৭
৯১'এর মহা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস
নব্বই সালে গোলাম মহীউদ্দীন
স্যার রিটায়ার করার পর এলেন আকরাম হোসেন। ভদ্রলোক নারায়ণগঞ্জের সরকারী তোলারাম
কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে রিটায়ার করে এখানে এসেছিলেন। এখানে একাই থাকতেন অফিসার্স
কোয়ার্টারের রূপসাতে। এবার অধ্যক্ষের জন্য দুই কোয়ার্টার থেকে একটি বাদ দিয়ে
একটিমাত্র কোয়ার্টার বরাদ্দ দেয়া হল নতুন অধ্যক্ষকে। অবশ্য পরিবার না এনে একা
থাকার কারণে তাতে তাঁর কিছু এসে যেত না। তোলারাম সরকারী কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ
এখানে এসে রবীন্দ্রনাথের ‘দুই পাখি’ কবিতার মত যেন খাঁচায়
বন্দী হলেন। তিনি প্রায়ই চেয়ারে বসে ঝিমোতেন।
একদিন কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন,
আপনি কেন এখানে বসে আছেন, আরো কত ভাল জায়গায় যেতে পারতেন। আমি শুনে হেসেছিলাম। কে
যে কেন কোথায় কখন থাকে তা সে নিজেও কি জানে!
৯১-এর এপ্রিলের মাঝামাঝি রোজার ঈদ
হয়েছিল। একদিন শহর থেকে বেড়িয়ে ফিরতে আমি আর আমার মেয়েরা এমবারকেশন গেট দিয়ে ঢুকে
হেঁটে বাসায় যাচ্ছিলাম। হাঁটতেই হাঁটতেই আমরা দেখছিলাম চারপাশে ঝোপঝাড়ে সবুজের
মেলা। স্বচ্ছ জলের পুকুর কি যে ভাল লাগছিল, মনে হচ্ছিল এত সুন্দর একটা জায়গায় আমরা
থাকি! হায়! তখনো জানি না কি প্রকান্ড প্রাকৃতিক দৈত্য সবকিছু তছনছ করতে ধেয়ে আসছে।
সেবার প্রচন্ড গরম পড়েছিল। ঈদের পর থেকে গরমে গা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিল যেন। সবার মুখে
এক কথা- এত গরম কেন?
এরকম গরম পড়লে কয়েকদিনের মধ্যেই সমুদ্রে
নিম্নচাপ হয় এবং হলও তাই। এসএসসি পরীক্ষা এগিয়ে এসেছে। ২৯ এপ্রিল পরীক্ষার্থীদের
বিদায় সংবর্ধনা। এর দু'দিন আগে থেকেই আবহাওয়া বদলে গেছে, গুঁড়ি গুঁড়ি
বৃষ্টি, অস্বস্তিকর ভ্যাপসা গরম। এরই মাঝে অনুষ্ঠান। তখন সাধারণত ছাত্র-ছাত্রীদের
বিদায় অনুষ্ঠানে স্মারক হিসেবে বই দেয়া হত। বইয়ের প্রতি স্বাভাবিক কৌতূহলে এবং
শিক্ষকের দায়িত্বে থাকায় বই দেখতে চাইলাম। বই দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ! নামটা ‘সর্বনাশ চর্তুদিকে’, লেখক বোরহান উদ্দীন
খান জাহাঙ্গীর। এই লেখক এত উচ্চমার্গীয় লেখা লেখেন যে আমাদের সীমিত জ্ঞান দিয়ে
আমরা বুঝতে পারি না। দুর্বোধ্যতার জালে আটকা পড়ে পড়া রেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। শিশুরা
কি বুঝবে এই বইয়ের মর্মার্থ? সবগুলো বই এই লেখকের লেখা। মূল্য দুটাকা। সে কোন কালে
ছাপা হয়েছিল। সেই পুরনো মলিন বই এরা কিনেছে ওদের সুসময়ে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য।
জ্ঞিজ্ঞেস করলাম এ বই কেন আনলে? নামটা
দেখলেইতো ভয়ে বুক ধক করে ওঠে। এরা পরীক্ষা দিতে যাবে এদের জন্য এ বইতো মোটেও
মানানসই নয়।
দায়িত্বে থাকা দশম শ্রেণির ছাত্র
মোর্শেদ ইমতিয়াজ পাপ্পু (বর্তমানে সরকারী উচ্চপদস্থ আমলা) বলল, ম্যাডাম বাজেট কম
যে! টাকায় সবকিছু কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না।
নাস্তা, ফুল, গিফট, অভিনন্দনপত্র- আসলেই
তখন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল কম। আরো আশ্চর্য লাগত পাঁচ টাকা চাঁদা চাইলেও অনেক
অভিভাবক দিতে চাইতেন না। এতে যে তার সন্তানটি বন্ধুদের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছে তা
তারা ভাবতেন না। এরকম বিদায় অনুষ্ঠান নিশ্চয় তাদের শিক্ষাজীবনেও হয়েছে। তবু কেন
এমন আচরণ করতেন বুঝতে পারতাম না। যাই হোক বিদায় অনুষ্ঠান শেষে আমরা যখন কোয়ার্টারে
ফিরছি তখন একটু একটু করে বৃষ্টি ও বাতাসের জোর বাড়ছে।
এর কিছুদিন আগে এরশাদকে হটিয়ে
নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র এসেছে। গরমে দেশে মহামারী আকারে ডায়ারিয়া দেখা
দিয়েছে। সবচেয়ে ভয় লাগত, আমাদের বাসার পিছনে দিন-দুপুরে শেয়াল ডাকত এবং সে ডাকটা
কান্নার মত করুণ শোনাত। মনে ভয় হয়ত আবার কি বিপদ! কারণ ৭১ সালে বাড়িতে দেখেছি
মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই কুকুরগুলো এরকম করুণ সুরে ডাকত। তাই শেয়ালের ডাক শুনলেই
মনে হত- আবার কোন বিপদ! শুনেছিলাম প্রাকৃতিক বিপদ আসার আগে সবার আগে পশুপাখি টের
পেয়ে যায়।
২০০৪ এর ভয়ঙ্কর সুনামির পরও পত্রিকায়
পড়েছিলাম ভারত মহাসাগরের কোন একটি দ্বীপের একজন মানুষও মরেনি। এর কারণ
পূর্বপুরুষরা নাকি বলে গিয়েছিল, যখনই দেখবে ইঁদুরেরা গর্ত ছেড়ে পাহাড়ের দিকে
পালাচ্ছে তখন কোন কিছুর মায়া না করে একবস্ত্রে পাহাড়ে উঠে যাবে। পশু-পাখিই নাকি
সবার আগে দুর্যোগের বার্তা পায়। শৈশবে বাড়িতে সাঁরি বেঁধে পিঁপড়াদের ছুটতে দেখলে
গুরুজনরা বলতেন- বৃষ্টি হবে।
বিকেলের দিকে বৃষ্টি এবং ঝড়ো বাতাস
বাড়তে লাগল। হোসনে আপার মেয়ে বাবলীর বর তখন বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এবং
থাকে সেই রূপসা কোয়ার্টারে (অফিসার্স)। তার আসল নাম জগলুল হায়দার হলেও আপার সাথে
