Tuesday, 18 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - পড়শী

 


______________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - দহনের কাল।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭

গল্প - পড়শী
______________________________________

পড়শী


কম্পাউন্ডের গেটের ছোট দরজাটা খুলতেই রান্নাঘরের জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালেন আফরোজা। চারতলার ফারহানা ভাবী ঢুকছে। তোয়ালেতে হাত মুছে তাড়াতাড়ি সিঁড়ির দরজা খুলে দাঁড়ালেন। খট খট শব্দে স্যান্ডেলের আওয়াজ তুলে ফারহানা উঠে আসছে। দোতলার ল্যান্ডিং থেকে ওপরের দিকে চোখ তুলতে দুজনার চোখাচোখি হল। ফারহানা হাসল, ক্লান্তির ছাপ হাসিতে। আফরোজাও হাসল। সদ্যস্নাত আফরোজার হাসিতে সজীবতা।

          -ভাবী, এইমাত্র এলেন?

          -জী, ভাবী।

কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবু সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতেই তাকে বলতে হল।

          -আজ এত দেরি যে।

          -রাস্তায় জ্যাম ছিল।

বলতে বলতে দুজনে মুখোমুখি হয়ে আবার হাসি বিনিময় হল। ফারহানা আসি বলে তিনতলার সিঁড়িতে পা রাখল। আফরোজা দরজায় দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ তার চলে যাওয়া দেখল।

          আফরোজার এটা একটা নেশার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালবেলা যখন ফারহানা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে বাড়ির কম্পাউন্ডটা অতিক্রম করে তখনও রুটি-পরোটা ভাজতে ভাজতে কিংবা আলুভাজিতে খুন্তি নাড়াতে নাড়াতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। একটা নেশার মত হয়ে গেছে আফরোজার। তিনতলার ফারহানার ব্যাগ আর আঁচল যখন বাতাসে দোল খায়, অথবা তার হাঁটার গতিতে দুলে উঠে তখন আফরোজার মনে হয় তার সামনে দিয়ে যেন একটা মুক্তির পতাকা উড়তে উড়তে মিলিয়ে গেল। গোপন একটা দীর্ঘশ্বাস চাপে আফরোজা। তার মনে হয়, ফারহানার মত এমন মুক্ত স্বাধীন জীবন যদি তারও হত!

          যৌথ পরিবারে রক্ষণশীল মা-বাবা, চাচা-চাচীদের মাঝে বড় হয়েছে আফরোজা। সবসময় শুনতে হয়েছে মেয়েদের এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। এমনকি ওরা সব বোনেরা যখন স্কুলে যেত তখনও আকলিমা ফুপুকে তাদের সঙ্গে দেয়া হত। অথচ এলাকার মধ্যেই গার্লস স্কুল। তারপর কোনমতে ম্যাট্রিক পাশ করার পর আর লেখাপড়া নেই। বিয়ে দিতে হলে বলতে হয় মেয়ে ম্যাট্রিক পাশ। এটুকু লেখাপড়া না থাকলে বরপক্ষ বিয়েতে রাজি হয় না। আবার বেশি শিক্ষিত শুনলেও পিছিয়ে যায়।

          তাই ম্যাট্রিক পাশের পরই অন্য বোনদের মত আফরোজাকে বিয়ের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল। মা-চাচীদের কাছ থেকে সাংসারিক কাজ শিখতে হয়েছিল।

          বিয়ের পর স্বামীর কাছে একদিন আবদার করেছিলেন, আমাকে একটু কলেজে ভর্তি করাও না। আমার খুব ইচ্ছে করে পড়াশোনা করতে।

          -তুমি পাগল হয়েছ? বিস্মিত কন্ঠে মনসুর বলেছিল। আব্বা-আম্মা একথা শুনলে রক্ষা আছে!

          -ওনারাতো গ্রামে আছেন। এখানে শহরে আমরা কি করছি না করছি তারা কিভাবে জানবেন।

          -শোন আফরোজা, এসব কথা চাপা থাকে না। তা হঠাৎ লেখাপড়ার ভূত চাপল কেন মাথায়?

          -ভূত চাপবে কেন, আমার আগে থেকেই ইচ্ছে করত কিন্তু আমাদের পরিবারেতো কেউ মেয়েদের বেশি লেখাপড়া পছন্দ করত না।

          -তাহলে বুঝে দ্যাখ, যা তোমাদের পরিবার পছন্দ করেনি আমার পরিবার কেন পছন্দ করবে! তাছাড়া তুমিও লেখাপড়া শিখে চাকরি করলে, সংসার সামলাবে কে?

