Sunday, 23 February 2025

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ২৭-২৮



 -----------------------------------

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫

___________________________________

২৭

 

টেম্পোর শব্দ পেয়ে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াল লীলা টেম্পোটা গেট পার হয়ে উঠানে এসে দাঁড়াতে সেটা থেকে লাফ দিয়ে নামল বর্গাদার রহিম আলীর দুই যময ছেলে হাসান-হোসেন

          "ভাইয়েরা কই?" লীলা ওপর থেকেই জ্ঞিজ্ঞেস করল

          "আইতাছে"

          "তোরা আগে আইলি যে?"

          "ভাইয়েরা রিক্সায় আইতেছে হের লাইগ্যা পিছে পইড়া গেছে"

          ""

          লীলা আর কোন কথা না বলে সিঁড়ি ভেঙে নিচে এল সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে জিনিসপত্র নামানো দেখল কাজের বুয়াদের একজনকে ডাক দিল, "মোমিনের মা তোমরা আইসা জিনিসগুলা ঘরে তোল জাইল্যা কি আইছে? আইজকা জাল ফালাইব?"

          "না বুবু, আইজ না কাইল মউতার খানাতো কাইল বিয়ানে ফালাইব জাইলাগোরে কইয়া আইছি"

          কাল কুলখানি করবে শরীফ আর তারিক বড়ভাই চেয়েছিল একসাথে করতে ওরা রাজি হয়নি উল্টে বলেছে, "আম্মার খানা চোরের সাথে কেন করতে হবে?"

          আশ্চর্য শরীফ বড়ভাইকে চোর ছাড়া বলেই না ভাগ্যিস আত্মীয় স্বজন অনেকেই ভোর ভোর রওনা দিয়েছে সকালে ওরা যেভাবে গালিগালাজ করল তাতে বাড়ির লোক আর কুটুমদের সামনে মান থাকল না তিন ভাইয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি, তাদের নাতি-নাতনী সবাই শুনল নিজেদের ছেলেমেয়েরা তো আছেই অথচ তাদের বাবার কত সুনাম ছিল ভালমানুষ বলে সেই বাবার ছেলেরা আজ পরস্পর শত্রু তাদের আর বাইরের শত্রুর প্রয়োজন নেই একটুকরা জমি হোক না যতই দামি তার জন্য এত লালায়িত হতে হবে! বড়ভাইও যেমন ছাড় দেবেন না অন্য দুভাইও তেমনি ছাড়বে না

          মাঝখান থেকে লীলার বিপদ যখন সবাই একসাথে হল তখন সবদিক সামাল দিতে হচ্ছে লীলাকে কারো তত্ত্বাতালাশ একটু এদিক হলে তারাই খেপে যাবে বড়ভাইয়ের তবু ভদ্রতাবোধ আছে কিন্তু তারিকভাই আর শরীফ খোঁটা দিতে ছাড়বে না

          সাবেরার ছোটবোনের মেয়ে সামিহা এসে পানি খেতে চাইল ওকে পানি দিতে গিয়ে লীলার মনে পড়ল- পানির কথা তো খেয়াল করা হয়নি স্টোরে দেখতে হবে আর 'বোতল আছে বাড়িতে এলে ওরাতো কলের পানি খায় না কার্টনে কার্টনে মিনারাল ওয়াটার আনাতে হয় আগে ঢাকা থেকে আনতে হত এখন অবশ্য এখানকার বাজারেও পাওয়া যায়

          বাজার নামানো হয়েছে লীলা নিচে নেমে এল আয়না আর আন্নাও এল লীলার পিছু পিছু

          "আপনার ভাইয়েরা কাজটা কি ঠিক করল?" আন্নার প্রশ্ন

          "সেটা আমার কাছে জানতে চাইছ কেন? আমার ভাইয়েরা তো তোমাদের স্বামী তাদেরকে জ্ঞিজ্ঞেস করো"

          "আমাদের তো পাত্তা দেয় না"