আমরা তাকে শাহীন নামে ডাকতাম। সে তখন আবহাওয়া বিভাগের দায়িত্বে নিযুক্ত অফিসার। দু-তিনদিন আগে
থেকেই সে শাশুড়িকে বারবার সতর্ক বার্তা দিয়েছিল –এবার কিন্তু ভয়ঙ্কর সাইক্লোন হবে। সবাইকে
সরে যেতে হবে। দশ নম্বর সিগন্যাল। জলোচ্ছ্বাসও হবে।
আমরা বিশেষ পাত্তা দিই না। এরকম দশ
নম্বর এখানে আরো কয়েকবার দিয়েছে কিছুই হয়নি। কিন্তু সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টির আর
বাতাসের জোর বাড়ছেই।
আমার গৃহকর্তা চাকরি করতেন চট্টগ্রাম
ইউরিয়া ফার্টিলাইজারে। সেই সময়ে সেখানে ‘বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি’র একটা বড় সম্মেলনের আয়োজন হচ্ছিল এবং তৎকালীন এমডি শফিকুর রহমান অনুষ্ঠান
আয়োজনের মূল দায়িত্ব তাকে দিয়েছিলেন। দিন-রাত ব্যস্ততায় ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস
সম্পর্কে তিনি খুব একটা অবগত ছিলেন না। সন্ধ্যার দিকে বাতাসের জোর বাড়তে থাকলে
তাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ল। এদিকে সবাই পরিবার নিয়ে কোয়ার্টার ছাড়ছে। এয়ারপোর্টও
খালি।
আমি আমার শাশুড়ির কাছে যাই।
-আম্মা কি করব?
তিনি বলেন অপেক্ষা করতে। আগে তাঁর ছেলে
আসুক।
হুসনা আপা, দুলাভাই লোকজন নিয়ে নিজেদের
জিনিস গুছিয়ে উপরের তাকে তুলছেন আর বার বার আমার কাছে আসছেন, আমরা কি করব। আমি
দ্বিধাগ্রস্ত। তবু ওনাদের অনুরোধে ওনাদেরই লোক দিয়ে শুধু টেলিভিশনটা উপরের তাকে তুলে
রাখলাম। কারণ তখন রঙিন টিভির অনেক দাম। কোনমতে একটা কিনেছি আরেকটাতো
সম্ভব নয়।
প্রায় রাত নটার দিকে গৃহকর্তা ফিরলেন জবুথবু
হয়ে। সার কারখানার
একটি গাড়ি তাঁকে সল্টগোলায় নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। তারপর কিছুটা টেম্পোতে বাকিটা
পায়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় এসেছেন। যাক তবু এসেছেন এটাই স্বস্তি।
তখন রাত নটা। তখনই কারেন্ট চলে গেল। এদিকে বাতাসের বেগ
ক্রমাগত শিস দিয়ে বাড়ছে। মোমবাতির আলোয় কোনরকমে খাওয়া হল। এবার সিদ্ধান্ত, আমরা কি
করব, কোথায় যাব।
আমার একটা ধারণা ছিল, ভরা কটাল অর্থাৎ
ভরা পূর্ণিমায় সাইক্লোন হলে জলোচ্ছ্বাস হবেই। বইতে পড়া সে জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আমি
সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা এখান থেকে সরে যাব। কিন্তু কোথায় যাব এত রাতে, এই আঁধারে।
এমন সময় হোসনে আরা আপা এলেন। বললেন,
এয়ারফোর্সের মাইক্রো এসেছে আমরা যাচ্ছি, আপনারাও চলেন।
শাশুড়ি আম্মাকে বললাম। তিনি পর্দানশীন
মানুষ কোথাও যাবেন না। বাঁচলে এখানে বাঁচবেন, মরলেও এখানে। আল্লাহর হুকুম যা তাই
হবে। মা না গেলে ছেলেই বা যায় কিভাবে। তখন তিনি আমাদের বললেন, তোমরা যাও, আমি
আম্মাকে নিয়ে থাকি।
আমি তো যাবই। কারণ আমার ছোট মেয়ের
কিছুদিন আগে হাম হয়েছে এখন যদি ঠান্ডা লাগে তাহলে তাকে নিয়ে ভুগতে হবে।
গাড়ি আসার পর মা-ছেলেকে রেখে নিজের দুই
মেয়ে আর কাজের মেয়েটিকে নিয়ে হুসনা আপার সাথে গাড়িতে উঠলাম। আজও ভাবি সেদিন যদি
আপা আর দুলাভাই জোর করে না নিতেন তাহলে আমাদের কি হত! কি হত জানি না তবে তাঁদের
স্নেহ-ভালবাসার কাছে আজীবন ঋণী আছি, থাকব।
আমরা উঠেছিলাম শাহীনেরই বন্ধু ফ্লাঃ লেঃ
সালেকীনের বাসায়। তাদের খুবই ছোট দুটি মেয়ে সেঁজুতি, ভাস্বতী আর ছোট ভাই (আমাদের
ছাত্র ছিল)। গিয়ে দেখি তাদের চারতলার ঘর ইতিমধ্যে আশেপাশের একতলার মানুষে ভরে
গেছে। কিন্তু ছোট্ট দুটি বাচ্চা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর কোন বিরক্তি নেই। সবাইকে তারা
সাদরে গ্রহণ করছে।
ঝড়ের তোড় বাড়ছে, আমরা সবাই দোয়া দরুদ
পড়ে আল্লাহকে ডাকছি। চারতলার দরজা একটু ফাঁক করলে চোখে পড়লো পুরোটা আকাশ যেন লাল
আগুনের সামিয়ানা! বাতাসের ঝাপটায় দরজা খোলা যায় না। এবার পর্দা সরিয়ে দেখতে
থাকলাম। বাইরের জগৎ ভয়ঙ্কর লাল আলোয় আলোকিত। বিমান ঘাঁটির বড় বড় গাছগুলো একবার
মাটিতে নুয়ে পড়ছে আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। দক্ষিণে কর্ণফুলি নদীতে নোঙর করা
বড় বড় জাহাজগুলো মনে হচ্ছে অনেক উপরে উঠে এসেছে আর অনবরত হর্ণ বাজাচ্ছে। সবগুলো
জাহাজ আলো জ্বালিয়ে রাখাতে আলোক সজ্জার মত দেখাচ্ছে। আবার আকাশের অগ্নিগোলক আর
প্রকৃতির উথাল-পাথালে মনে হচ্ছে- আজই সেই মহাপ্রলয়ের রাত্রি। না কেয়ামত হওয়ার
কথাতো ধর্মীয় মতে দশ মুহররম। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে মনে হচ্ছে আজই কেয়ামত লেখা।
হঠাৎ হুসনা আপার খেয়াল হল- ওনার মেয়ে আর
জামাই, বাবলী-শাহীন কোথায়? সালেকীনকে জ্ঞিজ্ঞেস করার পর বলল, আমার এখানে যখন আসেনি
তাহলে হয়তো অন্য কারও বাসায় উঠেছে। এবার আপার টেনশান বেড়ে গেল। আমি সান্ত্বনা
দিচ্ছি, আমাদেরকে সর্তক করেছে আর ওরা কি বসে আছে! হয়তো অন্য কোন বন্ধুর বাসায়
উঠেছে।
আমার কেবলই মনে হচ্ছে, জলোচ্ছ্বাস আসবে।
কান পেতে আছি, কখন আসে, কখন আসে, এলে রাকার আব্বুদের কি হবে?
