১৬
মিলাদ মাহফিল
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে
বছরের শুরুতে মিলাদ, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, পাঠাগার, কলেজ ম্যাগাজিন
ইত্যাদি খাতে টাকা নেয়া হত। সার্জেন্ট জহুরুল হকের শহীদ দিবস ১৫ ফেব্রুয়ারী। সে
কারণে কলেজে সেই তারিখেই মিলাদ হত। কলেজ প্রাঙ্গনে সামিয়ানা খাঁটিয়ে (এসব কাজ
ঘাঁটি থেকে করা হত) সেন্ট্রাল মসজিদের ইমাম সাহেব মিলাদ পড়াতেন। ছাত্র-ছাত্রীরা
হামদ-নাত পরিবেশন ও সার্জেন্ট জহুরের জীবন সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করত। মিলাদ
শেষে প্যাকেটে জিলাপি ও নিমকি বিতরণ হত। আকস্মিকভাবে একবার সিদ্ধান্ত হল, মিলাদের
পর শিক্ষার্থীদের তাবারুক দেয়া হবে না। অবাক হলাম। মিলাদ মানেই বাচ্চাদের কাছে
যৎসামান্যই হোক একটু মিষ্টি খাবার। তখন ঘাঁটিতে প্রধান কারা ছিলেন, হিসাবরক্ষণ
কর্মকর্তা কে ছিলেন মনে নেই। তবে মনে হয়েছিল এটা ভীষণ অন্যায় এবং অন্যায্য। শিশুরা
মিলাদের চাঁদা দেয় তবু তারা কেন এইটুকুও পাবে না! যারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মনে
পড়লে আজো তাদের ‘পরের ধনে
পোদ্দারী’র জন্য
তিরস্কার করি। শিশুদের এই সামান্য অধিকার হরণ করা কি সমীচীন ছিল!
সমাজ-সংসারে কিছু মানুষ থাকে যারা শুধু
আর্থিক লাভের দিকটাই দেখে। আমাদের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানেও নতুন
বিষয় চালু হল। আগে বিদায়ীদের একটা করে বই দেয়া হত। অনেকগুলো বই একসাথে কিনলে
কমিশনও পাওয়া যেত। ততদিনে হুমায়ুন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল শিশুদের কাছে
অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু একজন অধ্যক্ষ সিদ্ধান্ত দিলেন, না এবার থেকে পরীক্ষার্থীদের
জ্যামিতি বক্স, প্রবেশ পত্র রাখার জন্য একটা ট্রান্সপারেন্ট ব্যাগ দেয়া হবে সাথে
স্কেল পেন্সিল ছিল কিনা মনে নেই।
কি বুদ্ধি! প্রবেশ পত্র নেয়ার দিন ফেয়ার
ওয়েল দেয়া হত এবং তার দুদিন পরে পরীক্ষা। এ সময়ে অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীরা এসব না
কিনে বসে থাকে! তার চেয়ে একটা বই দিলে হয়তো পরীক্ষার পর পড়ত এবং এভাবে কারো কারো
হলেও পড়ার আগ্রহ বাড়ত। আরও দশজনে সেটা পড়তে পারত। স্মৃতি হিসেবে চিরদিনের স্মারক
হয়ে থাকত। না জ্যামিতি বক্স দাও- ফালতু।
এইচএসসি-র ছাত্ররা (একাদশ শ্রেণী) চাইত
দ্বাদশ শ্রেণির ফেয়ারওয়েলে অথবা নবীনবরণে ব্যান্ড আনতে। সেটাও দেখা যেত কোন
অধিকর্তা অনুমতি দিলেন তো পরের বারের জন ব্যান্ড ব্যান করে দিলেন। এসব তামাশা দেখে খুব
মজা লাগত। মাঝে মাঝে ‘হীরক রাজার
দেশে’র কথা মনে
পড়ত। হীরকের রাজার মতই আপন ক্ষমতায় তারা বোধহয় নিজেদের ভগবান মনে করতেন। তবু
তারুণ্যের চাঞ্চল্যকে রুখতে তারা পারতেন না। ওরা আপন আনন্দে ‘ওগো নদী আপন বেগে
পাগলপারা’ হয়ে
অনুষ্ঠান করত। তারুণ্যের ধর্ম যা হয় আর কি।
একবার খুব মজার একটা কান্ড হয়েছিল।
দ্বাদশ শ্রেণির ফেয়ারওয়েলে আরটিএস অডিটোরিয়ামে ততদিনে আমাদের ছাত্রদের বিজ্ঞান,
