৮
সাইক্লোন শেল্টার
১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড় ও
জলোচ্ছ্বাসের পর সরকার উপকূলীয় এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার তৈরির উদ্যোগ নিল। এতে
বিদেশী বিশেষত সৌদি আরব (যতটুকু জানি) প্রচুর সাহায্য দিয়েছিল। বেশিরভাগ ঘূর্ণিঝড়
আশ্রয় কেন্দ্রের নিচতলা খালি রেখে পিলারের উপর থেকে দোতলা করা হয়। কিন্তু
বিমানবাহিনীর উদ্যোগে ঘাঁটি অভ্যন্তরে এমবারকেশান ইউনিটের কাছাকাছি রিক্রুটস
ট্রেনিং সেন্টার অর্থাৎ তৎকালীন ফ্যালকন ও ঈগল টাওয়ারের অপর পাশে স্থান নির্ধারণ
করা হল সাইক্লোন শেল্টারের এবং সিদ্ধান্ত হল এটি (মূলত) শাহীন কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত
হবে এবং ঝড়ের সময় সাইক্লোন শেল্টার হিসেবে ঘাঁটি এবং আশেপাশের জনগণের আশ্রয়স্থল
হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
তখন আমাদের অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ। ৯৩ সালে
তিনি জয়েন করেছেন। বয়সে তরুণ তুর্কী কাজেও তাই। সত্যি বলতে কি কাজ করতেন, করাতেন।
তবে শিক্ষকদের সবসময় এমন টেনশানে রাখতেন যে আমার মাঝে মাঝে মনে হতো সহিস যেমন
ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে তাকে দৌড়াতে বাধ্য করে, আর দৌড়াতে দৌড়াতে তার দু'কষ বেয়ে
ফেনা গড়িয়ে পড়ে উনিও তেমনি করে দাবড়ানোর মধ্যে রাখতেন শিক্ষকদের। তবে অকপটে
স্বীকার করছি আমাদের মত সিনিয়র শিক্ষকদের সম্মানও করতেন। কোন সমস্যার পরামর্শ
নিতেন। সবচেয়ে বড়ো গুণ ছিল তাঁর ক্যারিশমাটিক আচরণ দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মুগ্ধ
করতেন। তারা তাঁকে যেমন ভয় পেত তেমনি সমীহ ও পছন্দ করত। তিনি চলে যাওয়ার অনেকদিন
পরও বাংলা দ্বিতীয়পত্রে প্রধান শিক্ষকের বিদায় অভিনন্দনপত্রে শিক্ষার্থীরা তার নাম
লিখত।
ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য উৎসাহ
দিতেন। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। তাঁর প্রথম কর্মক্ষেত্র সম্ভবত পাবনা ক্যাডেট কলেজ
হওয়াতে চলা বলায় তিনি অত্যন্ত চৌকষ ছিলেন। তাঁর সময়ে আমাদের কলেজ এবং স্কুল শাখায়
দু-তিনজন ছাত্রী বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছিল। এদের একজন নাসরীন সুলতানা যে এখন ঢাকা
মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটের রেজিস্টার, একজন মানবিক শাখার রওশন আরা বর্তমানে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষিকা, আরেকজন সুলতানা রাজিয়া বর্তমানে
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।
আমার বড় মেয়ে সানজিদা নাসিম রাকা ভাল
ছাত্রী হওয়াতে তিনি তাকেও যথেষ্ট স্নেহ করতেন। তার রেজাল্টের পরপরই তার জন্য গিফট
নিয়ে বাসায় এসেছিলেন। এর কারণ তাকে নিয়েও তিনি আশা করেছিলেন বোর্ডে প্লেস পাবে।
স্বভাবতই রেজাল্টের পর সে খুব কান্নাকাটি করছিল। কলেজের সব শিক্ষকরা তার শান্ত
