__________________________________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪
গল্প - জৈবিক
__________________________________________
জৈবিক
জীবনে এই প্রথম ঢাকা যাচ্ছে
হালিমা। পড়শি রহিমার হাত ধরে নিজের বোরকা ঢাকা শরীরটাকে পুঁটলির মত বানিয়ে বাসের
সিটের এক কোণে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। বাসটার গতি অনেক বেশি। আবার মাঝে মাঝে হঠাৎ
ঝাঁকুনি দিয়ে থামে যে মনে হয় যেন হুমড়ি খেয়ে উল্টে যাবে। হার্ডব্রেক কী জিনিস
হালিমা জানে না। কিন্তু এভাবে একটা ধাক্কা দিলে তার ভিতরটা ওলট-পালট হয়ে
নাড়িভূড়িসহ মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। প্রতি মুহূর্তে মুখের ভিতরটা ভরে আসা
পেটের পানিকে ভিতরে চালান করতে গিয়ে জানটা আরো ধড়ফড় করছে।
পাশের সিটে বসা রহিমা
নির্বিকার। ভিতরে ভিতরে তার রাগ হচ্ছে। সে আনতে চায়নি তবু জোর করে তার সাথে যাচ্ছে
হালিমা। কী না - মেয়েকে দেখতে চায়। কেন, দেখতে হবে কেন? মেয়েকে যারা কাজে নিয়েছে
তারা তো বলেছে আর ছ'মাস পরে বিদেশে নিয়ে যাবে। তারপর হালিমাকে ঘর তোলার জন্য টাকা
দেবে। মেয়েকে ওখানে বিয়ে দেবে। হালিমা
এসবের কিছুই বোঝে না। কোথায় বিদেশ? সে কোন দেশ আর কার সাথে তার মেয়ের বিয়ে হবে এসব
কিছুই সে জানে না। তার কেবল একটাই স্বপ্ন ছিল শ্বশুরের ভিটায় একটা ঘর হবে তার।
কোনমতে মাথা গুঁজে থাকার মত একটা একচালা ঘর।
পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা এই পৃথিবী সম্পর্কে কোন ধারণাই
রাখে না। নিজের ঘর উঠান আর বড়জোর বাড়ির লাগোয়া পুকুরঘাটটাই এদের কাছে পৃথিবী।
হালিমার অনূঢ়া জীবনে বাবার
বাড়ির সীমানাও এটুকুতে সীমাবদ্ধ ছিল। ঋতুবতী হওয়ার পরের মাসেই কালাম মিস্ত্রির
বালিকাবধূ হিসেবে শ্বশুরবাড়ির এই চৌহদ্দীটুকুই ছিল তার জগৎ।
গত সাত বছরে সে জগৎ কিছুটা
প্রসারিত হয়ে নগরে এসে ঠেকেছে। শ্যামনগরের এ ছোট্ট শহরের অনেকগুলো বস্তির একটিতে
এখন হালিমার ঠিকানা।
প্রায় আট বছর আগের একদিন বসত
নির্মাণের মাচা থেকে পড়ে কোমর ভেঙে কালাম যখন পঙ্গু হল তখন সে চোখে আঁধার দেখেছিল।
তারপরও প্রায় এক বছর বাড়ির আশেপাশে এর ওর কাজ করে চেয়ে-চিন্তে কোন রকমে দিন
কাটছিল। তখন কালামের দোস্ত সবুরের বউ বলেছিল - "তুমি পোলা-মাইয়া লইয়া এত কষ্ট
না কইরা শহরে যাও না ক্যান বইন?"