          "তোমাদের দেয় না আমাকে দেয়! এসব কথা বলে আর লাভ কী? তার চেয়ে দেখ, বাজার থেকে কী কী আনল বাচ্চারা কোনটা খাবে কোনটা খাবে না সেভাবে বলে দাও মোমিনের মাকে"

          আন্নার পাশে দাঁড়িয়ে আয়না চুপচাপ সব দেখে, কিন্তু কিছুই বলে না সংসারে সবার আগে বউ হয়ে এসেছিল সে তখন সংসারে শাশুড়ির কর্তৃত্ব এত সচ্ছলতা সেদিন স্বপ্নেরও অতীত ছিল তা পদে পদে হিসাব করে চলতে হত তারপর যখন বিদেশে লোক পাঠানো শুরু হল আয়নার স্বামী তারিকও চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভাইদের সাথে ব্যবসায় নামল কিন্তু তারিক কখনও আয়নার হাতে চাবি ছাড়েনি অন্যদিকে বড়ভাই আর শরীফের তহবিলদার হিসেবে কখন যেন লীলাই কর্তৃত্ব দখল করল

          সেসব দিন মনে হলে এখনও যেন কেমন লাগে তারিকের সাথে প্রেমের সূত্রে তার বিয়ে হয়েছিল মেজছেলে আগে বিয়ে করবে এটাতে শাশুড়ির সায় ছিল না কিন্তু বড়ভাই তখন রাজনীতি করতেন ব্যবসা-বাণিজ্য টুকটাক করলেও সেরকম কিছু ছিল না তবু তিনিই মাকে বুঝিয়ে বিয়েতে রাজি করালেন কিন্তু এত যেন তেন ভাবে বিয়ের আয়োজন হয়েছিল যে মনে পড়লে আজও বুকটা জ্বলা করে

          শাশুড়ি শুরু থেকেই তাকে ভাল চোখে দেখেননি আয়নাও সহজ হতে পারেনি দিনে দিনে দূরত্বটা বেড়েছিল আর তারিক? প্রেমিক আর স্বামীকত যোজন দূরত্ব, দিনে দিনে কত নতুন নতুন রূপের পরিচয় রোমান্স আর আধিপত্য প্রেম আর দাম্পত্যের সম্পূর্ণ উল্টোপিঠ

          প্রথম প্রথম দুএক কথায় ধাক্কা খেয়ে আয়না কথাবার্তায় সাবধান হতে হতে এখন সবকিছুতে নির্বাক থাকাটাই তার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে

          লীলা এখন বাড়ির কর্ত্রী গেল কয়েক বছর থেকে সে বাড়িতে থাকে জমি-জমার আয়-ব্যয়, জমি কেনা সবকিছুতে ভাইদের বিশেষ করে জহির ভাইয়ের তত্ত্বাবধানকারী

          আশ্চর্য শক্তধাতুতে গড়া লীলার চরিত্র নামেমাত্র বিয়ে ওর জীবনটাকে লন্ডভন্ড করে দিল, কিন্তু কোনদিন বিষয়ে টুঁ শব্দ করেনি কেন বিয়েটা টিকল না, কেন সে আসাদের সঙ্গে ঘর করল না কানাঘুষায় দু'চার কথা শোনা গেলেও লীলা কিন্তু এত বছরেও মুখ খোলেনি আবার অ্যাকসিডেন্টে আসাদের মৃত্যুর পর স্ত্রী হিসেবে পাওনা সম্পত্তি কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নিয়েছে

          এই একটা প্রবণতা ওদের সবার মধ্যে সবাই খুব হিসেবি আর বৈষয়িক গ্রাম থেকে লোকজন যায় তারিকের কাছে তাদের কাছেই শুনেছে গ্রাম শাসনের জন্য নাকি সামনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার পরিকল্পনা আছে লীলার স্বভাবের কাঠিন্যের জন্য গ্রামের মানুষ নাকি আড়ালেবেনজীর ভুট্টোনামে ডাকে আয়নার মনে হয় নামটা যথার্থ

