Friday, 21 February 2025

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ১৫

 -----------------------------------

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫

___________________________________

১৫

 

" মনা, মনারে কই গেলি, আমারে একটু চিলমচিটা তুইলা দে আমার বড় পেশাব লাগছে বইন না তোর আল্লার দোহাই লাগে ক্যাতাখান ভিজা গেলে হারাডা রাইত ঠান্ডায় কাডাইতে অইব তোর মা আমারে গাইল দিয়া কিচ্ছু রাখব না মনা, বইন আমার"

          কিন্তু মনার কোন সাড়াশব্দ নাই ঘরে মানুষ আছে বলে মনে না একটা টিমটিমে চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব ঘরের অন্ধকারটা দূর করতে না পেরে এক ধরনের রুগ্নভাব ছড়াচ্ছে

          নব্বইয়ের মত বয়স হয়েছে মনজিলা বিবির ভাল করে চোখে দেখে না আবছা দৃষ্টিতে মানুষের ছায়াগুলো তার চোখের সামনে নাচানাচি করে সেই কবে বহুবছর আগে চোখে ছানি ড়েছিল তখন বড়বিবি আর ছোটবিবি দু'জনই ছিল পোলারে ডাইক্যা ট্যাকা-পইসা দিয়া হেরা শহরের হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা করাইয়া আনছিল কিন্তু আইজ 'বছর আবার ঝাপসা অইয়া গেছে চোখের জ্যোতি কারো সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারে না হাঁটা বলতে মাঝে মাঝে নাতনি মনার কাঁধে হাত দিয়ে উঠানের আমগাছটার তলায় বসা দু-চারদিন পর পর গোসল করা বৌ তো সহ্যই করতে পারে না ছেলেডা বয়স অইয়া গেছে কিছু তেমন করতে পারে না

          মনা চৌধুরী বাড়িতে ঘরে সে ঘরে কাজ করে কোন মতে চলে মনার ভাই জোয়ান পোলাডা পাগল অইয়া নিরুদ্দেশ হওনের পর বৌয়ের জ্বালানি আরো বাইড়া গেছে কেবলই বলে, "বুড়ি, আমার জোয়ান পোলা নিরুদ্দেশ হইল আর তুই মরস না"

          দিনের মইদ্যে কতবার যে কয়, "বুড়ি মর, মর, মর" মনজিলাওতো মরতে চায় কিন্তু মরণ কি সবার ভাইগ্যে আছে? শরীরে শক্তি থাকলে কবেই নদীতে গিয়া ঝাঁপ দিত

          " মনা" মনজিলা মাচার উপর চারপাশ হাতড়াতে হাতড়াতে আবার ডাকে " বউ, বউরে, আমারে একটু চিলমচিটা আগাইয়া দে আমিতো হাতের নাগালে পাই না" বলতে বলতে উপুড় হয়ে চিলমচিটা নেবার জন্য নিচে হাত বাড়ায় কিন্তু হাতের ধাক্কায় প্লাস্টিকের বদনা উলটে মাচার নিচে পানি ছড়িয়ে পড়ে পানি গায়ে পড়ায় হাঁস-মোরগ আর ছাগল দুটো নিজের নিজের ভাষায় ট্যাঁ ভ্যাঁ করে উঠে এমন সময় ঘরের ঝাঁপ খুলে ঢুকে মনা

          "কে কে?"

          "কে অইব আর আমি ঘরে নি কিছু আছে যে চোর আইব?"

          ", তুই তুই আইছস মনা এতক্ষণ তোরে কত ডাক পাড়ছি সারাবাড়ি এমন চুপচাপ মনে অয় মরা মানুষও নাই"

          "মরা মানুষ নাই তো কি অইছে তুমি তো আছ"

          ", আমারেতো যমেও দ্যাখে না হাপেও কাডে না আমার মরণ নাইরে মনা"

          এবার না একটু নরম হয় এই বুড়ি দাদীর জন্য ছোটবেলা থেকে তার একটু বেশি মায়া এজন্য মায়ের কাছে কম কথা শুনতে হয় না অলক্ষ্মী বুড়ির জন্য এত মায়া যে দেখায় তারও নাকি অলক্ষ্ণীর কপাল হয় কিন্তু মনা পারে না দাদীর কাছে এসে বলে, "তা অইছে তোমারে না সাইনঝা বেলায় ভাত খাওয়াইয়া গেলাম আবার ভুক লাগছে?"