"শহর?" হালিমার বুকটা ধক্ করে ওঠে। জন্মাবধি সে শুনেছে
শহর এক বিচিত্র জায়গা। সেখানে কত মানুষ, কত মানুষ। রাস্তায় হাঁটা যায় না। না বাবা
শহরে সে মরে গেলেও যাবে না।
তবুও শেষপর্যন্ত ছেলে-মেয়েকে
সাথে নিয়ে কালামকে বাড়িতে রেখে পাশের বাড়ির রহিমার হাত ধরে শহরে এসেছিল। কথা ছিল
বাসাবাড়িতে কাজ পেলে কিছুদিন পর কালামকে নিয়ে আসবে।
রহিমাই কাজ ঠিক করে দিয়েছিল।
সেই প্রথম যেখানে কাজ নিয়েছিল আজও সেখানেই কাজ করে। অন্য কোথাও যেতে তার ভয় করে।
এই বাড়ির মানুষগুলোকে সে চেনে। অন্য কাউকে নতুন করে চিনতে তার সাহস হয় না।
সাত বছরে শ্বশুরের ভিটার ঘরটা
একটু একটু করে ভেঙে বসে গেছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বাসাবাড়ির কাজ বাদ দিয়ে আবার
গ্রামে গিয়ে থাকবে। পাড়া-পড়শির এটাওটা করে কোনরকমে দিন কেটে যাবে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার সবচেয়ে বড়
বাধা ঘরের অভাব। নিজেকে খুব বোকা মনে হয় হালিমার। তারই প্রতিবেশী রহিমা এই শহরে কত
কিছু করেছে। তার ঘরে একটা টিভিও আছে। হালিমার ছোট দুটো ছেলেমেয়ে ওর বাসাতেই টিভি
দেখে। হালিমা সব কিছুতেই তার পরামর্শ নেয়।
সেবার যখন রহিমার খালাতো ভাই ওর বাসায় বেড়াতে এল তখন বড়মেয়ে
সুফিয়াকে দেখে রহিমাকে বলেছিল - "রহিমাবু হালিমাবুবুর কষ্ট তো চোখে দ্যাখন
যায় না। এক কাজ কর না - সুফিয়াকে দ্যাও আমার সাথে। ঢাকা শহরে আমার ফ্যাক্টরির
মালিকের বাসায় কামে দিমু। অনেক বেতন দিব। তোমার মাইয়ারে কপাল ভালা অইলে বিদেশে
পাঠাইয়া দিব। তখন আর তোমার কোন অভাব থাকব না" - বলে হালিমার দিকে তাকিয়ে ছিল।
হালিমা লজ্জায় তার আধ-ঘোমটা
পুরোটা টেনে মাটির কাছাকাছি নুয়ে পড়েছিল। তারপর রহিমা আর রতন মিলে তিন-চারদিন
সমানে তোতাপাখির মত বকে যেতে লাগল মেয়েকে ঢাকা শহরে রতনের মালিকের বাড়িতে পাঠালে
সবকিছু কত সহজে হয়ে যাবে। হালিমা কি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল? নাকি তার ভিতরে লোভ ছিল
- সত্যি সত্যি যদি ঘরটা হয়।
হ্যাঁ, দু'বছর আগে একদিন
মেয়েটাকে সত্যি সত্যি রতনের সাথে ঢাকা যেতে দিয়েছিল। তারপর রতন যতবারই এসেছে
ততবারই বলেছে - "সুফিয়া খুব ভাল আছে।"
"ট্যাকা-পয়সা দেয় না ক্যান?" হালিমা প্রশ্ন করত।
"আরে দিব দিব। সব ট্যাকা একবারে দিব যাতে তোমরা ঘর তুলবার পার।
মাসে মাসে দিলে তোমাগো যা অভাব সব খাইয়া শ্যাষ কইরা দিবা।"
রতনের এই কথাটা সত্যি বলে মানে এবং মেনে বলেছিল - "তাইলে
মাইয়াডারে একটা ফোন কইরতে কইয়েন।"
না ফোনও করেনি সুফিয়া। শেষ পর্যন্ত
রহিমাকে ত্যক্তবিরক্ত করে আজ ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটাকে দেখতে। গাড়ির ভিতর
গুনগুনিয়ে কেঁদে ওঠে হালিমা।
"কান্দিস না। এত মাইয়া-সোহাগী হইলে দিছিলি ক্যান? তুই না দিলে
তোর মাইয়া কেউ নিতে পারত?" রহিমার ধমকে হঠাৎ চুপ করে যায় হালিমা। কেউ যেন তার
কলজেটাকে খামচে ধরে। চিরদিনই ভীরু স্বভাবের হালিমা আরো গুটিশুটি হয়ে বাসের সিটে
মিশে যায়। প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে বাসটা রাতের অন্ধকারে চলতে থাকে, চলতেই থাকে।
