-----------------------------------
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫
___________________________________
৩১
ঢাকায়
ফিরেই ব্যস্ত হয়ে গেল জহির। মায়ের মৃত্যুতে আত্মীয়-বন্ধু
যারা এসেছে বা ফোন করেছে
তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে ব্যবসা
প্রতিষ্ঠানের প্রধান পরিচয়ে পত্রিকায়
বিজ্ঞপ্তি দিল। কম্যুনিটি
সেন্টারে কুলখানির আয়োজন করল।
তারপর বসে গেল চেহলামের
বাজেট এবং প্ল্যান নিয়ে। মায়ের রুমটা খালি হয়ে গেছে। এখন সেখানে বসেই নিরিবিলিতে
কাজ করে প্রয়োজনে পরামর্শ
নিতে সাবেরাকে ডাকে, ফোনে
লীলার সাথে যোগাযোগ করে। বাড়ির সব কাজে
লীলা তার মন্ত্রকও বটে। বেঙ্গলমিট এর সাথে
কথা হয়েছে ওরা তিনটন গরুর মাংস পাঠাবে
ফ্রিজার কন্টেইনারে। বাবুর্চি
ফখরুদ্দিন এর লোকেরা দেবে। চাল-ডাল-তেল-নুন সবই যাবে
ঢাকা থেকে। শুধু
ডেকোরেটর নিজেদের শহর থেকে
নিতে হবে। এম পি ভাইকে
বলা হয়েছে এসব ব্যবস্থা
তিনিই করবেন। গাছ কেটে লাকড়ি জমা করা হচ্ছে।
জহিরের
ইচ্ছা একাই যখন করছে মায়ের চল্লিশাটা ইচ্ছাপূরণ করেই করবে।
এইতো শেষ।
কাকার মৃত্যুর পর তিনভাই মিলে একটা বড় জেয়াফত দিয়েছিল।
সেটার উদ্দেশ্য অবশ্য ভিন্ন ছিল।
তখন এলাকার মানুষকে এটা জানানো দরকার ছিল যে ছোটচৌধুরীর উত্তরসূরীও তারা।
শীলা যেন কোনভাবেই সামনে না আসে।
আম্মাও চেয়েছিলেন।
শীলা অবশ্য এ নিয়ে
কোনদিন উচ্চবাচ্য করেনি।
শুধু আত্মীয়স্বজনের অনুষ্ঠানে দেখা হলে এড়িয়ে যায়।
জহিরের ইদানিং মনে হয় কাজটা ঠিক হয়নি।
সেটা অবশ্য বেশিক্ষণ মনে রাখে না। কারণ এসব কথা মনে রাখলে জীবনে আর ওপরে ওঠা লাগবে না।
মায়া তো
মানুষকে নিচের দিকে টানে।
কি দরকার এত মায়ার!
"বাবা"
"কে?
অরিন আয়। কিছু
বলবি? আজ না তোর ভিসার
জন্য যাওয়ার কথা, যাসনি?"
"না বাবা,
ইচ্ছে করছে না।"
"ঠিক আছে,
আজ থাক। কালকে
যাস।"
জহির আবার হিসাবে
মন দিলেন। এগুলো
শেষ হলে আত্মীয়স্বজনের লিস্টটা
করতে হবে। বংশের
সঙ্গে যোগসূত্র আছে এরকম
কাউকে বাদ দেয়া যাবে
না। রফিককে দায়িত্ব
দিয়েছে সবার নাম-ঠিকানা
জোগাড় করতে। তস্য তস্য মানুষেরাও যেন বাদ না যায়।
"বাবা।"
"কিরে কিছু বলবি?"
"হ্যাঁ।"
"তাহলে চুপ করে আছিস কেন বল? টাকা লাগবে? তাতো তোর মায়ের কাছেই আছে।
যা লাগে নে।"
"না বাবা, অন্য একটা কথা।"
"কী কথা আবার!"
"না থাক।" অরিন উঠে দাঁড়ায়।
"আরেকদিন বলব।
এখন তুমি ব্যস্ত।"
"আরে আমার ব্যস্ততাতো আরো বাড়বে। আর তোরও যাওয়ার সময় এসে যাবে।
যা বলবার এখনই বল।"
অরিন দ্বিধান্বিত
হয়ে আবার খাটে বসে। বাবার দিকে চোখ তুলে
তাকাতে ভয় লাগছে। তবু আমতা আমতা করে বলল,
"আচ্ছা বাবা আমি যদি না যাই।"
"কোথায়?"
