Sunday, 23 February 2025

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩৭-৪১


 

-----------------------------------

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫

___________________________________

৩৭

 

বাড়িতে আজ কদিন থেকে ননকোঅপারেশান চলছে মা হঠাৎ একদম চুপচাপ বাবা অত্যধিক গম্ভীর। কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও আগে যেমন আরিয়ানাদের সাথে কথাবার্তা হতো, খাওয়ার টেবিলে বসত কদিন থেকে সেসব বন্ধ মা তো বাবার খাওয়ার সময় টেবিলেই আসে না

          মামা-মামী আর খালামনিরা আসছে না আর যে এলে বাড়িটা হাসিখুশিতে ভরে যেত সে অভী ভাইয়াকে বাবাআনওয়ান্টেডএ্যানাউন্স করেছে আরিয়ানার ভাল লাগে না অরিনটা এত মনমরা হয়ে আছে যে তার সাথে খুনসুটি করতেও ভাল লাগে না বাবা নাকি বলেছে তাকে আমেরিকায় যেতেই হবে

          আরিয়ানা সল্যুশান খোঁজে কী করা যায় কী করা যায় এরকম দমবন্ধ করা এনভায়রমেন্ট তার ভাল লাগে না Something must be done."

          অনুষ্ঠানের দিন এগিয়ে আসছে কিন্তু যে আশা আর ইচ্ছা নিয়ে কাজটার পরিকল্পনা করেছিলেন- এখন সেটাকে বোঝা মনে হচ্ছে জহিরের এখন মনে হচ্ছে সবার আগে অরিনের বিষয়টা এসপার-ওসপার না হলে কোন কাজেই মন দিতে পারবেন না সাবেরাতো গুম হয়ে আছে অরিন কাছেই আসে না বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়াতে নিজের রুম থেকেই বের হয় না

          প্রায় সপ্তাহ ঘুরে যাচ্ছে মেয়ের সাথে তার দেখা হয়নি কিন্তু জহির অনড় থাকতে চেষ্টা করছেন তবুও বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করছে আম্মার মৃত্যুতেও যে বিষাদ তাকে আক্রান্ত করেনি বরং স্বস্তি দিয়েছিল আত্মজার আচরণে সেই বিষাদই তাকে গ্রাস করতে চাইছে বুঝতে পারছেন না এর থেকে মুক্তি কিভাবে আসবে সাবেরার অসহযোগিতা আরও অসহ্য লাগছে

          "হারামজাদা", মনে মনে অভীকে গালি দিলেন "শালার পুত তুইই আমার সর্বনাশ করলি"

          টেবিলের ওপর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই তাকালেন- লীলা করেছে ফোনটা দ্রুত তুলে নিলেন নিজেকে সামলে নিয়ে রিসিভ বাটন টিপেই জ্ঞিজ্ঞেস করলেন- "কিরে কী খবর টবর ওদিকে সব কাজ ঠিক মত হচ্ছে তো? ভুঞাবাড়ির দাদাদের মাঠটা পরিষ্কার করা হচ্ছে কি? ওখানেওতো মানুষের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে

              "হ্যাঁ, সবই ঠিকমতো হচ্ছে"

              "আমাদের উঠান, স্কুলের মাঠ, এগুলো?"

              "এগুলো তো করা প্রায় হয়ে গেছে"

              "তারপর অন্যান্য খবর? কিছু বলবি?"

              ওপাশ থেকে লীলার সাড়া আসে না মোবাইল দেখলেন, লাইন কাটেনি ডাকলেন, "লীলা কথা বলছিস না যে আর কোন দরকারী কথা আছে?"

              "হ্যাঁ" লীলা আবারও চুপ করে থাকে

              "বল"

              "ভাইজান"

              "হ্যাঁ বল না"

              "অরিনকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন কেন?"

              "কে বলল তোকে?"

              "যেই বলুক কথাটাতো সত্যি শুনেন ভাইজান আমি কোনদিন নিজের বিষয়ে আপনাদের কিছু বলিনি কোন অভিযোগও করিনি"

              " কথা আসছে কেন?"

