Saturday, 8 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - অসূয়া



__________________________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪

গল্প - অসূয়া
__________________________________________

অসূয়া

 

স্টেশনে লোক গিজ গিজ করছে সকাল বেলার এই সময়টাতে একসঙ্গে কয়েকটি আপ এবং ডাউন ট্রেনের যাত্রী এ স্টেশনে উঠানামা করে ফলে  উচ্চশ্রেণির যাত্রীর পাশাপাশি শ্রেণিহীন ছিন্নমুল মানুষ একসঙ্গে ছুটোছুটি করে এতে ভদ্রলোকেরা বিরক্তিতে নাক কুঁচকালেও শ্রেণিহীন মানুগুলো পরোয়া করেনা গন্তব্যে যাওয়ার উদ্দেশে এরা কেবল উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ায়। এমনকি দিয়ে কাউকে ফেলে দিলেও ফিরে তাকায় না

          আজ সকালে  প্রায় সবকটি ট্রেনই লেট মে মাসের মাঝামাঝির সুর্য চারদিকে গনগনে রোদ ঢালছে সকাল আটটা বেজেছে কি বাজেনি কিন্তু রোদের তাপে মনে হছে ভর দুপুর সুর্যটা তির্যক ভাবে প্লাটফরমে রোদ ঢালছে কোথাও ছায়া নেই এরি মাঝে একটা থামের আড়ালে বসে আছে শাবানী আর তার মা আলেখা বানু।

           শাবানীর গায়ে কালো বোরকা, কোলে চৌদ্দদিনের শিশুশিশুটি কন্যাগরমের তাপে শিশুটি কাঁদছে, কিন্তু তার কান্নার শব্দ এত ক্ষীণ যে হট্টগোলকারী জনতার শব্দ ছাপিয়ে সেই শব্দ তার মায়ের কানেও যাচ্ছে কিনা সন্দেহ

          আলেখা বানু নিজের বোরখা খুলে কাপড়ে আঁচল দিয়ে কন্যা এবং নাতনিকে রোদ থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন

          বাচ্চাটা যে কাঁদছে শাবানীর সে দিকেও খেয়াল নেই এমনভাবে বসে আছে যেন কোলের মেয়েটি তার নয়

          আলেখা বানু ডাক দিলেন - "শাবানী, অ শাবানী, মাইয়াডারে একটু শক্ত কইরা ধর অর খিদা লাগছে, একটু বুকে নে দ্যাখ একটু দুধ পায় কিনা।"

          শাবানী একটু নড়ে চড়ে বাচ্চাটার দিকে তাকায় তারপর আনাড়ী হাতে বোরকার বোতাম খুলে মেয়েকে বুকে নেওয়ার চেষ্টা করে আলেখা বানু হাত বাড়িয়ে বোরকাটা সরিয়ে মেয়েকে সাহায্য করেন বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে

          প্রথম বাচ্চার মা এমনিতে আনাড়ী, তারপর বাচ্চা হওয়ার পর থেকে মায়ের পেটেও কি একবেলা ভাত ভাল করে পড়েছে যে দুধ আসবে পেট থেকে পড়ার পর থেকে দিন দিন তাই চিমসে হয়ে যাচ্ছে বাচ্চাটাহয়তো মরেই যাবে - কথাটা মনে আসতেই মনে মনে তওবা কাটেন আলেখা বানু          আল্লাহ, আল্লা মরবো ক্যান। মাফ কইরো আল্লাহ কত আদরের মেয়ে তার শাবানী কতই বা বয়স হইছে মাইয়ার পনেরয় পা দিতে না দিতেই তো বিয়া অইলো আর এখন ষোল বছর সাত মাস ওরেইতো এখনো দুধের শিশু মনে হয় 

          একথা ভাবতেই চকিত স্মৃতি উঁকি মেরে যায় মনেমনে হয় এই সেইদিন বিয়ের পর শাবানীর বাপের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল ভৈরবের সেই সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে দেখতেই নতুন বৌয়ের কানে কানে রহমত মিয়া বলেছিল, "সিনেমার এই সুন্দর মাইয়াটার নাম কি জান?"