– একটু জোরেই যেন বলল জহির।
"বলছিলাম যদি আমেরিকা
না যাই। এখানেই
পড়াশোনা করি।"
"কী বলছ অরিন!" চিৎকার করে উঠল জহির। "সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার
পর তুমি এসব কী
বলছ? কেন যাবে না,
কী সমস্যা তোমার?"
জহিরের উচ্চস্বর শুনে সাবেরা ছুটে
এল।
"কী
হল এত চিৎকার করছ কেন?"
"করছি কী আর আনন্দে? তোমার মেয়ের কথা শোন। সে বলছে আমেরিকা যাবে না।"
সাবেরা বিস্মিত দৃষ্টিতে অরিনের দিকে তাকায়। "তাই বলেছ অরিন?"
"না মা, আমি যাব না বলিনি।
বলেছি যদি না যাই। কিন্তু বলার আগেই বাবা রেগে গেল।"
"হ্যাঁ রাগব না, কী বলছ তুমি? সবকিছু ঠিক হওয়ার পর এসব কথা কেন আসছে?"
"সবকিছু ঠিক হওয়ার আগে বললেও কি তোমার কথার নড়চড় হতো?"
মেয়ের কথায় যেন আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেল জহির।
কী বলছে মেয়ে।
তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "কিভাবে
বুঝলে নড়চড় হত না!"
"বুঝেছি তোমাকে দেখে।
আমাদের এ সংসার
তো তোমার নির্দেশেই চলে, ওঠে বসে।
মা ভালমানুষ বলে মেনে নেয়, হাঙ্গামা করে না।"
"বাবাকে
এসব কী যা তা বলছ অরিন?" সাবেরা ধমকে উঠল।
"না মা, যা তা নয়। শুধু সত্যি কথাটা বলছি। আমিতো বাবারই মেয়ে। সামনে
আমার বয়স উনিশ পেরিয়ে
কুড়িতে পড়বে। কেন তোমরা
মনে কর আমি এতটা
ছোট যে আমার কোন ইচ্ছে
অনিচ্ছে নেই, বাবার
ইচ্ছেই সব?"
"কেন বাবা
কি তোমার ভালর জন্য
এসব করেনি?"
"অবশ্যই
করেছে। কিন্তু আমার
ইচ্ছেরও তো একটা দাম থাকবে
তাই না মা! আমার
যে সবাইকে ছেড়ে এত দূরে
যেতে ইচ্ছে করছে না সেটা
তোমরা বুঝতে চাইছ না কেন?"
"তুমি
আগে বোঝনি সেটা?"-
জহিরের কন্ঠে ঝাঁঝ।
"না বাবা,
আগে এভাবে বুঝিনি। কিন্তু
এখন যতই যাবার দিন এগিয়ে
আসছে ততই বুঝতে পারছি।"
জহিরের মনে হল নিজের
মাথায় একটা বাড়ি মারে
অথবা মেয়ের মাথায়। সবাই
জেনেছে মেয়ে আমেরিকা যাবে
এখন দেখি মান ইজ্জত
সব ডোবাবে।
"ঠিক আছে তুমি
এখন যাও। আমি পরে তোমার
সাথে কথা বলব। আর যেহেতু
আমি তোমার বাবা আমার
কথা অবশ্যই মানতে হবে।"
বাবার কথায়
অরিন বেরিয়ে এল। বেরিয়েই
দেখতে পেল কোমরে হাত দিয়ে
আরিয়ানা দাঁড়িয়ে আছে। থোকা
থোকা কাঁধ পর্যন্ত চুল আর প্যান্ট-শার্টে
তাকে দুর্দান্ত টমবয় মনে হচ্ছে। অরিনকে দেখে তার দিকে
এগিয়ে এসে বললো Princess chowdhury you have fall in love আহারে
dady’s good baby কষ্ট
পাবে তবু বলবে না। টিপিক্যাল বাঙালি
মেয়ে, কেন বাবাকে বলতে
পারিস না, আমি একজনকে
ভালবাসি তাকে ছেড়ে আমেরিকা
যাব না। ক্যান?"
এতক্ষণ
অরিনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে কথা বলছিল। এবার তাকে পিছন থেক জড়িয়ে ধরে বলল, "my poor sister আরো সাহসী হতে চেষ্টা কর।"
হঠাৎ আরিয়ানা টের পেল মা পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
তার মানে সব শুনতে পেয়েছে। বোনকে
ছেড়ে দিয়ে এবার মায়ের দিকে ফিরল।
"তুমি কি আমাদের সব কথা শুনতে পেয়েছ মা?"
