৬
ক্রীড়া প্রতিযোগিতা
বার্ষিক ক্রীড়া
প্রতিযোগিতাও জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যেই শেষ করা হত। চারটি হাউজে ভাগ করেই
প্রতিযোগিতা হত। প্রথমে হাউজ ভাগ, তারপর হিট এবং সবশেষে ফাইনাল। ফাইনাল দুদিন হত।
প্রথমদিন ঘাঁটির সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার উদ্বোধন করতেন আর সমাপনীতে ঘাঁটি অধিনায়ক
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন।
আশির দশকে কলেজে শরীরচর্চা শিক্ষক ছিল না।
পরে কামরুজ্জামানকে নেয়া হল। কিন্তু খেলা পুরো পরিচালনা দায়িত্বে থাকত ঘাঁটির Physical Instructorরা। অতিথিদের প্যারেড
প্রদর্শনের জন্য এবং তা যতটা পারা যায় নিঁখুত করার জন্য এসব প্রশিক্ষণে ঘাম ঝরানো
শ্রম দিতেন।
কামরুজ্জামান চলে যাওয়ার পর এল শংকর
মন্ডল। ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে আরো শিক্ষকের প্রয়োজন দেখা দিলে এল মিতা
দাশ। এসব যদিও অনেক পরের কথা। তবু স্মৃতি কোনটা ঠেলে কোনটা উপরে উঠে আসে বুঝতে
পারি না। মিতাও চট্টগ্রাম বেতার এবং টিভির শিল্পী এটাও আমাদের জন্য একটা প্লাস
পয়েন্ট। আবার ছাত্রীদের ডিসপ্লে বা মনোরম শরীরচর্চা প্রদর্শনে তার অধ্যবসায় ছিল
অনেক বেশি। এর ফলে প্রতি বছরের শরীরচর্চা প্রদর্শনী আগের বছরের চেয়ে সুন্দর হত।
আমিও তাল মিলিয়ে চেষ্টা করতাম ধারা বিবরণী দিতে।
মিতাকে সহযোগিতা করত ড্রইং টিচার
সামিনা, কম্পিউটার টিচার আয়েশা সামী। হাউজ ভিত্তিতে স্যার-ম্যাডামদেরও ভাগ করা হত।
প্রত্যেক ছেলেদের জন্য একজন ও মেয়েদের জন্য একজন করে হাউজ মাস্টার নির্বাচন করা
হত। তাদের নেতৃত্বে অন্যান্য শিক্ষকরা হাউজের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে কাজ করতেন।
সাংস্কৃতিক এবং ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সময় শিক্ষকদের মাঝেও হাউজ নিয়ে দ্বন্দ্ব চরমে
উঠত। সবাই চাইত বেশি পয়েন্ট পেয়ে তার হাউজ চ্যাম্পিয়ন হোক। এজন্য বিচারকদেরও মাঝে
মাঝে স্বজনপ্রীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হত। বিশেষত সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায়।
অন্যদিকে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চলত
কারচুপি। এক হাউজের ছেলে বা মেয়েকে ফুসলিয়ে শিক্ষকরা নিজের হাউজে নিয়ে আসতেন।
তারপর যখন ধরা পড়ত তখন প্রচন্ড বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে যেত। এ সময় হাউজ শিক্ষকদের
বেশিরভাগ এত বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়তেন ভুলেই যেতেন এটা তাদের খেলা নয়, শিশুদের
প্রতিযোগিতা। ঝগড়া, মান-অভিমান বেশ কিছুদিন কমনরুমের পরিবেশ গরম করে রাখত। তারপর
