কলেজ শুরু করেছিল। শুরু করার আগে তাদের শিক্ষক আমাদের কলেজে এসে অনেক নিয়ম কানুন ও
তথ্য জেনে গিয়েছিল। তারপরও নেভীর অনেক ছাত্র-ছাত্রী শাহীনে ভর্তি হত। জানি না, এতে
সেই কলেজের শিক্ষকদের অহং-এ লাগত কিনা।
কারণ সেন্টার পড়ার পর সেই কলেজের অনেক পরিদর্শক আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকসুলভ
আচরণ করতেন না। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল, তারা খাতা দিতে দেরি করতেন, অথবা
অতিরিক্ত উত্তরপত্র দিতে যে সময় ব্যয় করতেন তাতে অনেক ভাল শিক্ষার্থীর মূল্যবান
সময় নষ্ট হত। স্বভাবতই এর একটা প্রতিফল ফলাফলে আসত। প্র্যাকটিকেলে শিক্ষার্থীদের
কম নম্বর দেয়া হত। এসব অবশ্য ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে শুনেছি, আমি নিজে সঠিক অবগত
নই।
এখন আবার ঘটনার উল্টোপিঠ। আমাদের অনেক
ছাত্র শাহীন থেকে এসএসসি পাশ করে নেভীতে পড়তে যায়। ১৯৯৬-র পরে সরকার নিয়ম করল, এক
কলেজের শিক্ষার্থী অন্য কলেজের সেন্টারে পরীক্ষা দেবে। এটাই হওয়া উচিত। কারণ যতই
আমরা বিবেকবান হতে চেষ্টা করি নিজেদের শিক্ষার্থীদের প্রতি কিছুটা দুর্বলতাতো
থাকেই।
নব্বইয়ের দশকে আশে-পাশে আরো দু-একটি
কলেজ প্রতিষ্ঠিত হল। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে কাটগড় বালিকা বিদ্যালয়
কলেজ হল, নেভীর প্রায় উল্টোদিকে ব্যরিস্টার সুলতান আহমেদের নামে একটি কলেজ হল। দুর্ভাগ্যক্রমে
আমাদের কলেজের HSC পরীক্ষার্থীদের জন্য ব্যারিস্টার সুলতান আহমেদ কলেজ
কেন্দ্রে হিসেবে বরাদ্দ হল। এর খারাপ প্রতিক্রিয়া যেটা হল- সেটা হচ্ছে ছাত্ররা
লেখাপড়ায় অতিরিক্ত অমনোযোগী হয়ে গেল। টেস্ট পরীক্ষায় কলেজে রি-টেস্টের নিয়ম ছিল।
তারা ৩টে পরীক্ষায় পাশ করলে বাকি দুটো রি-টেস্ট দিয়ে কোন রকমে উৎরে যেত। এরপর
পরীক্ষাকেন্দ্র ব্যারিস্টার সুলতান কলেজে। তাদেরকে আর পায় কে! কারণ সেখানে
বেঞ্চগুলো এত ছোট আর লাগালাগি ছিল যে পাশাপাশি, সামনে-পিছনে যে কোনভাবেই একজন
আরেকজনের খাতা দেখে অনায়াসে প্রশ্নোত্তর লিখতে পারত।
এতে অবশ্য আমাদের কিছু ভাল ছাত্র-ছাত্রী
খুব হতাশ হয়ে আমাদের কাছে আক্ষেপ করত। আমরাও চাইতাম না, কারণ প্রতিক্রিয়ায় উচ্চতর
ভর্তি পরীক্ষায় অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তারা ভাল
করত না। তবে অকপট সত্য স্বীকার করলে বলতেই হয়, আমাদের কিছু শিক্ষক চাইতেন পরীক্ষার
কেব্দ্র এখানেই থাকুক। কেননা ছাত্র-ছাত্রী কোনভাবে পাশ করে গেলে তাকে জবাবদিহি
করতে হবে না। কারণ একটা বাজে নিয়ম ছিল বোর্ড পরীক্ষায় একজন ছাত্র অকৃতকার্য হলেও
বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ মিটিং করে সর্বসমক্ষে শিক্ষকদের অপদস্থ করতেন। স্বভাবতই
বিজ্ঞান শাখার ছাত্ররাই বেশি ফেল করত এবং তাদেরকেই কথা শুনতে হত বেশি। সুতরাং মান
হারানোর চাইতে তাঁরা এটাই ভাল মনে করতেন।
অন্যদিকে স্কুলের পরীক্ষায় নিয়ম চালু