          "কী?" - অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল আলেখা

          "শাবানা, শাবানা এরে কয় নায়িকা আমাগো একটা মাইয়া হইলে নাম রাখুম শাবানা।"

          "যাহ!"  বলে একটা মৃদু ধাক্কা দিয়েছিল স্বামীর গায়ে

          আর যখন মেয়েটা হল তখন রহমত মিয়া সত্যি সত্যি নাম রাখলো শাবানা কিন্তু পাড়ার মানুষের মুখে মুখে হয়ে গেল শাবানীতবে এটা ঠিক মেয়েটা হয়েছিলো কিন্তু খুব ফুটফুটে

          "মা, ও মা কী এত ভাবো? মাইয়াডারে একটু ধর আমি আর পারি না পানির পিপাসায় আমার ছাতি ফাইটা যাইতাছে আমি পানি খামু।"

          "পানি?" - অসহায় চোখে আশেপাশে তাকালেন আলেখা বানু          
            "
পানি কই পাবি এইখানে তো কোন কল নাই।"

          "ওই যে বোতলে পানি বেচতাছে দ্যাখনা ঠান্ডা পানি মাগো আমারে একটু ঠান্ডা পানি খাওয়াও না, আমার কইলজাটা যে ফাইটা গেল গো মা।"

          অনেক দরাদরি করে এক বোতল পানি কিনলো মা-মেয়ে এক বোতল পানি দুই গ্লাসও হবে না বলে দশ টাকা!! কি আজব কথা পানির এত দাম! আঁচলের খুটে বাঁধা আশিটি টাকা থেকে দশটি টাকা খরচ করতে বুকটা ভেঙ্গে যেতে চায় যায় তার মেয়ের বাচ্চা হওয়ার খবর পেয়ে এক প্রতিবেশির কাছ থেকে তিনশটি টাকা ধার করে ঢাকা এসেছিল

          পানিটা খেয়ে যেন শাবানীর শরীরে একটু প্রা আসেসেই সকালে না খেয়েই পথে বের হয়েছে মা-মেয়ে পথে বের হয়েছে না বলে বলা উচিত - বের করে দিয়েছে

          শাবানীর বুক টা হু হু করে উঠে চলে আসার সময়ও একবার উঠলো না লোকটা কাল সারারাত কত কেঁদেছে, কত হাত পা ধরেছে "আমারে বিদায় দিওনা আব্বায় মইরা গেছে মায়ে কত কষ্ট কইরা চলেআমারে কে দেখবো? কে খাওয়াইব?"

          কিন্তু লোকটা যেন পাথর একবার খালি কইল - "তুই মাইয়া হওয়াইলি ক্যান?"

          শাবানীর পর পর আরো চারটা ভাই বোন হয়ে একটাও বাঁচেনি। এজন্য শাবানী ছিল বাবা মায়ের চোখের মণি বাপ মান্‌ষের ক্ষেতে মুনিষ খাটলেও শাবানীর কখনও ভাত পানির কষ্ট হয়নি। বরং মেলা থেকে চুড়িটা ক্লিপটা, মাটির পুতুল্টা বাবা ঠিকই কিনে এনে দিত সেই বাপই সুখের আশায় শাবানীকে বিয়ে দিলো ঢাকা শহরে থাকা ছেলের সাথে

          ঘটক মজু যখন সম্বন্ধ এনেছিল তখন বলেছিল, ছেলে শহরের কারখানায় কাজ করে একটাই ছেলে বাপ মায়ের বোন ছিল দুটো, সেগুলোর বিয়ে হয়ে গেছে, ঢাকায় থাকে

          বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন ধার দেনা করে জামাইকে ঘড়ি, আংটি আর দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন মেয়ের সুখ হবে, ঢাকা শহরে থাকবে এই ছিল তার স্বপ্ন

          হায়রে, বিয়ের দুই সপ্তাহ পর ঢাকায় এসে শাবানীর কলজেটা চুরমার হয়ে গেল যেখানে এসে উঠলো সেটাকে নাকি বলে বস্তিএকটা ঘরের মধ্যে কাপড় দিয়ে পরদা টেনে একপাশে শ্বশুর শাশুড়ী আর একপাশে ছেলে বউ পায়খানা কলঘর এমনকি চুলাটাও আরো দশ ঘরের সাথে ভাগাভাগি করতে হয়

