Sunday, 23 February 2025

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ২৩ - ২৪



 -----------------------------------

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫

___________________________________

২৩

 

বাড়ির ছেলেমেয়েরা সবাই টেবিল ঘিরে বসেছে যাদের জায়গা হয়নি তারা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে চেয়ার নিয়ে বসেছে টেবিলে ডাঁই করা খাবার- পিঠা, মাংস, সেমাই, ফল যার যেটা খুশি সেটা নিচ্ছে অরিনের উল্টোদিকের চেয়ারে বসেছে অভী অরিন চোখ তুলে তাকাতে পারছে না রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে অভীর দিকে তাকাতে লজ্জা লাগছে একটা নতুন সম্পর্কে বাঁধা পড়ার শিহরণ

          "কী অভীভাইয়া সারাক্ষণ এত পটর পটর কর আপুর পিছনে লাগ আজকে দেখি একেবারে চুপচাপ What’s the matter?

          "তোকে দেখে সকাল থেকে একটা কবিতা মনে পড়ছে, তাই কথা বলছি না"

          "শুনি শুনি কী কবিতা, তুমিতো আবার বাংলা কবিতার container.

          "তুই শুনে বুঝতে পারবি? হয়েছিসতো একটা বুদ্ধু বাংলিশ তোদের মতগুলোকে আগে বাংলায় কী বলতো জানিস- ফিরিঙ্গী"

          "বাজে কথা বলোনা Why are you trying to irritate me? কবিতা না জানলে শোনাবে না"

          অভী হেসে উঠে "অমনি রাগ হলো আহা হা আমার sweet sister. Don’t be angry. শোন কবিতাটা- দোহাই তোদের একটু চুপ কর, ভালবাসিবারে আমায় দে অবসর"

          বলতে বলতেই লক্ষ করল অরিনের মাথাটা আরও নিচু হয়ে টেবিলে ঠেকে যাচ্ছে

          "ভাল করে বুঝতে পারলাম না দোহাই, দোহাই means for God’s sake. আর অবসর অবসর What does it means retired? No, no I am sorry. অবসর, অবসর"

          "আর ভাবতে হবে না শোন এটা ইংরেজি কবি লিখেছেন এরকম- For God’s sake, hold your tounge and let me love."

            "তা তোমার লাভলী ফিঁয়াসেটা কে?"

            চকিতে আরেকবার অরিনের দিকে তাকাল অভী তারপর বলল, "সেটা জেনে তোর লাভ কী? তুই যে নোস সেটা তো বুঝিস my baby sister.

          "ইস I don’t like this type of goody goody boy. Mother’s baby. পচু"

          অভী হেসে উঠল "ঠিক আছে তুই father’s baby থাক আর একটা incredible hulk খুঁজে নে"

          এবার উপস্থিত অন্যরাও হেসে উঠল

          মালিহা এতক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখছিল এদের কান্ডকারখানা এই ছেলেমেয়েগুলো তার কাজিন অথচ পরিচয়ও নেই এক টেবিলে বসে ওরা খাচ্ছে অথচ কেউ কারো সাথে কথা বলছে না সকালে বাবা আর মেজকাকা এমন করল যে ওরা সবাই তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল

দিদা হসপিটালে এ্যাডমিট হওয়ার পর মা শুধু বলত, "এবার তোর বাবা-কাকারা মিলবে হাজার হোক মা তো মায়ের মৃত্যুতে এক ভাই আরেক ভাইকে জড়িয়ে ধরবে না তা কী হয়?" অথচ কাল থেকে আজ পর্যন্ত কেউ কারো দিকে তাকাল না

          "এ্যাই তোমার নাম মালিহা না?"

          "জী," মালিহা উত্তর দিল

          "আমাকে চেন? আমি আরিয়ানার অভী ভাইয়া ওর cousin

          "জী"

              "তাহলে আমি তোমারও কাজিন তাই না? We are relatives. so এখন আসো, আমরা একসাথে গল্প করি তোমার ভাইয়ের নাম যেন কী?"

              "ইফতি"

              "হ্যাঁ, হ্যাঁ, ইফতি হ্যালো ইফতি এখানে আসো তুমি এত দূরে কেন?"