          "আসছে এই জন্য যে, আপনি নিজের স্বার্থে আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছেন এবার নিজের মেয়ের জীবনও শেষ করতে চান? কেন আপনার এত স্বার্থপরতা? আমি বোন বলে হয়তো কষ্টটা বুঝেননি কিন্তু মেয়ের সর্বনাশ করে আপনিও শান্তি পাবেন না সময় থাকতে নিজেকে বদলান" সাথে সাথেই ফোনটা কেটে দিল লীলা

          নিজের অফিসরুমে এসি চলা অবস্থায়ও ঘামতে শুরু করলেন জহির শার্টের বোতাম খুলে দিলেন ইন্টারকমে সেক্রেটারীকে ডাকলেন, "আমার খুব খারাপ লাগছে একবার হাসপাতালে যাব বাসায় ফোন দাও"

 

****

৩৮

 

স্কয়ার হাসপাতালের ডিলাক্স কেবিনের একটিতে শুয়ে আছেন জহির স্ত্রী, পুত্র কন্যারা তাকে ঘিরে আছে একটা মাইল্ড স্ট্রোকের মত হয়েছে যথাসময়ে চিকিৎসা হওয়াতে বিপদজনক কিছু ঘটেনি মাথার ভেতরে যে জটটা পাকিয়ে উঠেছিল সেটার গিটও খুলে এসেছে কাউকে বলতে পারছেন না, লীলার কথাগুলো আচমকা তাকে ধাক্কা দিয়ে অরিনের কাছে ফিরিয়ে এনেছে অভীর বাবা-মা, অভী সবাই আছে যে সঙ্কটে জীবনটা দুঃসহ হয়ে উঠছিল সেটা কেটে যাওয়ার পর মনে একধরনে প্রশান্তি অনুভব করছেন

          অরিনকে ডাকলেন চোখমুখ ফুলে আছে খুব কান্নাকাটি করেছে কাছে আসতেই তাকে বললেন, "আমার জন্য কেঁদেছিস ঠিক আছে আজ থেকে আর কোন কিছুতে তোকে কাঁদতে দেব না তোর যা ইচ্ছা আমি তাই পূরণ করতে চেষ্টা করব"

          অরিন এতক্ষণ বাবার বুকে মাথা রেখেছিল বাবার কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, "কী বলছ বাবা?"

          "হ্যাঁ, যা সত্যি তাই বলছি তোদের কষ্ট আমি দেখতে চাই না।" বলে পাশ ফিরে শুলেন তাঁর চোখেও জল

          সাবেরা আর আরিয়ানার চোখেও কান্না-হাসি মাখামাখি আরিয়ানা বুঝতে পারল ছোটফুপ্পি তার কাজটা ভালভাবেই করেছে মনে মনে বলল, থ্যাংক ইউ, ছোটফুপ্পি

          মেয়ের সমস্যাটা এত সহজে মিটবে আশা করেনি সাবেরা কোথা থেকে কী হল সে নিজেও ভেবে পাচ্ছে না কদিন আগেও মনে হচ্ছিল জীবনের আশাভরসা সব শেষ আর এখন মনে হচ্ছে অপার শান্তি মনের অশান্তি কতটুকু খারাপ সেটা, এবারই হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারা গেল জহির এখন অফিস আর আম্মার চেহলাম নিয়ে এত ব্যস্ত যে তাকে জিজ্ঞেস করা যায় না

          হঠাৎ সাবেরার মনে হয়- আহা, ওদের তিন ভাইয়েরও যদি এমনি করে একদিন মিল হয়ে যেত পৃথিবীতে অসম্ভব কতকিছুইতো ঘটে ভাইয়ে ভাইয়ে যে শত্রুতা সেটাওতো এরকম অসম্ভবই তবুতো হয়েছে শরীফ এত রকমে হেনস্থা করার পরও সাবেরার আশা ছিল একদিন সব ঠিক হবে এমনকি পুলিশকে ঘুষ দিয়ে বড়ভাইকে হাজত খাটানোর চেষ্টাও করেছে শরীফ তখন খুব কষ্ট পেলেও সময়ে এখন সয়ে নিয়েছে আর আন্নাটাতো একসাথে হওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে মালিহাটাও মায়ের মতই হয়েছে ভাগ্য এত খারাপ, এত বড় একটা অনুষ্ঠানকিন্তু মায়ের পেটের ভাইয়েরা অনুপস্থিত

          দাওয়াতের তালিকাটা নিয়ে বসলেন জহির কিছু মানুষ আছে যাদেরকে তিনি নিজে দাওয়াত দেবেন বলে বিশেষ করে রেখেছেন এরা বেশিরভাগ রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় আর কিছু শহরের বিজনেস ম্যাগনেট ব্যবসাসূত্রে যাদের সঙ্গে সম্পর্কটা গভীর শীলার নামটা ওপরের দিকে কি মনে করে তাকেই প্রথম রিং দিলেন দু'একবার রিং টোন বাজতেই শীলা ধরল- "হ্যালো স্লামালেকুম ভাইয়া"

          "কেমন আছিস?"