          "ভাবি দেখ সবজিগুলো কি টাটকা লাউয়ের এত সুন্দর রঙ অনেকদিন দেখিনি"

              "দেখবে কোথা থেকে সব তো খাও সুপারশপ থেকে"

              "এটা ঠিক বলেছ আমাদের বাচ্চারাতো জ্যন্ত মাছ-মুরগিই দেখেনি"

              "মাঝে মাঝে গ্রামে এলেই পার" কিছু একটা বলতে হয় তাই বলে আয়না

              "হুঁহ্‌ তোমার দেবর আনবে গ্রামে গ্রা গ্রামের মানুষ এসব একদম অপছন্দ অথচ এই গ্রামেই সে বড় হয়েছে"

              লীলা বিরক্ত হয় বাজার দেখতে এসে দুই জায়ে গল্পের হাট বসিয়েছে আন্নাটার সবসময়ই আদিখ্যেতা একটু বেশি

          "বাজার দেখে বলে দাও রাতের জন্য কী কী রান্না হবে বুয়ারা সেভাবে করবে আমি তো অনেকদিন ওদের দেখিনি তাই ওদের পছন্দ অপছন্দও জানি না"

          "আচ্ছা লীলা আপা, যারা খাবার পাঠাবে যে কী বলে আফজালরা তাদের বাড়ির খাবার কেন খাবে না আপনার ভাইয়েরা?"

          "কেন সকালে শোননি? ওরা বংশে ছোট তারপর আবার হঠাৎ বড়লোক সেজন্য"

          "আর তোমরা বুঝি হঠাৎ বড়লোক না! এখনও লোকে পিছনে আদম ব্যাপারি ডাকে" কথাটা মনে এলেও মুখে বলতে না পেরে বাঁকা হাসিতে আয়নার ঠোঁট দুটো বেঁকে গেল

          "এসব কথা বলে আর কী হবে আস আমরা কি কি রান্না হবে তা বলে দিই" আয়না এবার হঠাৎ তাগিদ দিল আন্নাকে

          লীলা বলল, "হ্যাঁ, তোমরা এদিকটা দেখ আমি তাহলে ওপরে যাই"

          দোতলার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে লীলার মনে হল কাল আম্মা মারা গেছে, আর আজই সবাই কেমন স্বাভাবিক তার নিজেরও সেরকম শোক নেই দীর্ঘদিন রোগভোগের পর মৃত্যু- মৃত্যুতে বরং সবাই এক ধরনের স্বস্তি পায় লীলা অবশ্য আগেই মুক্তি পেয়েছে আম্মার অসুস্থ হওয়ার পর যখন দেখল সারে কর্মহীন এবং নির্ঝঞ্ঝাট বলে মায়ের সেবার ভারটা তার ওপরই পড়েছে তখনই সে এক রকম বাড়িতে এসে ঠাঁই নিয়েছিল

          অবশ্য আসার পেছনে আরও একটা কারণ ছিল সরকারী জরিপের পর ভাইয়েরা সব জমিজমা তাদের তিনজনের নামে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছিল তখন শেলি আপা আর লীলা ঢাকা থেকে এসে সরাসরি রেজিস্টার অফিসে গিয়ে অনেক হাঙ্গামা করে বিষয়টা মিটমাট করেছিল ঘটনার পরে জহিরভাই তার অফিসের ম্যানেজারের পোস্ট থেকে শেলি আপার স্বামীকে তাৎক্ষনিকভাবে বরখাস্ত করেছিল

          আম্মা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন কিন্তু ছেলেকে কিছু বলেননি জহির ভাইয়ের প্রতি আম্মার সবসময়ে একটা বিশেষ দুর্বলতা ছিল ছেলের মা হয়ে সংসারে কর্তৃত্ব পেয়েছিলেন বলেই হয়তো অথবা তাঁর শেষ আশ্রয় এই ছেলে বলেই প্রতিবাদ করার সাহস করেননি লীলাকেও তো শেষ পর্যন্ত বড় ভাইয়েরই তাবেদারী করতে হচ্ছে আর না করে করবেই বা কী? এই বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও তার অধিকার আছে কি?