          ইফতি মজা করে গরুর মাংসের ঝোল মাখিয়ে পিঠা খাচ্ছিল তার উঠতে ইচ্ছে করছে না তবু প্লেটটা হাতে করে উঠে এল

          আর যারা ইতিউতি ছড়িয়ে ছিল তাদেরকেও কাছে ডাকল অভী সবার সাথে পরিচয় করল তারপর বলল, "আজ সকালে আমি গ্রামটা একটু ঘুরে এসেছি খুব সুন্দর একটু দূরে নাকি একটা নদী আছে চল আমরা সবাই মিলে গ্রামটা ঘুরে দেখি কি রাজি?"

          মালিহা উচ্ছ্বসিত হাত তুলে বললো, "হ্যাঁ ভাইয়া"

              অরিন তাকালো মালিহার দিকে চোখ দুটো খুব মায়াময় ছোট থাকতে দু-একবার দেখেছে তারপর বহুদিন আর দেখা হয়নি মালিহাও হাসিমুখে অরিনের দিকে তাকাল জ্ঞিজ্ঞেস করল, "তুমি যাবে তো অরিন আপু?"

              "হুঁ, সে না গেলে অভীভাইয়া যাবে নাকি?" একটু চোখ ঠেরে বলল আরিয়ানা

          "আরিয়ানা, কী হচ্ছে?" অরিন মৃদু ধমক দিল

          "হ্যাঁ, আমি কিছু বুঝি না, না? For God sake hold your tounge and let me love- কাকে বলা হচ্ছে?"

          অরিনের মুখটা লাল হয়ে উঠল আরিয়ানা হি হি করে হেসে উঠল "আমার মাত্র দু বছরের বড় বোনটা আমাকে এত বোকা ভাবে"

          কথা ঘুরাতে অভী তাড়াতাড়ি বলল, "সবার খাওয়া শেষ চলো, এবার আমরা বেরিয়ে পড়ি"

          সবাই উঠে অভীর পিছু নিল অরিন তখনও বসে আছে দেখে আরিয়ানা খোঁচা দিল, "আপু যাবি না? তোর হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা যে চলে যাচ্ছে চল চল।" বলতে বলতে বোনের হাত ধরে টান দিল সে

 

****

২৪

 

চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিল মামুন আর শীলা

          "রাস্তায় মাথায় যাব, যাবে?" মামুন বল রিক্সাওয়ালাকে

          "না, না, রাস্তার মাথায় না চলো শহরে যাই অনেকদিন শহরটা দেখি না ওখান থেকে না হয় বাস ধরব"

          "ঠিক আছে চলো"

          রিক্সায় উঠে শীলা বলল, "একটু আস্তে আস্তে যাবেন ভাই, চারপাশটা একটু দেখতে দেখতে যাব চিন্তা করবেন না আপনাকে সেভাবে টাকা দেব"

          "জী আইচ্ছা" বলে রিক্সাঅলা প্যাডেলে চাপ দিল হেমন্তের রোদ হলেও রোদটা বেশ চড়া

          "হুড তুলে দেব?"

          "না, না" শীলার কথাটা ব্যাকুল শোনাল "একটু দেখতে দেখতে যাব কতদিন পর এলাম আর কী জীবনে আসব জানো মামুন এই গ্রামটাকে এত আপন জেনে বড় হয়েছি যে একসময় মৃত্যুর কথা মনে হলে ভাবতাম এখানেই আমি বাবা-আম্মার পাশে চিরদিন ঘুমাব"

          "থাক না ওসব এখনই এত মৃত্যু চিন্তার দরকার কী"

          "না, তা নয় আমি আসলে আমার ইচ্ছাটার কথা বললাম" দুপাশে তাকাতে তাকাতে শীলা বলল

          রাস্তাটা পাকা হয়েছে কিন্তু আগে যেমন দুপাশে যতদূর তাকানো যায় ফসলের মাঠ দেখা যেত দূরে দিগন্ত রেখা পর্যন্ত এখন তেমন নেই রাস্তার পাশে কিছু পর পরই দৃষ্টি আড়াল করে ঘরবাড়ি উঠেছে শীলার মনে পড়ছে এই রাস্তা দিয়ে কত অসখ্যবার যাওয়া আসা করেছে ছোটবেলায় এই রাস্তা দিয়ে বাবার হাত ধরে নদীর পাড়ে যেত

          হায়রে, কোথায় গেল সেসব দিন বাবার সাথে পুকুরপাড়ে বসে থাকা মসজিদের সামনে বড় আমগাছটার ছায়ায় বসে আপনমনে খেলা পাশে বাবা বসে থাকত, লোকজন এসে কথা বলত সেই ছোট্ট শীলা দিনে দিনে বড় হল কিন্তু বাবার হাতধরেই হোস্টেলে হলে যাওয়া আসা

