_____________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - বোধন ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৯
গল্প - অবশেষে বৃষ্টি
__________________________
অবশেষে বৃষ্টি
টিফিন শেষের ঘন্টা পড়তেই পড়তে থাকা বইটা ডেস্কের ভেতর চালান করে দেয় অয়ন। ছেলেরা সবাই হুড়োহুড়ি করে ক্লাসে ঢুকছে। এখন শুরু হবে অঙ্ক পিরিয়ড। আর অঙ্কের স্যার এত কড়া যে বই দেখলে কেড়ে তো নেবেনই আবার কয়েক ঘা মারতেও ছাড়বেন না। যখনই মারেন এত জোরে মারেন যে সহজে কেউ তাঁর হাতে মার খেতে চায় না। অয়নও খুব ভয় পায় স্যারকে। তবে স্যার অঙ্কটা বোঝান ভাল। একবার মন দিলেই জটিল পাটিগণিত আর জ্যামিতিগুলো সহজ হয়ে যায়। কিন্তু তারপর আছে বাংলা ক্লাস। মজা হল স্যার যখন পড়ান তখন বইয়ের নিচে বই রেখে বাকি কয়েক পৃষ্ঠা শেষ করা যাবে। উহ্ যা অদ্ভুত চরিত্র মিসির আলী!
— এই অয়ন। পেছন থেকে ডাক দিল রুবেল।
— কী?
— আমার বইটা দে না।
— আর মাত্র কয়েকটা পৃষ্ঠা। বাংলা পিরিয়ডে পড়েই দিয়ে দেব।
— আমি এখনো পড়িনি তো।
— আচ্ছা বাবা বললাম তো দিয়ে দেব।
অঙ্কস্যার ক্লাসে ঢুকতেই যে যার মত খাতা বই খুলে বসল।
স্কুল ছুটির সময় রুবেলের সামনে বইটা ধরতেই সে একরকম ছোঁ মেরে নিয়ে ব্যাগে ঢুকাল।
— এই রুবেল – কালকে আরেকটা বই আনিসতো।
— আচ্ছা, মনে থাকলে।
— ঠিক আছে আমি আনব। আমার কাছে হিমু সমগ্র আছে। বলতে বলতে ক্লাসের দুটো বেঞ্চ লাফিয়ে চলে এলো সুজয়।
— ওটা কার লেখা?
— কেন হুমায়ূন আহমেদের। তুই জানিস না? তাহলে কী পড়েছিস? সারাক্ষণতো দেখি পড়িস।
— কী করবো, বাসায় গল্পের বই একদম পড়তে দেয় না যে।
—
বেশ তাহলে কথা রইল তুই হিমুসমগ্রটা নিয়ে আসবি।
— হ্যাঁ নিয়ে আসব। কিন্তু
বইটা যে বেশ মোটা। একদিনে পড়ে শেষ করতে পারবি না।
— আচ্ছা, সে আমি দেখব। তোকে আনতে
বলেছি তুই নিয়ে আসবি। তারপর আমি দেখবো।
ক্লাস ততক্ষণে ফাঁকা হয়ে গেছে। ওরা তিনজনও বেরিয়ে এল। স্কুল ভবনের
ছোট গেট পেরিয়ে সুজয়কে আবারও বইয়ের কথা মনে করিয়ে দিল অয়ন। তারপর
তিনজনই আলাদা হয়ে যার যার গন্তব্যের দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
ওরা তিনজন একই কলোনীতে থাকে। কলোনীটা
অনেক বড়। ওদের তিনজনের বাসা তিন প্রান্তে। ব্যাগটা ভালো করে পিঠে নিয়ে বেল্ট দুটো কাঁধের
উপর তুলে দিয়ে অয়ন বললো¾ বিকেলে
খেলার মাঠে দেখা হবে। এখন যাই। দেরি হলে আব্বু এসে বকা দেবে।
অয়ন রাস্তা থেকে নেমে মাঠের আলপথ ধরে হাঁটতে শুরু করলো। রুবেল
আর সুজয় আরো কিছুটা পথ এগিয়ে তারপর দু’জন দু’দিকে যাবে।
মাঠের আলপথ দিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল অয়ন। কারখানার ভোঁ পড়ে
গেছে। এখন দুপুরের খাবার খেতে আসবে আব্বু। আর এসে যদি দেখে অয়ন বাসায় পৌঁছেনি তাহলেই