"হ্যাঁ।"
"তাহলে জেনে গেলে তো তোমার কন্যাটি কেন দেশ ছেড়ে যেতে চায় না।
বলতে না পেরে সবাইকে ছেড়ে থাকতে পারব না বলে pretend করছে।
ঢ-অং। আমরা যেন বুঝি না তাইনা মা?" বলতে বলতে হি হি করে হেসে উঠল আরিয়ানা।
"আরিয়ানা চুপ করো।
তোমার বাবা শুনতে পেলে রক্ষা থাকবে না।"
"কেন রক্ষা থাকবে না।
ভালবাসা, প্রেম এগুলো তো heavenly. এই বিষয়টা তোমরা এত খারাপ ভাবে দেখছ কেন?"
"আরিয়ানা,
চাপা স্বরে মেয়েকে ধমক দিল সাবেরা। পাপ-পুণ্য তুমি বেশি
বোঝ তাইনা। যাও এখান
থেকে।"
"অরিন
তুমি আমার সাথে এসো" বলে অরিনের ডানহাতটা
ধরে জোরে টান দিল। অরিন মাথা নিচু করে মায়ের
সাথে চলল।
"মা ওকে কষ্ট
দিওনা কিন্তু।"
আরিয়ানা পিছন থেকে আবারও
বলল।
"সে আমি বুঝব। তুমি তোমার কাজে যাও।"
আরিয়ানার ভাল লাগে
না। পিঠোপিঠি বোন তারা
বন্ধুর মতও। কিন্তু
বোনটা তার রিয়েলি সোবার। সে নিজে ছোট থেকে
চঞ্চল, ঝগড়াটে, মুখরা। অরিন
কখনও বাবা-মায়ের অবাধ্য
হয়নি। কিন্তু অভীভাইয়ার
সাথে তার যে একটা
রিলেশান তৈরি হয়েছে সেটা
দুজনের বিহেভিয়ারে সে বুঝতে
পারছিল। কিন্তু দাদীর
মৃত্যুর পর বাড়িতে গিয়ে
কী হল কে জানে-
দুজনকেই অন্যরকম লাগছে। যাকগে, মা জেনে
গেছে। এবার অরিন
সাহস করে নিজেরটা সামলাক। আরিয়ানা তার কাজ করে দিয়েছে। কিন্তু বাবা! His Exellency জহির চৌধুরী? dictator and
conservative বাবা কি মেনে নেবে!
ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরের
দিকে যায় সে।
অরিনের বেডরুমের
দরজা বন্ধ করে বিছানায়
মা মেয়ে মুখোমুখি বসে আছে। অরিন মাথা নিচু করে আছে। মায়ের দিকে তাকাতে তার ভয় হচ্ছে। সাবেরার মুখটা রাগে গনগন
করছে। বার বার মেয়েকে
প্রশ্ন করছে "বল,
কে সে যার সঙ্গে
তুমি সম্পর্ক গড়েছ। তুমি
কি বোঝ না এসবের
পরিণতি! তোমার বাবা এসব কখনও
মেনে নেবেন? কেন তুমি
নিজের বিপদ ডেকে আনছ।"
"আমি ইচ্ছে
করে কিছু করিনি মা। কখন যে কী হয়ে গেল।"
"কী হয়ে গেল?
প্রেম! বলতে পারলে তুমি
একথা? কিভাবে কী হয়ে গেল। এমন অজুহাত কেন খাড়া
করছ?"
"অজুহাত
নয় আমি সত্যি বলছি
মা।"
"সত্যি বলছ? যদি সত্যি বলে থাক, তাহলে বল কে সে?
আমরা কি তাকে চিনি?"
মায়ের
কথায় মাথা নাড়াল মেয়ে।
"কে সে?" আবারো প্রশ্ন করল সাবেরা।
"অভী", মাথা নিচু করেই
স্পষ্ট উচ্চারণ করল অরিন।
ঘরে বাজ পড়লেও
বোধহয় এতটা বিস্মিত হত না সাবেরা
যতটা হল মেয়ের মুখে
অভীর নাম শুনে। কিছুক্ষণ কথা খুঁজে
পেল না। তারপর
নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-
"অভী না তোমার
ভাই!"