করা হয়েছিল দশ পার্সেন্টের বেশি শিক্ষার্থী কারো বিষয়ে অকৃতকার্য হলে তাকে ‘শোকজ’ দেয়া হবে। যদিও এটাকে
আমরা ঠাট্টা করে ‘শী-কেস’ বলতাম।
মেরুদন্ড আসলেই কি শিক্ষকদের আছে? থাকবে
কি করে! তাদের পরিবার প্রতিপালনের দায় আছে, মান সম্মানের বিষয় আছে সুতরাং অনেক
শিক্ষকই বেশিরভাগ ছাত্রকে টেনেটুনে পাশ করিয়ে ১০% এর নিচে রাখতেন।
আমাদের বাংলা নিয়ে ছিল সমস্যা। কারণ
ভাষা অত্যন্ত জটিল বিষয়। এতে বানান, বাক্য, পাঠ্যবিষয় সবকিছু দেখতে হত। আবার
মাতৃভাষা বাংলা হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা পাতার পর পাতা লিখে যেত- আর এসব লেখা
পড়তে গিয়ে নিজের মাথায়ই জট লেগে যেত। কিন্তু যে শিক্ষার্থী ফেল করবে তাকে আমি পাশ
করাব কিভাবে? নাহ দশ পার্সেন্ট আর বিশ পার্সেন্ট ফেল করলেও কর্তৃপক্ষ কখনো আমাকে
জবাবদিহি করেননি।
ফেল করার ভয়ে অনেক সময় কিছু ছাত্র
প্রাইভেটে পড়তে চাইত- কিন্তু আমিতো ক্লাসে পড়াচ্ছি প্রাইভেট পড়তে হবে কেন? এবং
কর্তৃপক্ষের আদেশে বাধ্য হয়ে বিশাল বিশাল নোট করতাম। কারণ তখন বাংলা প্রথম পত্র
পুরোটাই ছিল রচনামূলক।
উত্তরপত্র যাচাইয়ের একটা মান ছিল ৩৩%,
৪৫% ও ৬০% অর্থাৎ প্রথম বিভাগ পর্যন্ত। কেন যেন এর চেয়ে বেশি নম্বর হাতে উঠত না।
কারণ বোর্ডেও এর চেয়ে বেশি দেয়া হত না। সুতরাং কলেজে বেশি পেলে ছাত্রের উচ্চাশা
বেড়ে যাবে, বোর্ডে পাবে না- তখন হতাশ হবে। আর এটাও ঠিক ভাষা সৃজনশীল বিষয়। একটি
গল্প বা কবিতার প্রশ্নোত্তর বিভিন্ন শিক্ষার্থী বিভিন্ন ভাবে লিখতে পারে। ভাষা
বিজ্ঞানের চেয়ে কম জটিল বিষয় নয়। কারণ বিজ্ঞানের সূত্রও শুদ্ধভাষায় না লিখলে
বিষয়ের অর্থ ভজঘট পাকিয়ে যাবে। তবু কেন যেন বাংলাভাষা মাতৃভাষা বলে অনেকে
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলতেন, “বাংলায় আবার
ফেল করে নাকি!” তাদের বলতে
ইচ্ছে করত, ‘ভাই দুলাইন
শুদ্ধ বাংলা লিখে দেখানতো, অথবা প্রমিত বাংলা উচ্চারণে একটা লেকচার দিন!’ কিন্তু বলা হত না,
কারণ বাজে বিতর্কে জড়াতে ইচ্ছে করত না। আর অধিকাংশ শিক্ষকই সাহিত্যকে ব্রাত্যবিষয়
মনে করতেন। সিলেবাসের নোট মুখস্থ করা ছাড়া অনেক শিক্ষকই বই পড়ার ধার ধারতেন না।
আমি বাংলায় পাশ দুজন সহকর্মীকে প্রশ্ন করে অবাক হয়েছিলাম। তারা বঙ্কিমচন্দ্র না
পড়েই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ডিগ্রী নিয়েছেন। একজন আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণি পেয়েছিলেন। ইংরেজি ভাষার শিক্ষকরাও একই ধারণার বশবর্তী
ছিলেন। একমাত্র আবদুল কাইয়ুম নিজামী ছাড়া কোন ইংরেজি শিক্ষককেই আমি কখনো সাহিত্য
বিষয়ে কথা বলতে শুনিনি। পরের দিকেতো ইংরেজি থেকে সাহিত্যই উঠে গেল। কমুনিকেটিভ
ইংলিশের নামে comprehention থেকে সত্য-মিথ্যা, শূন্যস্থান পূরণ, প্রশ্নোত্তর
সম্পূর্ণ করা এসবই বেশি। এতে নম্বর পাওয়া গেলেও বিশ্বসাহিত্যের উন্নত ভাষা ইংরেজি
ভাষা সাহিত্য ও লেখক সম্পর্কে ছেলে-মেয়েরা কিছুই জানতে পারত না। কালচারাল কম্পিটিশনেও