ঠিক রাত দেড়টা- হঠাৎ এমইএস কোয়ার্টারের
দিক থেকে ঝড়ের প্রচন্ড গর্জনের মাঝেও মানুষের কান্না-চিৎকার শোনা গেল। আমি দরজা
ফাঁক করে দেখতে গেলাম- কি যে দেখলাম, সেটা আজও আমাকে বিভ্রান্ত করে। ওপরে লাল আলো,
নিচে শঙ্খসাদা ফেনার ঢেউ- আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমার মনে হল আমার শাশুড়ির সাদা
আঁচল- ওরা ভেসে যাচ্ছে। হতবিহ্বল হয়ে গেলাম।
এ সময় হঠাৎ হুসনা আপা চমকে উঠে আমাকে
বললেন, রিফাৎ আপা, আমি যেন বাবলির ডাক শুনতে পেলাম। আমাকে ডাকল-আম্মা, আম্মা।
আমি বললাম, আরে না, আপনি মিছেমিছি
ভাবছেন। ইনশাল্লাহ ওরা নিরাপদে আছে, পৃথিবীতে কিছু ঘটনা ঘটে যা ব্যাখ্যাতীত। পরে
আমরা জেনেছিলাম সবাইকে সাবধান করে ওরা নিজেরাই যায়নি। ওদের আশে-পাশে যারা দামি
জিনিসপত্র নিয়ে সরে যাচ্ছিল ওরা কয়েকজন বন্ধুদের তাদের নিয়ে হাসাহাসি করেছে। ‘যাও যাও কাল সকালে
আবারতো ফিরে আসবে’- এই বলে। যখন পানি
আসছিল ওরা কোয়ার্টারের ভিতর থেকে টর্চের লাইট ফেলায় টিনের ছাদের নিচে হার্ডবোর্ডে
ওঠা অন্য অফিসার এসে চেয়ারের ওপর টেবিল দিয়ে কোনমতে বাবলীকে টেনে তোলে এবং শাহীনও
ওঠে। পরে ঘটনার সময় হিসাব করে দেখেছি বাবলীর যখন এই বিপদ তখনই
হুসনা আপা বাবলীর ‘আম্মা’ ডাক শুনতে পেয়েছিল। এ
জন্যই লোকগীতিতে আছে, “বিদেশ
বিপাকে যার পুত্র মারা যায়, পাড়া-পড়শী না জানিতে আগে জানে মায়”।
বুক দুরুদুরু করছে। হায় খোদা কি দেখাবে
আমাকে। এর কিছুদিন আগে ৯০ এর ত্রিশ ডিসেম্বর আমার বাবা মারা গেছেন। সেই শোক এখনো
আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আরো কি বিপদ অপেক্ষায় আছে আমার জন্যে।
ভোরের দিকে ঝড় একটু একটু করে প্রশমিত
হয়ে এল। প্রায় সকাল নটায় পরিবেশ কিছুটা শান্ত হল। তখন চারদিকে পানি। বুঝতে পারছি না
পানির উচ্চতা। চারতলা থেকে আমাদের কোয়ার্টারের সামনের রাস্তা দিয়ে প্রথম একজন
মানুষকে হেঁটে যেতে দেখলাম। মনে হল লোকটা অনেক লম্বা কেননা কোয়ার্টারের সামনের
বাংলোতে যে অফিসার থাকতেন তার বাসার উঁচু দেয়াল দেখা যাচ্ছিল না। আমরা ভাবলাম
দেয়ালের চেয়ে উঁচু এই লোকের হাঁটু দেখা যাচ্ছে তার মানে সে কত লম্বা। লোকটাকে বকের
মত দেখাচ্ছিল। পরে পানি নামার পর দেখলাম দেয়াল ভেঙে মাটিতে মিশে যাওয়াতে এরকম মনে হয়েছিল। এটা নিয়ে পরেও
আমরা অনেক হেসেছি।
সালেকীন পরিবার উপস্থিত সবার জন্য কোন
রকমে সকালের খাবার হিসেবে খিচুড়ির যোগান দিলেন। পানি নেই, কারেন্ট নেই, ঘরে এতগুলো
মানুষ গিজগিজ করছে। তবু তারা স্বামী-স্ত্রী যে আন্তরিকতায় সবাইকে আশ্রয় এবং
আপ্যায়ন করেছিল তা কোনদিনও ভুলবার নয়। সেঁজুতি-ভাস্বতী নিশ্চয় এখন অনেক বড় হয়ে
গেছে। সালেকীনের ছোটভাইটি (আমাদের ছাত্র) তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ত। এদের সবার
স্মৃতিই হৃদয়ে ধারণ করে বেঁচে আছি।
সময় সম্ভবত দুপুর বারোটা, পানি নেমে
গেছে। কিন্তু কাদায় রাস্তাঘাট কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পিচ্ছিল দুর্গন্ধযুক্ত সে কাদায়
আছাড় খেতে খেতে না খেয়ে কোন রকমে বাসায় এলাম। বুক কাঁপছে গিয়ে কি দেখব, ওদের কি
পাব?