বাণিজ্য ও মানবিক শাখার শিক্ষার্থীদের সহজে চেনার জন্য কাঁধে ব্যাজ দেয়া হয়েছিল।
আমাদের কলেজ পোশাক ছিল বিমানবাহিনীর সাথে মিলিয়ে আকাশনীল শার্ট আর খাকি প্যান্ট।
বিজ্ঞান শাখায় লালের ওপর সোনালী রেখা টানা ব্যাজ। তখন মজিদ স্যার অধ্যক্ষ।
কর্তৃপক্ষ ওনার ওপর সন্তুষ্ট, উনি যা করেন তাতে বাধা দেন না। ছাত্রদের পীড়াপিড়িতে
তিনি ব্যান্ড আনার অনুমতি দিলেন। তখনতো এত গাড়ি ছিল না। ব্যান্ডদল বললো হয়
গাড়ীভাড়া দিতে, নয় গাড়ির ব্যবস্থা করতে। সাব্বির নামে পদ্মা অয়েলের এক অফিসারের
ছেলে দায়িত্ব নিল গাড়ি দিয়ে তাদের আনার। সাব্বির দেখতে ফর্সা, স্বাস্থ্য ভাল,
কলেজের পোশাকে মানাত ভাল।
কিন্তু দৈবক্রমে তখন চট্টগ্রাম
মেট্রোপলিটন পুলিশেরও এই পোশাক ছিল এবং এ কারণেও অনেক ছাত্র কলেজ ড্রেস পরে আসা
যাওয়ায় অস্বস্তিতে ভুগত। তো সাব্বির গেল গায়ককে আনতে এবং সাব্বিরকে দেখে গায়ক এবং
তার পরিবার ভাবল পুলিশ এসেছে। তিল পরিমাণ দেরি না করে গায়ক তীরবেগে পিছনের দরজা
দিয়ে পালিয়ে গেল। সাব্বির সামনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। অবশেষে অভিভাবকদের সন্দেহ
নিরসন করে গায়ককে খুঁজে আনা হয়েছিল। এদিকে আমরা অপেক্ষায় আছি, সময় গড়িয়ে যাচ্ছে
গায়ক আসে না কেন? পরে বিষয়টা জানাজানি হলে হাসির হুল্লোড় পড়ে গিয়েছিল।
১৭
শিক্ষক প্রতিনিধি
আমরা অনেকদিন থেকে কর্তৃপক্ষের
কাছে আবেদন জানিয়ে আসছিলাম গভর্নিং বোর্ডের মিটিং-এ স্কুল এবং
কলেজ শাখার একজন করে শিক্ষক প্রতিনিধি রাখার জন্য। কারণ কর্তৃপক্ষের
সাথে মিটিং-এ অধ্যক্ষ এবং উপাধ্যক্ষ উপস্থিত থাকেন স্বভাবতই সব তথ্য আমরা পাইনা। বেশিরভাগ হুমকি
ধামকির নেতিবাচক তথ্যই আসে।
তখন গ্রুপ ক্যাপ্টেন শাহজাহান সরকার স্যার
আরটিএস-এর অফিসার কমান্ডিং ছিলেন এবং আমাদের অধ্যক্ষ হিসেবেই চলতি দায়িত্বে ছিলেন। সিদ্ধান্ত হল
শিক্ষকদের গোপন ব্যালটে প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। কমন রুম থেকে
বের হওয়ার আগেই জেনে গেলাম স্কুলশাখায় হোসনে আরা ম্যাডাম এবং কলেজশাখায় আমি প্রতিনিধি
নির্বাচিত হয়েছি। বিশজন কলেজ শিক্ষক ও ডেমোনেস্ট্রটরদের মধ্যে আমি পেয়েছি আঠারো ভোট, প্রতিদ্বন্দী
দুই ভোট।
প্রতিনিধি হয়ে মিটিং-এ যাই। দাবি-দাওয়া পেশ। সরাসরি
কথা বলি। কিন্তু ঘটনা যা ঘটে, নির্দেশ যা জারি হয় তা যথা পূর্বং তথা পরং। শুধু মিটিং-এ
গিয়ে অযথা কথা বলে আর কত ভাল লাগে। সেগুলো এসে আবার শিক্ষকদের জানানোতে নতুনত্ব কিছু নেই। কিন্তু এ কথা
আমি এখনও বিশ্বাস করি শাহীন কলেজে যতদিন আমি ছিলাম স্পষ্টবক্তা এবং দাবী-দাওয়া উত্থাপনের
বিষয়ে আমার কথায় আমার উর্ধতনরাও বিব্রত হতেন, কিন্তু সহকর্মীরা খুশি হতেন।
পরের বছর আবার নির্বাচন। আমি বললাম, আমি
এবার না-ই থাকি। কারণ কাজতো তেমন কিছু নেই। কিন্তু ম্যাডামদের এক কথা, না আপা
আপনাকে থাকতে হবে। বাংলায় প্রবাদ আছে, ‘অনুরোধে ঢেঁকি গিলে’ আর আমি
এটুকু করতে পারব না। অতএব বললাম তথাস্তু। ভোট শেষে দেখা গেল আমি পেয়েছি আটটি ভোট