          প্রথম প্রথম স্বামীর সাথে ঘুমাতে গেলে লজ্জায় মরে যেত শাবানী স্বামীকে বলত – "আমার শরম করে ওনাগো লগে এক ঘরে শুইতে আরেকটা ঘর লও নাঅন্তত মাইঝখানে এক্খান বেড়া দেওয়া।"

          "হ, ঢাকা শহরে ঘর এত সস্তা। তুই জানস এখানে থাইকবার গেলে কত ভাড়া দিতে অয়? চুপ যা থাইকবার পারলে থাক নইলে চুপ যা।"

          শাশুড়ী বাসাবাড়িতে কাজ করে আর শ্বশুর রিকশা চালায় রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া সব কাজ শাবানীকে একা করতে হয় এবং অবাক হয়ে দেখে তার স্বামী আসলে কিছুই করে না বস্তির মুখে বসে সারাদিন অন্য মানুষের সাথে জুয়া খেলে সুযোগ পেলেই মা বাপের পয়সা চুরি করে

          এই চুরি নিয়ে মা–ছেলে আর বাপ মিলে এক একদিন এমন ঝগড়া শুরু হত যে শাবানীর মনে হত আজকে বোধহয় একজন খুন হয়ে যাবে তারপর আবার যেই কে সেইবাপ-মা কাজে গেলে খেয়েদেয়ে তার মত বের হয়ে যেত

          একদিন শাবানী বলেওছিলো – "তুমি কাম করনা ক্যন? ওনারা না বুড়া অইছে ওনাগো খাওয়ানোর কাম তো এখন তোমার।"

          শুনে ধেয়ে এসেছিল লোকটা শাসিয়ে বলেছিলো "আর কোনদিন এমুন কতা কইবি তো তরে লাত্থি মাইরা বাইর কইরা দিমুকী আমার দরদী আইছে, যা যা।"

          "অ শাবানী তর মাইয়া কান্দে তো এমুন আলগা কইরা রাখছস ক্যান? একটু জড়াইমড়াই ল।"

          তাড়াতাড়ি মেয়েকে বুকে নেয় শাবানী আশ্চর্য, জন্মের পর থেকে কত কষ্টে যে মাইয়াডা বাঁইচা আছে শুকিয়ে যাওয়া দুই চোখ থেকে দু'ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে তারপ্রচন্ড গরমে, মানুষের থিকথিকে ভিড়ে বাচ্চাটা তবুও চিঁ চিঁ করে কাঁদতে থাকে

          "মা ওর গলা শুকাইয়া গেছে লাগে যেমন এট্টু পানি দিবা মুখে?"

          "কী কস এত ছোট মানুষেরে কি পানি খাওয়ান যায়?"

          "দাও না মা।"

          বোতলের অবশিষ্ট পানিটুকু ঢাকনাতে নিয়ে আস্তে আস্তে শিশুটির হা করা মুখে ঢালতে থাকে আলেখা বেগম

          আহারে মায়ের বুকে দুধ নাই আসলেই তো গলা শুকাইয়া কাঠবুভুক্ষু শিশুটি পানির ফোটাগুলো চেটে চেটে খেতে থাকে আর মা-মেয়ে সব কষ্ট ভুলে তা চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে

          "আরে খালা, তোমরা এইখানে কোত্থেকে?"

          মা-মেয়ে একসঙ্গে চোখ তুলে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো

          "দুলাল! তুমি কোত্থেইকা আইলা?"

          "আমি তো ঢাকায় থাকি মই এখানে গারমেন্টে চাকরি করি শাবানী তোমারে এমুন লাগতাছে কেন?"

          শাবানীর ভালো লাগে না দুলালের দরদ মাখা কথা সে তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে দেয়

          "অ খালা দ্যাহ দ্যাহ, শাবানী আমারে দেইখা ঘোমটা টানে তা কোলে কি ছাওয়াল না মাইয়া?"

          "মাইয়া" - আলেখা বানু বলে "তা তুমি কই যাও বাপ? বারিত যাইবা?"

          "হ খালা বারিত যামু।"

          কথা বলতে বলতে দুলাল ওদের পাশে বসে পড়ে কাঁধের ব্যাগ আর হাতে ঝোলানো লাল বস্তুটি পাশে রাখে

          সব ভুলে গিয়ে আলেখা বানু বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করেন, "লাল মত ওইডা কী বাপ?"