          "নারে মনা পেশাব ধরছে"

          চিলমচিটা তুলে এনে দাদিকে ধরে বসাতে গিয়ে দেখে কাঁথা ভিজা " দাদী, তুমিতো পেশাব কইরা দিছ হায় হায় অহন আমি ক্যাঁতা পামু কই দেখি দেখি কাপড় খোল"

          শুকনো কাপড়টা গায়ে জড়িয়ে নিজের কাঁথাটা বিছিয়ে দিয়ে চিলমচিটা মাচার উপর তুলে রাখে মনা তারপর বলে, "এইখানে রাইখলাম মনে কইরা পেশাব কইরো এইবার আমি যাই"

          "কই যাস বইন?"

          "ওমা তুমি জান না? তোমারে না কইলাম চৌধুরী বাড়ির বড় দাদী আইজকা মইরা গেছে ওনার লাশ তাছে গেরামের সব মানুষ বাড়িতে থিক থিক করতাছে আমিও তো এতক্ষণ আছিলাম, হঠৎ তোমার কথা মনে অইল হের লাইগ্যা দেখবার আইলাম"

          "কে মারা গেছে? বড়ভাবীজান? চৌধুরী বাড়ির বড় বউ জহির মিয়ার মা?"

          ", তোমার তো দেখি সব মনে আছে তানি মারা গেছেন ঢাকায় অহন লাশ আনতাছে, রাতে কবর অইব"

          "আহা রে, বড়ভাবীজানও মইরা গেল"

          "মরব না বয়স অইছে তুমি তো কইতা তোমার থেইকাও বড়"

          ", আমার থেইকাও বড় আমার তো বিয়া অইছিল হেই বছর বয়সে পনের না অইতে তোর বাপেরে আর আমারে থুইয়া কালাজ্বরে তোর দাদা মইরা গেল ভাত-কাপড়ের সে কী কষ্ট তয় একদিন জেডিমা ডাইক্যা কইলেন, তুই এখন থাইকা আমার এখানে কাম করবি পোলায়ও গরু-গোয়াল দেখব খাইবি-দাইবি আর বছরে পাঁচ আড়ি ধান পাইবি হেই যে শুরু অইল তারপর যতদিন আমার শরীরে জোর আছিল আমি হেগো বাড়িতেই খাইট্যা খাইছি তোর বাপেও"

          "দাদার মায় আর দাদীও হেইবাড়ির বান্দী আছিল?"

          "বান্দী কস ক্যান, বান্দী খারাপ কথা আমরা পেডে-ভাতে কাম করছি খারাপ কিছু করি নাই"

          "কিন্তু একখান কথা কওতো দাদী এই যে হারাডা জীবন তোমরা হেগো লাইগ্যা খাটনি দিলা, তোমাগোরে কী দিছিল?"

          "ওমা কী দিব? হেরা তালুকদার হেরা হুমুম করলে তো কাম করতেই হইব বছরে একখান কাপড় আর তোর বাপেরে একজোড়া লুঙ্গি দিত তিনবেলা খাওন দিত কতজনের তো প্যাডের ভাত যোগাতেই জীবন যাইত গেরামের মইদ্যে কয়জন আর কাম করাইত তয় একখান কথা কি, তালুকদারী ক্যামনে জানি চইল্যা যাওয়ার পরে হেগো অবস্থাও খারাপ অইয়া গেছিল"

          ", অহন তো বিদেশে লোক পাডাইয়া আবার বড়লোক অইছে আগের থিকাও বড়লোক দ্যাখনা মা মরছে সারা গেরাম বাতি জ্বালাইয়া আলো কইরা ফালাইছে, য্যান রঙমহল আইচ্ছা তুমি হুইয়া থাক আমি যাই লাশ পুলের গোড়ায় আইসা গেছে এতক্ষণে বাড়িতে আনছে মনে হয় আমি যাই"