আর আমার প্রতিদ্বন্দী বারো ভোট। অর্থাৎ ম্যাডামরা সবাই আমাকে ভোট দিয়েছেন। পরে
পুরুষ শিক্ষকদের অনেকে গোপনে আমাকে জানিয়েছিলেন, স্থানীয় প্রশাসন অর্থাৎ অধ্যক্ষ
এবং উপাধ্যক্ষ মহোদয় তাদের শাসিয়েছিলেন, আমাকে ভোট না দেয়ার জন্য। আমি হেসেই সারা।
বাহ, এত সামান্য বিষয়েও পলিটিক্স! তার মানে নির্বাচন হলে পলিটিক্স থাকবেই। আমি
কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে বিজয়ী প্রতিনিধিকে সবার আগে অভিনন্দন
জানিয়েছিলাম। ম্যাডামরা খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিল।
শাহীন কলেজে ম্যাডামদের কমনরুম ছিল
সবচেয়ে আনন্দের। আমাদের মাঝে কোন রেষারেষি বা প্রতিযোগিতা ছিল না। অবশ্য স্যাররাও
আমাদের খুব সম্মান করতেন। আমরা যেন ভাই-বোন মিলে একটি শাহীন পরিবার। কারো সাথে
কারো দ্বন্দ্ব বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মত দলাদলি ছিল না। আমাদের সব দাবি-দাওয়া,
ক্ষোভ ছিল উর্ধতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। তাই আমি বলতাম, আমরা হচ্ছি ‘বাকশাল’!
পে-স্কেল বাড়ার পরে স্বভাবতই সবার
স্বচ্ছলতা একটু বেড়েছিল। আমরা ম্যাডামরা যার জন্মদিন তাকে না জানিয়ে জন্মদিনের
কেক, খাবার-দাবার এসবের আয়োজন করতাম। কলেজের স্যার-ম্যাডাম, সহকারী-সহকর্মী সবাইকে
ডাকা হত। প্রিন্সিপাল স্যার আসতেন। এরকম টুকিটাকি আনন্দে শত কর্মব্যস্ততার মাঝেও
আমরা মিলেমিশে আনন্দ খুঁজে নিতাম। সাধারণত আমাদের পরামর্শে জুনিয়ররাই এসব কাজ
সুন্দরভাবে সমাধা করত। এদের প্রধান ছিল নার্গিস মোস্তারী। তাকে সাহায্য করত আয়েশা
সামী, আরো দু-একজন। আর আমাদের সার্বক্ষণিক সহকর্মী আয়ারাতো ছিলই। আয়েশা সামী এত
নীরবে সিনিয়রদের নির্দেশ পালন করত যে মিতভাষী এই মেয়েটিকে আমি আদর করে ‘ছোট বউ’ ডাকতাম। নোয়াখালী
শ্বশুরগৃহেও সে ছোটবউ ছিল। আর নার্গিস মোস্তারী যে কোন অনুষ্ঠান এত সুন্দর আর
পরিপাটি করে আয়োজন করত যে খুঁত রাখত না।
আমাদের একসময়ের অধ্যক্ষ মোঃ শাহাজাহান
স্যার একবার তাকে কলেজের বাগানের পরামর্শক ও পরিদর্শকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সে
মালীদের দিয়ে এত সুন্দর বাগান করিয়েছিল, আমার মনে হয় শাহীন চট্টগ্রামে এত সুন্দর
বাগান আগেও হয়নি, পরেও হবে না।
খাতা দেখার চাপ, লেসন
প্ল্যান, দাঁড়িয়ে ৫/৬টা ক্লাস আরো কতরকম অকাজের বোঝা কিন্তু সবার মাঝে সম্প্রীতি
আর কমনরুমের আনন্দ আমাদের উজ্জীবিত রাখত।
তাই যারা অন্য কোথাও চাকরি নিয়ে অথবা সরকারী চাকরি কিংবা বিদেশে গেলেও চট্টগ্রাম
এলে একবার শাহীনে এসে দেখা করে যেত। তাদের সবার এক কথা, শাহীনের এই আন্তরিক
সম্পর্ক আর কোথাও তারা পাননি। শফি কামাল, সোলায়মানভাই, আলী হায়দার আরো অনেক স্যার
ম্যাডাম দেশ এমনকি বিদেশ থেকে এলেও শাহীন কলেজ ঘুরে যেতেন।
আর আমাদের ম্যাডামদেরতো কথাই নেই। নতুন
স্যান্ডেল থেকে শাড়ী-জামা কিনলেই বাচ্চাদের ঈদের খুশির মত কখন সেটা পরে শাহীন