ঘরে ঢুকলাম। গৃহকর্তা হাসিমুখে এগিয়ে
এল। যাক স্বস্তি! এত বিপদেও এই লোক হাসতে পারে! চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম আমার ষোল
বছরের সংসার লন্ডভন্ড। কাদামাটিতে দেবে গেছে। কাঠের বড় আলমারীটা মাটিতে শুয়ে আছে।
তার ওপর ভিজা কাপড়ে আমার শাশুড়ি বসে আছেন। একই দশা স্টিল আলমারী, ওয়ার্ডরোব,
খাটপালং, চেয়ার-টেবিল সবকিছুর। ঘরের ছাদ অনেক অনেক উঁচু ছিল। দেখলাম টিউবলাইটের
নিচে পর্যন্ত পানির দাগ। তার মানে নয় থেকে দশ ফুট পানি উঠেছে। ইলেকট্রিক
সুইচবোর্ডে একটা ছোট্ট সাপ কোনরকমে পেঁচিয়ে বসে আছে।
আমি হু হু করে কেঁদে উঠলাম। তিল তিল করে
গড়ে তোলা এত সাধের সংসার- কত বই, ভিসিআর, ক্যামেরা, সেলাইর মেশিন, ফ্রিজ, কাপড়
চোপড় সবকিছু একমুহূর্তে লন্ডভন্ড। আমার ধারণা ছিল, পানি উঠবে কিন্তু এভাবে সবকিছু
ওলটপালট হয়ে যাবে সে ধারণা ছিল না। ঘরে কাচভাঙা আর বইয়ের জন্য পা দেয়া যাচ্ছিল না।
আমার কান্নায় গৃহকর্তা সান্ত্বনা দিল। আমারও সম্বিৎ ফিরল। আসলেইতো মানুষ বাঁচলে
জিনিস হবে। কিন্তু আজ যদি ঘরের এ দুজন মানুষকে হারিয়ে ফেলতাম তাহলে- নাহ আর বেশি
ভাবতে চাই না।
ডাইনিং টেবিলটা ভাসছিল এবং তার উপর রাখা
ভাত আর দুধের পাতিলও নিরাপদে ভেসেছে। আম্মা সকালে সেগুলো খেয়ে কোনরকমে প্রাতরাশ
সেরেছেন। তাঁর পুত্র এয়ারপোর্টে দোকানে গিয়েছিল এক বোতল পানি আর যদি কোন শুকনো
খাবার পাওয়া যায়। তারা প্রথমে পানি দিতে চায়নি। অনেক অনুরোধের পরে একবোতল পানি ধার
হিসেবে দিয়েছিল। কারণ তাদেরও বাঁচার জন্য পানি চাই। প্রতিবেশীদের খবর নিতে গেলাম।
সবাই নিজ নিজ পরিবার আত্মীয়স্বজনের কাছে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। শুধু মনোয়ার ভাইয়ের
পরিবার ছাদে আশ্রয় নিয়েছিল। স্যাররা সবাই ছাদে বাতাসে উড়ে যাওয়ার ভয়ে পিলারের সাথে
নিজেদের কাপড় দিয়ে বেঁধে রেখেছিল।
আমার শাশুড়ি একে রাশভারী স্বভাবের
পর্দানশীন মহিলা, তায় শারীরিকভাবে ভারী গড়নের এবং বয়স একাশি/বিরাশি। তিনি কোনদিন
লোহার মই বেয়ে ছাদে উঠেননি। কিন্তু তাঁর ছেলে যখন দেখল পানি আসছে তখন কোন আসুরিক
শক্তিতে মাকে পিছন থেকে বুকে ঠেলে উপরে তুলেছিল আজও বুঝে পাই না। আমি যখন রাতের
বেলায় ওদের নিয়ে টেনশান করছিলাম তখন দুলাভাই (হুসনা আপার স্বামী) বলেছিলেন, চিন্তা
করবেন না ভাবী, জান বাঁচাতে ঠিকই উঠতে পারবেন। দেখলাম তাঁর কথাই সত্যি।
কোন দিশা নাই। কি করব, কি পরব, কি খাব
জানি না। চারপাশে সবার এক অবস্থা। সিদ্ধান্ত নিলাম শহরে চলে যাব মেজ ভাইয়ের বাসায়
(আমার ভাসুর)। কিন্তু কীভাবে যাব? যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। শহরের মানুষ তখনো জানে না
উপকূলে এ মহাপ্রলয় ঘটে গেছে। আমাদের ফুপাতো ভাই জহিরুল ইসলাম তখন ইস্টার্ন
রিফাইনারীর প্রশাসনিক ম্যানেজার। তিনি অফিসে এসে শুনলেন এবং দেখলেন। শেষে অফিস করে
যাওয়ার সময় কাটগড় দিয়ে অনেক কষ্টে গাড়ি নিয়ে আমাদের দেখতে এলেন। এলেন ত্রাতা
হিসেবে। তাঁর গাড়িতে করেই আমরা রওনা দিলাম। রাকার আব্বু শুধু একা রয়ে গেল। কারণ
গাড়িতে জায়গা হচ্ছিল না। তাছাড়া খোলামেলা তছনছ এই ভাঙাগৃহের নিরাপত্তারও ব্যাপার
ছিল। আশ্চর্য গরু খোঁজার নাম করে পরদিন কাকভোরে চোরেরা ঠিকই এসেছিল।
আমরা যেতে যেতে দেখলাম ঘাঁটির একটি
গাছেরও পাতা নেই। আগুনে পোড়া কেমন একটা লালচে রঙ নিয়ে ন্যাড়া গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে
আর যেগুলো ঝড়ের সাথে যুদ্ধে বাঁচতে পারেনি সেগুলো ভূমিশয্যা নিয়েছে।
এমবারকেশান গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় চোখে
পড়ল বার্মা ইস্টার্ন (তখনো পদ্মা অয়েল হয়নি), যমুনা আর মেঘনা অয়েলের অসংখ্য তেলের
ড্রাম রাস্তায় পড়ে আছে আর উপচে পড়ছে তেল-কাদায় রাস্তা অসম্ভব পিচ্ছিল। বাঁ দিকে
তাকিয়ে দেখলাম ভাটার টানে কর্ণফুলির পানি অনেক নিচে এবং শান্ত নদী বয়ে চলেছে। কে
বলবে সাগরের জোয়ারে কাল রাতে এ নদী ফুঁসে ওঠা নাগিনীর মত সর্বগ্রাসী ছিল!