"হ্যাঁ, মা অভী আমার
ভাই-বন্ধু আর আ-র আমার
ভালবাসার মানুষ। আমি জানি
না মা কখন কিভাবে
এরকম ঘটল। কিন্তু
ঘটেছে এটা সত্যি। মা,
আমি কি করবো মা"- বলতে বলতে মাকে
জড়িয়ে ধরে হু হু
করে কেঁদে উঠল অরিন।
সাবেরা বজ্রাহতের
মত স্তব্ধ। মেয়েকে
কোন কিছু বলার ক্ষমতা
হারিয়ে ফেলেছে। নিজের
ঘরেতো অশান্তি হবেই সেই সাথে
ভাইয়ের সংসারেও। সবচেয়ে
বেশি ভয় অরিনের বাবাকে। সে কিছুতেই এটা মানবে
না। ছেলে-মেয়েদের
প্রেম ভালবাসার সম্পর্ককে এরা এখনও
অচ্ছূৎ মনে করে। তারিকের মেয়েটা তার ছেলের
বন্ধুকে বিয়ে করার পর তারিক
মেয়ের নামতো মুখেই আনে না। আবার আয়নাকেও এ ব্যাপারে
এমন শাসিয়েছে যেন আয়নার
দোষেই সব ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়
পাশ করা ছেলে, এখন ভাল চাকরি
করে, পরিবারও ভাল কিন্তু
ওরা মেনে নিলেও তারিক
নিজের সিদ্ধান্তে অনড়।
"তাহলে এখন কী
করব? তোমার বাবাকে বলব তুমি
এ কারনে যেতে চাচ্ছনা। সবাইকে ছেড়ে যেতে খারাপ
লাগছে- এসব বাজে কথা।
"বাজে কথা না মা। যত দিন কাছে আসছে
ততো বেশি খারাপ লাগছে
বাবার জন্য, তোমার জন্য"
"আর, আর কার জন্য?"
সাবেরা তীব্র চোখে তাকাল
মেয়ের দিকে। সহজে
রাগে না সে। বাচ্চাদের
সঙ্গে তো নয়ই। জীবনে
এই প্রথম মেয়ের সঙ্গে
সে এত রাগ করছে।
"আমার
ভাইবোনদের জন্য, আর অভীর
জন্যেও মা।"
সাবেরা অবাক
হয়ে গেল। ছোট থেকেই
ঠান্ডা ঠান্ডা শান্ত মেয়েটা
তার। সবাই বলত মায়ের
মেজাজ পেয়েছে। কোনদিন
মা-বাবার ওপর কোন কথা বলেনি। আজ কী এমন শক্তি
ওকে এমন দুঃসাহসী করে তুলল!
"আমার চিন্তা
ছিল আরিয়ানাকে নিয়ে।
ও চঞ্চল, মুখের ওপর কথা বলে। তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে
গর্ব করে, তাঁর বাধ্য
মেয়ে বলে। এখন কী
হবে?"
"আমি তোমাদের সত্যি কথা বলেছি।
কী হবে সেটা তোমরা ভাবো।"
"হ্যাঁ, আমি তোমার
বাবাকে বলব। আর তিনি
রাগে তোমার মুখ দেখা
বন্ধ করবেন। তারপরও
তোমাকে আমেরিকা পাঠাবেন। এতদিনতো
বাবার খুব আদর পেয়েছ
লক্ষ্মী মেয়ে বলে, এখন শাসনটাও
বোঝ।"
"তবু আমি যাবো
না। বাবাকে কথাটা
বলে দিও।"
"আমি বলব কেন? তুমিই বলো।"
"তুমি আগে বলো,
বাবা তোমার কথা না শুনলে
আমি বলব।"
সাবেরার ভিতরটা
কেঁদে ওঠে, হায় আমার
শান্তশিষ্ট মেয়েটা নিজের জন্য
এমন বিপদ বয়ে আনল!
হঠাৎ টেবিলে রাখা
মোবাইলটা বেজে উঠল। সাবেরা
তাকিয়ে দেখল- জহিরের ফোন।
"তোমার বাবা
ডাকছেন। আমি যাচ্ছি। তোমাকে আবারও বলছি, ভেবে
দ্যাখো অরিন, সংসারে অশান্তি
হবে। এমনও হতে পারে
তোমাকে আমি হারাবো সেই সাথে
আমার মা, ভাই-বোনকেও।"
অরিন সত্যিটা উপলব্ধি
করে। আজ কদিন
থেকে সেও বিষয়টা নিয়ে
ভাবছে। অভীর সঙ্গেও
কথা হয়েছে। অভির
একটাই ভরসা, তার মা তাকে
কখনও ফেলবে না, অরিনকেও
না।
"আর তোমার
বাবা, মানে আমার মামা?"