          পাতলা সাদা নেটে বাধা জিনিসটার দিকে তাকিয়ে হাসি ফুটে উঠল দুলালের মুখে

          "এইডা পটি।"

          "পটি? পটি কী?" –আলেখা বেগম জানতে চায়।

          সঙ্গে সঙ্গে উৎকর্ণ হয় শাবানীও

          "পটি হইল গিয়া বাচ্চাগো পায়খানা ছোড বাচ্চারা এইখানে বইস্যা পাইখানা করলে স্বাস্থ্যের জন্যও নাকি ভাল শহরের বড়লোকেরা তাগো ছাওয়াল-পাওয়ালের জন্য ব্যাভার করেতো এখন প্যালাস্টিকের বাইর হইছে। তাই তোমার নাতির লাইগ্যা একটা কিন্যা ইলাম।"

          ", তোমার ছাওয়াল হইছে!" - শাবানী এতক্ষ পরে একটা কথা বলে

          "হ পাঁচমাসে পড়ছে।"

          ""  বলে চুপ করে যায় শাবানী

          তার মনের ভিতর জমে থাকা কান্না বুক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়েকে বুকে নিয়ে পাষাণ প্রতিমার মত বসে থাকে

          আলেখা বানু লাল পাটিটার দিকে বার বার তাকায়।

          আহারে কপাল ভাগ্যের ফেরনাইলে আজকে এই পটি শাবানীর ছেলের হতে পারত দুলাল হতে পারত তার ঘর আলো করা জামাই তার মনে পড়ে ননদের ভাগ্নে দুলাল ছোটবেলা থেকেই তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসত মামির সাথে

          তারপর একটু বড় হতে আরো বেশি আসত এবং সেটা যে শাবানীর টানে বুঝতে বাকি ছিলনা কারও ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ে ছেলেটা যাত্রাদলে ঢুকল তার শখ যাত্রাপালা করবে, নায়ক হবে বাঁশি বাজাতো গানের গলাও ছিল ভাল একবার দু'বার তাদের গাঁয়েও পার্ট করতে এসেছিল। তারপর যখন শাবানীকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো তখন রহমত মিয়া সাথে সাথে ফিরিয়ে দিল

          রাগ করে বলেছিল - "কাম কাইজ নাই, যাত্রা কইরা গেরামে গেরামে ঘুরব আর আমার মাইয়া খালি বইয়া বইয়া কাঁদবোআমি বিয়া দিমু না।"

          মেয়েরও পছন্দ ছিল দুলালকে কিন্তু বাপের ভয়ে রা করেনি

          "খালা চল চা খাইঘোষণা দিছে গাড়ি লেইটে আইব।"

          "নারে বাপ আমি চা খাইনা, বমি বমি লাগে।"

          "তাইলে ঠান্ডা খাও ডিরিংস আছে কিছু খাও শাবানী ছোট মানুষ অর তো কষ্ট হইতাছে। আবার কোলে ছোট মাইয়া এ সময় না খাইয়া কতক্ষ থাকবার পারে?"

          দুলালের কথা শুনে শাবানীর ইচ্ছা করে কোন খোলা প্রান্তরে গিয়ে বিলাপ করে কাঁদে হায়, যার মেয়ে তার যদি সামান্য মায়াও থাকত বাচ্চাটার জন্য

          তবু সে শক্ত হয়ে থাকে তার মনে হয় দুলালের সাথে আজ তাদের দেখা না হলেই ভাল ছিল এমন দুঃখের দিনে দুলালের সুখ দেখে তার ভিতরটা ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে যে একদিন তাকে চেয়েছিল আজ তার সামনে দুর্দশাগ্রস্ত শাবানীর মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছেতবুও মাথা তুলে প্রশ্ন করে "তুমি এখন যাত্রা কর না দুলাল ভাই?"

          "নাহ্‌, এইসব কবেই ছাইরা দিছি।"

          "ক্যান ছারলা ক্যান? তুমি না নায়ক হইবার স্বপন দেখতা? যাত্রা দলের নায়ক?"

          দুলাল অবাক হয়ে দ্যাখে—এত দুর্বল শরীরের মেয়েটার কথা এত শক্ত শোনাচ্ছে কেন? সে কি তবে পুরনো কথা ভোলেনি? এখনো মনে রেখেছে দুলালকে?