          ছিল আরেকটা জায়গায় আসাদের বাড়ি কিন্তু লীলার জীবনে সত্যিকার অর্থে আসাদের কোস্থান ছিল না আজও নেই

          বিএ পাশ করার পর ভাইদের সংসারেই দিন কাটছিল লীলার আম্মা বিয়ে দেয়ার জন্য অস্থির ছিলেন কিন্তু এমনই ভাগ্য সেরকম কোন সুপাত্র আসেনি সংসারে মায়ের ডানহাত, তাই দিনে দিনে তার ওপর মায়ের নির্ভরতাও বাড়ছিল আয়না বউ হয়ে এলেও বয়স কম বলে তার ওপর তেমন আস্থা ছিল না

          তারপর তো স্রোতের মত টাকা আসতে শুরু করল ম্যানপাওয়ার বিজনেস রমরমা বড়ভাই পলিটিক্স ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় মন দিল একদিন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে মানুষটি জেল খেটেছিল দিনে দিনে সেই হয়ে উঠল বুর্জোয়া সমাজের প্রতিনিধি রাতারাতি জীবনযাত্রার ধরনটাই পালটে গেল গেটে দারোয়ান, উর্দিপরা ড্রাইভার উঠতে সালাম নামতে সালাম রান্নাঘরে বাবুর্চি, খাবার টেবিলে বসে ঘন্টা বাজালে সার্ভ করার জন্য ছুটে আসে চাকর পূর্বপুরুষের তালুকদারীতে এত রমরমা না থাকলেও কাঁচাপয়সায় এবার চৌধুরীদের সত্যিকারের বাড়বাড়ন্ত হল

          সময় পাত্রীপক্ষের আনাগোনা শুরু হলেও বড়ভাই অনেক হিসেবনিকেশ করে বনেদী ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিল আর তখনই লীলার জীবনের সংকট শুরু ঘরে অনূঢ়া বিএ পাশ বোন রেখে ভাই বিয়ে করবে এটা সমাজের চোখে নিন্দনীয় হতে পারে আত্মীয়স্বজন নানা কথা বলতে পারে- সবদিক ভেবে চিন্তে কৌশলী বড়ভাই ছোটবোনের বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন

          আসাদের বাবা-মা ছিল না বড়বোন অভিভাবক আসাদ নাকি এমএ পাশ করে ব্যবসা করে বংশে তারা আরো উচ্চ বড়ভাই যেকোন ভাবে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগলেন

              কিন্তু প্রথম দেখাতেই আসাদকে ভাল লাগেনি লীলার মাথায় টাক কেমন লিকলিকে দড়ি পাকানো চেহারা আপত্তি জানাতে বড়ভাই খেপে উঠেছিলেন, আম্মাও কেঁদেকেটে অস্থির সুতরাং নিজের অমতে হলেও সেদিন বিয়েতে রাজি হতে হয়েছিল আরেকজন সেদিন পাশে ছিল- শীলা আম্মার অনুরোধে লীলাকে বুঝিয়ে রাজি করাতে চেয়েছিল হঠাৎ লীলার মনে পড়ল, শীলা তো এসেছিল কালরাতে ব্যস্ততার কারণে খুব একটা কথা হয়নি

          সিঁড়ি ভেঙে তাড়াতাড়ি দোতলায় উঠল লীলা এঘর ঘরে সব ঘরে মেহমান আছে কিন্তু শীলা কই? তাড়তাড়ি তিনতলায় উঠল- নাহ কোথাও নেই তাহলে কি চলে গেছে শীলা কাউকে বলে গেল না! এত অভিমান!