আচরণের জন্য তাকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। তাই তার মন ভাল করার জন্য
ম্যাডামদের অনেকেই কিছু না কিছু গিফট দিয়েছিলেন। বাবা-মা হিসেবে আমাদের এই
ফলাফলে কোন ক্ষোভ ছিল না। কারণ আমরা জানি সে লেখাপড়া করেছে, বেসিক ভাল সুতরাং
ভবিষ্যতে ভাল করবেই। কিন্তু সন্তানের চোখে পানি যখন অঝোর ধারায় ঝরে তখন মনকে বুঝ
দেয়া বড়ো কষ্টের। আমরা আনন্দিত, এটা বোঝাবার জন্য সবাইকে মিষ্টি বিলাই, ওকে নিয়ে
বেড়াতে যাই। কিন্তু তার মন ভাল করতে পারি না। মার্কশিট আসার পর দেখা গেল আমাদের
আরেক ছাত্রী নুরুন নাহার খানম রুবা এবং রাকা কয়েক নম্বরের জন্য প্লেস মিস করেছে। এখন রুবা
ডাক্তার, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এবং রাকা বুয়েট থেকে ট্রিপল-ই তে গ্রাজুয়েশন করে
অস্ট্রেলিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা।
স্মৃতি মনে হয় নদীর মতো কখন কোন পথে যায়
সে জানে না। যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তার থেকে দূরে সরে এসেছি।
সত্যিকার অর্থে মজিদ স্যার ছিলেন
ডাইনামিক এবং যুগপৎ কিছুটা অস্থিরচিত্ত। তিনি ক্যাডেট কলেজ থেকে ‘ঢাকা ন্যাশনাল ব্যাংক
স্কুল এন্ড কলেজ থেকে চট্টগ্রাম শাহীনে এসেছিলেন ১৫-৮-৯৩ সালে এবং মধ্যপ্রাচ্যের
দুবাই বা আবুধাবীর বাংলা স্কুলে অধ্যক্ষের চাকরি নিয়ে চলে যান ১৬-১২-৯৫তে। এর পেছনে
অবশ্য একটা বিশেষ কারণও ছিল। স্বাধীনচেতা বা ব্যক্তিত্ববান অধ্যক্ষদের বিমানবাহিনী
কর্তৃপক্ষ খুব একটা ভাল চোখে দেখতেন না। তাঁরা চাইতেন সবকিছু তাঁদের কর্তৃত্বে
চলবে। আবার স্যার ছিলেন অস্থিরচিত্ত। তিনি জাম্প দিতে পছন্দ করতেন।
দু-তিন বছর পরে বিদেশ থেকে এসে আবার
শাহীনে অধ্যক্ষের চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিয়ে মনোনীত হয়েছিলেন। এ সংবাদে শিক্ষকদের
মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ কারণে অকারণে শিক্ষকদের সর্বসমক্ষে অপদস্থ করতেও
তিনি ছাড়তেন না। তাঁর সময়ে আমাদের রসায়ন শিক্ষক সুপালদা এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞানের
প্রভাষক শাহনাজ ইসলাম চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এমন কি তৎকালীন উপাধ্যক্ষ আখতারুননেসা
ম্যাডামও পার্সোনালিটি ক্ল্যাশের কারণে চাকরি ছেড়ে দেন।
তারপরও এ সত্য স্বীকার করতেই হবে তাঁর
সময়ে চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার শাহীন কলেজের সুনাম এবং পরিচিতি বৃদ্ধি
পেয়েছিল। এখন স্যারও পরিণত বয়সের পরিপক্কতায় বহুদিন ‘কর্ণফুলি ইউরিয়া ফার্টিলাইজার স্কুল এন্ড
কলেজে’ থিতু
হয়েছেন।
সাইক্লোন শেল্টারের ভিত্তি স্থাপন করতে
এলেন তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী ব্যারিস্টার জমির উদ্দীন সরকার। মন্ত্রী আসবেন,
সুতরাং তোড়জোড়। বিমানবাহিনীর ঘাঁটিস্থ
উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তটস্থ । প্রতিটি কাজে ঘাঁটি অধিনায়ক, প্রশাসনিক
অধিনায়ক, সিকিউরিটি অফিসার, ফিল্ড ইউনিট তদারকিতে ব্যস্ত। আমি অনুষ্ঠান ঘোষণায় আছি