"শোন, আমার বাবাও তোর বাবার
মত নয়। আর বাবা
তোকে কত আদর করে বলতো। তিনি বুঝি তোকে কষ্ট
দেবেন!"
অভীর কথা শুনে
মনে কিছুটা সাহস পেয়েছিল
সে। কিন্তু এখন মায়ের
কথায় আবার ভয় লাগছে। আর সব ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার
পর আমেরিকা না গেলে
আত্মীয়স্বজনও নিশ্চয় হাসাহাসি করবে। বাবাকে ছোট হতে হবে সবার
কাছে। ভাবতে
ভাবতে অভীকে ফোন করল সে।
****
৩২
বাড়িটা আজ সকাল
থেকে একদম সুনসান হয়ে আছে। কাল মায়ের কুলখানি ছিল সেটা
শেষ হওয়ার পর তারিক
শরীফরা ভোর ভোর ঢাকার
পথে রওনা দিয়েছে। আত্মীয়-স্বজন
যারা কুলখানির জন্য থেকে
গিয়েছিল তারা কাল বিকেলেই
যে যার মত চলে গেছে। কুলখানিতে গ্রামের সবাইকে পোলাও-কোর্মা
খাওয়ানো হয়েছে। শরীফের
ধারণা গ্রামের মানুষ ভাল খাবার
খাবে কোত্থেকে। সুতরাং
একবার খাওয়ালে অনেকদিন মনে রাখবে। তবে একটা
ঘটনা এর মধ্যে নীরব
বিপ্লবের মত ঘটে গেছে। আফজালদের বাড়ির কেউ আসেনি
দাওয়াতে। তাদের
শরীকের অন্যরাও আফজালদের অপমানে
অপমানিত হয়েছে। আজ নাকি
আফজাল তাদেরকে খাওয়াবে। এ খবর শুনে
লীলার মনে হয়েছিল- ওরা যেন ভাইদের
মুখে কষে একটা চড় দিল।
আজ সকাল থেকে
এই জানালার ধারে বসে অজস্র
স্মৃতি রোমন্থন করছিল লীলা। বাড়িতে এখন সে আর মনা। বাড়তি কাজের মানুষ যারা
ছিল তারা পাওনা আর বখশিশ
নিয়ে বিদায় নিয়েছে। প্রয়োজনে
ডাকলে আসবে। মনা এখন এ বাড়িতেই
থাকে। আগে দাদীর
টানে অনেক রাতে চলে যেত এখন আর সে টান নাই। লীলা লক্ষ করেছে কাজের
ফাঁকে ফাঁকে বা রান্না
করার সময় মনা গুনগুনিয়ে
কাঁদে, চুপি চুপি আঁচলে
চোখ মোছে।
আহা, আম্মার
জন্য কি কেউ এমন করে কাঁদে। মনার দাদীও বুড়ো হয়ে বিছানা
নিয়েছিল আর আমার আম্মাও। কিন্তু আমরা সবাই বিষয়টাকে
কেমন স্বাভাবিক বলে মেনে
নিয়েছি। নাতি-নাতনী
তো দূর ছেলে-মেয়েরাও
সেভাবে দুঃখ পেয়েছে কি!