          "হ শাবানী। স্বপ্ন আর জীবন কি এক? আব্বায় মারা গ্যালে সংসারের ভার পড়ল। আমি বড় ছাওয়াল। গেরামের কাম শিখি নাই। যাত্রা কইরা বেড়াইছি। তাই শহরে আইসা গারমেন্টে কাম নিলাম।"

          "হ, তয় আগে নিলা না ক্যান?"

          দুলাল অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। এ কী প্রশ্ন শাবানীর? আর কথার মধ্যে কেমন রাগ ঝরে পড়ছে।

          "আইচ্ছা, পুরানা কতা লইয়া প্যাচাল পাইড়া লাভ নাই। বও দুলাল বও।" - আলেখা বানু বলে ওঠে।

          দুলাল ম্লান হাসে। সে তো জানতো না যে শাবানীও তাকে চাইত। তাহলে তো সেদিন সব বাধা ডিঙিয়ে শাবানীকে ঘরে তুলত।

          ভীষণ মায়া হল দুলালের। আজকের এই শাবানীর সঙ্গে সেই কিশোরীর মিল কোথায়? এ তো একটা নারী কঙ্কাল। তবু বুকের মধ্যে এই শাবানীর জন্য গভীর মমতা বোধ করে।

          "মা, চল" বলেই হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় শাবানী। আর দাঁড়াতে গিয়ে তার পা-দুটো টলে যায়। মা তাড়াতাড়ি ধরে ফেলে। বাচ্চাটা ঘুমে না জাগরণে কঁকিয়ে ওঠে।

          "কই যাবি? এহনতো গাড়ি আহে নাই।"

          ধপ করে আবার বসে পড়ে শাবানী।

          ওদের অবস্থা দেখে বিচলিত হয় দুলাল। বলে - "তোমরা ঠান্ডা কিছু খাও। আমি নিয়া আসি।"

          "না, খামু না। আমাগো কিছু খাওয়ানো লাগবো না।"

          দুলাল অবাক হয়। কথা বলতে গিয়ে শাবানীর দু'চোখে যেন আগুন ঝরছে।

          "আমার কতা হুন। আমি এক দৌড়ে যামু আর আমু।" - বলতে বলতে স্টেশনের খাবারের দোকানের দিকে হন হন করে হাঁটতে থাকে দুলাল।

          "মা ওড"

          "ক্যান? দুলাল আইব ত।"

          "না, আওন লাগবো না। তুমি থাক। আমি এখানে আর একদন্ডও থাকুম না। দরদ দেখাইতে আইছে, দরদ!" - বিদ্রুপ ঝরে পড়ে শাবানীর কন্ঠে।

          মেয়ে হাঁটতে শুরু করেছে দেখে আলেখা বানুও উঠে দাঁড়ায়। মেয়েকে মায়ের কোলে দেয় শাবানী। তারপর বলে - "চল"

          "কোন্‌ দিকে যামু?" - আলেখা বানু জানতে চায়।

          "উই যে উই দিকে যেখানে মানুষ থিক থিক করতাছে, সেই দিকে চল।"

          "দুলালের ব্যাগ, ছাওয়ালের পটি - এইগুলান তো চুরি হইয়া যাইব।"

          "হউক। অয়কি আমাগো চকিদার ঠাউরাইছে?"

          কিছুদূর হাঁটার পর থমকে দাঁড়ায় শাবানী। পিছন ফিরে তাকায়। তারপর মাকে দাঁড়াতে বলে ফিরে যায় আগের জায়গায়। একটু ভেবে পটিটা হাতে তুলে নেয়। তারপর শরীরের সব শক্তি দিয়ে পটিটা ছুঁড়ে দেয় প্লাটফরমের বাইরের ঝোপের ভিতর। তারপর বিড়বিড় করে বলে ওঠে - "সুখ, সুখ শুধু তোমার। আর যত দুখ শাবানীর। তাই সুখ দেখাইতে আইছ!"

          কান্না আসে চোখ ছাপিয়ে। বোরকার আড়ালে সে কান্না চেপে ভিড়ের মাঝে মিশে যায় শাবানী।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩১-৩২

----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ __________________________...

Popular Posts