তাই কলেজ ছুটির পর বেশ কয়েকদিন বিকালে গিয়ে রিহার্সাল করতে হত। আমার সাথে থাকতেন
হোসনে আরা ম্যাডাম। আমরা তখন এক লম্বু আর এক বাটকু মানিকজোড় হয়েই সর্বত্র ঘুরে
বেড়াতাম। অবশেষে তিনি এলেন ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন হল। এবার ভবন তৈরির পালা।
১৯৯৬এ এয়ার ভাইস মার্শাল জামাল উদ্দিন,
পি এস সি, এন ডি সি নতুন দোতলা ভবন উদ্বোধন করলেন। ঈগল আকৃতির এ ভবনটি দোতলা
হওয়াতে এখানেও স্কুল কলেজ মিলিয়ে স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। তাই স্কুলের ক্লাস থ্রি (তৃতীয় শ্রেণি) পর্যন্ত পুরনো
ভবনে রয়ে গেল। নতুন ভবনের দোতলায় অফিস, বিজ্ঞান বিষয়ের ল্যাব, শিক্ষকদের কমন
রুম, এবং অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের অফিস। এটা করা হল সাবধানতার জন্য
যাতে সাইক্লোন হলেও এগুলো নিরাপদে থাকে। অধ্যক্ষের অভাবে কিছুদিন
বিমানবাহিনীর উইংকমান্ডার পদের পদস্থ অফিসাররা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন
করেছিলেন। তাঁরা নিজেদের অফিস করার ফাঁকে কলেজে এসে একবার ঘুরে যেতেন।
মজিদ স্যার আসবেন শোনা গেলেও শেষ
পর্যন্ত তিনি আসেননি। এবার এলেন মোয়াজ্জেম হোসেন নামের জনৈক শিক্ষক। তিনি ফরিদপুর
বা এরকম কোথাও অধ্যক্ষ ছিলেন। প্রথম দিন পরিচয়ের মিটিং-এ তাঁর কথাবার্তা শুনে আমরা
উৎফুল্ল হলাম। মনে হল শিক্ষকদের প্রতি তিনি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল হবেন। একবার এক
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জানালেন তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমিতো মহাখুশি। ঘোষণায় বার
বার ছাত্র-ছাত্রীদের বললাম ‘তোমাদের সৌভাগ্য একজন মুক্তিযোদ্ধাকে অধ্যক্ষ হিসেবে পেয়েছ’। তারাও আনন্দে
হাততালি দিল। এবার তাঁর বক্তৃতার পালা।
হায় কপাল! তিনি শুরু করলেন তো করলেন- আর
শেষ করেন না। কন্ঠস্বরে কোন ওঠানামা নেই, একঘেঁয়ে বলেই চলেছেন নিজের একক কৃতিত্বের
কথা। যেন তিনি একাই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ছেলে-মেয়েরা হৈ-হট্টগোলে মেতেছে। আমি
ছাত্র-ছাত্রীদের ইশারা দিলাম বার বার হাততালি দিতে। কিন্তু বক্তৃতাতো শেষ হয় না।
সেদিন যে সবার কি বিরক্তির উদ্রেক ঘটেছিল তা বলার নয়।
কোন কোন মানুষের স্বরূপ বা তার চরিত্রের
সুলুক-সন্ধান সহজে জানা বা বোঝা যায় না। আমরাও প্রথমে আমাদের এই অধ্যক্ষের স্বরূপ
চিনতে পারিনি। প্রথমেই তিনি তার অপদার্থ পুত্রটিকে কলেজের স্কুল শাখায় ভর্তি করিয়ে
বিভিন্ন পরীক্ষা পাশ করাতে বাধ্য করলেন।
তখন কলেজে SSC ও HSC পরীক্ষার সেন্টার ছিল। তার মেয়ে HSC পরীক্ষা দেবে
সুতরাং বিষয় শিক্ষকদের তার হলে পরিদর্শক নিযুক্ত করা হল তাকে সাহায্য করার জন্য। মেয়েটি ভাল ছাত্রী
ছিল। তার বাবা এসব
না করলেও সে ভাল করত। শুনেছি উচ্চতর শিক্ষায় সে ফরিদপুর মেডিকেলে ভর্তি
হয়েছিল। ছেলেটিকেও এভাবে পাশ করিয়ে নিয়ে গেল।