          "জী, ভাল"

          "পঁচিশ তারিখ আম্মার চল্লিশা ছুটির দিন আছে তোর ছেলেমেয়েকে আর মামুন ভাইকে নিয়ে চলে আয় কি যেন নাম ওদের?"

          "মহুল-মনিকা" শীলা একটু বিরক্তভাব প্রকাশ করল

          "হ্যাঁ, হ্যাঁ আমার আবার মনে থাকে না ঠিক আছে আসিস কেমন আত্মীয় স্বজন সবাই আসবে বড় করেই করছি"

          "ভাল করেছেন তবে আমি যেতে পারব না আত্মীয়স্বজন আসবে কিন্তু আমার ছেলেমেয়েতো আত্মীয় হিসেবে আপনাদের চিনে না ওরা যাবে না" কথা শেষ না হতেই ফোন কেটে দিল শীলা

          জহির কিছুক্ষণ ভাবলেন ঘটনাটা একেবারে অপ্রত্যাশিত নয় তবুও আম্মার মৃত্যুর সংবাদে এসেছিল তাই দাওয়াত দেওয়াটা সৌজন্য মনে করে দিতে চেয়েছেন কিন্তু মেয়েটার বাঁকা স্বভাব আর তেজটা গেল না। যাক- এবার অন্য নম্বরগুলো বের করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন

 

****

৩৯

 

অনুষ্ঠানের পাঁচদিন আগেই সপরিবারে বাড়ি এসেছেন জহির অরিন আর আরিয়ানা অভীকে আসতে বলেছিল, কিন্তু সে এখনও ফুপার মুখোমুখি হতে ভয় পায় কাল থেকে অজস্র মেহমান আসছে ঢাকা থেকেও আসছে লোকজন বাড়ির অন্যদের ঘরও ঠিকঠাক করে মেহমানদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ব্যবসাসূত্রের মেহমান শহরে রেস্ট হাউসে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে আসছেন দেশের বেশ কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিও তাঁরা ভোরে ঢাকা থেকে রওনা দেবেন আর আজ রাতে মাংস, মাছ এগুলোর কনটেইনার এসে যাবে কাল থেকে রান্নার আয়োজন শুরু হবে

            ঢাকার প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্থানীয় প্রশাসন থেকে প্রায় পঞ্চাশজনের মত আনসার পুলিশের ব্যবস্থা করা হয়েছে মেহমানদের রান্নার জন্য ঢাকা থেকে যে বাবুর্চী এসেছে তারা চৌধুরী ভুঁঞাবাড়ির সবার জন্য রান্না করছে ভিতর বাড়িতে মহিলা বাইরে পুরুষদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে চারদিকে একটা উৎসব উৎসব আমেজ

          এরই মাঝে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় কখনও কখনও গ্রামের কিছু কিছু মানুষ দেখা করতে এসে একথা সেকথার উছিলায় জানতে চায়- ছোডো মিয়া, মাইজ্যা মিয়া আইব না ভাইসাব?

          জহির তখন গাম্ভীর্য বজায় রেখে অকপটে মিথ্যা বলেন, "আসবে ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত, কে কখন আসে ঠিক নাই"

          উপস্থিত আপাত সরল লোকেরা একটা মাত্র ধ্বনিতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে- ‘তারপর পরস্পর চোখ চাওয়াচাওয়ি করে জহির চৌধুরীর চোখ এড়ায়না তাদের ইশারা ইঙ্গিত

          ভাইয়েরা আসবে না জেনেও সাবেরার বার বার অনুরোধে তাদেরকে ফোন করেছেন মেয়েরাও চেয়েছে চাচারা আসুক, বিশেষ করে আন্না আর মালিহার কথা বলেছে কিন্তু ভাইয়েরা তার ফোনই ধরেনি

