__________________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - দহনের কাল।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭
গল্প - প্রতিশোধ
__________________________________
প্রতিশোধ
দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে
ছুটছে শিহান। ছুটতে ছুটতে হোঁচট খেল। উল্টে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিল। ছুটতে ছুটতে আলোর
বৃত্তের বাইরে এল। অন্ধকার শুরু হয়েছে। নিকষ কালো অন্ধকার। শিহান এখন অন্ধকারের
প্রানী/মানুষ। অন্ধকার যত ঘনকৃষ্ণ (গভীর হয়) শিহান তত ভালো
দেখতে পায়। শহরের সাতরাস্তার মাথায় এসে পশ্চিমের পাহাড়ি রাস্তাটা ধরে এগিয়ে গেল। আরেকটু এগোলে
পাহাড়ের দিকে যে রাস্তাটা উঠে গেছে সে পথে চলতে চলতে পাহাড়ের গভীরে হারিয়ে যাবে সে। কিন্তু একটু
আগে যে ঘটনাটা ঘটল সেটাতো শিহাবের কাঙ্ক্ষিত ছিল না। দীর্ঘদিন পরিকল্পনা
ও প্রস্তুতি নিয়ে যে শিকারকে সে ধরাশায়ী করতে চেয়েছিল মুহূর্তের ঘটনায় তা ভেস্তে গেল। উল্টে আর যা
করার কথা সে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি তাই ঘটে গেল।
মা, মা তুমি কেন লোকটার সামনে এসে
দাঁড়ালে। তুমিতো জানো না মা, কত কষ্ট করে আমি এ যন্ত্রটা জোগাড় করেছি। কত
প্র্যাকটিস করে নিশানা ঠিক করেছি। কত গোপন প্রক্রিয়ায় বুলেটগুলো সরিয়েছি। অথচ তুমি
সব নষ্ট করে দিলে মা। তুমি কেন সামনে এসে দাঁড়ালে। কেন লোকটাকে বাঁচাতে চাইলে। ঐ
লোকটার তো আরো আগেই মরে যাওয়া উচিত ছিল। যেদিন থেকে লোকটা আমাকে তোমার কাছ থেকে
সরিয়ে নিল, আমার পরিচিত আবাস, পরিবেশ, বন্ধু থেকে সরিয়ে আমাকে ঐ চারদেয়ালের মধ্যে
নিক্ষেপ করল সেদিন থেকেই আমি লোকটার ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে আছি। তারপর যত বড় হয়েছি
অত্যাচারে অবিচারে দিনে দিনে আমার মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা প্রবল হয়েছে। ঐ আবদ্ধ
দেয়ালগুলো দিনে দিনে যত উঁচু হয়েছে ততই আমি সংকল্পে অটল হয়েছি। মনে হয়েছে আমাকে
বিপথে ঠেলে দিয়ে লোকটার বেঁচে থাকার অধিকার নেই।
-মা, মাগো
দুহাতে নিজের চুলগুলো শক্ত মুঠিতে ধরে
হাঁটু গেড়ে বসল শিহান। চোখে ভাসছে মায়ের লুটিয়ে পড়া দেহটা। বুকের বাঁ দিক থেকে
মুহূর্তে ফিনকি দিয়ে ছুটে আসা লাল রক্তের বন্যা। হতবিহ্বল হয়ে একদন্ড দাঁড়িয়ে ছিল