          -কেন, আমরা দুজনেই সামলাব। তুমি আমাকে একটু সাহায্য সমর্থন দিলে আমি সব পারব।

          -বাহ, এখনই দেখি তোমার মুখে যে স্বাধীনতার বুলি ফুটছে, কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়লেতো আমাকেই রান্নাঘরে পাঠিয়ে দেবে- বলতে বলতে হেসে উঠেছিল স্বামী মনসুর আহমেদ।

          সে হাসিতে বিদ্রুপ ছিল। স্বামীকে সেদিন নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল আফরোজার। অথচ মানুষটা তেমন খারাপ নয়। ঝগড়াঝাটি, কিছু গালমন্দ মিলিয়ে মোটামুটি ভালমানুষ। এসব কোন সংসারে নেই? বাপের সংসার, শ্বশুরবাড়ির সংসার সবখানেই এই দেখেছে। এর বাইরের জগৎ তার অজানা।

          কিন্তু কিছুদিন থেকে মাথার ওপরের নতুন প্রতিবেশী তার মনটাতে আবার আলোড়ন তুলেছে। আফরোজার অবদমিত আকাঙ্ক্ষা মনের ভিতর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

          ফারহানা ভাবীর অফিসে যাওয়া আসা, তার চলাফেরা সবকিছুই গোপনে পর্যবেক্ষণ করে সে। আর বিকেল গড়ানো দুপুরে যখন মহিলা ফিরে আসে তখনই সুযোগ পেলে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে স্বাধীন সুখী এই নারীটিকে কিছুটা ঈর্ষাও করে সে।

          সকাল সাড়ে আটটায় গাড়ি আসে। তার আগে সবকিছু দুহাতে যতটা সম্ভব সারতে হয় ফারহানাকে। বাচ্চা দুটোকে স্কুলের জন্য রেডি করা, নাস্তার টেবিলে আশরাফের জন্য নাস্তা রেডি করে রাখা, দুপুরে বাচ্চারা ফিরলে কি খাবে তা কাজের বুয়াকে পই পই করে মনে করিয়ে দেওয়া। তারপর বাচ্চাদের স্কুলের গাড়িতে তুলে দিয়ে এসে অফিসের জন্য তৈরি হওয়া। অফিসে যাওয়ার আগে গোসল সারতে হয়। একটু ফ্রেশ হয়ে না গেলে সারাদিনই মনটা খুঁতখুঁত করে। চুল আঁচড়ানো, শাড়ি ঠিকঠাক করে পরা, হালকা লিপস্টিক বা একটু কাজল এইটুকু সাজ- তাও কত দৌড়ে ধাবড়ে করতে হয়। অথচ চাকরি করতে গেলে এটুকু না করলে নয়। আজকাল সর্বত্রই স্মার্টনেসের একটা ব্যাপার থাকে। যেনতেনভাবে চললে আয়া-পিয়নরাই পাত্তা দেয় না আর সহকর্মীরাতো----।

          অফিসে নারীকর্মীরা সবাই বেশ সাজগোজ করে আসে। প্রায় প্রতিদিনই কমপক্ষে আধঘন্টা এসব নিয়ে গ্যাঁজানো হয়। সাফিনা ফরিদাকে বলে আপনার শাড়িটাতো নতুন, কবে কিনলেন? অমনি সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে হ্যাঁ সত্যিইতো- কোথা থেকে কিনলেন, কবে কিনলেন আপা। কত দাম নিল। ফরিদা ততক্ষণে ফুলেফেঁপে ফাটার উপক্রম তবু গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলেন- টাঙ্গাইল শাড়িকুটির থেকে। সাড়ে তিনহাজার।

          -একটা সুতি শাড়ি সাড়ে তিনহাজার! মাগো, আপনার সাহস আছে। আমিতো ঐ দোকানের ধারে কাছেও যাই না। একদম গলা কাটে।

          -কিন্তু এক্সসেপশনাল কিছু পেতে হলে তোমাকে তো বেশি পে করতেই হবে তাই না- ফরিদা বলেন।

          এভাবে কোনদিন ঘড়ি, কোনদিন স্যান্ডেল আবার কোনদিন কানের দুল কিংবা হাতের চুড়ি নিয়ে মাতামাতি চলে। এটুকুই তাদের আনন্দ। কারণ তারা জানে অফিসে আসার আগে এতটুকু দম ফেলার সময় পায়নি কেউ। আবার অফিস থেকে ফিরেই বাচ্চাদের পড়াশোনার তদারকি করা, রান্নাবান্না করা, পারলে যাওয়ার সময় বাজার করে যাওয়া।