কলেজে যাওয়া হবে এবং সবাই মিলে হুল্লোড় হবে, সবাইকে নতুন শাড়ির জন্য নিদেনপক্ষে
একটা সিঙ্গারা হলেও খাওয়াতে হবে। এসব ছিল আনন্দের খোরাক। আবার স্পোর্টসে
ম্যাডামদের একরকম শাড়ী পরা এগুলো আগত অতিথিদেরও চমকে দিত। কর্তৃপক্ষ এটা এত পছন্দ
করেছিলেন যে, পরে এটা রীতিই হয়ে পড়েছিল। শাড়ির অর্ডারও দিতে হত অনেক আগে। নয়তো
একরকম এত শাড়ী পাওয়া যেত না।
১৮
কিছু কষ্ট
একানব্বইয়ে গণতান্ত্রিক
সরকার এলে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলেন। প্রথমে তিনি প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতিতে
প্রেসিডেন্ট হলে একক ক্ষমতার অধিকারী হতে চেয়েছিলেন। তাঁর দলও তাই চেয়েছিল, কিন্তু
বিরোধীদলের প্রচন্ড বিরোধিতার মুখে অবশেষে তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন।
আর আগে থেকেই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের
নেতৃত্বে দেশে গণহত্যা ও রাজাকার আলবদরের নেতা গোলাম আজমের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন
দানা বাঁধছিল। ৯২ সালে সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণ আদালত বসিয়ে
নির্যাতিতদের সাক্ষী সাবুদ আর তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে গোলাম আজমকে প্রতীকী ফাঁসি
দেয়া হল।
বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় বিষয় পরচর্চা আর
রাজনীতি। শাহীন কলেজের শিক্ষকরাও শিক্ষিত ও সচেতন সুতরাং আমাদের সবারই নিজস্ব
রাজনৈতিক দর্শন ছিল। তখন চট্টগ্রামে শিবির জামায়াতের দাপট বেশি। চট্টগ্রাম কলেজ,
মহসীন কলেজ এমনকি ভার্সিটিও তাদের একচেটিয়া দখলে। তারপর যারা আছে তারা বিএনপি।
কলেজে পত্রিকা রাখা হত ‘ইনকিলাব’ আর ‘আমার দেশ’। একদিন আমাদের সবার
শ্রদ্ধাভাজন একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে দেখলাম- জাহানারা ইমামকে ‘জাহান্নামের ইমাম’ বলতে বলতে মুখে থুতু
তুলে ফেলছেন। অথচ এঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, সে সময় হয়তো কষ্টও ভোগ করেছেন। কিন্তু
ধর্মের দোহাই দিয়ে গো আজম গং এদের আদর্শ ছিল।
কলেজের পুরস্কারের বই কিনতে গেলে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বাদ দিয়ে আলমাহমুদের
কবিতার বই এবং উপন্যাস কেনার নির্দেশ আসত। আল মাহমুদ, ফররুখ আহমদ কবি হিসেবে
শক্তিমান এ কথা নিঃসন্দেহে। সত্য, এমনকি কবি হিসেবে পশ্চিম বাংলার কবি সাহিত্যিকদের
কাছেও আল মাহমুদ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য পরবর্তীতে কবিতা ও
কথাসাহিত্যে তিনি মানবিকতার চেয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাধান্য দিয়ে নিজের কবি
প্রতিভাকে খাটো করেছেন। অথচ একসময় আমরা ভাষা আন্দোলন ও মাতৃভূমির বন্দনায় আল
মাহমুদের অনেক শ্রেষ্ঠ কবিতা পেয়েছি। যৌবনে ফররুখ এবং আল মাহমুদ দুজনেই ছিলেন সমাজতন্ত্রের সমর্থক। আল
মাহমুদ স্বাধীনতার পর জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচারক পত্রিকা ‘গণকন্ঠে’র সম্পাদক ছিলেন।