সে। তারপর সম্বিৎ ফিরে পেতে ছুটে পালিয়েছে। ছুটতে ছুটতে অন্ধকার এই পাহাড়ের
ঘুপচিতে নিজেকে আড়াল করেছে। সেজদার ভঙ্গিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
এবার ক্লাস ফাইভ শেষ করবে শিহান। ইংরেজি
স্কুলের মেধাবী ছাত্র। দুই মেয়ের পর ছেলে। মায়ের চোখের মনি। ধনী পরিবারের এই পুত্র
সন্তানটি না জন্মালে সব ধনসম্পদ আত্মীয়রা লুটে নিত। নিকট আত্মীয়রাতো আরো বেশি
শ্যেন দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। ছেলে এলে তার পাশাপাশি মেয়েদের অধিকারও বাড়ে।
স্বস্তির পাশাপাশি ফুটফুটে ছেলের দিকে তাকালেই বুকটা ভরে ওঠে মা ফরিদা বানুর।
সমস্যা দেখা দিল ছেলের বাবাকে নিয়ে।
ছেলের জন্মের পর বাবা হজ করেছিল। মা ফরিদা খুশি ছিল। ছেলের বিপদ বালাই দূর হবে।
তিন বছরে মাথায় প্লে-তে ভর্তি করা হল। বোনদের সঙ্গে ছোট্ট শিহান স্কুলে যায়।
প্রতিদিন সকালে বায়না, মা তুমি চলো।
-না বাবা, মায়ের কত্তো কাজ। তুমি আপুদের
সাথে যাও। তারপর ছেলের কপালে একটা চুমু দিত।
স্কুল থেকে ফেরার সময় হলে মা বারান্দায়
এসে দাঁড়িয়ে থাকত। তিন ভাইবোন। গাড়ি থেকে নেমে একছুটে এসে জড়িয়ে ধরত। কার আগে কে ধরবে এই
প্রতিযোগিতা। ছোট্ট শিহানের জেদ ছিল সে আগে ধরবে। পিঠোপিঠি বড়বোন দুটো তা মানতে
চাইত না।
ক্লাস ফাইভে ওঠার আগে থেকেই বোনরা বলত,
তোকে বাবা মাদ্রসায় দেবে।
-মাদ্রাসা? মাদ্রাসা কী? কেন দেবে?
শিহান অবাক হয়ে প্রশ্ন
করত।
-ওমা! কি বোকা, জানিস না বুঝি মাদ্রাসায়
আরবী লাইনে পড়ালেখা শেখায়।
-কেন, কেন মাদ্রাসায় কেন পড়ব আমি? আমিতো
এখানেই ভাল আছি। তোমাদের ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
-কিন্তু বাবা যে নিয়ত করেছে তোকে
মাদ্রাসায় পড়াবে।
ও লেভেল পরীক্ষার্থী
বড়বোন সোহানা বলেছিল।
-নিয়ত কি?
আবারও প্রশ্ন করে
শিহান।
-নিয়ততো আমি পারি। রোজার নিয়ত, নামাযের
নিয়ত, গোসলের নিয়ত। এগুলো তো হুজুর আমাকে শিখিয়েছে। এসবের জন্য মাদ্রাসায় যেতে হবে
কেন?
শিহানের বোকামীতে দুবোন হেসে ওঠে।
-আরে বোকা তা নয়। এতদিন যেমন ইংলিশ
মিডিয়ামে পড়েছিস এবার আরবী মিডিয়ামে পড়বি।
-কক্ষনো না। নেভার। আমি ওসব পড়বই না।
-হুঁ তুমি বললে
হবে। বাবা বলেছে
মেজবোন ইশানা চোখ পাকিয়ে
বুঝিয়ে দিতে চায়।
শিহান ছুটে যায় মায়ের কাছে।
-মা, বাবা নাকি আমাকে মাদ্রাসায় পাঠাবে?
-কে বলেছে এ কথা?