          হোস্টেলে যেদিন বাবা আসার কথা সেদিন না এলে শীলার এত মন খারাপ হত যে বন্ধুদের সঙ্গেও কথা বলতে ইচ্ছে করত না আহা সেই বাবা মারা যাওয়ার পর তারিকভাই কিনা মসজিদে ঘোষণা দিল, "আমার চাচা আওলাদ নাই আমরাই তার বংশধর আমরা বাড়িতে থাকি না আমাদের ঘরবাড়ি, সম্পত্তি আপনার নিজের মনে করে দেখাশোনা কইরেন"

          জানাযার আগের ঘোষণা শুনে প্রথম ধাক্কায় যেমন শীলার মনে হয়েছিল, আমি তবে কে বুক ভেঙ্গে কান্না এসেছিল মিলাদের দিন সেই ঘোষণা শুনে হাসি পেয়েছিল মানুষ সম্পদের জন্য এত দুর্বলচিত্ত হয়ে যায়! গ্রামের মানুষ যদি নিজের মনে করে দেখাশুনা করে তাহলে নিজের মনে করে ভোগ করবে না কেন? কিন্তু সেটা তো তারা করতে দেবে না

          "এ্যাই এত কী ভাবছ?"

              "ভাবনার কি শেষ আছে? আচ্ছা তোমার মনে আছে বাবাকে নিয়ে যখন আমরা বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিলাম, তখন আমি ছাড়া আর কেউ বাবার জন্য একটুও কাতর হয়নি আমরা যে বাসে ছিলাম সেখানে আত্মীয়-স্বজন সবাই হৈ-হট্টগোল করছিল"

              "আমি তো বাবার সাথে ট্রাকে ছিলাম তুমি পরে আমাকে বলেছিলে"

          তারপর বাবার মৃত্যুর একদিন পরে থার্টি ফার্স্ট নাইট ছিল শেলি আপার ছেলেরা রাত বারোটায় এমন হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিল যে বাড়ির লোক চমকে উঠেছিল তারা বুঝতে পারছিল না এটা শোকের বাড়ি না উৎসবের আর আমি শুধু ভাবছিলাম এই ছেলেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বাবা ছোটবেলায় এদের কত আদর করেছেন আর শীলা এদেরকে ছোটবেলা থেকে এত আদর করেছে বিশেষত মুরাদকে ছোটবেলায় বইপড়া থেকে সবকিছুতে শীলা উৎসাহ দিত

          যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল তখনও ছুটিতে চট্টগ্রামে দের বাসায় এলেই রাতে না পারলে পরদিন শীলার বাসায় হাজির হত মুরাদ শীলার আলমারির বই থেকে আচারের বয়াম সবকিছুতেই তার হাত পড়ত অনায়াসে এই বোনের ছেলেটিকে শীলাও খুব বেশি আদর করত কিন্তু সেই মুরাদ তার প্রিয় খালার প্রতি এতটুকু সহমর্মিতা না দেখিয়ে নিউইয়ার্স ফেস্টিভেলে নেতৃত্ব দিয়েছিল

          হায়রে শিক্ষা, হায়রে দীক্ষা এত বই পড়ে তাহলে কী লাভ হল এরপর থেকে মুরাদকে দেখলেও আর কথা বলতে ইচ্ছে করত না

          বাবার কুলখানির পর চলে এসেছিল শীলা কিন্তু ঘরের চাবি দিয়ে আসেনি বিদায় নেয়ার আগে জহিরভাই খালাম্মা সবার সাথে দেখা করতে গেলে জহিরভাই বলেছিল, "আমার আর দুটো বোনের মত তুইও আমার আরেকটা বোন"

          শুনে শীলার মেজাজ তেতে উঠেছিল তাৎক্ষণিক মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, "না আমি আপনাদের খালাত বোন মাত্র"

          "হ্যাঁ, তাতো বলবি এটা আমাদের ভাতের দোষ যারাই আমাদের ঘরের ভাত খেয়ে বড় হয়েছে তারাই পাত ফুটো করেছে"

          মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছিল সেদিন বলতে ইচ্ছে করেছিল, "আমি আপনাদের ভাত খেলাম কখন আমি তো আমার বাবার ভাতেই বেড়ে উঠেছি"