সময়ের প্রলেপে আমরা ভুলে যেতাম পুরনো মান-অভিমান। ফেব্রুয়ারীর শেষ থেকে শুরু হত
পূর্ণোদ্যমে পড়াশোনা।
কলেজের
অনুষ্ঠানে
বিমান বাহিনীর
অভ্যন্তরে হওয়ার কারণে প্রত্যেকটি বিষয় হত একদম সুচারুভাবে। দস্তুরমত মুখস্থ রাখতে
হত কোনটার পর কোনটা হবে। প্রধান অতিথি আসার আগেই প্যারেড কমান্ডারের নির্দেশে
স্টুডেন্টরা রোদের তেজ উপেক্ষা করে ‘নট নড়ন চড়ন’ হয়ে
দাঁড়িয়ে থাকত। দূরে ফ্যালকন ভবনের বিউগল বাজানোর জন্য ছাদে দাঁড়িয়ে থাকত বাদকদল।
বিউগলে সুর উঠলেই সবাই বুঝতে পারত প্রধান অতিথি আসছেন। তাঁর আগে জুনিয়র অফিসাররা
এসে যেতেন। বিমানসেনা এবং অভিভাবকবৃন্দও মাঠের দুপাশের তাঁবুতে অতিথি মঞ্চের পাশেই
ঘোষণামঞ্চ, উল্টো দিকে চারটি হাউজের তাঁবু,হাউজ পতাকা, অলিম্পিক পতাকা আর একপাশে
প্রজ্জ্বলিত মশালের ঘেরা দেওয়া জায়গা।
অনেক আগে ষোলকোয়ার্টার মাঠে এই
প্রতিযোগিতা হত। সেখানে খালপাড় দিয়ে ঢেলা-মাটি ভেঙে আসা-যাওয়া করতে অসুবিধা যেমন
হত তেমনি সময়ও লাগত। শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারী সবারই এতে কষ্ট হত। পরে রিক্রুট
ট্রেনিং স্কুল মাঠে যখন খেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত হল তখন অনেক সুবিধা হয়েছিল।
এখনও সেখানে হয়। তবে পুরনো ভবনে থাকতে আসা যাওয়ার কষ্ট হত। বিশেষ করে শিক্ষিকাদের
গায়ের রঙ পুড়ে তামাটে হয়ে যেত। এই রোদে পোড়ার ছাপ মুছে যেতে অনেকদিন লাগত।
কলেজের
অনুষ্ঠানে আমরা একই ধরনের শাড়ী পরতাম
কেন জানি না ক্রীড়া
প্রতিযোগিতার সময় প্রায় বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিত। আর কিছু না হোক গুঁড়ি
গুঁড়ি বৃষ্টি হলেও কিছুটা হত। অথবা প্রচন্ড কুয়াশা। কিন্তু খেলার দিন সব দুর্যোগ
কেটে আকাশে সূর্য উঁকি দিত।
মাঠের দক্ষিণ প্রান্ত
খোলা থাকলেও উত্তর প্রান্তে আকাশছোয়া ঝাউগাছের সারি আর উর্ধ্বে নীলাকাশ মিলে
প্রকৃতির যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হত তা দেখে আমার কেবলই কক্সবাজারের ঝাউবনের কথা মনে
পড়ত।
আমরা যখন জয়েন করেছিলাম
তখন প্রতিযোগিতার সময় খেলার মাঠে বাচ্চাদের জন্য নুন, আদা, লেবু আর পানি দেয়া হত।
কয়েকজন আয়া-পিয়নকে এ দায়িত্ব দেয়া হত। আর শেষ তিনদিনের জন্য হাউজমাস্টারদেরকে
প্রত্যেক হাউজের জন্য বেশ কয়েক প্যাকেট করে লজেন্স দেয়া হত।
খেলার সময় শিক্ষকদের
চা-সিঙ্গারা টিফিন দেয়া হত এবং মূল অনুষ্ঠানের দুদিন দুপুরে খাবার দেয়া হত।
সারাদিন থাকতে হত বলে এই ব্যবস্থা ছিল। খেলা শেষে শিক্ষকদেরও একটা করে বাটি বা
প্লেট দেয়া হত। এটা খেলার দু-একদিন পর অধ্যক্ষ তাঁর কক্ষে শিক্ষকদের একসাথে ডেকে