বছরের পর বছর একই ইংরেজি কবিতার আবৃত্তি শুনেছি। দূর বিলাত বাদ দিলেও হাতের কাছে
রবীন্দ্রনাথের স্বকৃত অনুবাদ ‘গীতাঞ্জলি’ তো ছিল।
বিজ্ঞান আর ইংরেজি শিক্ষকেরা কলেজে জয়েন
করা মাত্র টিউশনীর বিষয়ে অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে উঠতেন। দু-একজনের কথা শুনেছি, যারা
কলেজের প্রথমবর্ষের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষাতে এমন কঠিন প্রশ্ন করতেন যে, ছাত্র-ছাত্রী
বাপ বাপ করে তাদের কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য ধর্ণা দিত। তারপর যখন বাণিজ্য শাখা
খোলা হল, তখন যারা বাণিজ্য পড়াতে এলেন তারা তো বাণিজ্য করবেনই। কারণ তারা বাণিজ্য
পড়ে জেনেছেন “টাকাই ঈশ্বর” বা Money is God. ততদিনে ইন্টারনেট
এসে গেছে। কিন্তু তখনও ডিজিটাল মোবাইল মহাদামী। তারা কিনছেন, কেউ গাড়ি কিনছেন, কেউ
ফ্ল্যাট বুকিং দিচ্ছেন। কলেজও অনুমতি দিয়েছে, ছুটির পর শিক্ষকরা কলেজেই প্রাইভেট
পড়াবেন, কলেজে সকল অবকাঠামোর সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে। অথচ অতীতে একটা সময় ছিল
হেডকোয়ার্টার থেকে প্রায়ই নোটিশ ছাপিয়ে জানতে চাওয়া হত একজন শিক্ষক কতজন ছাত্র
পড়ান। তাদের নির্দেশ ছিল পাঁচজনের বেশি ছাত্র কোন শিক্ষক প্রাইভেট পড়াতে পারবেন
না। এখন প্রশ্ন হল পাঁচজন যদি সুযোগ পায় বাকি পাঁচশো জন কোন অপরাধে বঞ্চিত হবে?
এই নোটিশ এলেই ফারুকী স্যার ক্ষেপে
যেতেন। কারণ গণিতের শিক্ষক হওয়ায় এবং ঘাঁটিতে (১২ কোয়ার্টারে) বাসা হওয়ার কারণে
অভিভাবকরাই তাঁকে অনেক আকুলি-বিকুলি করে অনুরোধ করত তাদের ছেলে মেয়েদের পড়াতে।
অন্যদিকে ঘাঁটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের সন্তানকে পড়ানোর জন্য তাঁকে তাদের
কোয়ার্টারে যেতে বাধ্য করত। চাকরির খাতিরে ভিতরের ধূমায়িত অসন্তোষ নিয়ে তাঁকে যেতে
হত।
ফারুকী স্যারের মত নীতিবান বা এক কথার
মানুষ আমাদের মধ্যে আর কেউ ছিল না। ক্লাস শুরুর পাঁচমিনিট আগেই তিনি দরজায় হাজির,
আবার ঘন্টা পড়ার সাথে সাথে পাঠদান শেষ বেরিয়ে যেতেন। তিনি ঘড়িও ব্যবহার করতেন না।
আমার মনে হয়, এরকম শিক্ষক বাংলাদেশে আরো দু-দশ হাজার থাকলে শিক্ষার চিত্রটাই
পাল্টে যেত। আমার মেয়ে রাকাও বলে, স্যারের কাছে গণিতের যে শিক্ষা পেয়েছি, বুয়েটেও
সেটা কাজে লেগেছে। আর ছোটজন একটু বেশি চঞ্চল কিন্তু লেখাপড়ায় ভাল ছিল বলে তাকে স্যার
একটু বিশেষ স্নেহ করতেন। এসএসসি পরীক্ষায় উচ্চতর গণিত পরীক্ষার পর তারা দেখা করতে
গেলে তিনি সবার কাছে জানতে চাইলেন, পরীক্ষা কেমন হয়েছে। সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে
উল্টো প্রশ্ন করেছিল- স্যার, আমাকে জ্ঞিজ্ঞেস করলেন না? স্যার হেসে বলেছিলেন, তুমি
কেমন দিয়েছ সেটাতো জানিই, ভাল না দিলে কাঁদবে আর ভাল দিলে হাসবে।
এটা ঠিক শাহীন কলেজে আমার চাকরি সূত্রে
আমার দুটি মেয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছ থেকে যে স্নেহ-মমতা ও যত্ন পেয়েছে তার জন্য