          মায়ের মৃত্যুর পর একটা উপলব্ধি তাঁর এসেছে পাঁচ পাঁচটা ভাই-বোন থেকেও তারা প্রত্যেকে একা সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ ভাইদের পৃথক করেছে বিত্ত বৈভবের প্রাচুর্যে মধ্যবিত্ত, নিম্মমধ্যবিত্ত এবং গরীব আত্মীয় স্বজনরা দূরে সরে গেছে অনেকদিন থেকে কোন আত্মীয় তাঁর বাসায় আসে না দেখা হয় বিয়ে শাদী অথবা কারো মৃত্যুর পর

          অথচ আম্মার মৃত্যুর পর বলা হয়নি এমন অনেকেও ছুটে এসেছে আর তাঁর মৃত্যু হলে- ভাবেন জহির, আপন ভাইয়েরাও আসবেনা অসুস্থ মাকে দেখতে বছরের পর বছর ভাইয়েরা তাঁর বাসায় আসেনি শরীফতো সুযোগ খোঁজে কিভাবে ভাইকে হেনস্থা করবে এত কিছুর পরও শৈশব যৌবনের কথা মনে হলেই তাদের মুখগুলোই ফিরে ফিরে আসে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বলতে, "আয় তোরা যেভাবে চেয়েছিস সেভাবে ওই সোনারথাল জায়গাটা ভাগ কর নিয়ে যা তবু কাছে আয়" কিন্তু শুধু দুর্বল মুহূর্তের ভাবনা পরমুহূর্তে বিষয়-আসয় যখন ভাবেন এসবকে পাগলামী বলে উড়িয়ে দেন 

          "বাবা"

          "হ্যাঁ", চমকে উঠে জবাব দিলেন জহির তারপর শুধরে নিয়ে বললেন- yes,

          "What are you thinking বাবা?"

          "Nothing serious. তুমি কি কিছু বলবে?" বার বছরের কিশোর পুত্রকে প্রশ্ন করলেন

          "না তেমন কিছু নয় But look বাবা so many people are coming দাদির death festival- কত মানুষ আসছে I did not see them before. Who are these people বাবা"

          ছেলেকে রাজধানীর সেরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়িয়ে জহিরের কিছুটা বিপদ হয়েছে সে বাংলায় কথাবার্তা প্রায় বলতেই পারে না

          "এরা আমাদের relatives.কিন্তু দাদীর অনুষ্ঠানকে বলে চেহলাম বা চল্লিশা এটা Festival নয় কারো মৃত্যু festival হয় না"

          "Oh yeah."

 

****

৪০

 

সুবর্ণগ্রাম জুড়ে উৎসবের রঙ চেহলামের আগের দিন বিকেল থেকে ঘরে ঘরে মেহমানের আগমন ঘটতে থাকে এই গ্রামের প্রতি ঘর ষোল আনা অর্থাৎ নারীপুরুষ, শিশু সবার দাওয়াত সেই সুযোগে তারা আত্মীয়স্বজনকেও দাওয়াত দিয়ে বসে আছে

          রমিজ আলীর ঘরে তার তিন মেয়ে জামাই এবং বেয়াই-বেয়ানও এসেছে এই উপলক্ষে সবার একবেলা ভাল খাওয়াদাওয়া হবে ঈদ পরবেও যারা পেটভরে খেতে পায় না তাদের জন্য একটা বিরাট সুযোগ

          মনার নানাবাড়ীর লোকজনও এসেছে এসেছে তার দাদীর ভাইবেরাদরেরা মোমিনের মা, হাসান-হোসেন সবার ঘরেই আত্মীয়স্বজনের আগমন রাতের বেলাতেই হাবীবের মারফত খবরটা জহিরের কানে এল এক সুবর্ণগ্রামেই হিসাবের চাইতে তিন-চারগুণ লোক বেড়ে গেছে