          উফ কেন যে লেখাপড়া শিখিয়েছিল বাবা-মা। মাথার ভিতর ছোট থেকেই ঘুনপোকা ঢুকিয়ে দিয়েছিল, মেয়ে নয়, মানুষ হিসেবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। শিক্ষক বাবার এ বাণীমন্ত্র জপতে জপতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে চাকরি পেতেও কি কম কষ্ট করতে হয়েছে! আর আশরাফকে দ্যাখ- ব্যাংকের কর্মকর্তা। আগে নটায় অফিস যেতে হত এখন সরকারের নতুন নিয়মে দশটায় যায়। যানজটের অজুহাতে এগারোটা বাজলেও ক্ষতি নেই। আর ফারহানাকে নারী অধিকার বিষয়ক এন.জি.ওতে নটার মধ্যে পৌঁছাতে না পারলে লালকালি মাসে তিনদিন লেটলতিফ হলে একদিনের বেতন কাটা

          বিরতিহীন দৌড়াতে দৌড়াতে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে চাকরিটা ছেড়ে দিতে সংসারের এতসব দায়িত্ব, বাচ্চাদের দেখভাল, তাদের মানুষ করার দায়িত্ব, আবার মাঝে মাঝে গৃহকর্মীর সংকট সব মিলিয়ে হাঁফিয়ে ওঠে ইচ্ছে করে ধ্যাত্তেরি বলে চাকরির পায়ে লাথি মেরে সব ছেড়েছুড়ে সংসার করতে

          এই যে দোতলার আফরোজা ভাবী কি সুন্দর সংসার করেন। অফিস থেকে ফেরার সময় ঝড়োকাকের মত বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে যখন ফারহানা উঠে আসে তখন স্নানস্নিগ্ধ আফরোজা ভাবীকে দেখে বুকের ভেতর কেমন যেন একটা ঈর্ষা জাগে। মনে হয়, আহারে কত শান্তি। আর আমার ঘরে বাইরে কোথাও শান্তি নেই কেবল কাজ, কাজ আর কাজ। তবু আশরাফ যদি একটু হেল্প করত, বোঝা কিছু কমত। কিন্তু সে তার ওপরে ওঠার সিঁড়ি নিয়ে ব্যস্ত। ক্লায়েন্ট ধরতে হবে, পারসেন্টেজ কামাতে হবে। গাড়ি বাড়ি করতে হবে। এদেশের মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের যা স্বপ্ন। যদি কখনও ফারহানা বলে, চলো, এবার ছুটিতে কোথাও বেড়িয়ে আসি। বাচ্চারাতো এক দাদার বাড়ি আর নানার বাড়ি ছাড়া কিছুই দেখেনি। তখন ব্যাংকার আয়-ব্যয়ের হিসাব কষে ফারহানাকে বোঝাতে চেষ্টা করে ম্যাক্সিমাম-মিনিমাম কস্ট কত পড়বে। তারচে এভাবে টাকাটা জমলে একটা ফ্ল্যাট বুকিং দেয়া যাবে। তারপর একটা গাড়ি- হ্যাঁ তারপর আমরা বুড়োবুড়ি, হাতে ব্যাথা, গাঁটে ব্যাথা ইত্যাদি ইত্যাদি। কথায় কথা বাড়ে, বাড়ে তিক্ততা- ভাল লাগে না।

          মাঝে মাঝে দাম্পত্য কলহ হলে আশরাফ বলে, চাকরি ছেড়ে দিতে। কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে থাকতে পারবে না। তাছাড়া নিজের স্বাধীনভাবে চলা, একটু কেনাকাটা, বাবামায়ের ওষুধের টাকা এসব খরচগুলোতো তাকে সামলাতে হয়। চাকরীজীবী বউ বলে ঈদে চাঁদেও আশরাফ তাকে নতুন কাপড় দেয় না। বাচ্চাদের স্কুলের খরচ ও সমানভাবে দুজনে শেয়ার করে। গেলবার কোরবানী ঈদে নতুন ডিপফ্রিজটা কেনার সময় দুজনকে সমান শেয়ার করতে হয়েছে।