তারা এবং আমি শাহীনের কাছে চিরঋণী থাকব।
মনে পড়ছে, রাকার এসএসসি পরীক্ষার
রেজাল্ট যে আশানুরূপ হয়নি সেটা বুঝেছি বর্তমান অধ্যক্ষ নাসির ভাইয়ের শহর থেকে
ফলাফল নিয়ে কলেজে ঢুকার সময়। তাকে অত্যধিক স্নেহ করতেন বলে, তার ফর্সা চেহারা লাল
টকটকে হয়ে উঠেছিল। মনের কষ্ট মুখে ফুটে উঠেছিল। রাকার নম্র স্বভাবের জন্য সকল
শিক্ষকই তাকে স্নেহ করতেন এবং লেখাপড়ায় সিরিয়াস হওয়ার কারণে ভাল ফলাফল প্রত্যাশা
করতেন। আমার মনে হয় তার আগে শাহীন চট্টগ্রামের ছাত্রীতো নয় কোন ছাত্রও বুয়েটে
যায়নি। অনেক সিনিয়ার এবং আমার খুব প্রিয় ছাত্র মাহাবুবুর রশীদ নেভীতে কমিশনড
অফিসার হিসেবে জয়েন করে বুয়েটে পড়তে গিয়েছিল, তখন রাকাও পড়ে। এ বিষয়ে আমার স্মৃতি
এটাই বলে। মেরিনে, সামরিক বাহিনীতে, মেডিকেলে যেতে চাইলেও তখনও বুয়েট প্রজন্ম
শাহীন কলেজে ততোটা জনপ্রিয় ছিল না।
ছোটমেয়ে
দিঠির ব্যাপারে সব শিক্ষকের কমপ্লেন ছিল, ক্লাসে খুব কথা বলে, কিন্তু পড়া ধরলে
সাথে সাথে উত্তর দেয়। এতে তাঁরা শাস্তিও দিতে পারতেন না। মাঝে মাঝে আমার কাছে
স্নেহমাখাস্বরে অনুযোগ করতেন। মহীউদ্দীন স্যার আদর করেই বলতেন, ‘বড়টা ছিল ফেরেশতা আর
তুই একটা শয়তান’। এতে সে
খুব মজা পেত। এটাই ছিল শাহীনেরর বৈশিষ্ট্য, ওনার বকা শোনার জন্য এবং মার খাওয়ার
জন্য ছেলেরা বিশেষত আগ বাড়িয়ে স্যারকে রাগাতে চেষ্টা করত। কারণ তারা জানত,
এটা তাঁর স্নেহের বহিঃপ্রকাশ।
আমরা যখন জয়েন করি তখন শাহীনে শিক্ষকদের
বেতন কাঠামো ছিল- বিএ পাশদের পাঁচশো টাকা, এমএ পাশদের ছ’শো টাকা। বাড়িভাড়া সম্ভবত ছিল না। তিন মাস
পর পর সরকারী অনুদান আসত। সেটাও তত বেশি ছিল না। সেটা পাওয়ার জন্য ডিডিপিআই অফিসে
ঘুষ দিয়ে, ধরাধরি করে শিক্ষকদের নাম এমপিও ভুক্ত করতে হতো। ঐ অফিসটা ছিল দুর্নীতির
আখড়া। অবশ্য এখনো তাই। একজন শিক্ষককে এমপিও ভুক্ত করতে এখন অনেক বেশি টাকা খরচ
করতে হয়।
বছরে আমাদের ইনক্রিমেন্ট ছিল কলেজ থেকে
একশো টাকা! অন্যদিকে সরকার বাসাভাড়া দিত একশো আর চিকিৎসাভাতাও দিত ১০০ টাকা। আমরা
যোগ দেবার পর পর বিমান বাহিনী নিজস্ব পে-স্কেল করল। তখন আমাদের বেতন হল ১১৫০ টাকা,
সাথে সরকারী অনুদান। এটা মোটামুটি ভাল ছিল সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে।
কিন্তু কর্তৃপক্ষ যেভাবে আমাদের কাছে
শ্রম এবং dedication চাইতেন সেটার জন্য এ সম্মানী
একেবারেই অপ্রতুল ছিল। তারা সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে তাদেরকে যেমন সবসময়
standby থাকতে হত। সুতরাং তাদের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধাও ছিল বেশি। খামারের সস্তা
দুধ, চিকিৎসা, রেশন এবং অন্যান্য আরো নানারকম ভাতা। কিন্তু আমরা
যখনই কোন সুবিধা চাইতাম তখনই তারা শুধু ‘ডেডিকেশান’ এর দোহাই দিতেন। আরে বাবা, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’। তবুও জীবনধারণের জন্য
মেনে নিতে হত- একশো টাকা বাসাভাড়া আর একশো টাকা চিকিৎসাভাতার সরকারী অনুদান!