কিন্তু তারপরও ‘একাত্তরের
দিনগুলি’ প্রতিবছরই
আমি কয়েক কপি জোর করে নিতাম। বই না পড়লে বই বাছাই করা আরেক ঝামেলার বিষয়। অনেকে
শিরোনাম দেখেই বই কিনেন। এর ফলে একবার ৫ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে পুরস্কার দেয়া
হল আল মাহমুদের ‘পানকৌড়ির
রক্ত’। বইটি আমার পড়া ছিল, তাড়াতাড়ি
যারা কিনেছেন তাদের বললাম, এটা সম্পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্কদের উপন্যাস। তখন বইটি
ছাত্রের কাছ থেকে ফেরত নেয়া হল। আরেকবার ক্বেরাত ও হামদ নাতের পুরস্কারের জন্য
ইসলামী বই কেনা হল। আমি পুরস্কার প্রদানের পর ছাত্রের হাত থেকে বইটা নিয়ে খুলে
দেখি এতে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে যা
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রযোজ্য। আমি বইটি তাকে ফেরত না দিয়ে পরে বইকেনা কমিটির
একজনকে বললাম বইটি বদলে দিতে। অবশ্য আমরা দেখে শুনে ভাল বই কেনার চেষ্টা করতাম।
এটা দেখে দোকানের সেলসম্যান বলত অন্য স্কুলের শিক্ষকরা বই কিনতে এসে নিজেদের কমিশন
চান, আর আপনারা শুধু ভাল বই চান। জানি না তার কথা কতটুকু সত্য।
এই বই কেনার জন্য আমি বইমেলা,
পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিনের আপডেট খবর রাখতাম, প্রকাশকদের ক্যাটালগ সংগ্রহ করতাম।
কি যে ভাল লাগত দোকানে গিয়ে বইয়ের তাকে বই খুঁজতে। হায়! কোথায় হারালো সেই দিনগুলি!
১৯
ক্লাস নেয়া
শিক্ষকতার সবচেয়ে
বিরক্তিকর দিক হচ্ছে উত্তরপত্র নিরীক্ষণ এবং সবচেয়ে আনন্দদায়ক হচ্ছে শ্রেণীকক্ষে
পাঠদান। আমার মনে হয় একজন শিক্ষকের স্বাধীনতা, স্বতঃস্ফুর্ততা ও প্রকৃত আনন্দ শ্রেণীকক্ষে
পাঠদানে। সত্যিকারের শিক্ষক এতে যে আনন্দ পান এবং শিক্ষার্থীদের শেখাতে শেখাতে জ্ঞানভান্ডারে
প্রবেশের যে চাবিটি হাতে পান তা যুগপৎ তাকে এবং শিক্ষার্থীদের সমৃদ্ধ করে।
শাহীনের ৪০ পূর্তিতে ‘স্মরণিকা’য় শ্রদ্ধেয় মজিদ স্যার বলেছেন, আমি অনেক সময়ই
পড়াতে পড়াতে সিলেবাসের বাইরে চলে যেতাম। কথাটা সত্যি। কিন্তু সাহিত্য
এমন এক বিষয় এবং এর যে বিশাল ভান্ডার তাকি ৫টা কবিতা কিংবা ৫টা গদ্যের সিলেবাসে
কুলায়! পৃথিবীর এমন কোন বিষয় আছে যা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত নয়। প্রাচীন কালের
রূপকথা থেকে আধুনিক কালের কল্পবিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, চিত্রশিল্প, চলচ্চিত্র,
খেলাধুলা, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম কোন বিষয় সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত নয়? সাহিত্যের
অন্তরালে যে কবি-লেখক তাঁর জীবন-সত্য না জানলে সাহিত্যের মর্মকথা বুঝবো কিভাবে।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এক লেখায় পড়েছিলাম তিনি কখনও সিলেবাস ফলো করে
পড়াননি অথচ তাঁর ক্লাসে তাঁর প্রাক্তন ছাত্র যারা বুয়েট অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত
তারাও মাঝে মাঝে ঢাকা কলেজে হানা দিত।
যদি প্রশ্ন করা হয়, শিক্ষকের কাজ কি?