সেরেছে। একশোবার জানতে চাইবে কেন দেরি হল।
এটা একটা ফ্যাক্টরির কলোনী। স্কুলটাও ফ্যাক্টরির। কলোনীতে যারা
থাকে তাদের ছেলেরা পড়ে। মেয়েদের জন্যও একটা স্কুল আছে।
সেটা কলোনীর একেবারে পাশে। আছে হাসপাতাল, ক্লাবঘর, খেলার মাঠ।
অয়নরা প্রায় তিন বছর ধরে এখানে
আছে। এর আগে ঢাকায় মীরপুরে ছিল। তখন ছোটমামা আসত বাসায়। ছোটমামা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়ত। আর যখনই আসত মামার হাতে থাকত বই। প্রতিবারই
মামা অন্তত একটা বই হলেও আনত ।তারপর দুপুর বেলা মাঝে মাঝে অয়নকে গল্প শোনাত। দেশী-বিদেশী
কত গল্প। আর বইগুলো কি সুন্দর ছিল। অয়ন এখনো খুলে খুলে দেখে, কোনটা পড়ে।
কিন্তু বাবা কেন যেন বই কেনার কথা
শুনতেই পারেন না। গল্পের বই পড়তে দেখলেও রেগে যান। অথচ রুবেলের আর সুজয়ের আব্বু-আম্মু
জন্মদিনে বই উপহার দেন। এই বই পড়ার জন্যই তো এখানে আসার পর থেকে ওদের সাথে ভাব হয়ে
গেল। তিন গোয়েন্দার গল্প নিয়ে কথা বলতে বলতে কতদিন ওরা নিজেরাই কিশোর, রবিন আর মুসা
হয়ে গেছে। তবে ইদানিং বিশেষ করে ক্লাস নাইনে ওঠার পর থেকে হুমায়ূন আহমেদ তার খুব প্রিয়
হয়ে উঠেছে।
স্কুল লাইব্রেরিতে অনেকগুলো বই আছে হুমায়ূন
আহমেদের। কিন্তু বাসায় বই নিলে আব্বু দেখলে যদি রাগ করে এই ভয়ে সে বাসায় নেয় না। টিফিন
পিরিয়ডটা বেশির ভাগ সময় অয়ন লাইব্রেরিতে পড়ে। পড়াতো নয় যেন গোগ্রাসে গেলা। এইতো ক’দিন আগে হুমায়ূন আহমেদের ‘আমার ছেলেবেলা’ পড়ে কি যে মজা পেয়েছে অয়ন। রুবেলকে বলতেই সে ঠোঁট উল্টে বলেছিল¾ ওটাতো আমি কত আগেই পড়েছি। মা যেদিন
এনে দিলো সেদিন রাত দুটো পর্যন্ত এক নাগাড়ে পড়ে শেষ করেছিলাম। সত্যিই
এক্সাইটিং!
ভাবতে ভাবতে কখন বাসার সামনে এসে পড়েছে। আর তক্ষুণি গাড়ি থেকে
নামলেন বাবা। আরেকটু হলেই বকুনি শুনতে হত। বাবার আধঘন্টা আগে অয়নের স্কুল ছুটি হয়ে
যায়। ঘড়ি দেখল¾ দুটো দশ বাজে। অর্থাৎ এর মধ্যে চল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে। এক সঙ্গেই ঘরে ঢুকল দু’জন।
পরদিন ক্লাসে সুজয় ‘হিমু সমগ্র’ বইটা এনে দিল অয়নের হাতে। সাথে সাবধান করে দিল¾ দেখিস, স্যারের কাছে ধরা খাসনে।
তাহলে কিন্তু আমার বই কিনে দিতে হবে।
অয়ন হাসল। এত বোকা কি সে? বইটা
দেখে তাড়াতাড়ি ডেস্কে রেখে দিল।
প্রাত্যহিক
সমাবেশের ঘন্টা পড়ে গেছে। এখনি লাইন বেঁধে মাঠে নামতে হবে। সমাবেশ শেষ হলেও পিটি স্যার
কিছুক্ষণ পিটি প্যারেড করালেন। অয়নের অস্থির লাগছিল। বার বার মনে হচ্ছিল কখন শেষ হবে¾ কখন
ক্লাসের ঘন্টা পড়ার আগে বইটা একটু দেখে নেবে।
টিফিনের ঘন্টা পড়তেই ডাক দিল রুবেল¾ এই অয়ন, চল টিফিন করবো একসঙ্গে। অয়ন মাথা নাড়ল, সে আজ যাবে