মা সন্ত্রস্ত হয়ে
প্রশ্ন করেন।
-কেন,আপুরা বলেছে। আমি কিন্তু তোমাকে
ছেড়ে কোথাও যাব না। তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না মা।
এগারো বছরের শিহান মাকে জড়িয়ে ধরে। মাও
ছেলেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে, না বাবা, তুমি কোথাও যাবে না। তোমাকে ছেড়ে
আমিও থাকতে পারব না। মানিক আমার, আমার সাত রাজার ধন।
মা শিহানের মাথায় হাত বুলায়।শিহান মায়ের
বুকে মুখ গুঁজে আশৈশব পরিচিত মায়াবী গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আর মনে মনে আওড়ায়- আমি
কোথাও যাব না। যাব না।
ইদানিং প্রায়ই মা-বাবার ঝগড়া হয়। বাবা
শিহানকে মাদ্রাসায় পাঠাবে। ছেলে হলে তাকে মাদ্রাসায় পড়াবে এই নিয়ত ছিল শিহানের
বাবার। কিন্তু মা কিছুতেই রাজি নয়। এত আদরে লালিত শিহান কিভাবে মাদ্রাসায় থাকবে।
তাছাড়া আরবি লাইনে পড়লে পরবর্তী জীবনে এত বড় ব্যবসা-বাণিজ্য চালাবে কি ভাবে।
-এসব ফালতু কথা। আল্লাহ যেভাবে রিজিক
রাখবেন সেভাবেই হবে। তাছাড়া চেয়ারে বসলে ব্যবসা এমনিতেই আসবে। এ ব্যবসা আমাদের তিন
পুরুষের।
বাবার উত্তর। কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে
রণেভঙ্গ দিয়ে মা কান্নাকাটি শুরু করেন। একটামাত্র ছেলে আমার। আমি ওকে কিছুতেই কোল
ছাড়া করব না।
কিন্তু মায়ের কান্নায় কোন কাজ হয় না।
বাবা তাকে মাদ্রাসায় ভর্তির সিদ্ধান্তে অটল। কাছে ডেকে শিহানকে বোঝান-
-বাবা আমি নিয়ত করেছি, তোমাকে ধর্মীয়
শিক্ষা দেব, তোমাদের দুই বোনের পর তুমি যখন তোমার মায়ের গর্ভে এসেছে তখনই আমি
আল্লার কাছে প্রার্থনা করেছি ছেলে হলে তাকে মাদ্রাসায় পড়াব।
-আমার জন্মের
আগেই তুমি ডিসিশান নিয়েছ?
-হ্যাঁ বাবা।
তারপর একদিন সকালবেলা বোনরা যখন গাড়িতে চড়ে
স্কুলে যাচ্ছিল তখন আরেকটা গাড়িতে চড়ে শিহান যাত্রা করল নতুন গন্তব্যে।
মাদ্রাসায় যাওয়ার পর প্রিন্সিপাল স্যার এগিয়ে
এসে বাবার সাথে হ্যান্ডশেক করলেন। শিহানকে কাছে ডাকলেন, তোমার নাম কি
বাবা?
-আসিফ সোবহান শিহান।
-মাশাল্লাহ, মাশাল্লাহ।
-কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছ?
-স্ট্যান্ডার্ড ফাইভ
-সোবহান আল্লাহ। এখন তোমাকে দ্বীনি
লাইনে লেখাপড়া করতে হবে। দ্বীনি এলেম হাসিল বড় সওয়াবের কাজ। দুনিয়া আর
কয়দিনের। আল্লাহ গাফুরুর রাহীম - বলে তিনি
বাঁ হাতে দাড়ি মুঠো করে ধরেন।
ভর্তি হওয়ার পর লাগেজ বেডিংসহ তাকে
হোস্টেলে পাঠিয়ে দিল। যাবার আগে বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন- যাও বাবা
ফি-আমানিল্লাহ।
শিহান হোস্টেলের দারোয়ানের সাথে
দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়।
তারপর আমার কি হল তোমরাতো জানো না বাবা।
শিহান থুতু ফেলল মাটিতে। বাবা! লোকটাকে
বাবা ডাকতেও ঘৃণা হয়। তার মনে পড়ে প্রথম দিনই তার বাড়ি থেকে আনা দামি বিস্কুটের
প্যাকেট আর চকোলেট চুরি হয়ে গেল। রুমমেটদের চার্জ করতেই তারা একসঙ্গে বলে উঠল- -আস্তাগফিরুল্লা, আমরা কেন তোমার জিনিস
চুরি করতে যাব। তওবা, তওবা।
