_________________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - দহনের কাল।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭
গল্প - আদৃতা
__________________________________________
আদৃতা
রাত সাড়ে দশটায় কলিংবেল
বাজতেই চমকে উঠলাম আমি। এত রাতে কে এল! আইহোলে চোখ রাখতে মনে হল কোন বিদেশি
দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের এই এ্যাপার্টমেন্টে সিকিউরিটি ভাল তবে তারা হয়তো ফ্ল্যাট
নম্বর উল্টা পাল্টা করেছে। একটু দ্বিধা ধন্দে পড়েও দরজা খুলে দিলাম।
-আন্টি, আমাদের বাসা ফোরটিন সি।
আব্বু-আম্মু একটা বিয়ের দাওয়াতে গেছে তো আসতে দেরি হচ্ছে, আর আমার কাছে বাসার
ডুপ্লিকেট চাবিও নেই। আপনাদের বাসায় একটু বসতে পারব?
একটু বিব্রত হলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে কথা
বলছি। এতক্ষণে তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে ওকে পথ ছেড়ে দিলাম- এসো, এসো। সরি, কথা বলতে বলতে
একটুও খেয়াল করিনি।
মেয়েটি সোফায় বসল। নাম জানতে চাইলে
বলল-আদৃতা। মনে মনে বললাম, এমন মেয়ের নামতো আদৃতাই হবে। তাকিয়ে দেখলাম ফর্সা গায়ের
রঙ। অনেকটা বিদেশি ধাঁচের। একটু কটা চোখ আর ঈষৎ লালচে চুল। পরনে জিনসের প্যান্ট ও
ফতুয়া। পোশাকটাও এমনভাবে মানিয়ে গেছে যা ওকে শোভন সুন্দর করেছে।
গল্প করতে করতেই জানা গেল
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছে। ফ্রেন্ডের কাছে পড়া নোটস করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে।
-বাসায় কেউ নেই? জানতে
চাইল।
-আছে। সবাই খাওয়ার পর
ঘুমাতে গেছে।
-সরি, আমি আপনাকে ডিসর্টাব
করলাম আন্টি।
-আরে না না। কিসের ডিসটার্ব, আমিতো রাত
করে টিভি দেখি, বই পড়ি। আচ্ছা তুমি খেয়েছ?
কথা বলছি এতক্ষণ কিন্তু কিছু তো দেয়া হল
না। কিন্তু এত রাতে কি নাস্তা দেয়া যায় মনে মনে
ভাবলাম। তারপর মনে হল ফ্রিজেতো ভাত তরকারি আছে। সৌভাগ্যক্রমে আজকে বেশ ভাল
খাবারই আছে।
বললাম- ভাত খাবে?
কোন জড়তা ছাড়াই বলল, হ্যাঁ খেতে পারি।
আপনার যদি অসুবিধা না হয়।
আমি খাবার বের করে ওভেনে গরম করলাম।
টেবিল সাজিয়ে ওকে ডাকলাম।
-এত্তো খাবার আন্টি।
-ছিল তাই দিলাম। তোমার যেটা খেতে ভাল
লাগে, যতটুকু ভাললাগে নিজের ইচ্ছেমত খাও। আমি বেড়ে দিই না। যদিও এটা আমাদের
কালচার। মেহমানকে আপ্যায়ন করে পাতে তুলে দেওয়া। আবার এটাও বলে- খাবার আপনা রুচি-
আমি এটাই মানি।
হাতমুখ ধুয়ে আদৃতা খেতে বসলে খেতে খেতেই
টুকটাক গল্প হল। খাওয়া শেষে আমরা আবার বসার ঘরে এলাম। টিভিতে একটা রিয়েলিটি শো
চলছিল গানের। জি বাংলার সা রে গা মা পা।
-দ্যাখো, ওদের ছেলেমেয়েদের সুরের ওপর
কেমন দখল। এই জিনিসটার অভাবে আমাদের এখানকার বেশিরভাগ কমবয়সী শিল্পীদের গান কেমন
যেন বেসুরো লাগে।
-হ্যাঁ আন্টি।
-আর ব্যান্ডের গানতো বেশিরভাগ চিৎকার
ছাড়া আর কিছু নয়।
-জী আন্টি। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে
ব্যান্ডের প্রোগ্রাম হয়। তখন কানফাটানো চিৎকার, দমবন্ধ করা ড্রামের শব্দে অস্থির
লাগে। বন্ধুদের সাথে না গিয়েও পারি না।
তারপর একটু একটু করে আমাদের আলাপ জমে
ওঠে। আমি জানতে পারি ওর মাও পুরনো দিনের গান আর বাংলা ছায়াছবি দেখতে ভালবাসে। আমি
হাসতে হাসতে বললাম, এই ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সেও উত্তমকুমার আমাদের চিরদিনের নায়ক।
-জী আন্টি আম্মুও খুব দেখে। আমারও ভাল
লাগে। ফ্রি থাকলে আম্মুর সাথে আমিও দেখি।
-আচ্ছা! আমি বিস্ময় প্রকাশ করি। কিন্তু
এই প্রজন্মের শিশুরাতো বেশিরভাগই পুরনো ছবি, পুরনো গান রবীন্দ্র সংগীত এসবকে
বস্তাপচা মনে করে। তাদের কাছে এসবকে স্লো মনে হয়। অবশ্য যেসব পরিবারে বাঙালি
সংস্কৃতিচর্চা আছে তাদের কথা ভিন্ন।
-জী আন্টি।
সময় যায়। আমরা টুকটাক কথা বলি। রাত সাড়ে
বারোটার পর ওর মা-বাবা আসে। দরজা খুলে দিতেই হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমাকে ধন্যবাদ
জানান। আমিও সবিনয়ে জানাই- প্রতিবেশি হিসেবে এটাতো আমার কর্তব্য। আমি খুব খুশি
হয়েছি যে আমাকে আপন ভেবে ও আমার কাছে এসেছে।
আদৃতাও আবার দেখা হবে বলে হেসে চলে গেল।
বেশ কিছুদিন পর আদৃতা আবার এল।
দুপুরবেলা।
-আন্টি একটু ডিসটার্ব করলাম। আপনি বোধহয়
ঘুমাচ্ছিলেন।
-আরে না না। তাতে কি হয়েছে। তুমি কেমন
আছ বলো।
-ভাল। আন্টি একটা রিকোয়েস্ট করব।
-বলো।
-আন্টি, আমরা তিন-চারদিনের জন্য একটু
নানা বাড়ি যাব। আমাদের একটা এ্যাকুরিয়াম আর দুটো কচ্ছপ আছে। যদি আপনাদের বাসায়
একটু রেখে যাই।
কচ্ছপ মানে কাছিম! মনে মনে একটু ভড়কে
গেলাম। এই শহরের ফ্ল্যাটবাড়িতে আবার কচ্ছপও কেউ পোষে নাকি?
মুখে বললাম, আমিতো ওগুলোর যত্ন আত্তি
কিছু জানি না। যদি মরে টরে যায়!
-না না আন্টি আপনাকে কিছু করতে হবে না।
শুধু প্রতিদিন সকাল নটার দিকে একবার একটু খাবার দিতে হবে। আপনার বাসায় যে মেয়েটা
আছে ওকে একটু দেখিয়ে দিলে পারবে।
-তাহলে রেখে যাও।
আদৃতা আর ওর ভাই ভাবি এ্যাকুরিয়ামটা
ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এল। আমি বসার ঘরের আসন সরিয়ে জায়গা করে দিলাম। এ্যাকুরিয়ামের
জন্য ইলেকট্রিসিটি লাগবে। আমি টেবিলল্যাম্পটা সরিয়ে সুইচবোর্ডটা ফ্রি করে দিলাম।
আদ্রিতার মা মাছের খাবারটা নিয়ে এলেন।
আমি ফাতেমাকে বললাম, বুঝে নে খাবারটা
কিভাবে কখন দিতে হবে।
আদৃতার মা খাবার বুঝিয়ে দিয়ে আমাকে
বললেন, আপা আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি।
-আরে না না। প্রতিবেশি হিসেবে এটুকু যদি
না করতে পারি আমরা আর মানুষ হলাম কেন।
আমার ছোট্ট নাতিটি মহাখুশি। মাছের
চাইতেও কচ্ছপে তার বেশি আগ্রহ। তার চারবছর বয়সে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় এ্যাকুরিয়াম
দেখলেও কচ্ছপতো দেখেনি।
অফিস ফেরত ছেলে ঘরে ঢুকেই নাক সিঁটকাল,
মা কিসের গন্ধ। ঘরে কিছু পচল নাকি? কেমন বোঁটকা গন্ধ।
পিছনে আসতে আসতে বৌমাও বলল, হ্যাঁ মা
কেমন যেন পচা গন্ধ। আজকে ময়লা নিতে আসেনি?