তাহলে আমি বলব শিক্ষার্থীর মন ও মস্তিষ্ককে উদ্বোধিত করা। আর আচার-আচরণ, ব্যবহারে
শালীনতার ও সততার প্রশিক্ষণ দেয়া। বিবেক জাগিয়ে তোলা, যাতে সে নিজেই নিজের বাতিঘর
হতে পারে। এক্ষেত্রে সাহিত্যের চেয়ে বড়ো মাধ্যম আর কিছু নেই।
“তাহারেই পড়ে মনে” পড়াতে গিয়ে
কবির জীবনের অন্তর্নিহিত কষ্ট যদি আমরা অনুভব না করি তাহলে কবিতাটির পাঠদান কি সফল
হবে! “যৌবনের গান” পড়ানোর সময় নজরুলের
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর স্বশিক্ষিত হওয়ার কথা যদি না বলি তাহলে বিষয়টা কি
অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে না!
শিক্ষার্থীর হৃদয়ে আবেগ সঞ্চারিত হলে সে
নিজেই পথ খুঁজে নেবে। ‘সময়ের
প্রয়োজনে’ গল্পে
মুক্তিযুদ্ধের খন্ডচিত্রের অন্তরালে যে বিশালতা নিস্তব্ধ হয়ে আছে তাকে তা জানাতে
এবং বোঝাতে হবে আমাকে। এই বিশাল বিষয়গুলো আমাকে যেমন আলোড়িত করত আমি চাইতাম তারাও
সে আলোড়নে সংক্রামিত হোক। কারণ আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, বিজয় দেখেছি। কিন্তু ওরা
কিছু দেখেনি, ওদের জানানোর দায়িত্বতো আমার/আমাদের যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। কিন্তু
এমন কপাল ৯১-এর সরকার পাঠ্যসূচী থেকে গল্পটা বাদ দিয়ে দিল। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ওপর
লেখা গল্পের মধ্যে এটি শ্রেষ্ঠতম একটি। তবু, আমি সুযোগ পেলে গল্পটি ক্লাসে ৯ম-১০ম
শ্রেণীতে পড়ে শোনাতাম।
বিজ্ঞানের শিক্ষকরা সূত্র মুখস্থ করান,
কার্যকারণ বোঝান, কিন্তু বলেন না একজন বিজ্ঞানী কি কষ্টকর সাধনায় তার লক্ষ্য অর্জন
করেছেন। সক্রেটিস, গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস, হেরাডোটাস, আইনস্টাইন, ফাইনম্যান, পল
ডিরাক, জগদীশ বসু, সত্যেন বসু, স্টিফেন হকিং, পিয়ের কুরি ও মাদাম কুরি এদের জীবনে
বিজ্ঞানসাধনায় শাসক এবং পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে কি লড়াই ছিল সেটা না জানলে
শিক্ষা কি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে না!
আমার ক্লাসে সুযোগ পেলে শিক্ষার্থীরা
গল্প শুনতে চাইত। আমিও চেষ্টা করতাম যতটা উপভোগ্য করে পরিবেশন করা যায়। সেটা কেজি
ক্লাসে কেজির মত আবার কলেজে কলেজের মত। আর তাৎক্ষণিক কৌতুক। যেমন-ক্লাসে কেউ কথা
বলছে দেখলে তাকে বলতাম, ‘কথা বললে
ফ্যানের সাথে বেঁধে দেব তারপর বুঝবে মজা’। অথবা ‘মাথাটা পিছন
দিকে এমন করে ঘুরিয়ে দেব যে ভূতের মত উলটা দিকে হাঁটবে-এসব শুনে ছেলে-মেয়েরা মুখ
টিপে হাসত। আমিও হাসতাম মনে মনে।
তবে যেদিন সত্যি রেগে যেতাম সেদিন এমন
ঝাড়ি দিতাম পুরো ক্লাস মাথা নিচু করে বসে থাকত। ঘন্টা পড়লে আমি বেরিয়ে আসতাম। তখনও
ওরা চুপ। কিন্তু একা একজনকে বকা সাধারণত দিতাম না যাতে সে বন্ধুদের সামনে নিজেকে
ছোট মনে করে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা বাইরে যতো ঝাঁঝালো বুলি আওড়াতাম ভেতরে আমি তত কোমলতায়
ভেঙে পড়তাম। তারপর ওরা ভুলে যেত, আর অনুতাপে আমার রাতের ঘুম হারাম।
No comments:
Post a Comment