          ফারহানা এসব কথা কাউকে বলতে পারে না। প্রেম করে বিয়ে করেছে। তখন শুধু ভালবাসার বায়বীয় মোহে কোনো কিছু ভাবেনি। বাবা-মা বলেছিলেন-দ্বিতীয়বার ভাবতে। কিন্তু ফারহানা ততদিনে কমিটমেন্টে চলে গেছে। তাই বলেছিল, ভাল হোক, মন্দ হোক কপালে যাই থাক আমি একেই বিয়ে করব। বাইরের দৃষ্টিতে ঠকেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স থেকে পাশ করা সিজিপিএ ভাল। প্রফেশনে ভাল করছে। সবাই প্রশংসা করে, কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হয় কিন্তু কষ্টটা শুধু ফারহানার। শ্বশুর শাশুড়ি দুজনই চুড়ান্ত কৃপণ। প্রতিষ্ঠিত ছেলেদের নিয়ে শাশুড়ির দেমাকের অন্ত নেই। ফারহানার সহজ-সরল বাবা-মায়ের সাথেও মহিলা এমনভাবে কথা বলে যেন ছেলের মা হয়ে উনিই একটা বিশেষ কিছু।

          বিয়ের পর প্রথম শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে নোংরা বাথরুম পায়খানা দেখে বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল সে। মনে হয়েছিল বাবার কথাই ঠিক। একজন মানুষকে দিয়ে তার পরিবেশ চেনা যায় না। তবু মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে। তাদের মফস্বলের ছিমছাম ভাড়াবাড়িটার কথা মনে হয়ে অনেক কেঁদেছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আশরাফের জন্য ভালবাসা তাকে বারবার পরাজিত করেছে প্রতিবাদ করতে প্রচন্ড মনঃকষ্টেও সংসার ছেড়ে যেতে পারেনি। এখন তো ছেলে-মেয়ে জীবনযাপনের অভ্যস্ততা সবকিছু নিয়ে এমন আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা যে অন্যকিছু ভাবার প্রশ্নই ওঠে না।

          একেকসময় আশরাফের সঙ্গে খিটিমিটিও করে। সবকিছু যখন দুজনে শেয়ার করছি তখন ঘরের দিকটা তুমিও দ্যাখোনা কেন। এখন থেকে সপ্তায় তিনদিন তুমি রান্না করবে বাকি চারদিন আমি। আশরাফ শুনে হো হো করে হাসে, সে হাসির বিদ্রুপ ফারহানার কানে যেন গরম শীসা ঢালে। বলে, এন.জি.ও তে চাকরি করে খুব নারীবাদী হয়ে উঠেছ দেখি এরপর কি বলবে আমাকে হাতে বালা পরে থাকতে হবে!

          -দ্যাখো, নারী অধিকার আর পুরুষের হাতে বালা পরা এক জিনিস নয়। একটা শিক্ষিত মানুষ হয়ে তুমি এরকম যুক্তিহীন কথা বলছ কেন?

          -তাইতো আমি যুক্তিহীন, আর তুমি যুক্তিবাদী বেশ বেশ তাহলে আমাদের সংসারটাতো একটা বিতর্কের মঞ্চ হয়ে যাবে। ভেবে দেখ কি রকম হবে ব্যাপারটা! ফারহানা হকের যুক্তি শুনতে লোকে ছুটে আসবে।

          এমনসব অদ্ভুত আর বাজে কথা বলে যে, ফারহানার তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা আর লুকিয়ে চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছু করার থাকে না। ভাবতে পারেনা, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে আশরাফকে সে চিনত একি সেই! তখন কত কথা- পায়রার মত বাকম বাকম। ফারহানার যা পছন্দ তারও সেটাই পছন্দ দুশত ভাগ। অথচ ফারহানা বুঝতে পারে সে যে রিটায়ার্ড বাবাকে ওষুধের টাকা দেয়, ছোট ভাইটার টিউশনির খরচ দেয় সেটাও খুব বেশি পছন্দ করে না সে। আবার এটাও বোঝে এই একটা ক্ষেত্রে ফারহানা কখনও আপোষ করবে না। প্রয়োজনে গৃহত্যাগ করবে তাই ফ্ল্যাট বুকিং, গাড়ি কেনার জন্য সুযোগ পেলেই তার কানের কাছে তখন মন্ত্র জপে তখন কোন দুর্বল মুহূর্তেও সামান্য সায় দেয় না সে, শক্তভাবে জানিয়ে দেয়- আমার বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট চাই না।