          নাহ বলেনি তিক্ততা আর বাড়াতে চায়নি তাছাড়া আকস্মিক ধাক্কাটা এমন বেজেছিল যে অপমানে গলা দিয়ে স্বর বেরোয়নি

          "এ্যাই শীলা, তুমি না বলেছ, রাস্তা দেখতে দেখতে যাবে এখন তো দেখছি নিজের মধ্যেই ডুব দিয়ে বসে আছ"

          "কী করব বলো কষ্টের স্মৃতি যে পিছু ছাড়ে না ওরা হয়তো ভাবে, বাবার সম্পদ না পাওয়াতে আমি সম্পর্কছেদ করেছি আসলে তো তা নয় বাবার মৃত্যুর সময় ওদের মেকি আচার-আচরণ আমি ভুলতে পারি না। আজও আমার মনে হয়, জহিরভাই আগে বাবাকে অসম্মান করল, আবার মুমূর্ষু অবস্থায় জাঁকজমক দেখা আর মৃত্যুর পর তো বিশাল আয়োজন করে চেহলাম করল এটা কি ভালবেসে করেছিল নাকি উত্তরাধিকারের সনদপত্রে স্থায়ী সিল দিয়েছিল? সমাজের কাছে ওরা একটাই সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল যে, বাবার কেউ ছিল না ওরাই আছে আরও আশ্চর্য ওদের অর্থ-প্রতিপত্তির ভয়ে আপন মুরুব্বীরাও একটা টুঁ-শব্দ করেনি একবারও প্রশ্ন করেনি, শীলা তাহলে কে ছিল? কাকে নিয়ে নিঃসন্তান দুজন মানুষের জীবন ভরে ছিল?"

          না কেউ জানতে চায়নি বাকি খালা-মামারা কেউ না এখানে শীলার একটা কষ্ট আছে টাকার এত শক্তি যে গুরুজনরাও ওদের ভয় পায়? নাকি ওদের হাতে অপমানিত হবার ভয়? টাকার গরমে ওরা যে কাউকে যে কোন কথা শুনিয়ে দিতে পারে কিন্তু ওরা কি জানে মৃত্যুর আগে আম্মা আমাকে কী বীজমন্ত্র দিয়েছিলেন?

          ক্যান্সারে ভুগে আম্মার যখন শেষ অবস্থা তখন আত্মীয়রা দেখতে এসে জানতে চাইত, শীলার বিষয়ে বাবাকে তিনি কিছু বলেছেন কি না আম্মা একদিন জোরেই বলেছিলেন, "আমাকে কেন বলতে হবে? আর ওকে মানুষ করার দায়িত্ব ছিল সেটা করে দিয়েছি বাকিটা ওর তকদীর"

          সেদিন থেকে একটা প্রতিজ্ঞাই ছিল শীলার নিজের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে জীবন গড়বে তাছাড়া সম্পত্তির মোহ তো কখনও ছিল না আম্মার শিক্ষায় সম্পত্তির চেয়ে মানুষের স্নেহ-ভালবাসাকে অনেক বেশি বড় সম্পদ মনে করেছে অথচ ওরা তা বুঝতে পারল না না হলে যে মানুষগুলো এক জীবনে তার এত আপন ছিল, জ তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে মন একটুও সায় দেয় না মনে হয় বাবাকে যারা এত মনোঃকষ্ট দিয়েছে তারা ধনী বলেই কি তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা! পৃথিবীতে যার কেউ নেই সেওতো বেঁচে থাকে আর শীলার পৃথিবী জুড়ে আছে মহুল-মনিকা যাদের চেয়ে বড় সম্পদ সে আর কোন কিছুকেই মনে করে না তবু বাবা-আম্মার স্মৃতি, সেই ঘর, পরিচিত পরিবেশ মানুষ-জন সব কিছু থেকে আজ কতদূরে শীলা মনে হলে স্মৃতিভারে কাতর হয় তার মন।

          বাবা মারা যাওয়ার পর ওদের আচরণে ক্ষুব্ধ শীলার সবচেয়ে ষ্ট হতো কেউ যদি জানতে চাইত গ্রামের বাড়ি কোথায় ভীষণ ধন্দে পড়ে যেত, কোনটা বলবে? জনকের গ্রাম যেখানে তার অধিকার স্বীকৃত নাকি যে গ্রাম তার প্রাণের গভীরে প্রোথিত সে নাম খুব কষ্ট হত তখন মনে পড়ত তারিক ভাইয়ের মাইকের ঘোষণা, আমার চাচার কোন আওলাদ নেই আর জহির ভাইয়ের উক্তি, সব আমাদের ভাতের দোষ

          "এ্যাই শীলা, তখন থেকে কী ভেবেই যাচ্ছ এত রোদ শেষে মাথাব্যাথা করবে এবার হুডটা তুলে দিই"

          "আচ্ছা দাও"

          "মহুলের বাবা"

          "হুঁ"

          "তোমার মনে আছে?"