সন্ধ্যায় মেজভাইয়ের বাসায় গেলাম। শহরে
বিদ্যুৎ, পানি, টেলিভিশন কিছু নেই। আছে শুধু বেতার আর সৌভাগ্যক্রমে তিতাস গ্যাস।
সে রাত কোনভাবে কাটল। পরদিন সকাল থেকে
চিন্তা। রাকার আব্বু ওখানে একা এবং গত পরশু রাতের পর থেকে তার পেটে কোন দানাপানি
পড়েনি। ইতিমধ্যে অনেকেই জেনে গেছে উপকূলীয় অবস্থার ভয়ঙ্কর এ বিপর্যয়ের কথা।
আমার প্রতিবেশী (অতীতে), পরম বন্ধু
শাহাজান ভাবী এগিয়ে এলেন, ভাইসাহেবসহ। টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত-তরকারী নিয়ে আমরা
ট্যাক্সি নিয়ে পতেঙ্গার দিকে চললাম, সাথে গেল আমার খালাত বোন হেলেন।
ওখানে যাওয়ার পর থালা-বাসন, বাটি-ঘটি যা
খুঁজে পাওয়া গেল তা পিছনের মাঠে জলোচ্ছ্বাসের জমে থাকা নোংরা জলে কোন রকমে ধোয়া
হল। ভাইসাহেব একটা ঝাঁকা কুড়িয়ে মাথায় করে সেগুলো ঘরে নিয়ে এলেন। দৃশ্যটা দেখে
চোখে পানি চলে এল। হায়রে দুঃসময়ের আপনজন মাথায় ঝাঁকা বহন করার অভ্যাস না থাকলেও
করছেন আমাদের প্রতি বন্ধুত্ব্ব আর ভালবাসার দায় থেকে।
সবকিছু দেখে ভাবী বললেন, এভাবেতো হবে
না। কালকে আমি শহর থেকে কিছু লোক নিয়ে আসব। পরদিন সকাল থেকে তিনি ট্যাক্সি ভাড়া
করে কয়েকজন শ্রমিক এবং আরেকটা ট্যাক্সিতে আমরা, ওদের দুপুরের খাবারের জন্য বড় দুই
টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত-তরকারী নিয়ে আসতেন। তারা সকাল দশটা-এগারোটা থেকে বিকেল চারটা
পর্যন্ত কাদা সরিয়ে ধোয়া-মোছার কাজ করত। তারপর আবার ট্যাক্সি করে শহরে ফিরতাম।
ভাবী খুব অনুরোধ করতেন ওনার বাসায় থাকতে। কিন্তু আমি থাকতাম না। কারণ আম্মা
(শাশুড়ি) আছেন ওখানে, তাছাড়া আমার ভাই-ভাশুরের বাসায় থাকার অধিকার সবার আগে। তাই
ওনার ব্যাকুল অনুরোধ সত্ত্বেও কাজের মেয়েটাকে নিয়ে মেজভাইয়ের বাসায় ফিরে যেতাম।
এরই মাঝে একদিন আমাদের ছাত্র হেদায়েত এল
ওর বন্ধুকে নিয়ে আমাদের সাহায্য করতে। কিছুক্ষণ কাজ করার পরই ঘরের কাদায় ডোবা কাচে
তার বন্ধুর পা কেটে গেল। আমরা তাড়াতাড়ি ওদের পাঠিয়ে দিলাম টিটেনাস দেয়ার জন্য। সেই
হেদায়েত ক্যান্সারে ভুগে অনেক কষ্ট পেয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু সেই
স্মৃতি আজও অমলিন। এত সাদামনের মানুষ ছিল এই ছেলেটা।
আশেপাশের প্রতিবেশীরাও ঘরবাড়ি পরিষ্কার
করছে। দেখতে যাই। গৃহিনী ও বাচ্চাদের ফিরিয়ে আনার জন্য সবাই ব্যস্ত-ব্যাকুল।
কদ্দিন আর পরের বাড়িতে ফেলে রাখা যায়। রাতে পুরুষরা থাকে। আড্ডা দেয়। সবাই
দুলাভাইকে নিয়ে মেতে থাকে। কারণ আমার কর্তাটি বিশ্বজগতের দুলাভাই, যেহেতু আমি সবার
আপা। কোয়ার্টারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল আমাদের। কিন্তু নাসির ভাই, সাইদ ভাই
এদের উক্তি ছিল- এসবের জন্য দুলাভাইকে এক মুহূর্তের জন্যেও আফসোস করতে দেখিনি। বরং
আড্ডায়, চুটকিতে হাসিয়ে আমাদের দুঃখ ভুলিয়ে দিতেন।
প্রায় মাসখানেক পর আমরা সবাই যার যার
ঘরে ফিরতে লাগলাম। তখনও সাগরে লাশ পাওয়া যাচ্ছে। পুকুর-ডোবায় লাশ ফুলে ভেসে উঠছে।
আমরা প্রতিদিনই শুনি এখানে ওখানে লাশ পাওয়া গেছে।
এরপরও দীর্ঘদিন রাতের বেলা জোরে বাতাস
হলে শূন্য প্রান্তরে এমন শোঁ শোঁ শব্দ হত যে বুকের ভিতরটা গুমরে গুমরে উঠত। একটু
বাতাস হলেই কারেন্ট চলে যেত। আমাদের ফ্রিজ, সেলাইর মেশিন, ক্যাসেট প্লেয়ার প্রচুর
জামাকাপড় নোনা পানিতে নষ্ট হয়েছিল। কিছু দামী কাপড় লন্ড্রীতে দিয়ে আরো গচ্ছা দিতে
হল। ড্রাই ওয়াশ থেকে
আনার পর দেখা গেল সব শাড়ি ফেঁসে ফেঁসে গেছে।
সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছিল বই আর অ্যালবামের
জন্য। বই কেনার শখে জীবনে প্রচুর টাকা ব্যয় করেছি। সেগুলো সব কাদায় মিশে হারিয়ে
গেল। আর জীবনস্মৃতি যত ছবি শৈশব-যৌবনের, বাবা-মা, বন্ধু এবং বাচ্চাদের ছোটবেলার
ছবিগুলো সব নোনাপানি লেগে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। স্টিলের আলমিরার লকারে রাখা অলঙ্কারের
বাক্সেও মুঠো মুঠো বালি ঢুকে আছে। দেখি আর বিস্মিত হই। এত প্রায় নিশ্ছিদ্র কৌটায়
বালি ঢুকল কি করে। সার্টিফিকেট গুলো ভিজে পচা গন্ধ বেরুচ্ছে।
সেসময় সারা পতেঙ্গায় একটা দুর্গন্ধ ছিল।
এর কারণ বোধহয় সমুদ্রের পানির সাথে প্রচুর সামুদ্রিক প্রানী ও মাছ ভেসে এসে পচে
বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। অনেকে আবার ভেসে আর মৃত মাছ ধরে খেয়েছিল। ভাগ্যিস
বেশিদিন এটা করতে দেয়া হয়নি। তাহলে মহামারী ছড়াত।