না। টিফিনও করবে না। টিফিন করতে যে দশ মিনিট সময় যাবে ততক্ষণে বইটার দশ পৃষ্ঠা পড়া
হয়ে যাবে।
¾ থাক তুই, আমি
যাচ্ছি। আমরাও তো পড়ি। কিন্তু তোর মতন এমন পোকা নই। গজগজ করতে করতে রুবেল বেরিয়ে গেল,
সুজয় অপেক্ষা করছে।
অয়ন ডেস্ক থেকে বইটা
বের করল। মলাটে লেখা “হিমু
সমগ্র” – হুমায়ূন আহমেদ। ঝকঝকে বাঁধাই করা
কি সুন্দর বই। পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখে পড়ল¾ “পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রিয় সুজয়ের জন্মদিনে
আদর আর আশীর্বাদ– আব্বু-আম্মু”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অয়নের বুক থেকে।
হায়রে,
আমার আব্বু-আম্মু যদি এমন হত। আব্বুটা এত কড়া যে ওদের দু’ভাই অয়ন আর চয়নকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখে। চয়ন ক্লাস টু’তে পড়ে। অয়ন সায়েন্স নিয়েছে। বাবার ইচ্ছা অয়ন বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে।
কিন্তু অয়নের ভাল লাগে সাহিত্য পড়তে। তবে সায়েন্সও ভালো লাগে। অনেক মজার মজার তথ্য
জানা যায়। সবচেয়ে ভাল লাগে ল্যাবরেটরিতে রসায়নের ক্রিয়া-বিক্রিয়াগুলো দেখতে।
বই খুলে দ্রুত চোখ বুলাতে শুরু করল অয়ন।
ঢং করে ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সচেতন হল অয়ন। এক্ষুণি বইটা লুকিয়ে ফেলতে হবে। ক্লাসে
গল্পের বই নিয়ে আসা একদম পছন্দ করেন না স্যাররা। কিন্তু মনটা তার পড়ে
থাকল বইয়ের পাতায়।
বিকেল সবে শুরু হয়েছে।
আজ দুপুরে অঙ্ক করার নাম দিয়ে ঘুমোয়নি। বাসার সবাই
যখন ঘুমাচ্ছে তখন অয়ন খাতা সামনে রেখে অঙ্ক করার ভান করতে করতে অনেকটুকু পড়ে ফেলেছে।
একের পর এক এত মজার মজার ঘটনা! সবচেয়ে মজার হল হিমু সবসময় হলুদ
পাঞ্জাবী পরে। একটু অদ্ভুত, কিন্তু কেমন যেন ভাল লাগে। ¾ ইস্ আমি যদি হিমু হতাম! একদম
স্বাধীন! তাহলে কী মজাই না হতো।
¾ নাহ্,
আজ আর খেলতে যাওয়া হবে না। বরং খেলার নাম করে
কলোনীর পেছনে ঝোপের আড়ালে বসে বই পড়া যাবে। বইটা কাগজে মুড়ে আরেকটা পাঠ্যবই সাথে নিল।
ঘরে ফেরার সময় বাবা জিজ্ঞেস করলে যাতে বলা যায় পড়ার বই- বাংলা রচনা। দরজা খুলে মাকে
হাঁক দিল অয়ন¾ মা, আমি খেলতে যাচ্ছি।
দরজা বন্ধ করো। তারপর আর দাঁড়ালো না। তরতর করে নেমে গেল সিঁড়ি ভেঙে।
হিমু সমগ্র পড়ে হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত হয়ে
ওঠে অয়ন। স্কুলের লাইব্রেরিতে আজকাল টিফিনের সময়টা কাটায়। লাইব্রেরির একটা আলমারির
প্রায় তিনটা তাক ভর্তি হুমায়ূন আহমেদের বই। অয়নের চোখ দু’টো চকচক করে ওঠে। ইচ্ছে করে একসঙ্গে অনেকগুলো বই নিয়ে¾ কিন্তু
লাইব্রেরি থেকে একটার বেশি বই নেয়া যায় না। তারপর আছে বাবার দেখে ফেলার ভয়। কিন্তু
কী করা যায়?