এখানে শাহীন কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্র
সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। সম্ভবত ১৯৮৯ সাল থেকে প্রথমে প্র্যাকটিক্যাল
পরীক্ষা কলেজে নেয়ার জন্য সেন্টার নেয়া হয়েছিল। এর কারণ চট্টগ্রাম কলেজে সিট পড়ার
কারণে যাতায়াত কষ্টসাধ্য ছিল। সেসময় যিনি অধ্যক্ষ ছিলেন তিনিও তাঁর বিজ্ঞান শাখায়
পরীক্ষার্থী মেয়ের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার পূর্ণ নম্বর নিশ্চিত করার জন্যই এটি
করেছিলেন। তখনও নেভী কলেজ স্কুল ছিল কলেজ হয়নি। এছাড়া শাহীনের ইমেজের কারণে তখন
সহজেই বোর্ডের অনুমোদন পাওয়া যেত। পরে আমাদের ছাত্রদের নিয়েই আমাদের সেন্টার চালু
ছিল। আশেপাশের দু-একটি স্কুল কাছে হওয়ার কারণে তারাও আমাদের সেন্টারে
ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিল, কিন্তু ঘাঁটি কর্তৃপক্ষ ঘাঁটির
নিরাপত্তার কথা ভেবে রাজী হননি। এর ফলে আমাদের পরীক্ষার্থীরা একচেটিয়া পরীক্ষা
দেয়ার সুযোগ পেল।
সুযোগের কথা বললাম এ জন্যে, শিক্ষকদের
উপর অধ্যক্ষের মৌখিক নির্দেশ ছিল যেদিন যার বিষয়ে পরীক্ষা হবে সেদিন সেই হলে হলে
গিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র বুঝিয়ে দিতে হবে, প্রয়োজনে সাহায্যও করতে হবে।
বিশেষভাবে বাংলা ২য় পত্র, ইংরেজি এবং বিজ্ঞান শিক্ষকদের এ বিষয়ে কড়া নির্দেশ দেয়া
হত। কিন্তু এটা সত্যি, ফারুকী স্যার (আবদুস সোবহান ফারুকী) ও আমাকে কোন অধ্যক্ষই এ
বিষয়ে অনুরোধ করেননি। আবার কিছু ভাল ছাত্রী এটা নিয়ে আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ
করেছিল। এ অনৈতিকতাকে তারা সমর্থন করতে পারেনি। এদের একজন নাসরীন সুলতানা এবং
অন্যজন সায়মা লিজা। বর্তমানে এরা দুজনেই ডাক্তার।
মোয়াজ্জেম হোসেন এসে প্রথমেই যে
দুর্নীতিটা করলেন সেটা ভর্তি বাণিজ্য। টাকা নিয়ে সিভিলিয়ান কিছু ধনীপুত্রকে ভর্তি
করালেন যারা লেখাপড়ায় মোটেও ভাল ছিল না। চক্ষুলজ্জার খাতিরে নাম বলছি না। এ কাজে
তার সঙ্গী ছিলেন আমাদের দু-একজন শিক্ষক। (বিশেষত একজন)।
এই সময় চট্টগ্রাম বোর্ডে একটি ঘটনা
ঘটেছিল। ক্যান্ট-পাবলিকের এক ছাত্র টেস্টে খুব খারাপ করে শিক্ষকদের যোগসাজশে
কিভাবে যেন ফাইনাল পরীক্ষার সুযোগ পেয়েছিল। পরে পরীক্ষক এবং তার প্রতিষ্ঠানের কিছু
শিক্ষকের সহায়তায় সে বোর্ডে ২য় স্থান পেয়েছিল। সম্ভবত তার মূল উত্তরপত্র বদল করে
তাকে বোর্ডে স্ট্যান্ড দেখানো হয় এবং রেজাল্টের পরপরই সে অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। এটা
নিয়ে নানা আপত্তি উঠতে থাকলে আমাদের অধ্যক্ষ মোয়াজ্জেম হোসেন ও অন্যান্যদের নিয়ে
তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং সেখানেও দুনম্বরী করাতে তাঁকে বাসায় কয়েকদিন অন্তরীন
রেখে বরখাস্ত করা হয়। এমন অবস্থা করা হয়েছিল তাকে ফোনেও তার কন্যার সাথে কথা বলতে
দেয়া হয়নি। সেই সাথে আমাদের পরীক্ষার সেন্টারও বাতিল হয়ে যায়।
No comments:
Post a Comment