সুবেহ্সাদিকের সময় ঘড়িতে
এলার্ম বেজে ওঠে। জেগে ওঠে শরাফত আলী। বেশ শব্দ করে আল্লাহু আকবর বলে আড়মোড়া ভাঙে।
এসির গুনগুন শব্দ ছাড়া আশেপাশে আর কোন শব্দ নেই। গায়ের ওপর থেকে পাতলা কম্বলটা
সরিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসে। প্রচন্ড গরমেও এসির ঠান্ডা বাতাস তার শরীরে একটা
আরামদায়ক স্পর্শ বুলিয়ে দেয়।
না, এখন আর শোয়া যাবে
না। নামাজ পড়তে হবে। তারপর ফ্যাক্টরিতে যাবার আগে বসে দিনের কাজকর্মগুলোর
পরিকল্পনা করতে হবে। স্যান্ডেল জোড়া পায়ে গলিয়ে পায়ে পায়ে সামনের রুমটার দরজায়
দাঁড়িয়ে ডাক দিল - "সুফিয়া, সুফিয়া ওঠো"।
আরো কয়েকবার ডাকার পর দরজার
পর্দাটা সরাল। পর্দা সরাতেই উল্টোদিকের দরজাটার দিকে তাকাল। বন্ধ। বন্ধ থাকারই
কথা। কাল জমিলার স্বামী আফসার এসেছে। মেহেদি রাঙানো কাঁচাপাকা দাড়িগুলো মুঠো করে
ধরে একটু ভাবল শরাফত, তারপর ঝট্ করে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল।
মাটিতে এলোমেলো শুয়ে আছে সুফিয়া।
প্যাসেজের আলোতেই দেখা যাচ্ছে শরীরের কাপড় ঠিক নেই। শরাফত ডাকল - "সুফিয়া,
সুফিয়া"।
কোন সাড়া নেই। অচেতন ঘুমাচ্ছে। ঘামে ভেজা একটা নোনতা গন্ধ আসছে ওর শরীর থেকে। শরাফত নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ঘুমন্ত মেয়েটির পাশে। মেয়েটির শরীরে তার হাতটা খেলা করতে করতেই ডাকে "সুফিয়া, অ সুফিয়া, উঠবা না? আমারে চা দিবা না?"
ঘুমের ঘোরে সুফিয়া শরাফতকে তার
লতানো বাহু দুটি দিয়ে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। তার গলা দিয়ে একটা আদুরে শব্দ বের
হয়ে আসে। শরাফত সতর্ক হয়।
না, আজ এভাবে ধরা দেয়া চলবে না। আফসার আছে। যদি উঠে যায় তাহলে বিপদ হবে। দ্রুত
নিজের হাত দুটো দিয়ে সুফিয়ার হাত দুটো ছাড়িয়ে ওকে ডাক দেন - "সুফিয়া ওঠ, সকাল
হয়েছে।"
ইস্কাটনের এই অ্যপার্টমেন্টটাকে শরাফত তার এক বোন আর কাজের মেয়ে
সুফিয়াকে নিয়ে থাকেন। ঢাকার শিল্পনগরীতে তার গার্মেন্টস এবং জুতার কারখানা আছে।
স্ত্রী দুই ছেলেকে নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে লন্ডন প্রবাসী। বছরে একবার আসে শীতকালে যখন
ছেলেদের ছুটি থাকে। শরাফত বছরে কয়েকবার যাওয়া আসা করে। ঢাকায় তার দুটো বাড়ি আর
দুটো এপার্টমেন্ট আছে অভিজাত এলাকায়। কিন্তু শরাফত সেখানে থাকে না। বাড়িতে বা অ্যাপার্টমেন্টে
থাকলে ইচ্ছেমত থাকা যায় না। এখানে নিজের পরিচয়ে থাকে না।
পনের তলার এই ভবনের একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকা
তার পরিচয় শুধু ভাড়াটের। অফিসের দু'একজন ছাড়া কেউ জানে না তার ঠিকানা। এ বাসায়
থাকা জমিলা সম্পর্কে ফুপাতো বোন হলেও আসলে আশ্রিতা ছাড়া আর
কিছু নয়।
একবার স্ত্রী রেনু দেশে আসার
পর জমিলা এসেছিল দেশের বাড়িতে চাকরির তদবিরে। ছিপছিপে একহারা গড়নের জমিলা যখন
বলেছিল - "দাদাভাই, শুনছি আপনের অনেক
মিল-ফ্যাক্টরি আছে। আপনেগো জামাইরে যদি একটা চাকরি দিতেন। আমরা বেশি কষ্টে আছি
মিয়াবাই" - বলতে বলতে জমিলার গলাটা ধরে এসেছিল।
শরাফতের চোখাচোখি হয়েছিল