১৯৮৮ সালে (সম্ভবত) বিমান সদর দপ্তরের
‘শিক্ষা উইং’ থেকে বেসরকারী
শিক্ষক নীতিমালার আলোকে শিক্ষক-কর্মচারীদের ‘সার্ভিস রেগুলেশন’ প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেখানে নৈমিত্তিক
ছুটি ধার্য করা হল ১৫ দিন। অথচ তখন সর্বত্রই এটি ছিল বিশ দিন। প্রসূতি ছুটি
একমাস।
নতুন পে স্কেল করা হল সরকারী স্কেলের সাথে
সামঞ্জস্য রেখে। নিয়ম করা হল সরকার যখন অনুদান দেবে তখন আমরা শুধু সাইন করে দেব। কিন্তু বিমানবাহিনী
কর্তৃপক্ষ সরকারী পে-স্কেল অনুযায়ী আমাদের বেতন ও বাড়ি ভাড়া ৪৫% দেবেন। বার্ষিক বেতন
বৃদ্ধিও সরকারী নিয়মে হবে। এতে সরকার (৯০ সালের আগে) শিক্ষক কল্যাণ
তহবিল ও অবসর ভাতা অনুমোদন করেনি। এগুলো ধাপে ধাপে হয়েছে। তখন বিমানবাহিনী
চাকরি বিধিমালায় করা হল পারিতোষিক বা গ্র্যাচুইটি দেয়া হবে কিন্তু- কিন্তু কি! যদি কেউ বিশ
বছর বা পঁচিশ বছর চাকরি করেও অবসরের একদিন আগেও স্বেচ্ছা অবসরে যান তাহলে তিনি কোন
গ্র্যাচুইটি পাবেন না। আমরা প্রতিবাদ করলাম এটা কি করে হয়। যে কোন বেসরকারী
প্রতিষ্ঠানেও আছে পাঁচ-দশবছর (কমপক্ষে) চাকরি করলে সে কিছু লামসাম পায়। আমরা কিছুই
পাব না? একেকজন শিক্ষক দাঁড়িয়ে ৫/৬ ঘন্টা ক্লাস নিচ্ছেন, ঘরেও সময় দিচ্ছেন খাতা
দেখায়, স্পোর্টস, কালচারে ছুটির দিনেও কলেজে আসছেন তারপরও তাকে যেতে হবে
শূন্যহাতে!