              মনটা বিষাদে ভরে উঠল লীলার কেবলই মনে হতে লাগল এই যে চারপাশের সবকিছু এসব কিছুই নয় সবচেয়ে সত্যি হচ্ছে বিচ্ছেদ এবং মৃত্যু সংসারের শত আয়োজনের মাঝেও যা বুকের মাঝে গেঁথে থাকে

          "লীলা, লীলা"

          বড়ভাই ডাকছে সাড়া দিল, "জী ভাইজান"

          "একটু শুনে যাতো"

          লীলা করে ওড়নার খুঁটে চোখ মুছে নিল

          নিজের শোবার ঘরে খাটের ওপর হিসেবের খাতাপত্র খুলে বসে আছে জহির লীলা ঢুকতেই বলল, "এদিকে আয়তো আম্মার চল্লিশার একটা বাজেট রেডি করে ফেলি ওরাতো কুলখানি করবে আমি ভাবছি আমি করব না বুঝিসতো গ্রামের লোকের কাছে ভাইয়ে ভাইয়ে মনোমালিন্যটা বেশি করে চোখে লাগবে দেখলিতো কালরাতেও চেষ্টা করলাম ওরা কিছুতেই মিলল না"

              "মিলবে কীভাবে? আপনি ওদের দাবিটা মেনে নিয়ে মিটমাট করেন না ওদের দাবি কি অনুচিত?"- লীলা ভাবল কিন্তু মুখে কিছু বলল না

          "কবে করবেন ভেবেছেন? ঠিক চল্লিশ দিন হলে নাকি আগে পরে?" লীলা জানতে চাইল

          "আগেতো না-, চল্লিশার দু-চারদিন পরেও হতে পারে"

লীলা প্রশ্নমুখে ভাইয়ের দিকে তাকাল

              "শোন আমি চাচ্ছি এই কাজটা বেশ বড় করে করব সেই যে কাকার মৃত্যুর পর একটা বড় খাওয়া দিয়েছিলাম আরতো সেরকম কিছু হয়নি"

          "কীভাবে হবে, কেউ মরলে তো" আবারও লীলার মন কথা বলে উঠল কিন্তু এসব ব্যাপারে বাইরে চুপ থাকাই ধর্ম

                  "তুই কী বলিস?"

                  "আমি আর কী বলব করতে পারলে তো ভালই হয় কী করবেন বলে ভাবছেন?"

                  "আমাদের এই ইউনিয়নেতো এগারোটা গ্রাম আছে বাবা একসময় এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন আমার ইচ্ছা এই সবগুলো গ্রামের ঘর ঘর সব মানুষরে দাওয়াত দেব"

                  "বৌ-ঝিদেরও!"

                  "আরে না না শুধু পরিবারের বেটাছেলেদের আর আমাদের গ্রামের বউ-ঝি সহ সবাইকে"

              ""

              "তুই কী বলিস?" ছোটবোনের দিকে জ্ঞিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল জহির

              "ভালইতো হয় কিন্তু এত আয়োজন সামাল দিতে পারবেন?"

              "কেন পারব না? দরকার হলে ওপরে কথা বলে থানা থেকে পুলিশ আনব গ্রামের মানুষ পুলিশ দেখলে বিশৃঙ্খলা করবে না তারপর পুলিশ দেখে আমাদের প্রতি তাদের ভয়আরও বাড়বে সেই সাথে সম্মানও"

          হ্যাঁ, হিসাব ঠিক আছে লীলা এখন গ্রামে থাকে সুতরাং তারও ইচ্ছে গ্রামের কর্তৃত্বটা তার হাতে থাক এভাবে হলে মন্দ হয় না যদিও গ্রামে আগের সেই মান-মান্যতা নাই আর্থিক অবস্থা পড়তির দিকে থাকলেও বংশের কারণে আগে মানুষ বাবা কাকাদের যে সম্মান করত এখন অনেক জাকাত, টাকা-পয়সা দান করেও সে মান্যতা নাই গ্রামের মানুষ বিদেশ যাচ্ছে পল্লীবিদ্যুৎ এসেছে ঘরে ঘরে টেলিভিশন চলে লেখাপড়ায় তত বেশি না এগোলেও দেখাশুনার জ্ঞানে তারা অনেক চালাক চতুর তবু টাকার একটা শক্তি আছে সেই শক্তির কাছে নত হতে হয় সবাইকে