স্ত্রীর সঙ্গে। স্ত্রী রেনু বলেছিল, "দ্যাখো, যদি পার লাগিয়ে দাও।"
সাথে সাথে অবশ্য হ্যাঁ বলেনি
শরাফত। চিরদিনের অভ্যাসমত কিছুটা খেলিয়ে ছিল। ঢাকায় এসে পরে খবর পাঠিয়ে ওদের
এনেছিল। রেনু যতদিন ছিল ওদেরকে বাসায় রেখেছিল। লন্ডন ফিরে যাবার সময় বলেছিল, "ওরা বাসায়ই থাক। তোমার দেখাশোনাটাও করতে
পারবে।"
সেই থেকে জমিলা এখানেই আছে।
শরাফত শুধু কৌশলে জমিলার স্বামীকে চট্টগ্রামে মাছ রপ্তানির কারখানা খোলার কাজে
পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন বছরের বেশিরভাগ সময় আফসার সেখানেই থাকে।
দিনে দিনে শরাফত জমিলাকে নিজের
আয়ত্তে এনেছে। আর আসবে নাই বা কেন? শরাফতের ইচ্ছেয় না চললে
আবার সেই পুরনো গ্রাম পুরনো অভাবে কে ফিরতে চায়? শুধু শরাফত একটা ব্যবস্থা করেছে
মাঝে মাঝে আফসার ঢাকায় আসে আর রেনু এলে পুরোটা সময় ঢাকায়।
কিন্তু গতকাল থেকে একটা বিষয় শরাফতকে ভাবাচ্ছে। জুতা কারখানার
কর্মচারী যে কি না শরাফতের অনেক গোপন অভিসারের দোসর সে বলেছে সুফিয়ার মা ঢাকায়
আসছে। তাকে আর কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এখন একটাই চিন্তা মা এলে মেয়ে যদি
সব বলে দেয় আর যদি চলে যায়!
বাচ্চা মেয়েটাকে বড় পছন্দ
শরাফতের। আর মেয়েটাও পোষমানা পাখির মত কেমন তার হাতে ধরা দেয়। হারাতে মন চায় না।
রতন নাকি মেয়ের মাকে বলেছে তার বাড়িতে ঘর তুলে দেবে। তাকে বিদেশে পাঠাবে। বিরক্ত লাগে শরাফতের। রতনের মত
লোকগুলোই তাকে ঝামেলায় ফেলবে। খেয়ে দেয়ে কাজ নেই এই মেয়েকে বিদেশে পাঠাতে আর তার
বাপের ভিটেয় ঘর তুলতে। বিদেশে অবশ্য পাঠানো যায় - কিন্তু সে অন্য ব্যবসা। একটা
নতুন চিন্তা বিদ্যুৎচমকের মত মাথায় খেলে যায়।
বাস থেকে নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল হালিমা।
"ধ্যাত্তেরিকা। ক্যান যে
তোমার মরতে ইচ্ছা অইল। আগেও কইছি ঢাকা শহর সবাইর লাইগা না। তা হুনলা আমার কথা? এখন
নিজেও মর, আমারেও মার। এখন তোমারে লইয়া ফিরতে পারলে বাঁচি। আমার হইছে যত
জ্বালা।"
বোরকাটা টেনেটুনে ঠিক করে কোনমতে রহিমার পিছন
পিছন টলতে টলতে হাঁটে হালিমা। সারারাত বাসের ঝাঁকুনিতে তার শরীরের একটা অংশ আরেকটা
থেকে জোড়া ছুটে যাওয়ার মত অবস্থা।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখল রতন দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাক্সি ঠিক করা ছিল। এই
প্রথম ট্যাক্সিতে চড়ল হালিমা। ঢাকা শহরে কত কিছু দেখা যাচ্ছে। কিন্তু
মেয়ের জন্য ব্যাকুলতায় তার কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে।
ট্যাক্সিটা ভবনের সামনে থামতেই ওরা নামে। তখনো হালিমা রহিমার
বাঁ-হাতটা ধরে রাখে।
রতন দেখায় - "দ্যাখ, পনের
তলা বিল্ডিং- কত্ত উঁচা। তোমার মাইয়া সাততলায় থাকে।"
ওরা উপরের দিকে তাকিয়ে
দেখার চেষ্টা করে। হালিমার মনে হয় পুরোটা দেখতে গেলে সে চিৎ হয়ে পড়ে যাবে।
লিফটে উঠে আবার ভয় করতে লাগল।
এটা যদি না থামে তাহলে কতদূরে যাবে, আর যদি থেমে যায় সে কি কোনদিন মেয়ের কাছে যেতে
পারবে?
ঘরে ঢুকে আরও তাজ্জব বনে যায়।
রহিমার কানে কানে বলে "অ বইন, মাইনষে এত্ত সোন্দর ঘরে থাকে?"