সবার বড়বোন শেলী আপা নিজেই
এখন বার্ধক্যের ভারে নানা
শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত- ছেলেমেয়েরা
দেশে বিদেশে নিজের সংসার
সামলাতে ব্যস্ত। মাকে
দেখার সময় নেই কখন নানীর
জন্য শোক করবে।
লীলা নিজেও কি খুব দুঃখ
পেয়েছে? কই তার নিজেরতো
মনে হয় না। অনেকদিন
থেকেই সে গ্রামের বাড়িতে
থিতু। তেমন কোন কাজ না থাকলে
ঢাকা যেত না। বরং এখানে স্বাধীনভাবে নিজের
মত রাজ্যপাট চালাতে তার ভালই
লাগে। জমি-জমা,
ধান-পাট, গ্রামের লোকের
নানা বিষয়ে আলাপ-পরামর্শ,
প্রয়োজনে তাদেরকে শাসন ধমক-
উপভোগ্যই মনে হয়।
মাঝখানে মা বেশি
অসুস্থ হওয়ার পর প্রায়ই
ঢাকা দৌড়াতে হত। তার যখন সংসার নেই তখন মাকে
দেখার দায়িত্বটাও যেন তারই
ছিল। মেজভাই
তারিক আর ছোটভাই শরীফ
এবং তাদের স্ত্রীরা লীলাকে
পছন্দ করে না। এটা লীলা নিজেও
বোঝে। বড়ভাইজান আর ভাবী
অবশ্য তাকে যথেষ্ট আদর করত। কিন্তু কয়েক বছর আগে শরীফ
কী একটা ট্র্যাপে ফেলে
বড়ভাইজানকে জেল খাটাতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস ভাইজান আগেই টের পেয়ে
যাওয়াতে কোনরকমে রক্ষা পেয়েছিল। এ ঘটনার পর থেকে সাবেরাভাবী
লীলার উপর কিছুটা মনঃক্ষুন্ন। তার ধারণা এর পেছনে
লীলারও সায় ছিল। লীলা
সবকিছু জেনেও জানায়নি।
লীলা আসলেই জানত না- এটা সাবেরা বিশ্বাস করে না।
সেই থেকে দুজনের সম্পর্কে কিছুটা দূরত্ব বেড়েছে।
কিন্তু লীলাতো জানে তার জীবনে বড়ভাইই একমাত্র নির্ভরতার মানুষ।
তাকে হেনস্থা করে লীলার কী লাভ!
একা একা জীবনের
এতগুলো বছর কিভাবে কেটে
গেল ভাবতে অবাক লাগে
তার নিজেরই। শরীরটা
চিরদিনই শক্তপোক্ত তেমন বড় অসুখ
বিসুখ কখনও হয়নি। যেসব
কারণে মেয়েদের শরীর ভাঙ্গে
বিশেষ করে মাতৃত্ব-
সেই স্বাদও সে পায়নি,
তার জন্য কষ্টও করতে
হয়নি। তাই পঞ্চাশ
পেরিয়ে গেলেও শরীরের বাঁধুনি
তার বয়সী অনেকের চেয়ে
মজবুত।
কিন্তু এ জীবন
কি লীলার চাওয়া ছিল? যে কোন মেয়ের
মত কৈশোর-যৌবনে তারও
তো চাওয়া ছিল একটা
সংসার, সন্তান তাদের ঘিরে
আবর্তিত জীবন।
বিয়ের আগে আসাদকে
দেখে তার মোটেও পছন্দ
হয়নি। তবু আম্মা
আর ভাইজানের চাপে রাজি
হতে হয়েছিল। লীলার
সমবয়সীদের প্রায় সবারই তখন বিয়ে
হয়ে গিয়েছিল এবং দু একজন
বাচ্চার মা। শীলারও
বিয়ে হয়ে মহুল-মনিকার
মা হয়েছে।
ছোটবোনকে বিয়ে
দেয়ার জন্য ভাইজান তাই পড়িমড়ি
করে ব্যস্ত হয়েছিলেন। তার নিজেরও
বয়স বেড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু
বয়স্থা বোন ঘরে রেখে
নিজের বিয়ে করতে হয়তো
সঙ্কোচ হচ্ছিল। অতএব,
বলির পাঁঠা করে বোনকে
জুড়ে দেয়া হলো একটা
মেদোমাতালের সাথে।
বাসর রাতের কথা মনে হলে এখনও
মনটা তিক্ততায় ভরে ওঠে লীলার। কত আশা স্বপ্ন, খুব পছন্দ
না হলেও স্বামীতো বটে। অথচ বাসর রাতের অন্তহীন
অপেক্ষায় যখন সময় কাটছে
তখন শেষ রাতের দিকে
লোকটা ঘরে এসেছিল। পরে লীলা
জেনেছিল তাকে নেশার আড্ডা
থেকে তুলে আনা হয়েছিল। বাড়ী ফিরেই সে গাড়ি
নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।
ঘরে ফিরে লীলাকে
বলেছিল, "তোমাকে তোমার
বড়ভাই বিয়ে দিয়েছে।
আমাকে আমার বোন। আমাদের
দুজনের কেউই নিজের ইচ্ছায়
বিয়ে করিনি। সুতরাং
তুমি তোমার মত থাকো,
আমি আমার মতো।" তারপর পাশ ফিরে
শুয়ে সেই যে ঘুম দিল পরদিন
দুপুরে লীলাদের বাসা থেকে
যখন আত্মীয়-স্বজন এলো তখনও
সে ঘুমাচ্ছিল।
কিছুদিন পর একদিন
আসাদের বড়বোন রাজিয়া বলেছিল,
বিয়ে যখন হয়েছে তখন তোমার
হাজব্যান্ডকে তুমিই শোধরাবার চেষ্টা
কর। আমি তো পারিনি। কথাটা শুনে লীলার সমস্ত
শরীর রাগে রি রি করে উঠেছিল। তারপরও একদিন আসাদকে বলেছিল। শুনে এমন উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল-
"সে বলার কে?