          "কি রে তুই দেখি চুপ করে ছি"

          "না, আমি আর কী বল যা বললেন সবইতো ঠিক আছে"

          "তাহলে আমার সিদ্ধান্তে তোর সায় আছে"

          "জী"

          এতক্ষণে কাগজটা লীলার দিকে বাড়িয়ে দিল জহির "দ্যাখ, প্রাইমারী ছকটা করেছি এটাকে বেসিক ধরে আস্তে আস্তে plan করব"

          লীলা দেখল ইউনিয়নের গ্রাম-মাতবর, ঘরবসতি, লোকসংখ্যা, খাবারের মেন্যু দায়িত্বপালন করবে কারা কারা ইত্যাদি সবকিছুর একটা ছক করা হয়েছে

          "আত্মীয়স্বজনরাও শহর থেকে আসবে যারা কাল এসেছিল তারা তো আসবেই এছাড়া দূরের কাছের নতুন-পুরণো সব আত্মীয়দের দাওয়াত দেব"

          হঠাৎ কি মনে হতে বলল, "শীলা এসেছিল না?"

          "হ্যাঁ"

          "ওকে একটু ডেকে আনতো কথা বলি মামুনও ছিল ওদের কি খোঁজ নিয়েছিস ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করল কি না"

          "ওরা চলে গেছে"

          "কখন?"

          "জানি না এখন খোঁজ করলাম, মেহমানরা বলল, ওনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে"

          "", জহির একটু থমকে গেল একটা কথাও বলে গেল না সামান্য ভদ্রতা আরে বাড়িতেই তো বড় হয়েছিস এই বংশের ভাতেই তো বেড়ে উঠেছিস- আবারো পুরানো সেই কথাটাই মনে এল

          "আর কিছু বলবেন?" বড়ভাইকে চু্প থাকতে দেখে লীলা জানতে চাইল

          "হ্যাঁ, না না আচ্ছা, তোর ভাবী কোথায়?"

          "নিচে ড্রইংরুমে বাড়ির চাচী-ফুপুরা এসেছে ওদের সাথে কথা বলছে"

          "আচ্ছা আরেকটা কথা বলতো"- জহিরের কথায় দরজার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে আচমকা থেমে যায় লীলা

          "কী কথা?"

          "আজ সকালে আফজালদের দাওয়াত নিয়ে তারিক আর শরীফ মিলে যা করল তাতে কারো কি মান থাকল? আমার শ্বশুরবাড়ি, শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-কুটুম লজ্জায় মাথা কাটা গেল"- বলতে বলতে জহিরের সুন্দর মুখটা লাল হয়ে উঠল

          ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে লীলার খারাপ লাগল আসলেইতো লোকের সামনে বড় ভাইকে এভাবে অপমান করে তোরা কি খুব বড় হলি লীলার একদম ভাল লাগেনি ব্যাপারটা মুখে শুধু বলল, "ওরা তো এরকমই ভাইজান"

          "ছেলেমেয়েরা কোথায় রে, সাড়াশব্দ নেই"

          "বাইরে কোথাও ঘুরতে গেছে হয়তো"

          "দেখিস আবার বাইরে পুকুর-টুকুর আছে একটাও তো সাঁতার জানে না এখান থেকে ফিরে গেলেই অরিনটা আমেরিকা চলে যাবে ভাবতে একটু কষ্টই হয় তবু তোর ভাবীর সামনে বলতে পারি না এমনিতে মন খারাপ আমি বললে নিজেকে সামলাতে পারবে না আফটার অল মা তো"

          "হ্যাঁ, আমাদের মাও মা ছিলেন" কথাটা মনে আসতেই গলার কাছে কষ্টটা ধাক্কা দিল এরপর হয়তো চোখে পানি এসে যাবে লীলা দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল

 

****

২৮

 