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত একটা
চিন্তা খেলে যায় অয়নের মাথায়। লাইব্রেরি থেকে ছুটে আসে ক্লাসে। নাহ্ রুবেল আর সুজয়
এখনো মাঠে। ভিতরে ভিতরে একটা উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে ওঠে অয়ন। টিফিনের পরের ঘন্টাগুলো
কীভাবে কেটে যায় বুঝতেই পারে না। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রাখে। এক ফাঁকে খাতায় লেখে¾ তুই
আর সুজয় ছুটির পর থাকবি। একটা পরামর্শ আছে।
খাতাটি আস্তে করে ঠেলে দেয় সুজয়ের দিকে। সুজয় ‘ঠিক আছে’ লিখে খাতাটি আবার অয়নের
কাছে ফিরিয়ে দেয়।
ছুটির পর ওরা এমনিতেও দাঁড়ায়। আজ আরো উৎসুক
হয়ে ছুটে এল।
¾কী রে, কিসের পরামর্শ?
প্রশ্ন করে রুবেল।
¾ হ্যাঁ, কী আবার এমন
ঘটল যে তোর পরামর্শের দরকার? ¾একটু টেনে টেনে বলল সুজয়। কথায়
কথায় ঢং করা ওর একটা বদ-অভ্যাস। তবু অয়ন রাগ করে না। ওদের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। গেটের
বাইরে এসে এবার কথাটা পাড়ে অয়ন।
¾ আজ
বিকেলে কলোনীর পেছনের ঝোপটার কাছে আসতে পারবি? একটা কথা আছে।
¾ কী
কথা? এত রহস্য না করে বলেই ফ্যাল না বাপু। রুবেল তাগিদ দেয়।
¾ না, এখন নয়। ঠিক বিকেল
চারটায় ওখানে আসবি। তখন কথা হবে। মনে থাকে যেন ¾ ঠিক চারটায়। আমি অপেক্ষা করব।
ঠিক চারটায় ওরা সত্যি সত্যিই আসে। অয়ন আগে
থেকেই এসে একটা ঝোপের আড়ালে বসে। কলোনীর পেছনে এই পতিত জমিটুকু গাছপালা আর ঝোপঝাড়ে
আকীর্ণ। কোন ভনিতা না
করেই রুবেল জানতে চায়¾ ব্যাপারটা
কী? কেন আসতে বলেছিস?
¾ আমি একটা অভিযান
চালাব। তোরা থাকবি আমার সঙ্গে।
¾ কী অভিযান? একসঙ্গেই বলে ওঠে রুবেল-সুজয়।
অভিযান শব্দটি শুনে ওদের ভেতরেও যেন উত্তেজনা তোলপাড় করে ওঠে।
অয়ন বলে ¾ লাইব্রেরির বই চুরি করব।
¾ বই চুরি অপরাধ
নয়। বিজ্ঞের মত বলে সুজয়।
¾ কিন্তু কীভাবে
করবি?
¾ কেন,
কিশোর, রবিন আর মুসার অভিযানের গল্প পড়িস না! ওরা বুদ্ধি খাটিয়ে কত অল্পে কত কঠিন সমস্যার
সমাধান করে।
¾ আরে বাবা, লাইব্রেরিতে
ইয়া বড় এক তালা ঝুলছে না? ভিতরে ঢুকবো কী করে?
একটু ইতস্তত করে বলে অয়ন¾ তালা গলিয়ে ফেলবো।
¾ কেমন করে? আবারো এক
সঙ্গে প্রশ্ন করে রুবেল-সুজয়।
¾ কেন, রসায়ন বইতে পড়িসনি
সালফিউরিক এসিড দিয়ে ধাতু গলানো যায়।
¾ আমরা
এসিড কোথায় পাবো? রুবেলের এ প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞের মতই বলে অয়ন¾ স্কুলের ল্যাবরেটরি থেকে যে কোন
ভাবে হোক সরিয়ে নেব।
¾ তারপর? এবার সুজয় চোখ
বড় বড় করে প্রশ্ন করে।
¾ তারপর এক সন্ধ্যায়
তালা খুলে ভেতরে ঢুকব।
কীভাবে কী করতে হবে অয়ন ওদেরকে বুঝিয়ে বলে। মন্ত্রমুগ্ধের মত শোনে
দু’জন। ঠিক হয় আগে এসিডটা সরাতে হবে।
এত সহজে বিজ্ঞান স্যারের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এসিড সংগ্রহ করতে পারবে
ওদের জানা ছিল না। মনে হলো এর পরের কাজটাতো আরো সহজ।
একটা পরীক্ষাও হয়ে গেল। একেবারে হাতে কলমে শিক্ষা। এসিডটা এনে অয়ন একটা ঝোপের আড়ালে
লুকিয়ে রাখে। তারপর আবার বিকেলে ওরা একসাথে হয়। ঠিক হয় পরদিন সন্ধ্যায় হবে অভিযান।
তিনজনের ভেতরেই প্রবল উত্তেজনা। হঠাৎ সুজয় বলে উঠে¾ যদি ধরা পড়ি?