শুরু হল বাদানুবাদ। আমরা কর্তৃপক্ষের
সাথে মিটিং করি। তারা বলেন, শিক্ষকতা মহৎ পেশা! এখানে ডেডিকেশান চাই। কিন্তু
ওনাদের কাপড় ধোয়ার চার্জও সরকার দেবে আর আমাদের সাবান কেনার পয়সাও পাব না। রেশন আর
এমআই রুমে প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধা চাইলেও – তারা নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করতেন।
প্রথমদিকে মুখচেনা খাতিরে এমআই রুমের
টেকনিশিয়ান, নার্সরা নিতান্ত অপারগতায় গেলে একটু খাতির দেখালেও শেষের দিকে তাদের
আচরণ খুব বাজে হয়ে গিয়েছিল। এসব কারণে রাতে-বিরাতে কোন বিপদে না পড়লে শিক্ষকরা ওমুখো
হতেন না।
অনেক আগের নিয়মে আমাদের মাঝে খুব সিনিয়র
একজনকে কনভেন্স এলাউন্স দেয়া হত। অন্য শিক্ষকরা যারা শহর থেকে আসত তারা বিমান
বাহিনীর গাড়িতে আসত এবং বাচ্চারাও আসত। তখন শহর থেকে একজন অফিসার আসতেন সে গাড়িতে।
তিনি যখন গাড়িতে যাতায়াত ছেড়ে দিলেন তখন ১৯৯৮ সালে গাড়ি বন্ধ করে দেয়া হল। এর ফলে
শিক্ষক, বিমানসেনা ও অন্যান্য কর্মচারীদের যাতায়াত সঙ্কট দেখা দিল। শিক্ষকদের
উদ্যোগে প্রাইভেট বাসভাড়া করে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গাড়ি চালু হল। কিন্তু তাতে আর
কতটুকু হয়। শহর থেকেইতো বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রী আসত। আর বারেক নামে কাটগড়ের এক
বাসমালিক যত লক্কড়-ঝক্কড় বাস আর মাদকাসক্ত ড্রাইভার দিত। ফলে যত্রতত্র বাস হাঁটু
ভেঙে বসে যেত। তখন আরেক ঝঞ্ঝাট, পথে নেমে আবার ট্যাক্সি-বাস খোঁজ। তবে বেশিরভাগ
ছাত্রই পাবলিক বাসে যাতায়াত করত।
এরই মাঝে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ঘটল এক
দুর্ঘটনা। লোকাল বাসগুলোর যে কোন জায়গায় গাড়ী থামাত এবং পারলে বাড়ি থেকে লোক এসে
বাসে উঠত। এরা ধৈর্য ধরে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করত আর বাসের ভিতরের যাত্রীরা
অধৈর্য হয়ে উঠত। এরকম পরিস্থিতিতে একদিন আমাদের এক ছাত্র বাসের সিটে বসে
ঝিমাচ্ছিল। অনেকক্ষণ বাস চলছে না দেখে তার পাশেরজন (সম্ভবত) রেগে বাসের জানালার
কাচে ঘুষি মারল। ঝনঝন করে কাচ ভেঙে পড়ার সাথে সাথে সবাই সচকিত হল। কন্ডাক্টার এসে
আমাদের ছাত্রটিকে অপরাধী ভেবে তাকেই গালিগালাজ শুরু করল। ছেলেটিও আচমকা ঘুম ভেঙে
কিছু বুঝতে না পেরে রেগে বলল, শুধু ভাঙব না, কাচ তোর পেটে ঢুকিয়ে দেব হারামজাদা। আর
যায় কোথায়। ড্রাইভার, কন্ডাক্টর মিলে সে ছেলেকে ধরে রেখে অন্য বাসের চালক ও
সহকারীদের ডেকে এই মারে তো সেই মারে! এদিকে অন্য বাসে আরো কিছু ছাত্র ছিল। তারা
দেখে কোনমতে ধেয়ে এসে কলেজে খবর দিল শাহীনের ছাত্রকে ইপিজেড-এ বেঁধে রাখা হয়েছে।
তখন সবেমাত্র ক্লাস বসেছে। শিক্ষকরা
ক্লাসে ঢুকেছেন। এরই মাঝে এই খবরে তাঁরা কিছু বুঝে ওঠার আগে হুড়মুড় করে ছাত্ররা
ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়ল স্রোতের মত। তারপর হাতের কাছে গাছের ডাল থেকে শুরু করে যে
যা পেল তাই হাতে নিয়ে এমবারকেশান গেটের দিকে দৌড়াল।
উত্তেজিত ছাত্ররা শহর থেকে আসা বাসের
অপেক্ষা না করে উল্টোদিক অর্থাৎ পতেঙ্গা থেকে আসা বাসকে আক্রমণ করল। বাস ভাঙচুর
এবং ড্রাইভার আহত হওয়ার পর ঘাঁটিতে খবর রটে গেল।
উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বাসটি ভেতরে এনে
রাখলেন। ড্রাইভার কে এমআই রুমে প্রায় ৭দিন চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ দিয়ে মিটমাট হল।
বাসভাঙায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল অপরাধ অনুযায়ী তাদের ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত
জরিমানা করা হয়েছিল। প্রধান নেতাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হল। আর মজার ব্যাপার
হল, তখন এসএসসি’র রেজাল্টের
পর নতুন ভর্তির সময় একজন এসেছিল ফরম নিতে। সেও এই যুদ্ধে লাঠি সোটা নিয়ে সামিল
হওয়াতে তাকে আর ফরম দেয়া হল না।
এই আকস্মিক ঘটনায় শিক্ষকদের কোন ভূমিকাই
ছিল না। তবুও তাঁরা দিগবিদিকশূন্য হয়ে ছাত্রদের থামাতে ছুটে গেলেন। অথচ পরে তাদের
কয়েকজনকে কোন কারণ ছাড়াই ‘শো-কজ’ দেয়া হল। স্থানীয়
কর্তৃপক্ষ মিটিং ডেকে ইচ্ছেমত শিক্ষকদের গঞ্জণা দিলেন এবং তারপর?