এবার কলেজের কথায় আসি। একতলা লাল দালান।
সুতরাং কলেজের নথিপত্র সবকিছুই একতলার অ্যাকাউন্টস রুমে স্টিলের আলমারীগুলোতে
সংরক্ষিত ছিল। সব ডুবে চুবে একাকার। ল্যাবের বিভিন্ন উপকরণ ও কাগজপত্রের একই
অবস্থা। লাইব্রেরীর বই ছাত্র-ছাত্রীদের খাতাপত্তর, শিক্ষকদের বই সব কাদায় মোড়ানো।
অফিসের লোকেরা পিয়ন-আয়াদের দিয়ে সেগুলো ঝেড়ে ঝুড়ে রোদে শুকাতে চেষ্টা করে।
বিজ্ঞানের শিক্ষক আয়েশা আপা, দিলরুবা, সুপালদা এরাও যার যার ল্যাব নিয়ে ব্যস্ত।
আমাদের কোন ছুটি নেই। যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি নিজেদের কোয়ার্টারে কাজ করার জন্য
ছুটি চাইলে কর্তৃপক্ষ নামঞ্জুর করেন। আর আকরাম স্যার ঝড়ের পর কিছুদিন বারান্দার
চেয়ারে বসে ঝিমুতে ঝিমুতে চাকরি ছেড়ে চলে গেলেন।
অফিসের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নষ্ট হওয়ার
খেসারত এখনো শাহীন চট্টগ্রামের শিক্ষকদের দিতে হচ্ছে। কারণ আমাদের প্রায় সবারই
প্রথম এমপিও জলোচ্ছ্বাসে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অবসরে যাওয়ার সময় এই প্রথম
এমপিও জমা দিতে হয়। বাধ্য হয়ে চট্টগ্রামের জেলাপ্রশাসকের কাছে আবেদন করে ঘূর্ণিঝড়ে
নষ্ট হওয়া এমপিও প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করে ওনার অনুমোদনপত্র নেয়া হল। কিন্তু
ঢাকার নীলক্ষেতের ব্যানবেইস অফিস সে অনুমোদন বা সাক্ষ্যপত্র দেখালে শিক্ষকদের
প্রতি যে অবজ্ঞা প্রদর্শন করেন তাতে বোঝা যায় ৯১এর এই প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ
সম্পর্কে তাদের সামান্যতম ধারণাও নেই।
বিমানবাহিনীর অত্যন্ত প্রয়োজনীয়
দলিলপত্রও এ জলোচ্ছ্বাসে নষ্ট হয়েছিল। অফিসার্স কোয়ার্টারে ও বিমানসেনাদের রূপসা
কোয়ার্টারেও যারা একতলায় ছিল তারাও আমাদের মতই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল বিমান বাহিনীর
হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমানের। দশ নম্বর সর্তক সংকেতের পরও বিমানগুলো হ্যাংগারেই ছিল
এবং সেগুলো পরে ঢাকা-চট্টগ্রামের কিছু কিছু মোড়ে প্রদর্শনীয় বস্তু হিসেবে স্থাপন
করা হয়েছিল। সবকিছু জেনেশুনেও বিমান বাহিনী কর্তৃপক্ষ কোন অজ্ঞাত কারণে এত শত শত
কোটি টাকার সামরিক সম্পদ নষ্ট করেছিল- যা ভাবলে আজও প্রশ্ন জাগে মনে। সাধারণ মানুষ
অবগত হয়েও অজ্ঞতাজনিত কারণে অবহেলা করতে পারে। তার ব্যক্তিগত সম্পদ নষ্ট হয়।
কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত ও শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত সেনা কর্মকর্তারা কিভাবে জাতীয়
সম্পদের এত সর্বনাশ করতে পারেন। ঘূর্ণিঝড়ের আগেই বিমানগুলো ঢাকা-যশোরে উড়িয়ে নিয়ে
গেলে ৪০০ কোটি টাকার (তখন শুনেছি) নষ্ট হত না।
দিনে দিনে বিভিন্ন দিকের খবর আসতে লাগল।
জানা গেল, মাইক্রোবাসের যে ড্রাইভার সে রাতে আমাদের অফিসার্স কোয়ার্টারে পৌঁছে
দিয়েছিল। সে বেচারা ডিউটিতে থাকা অবস্থায় জলোচ্ছ্বাস এসে পড়েছিল এবং পরিণতিতে সে
ভেসে গিয়ে ঘাঁটির এমবারকেশানের সীমানার কাঁটাতারে জড়িয়ে ছিল। শুনে এক করুণ বিষাদে
আক্রান্ত হয়েছিলাম। আমাদের যখন নিয়ে যাচ্ছিল তখন সে জানে না অন্যদের রক্ষা করছে সে।
কিন্তু মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে তার জন্যে।
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল, বিমান
বাহিনীর ঘাঁটিতে অনেক বড় একটা পুকুর ছিল যাকে দীঘিই বলা চলে। সেখানে এক বিশাল
ট্রলার ভেসে এসেছিল। ভেসেতো এসেছে, কিন্তু এ বিরাট ট্রলারকে পানি থেকে তুলে আনার
কোন ব্যবস্থাতো নেই! দীর্ঘদিন এ ট্রলারটি ঐ পুকুরে ছিল। পরে কি হয়েছিল আজ আর মনে
নেই।
আমাদের বার কোয়ার্টারের দক্ষিণ পাশে
হ্যাংগারের না ট্রলারের একটা বিশাল কাঠের পাটাতন এসে পড়েছিল। ঝড়ের রাতে এটা যদি
ধাক্কা দিত তাহলে কোয়ার্টারগুলো থাকত না। কিন্তু সেটির পতন ঘটেছিল কোয়ার্টারের
সামনে ঝিলের মত জায়গাতে। পরে আমরা বারো কোয়ার্টারের ভাবী ও ম্যাডামরা বিকেলে ঐ
পাতাতনের ওপর বসে গল্প করতাম।
ষোল কোয়ার্টারে আমাদের নিচের দিকের
ক্লাসের একজন ছাত্র মারা গিয়েছিল। এরকম আরো দু-একজনের কথা শুনেছিলাম।
আমাদের চন্দ্রিকা ম্যাডাম পানি আসার সময়
দেয়াল বেয়ে বাসার টিনের নিচের ছাউনিতে উঠে সকালে আর নামতে পারছিলেন না। যে আতঙ্ক
তাকে উপরে ঠেলে দিয়েছিল তার অবসান হলে নামতে গিয়ে পতন হবে এই ভয়ে নামতে পারছিলেন
না। আমাদের ছাত্র একইভাবে খেজুর গাছে উঠেছিল কিন্তু পানি নামার পর লোক এসে না