          দাদীর গায়ে কাঁথা কাপড় জড়িয়ে মনা ঝাঁপ তুলে চলে যায় যাবার সময় বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে যায় বলে, "তুমি ঘুমাও, আমি তোমারে কাইল বিহানে হগগল কতা কমুনে"

          মনা চলে যায় মনজিলার ঘুম আসে না দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হলেও তার স্মৃতিশক্তি এখনও প্রখর শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে প্রায় শতাব্দীকাল আগের কথা 'বছর বয়সে যখন বিয়া অইল তখন শাশুড়ি একদিন লইয়া গেল জেডিমারে দেখাইতে একগলা ঘোমটা দিয়ে সালাম করতে গেলে জেঠিমা কইছিল দূরের থেইকা সালাম কর, ঠ্যাঙ্গে হাত দিওনা তারপর শাশুড়ি ঘোমটা খুলে মুখ তুলে ধরেছিল মনজিলা চোখ বন্ধ করে ছিল এক পলক দেখে জেঠিমা কইছিলেন, "লোকমানের বউডাতো বেশি কালারে এত কালা মাইয়া বিয়া করাইলি ক্যান?"

          "আল্লায় তকদিরে যা রাইখছে বিবিজান বিয়া তো আল্লাহর দা"

          " তাও ঠিক তয় কি দিছস বিয়াতে মোহরানা কত?"

          "বেশি দিতে অয় নাই মাইয়ার বাপ মাইয়া কালা দেইখা তেমন কিছু দাবি করে নাই আমরা দাবি কইরছি বরাতিরে ভাল কইরা খাওয়াইতে হইব হেরা তিরিশজনরে খাওয়াইছে আর মাইয়ারে একখান রুপার পৈছা গড়াইয়া দিছে"

          তারপর জেডিমা চাকরানীরে ডাক দিয়া একমুঠা গুড় আর কাঁসার একগেলাস পানি দিতে কইল শাশুড়ী-বৌ দুজনে সে পানি খাওয়ার পর কোমরের বন্ধনী খুইল্যা জেডিমা তার থেইকা একখান সিকি মনজিলারে দিছিল তখন একখান সিকিরই কত দাম! কিন্তু বাড়ি ফিরা আহনের পরই শাউড়িমা সিকিখানা ছোঁ মাইরা নিয়া গেল রাতে সোয়ামী কইল, "তুই সিকিডা মারে দিলি ক্যান?"

          "আমি দিই নাই তো মায় নিয়া গেল"

          ", বেকুব একখান"

          ভাঙা বেড়ার ওপাশ থেকে মা চিল্লাইয়া উঠল, "কী কসরে হারামজাদা বোয়েরে কুবুদ্ধি দেস আমি ট্যাহা জমাইয়া বোরে রুপার কানপাশা গড়াইয়া দিমু"

          মনজিলা আর তার স্বামী তৎক্ষণা চুপ করে গিয়েছিল কিন্তু পরদিন সকালে শাশুড়ি মনজিলাকে স্বামীর কাছে কথা বলার জন্য চড়-থাপ্পড় ভালই দিয়েছিলেন কানপাশার নাম দুজনের কেউই আর কোনদিন মুখে আনেনি তারপরতো বিধবা সারাজীবন সুতা পাড়ের কোরা শাড়ি শীত-গ্রীষ্ম একই পোশাক শীতে কেবল মাটির মালশার তুষের আগুনই সম্বল ছিল তাও কত কষ্টে কাঠ-লতা কুড়াইতে হইত আহা কৈ গেল হেইসব দিন