সবকিছু জেনে বুঝেও তাকে চুপ থাকতে হল।
কারণ রুমমেট ঐ দুজন তার চেয়ে যথেষ্ট বড়। তাদের গালে নতুন ওঠা দাড়ি। শরীর ঢ্যাঙা
লম্বা। সহজাত বোধ তাকে বুঝিয়ে দিল, এদের সঙ্গে সে পারবে না।
সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা লেগেছিল ওয়াশরুমে
গিয়ে। এত নোংরা আর দেয়ালে হিজিবিজি আজেবাজে লেখা। মনে পড়েছিল, বাসার ঝকঝকে
ওয়াশরুমের কথা। স্কুল থেকে ফিরে ইচ্ছেমত বাথটাবে শুয়ে থাকা। মা এসে টেনেও তুলতে
পারত না। আর এখানে! গোসল না করেই তাকে ফিরতে হয়েছিল। কিন্তু টয়লেট না করেতো থাকা
যায় না। ঘিনঘিনে একটা অনুভূতি নিয়ে সারাটা দিন কেটেছিল। খেতেও পারছিল না। কিন্তু
মানুষ এমন এক প্রানী পরিবেশের প্রভাবে দিনে দিনে সব সয়ে যায়।
মনে আছে ছুটিতে বাসায় গেলে মা প্রায়ই
বলত, শিহান তুই যেন কেমন হয়ে গেছিস। অগোছালো, এলোমেলো।
-যাও না ওখানে তুমিও এমনই হবে- রাগ করে
মাকে বলেছিল।
মনে আছে, মা বাবাকে বলেছিল, ছেলেটা কেমন
বদলে যাচ্ছে। তুমি নাহয় প্রিন্সিপালকে বলে ওকে বাসা থেকে আসা-যাওয়া করে লেখাপড়ার
ব্যবস্থা কর।
-না। বাসায় থাকলে লেখাপড়ার মন বসবে না।
এ শিক্ষার লাইন আলাদা। বাসায় টেলিভিশন আর চারপাশের রংতামাশা দেখলে পড়ার বারোটা
বাজবে।
মায়ের কথায় আশান্বিত শিহান বাবার কথায়
ভীষণ হতাশ হয়েছিল। বুঝতে পেরেছিল মানুষটা তাকে ঐ ইঁদুরের কলেই পিষে মারবে। সেই
থেকে মনে মনে বাবার প্রতি একধরনের বিতৃষ্ণা জমতে থাকে।
একদিন দেখল দামি ঘড়িটা নেই। এই ঘড়িটা
মেজমামা সুইজারল্যান্ড থেকে পাঠিয়েছিল। রেগে গিয়ে রুমমেটদের চোর বলে গালি দিতে
একজন এসে এমন জোরে থাপ্পড় মারল যে পড়তে পড়তে টাল সামলে নিয়েছিল। জীবনে সেই প্রথম
মার খেয়ে তের বছরের শিহান কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে অনুভব করেছিল, কেউ যেন
তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। শিহান নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলে কানের কাছে
ফিসফিসিয়ে একটা কন্ঠ বলে উঠল- কালাম হারামজাদা তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছে তাই না? আমি
তোকে অনেক অনেক আদর করব কিন্তু সাবধান একটুও শব্দ করবি না, তাহলে গলা টিপে মেরে
ফেলব।
ভয়ে আতঙ্কে পাথর হয়ে যাওয়া শিহান সেই
রাতে চুপ করে তার শরীরের ওপর ভয়ানক পাশবিক অত্যাচার দাঁতকামড়ে সহ্য করেছিল। তারপর
তো অন্ধকার থেকে ক্রমশ গভীর অন্ধকার সুড়ঙ্গে যাত্রা।
দাখিল পরীক্ষার পর বাবা বাসায় নিয়ে যেতে
এসেছিল। প্রিন্সিপাল স্যার বলেছিলেন, এতদিনতো পরীক্ষা দিল। এসব কিতাবের এলেম। এখন
আমরা তালিবে এলেমদের কিছুদিন ধর্মীয় আদব-কায়দা হাতেকলমে শিক্ষা দিব। দ্বীনি এলেমের
আসল শিক্ষাতো এটাই।
বাবা ফিরে যাবার সময় বলেছিল, তাহলে থাক
বাবা, পরে একসময় যেও।
সেদিন শিহানের মনে হয়েছিল, বাবাকে আঁচড়ে
কামড়ে ফালা ফালা করে দিতে। কিন্তু কিছু না বলে শুধু রুক্ষ চোখে তাকিয়ে ছিল।
বাবা বিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিল- বাসায় যেতে
ইচ্ছে করছে না তাই না?