          ফারহানা যে এন.জি.ও তে চাকরি করে সেখানেও একই সমস্যা নিয়ে কত অসহায় নারীরা আসে। স্বামীর অত্যাচার, দ্বিতীয় বিয়ে, যৌতুক, নির্যাতন, পরকীয়া এমন হাজারো সমস্যা। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ভাই-বাবা বা প্রতিবশিনীর হাত ধরে যখন অভিযোগ করতে আসে তখনও অতীতের স্মৃতি আর ভবিষ্যৎ নির্যাতনের ভয়ে ওদের শরীরিটা মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে। একদিন শহর বানু নামে এক যুবতীবধু বলেছিল, আপা আপনাগো মত ভদ্রলোকেরা কত সুখে সংসার করেন আর আমরা লাথি গুঁতা খাইয়া মুখ বুঁইজা পইরা থাকি তাও সংসার করতে পারি না। শহর বানুর কথা শুনে ফারহানা আর তার সহকর্মীরা পরস্পর চোখ চাওয়া চাওয়ি করেছিল। তাদের পরস্পরের চোখে যেন প্রশ্ন ছিল-কথাটা কি সত্যি?

          ফারহানার মনে হয়েছিল ওরা নিরুপায় হয়ে সত্য প্রকাশ করে আর আমরা মিথ্যের মুখোশ পরে সত্যকে যত্ন করে লুকিয়ে রাখি। প্রকৃতপক্ষে ওরা আর আমরা একই সমতলে দাঁড়িয়ে। শুধু শ্রেণী বৈষম্য আর শিক্ষা আমাদের আরও কপট হতে শিখিয়েছে।

          আবার সুখের সংসারও কি নেই? আছে। ফারহানা নিজেই দেখেছে। ব্যাংক কর্মকর্তা বাবা আর তার গৃহিনী মা মিলেমিশে সংসারে যে পরিমন্ডল সৃষ্টি করেছিল তাতে তারা ভাই-বোন, দাদা-দাদী, চাচা-মামা-ফুপু সবাইকে নিয়েইতো সুখী ছিল। দাদা-দাদী যখন বাড়ি থেকে আসতেন ছোট ছোট পুঁটুলি বেঁধে নারকেল নাড়ু, মোরব্বা, গাছের চালতার আচার কতকিছু যে থাকত। সেগুলো আবার বড়বউ হওয়ার কারণে সবাইকে ভাগ করে দিতে হত মাকে। দাদা-দাদী বাসায় এলে বাসায় ফুপু চাচীরা আসত। চাচাতো ফুপাতো ভাইবোনরা মিলে কত মজা হত। আজ এই বাসায়, কাল ঐ বাসায়। আর পরীক্ষা শেষে বাড়ি গেলে সব্বাই মিলে পুকুরে ঝাঁপাঝাপি, উঠানে গোল হয়ে বসে দাদীর হাতের ভাপা পিঠা, পুলিপিঠা, পাটিসাপ্টা, দুধলাউ কতরকম খাবার। সকালে-বিকেলে সবাই মিলে পাড়া বেড়ানো-এখন সবই স্মৃতি সুফিয়া কামালের কবিতার মত কেবলই মনে পড়ে।

          আফরোজার মনটা একটুও ভাল নেই। মেয়ে আসমা এবার এইচ এস সি পাশ করেছে। আর্টস গ্রুপ/মানবিক শাখা থেকে জিপিএ ৪.৭০ পেয়েছে মানবিক শাখায় ভালই ফলাফল। তাই মেয়ের ইচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবে। অনার্স পড়বে। মেয়ের উৎসাহ দেখে স্বামীকে বলেছিলেন। কিন্তু শুনেই উড়িয়ে দিয়েছেন আরিফ- তুমি কি পাগল হলে আফরোজা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়ে, তারপর কোন কান্ড করে নাক-কান কাটে।

          -কি বলছ তুমি। দুনিয়ার এত ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে তাদের সবার বাবা-মায়ের কি নাক কান কাটা যাচ্ছে? এখন এরকম চিন্তা কেউ করে।

          -কেউ না করুক, আমি করি, তুমি মেয়ের কথা শুনে নাচতে যেও না।

          -ওর বান্ধবীরা পরীক্ষা দেবে।

          -দিক। সেটা ওদের মা বাবার সিদ্ধান্ত।

          -ঠিক আছে, যতদিন বিয়ে না হচ্ছে ততদিন পড়তে দাও আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিলেইতো টিকে যাবে না, তখন মেয়ে নিজেই বুঝ মানবে।

          -এসব ফালতু কথা রাখো। ওকে বলো, আগে যেমন গার্লস স্কুল কলেজে পড়েছে এখনও তেমনি পড়বে। মেয়েদের যত লাই দেবে ততো মাথায় উঠবে।

          হঠাৎ যেন অগ্নিস্ফুরণ ঘটল আফরোজার ভিতরে।নিজের বেলায় যে স্বামীর কথা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মেনে নিয়েছিলেন আজ তা মানতে পারলেন না।

          -এই তোমার মত?