তারপর ঢাকা থেকে এলেন বিমান বাহিনীর
এডুকেশন ডাইরেক্টর দস্তগীর সাহেব। তাঁর রূঢ় আচরণের কথা আগেই শুনেছিলাম। তিনি এলেন।
অধ্যক্ষের কক্ষে আমরা শিক্ষকরা চারপাশে স্থানু হয়ে দাঁড়ালাম। তিনি ইচ্ছেমত
শিক্ষকদের তিরস্কার করলেন। ভাগ্যিস তাঁর হাতে ঝাড়ু ছিল না। তাহলে হয়তো সবাইকে
ঝাড়ুপেটা করতেন। তিরস্কার শেষ করে তিনি গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। আমরা অকারণ অপরাধের
গঞ্জনায় বিষণ্ণ এবং কুঁজো হয়ে গেলাম।
জানি না এই দস্তগীর সাহেব কোথায় আছেন
কিন্তু আজো তার কথা মনে হলে এক ধরণের বিবমিষা হয়।
এরপর থেকে নতুন ব্যাচ ভর্তি হলে এই ঘটনা
বর্ণনা দিয়ে তাদের সাবধান করতাম। না তারপর আর এমন ঘটেনি।
আগেই বলেছি কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া
প্রতিযোগিতার হিট নেয়া শুরু হলে আশি-নব্বইয়ের দশকে প্রতিযোগিদের জন্য আয়া-পিয়নরা
মাঠে আদা-লেবু-পানি নিয়ে হাজির থাকত। টিফিন পিরিয়ডে প্র্যাকটিসের শেষ কয়েকদিন
শিক্ষকদের চা-সিঙ্গারা দেয়া হত। পরে একজন একাউন্টস কর্মকর্তা এলেন যিনি এই সব কিছু
ছেঁটে দিলেন। এমনকি ফাইনালের দুদিন হাউজমাষ্টারদের কাছে বাচ্চাদের জন্য লজেন্সের
প্যাকেট দেয়া হত - দিনে দিনে প্যাকেটের সংখ্যাও কমে এল। শুধু যারা প্রতিযোগী তাদের
হিসেব করে দেয়া হত। অথচ আমরা স্কুলে পড়ার সময়ও ফাইনালের দিন নাস্তা দেয়া হত।
শাহীনের শিশুরা এ বিষয়ে বড়ই অভাগা।
বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক
প্রতিযোগিতার সময় শিক্ষকদের পর পর দুদিন সারাদিন কলেজে থাকতে হত। এর ফলে
শিক্ষক-কর্মচারী এবং প্যারেড কমান্ডার, পিটিআই এদের সবার জন্য খাবার ব্যবস্থা করা
হত। নব্বইয়ের দশকের সেই হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সেগুলো এত কেটে ছেঁটে বাজেট করতেন যে
আমাদের মনে হত এ খাবার না খাই। আমরা বলতাম, ‘বাসা থেকে এনে খাব’। কিন্তু সবার কথাতো ভাবতে হবে!