চিরদিনই তো আমার ওপর লাঠি
ঘুরিয়েছে আর নিজে মজা লুটেছে।"
লীলা আসাদের
অস্থিরতা চেয়ে চেয়ে দেখছিল। সিগারেটে টান দিতে
দিতে সে বলছিল, "বার-তের বছর বয়সের
মধ্যে বাবা-মাকে হারিয়ে
তের বছরের বড় একমাত্র
বোনকে মায়ের মত আঁকড়ে
ধরেছিলাম। কিন্তু সেই বোন আমাকে
শাসন করেছে যত,
সোহাগ করেনি তার কণামাত্র। সেই থেকে আমি নিঃসঙ্গ। আমার কোন বন্ধু নেই স্বজন
নেই। আত্মীয় যারা
ছিল তাদেরকে সে কাছে
ঘেঁষতে দেয়নি। নিজের
সন্তান-সংসার নিয়ে দাপটে
সংসার করেছে আর আমাকে
শুধু শাসন করেছে।"
"তাহলে
বিয়ে করলে কেন?"
লীলা জানতে চেয়েছিল।
"ঐ যে বললাম
না, তার দাপটে। এই যে এত কথা বলছি
তার কারণে। শাসন
করতে করতে আমাকে এত ভীতু
বানিয়েছে যে তার সামনে
দাঁড়ালে আমি কিছুই বলতে
পারি না।"
অস্থির পায়চারি
করতে করতে বলেছিল, "সে তো জানে আমি মাদকে
ডুবে গেছি, একটা ছেলে
যে প্রয়োজনে বিয়ে করে সে প্রয়োজন
বা চাহিদা আমার ফুরিয়ে
গেছে। তবু আমাকে
ধরে বেঁধে বিয়ে করাল। তোমার জীবনটাও নষ্ট করে দিল।"
শেষ কথাটা শুনে
লীলার মুখে একটা বাঁকা
হাসি খেলে গিয়েছিল। আসাদ সেটা খেয়াল
করেনি। কথার ঝোঁকে
বলেই যাচ্ছিল- "আমাকে
বিয়ে করিয়েছে লোক দেখানোর
জন্য। জানেই তো আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। কিন্তু আমার সম্পত্তি খেতে
হলে মানুষের আই-ওয়াশ
করতে হবে না। ওর জামাইটাও
একটা আস্ত
লম্পট বদমাশ। অফিসে সেক্রেটারীর সাথে লটপট
করে বেড়ায় ঘরে এসে বউয়ের
সামনে ভিজা বিড়াল।"
পায়চারী করতে
করতে আচমকা লীলার সামনে
দাঁড়িয়ে বলেছিল, "তোমার
নিজের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ তোমার। তুমি চাইলে এখানে থাকতে
পার, না চাইলে
চলেও যেতে পার।"
লীলা বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। এ সম্পর্ক কি এতই সহজ যে যেতে
বললেই চলে যাওয়া যায়! তারপরও একদিন কিন্তু সত্যিই
চলে এসেছিল লীলা এবং কেন এসেছিল
সেটা আসাদও জানতে পারেনি।
সেদিন দুপুরে রাজিয়া মেয়েকে নিয়ে কোচিং-এ গিয়েছিল। ছুটির
দিন রাজিয়ার স্বামী আনোয়ারও বাসায় ছিল।
আসাদ দুপুরে ভাত খেয়েই বাইরে গিয়েছিল।
বাসায় লীলা আর আনোয়ার।
লীলা ড্রইংরুমে বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিল।
আনোয়ার বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে একটা সোফায় এসে বসে বলেছিল, "এক কাপ চা খাওয়াতে পারবে লীলা?"