          -হ্যাঁ। এই আমার মত তুমি এবং তোমার মেয়ে জেনে রাখো। এর অন্যথা হবে না হতে পারে না।

          মুহূর্তে স্বামীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন আফরোজা।

          -ইতর, ছোটলোক বলতে বলতে মনসুরের বুকের কাছে জামা খিমচে ধরলেন।

          আকস্মিক ঘটনার ধাক্কায় টলে গিয়ে মনসুরও তাকে আচমকা ধাক্কা দিতেই দেয়ালে ধাক্কা খেলেন। কিন্তু থামলেন না। চিৎকার করে বলতে থাকলেন- আমি সারাজীবন তোমার দাসীগিরি করেছি। কিন্তু আমার মেয়েকে তা হতে দেব না। আমি আমার মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবই।

          কয়েকদিন থেকে ওঠা-নামার সময় আফরোজাকে না দেখে একটু অবাক হন ফারহানা। বাসাটা কেমন নির্জন। কিছু হয়েছে কি?

          পাঁচদিন কেটে গেল। ফারহানার মনে হল অনন্তকাল ধরে সে আফরোজাকে দেখে না। সাতদিন পর অফিস থেকে ফেরার পথে দোতলায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর ডোরবেলে চাপ দিল। দরজা খুলে সামনে দাঁড়াল আফরোজার ছোট মেয়ে সামিনা।

          -আন্টি!

          -হ্যাঁ। আম্মু কি অসুস্থ? কদিন ধরে দেখি না যে।

          -না আন্টি। নিচের দিকে তাকিয়ে পায়ের নখ মেঝেতে ঘষতে ঘষতে জবাব দিল।

          -তাহলে কি বেড়াতে গেছে? তোমরা যাওনি?

          এবার হু হু করে কেঁদে ওঠে কিশোরী সামিনা।

          -আন্টি আম্মু নানাবাড়ি চলে গেছে আপুকে নিয়ে। বলে গেছে আর আসবে না।

          -কেন? তোমাদের ফেলে আম্মু কিভাবে যাবে। ধুর। আচ্ছা আম্মু কি কারো সাথে রাগ করেছে?

          -হ্যাঁ। আব্বু আপুকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দেবে না বলেছিল তাই আম্মু আপুকে নিয়ে নানারবাড়ি চলে গেছে।

          -আচ্ছা। আচমকা বিস্ময় আর উদ্বেগ ঝরে পড়ল ফারহানার কন্ঠে। তাহলে তোমরা কিভাবে আছ?

          ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, আব্বুকে তাই বললাম। ফাহাদটা কান্নাকাটি করছে। কিন্তু আব্বু বলল নিজেই আসবে। না এসে থাকতে পারবে নাকি। কিন্তু সত্যি যদি না আসে বলতে বলতে সব ভুলে ফারহানাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ফারহানা মেয়েটিকে জড়িয়ে নিয়েই ঘরে ঢুকল। তারপর বলল, মায়ের মোবাইল আছে না?

          -আছে।

          -তাহলে আমাকে একটু দাও। আমি মায়ের সাথে কথা বলব।

          পরদিন সকালে অফিসে বের হওয়ার আগেই ডোরবেল বাজতে ফারহানা অবাক হল। দরজা খুলতেই দেখল সামিনা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখমুখ হাসিতে উজ্জ্বল।

          -কি খবর সামিনা?

          -আন্টি আম্মু কালরাতে বাসায় এসেছে। আব্বুই নিয়ে এসেছে আর বলেছে আপুকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে দেবে।

          -ও তাই। কথা বলার সময় ফারহানা অনুভব করল তার কণ্ঠে উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে বিষাদ খেলা করছে। নিজেকে এই সাধারণ গৃহবধুটির কাছে কেমন যেন পরাজিত মনে হচ্ছে।

          মেয়েটি সিঁড়ি ভেঙে নেমে যায়। ফারহানা বিষাদ প্রতিমা হয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩১-৩২

----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ __________________________...

Popular Posts