বেলা দুপুরের দিকে গড়াচ্ছে দাদীর দাফন হয়ে গেলেও মনার বিলাপ থামেনি সে একটানা - "দাদীগো, দাদী তুমি ক্যামনে চইলা গেলা, আমি ক্যামনে বুঝলাম না, বাত্তিটা জ্বালাইয়া রাখলে তুমিতো এমন কইরা পইড়া যাইতা না দাদী গো, আমি তোমারে মাইরা ফালাইলাম আমি তোমার কতা ভাবলাম না বাত্তির টাকা হিসাব করলাম দাদী আমারে তুমি মাফ কইরা দিও"

          সকাল থেকেই আছাড়ি পিছাড়ি করে এভাবে বিলাপ করছে মনা দাদীর জন্য না হলেও মনার কান্নায় উপস্থিত মহিলাদের অনেকেই কাঁদছে

          "আহারে, মাইয়াডা ছোড থাইকা দাদী ন্যাওটা"

          "মায়ের থাইকাও দাদীর লাইগ্যা দরদ বেশি"

          এসব কথাবার্তার মাঝেই মুরুব্বী দুএকজন এগিয়ে এলো মনার মাথার জট পাকানো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল- "মনা এত জোরে কান্দিস না এত জোরে কানলে কবরে মুরদার আযাব হয় তোর দাদীরতো কপাল ভালা দেখ বড়বিবির আদরের মানুষ ছিল তার লগেই গেল বড়বিবির পোলারা তোর দাদীর কাফন-দাফনের সব ব্যবস্থা কইরা দিল"

          কিন্তু মনা কারো কথা শোনে না ক্ষীণ দেহে এতক্ষণ বিলাপের শক্তি কোথা থেকে পেল দু-একজন এটাও ভাবছে

          "আহারে নাতনীডার বিয়াটাও দেইখা যাইতে পারল না" একজন আফসোসের কথা বলতেই মসজিদ থেকে আযানের শব্দ ভেসে এল           এবার জটলা ভাঙতে শুরু করে ঘরে যেতে হবে পুরুষরা ঘরে ফিরবে কাজ থেকে ফিরে খাবার না পেলে কপালে খারাপী আছে

          ছোট্ট উঠানের গিজগিজ ভিড়টা পাতলা হয়ে এলে এতক্ষণ বাঁশের খুঁটি ধরে বসে থাকা মনার মা মেয়ের কাছে আসে মেয়ের মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে চুলগুলো টেনে খোঁপা করতে করতে বলল, "এত কাইন্দা কী অইবরে মা আল্লার কাছে পানাহ চাও দাদী য্যান বেহশতে যায় কিন্তুক নিজেগো কথাও ভাবতে অইব যা গোসল কইরা আয় তারপর চৌধুরী বাড়িত একবার যা"

              "আইজকা যামু না মা মন ভালা না- দাদীরে" বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে  মা মেয়েকে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে বলল, "না গেলে চইলব আমারতো বিয়ানবেলা থেইকা এক চিন্তা এতদিন তোর দাদীর লাইগা ওরা খানা খোরাকি দিয়া সাহাইয্য করত অহন তুই যদি চোখের সামনে না থাকস তয় ওরা আমাগো কতা ভুইলা যাইব না"

          মনা অনুভব করে মায়ের কথাটা ঠিক কিন্তু দাদীর মরণ আজ তাকে বড় একা করে দিয়েছে কষ্টের সংসারে মা দাদীরে বোঝা মনে করলেও মনার কাছে দাদী ছিল সবচেয়ে আপন

          "মা আইজ না যাই"

              "ঠিক আছে যা তোমার মনে লয় কাইলতো বড় চৌধুরী চইলা যাইব তখন কি আর তোমার কতা তাগো মনে থাকব"

              "না থাক" মুখে একথা বললেও বাস্তবতা মনাকে বুঝিয়ে দেয় মায়ের কথাই সত্যি কান্না চেপে সে উঠে দাঁড়ায় গোসলটা করতে হবে শরীর মন দুটোতেই বড় জ্বালা পুকুরে ডু দিলে হয়তো মনেও শান্তি আসবে

 

****


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩৭-৪১

  ----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ ________________________...

Popular Posts