একে একে দিতেন।
নব্বইয়ের দশকে
এ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে এমন একজন অফিসার এলেন যিনি বাজেট কাটতে কাটতে, ছাঁটতে ছাঁটতে
এমন করলেন যে আদা-লেবু-লবণও বাদ দিলেন শুধু পানিটুকু ছাড়া। লজেন্সের প্যাকেট কমে
গেল। স্কোঃ লীঃ সাহেব বোধহয় মনে করতেন এসব শিক্ষকরাই খায়। শিক্ষকদের খাওয়ার বাজেট
আগে দুদিনের জন্য একশো টাকা ধার্য ছিল সেটা কাটতে কাটতে পরবর্তীতে ত্রিশ টাকায় নিয়ে
এলেন। ভদ্রলোক কোন কৃপণের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন জানি না। অথবা শিক্ষকদের প্রতি কোন
কারণে তিনি রুষ্ট ছিলেন নাকি তাদের দ্বিপদী প্রাণী ছাড়া মানুষ ভাবতেন না সেজন্য
এরকম ব্যবস্থা করেছিলেন। অথচ খুব সাধারণ স্কুল কলেজে শিক্ষকদের খেলার মাঠে
পরিশ্রমের জন্য ভাল খাবারের পাশাপাশি ভাল গিফট দেয়া হত।
আমি যখন কলেজ ছেড়ে আসি তখন বাজেট সম্ভবত
মাথাপিছু ত্রিশ টাকা করা হয়েছিল। খেতে ইচ্ছে করত না। তবু খেতে হত। আমাদের সহকর্মী
আয়া পিয়নদের জন্যেও মায়া লাগত। এ দুদিন অন্তত তারাও একটু ভাল খাবার পেতে পারত। তবে
এ ব্যাপারে ঘুরে ঘুরে যার কাঁধে এসে দায়িত্ব পড়ত সে যে এত সুন্দরভাবে ম্যানেজ করত
আমি অবাক হয়ে যেতাম। ঐ ত্রিশ টাকায় একদিন মুরগি, সবজি, ডাল; আরেকদিন সে পোলাও-মাংসের ব্যবস্থা করত। এই
শিক্ষকের নাম নাসরীন বানু। কলেজের এসব দায়িত্বে শিক্ষকদের সহযোগিতা করত একসময়ের
টাইপিস্ট কাম ক্লার্ক গাউছ ভাই। মাঠে সহযোগিতা করত এরকম কয়েকজন পিটি ইন্সট্রাকটারও
আমাদের সাথে ভোজসভায় যোগ দিতেন।
এরকম কিছু সংকীর্ণমনা অফিসারদের
কর্মকান্ড দেখে মনে হত এদের ব্যাকগ্রাউন্ড কি? শিক্ষকদের কি এরা ব্লাডি সিভিলিয়ানই
ভাবে! দু-একজন ঘাঁটি অধিনায়ক ছিলেন যাঁরা অবশ্য খেলার শেষ দিন শিক্ষকদের নিয়ে টি-পার্টি
করতেন। যেমন গ্রুপক্যাপ্টেন শমসের আলী (দুঃখিত এই মুহূর্তে নাম মনে করতে পারছি
না।) শমসের আলী স্যার একবার এসএসসির ভাল ফলাফলের পর শিক্ষকদের জন্য টি-পার্টির
আয়োজন করেছিলেন। যদিও এসব ব্যয় স্বাভাবিক ভাবে কলেজ ফান্ড থেকেই করা হত।
ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আকর্ষণীয় একটি বিষয়
ছিল ‘যেমন খুশি
সাজো’। শেষদিন বিকেলে
প্রধান অতিথি এবং অতিথিবৃন্দের সামনে সেজে তারা আসত। অতিথিরা এই প্রতিযোগিতার
বিচারক ছিলেন। এতে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া যেত। সৈয়দা
সামসুন নাহার ম্যাডামের ছেলে সেই ছোট্টবেলায় বাঁদর সেজে সবাইকে তাক লাগিয়ে
দিয়েছিল। একজন ডুগডুগি বাজাচ্ছিল আর সে এমনভাবে নাচছিল যেন সত্যি সত্যি বানর।
No comments:
Post a Comment