          এভাবে হলে সামাল দেওয়া যাবে কি? কিন্তু এই মুহূর্তে বাড়তি খাবারের জোগান ছাড়া আর কোন উপায় আছে কি? এই সন্ধ্যার মধ্যে এত মাছ-মাংস কোত্থেকে আসবে? জহির চৌধুরীর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে সব খাবারইতো লোক হিসাব করে গ্রামে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বাবুর্চিরাও চলে গেছে ভাগ করে কিছু পুলিশও পাঠানো হয়েছে গ্রামের মেম্বার, সর্দাররাই সব কিছু তত্ত্বাবধান করবে

          সকাল দশটা থেকেই লোক আসতে শুরু করে এগারোটার মধ্যে পাতপেড়ে খাওয়ানো শুরু হয় ভূঁইয়া বাড়ি, চৌধুরীবাড়ি এছাড়াও আশেপাশের বাড়িও ধান শুকানোর খলাগুলোতে খাবারের ব্যবস্থা ডিসেম্বরের শেষ হওয়াতে সামিয়ানাও টানতে হয়নি রোদে পিঠ দিয়ে বসে দিব্যি খেয়ে যাচ্ছে মানুষগুলো ভিতর বাড়িতে ছোট শিশুদের নিয়ে মহিলারা জহির চৌধুরী তার দলবল নিয়ে দেখাশোনা করছেন এম পি ফয়েজুর রহমানও আছেন আছেন থানার ওসি, এলাকার মান্যগণ্য মানুষেরা এত কিছুর মাঝেও সাথে রেখেছেন একমাত্র ছেলে কিশোর মাহীকে মাইকিং-এর ব্যবস্থা আছে

              বেলা তিনটার মধ্যে খাবারের হাঁড়িতে টান পড়লেও লোক আসার বিরাম নেই যত বেলা গড়াচ্ছে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতে শুরু করেছে এদেরকে সামলাতে গিয়ে ছোটখাটো হাতাহাতি, মারামারি ইতিমধ্যে ঘটে গেছে আনসার-পুলিশ এত মানুষ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে

 

****

৪১

 

পাড়াতলী গ্রামটা ইউনিয়নের বাইরে যোহর আলীর বয়স সত্তরের কাছকাছি অনেকদিন শহরের হাসপাতালে ছিল ডাক্তাররা বলেছে তার যক্ষ্মা হয়েছে যে 'দিন আয়ু আছে ভাল খাবার আর ওষুধপত্র খেয়ে যেতে হবে কিন্তু ভালখাবার কোথায় পাবে? পাঁচটা ছেলের চারটাই অকালে মারা গেছে অভাবে অসুখে ধুঁকে ধুঁকে স্ত্রীও গত সামান্য যা ভিটেমাটি ছিল সেগুলো বন্ধক দিয়ে আর ফিরে পাওয়ার সামর্থ হয়নি একমাত্র জীবিত ছেলে মহরম আলী কোনরকমে দিনমজুর খেটে খায় কিন্তু শ্বশুর তার বউয়ের দুচক্ষের বিষ উঠতে বসতে শ্বশুরের মৃত্যু কামনা করে সকালে দিলে দুপুরে খেতে দেয় না ছেলেটাও কেমন যেন- বউকে কিছুই বলে না আবার দেখো, মতের অমিল হলে দমাদম বউ পিটাচ্ছে

          সুবর্ণগ্রামে মেজবানের খবর পেইয়েছে যোহর আলী লোকের মুখে মুখে শুধু মেজবানের আলাপ গাছতলায়, পুকুরঘাটে, মসজিদের চাতালে নিয়ে বিস্তর আলোচনা কী খাওয়ানো হবে তবে সবার মুখে একটাই আফসোস, তারা কেন ইউনিয়নে পড়ল না একজন বলল, তার মামাতোভাই গ্রামে বিয়ে করেছে তাই তাদের ঘরের আটজনই দাওয়াত খেতে গেল

          যোহর আলী শুনে আর ভাবে একবার গেলে কেমন হয় রাস্তাতো সাতমাইলের মতো ভোর ভোর উঠে রওনা দিলে কেমন হয় কতদিন একটু মাংস খায়নি সে ভোরে রওনা দিলেও যোহর আলীর পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায় বাহাত্তর বছরের অসুস্থ অনাহারী শরীরে লাঠি ভর করে সে যখন পৌঁছাল তখন শীতের বেলা পশ্চিমে ঢলে পড়েছে