-না।
শিহান কঠিন স্বরে জবাব
দিয়েছিল।
মাদ্রাসায় কদিন ধরে কেমন একটা গুঞ্জন।
রাতে হোস্টেলে হেদায়েত স্যার আসে। ছাত্রদের নিয়ে বসে। তাদের বোঝাতে চেষ্টা করে
দ্বীনের তরিকা অনুসরণ করলে কিভাবে দুনিয়া ও আখিরাতে ফল পাওয়া যাবে। কিন্তু তারও
আগে দেশে প্রচলন করতে হবে ধর্মীয় শাসন। বিধর্মী, বিদাত্রী আর নাস্তিক নাফরমানে দেশ
ভরে গেছে। দেশের মানুষ বলে জয়বাংলা। এইটা কোন শ্লোগান হইল? এইটাতো মালাউনগো ভাষা।
আমরা বলমু, নারায়ে তকবীর, আল্লাহু আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
-দেশে কিভাবে ধর্মীয় শাসন চালু হবে
স্যার? শিহান প্রশ্ন করে।
-এইটা কি বোকার মত প্রশ্ন করলা। তোমাদের
মত নওজোয়ান সেনানী থাকতে ধর্মীয় শাসন চালু করা কোন ব্যাপার? নাইজুবিল্লাহ। তোমরাতো
একেকজন খালিদ, হামজা। তোমাদের আমরা এমন শিক্ষা দিব যেন আগামী দশ বছরের মধ্যে দেশে
আমাদের খিলাফত কায়েম হয়। আমরা তোমাদের সব শিক্ষা দিব। বল, ইনশাল্লাহ।
ছাত্ররা সমস্বরে বলে উঠল ইনশাল্লাহ।
রাত গভীর হতে থাকে স্যার বয়ান করতে
থাকেন কিভাবে খৃষ্টান আর ইহুদি নাসাররা মুসলমানদের ধ্বংস করে দিচ্ছে।
প্যালেস্টাইনে আফগানিস্তানে, সিরিয়া, ইরাকে কোথায় তারা হামলা চালাচ্ছে না। কিন্তু
মুসলমানরাও কম যায় না তারা আলকায়েদা, তালেবান গঠন করে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে।
পৃথিবীর সব দেশ থেকে মুসলিম নওজোয়ানরা ইহুদি নাসারদের বিরুদ্ধে দলে দলে যোগ
দিচ্ছে। -তোমাদেরও যাইতে হইব। অস্ত্র
ধরতে হইব। তবে তার আগে দেশে নাস্তিক, মুনাফেকদের শ্যাষ করতে হইব।
তালেবে এলেমরা চুপ করে শোনে। তাদের
কল্পনায় ভেসে ওঠে মুসলমানদের উপর অত্যাচারের ছবি, তারা প্রতিজ্ঞায় কঠোর হতে থাকে।
হঠাৎ শিহান প্রশ্ন করে- স্যার
মুসলমানদের নিজেদের মাঝেও তো নানা বিভেদ। শিয়া, সুন্নী, আহমাদিয়া তারপর আছে চার
মাজহার।
স্যার ধৈর্য নিয়ে শিহানের কথা শুনেন।
কারণ তাঁকে ভাবতে হচ্ছে। ইতিপূর্বে কোন তালিবে এলেম এরকম প্রশ্ন করেনি। কিছুক্ষণ
চুপ করে থেকে শিহানের দিকে তাকিয়ে বললেন- তোমার মনে প্রশ্ন আছে। জ্ঞানের জন্য এটা
খুব ভাল কথা। তবে এ ব্যাপারে আমার উত্তর আমি তোমারে আরেক দিন বলব। এখন আমার
কথাগুলো মনোযোগ দিয়া শুন- আমরা দ্যাশে ইসলামী শাসন চালু করতে চাই। আর সেজন্য
তোমাদের উইঠ্যা পইড়া লাগতে হবে। প্রয়োজনে অস্ত্র ধরতে হবে। জীবন দিতে হবে। মনে
রাইখো এই জিহাদে মরলে তোমরা শহীদ আর বাঁচলে? বাঁচলে গাজী। খিলাফত হইব তোমাদের। কি রাজি আছ
ধর্মের রাস্তায় মরতে? নাকি ডর করে! ডর করলে এখনই সইরা যাও। এ পথ ভীরু কাপুরুষের
নয়। এ পথ গাজী অথবা শহীদের। এখন কও তোমরা কি ডরাও?