নামানো পর্যন্ত তাকে গাছেই থাকতে হয়েছিল।
কিছুদিনের মধ্যেই রিলিফ আসতে শুরু করল।
প্রোটিন বিস্কুট, দুধ, পানি, কম্বল এসব। এল হোবারক্রাফট যা পানিতেও চলে মাটিতেও
চলে। সে হোবারক্রাফট দেখতে এবার এয়ারপোর্টে মানুষের ঢল নামল। হুজুগে মানুষেরা
নারী-পুরুষ–শিশু সবাইকে
নিয়ে আসতে লাগত। সে এক মহাহুল্লোড়। আমরা মরি যন্ত্রণায়। এরই মাঝে দর্শনার্থীরা
প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম সারতে আমাদের কাছে এসে সাহায্য চায়। আমরা সাহায্যতো পাই না,
চাইও না, উল্টে সেবা দিতে হয়।
ঘূর্ণিঝড়ে এয়ারফোর্সের অনেক গাড়িও নষ্ট হয়ে
গিয়েছিল। এসব দামী দামী বাস-মাইক্রোবাস সারানোর পরও চলতে গিয়ে পথে-বেপথে আটকে যেত। একবার আমরা কয়েকজন
এক ছুটির দিনে কলেজের কোন এক বিশেষ কাজ শেষ করে মাইক্রোতে বাসায় ফেরার পথে
যন্ত্রযানটি হঠাৎ শব্দ করে গলগল করে ধোঁয়া উগরে দিতে লাগল। আমাদের একজন দরোজার
পাশে বসেও দিশেহারা হয়ে সামনের সিটের উপর দিয়ে কিভাবে যেন নামলেন। আমি জানালার
পাশে ছিলাম। কাচ সরিয়ে লাফ দিতে গেলাম। তৎক্ষণাৎ চালক এসে হাত বাড়িয়ে আমাকে নামতে
সাহায্য করল। আমাদের কারোই দরজা খোলার কথা মনে আসেনি। মৃত্যু আতঙ্ক যে কী জিনিস তা
এসব ঘটনার মাঝ দিয়ে যেমন বোঝা যায় তেমনি বিপদ কাটিয়ে নিরাপদ অবস্থানে ফিরলে হাসির
খোরাকও পাওয়া যায়।
যতই লিখছি ২৯ এপ্রিল ১৯৯১-র ঘটে যাওয়া
দুর্যোগের নানা ঘটনা ততই বিস্মৃত অতীত থেকে স্মৃতিতে ভেসে উঠছে। জহির রায়হানের
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প ‘সময়ের
প্রয়োজনে’ অনামা তরুণ
মুক্তিযোদ্ধার ডাইরীতে লেখা ছিল- যখন যুদ্ধ শেষ হবে তখন এসব গল্প সবাইকে শোনাবে।
হয়ত হাজার বছর কেটে যাবে তবু এ গল্প ফুরাবে না।
আমারও মনে হত এক রাতের মধ্যে প্রকৃতি যে
প্রলয় নাচনে সবকিছু ধ্বংস হল তার বিবরণ হাজার রাত বললেও ফুরাবে না।
পরে জেনেছিলাম চট্টগ্রামের ইউরিয়া
ফার্টিলাইজার বিস্ফোরণের ভয়ে তাদের গ্যাস চুল্লির গ্যাস আগুনে পুড়িয়েছিল। এর ফলে
পতেঙ্গার আকাশ আরো লাল হয়ে উঠেছিল। আবার সে রাতেই নদীখনক ‘শক্তিমানে’র আঘাতে কর্ণফুলি সেতু ভেঙে পড়েছিল। এর ফলে
চট্টগ্রাম শহরই একরকম চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। নদীতে
নৌকা, সাম্পান আর রাস্তায় ট্যাক্সি-বাসে ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে যেতে হত। পতেঙ্গার
সাইলোর (খাদ্য গুদাম) খাদ্য-শস্যের পচা গন্ধে আসা যাওয়ার পথে নাক চেপে থাকতে হত।
বাংলাভাষায় একটি প্রবাদ আছে, ‘কারও পৌষমাস, কারো
সর্বনাশ’। এই চিরকালীন
প্রবাদটি এই মহা ঘূর্ণিঝড়েও সত্য হল। আগেই বলেছি, বিমান
বাহিনীর পাশেই ছিল তেলকোম্পানীগুলোর মূল ডিপো। বন্দরের জেটি থেকে পাইপলাইনে স্থায়ী
ট্যাংকারে জ্বালানি তেল জমা হত। এগুলো ড্রামে এবং তেলবাহী ট্যাংকার বা মালগাড়িতে
সারা দেশে পাঠানো হত। জলপথে যেত বার্জে। ঝড়ের রাতে হাজার হাজার ড্রাম ভেসে গিয়েছিল
আবার মজুদ তেলও ভেসে গিয়েছিল। রূপসা কোয়ার্টারে থাকা অনেকেই এসব তেলের ড্রাম
ধরেছিলেন এবং ‘তেলে জলে
মিশ খায় না’ বলে জ্বালানী তেল পানির উপর ভাসছিল। অনেকে পানি
ছেঁকে এই তেল সংগ্রহ করে বিক্রি করেছিল। পরে এমনও শুনেছি, কেউ কেউ নাকি মন্তব্য
করেছিলেন এরকম ঝড় বছরে দু-একটা হলে মন্দ হয় না। কিন্তু বিধি বাম। এই তেল সংগ্রহ
এবং মজুদের কারণে শাস্তি স্বরূপ ট্রায়ালে বেশ কিছু বিমানসেনার চাকরি চলে যায়।
সেবছর অনেকগুলো ঝড় হয়েছিল। প্রশান্ত
মহাসাগরীয় স্রোত ‘এল নিনো’ বা ‘লা নিনো’র প্রভাবে এসব ঝড়
হয়েছিল। নভেম্বরেও একটা বড় ঝড় হয়েছিল তবে সেটা সম্ভবত কক্সবাজারের উপর দিয়ে
গিয়েছিল।যার ফলে চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা পেয়েছিল।
এরপর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে
শিক্ষক-শিক্ষিকা ও আয়া-পিয়নদের সবার ওপর নির্দেশ এল ৫নং সিগন্যাল দিলে সব ছুটি
বাতিল। স্যারদেরকে পিয়নদের নিয়ে ক্লাসরুমের চেয়ার-টেবিল একটার সাথে আরেকটাকে দড়ি
দিয়ে বাঁধতে হবে যাতে ভেসে যেতে না পারে। ম্যাডামদের কাগজপত্র ওপরের দিকে তুলে
রাখতে হবে এবং ছুটি থাকলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
আবার অন্যদিকে পাঁচ নম্বর সিগলন্যাল
দিলে নিচের তলায় বা একতলায় কাউকে থাকতে দেয়া হত না। এতে স্যারদের হত বিপদ, ঘর
গোছাবেন না কলেজের বেঞ্চে দড়ি বাঁধবেন!!