          চৌধুরী বাড়ির সামনে বড় মাঠটা লোকে লোকারণ্য প্রচন্ড কোলাহল বেশ দূরে থাকতে লোকের মিছিলে পড়ে একরকম ঠেলাধাক্কা খেয়ে যখন মাঠে এসে পৌঁছাল তখন তার বুকের হাপর ওঠা-নামা করছে নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে অনেক কষ্টে যখন জায়গা পেয়ে খেতে বসল তখন সূর্য পাটে গেছে

          যোহর আলী খেতে বসে প্রথম গ্রাস মুখে তুলেই চোখ বন্ধ করল আহা কতদিন পর মাংস আর সুরুয়া ঝোলটা সুড়ুৎ করে টেনে নিয়ে পরিতৃপ্তিতে চোখ বুজল এক বাড়া ভাত খেয়ে আবার চাইল সে পরিবেশনের লোকটা বড় একবাটি ভাত তুলে দিল তার পাতে পরেরজন দিল মাংস তারপরের জন লাউ দিতে এলে হাত তুলে মানা করল ইঙ্গিতে মাংসের মালশাটা দেখাল

          "হেই বুইড়া আর কত গোশত খাইবা একজনে এত খাইলে অইন্যরা খাইব কি?" ধমক দিতে দিতেই পরিবেশনকারী আরও এক চামচ মাংস ঢেলে দিল তার পাতে

          যোহর আলী ঢোঁক গিলে বলল, "কতদিন খাইনা বাপ"

          অনেকক্ষণ ধরে চিবিয়ে মাংস খেল মাড়ির দাঁত না থাকায় একটু কষ্টই হচ্ছে হাড়গুলো চিবাতে না পেরে চুষে চুষে ফেলতে হল দেখে খুব আফসোসও হচ্ছে মাসকলাই আর সবশেষে পায়েসটা খেয়ে উঠতে গিয়ে যোহর আলী আর উঠতে পারল না অনেকদিন পর ভরাপেটে রীরটা ভারী হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল উচ্ছিষ্ট খাবারের ওপর সাথে সাথে হড়বড় করে বমি করে চোখ উল্টালো

          শোরগোল পড়ে চারপাশে

          "গেছে, গেছে বুইড়া শেষ"

          পরিবেশনকারী একজন বলল, "তখনই মনে অইছে বার বার খালি গোশত খাইতে চাইছে এত গোশত বুইড়া হজম করব ক্যামনে?"

          লোকজন ঘিরে ধরে চিনতে চেষ্টা করল, "কেডা এই মানুষটা?"

          উপস্থিত অনেকেই এসে দেখল কিন্তু কেউ চিনতে পারছে না নাহ কারো আত্মীয় না তাইলে ক্যামনে আইল?

          বেশ কিছুক্ষণ সময় গেলে বুড়ো যখন উঠল না তখন লোকজন তাকে ধরাধরি করে পুকুরঘাটের শানের ওপর নিয়ে শুইয়ে দিল তারা বুঝতে পারছে না লোকটা মৃত না জীবিত এত সহজে একটা লোক মরে যাবে শুধু একটু বেশি ভাত-মাংস খেয়ে এটা তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না

          শোরগোলের মধ্যেই খবরটা ছড়িয়ে পড়ল বিশিষ্ট মেহমানদের বিদায় দিয়ে মাত্র সান্ধ্যকালীন চা পান করতে ভিতর বাড়িতে এসেছেন জহির চৌধুরী রফিক এসে তাঁকে জানাল অতিথিদের মধ্যে যে দুজন ডাক্তার তাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি বাইরে বাড়িতে এলেন কোথা থেকে মাহী ছুটে এল সেও বাবার পিছু নিল

          ডাক্তারদের একজন পরীক্ষা করে দেখলেন লোকটি মারা গেছে তারপর দুজন মিলে দেখে বললেন- "অনেকদিনের দুর্বল আর উপোসী শরীরে অতিভোজন সহ্য হয়নি"

          "Ah! the man is dead!" হঠাৎ বিস্ময়বোধক এই কথাটি শুনে সবাই ঘুরে তাকাল মাহীর দিকে

          "তুমি এখানে কেন মাহী?" জহির চৌধুরী জানতে চাইলেন 

          "কী বলছো বাবা? এরকম একটা occurance- আসবো না!"