-না স্যার ডরাই না। দরকারে জান দিমু।
উপস্থিত একজন বলে উঠল।
একসঙ্গে সবাই ফিরে তাকাল সেই তরুণের দিকে। তার ঠোঁটের দৃঢতার সাথে চোখে হিংস্রতা।
-হাছান তো জবাব দিল। বাকিরা কি কও।
তোমাদের কি ওর মত বুকের পাটা নাই?
-জী স্যার আমরাও রাজি। দরকার হইলে জীবন
দিব।
-শোকর আলহামদুলিল্লাহ।
তারপর স্যার বয়ান করেন
মুসলমানরা দুনিয়াতে কতটা অত্যাচারিত। বির্ধমীদের কারণে মুসলমানরা লাঞ্ছিত। এই
জন্যই তো কবি লিখেছেন, রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি।
তারপর থেকে প্রায় প্রতিরাতে চলে বৈঠক।
বয়ানে বয়ানে উদ্দীপ্ত করেন শিক্ষক। একদিন এলেন আরো দুজন- তারা বাংলা, ইংরেজি,
আরবীতে বয়ান করতে লাগলেন জাতির দুর্দশার কথা।
-এ বেহাল, বে এলেম জাতিকে জাগাবে কে?
তোমরা তোমাদের মত আরও হাজার তরুণেরা। তবে তার আগে সেইসব শত্রুকে শেষ করতে হবে যারা
গণতন্ত্রের কথা বলে সব ধর্মের মানুষকে এক করতে চায়। আরে সৃষ্টিকর্তা যেখানে
ভিন্নভাবে সৃষ্টি করেছেন সেখানে তোরা এক করবি কীভাবে?
ঘৃণা আর
অসন্তোষ ঝরে পড়ে তাদের কন্ঠে। আর কৈশোর পেরিয়ে সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া ছেলেদের
রক্ত টগবগ করে ওঠে। মাথাটা কিলবিল করে প্রতিশোধের নানা চিন্তায়। তারা তসবির মত জপ
করে “মরলে শহীদ,
বাঁচলে গাজী। হ্যাঁ ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
দিনের পর দিন এভাবে ব্রেনওয়াশেও শিহান
ঝিমিয়ে পড়ছিল। তার ইচ্ছা ছিল ছুটিতে বাসায় গিয়ে মাকে বলে বাবাকে রাজি করাবে কলেজে
পড়ার জন্য। কিন্তু বাবা নামের মানুষটা তাকে সে সুযোগ দিল না। যাবার সময় বলে গেল-
পড়াটা মন দিয়ে শেষ কর তারপর আমি তোমাকে ব্যবসা শেখাব।
ঘৃণায় সমস্ত শরীর রি রি করে উঠেছিল
শিহানের। এখানেই যদি পচতে হবে তাহলে ব্যবসা শিখে কী হবে?