          এখন তাগো ঘরের বৌ-ঝিয়েরাও সায়া-ব্লাউজ পরে আবিতা মাইয়ারা জামা পরে, সেলোয়ার কামিজ পরে কত বদলাইল সবকিছু আগে দিনে সোয়ামীর লগে কতা কওন যাইত না কাউয়া-কুলি ডাক দিবার আগে পগারে গিয়া গোসল কইরা আইতে অইত হেরপর ঘরবাড়ি লেইপ্যা ঢেঁকিতে ধান ভানতে অইত তারপর বাসি পান্তা খাইয়া ব্যাটারা কামে যাইত হাল চাষ, জালমারা যার যেইডা কাজ অবশ্য সোয়ামীর মরণের পর শোকে 'মাসের মইদ্যে শাউড়িও যখন মারা গেল তহন তাগো মা-পোলারে জেডিমা চৌধুরী বাড়িত ডাইকা নিল

          হের পরতো আরেক জীবন বাটনা বাটা, কুটনা কুটা পুরা চৌধুরী বাড়ির ঘর উঠান ঝাড়ু মাইরা সাফ করা কারো কাম আছিল বাড়ির সেজ আর কুপি বাতিতে সইলতা পাকাইয়া তেল ভরা, পিতলের বাত্তি বদনা সব সোনার মত কইরা মাইজা ঘইসা চকচক করা এট্টু এদিক সেদিক অইলে জেডিমা লাত্থি মাইরা সব ফালাইয়া দিত এই এক স্বভাব আছিল জেডিমার গোস্বা হইলেই খড়ম পায়ে লাত্থি আহারে হেই লম্বা খাড়া দুধসাদা মানুষটা মইরবার বেলায় ব্যাঁকা অইয়া গেছিল আঁডু দুইটা ভাঁজ কইরা ব্যাকা অইয়া ছিল, মরার পরেও সোজা করা যায় নাই ঐভাবেই কবর দিতে অইছিল মাইনষে কানাকানি করছিল এইডা লাথির শাস্তি

          কত কথা যে মনে পড়ে মনজিলার বড়ভাবীজান বিয়া অইয়া আইবার পর হের লগে চুলার কামে থাকতে অইত নয়া বৌ শাউড়ির ভয়ে ভয়ে থাকত তবুও জেডিমা খুশি অইত না কামের মাইনষের লগে সারাক্ষণ বৌরেও কাম করাইত বড়লোকের মাইয়া চাইর মুখা আখায় আগুন দিতে যাইয়া হিমশিম খাইত মনজিলা নিজের কাম ফেলাইয়া দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া সাহায্য কইরত বাড়ির কামলা-মিনতি খাইয়া গেলেও জেডিমা না খাইলে ভাবীজান খাইতে পারত না মাঝে মাঝে কানত আর কইত, "আমি হাশরের মাঠেও এই বেডিরে মাফ করুম না আমার জানের উপর এত কষ্ট যে দিছে হেরে আল্লায় হাবিয়া দোজখে য্যান ফালায়।"

          মনজিলা একথা শুনে শিউরে উঠত কিন্তুক বড়লোকের বউ মায়া করলেও মুখের উপর কথা বলার সাহস পেত না বড়ভাইসাব বেশি ভালা মানুষ আছিলেন মা বাপের উপর কোন কতা কইতেন না কিন্তুক ছোডভাইসাব বেশি রাগী আছিলেন মইদ্যে মইদ্যে এসব লইয়া মায়ের সাথে লাইগ্যা যাইত আর জেডিমাও গোঁয়ার ছোডপোলারে খানিক মাইন্যা চইলতেন

          সব কথা মনে আছে মনজিলার নিজের জীবনেতো কোন কতা নাই মায়-পোলায় চৌধুরী বাড়িতে কতদিন কাটছে অল্প বয়সে বিধবা অইলেও তাগো ডরে কেউ কোনদিন একখান কুকথাও কয় নাই মাঝে মাঝে নিশুত রাইতে ঘুম ছুটলে মরা মানুষটার কথা মনে অইয়া শরীরডায় কেমন জ্বালা ধইরত তারপর হেই জ্বালাও কুন সময় নিব্যা গেছে খেয়ালও করে নাই