¾ ধুত্তোরি। ধরা পড়ব কেন? আমাদেরকে
সন্দেহ করার কী কারণ থাকবে?
¾ তবুও।
¾ এত তবু তবু করলে তুই
আসিস না তো বাপু। রুবেল ধমকে উঠল। ¾ এসব
কাজে নামতে গেলে বুকের পাটা থাকতে হয়। আমারতো মনে হয় আমরা কাজটা এত সহজে করব যে কেউ
বুঝতেই পারবে না। সন্দেহ করা তো দূরে থাক।
রুবেলের কথা শুনে আরো সাহস বেড়ে যায় অয়নের। শুধু সুজয় চুপ করে
থাকে।
¾ হ্যাঁ, কথা রইল ঠিক
সন্ধায়। মাগরিবের আজানের পর সবাই যখন ঘরে যাবে তখন এলাকাটা নিরিবিলি হয়ে যাবে আর স্কুল
ভবনটাতো আরো নির্জন।
¾ কিন্তু বাসা থেকে বেরুব
কী বলে?যাবার সময় আবারো প্রশ্ন করে সুজয়।
¾ এতো কিন্তু কিন্তু করলে তুই আসিস
না। আমি বলব রুবেলের বাসায় যাচ্ছি, আর রুবেল বলবে আমার বাসায়। তুইও
এরকমই বলবি। এখন আমাদের প্রয়োজন একটা টর্চ আর একটা বস্তা। অয়ন বলে বেশ বিজ্ঞের ভঙ্গিতে।
¾ কেন কেন বস্তা দিয়ে
কী হবে? এবার রুবেল জানতে চায়।
¾ ধুর বোকা। বইগুলো আনতে
হবে না? তারপর রাখবো কোথায়? এখানে কোথাও লুকিয়ে রাখতে গেলে বস্তা লাগবে না?
চারটা কখন বাজবে অধীর উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করে অয়ন। তারপর মাকে
বলে¾ “মা আজ একটু রুবেলদের বাসায় যাব। কিছু প্রাকটিক্যাল আঁকতে হবে। ফিরতে
একটু রাত হতে পারে”।
¾ তোর বাবা কিন্তু অসময়ে
কারো বাসায় যাওয়া পছন্দ করেন না। মা সাবধান করেন।
¾ আহ্হা যাচ্ছিতো একটা
কাজে। ঝাঁঝিয়ে ওঠে অয়ন।
মা আর কিছু বলেন না। অয়ন ড্রয়ার থেকে ছোট টর্চটা তাড়াতাড়ি পকেটে
ঢুকায়। রুবেল বলেছে বস্তা আনবে, দড়িও আনবে। সুজয়টা একটা ক্যাবলা। মুখে ফটফট করে। কাজের
দায়িত্ব নিতে চায় না। ¾উহ্ কত্তগুলো বই! চোখ
দুটো চকচক করে ওঠে অয়নের যেন সে দেখতে পাচ্ছে লাইব্রেরির আলমারিতে রাখা সারি সারি বই।
সন্ধ্যা হয়ে গেল অথচ সুজয় এলো না।
¾ আরে ওটা একটা ভীতুর ডিম। কোন অভিযানে
নামলে কি এত ভয় পেলে চলে! আর সেদিনতো সে-ই বড় গলায় বলল, বই চুরিতে নাকি অপরাধ নেই।
দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে ওরা দু’জন সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে স্কুল ভবনের দিকে এগিয়ে
যায়। যেতে যেতে চারপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ তাদের দেখছে কি-না।
সামনের গেট তালাবদ্ধ।পিছন দিকে ঘুরে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢোকে দু’জন।
¾ এসিডের বোতলটি এনেছিস
তো? রুবেল জানতে চায়।
¾ হ্যাঁ, হ্যাঁ, টর্চও
এনেছি।
স্কুলের মাঠ পেরিয়ে কথা বলতে বলতেই ওরা উঠে
আসে বারান্দায়। তালার উপর এসিড ঢালতেই সত্যি সত্যি তালার আঙটাটা ফাঁক হয়ে যায়। টর্চ