একদিন সকালে শিক্ষাসফরের উদ্দেশ্যে
শিহানরা একদল রওনা হল রাঙ্গামাটি। তারপর শুরু হল দুর্গম পাহাড়ী পথে যাত্রা। একটা
জায়গায় এসে গাড়ি রেখে তারা নৌকায় চড়ল। তারপর হাঁটা। আঁকাবাঁকা ঘোরানো পথ পেরিয়ে
অবশেষ তারা থামল এমন একটা জায়গায় যার চারপাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। দেড়দিনের পথ
চলায় সবাই ক্লান্ত। শনের ছাউনি দেওয়া ঘরগুলো মাটিতে পাতা বিছানায় জিরোতে গিয়ে
অনেকেই ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন ঘুম ভাঙতেই ডাক পড়ল। প্রাতঃকৃত্য
আর খাওয়ার পর শুরু হল ট্রেনিং। সারাদিন চাঁদমারি, বন্দুক পিস্তলে লক্ষ্যভেদ। রাতে
ছুরি কিরিচের ব্যবহার। লাশ বানাতে না পারলেও পঙ্গু করে দিতে হবে জাহেল, বেজলেমদের।
জ্বালাময়ী বক্তৃতায় তরুণ প্রশিক্ষণার্থীরা জোশে বলীয়ান হয়ে ওঠে। তারা যেন দেখতে
পায় শত্রুকে হত্যা করার পর তাদের উল্লাস। একেকজন বার বার ধরে দেখতে চায়
অস্ত্রগুলো।
শিহানের ভিতরেও ক্রোধ। সে তো এসব চায়নি।
এত হিংস্রতা তার ভালো লাগে না। ছোটবেলায় পড়া রুপকথার রাজপুত্রের মতো বন্দি আর
অসহায় মনে হয় নিজেকে। কিন্তু যেদিন পিস্তলটা হাতে এল। সেদিনের কথা মনে হল।
অস্ত্রের এমন গুণ। শিহানের ভিতরে প্রতিশোধের কামনা জ্বলে উঠল। মনে মনে শুধু
উচ্চারণ করল- ভন্ড, অপেক্ষা করো আমি আসছি।
তিন সপ্তাহ ট্রেনিং শেষে ওরা যখন ফিরে
এল তখন সবাই অন্য মানুষ।
আজ সন্ধ্যায় শিহান
বেরিয়ে এসেছে সবার অলক্ষ্যে। পিস্তলটা আগেই সরিয়ে রেখেছিল। দলের নেতাকে বলেছিল,
আমি আরো প্র্যাকটিস করতে চাই।
সে বলেছিল, সাবধান ধরা পড়লে তোমাকে আমরা
বাঁচাতে যাব না।
-আরে বাঁচতে চাইলে তো বাঁচাবে।
মনে মনে
বলেছিল। মুখে বলেছিল, বাসায় যাব, আমার কাছেই থাকবে। বাসার পাশে পাহাড় আছে না ওখানে
প্র্যাকটিস করব। কেউ জানতেই পারবে না।
দারোয়ান দরজা খুলে দিয়েছিল। তারপর হন হন
করে বারান্দায় উঠে কলিংবেল দিতে বুয়া দরজা খুলে দিয়েছিল। শিহান সরাসরি গিয়ে দাঁড়াল
মা বাবার ঘরের দরজায়। বাবা চেয়ার থেকে উঠতে যাচ্ছিলেন। শিহান চাপাকন্ঠে বলেছিল, এক
পাও নড়বে না। আমি তোমাকে খুন করব।
এক মুহূর্তমাত্র। মা যে কীভাবে ছুটে
গিয়ে লোকটাকে আগলে দাঁড়াল। ততক্ষণে রিভলবারের গুলি ছুটে গিয়েছে।
হায় মা! তুমি কেন লোকটাকে বাঁচাতে গেলে।
পাহাড়ের বুকে গড়াতে গড়াতে শিহান বিলাপ করতে লাগল। যে লোকটা নিজের ইচ্ছাপূরণের জন্য
আমার জীবনটা শেষ করে দিল তার জন্য কেন তুমি জীবন দিলে। মা, মাগো।
রাত হালকা হচ্ছে। শিহান পকেটে পিস্তলটার
উপস্থিতি যাচাই করে। বিড়বিড় করে বলতে থাকে- আমি আবার আসব। তোমার ক্ষমা নেই।
এলোমেলো পায়ে টলতে টলতে পাহাড়ের পথে
আবছায়ায় মিলিয়ে যায় শিহানের অবয়ব।
No comments:
Post a Comment