Thursday, 27 February 2025

রিফাৎ আরার 'চট্টগ্রাম শাহীনের স্মৃতিময় দিনগুলি' - পর্ব ১

 


 

মোবাইল ফোনটা বেজেই চলেছে গত কয়েকদিন থেকে এর কোন বিরাম নেই। আর ফোন বাজলেই আমিও বুঝে যাই কে বা কারা করেছে। করছে শাহীনের ছাত্র-ছাত্রীরা। সবার এক কথা, ম্যাডাম, গতবার আপনাকে পাইনি এবার আসছেন তো! আমি বলি- আসব না মানে। এবার আমায় বাঁধবে কে রে, সেই বাঁধন কি কারো আছে।

          সঙ্গে আছে আমার প্রাণের দোসর, বন্ধু, কন্যাসম আমার প্রিয় ছোটবোনটি মলি নুসরাত হক। আমার কিছুটা অচল শরীরে সে আমার অন্ধের যষ্টি। যদিও এ অচলতাকে আমি থোড়াই কেয়ার করি। তবু যখন ভ্রমণে বা কোন কিছুতে বাম পা-টা মুচড়ে উল্টোদিকে ঘুরে যেতে চায় তখন আমি ভীষণ অসহায় বোধ করি। সেই মুহূর্তের কষ্টে সঙ্গী লাগে। দাঁড়িয়ে, বসে নানাভাবে কসরৎ করে এ কষ্ট একসময় কমে আসে। তাই ভ্রমণে সঙ্গী আমার অপরিহার্য।

          একেকটা ফোন আসে, আর অসংখ্য স্মৃতি এলোমেলো মনে আসে যার একটার সাথে আরেকটার কোন যোগসূত্র নেই, তবু তারা ভেসে আসে আবার ভেসে যায়। মনে পড়ে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর কথা যারা আমার সন্তানতুল্য।

          ১৯৮৫ সালে যখন প্রথম পড়াতে শুরু করি তখন বয়স একটু বেশি হলেও কর্মজীবনে আমি নবীন। সহকর্মীরা দু-একজন বয়সে কিছুটা বড় হলেও অন্যরা আমরা প্রায় সমবয়সী ছিলাম এবং তাদের চেয়ে আমি কিছুটা বয়সী ছিলাম। আমাদের সেই শাহীন পরিবারে পরম প্রীতি-সৌহার্দে রঙিন ছিল আমাদের সে দিনগুলো।

          তবে সবচেয়ে বেশি যারা আমাকে হাসায় কাঁদায় তারা আমার ছাত্র-ছাত্রী। তারা আমার পরম ভালবাসার ধন। বর্তমানে ফেসবুকের কল্যাণে অনেককে খুঁজে পেয়েছি, যাদের সাথে বহুদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। ছাব্বিশ বছরে কত হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী সবার কথা মনে থাকার কথা নয়, যোগাযোগ রাখাও সম্ভব নয়।

          তবুও নীলু আক্তার যখন আমেরিকা থেকে ফোন করে তখন মনে হয় এই বুঝি সেদিন ওরা শাহীনে ছিল। অথচ এখন সে শাশুড়ি।

          ইকবাল প্রথম ব্যাচের ছাত্র। দুষ্টু ছিল। আমিও ক্লাস কন্ট্রোলে কড়া ছিলাম। আমার তির্যক বাক্য তার পছন্দ ছিল না। এখন ইকবালের সাথে আমাদের সম্পর্ক পারিবারিক। কারণ মহসীন, কাজল, হাসিনা তারা সবাই আমাদের ছাত্র।

          নাসরীন- ডাক্তার নাসরীন সুলতানা যার অন্তরে আমার বসবাস। মাঝে মাঝে আসে, বেশি কথা বলে না। আমি বলি সে শুনে। কিন্তু আমি বুঝি, তার মনেও অনেক কথা। আমার জন্য বই, নাতি নাতনীর জন্য খেলনা, নিজের হাতে বানানো খাবার, ফুল কি না আনে সে। কন্যাসম এই মেয়েটির কল্যাণে আমি মনে মনে প্রার্থনা করি ভালো থাকো মেয়ে।

          নাসির উদ্দীন শামীম কর্তমানে বাজিতপুর মেডিক্যালে ডেন্টিস্ট হিসেবে আছে। ক্লাস সেভেনে মাকে হারিয়ে খালার কাছে মানুষ। আমি তার ক্লাস টিচার ছিলাম। কৈশোরক আবেগে সে চাইত আমি তার রিপোর্ট কার্ডে সাইন করি। আমার মেয়েদের ছোটভাই নাসির, সাথে লালন।

          প্রথম রিইউনিয়নের আগে হঠাৎ একদিন এইচ এস সি ১৯৯১ ব্যাচের কিছু ছাত্রী আর একজন ছাত্র মিজান এলো। মেয়েরা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মিজান অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।

          রুমানা শিউলি (ডাক্তার), গুলশান, রওনক (জাপান প্রবাসী) এক দুপুরে ফুলের তোড়া আর বিশাল কেক নিয়ে হাজির, তারা আমাকে নিয়ে বাইরে খেতে যাবে। এখন ওদের সাথে আমার সম্পর্কটা শুধু ছাত্র-শিক্ষক এর নয় বন্ধুত্বের পর্যায়ে চলে গেছেকারণ তারাও পরিণত। তাই ফেসবুকে গুলশানের বাগানের ফুল দেখে আমি আনন্দিত হই। রওনক বেবী সুদূর জাপানে বসে বাংলার প্রকৃতি নিয়ে কবিতা লেখে, জলরঙে অপূর্ব ছবি আঁকে, গান করে। আমি অবাক হই এত গুণ একজন মানুষের! অসুস্থ মাকে দেখতে প্রায়ই দেশে আসে তখন আমাকে না দেখে যায় না।