একবার এমনও হয়েছিল কি একটা উপলক্ষে
দুপুরে থাকার কারণে শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য খুব সামান্য বাজেটে খাবার আনানো
হয়েছিল। পরে উপর থেকে জবাবদিহি করার পর শিক্ষকরা ত্রিশ টাকা হিসেবে সে টাকা ফেরত
দিয়েছিলেন। এটা ঘটেছিল মোয়াজ্জেম হোসেনের সময়ে। এজন্যই বোধহয় লোকে বলে কোন কোন
পেশার লোকের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে হয় না। তাদের মাঝে এই একাউন্টেন্ট প্রজাতিও
অন্যতম।
আমাদের কলেজ ভবনের উল্টোদিকেই ছিল
রিক্রুটস ট্রেনিং স্কুল। ননকমিশনড বিমান সেনাদের রিক্রুট করে এখানে দশ মাস ট্রেনিং
দিয়ে তারপর বিভিন্ন ট্রেডে নিয়োগ দেয়া হত। এরা ভুল করলে শাস্তি পেত এবং সেটা অনেক সময়
চোখে দেখে সহ্য করতে কষ্ট হত। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ সর্বত্রই অত্যন্ত কঠিন এবং
সিনিয়রদের র্যাগিং ছিল ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এটা ক্যাডেট কলেজ, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং,
সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে বেশি হত। সময় মনে নেই, মেরিনে সিনিয়রদের এই র্যাগিং এর কবলে
পড়ে কোন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান মারা গিয়েছিল এবং এটা নিয়ে গোপনে অনেক তোলপাড়
হয়েছিল। আমার নিজের চাচাত দেবর মেরিনে ভর্তি হয়ে শেষে বন্ড দিয়ে মুক্তি নিয়ে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। অর্থনীতিতে পড়াশোনা করে সে এখন সফল ও
স্বাবলম্বী।
তো এসব রিক্রুটদের যখন রাস্তার পাশ দিয়ে
বোঝা নিয়ে ডিগবাজী খেতে খেতে যেতে দেখতাম তখন ঐ বাচ্চাগুলোর জন্য কষ্ট হত। আবার এটাও উপলব্ধি
করতাম সৈনিকের কঠোর কর্তব্য সাধনে ওদেরকে এভাবেই কঠিন সাধনার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। মাঝে মাঝে শুনতাম
কষ্ট সইতে না পেরে দু-একজন পালিয়ে যেত। কিন্তু ওদের হেয়ারকাট এমন
ছিল যে যে কোন জায়গা থেকে ধরা পড়ে ঠিকই ফেরত আসতে হত। অফিসার আত্মীয়স্বজনদের কাছে
শুনেছি তাদের ট্রেনিং আরো অনেক বেশি কঠোর এবং দীর্ঘ সময়। লংকোর্সে আড়াই বছর।
বাইরের জীবন থেকে ঘাঁটির জীবন পরিবেশ সত্যিকার অর্থেই ছিল অনেক বেশি সুশৃঙ্খল
নিয়মানুবর্তী ও নিরাপদ।
তবু অতি নিয়মের ভার সইতে না পেরে অনেক
সময় কিছু দুর্ঘটনাও ঘটত। একবার যশোরে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটেছিল। একজন বিমানসেনা
সম্ভবত অনেকদিন ছুটি চেয়ে না পেয়ে দিনে দিনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। একদিন মতিউর
ঘাঁটির সেন্ট্রাল মসজিদে নামাজ পড়া অবস্থায় আচমকা গুলি চালিয়ে সে অনেককে খুন করে,
যাদের মধ্যে শিশু-কিশোরও ছিল। এই ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ মনে হয় কিছুটা নমনীয় হয়েছিল
পরিস্থিতি বিবেচনা করে। তারপর থেকে কাধেঁ ভারী ব্যাগ নিয়ে ডিগবাজী দেওয়া সম্ভবত
বন্ধ হয়েছিল। কারণ পরে এটা আর চোখে তেমন পড়েনি।
আরেকটা ব্যাপার কখনো কখনো ঘটত। সেটা
হচ্ছে- জেওসি বা ননকমিশনড থেকে যোগ্যতার বিচারে কাউকে কাউকে পরীক্ষা নিয়ে কমিশনড
করা হত। এদের মধ্যে দু-একজন র্যাংক পরিবর্তনের সাথে সাথে স্ত্রীও পরিবর্তন করতেন।
নামের আদ্যাক্ষর ‘ন’ এরকম একজনকে আমি
চাক্ষুষ করেছি যিনি পূর্বতন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে নতুন পাণিগ্রহণ করেছিলেন।
কিছু কিছু শিশুও ছিল বাবার পদবীকে তারা
নিজেদের পদবী মনে করত। স্কুল বাসে আসা যাওয়ার সময় এমইএস থেকে বাচ্চারা উঠলে তাদের
সাথে ক্লাস টুতে পড়া ‘উ’ নামের একজন অফিসারের
সেই মেয়েটির অভদ্র আচরণ আমাকে বিস্মিত করত। খুব ভাল আর খুব বাজে জিনিস বোধহয়
মানুষের স্মৃতিতে বেশি গেঁথে থাকে মাঝামাঝিতে হারিয়ে যায়। নয়তো এসব স্মৃতি এখনও
চোখের সামনে টাটকা দেখতে পাই কেন?
No comments:
Post a Comment