লীলা কিছু না বলে রান্নাঘরে গিয়েছিল।
চা বানাতে বানাতে ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাস অনুভব করে ঘাড় ফিরিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল- "আপনি
এখানে কেন?"
"এলাম তোমাকে দেখতে।
তোমার জন্য মায়া হয়।
তোমার স্বামীটির সব খবরতো আমি জানি।
তাই জানতে চাচ্ছিলাম, কেমন কাটছে তোমার দিনকাল।"
"আপনাকে
জানতে হবে না। আপনি
এক্ষুনি এখান থেকে বেরিয়ে
যান। না হয় আমি চিৎকার করব।"
"বাড়িতে আছি আমি আর তুমি। চ্যাঁচালে শুনতে আসবে কে?
কথা সেটা নয়। তুমি
অকারণে রেগে যাচ্ছ। আসলে
যেটা বলতে চাচ্ছিলাম, তোমার
স্বামীটি না হোক আমিতো
আছি।"
এক সেকেন্ড আগেও
যা ভাবেনি আচমকা লীলা
তাই করে বসল। হয়তো
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে সাবধান
করেছিল। গরম চা ঢালা
চায়ের কাপটা আনোয়ারের মুখে
ছুঁড়ে মেরেছিল।
অপ্রস্তুত আনোয়ার
হাত দিয়ে কোনরকমে মুখটা
বাঁচালেও হাত আর বুকের
ওপর গরম চায়ের জ্বলুনিতে
চিৎকার করে উঠেছিল।
ততক্ষণে তাকে
পাশ কাটিয়ে লীলা ড্রইংরুমে
ছুটে এসে কোনরকমে রাস্তায়
পড়েছিল। তারপর একটা
রিক্সা নিয়ে নিজেদের বাসায়
চলে এসেছিল।
পরে মা শেলী
আপা অনেকদিন জানতে চেয়েছিল-
এভাবে আসার কারণ কী?
লীলা মুখে কুলুপ এঁটেছিল। তারপর আর কোনদিন ঐ বাসায়
যায়নি। রাজিয়া বা আসাদ
কেউ যোগাযোগ করেনি। তারও
প্রায় বছর তিনেক পরে এ্যাকসিডেন্টে
আসাদ মারা গেলে বড়ভাইয়ের
অনুরোধে গিয়েছিল কিন্তু আসাদের
মৃত-মুখ দেখেনি। আনোয়ারও
ততদিনে সেক্রেটারিকে বিয়ে
করে বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
আসাদের মৃত্যুর
বছরখানেক পর লীলা উকিলের
সহায়তা নিয়ে তাদের বাড়িতে
গিয়েছিল। আইনত নিঃসন্তান
স্ত্রী হিসেবে সম্পত্তি থেকে
তার পাওনাটুকু বুঝে নিয়েছিল। সম্পত্তি বিক্রির টাকাটা লীলাকে
আত্মবিশ্বাস আর শক্তি দিয়েছে।
আম্মা আর বড়ভাই
এরপরও অনেক চেষ্টা করেছিল
বিয়ে দিতে। কিন্তু
লীলা আর কোনদিন একবারের
জন্যেও রাজি হয়নি। বিয়ের
সাধ তার প্রথম রাতেই
মিটে গিয়েছিল। বিবাহিত
অথচ কুমারী এ জীবনকে
ভবিতব্য মেনে একাকী জীবনে
অভ্যস্ত হতে চেষ্টা করেছে। আজ কখনও-সখনও নিঃসঙ্গতা
অসহ্য হলেও কারও জন্য
তেমন টান অনুভব করে না। এই যে আম্মা মারা
গেলেন তাতে কষ্টের চেয়ে
বরং একধরনের মুক্তি
এবং স্বস্তি বোধ করছে
সে। অন্যের বোঝা
হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে
মৃত্যুই শ্রেয়। অথচ বিধিলিপি
এমন কেউ জানে না কখন তার মৃত্যু
হবে অথবা কীভাবে হবে। লীলা নিজের জন্যও এমন জীবন
চায় না।
"আফা, আপনের
চা দিমু। বিয়ান
থাইকা নাস্তাওতো খাইলেন না।"
"দে। নাস্তা খামু না। শুধু
দুইখান বিস্কুট দিয়া চা দে।"
"হগগলে
চইলা গেলে বাড়িডা কেমুন
খালি খালি লাগতাছে।"
"হুঁ।" লীলা
এর বেশি কথা বলল না।
****
No comments:
Post a Comment