          শামসুল আলম- শৈশবে পিতৃমাতৃহারা। বড়বোনের তত্ত্বাবধানে থেকে লেখাপড়া করেছে। এখন সরকারী কর্মকর্তা। সাভারে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং-এ এসে একদিন ফোন করল, ম্যাডাম, আপনার সাথে দেখা করতে চাই।

          বললাম, এসো।

          এক সন্ধ্যায় দরজা খুলতে দেখি সহজ-সরল একটি মুখ। একহাতে মিষ্টির প্যাকেট, আরেক হাতে অজস্র লাল গোলাপ নিয়ে বিব্রত অথচ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।

          ভিতরে এসে বলল, ম্যাডাম এই গোলাপগুলো সাভারের গোলাপবাগান থেকে আমি নিজে আপনার জন্য তুলে এনেছি। টকটকে লাল গোলাপ, সংখ্যা কত হবে শখানেকও হতে পারে। ডালের গায়ে কাঁটা আছে। আমার ইচ্ছে করছে মাতৃস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরি। অশ্রুপাত করে আনন্দিত হই। এখনো মনে পড়লে মনে হয়, মৃত্যুর পরও এই স্মৃতি আমার চোখ থেকে মুছে যাবে না।

          ফারজানা ববি- দৃঢ়চেতা একটি মেয়ে। ভাল বিতার্কিক ছিল। ওর স্বভাবের দৃঢ়তায় আমার মনে হত সে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখে। হাতের মেহেদীর রঙ মোছার আগে প্রেমিক-স্বামীকে হারিয়ে অপার দুঃখের সমুদ্রে ডুবে গেল। কিন্তু আমার বিশ্বাস একদিন সে নিজেকে আবার তৈরি করবে নতুন দিনের জন্য।

          সিলেট যাব। চা বাগানে বেড়ানোর শখ। প্রবাসাগত বড় মেয়ে, ছোট মেয়েসহ সপরিবারে শ্রীমঙ্গলে গেলাম। কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র শাজাদ সরওয়ার মুন্না ফিনলের একটি চা বাগানের এ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার। যোগাযোগ করলাম। তার এবং তার জীবনসঙ্গী তানিয়ার আতিথ্যে বাংলোয় বেড়ালাম। বুড়ো বয়সে দোলনায় চড়লাম। মনের কি বয়স বাড়ে। মুন্না তার গাড়িতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো চা বাগান, ক্লাব, খেলার মাঠ সব দেখাল। প্রথম দেখাতেই তানিয়াকে মনে হল অনেকদিনের চেনা। নাতি-নাতনীরা অনেক মজা করল। নুসরাত মলি তার বন্ধু, ভেবেছি ওর সাথে আবার যাব।

          হেদায়াত মলির সাথে বন্ধুত্বের সূত্রে আমার বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করত। নূর-ই-আকবর, কন্দর্প, হেদায়াত, সেলিনা, রাবেয়া এরা ছিল আমার বাচ্চাদের মামা-খালা।

          নাজমুল হক এখন বড় আমলা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে আছে। কখনো ফোন করে, কখনো দেখা করে যেত। আশ্চর্য মায়া এই ছেলেটার আমার জন্য।

          দুষ্টু যে পিন্টু, সাংবাদিক নূরে আলম - তার কল্যাণে বইমেলায় আমার বই সম্পর্কে মিডিয়াতে কিছু বলার সুযোগ হয়েছে।

          বহুদিন পর দেখে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল তাহমিনা তারান্নুম সোমা।

          রি-ইউনিয়নের আগে এক রেস্তোরাঁয় ছাত্র-ছাত্রীরা একত্রিত হয়েছিল। জাওয়াদ আলী- আমাদের ছাত্র জাওয়াদ বলেছিল, ম্যাডাম, আপনি প্রথমদিন আমাদের ক্লাসে এসেছিলেন একটা সবুজ শাড়ী পরে। সেই ১৯৮৫ সালে। ২০১৬তে এ কথা শুনে আরেকজন ছাত্র কাফি কবির বিস্মিত কণ্ঠে কয়েকবার আউড়ে ছিলাম - এত দিন পরও মনে আছে!

          এরকম অজস্র স্মৃতি। একসময়ে যখন চিঠি লেখার প্রচলন ছিল তখন অন্যত্র পোস্টিং হলে কত ছেলে-মেয়ে চিঠি লিখত। আমার দুর্ভাগ্য নানা দুর্যোগে সেসব চিঠি হারিয়ে ফেলেছি। আমার জীবনে এসবই পরম সম্পদ!

          আমাদের দিলরুবা ম্যাডাম বলত আমার মাঝে নাকি একটা motherly ভাব আছে সেজন্য ছেলেমেয়েরা আমাকে এত ভালবাসে

          কিন্তু এত স্মৃতির মাঝেও বার বার ফিরে ফিরে আসে ১৯৮৫ সালের ১ জুলাইয়ের কথা যেদিন আমি আমার জীবনের পরম তীর্থে পৌঁছেছিলাম। 

*****



No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিশ্ব নারী দিবস ২০২৫

  এবছরও ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০২৫ সালের নারী দিবসের মূল স্লোগান – For All women and girls: Rights, Equality and Emp...

Popular Posts