          "কী মনে আছে না বললে কীভাবে বুঝব?'

          "সেই যে বাবার চল্লিশায় আমরা এলাম আত্মীয় স্বজনে ভর্তি ঘর জহির ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ির সবাই এল কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব বারো চৌদ্দটা গরু জবাই হলো আশেপাশের সাত গ্রাম দাওয়াত পেল কিন্তু আসল উৎসব আগত অতিথিদের নিয়ে তাদের জন্য নানারকম পিঠা-নাস্তার আয়োজন পোলাও-মাংসের গন্ধে চারদিক পুকুরে জাল ফেলে উঠানে মাছের স্তূপ করা সবকিছুর ভিডিও হচ্ছে ওরা ঘুরে ঘুরে গ্রাম দেখছে, ছাদে চাঁদোয়া তার নিচে চায়ের আসর গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে দেখছে এত আয়োজন তারা এর আগে কখনও দেখেনি শহরের বড়লোকও এত উৎসবে বাবার কথা কিন্তু কারো মনে নেই আর আমি! সরে সরে থাকি ঘরের যেদিকে তাকাই বাবা-আম্মার স্মৃতি তাকাতে পারি না, কেবলই বুক ভেঙে কান্না আসে বাড়ির, গ্রামের লোকজন আসছে আমার সাথে দেখা করতে কাজের লোকেরা টুকটাক জিনিস চাইছে আমিও দিচ্ছি

          এরকম সময় লীলা এসে আমাকে চার্জ করেছিল, ঘরে এত মেহমান আমি কোন কাজ করছি না কেন? জহির ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকদের আদর আপ্যায়নে একটু থাকলেই তো পারি

          সেদিন আমার এত কষ্ট হয়েছিল, আমি কী ওদের গেস্ট এ্যাটেন্ড করতে এসেছি? রাগ চেপে শুধু বলেছিলাম, 'আমার ওসব করতে ভাল লাগছে না তোমরা করো' লীলা আমার দিকে তাকিয়ে আর কোন কথা বলেনি আমার বোন, আমার বন্ধু লীলাও সেদিন আমার কষ্টটা বোঝেনি তারপরতো আসার আগে কানাঘুষা শুনতে পাচ্ছিলাম, খালাম্মা তারিকভাই চিন্তিত ঘরের চাবি কিভাবে চাইবেন

          আহা! ওরা তো জানত না বাবার মৃত্যুর পর ওই ঘরে আমার আর কোন আকর্ষণ ছিল না কোন দাবিতো নয়ই তবু ওরা এমন করে ব্যস্ত হল- আমারই খালাম্মা, আমারই তারিক ভাই যাদের চেয়ে আপন আমার কাছে আর কেউ ছিল না"

          "দ্যাখো একটা মাছরাঙা ওই যে পুকুর পাড়ের বাঁশঝাড়ের একটা কঞ্চিতে বসে আছে অনেক দিন পর মাছরাঙা দেখলাম এখনতো গ্রামেও তেমন পাখি দেখা যায় না"

          "তুমি আমাকে ভুলাচ্ছ মহুর বাবা কিন্তু আমি যে ভুলতে পারি না সেদিন যখন খালাম্মার হাতে চাবিটা দিয়ে আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম তখন আমার কান্না কিছুতেই থামছিল না"

          "হ্যাঁ, তোমার কান্নায় উপস্থিত সবাই কাঁদছিল আর তোমার ভাইয়েরা তোমার ভিডিও করছিল আমার সেদিন এত ত্যক্ত লাগছিল, শ্বশুরবাড়ি না হলে ওদের ক্যামেরাই ভেঙে ফেলতাম" মামুনের কন্ঠে আজও সেই তিক্ততা

          শীলা মামুনের বাঁ হাতটা ধরে এবং ধরেই থাকে দুচোখে তার জলের বন্যা রিক্সা শহরের কাছাকাছি এসে গেছে

 

****


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩৭-৪১

  ----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ ________________________...

Popular Posts