আমার যেটা হত- সিগন্যাল দিলেই ঘরে
হুলুস্থুল জুড়ে দিতাম, আমি আর এখানে থাকব না। গৃহকর্তাকে গঞ্জনা দিতাম, এখানে কি
মধু পেয়েছ, এবারই শেষ, এরপর শহরে বাসা দেখবে। তিনি ঠান্ডা মাথায় দুই মেয়ে আর কাজের
মেয়েটাকে নিয়ে সব গোছাতেন, উঁচু তাকে তুলতেন।
একবারতো নাসির ভাইয়ের ছোটভাই আমাদের
ছাত্র রফিককে এবং আরো কাকে যেন নিয়ে দড়ি বেঁধে ফ্রিজ ছাদে তুলে রাখলেন। তারপর তারা যখন
এসব করত আমি টেনশানে (!) দিব্বি একটা ঘুম দিতাম। অবশেষে সব শেষ হলে মেজ
ভাইয়ের বাসায় শহরে চলে যেতাম। তারপর ফিরে এসে আনার বোঁচকা-বুঁচকি খোল, ফ্রিজ
নামাও।
এত কিছুর পরও বারকোয়ার্টারের জীবনটা
আনন্দময় ছিল। আমরা যারা ছিলাম তারা ভাই-বোনের মত একসাথে জীবন কাটিয়েছি এবং এখনও
সেই সৌহার্দ্য সম্প্রীতি রয়ে গেছে।
জলোচ্ছ্বাসের আগে ঘাঁটিতে এবং বারো কোয়ার্টারে
প্রচুর জোঁক ছিল। একেকটা জোঁক রক্ত খেয়ে ছোট থেকে ফুলে বড় হত। একেকটা ছিনেজোঁক
প্রায় সুতোর মত লক লক করে জিভ বাড়াত। আমি সাপকেও বোধহয় এত ভয় পাই না (অবশ্য সাপের
সামনে পড়ে পরীক্ষা দিলে বোঝা যেত!) কিন্তু ছিনে জোঁক দেখলেই- পরিবেশ, পরিস্থিতি
ভুলে ত্রাহি চিৎকার। বিশেষত বর্ষায় হঠাৎ দেখা যেত মেঝে-দেয়ালে ওরা বাইছে। আরো ছিল
কেন্নো। যাকে আমরা রেলগাড়ি বলি। রাতে শুতে যাবার আগে মশারী কয়েকবার চেক করতাম এসব
পোকা মাকড়ের ভয়ে।
ছোট্ট সরীসৃপ যাদের আমরা আঁচিলা বলি
সেগুলো এবং অসংখ্য গোসাপ যত্রতত্র ঘুরে বেড়াত। সুযোগ পেলে উঠোন পেরিয়ে ঘরে চলে আসত
আবার কলেজে ক্লাসরুমে ঢুকে পড়ত। তারপর ছাত্র-ছাত্রীদের হৈ হৈ রৈ রৈ চিৎকারে
হতবিহ্বল হয়ে ওরা কোন দিকে যাবে বুঝতে পারত না। শেষে পিয়নরা এসে কোনভাবে বের করত।
সাপও ছিল প্রচুর। ঘাস জঙ্গলে লুকিয়ে থাকত। জলোচ্ছ্বাসের পর জোঁক একেবারেই কমে গিয়েছিল।
সমুদ্রের নোনাজলের কারণে কিনা জানি না।
আর সবার ঘরের আশেপাশে জেগে উঠেছিল
অসংখ্য পেঁপে চারা। এগুলো কোথা থেকে পানিতে ভেসে এসেছিল জানি না। পরবর্তীতে এই বীজ
থেকে জন্মানো চারার পেঁপে ছিল অত্যন্ত সুস্বাদু এবং ধরতও প্রচুর।
১৯৯৪তে আমার বড় মেয়ে রাকা এসএসসি পাশ
করার পর সে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয় এবং শহরের পাঁচলাইশ এলাকায় বাসা নিয়ে আমরা
চলে আসি।
কিন্তু আজও সবাই মিলে
গল্প করা, হুসনা আপা এবং আমার অনেক রাত পর্যন্ত রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে গল্প করা,
সামনে দিয়ে নির্ভয়ে শেয়াল পার হওয়া, একসাথে স্যাররাসহ সবাই মিলে মধ্যরাতে বিশ্বকাপ
ফুটবল দেখা ইত্যাদি কত স্মৃতি, মধুর স্মৃতি মনের জানালায় উঁকি দিয়ে যায়। এমনকি
ঘরের অভাবে সংসারের নানা দরকারী কথা বা সমস্যা স্বামী-স্ত্রী রাস্তায় গিয়ে আলাপ
করা। তবুও সবকিছুতেই সবাইকে নিয়ে আমরা সুখী ছিলাম।
No comments:
Post a Comment