নিয়ে রুমে ঢুকল ওরা। হায় আল্লাহ¾ আলমারিতে তালা দেয়া।
এটা তো মনে আসেনি। সবটুকু এসিডতো দরজার তালায় ঢেলে দিয়েছে।
¾ এখন? যেন কিছুটা হতাশ
হয়ে পড়ে অয়ন।
¾ এখন আর কী।ভাঙা তালাটা
দিয়ে আলমারির কাচ ভেঙে ফেল।
¾ সত্যিই
তো মাথায় এ বুদ্ধি আসেনি।
হাতের ভাঙা
তালাটা দিয়ে আলমারির কাচে জোরে আঘাত করে। ঝন্ঝন্ শব্দে ভেঙে পড়ে কাচ। ওরা ভয় পেয়ে
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর এক সময় রুবেল তাড়া দেয়¾ তাড়াতাড়ি কর। বইগুলো বস্তায় ঢুকিয়ে
নে।
ভাঙা কাচের ভেতর দিয়ে
হাত বাড়ায় অয়ন। বের করে আনে এক দুই করে পনেরটা বই। আরো দুটো নিতে তাকের কোণার দিকে
হাত বাড়াতে কাচে লেগে হাত কেটে যায় অয়নের। উহ্ বলে ভাঙা ছড়ানো কাচের ওপরই হাঁটু গেড়ে
বসে। রুবেল এতক্ষণ টর্চ ধরে ছিল। টর্চের আলোয় দেখল অয়নের ডান হাতটা রক্তে লাল। গড়িয়ে
গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। ভয় পেয়ে যায় রুবেল। কিন্তু ভুলে
যায় না পরিস্থিতি। তাড়াতাড়ি করে বইগুলো বস্তায় ঢুকিয়ে অয়নকে হাত ধরে টানে¾ চল্ এখানে বেশিক্ষণ থাকলে বিপদ
হবে।
অয়ন দাঁতে দাঁত চেপে
উঠে দাঁড়ায়। হাতটা চেপে ধরে বেরিয়ে আসে ওরা। পিছনে দরজাটা তেমনি খোলা
থাকে। তাড়াতাড়ি পা চালায়। অয়নের হাত থেকে রক্ত পড়ছে এখনো। রুবেল বলে¾ তুই বাসায় চলে যা।
আমি বইগুলো ঝোপের ভেতর রেখে আসব ।
¾ বাসায় কী বলবো? আমিতো
বলেছি তোর বাসায় যাচ্ছি প্র্যাকটিক্যাল আঁকতে।
¾ বলবি পড়ে গিয়ে কেটে
গেছে। অন্ধকারে দেখতে পাসনি।
অয়ন ঘরে ঢুকতেই মা চিৎকার করে ওঠেন¾ একি, কী হয়েছে তোর?
মায়ের চিৎকারে
বাবা, চয়ন এমনকি বাসার কাজের বুয়াটাও ছুটে আসে। সারাটা জামা রক্তে লাল। তবু কোন মতে
অয়ন বলে¾ পড়ে গিয়েছি অন্ধকারে।
কিসে লেগে এমন কাটল বুঝতে পারছি না।
বাবা রেগে গেলেন¾ সন্ধ্যাবেলা বাইরে গেলে কেন?
¾ আচ্ছা আগে ভাইয়ার রক্ত বন্ধ করেন,
তারপর কথা কইয়েন ¾ বুয়ার কথায় বাবা-মা
দুজনেই বুঝতে পারেন এখন দরকার দ্রুত চিকিৎসা।
যেরকম কেটেছে তাতে মনে হয় স্টিচ পড়বে। হাসপাতালে নিতে হবে। বাবা ফোন করেন এম্বুলেন্সের
জন্য। মা আর বুয়া রক্ত মুছে স্যাভলন লাগিয়ে হাতটা শক্ত করে বাঁধেন।কয়েক মিনিটের মধ্যেই
এম্বুলেন্স এসে যায়।
সকালে অফিসে যেতেই কথাটা কানে আসে অয়নের বাবার। স্কুল ভবনের তালা
ভেঙে বই চুরি করে নিয়ে গেছে। তাও সব হুমায়ূন আহমেদের বই। বাবা কোন কথা বলেন না। বুঝতে
পারেন কী ঘটেছে। তার ভিতরটা কষ্টে ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে চায়¾ বই পড়ার জন্য এত কান্ড করল ছেলেটা!
অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে বাসায় আসেন। বিছানায় ঘুমন্ত অয়নকে হ্যাঁচকা টানে তুলে বসিয়ে দেন।
¾ কী করেছিস? স্কুলের
বই চুরি করেছিস?
অয়ন মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে। ওঠ্, আমার সাথে স্কুলে যাবি।
এক্ষুণি গিয়ে হেডস্যারের কাছে মাফ চাইবি। ওঠ্¾ বলতে বলতে অয়নকে টেনে নিয়ে যান
ঘরের বাইরে। অয়নের শক্তি নেই ছুটে যাবার। কাল রাত থেকে তারও মনে হচ্ছে – কাজটা ভাল হয়নি।
সারা স্কুলে তোলপাড়। স্কুলে চোর এসেছিল। লাইব্রেরির
তালা খুলে আলমারির কাচ ভেঙে বই নিয়ে গেছে।সুজয় চুপ করে থাকতে পারে না। জিজ্ঞেস করে¾ কতগুলো বই নিয়েছে?
¾ তা প্রায় দেড়শ’র মত। দু’শও হতে পারে¾ কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর
দিল রায়হান।
হেডস্যারের রুমে মিটিং হচ্ছে। পুলিশে খবর দেয়া উচিত কিনা। এরকম
একটা ঘটনার পর পুলিশকেতো জানাতেই হবে।
একটা গাড়ি এসে থামে
স্কুলের সামনে। বাবা আগে নেমে যান। পিছনে অয়ন আর রুবেল আসে। হাঁটতে পা সরছে না ওদের।
চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। মনে হচ্ছে¾“ধরণী দ্বিধা হও, ঢুকে পড়ি মাটির
গভীরে”।
অয়নের শরীরটাও দুর্বল। কোনরকমে ওরা এসে দাঁড়ায়।
বাবা অনুমতি নিয়ে ভেতরে
ঢুকেন। হেডস্যারের
সাথে কথা বলেন। হেডস্যার ভিতরে ডাকেন ওদের। অয়নের মনে হয় পায়ের সঙ্গে কেউ দুটো ভারী
পাথর বেঁধে দিয়েছে। কীভাবে হেঁটে আসে রুবেল বলতে পারে না। তবু একসময় ওরা স্যারের সামনে
এসে দাঁড়ায়।
¾ তোমরা চুরি করেছ
বই? হেডস্যার প্রশ্ন করেন।
ওরা মাটির দিকে চেয়ে
চুপ করে আছে। বাবা ধমকাচ্ছেন¾ বল, বল স্বীকার
কর। বল আর কক্ষণো করবে না। মাফ চাও।
দু’জনেই হাঁটু গেড়ে বসে স্যারের পায়ে হাত দিতে যায়। স্যার উঠে দাঁড়ান। ওদেরকে
হাত ধরে তোলেন। অয়নের হাতের ব্যান্ডেজটা দেখেন।
¾ আর কক্ষণো করবো না
স্যার। অয়ন বলে। বলতে বলতে তার দু’চোখ গড়িয়ে পানি নামে। রুবেল ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। স্যার
ওদের পিঠে হাত রাখেন¾ জানো, এই অপরাধে কী
শাস্তি হতে পারে তোমাদের? স্কুল থেকে টিসি
দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু তোমরা স্বীকার করেছ। তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে এসেছেন
অয়ন। তাই আমি তোমাদের এবারের মত সত্যি সত্যি ক্ষমা করে দিচ্ছি। কিন্তু তোমাদের এবং
তোমাদের অভিভাবককে লিখিত দিতে হবে এরকম আর করবে না।
¾ একশো বার স্যার। রুবেল
কান্না থামিয়ে বলে।
¾ আর অয়ন শোন, বই পড়তে
হলে আমার কাছে এসো। আমি দেব তোমাদের বই।
হঠাৎ অয়নের মনে হলো হেডস্যারই কি তাহলে
মিসির আলী!
No comments:
Post a Comment