আমি তাদেরকে আঙুল তুলে দেখালাম ওই
দ্যাখো।
কচ্ছপ! এ্যাকুরিয়াম- দুজনেই বিস্মিত
কন্ঠে যুগপৎ উচ্চারণ করল।
ততক্ষণে নাতি ছুটে এসে পরম উৎসাহে
বাবা-মাকে বয়ান করতে শুরু করল ঘটনার।
তিনদিন ধরে সকাল-সন্ধ্যা কচ্ছপের গন্ধে
ছেলে- ছেলের বাবা সবার গঞ্জনা শুনতে হচ্ছে আমাকে। আমি নির্বিকার। প্রতিবেশির প্রতি
কর্তব্য বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। স্বার্থপরের মত শুধু নিজের জন্যই বাঁচব। তাছাড়া
সব ধর্মেইতো আছে- প্রতিবেশি সবচেয়ে আপনজন। এই সুযোগে একজন প্রতিবেশির সঙ্গে নৈকট্য
গড়ে উঠল। সেটাই বা কম পাওয়া কি।
ঢাকা শহরের হাইরাইজ বিল্ডিংগুলোর এমন
এ্যাপার্টমেন্টে আমরা অনেকে এক সঙ্গে আবার সকলেই একা। ইদানিংকালে আরেক ভীতি যুক্ত
হয়েছে। প্রতিবেশি কে কেমন না জেনে মেশাও যায় না। কে জঙ্গি কে চোরাকারবারী আগে থেকে
কিছুই জানার উপায় নেই। কার পাল্লায় পড়ে কোন বিপদ ঘটে সেটাও একটা আতঙ্ক। এই শহরে
সর্বত্রই এত বিপদের জাল পাতা যে কে কখন জেনে না জেনে শিকার হবে কেউ জানে না। তবু
প্রতিবেশি নিকটজন। আর এদের আইডেন্টেটিটি আছে। ভদ্রলোক একটি কর্পোরেট অফিসের বিগবস।
ফ্ল্যাটের মালিক। আমরা বরং উদ্বাস্তু। ভাড়াটে।
কচ্ছপ আর মাছ নিয়ে আনন্দে আছে আমার নাতি
আর ফাতেমা। নাতির খুব ইচ্ছে কচ্ছপ ধরে দেখার। আমি কাছে ঘেঁষতে দিইনা। দূর থেকে
দ্যাখো। কাছে যেওনা। শেষে আমানতে খেয়ানত করে বিশ্বস্ততা হারাব।
পঞ্চম দিনেও আদৃতারা ফিরে না এলে ফোন
করলাম। জানাল, আজ রাতেই ফিরবে।
পরদিন দুপুর নাগাদ ওরা এল। কচ্ছপ আর
এ্যাকুরিয়াম নিয়ে গেল। দিয়ে গেল এক প্যাকেট পোড়াবাড়ির প্রসিদ্ধ চমচম।
বহুদিন আর যোগাযোগ নেই। সবাই যে যার মতো
ব্যস্ত। আমারও শরীর ভাল নেই। বাতের ব্যথায় হাঁটতে পারিনা। ডাক্তারের চেম্বারে
ছোটাছুটি। সেদিন ফিরতে রাত হয়ে গেল। লিফটে উঠতে যাব দেখি আদৃতা ছুটিতে ছুটতে আসছে।
অপাঙ্গে আমাকে দেখেই ওর সুন্দর চুলগুলো দিয়ে মুখটা যেন কেমন করে ঢেকে দিল। কানে
হেডফোন। সম্ভবত গান শুনছে। আমি বার বার তাকালাম। লিফটে আরো দুজন আছে। তবুও ওকে দেখছি।
মনে হচ্ছে চোখাচোখি হলে ও আমার সাথে কথা বলবে।
কিন্তু না। একবারও চোখ তুলল না মেয়েটি।
লিফট খুলতেই হুড়মুড় করে নেমে গেল। পায়ের ব্যথা ভুলে আমি অবাক হয়ে ভাবছি- এ কোন
আদৃতা!
No comments:
Post a Comment