          কিন্তু অনেক দেখাদেখি, বলবলি করেও লোকটাকে কেউ চিনতে পারে না কোথায় তার গ্রাম, কী তার নাম ডিসেম্বরের এই ঠান্ডায় ঘাটের শানের ওপর তার প্রাণহীন দেহটা পড়ে আছে হাতের আঙুলে আর ঠোঁটের কোনায় এখনও খাবারের কিছুটা শুকিয়ে লেগে আছে

          "বাবা Whats the cause of death?"

          "মনে হচ্ছে লোকটা অনেকদিন পেটভরে খেতে পায়নি আজ বেশি খেয়ে টলারেট করতে পারেনি"

          "Strange! অনেকদিন খায়নি কেন বাবা?"

          বিরক্ত লাগে জহিরের তবু বাইরে ধৈর্য্য রেখে উত্তর দেন- "এদেশে অনেক গরীব মানুষ আছে যারা প্রতিদিন খেতে পায় না"

          "Really! Are they so poor?"

          "হ্যাঁ কিন্তু তুমি এখন এখান থেকে যাও এখন অনেক ঝামেলা আমার, অনেক কাজ"

          আশেপাশের গ্রামগুলোতে মাইকিং করা হল গ্রামের মানুষকে ডাকা হল কিন্তু পরিচয় পাওয়া গেল না শেষ পর্যন্ত থানার ওসির উপস্থিতিতে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে শহরের হাসপাতালে পাঠানো হল       

মানুষ তখনও আসছে-যাচ্ছে কিন্তু সারাদিন যে কলকোলাহল ছিল তা হারিয়ে এক বিষন্ন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে সবার মনে যেন একটাই ভাবনা- ক্ষুধা এত ভয়ঙ্কর! কতদূর থেকে শুধু একটু পেটভরে খেতে এসে লোকটা বেওয়ারিশ লাশ হয়ে গেল চারপাশে বিদ্যুতের আলো, এত আয়োজন তবু যেন এক বিষন্ন অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে সবার মনে অচেনা মানুষটির প্রতি সহানুভূতিতে তারা সবাই নির্বাক, মৌন

          মাহীর প্রশ্নবানে জর্জরিত তার বাবা ঢাকা শহরে অভিজাত এলাকায় বড় হয়ে মোটরগাড়িতে চড়ে যে প্রাচুর্যের জীবন তার সেখানে একজন না খেয়ে থাকা মানুষ বেশি খেয়ে মরে গেল এটা তার কাছে অবিশ্বাস্য

          গভীর রাতে সবাই ঘুমাতে গেল কিন্তু ঘুম আসছে না জহিরের কয়েকরাত ধরেই অনুষ্ঠানের টেনশানে ঘুম কম হচ্ছিল আজ সারাদিনের ধকলে ক্লান্তির পরও চোখে ঘুম নেই বিছানা থেকে নেমে বাইরে এলেন।

          আজও কি পূর্ণিমা? এই শীতের কুয়াশাও চাঁদের আলোকে ম্লান করতে পারেনি মন্ত্রমুগ্ধের মত সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠে এলেন কতদিন পর এমন চাঁদ দেখলেন মনে পড়ল মায়ের কথা তাঁর মৃত্যুর রাতেও সম্ভবত পূর্ণিমা ছিল সেদিন কতমানুষ এসেছিল আর আজ একটা মানুষ অপরিচয়ের কারণে অজ্ঞাত লাশ হয়ে গেল যার নাম নেই, ঠিকানা নেই মৃত্যু সবারই অনিবার্য নিয়তি অথচ প্রতিটা মৃত্যুই আলাদা

          আজ রাতে ছেলের পাগলামীতে কথা দিয়েছেন গ্রামের মানুষের খাবার কষ্ট ঘুচাতে কিছু করবেন আসলে কি করবেন? করতে পারবেন? নাকি আলো ঝলমল শহরে ফিরে গেলে বাবা-ছেলে দুজনেই গ্রামজীবনের অন্ধকারকে ভুলে যাবেন

          বুঝতে পারেন না জহির চৌধুরী দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে তাই শীতের রাতে খোলা ছাদে বসে থাকেন রাত গড়িয়ে যায় চাঁদ হেলে পড়ে জহির বসেই থাকেন

 

__________


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩৭-৪১

  ----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ ________________________...

Popular Posts