কিন্তু মেয়ে কই? কতক্ষণ হল তারা এসে এই সাজানো ঘরটাতে বসে আছে।
কিন্তু মেয়েকে ছাড়া এই বেহেশতের মত ঘরও তার কাছে ভাল লাগে না।
কিছুক্ষণ পর জমিলা আসে। ওদেরকে
ভিতরে নিয়ে যায়। সুফিয়া এগিয়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। কতদিন পর মেয়েকে দেখছে। হালিমার
ইচ্ছা করে গলা ছেড়ে কাঁদতে। কিন্তু এই ঘরবাড়ি এই পরিবেশ তার কান্নাকে যেন স্তব্ধ
করে দিয়েছে।
দুপুরবেলা অনেকটা শান্ত হয়ে মেয়ের কাছে জানতে চায় - "বাড়িত
যাবি?"
মেয়ে নিরুত্তর। মায়ের
পীড়াপীড়িতে এক সময় বলে - "বাড়িত যাই কী করমু মা? কী খামু?"
"আমরা হগ্গলে আছি। নুনভাত
যা অয় সবে মিল্যা খামু। চল্ চল্ তোরে ছাইড়া আমার ভালা লাগে না।"
"মা, আমি ফিরা গেলে তোমাগো ঘরটাও তো অইব না। দাদাভাই কইছে
আমারে বিদেশ নিব।"
"দাদাভাই - দাদাভাই কেডা?"
"আমাগো মনিব। ওনারে আমরা দাদাভাই ডাকি। জমিলা আপাও ডাকে,
আমিও।"
হালিমা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকায়। দৃষ্টি দিয়েই আঁতিপাতি
করে খোঁজে মেয়ের পরিবর্তন। চৌদ্দ বছরে এসেছিল এখন ষোল প্রায় শেষ। দেখতেও অনেক
সুন্দর হয়েছে। এখন গ্রামে নিয়ে গেলে একটা বিয়ে-শাদি দেয়া যেত। কিন্তু এতদিন পর
মাকে দেখে যেরকম উচ্ছ্বসিত হওয়ার কথা সেরকম কিছু নেই। আসার পর একবার জড়িয়ে ধরেছিল।
তারপর দিন গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। মেয়ে তেমন করে কাছে আসছে না। বাড়ি যাবার কথা বললেই
নানা অজুহাত দেখাচ্ছে। তবু সবার চোখের আড়ালে একবার চেপে ধরেছে। কিন্তু মেয়ে
কিছুতেই ধরা দিতে চাইছে না।
আজ ফ্যাক্টরি থেকে একটু দেরিতেই ফিরছে শরাফত। বাসায় ঝুটঝামেলা তার
সহ্য হয় না। কোথাকার কোন গ্রাম থেকে সুফিয়ার মা এসে বসে আছে। জমিলার কাছে দু'হাজার
টাকা দিয়ে এসেছে, দিয়ে বিদায় করার জন্য। কী জানি গেছে কি না।
লিফ্টে উপরে উঠে কলিং বেল
টিপতেই দরজা খুলে দেয় সুফিয়া। একটু দূরে সুফিয়ার মা আরো একজন মেয়েলোক দাঁড়িয়ে আছে।
দু'জনের মুখই ঘোমটা ঢাকা। কিন্তু একজনেরটা বেশি ঢাকা। কোন্টা সুফিয়ার মা? কে
জানে, যাকগে - এমন একটা তাচ্ছিল্য দিয়ে ভাবনাটাকে তাড়াতে চাইল।
হালিমা ঘোমটার ফাঁকে লোকটাকে দেখে। বাপ্রে এত্তো সোন্দর মানুষ!
মানুষ এমন সোন্দর হয় এক্কেরে ফেরেশতার লাহান, মুখে আবার দাড়ি।
রতন মিছা কয় নাই। পীরের বংশ না অইলে এমন অয় না।
হঠাৎ হালিমার কলজেটা ভয়ে
লাফিয়ে উঠে। থমকে যেতে চায়। এরা মাইয়াটারে জাদু করছে নাকি? বাড়িত যাইতে চায় না
ক্যান?
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন হালিমারা রওনা দেবে। হালিমা অনেক কাঁদছে। না
সুফিয়া যাবে না। দাদাভাই তাকে বিদেশ পাঠাবে। বাড়িতে ঘর উঠবে।
কিন্তু হালিমার মায়ের পরাণ বলে
- আরো কিছু আছে। কিন্তু সে কিছুটা কী?
No comments:
Post a Comment