          আতকা পইড়া জেডা মিয়া মইরা গেলে সংসারের কর্তা অইলেন বড়ভাইসাব কিন্তু বেশি ভালামানুষ হওনে ছোডভাইসাব শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরলেন বড়ভাবীজান সংসারের কত্তি কিন্তুক জেডিমার হুকুম ছাড়া তহনও কিছু করা যাইত না জেডাজী মইরা যাওনের পর জেডিমা ছোটভাইসাবরে বিয়া করাইবার জন্য উইঠা পইড়া লাইগলেন মিয়া বাড়ির মাইজ্যা মিয়ার মাইয়্যা তানার ভাইঝিরে বিয়া করানের ইচ্ছা আছিল ভাইয়েরাও বইনরে ধরছিল তিন পুরুষের কুটুম্বিতা নইলে শেষ অইয়া যাইব

          কিন্তু ছোডভাইজান যে মনে মনে পিতিজ্ঞা করছে বড়ভাবীজানের ছোড বইনরে বিয়া করব হেইডা তো আর কেউ জানে না। একথা শুইনা জেডিমায় ভাত পানি ছাইডা বিছনা লইল। কিন্তুক ছোডমিয়া অনড়। ভাইজানের মামারা হগলে মিল্যা ভাবীজানরে দোষ দিছিল। তারা কইত এই বেটি পোলাটারে জাদু করছে। শুইনা বড়ভাবীজান কসম খাইয়া বলে আমি যে আগুনে আছি সে আগুনে আমার বইনরে ক্যান ফেলমু? আমার জীবন গেলেও আমি বিয়েতে রাজি হমু না

          শেষ পর্যন্ত ছোডভাইসাবের জিদের কাছে জেডিমারে রাজি হইতে হইছিল , সেই কতদিনের কতা বিয়ার আয়োজনে একশ' চাইল জোগাড় কইরতে তিন-চার মাস আগের থেকে সারা রাইত পালা কইরা মিনতিরা ধান ভাইনত আবার হেগোরে খাওয়াইতে গিয়া চাইল জমত না বড়ভাবীজানের বহুত কষ্ট হইত মটকায় মটকায় চাইল মরিচ বড় বড় তামার ডেগে চিকন চাইল থুইতে থুইতে ভান্ডার ঘর ভইরা গেছিল

          আর বিয়ার দিন কি অইল -  পোলা দুলা সাইজ্যা রওনা দিব মা শরবত খাওয়াইলোতো না, বিছানায় উলটা দিকে মুখ কইর‍্যা শুইয়া থাকল মায়ের মুখ পোলায় দেইখল না শেষে সেলাম ইরা যাত্রা দিল তানার বড়মামী সরবত খাওয়াইল বড়ভাবীজান মুখ ভার কইরা থাকল

          অথচ আল্লার কি আশ্চর্য কুদরত, বৌ আনার লগে লগে জেডিমা হগলরে ডাইকা বৌ ঘরে তুইলতে কইল বৌরে কোলে নিয়া কইল, "বৌভার নাতি নাতিনে, পুত ভার ধনে মানে" বৌরে নিজের সোনার লকেট পরাইয়া দিল এই দেইখাতো বড়ভাবীজানের মাথা আরো গরম এত ঘটনা ঘটাইয়া শেষে এই আছিল মনে আরো আশ্চর্য, যে বড়বইনরে এত কষ্ট দিছে জেডিমা, হেরই ছোড বইনরে কোন দিন কিছু কয় নাই এমনকি ছোডভাবীজানের যে একটা পোলা-মাইয়াও অইল না তাও কিছু কয় নাই কোনদিন           

          এসব লইয়া বড়ভাবীজান অনেক দুঃখ করত শেষে ছোডভাবীজান যহন নিজের মা মরা বইনঝিরে পালক আনল তহনও জেডিমা একখান কথাও কয় নাই অথচ বড়ভাবীজান কত মায়াদার মানুষ আছিলেন বিপদে আপদে দুই বইনই মাইষের লাইগ্যা করতেন ছোডভাবীজান মইরা গেলে কতজন ভাইসাবরে আরেকখান শাদী কইরতে কইছিল কারো কথা হুনল না তার কলিজার টুকরা আছিল পালকা মাইয়াডা হেরে ছাড়া ভাইসাবের দুনিয়া আন্দার হইয়া যাইত মাইনষে কইত এই মাইয়া বিয়া দিয়া ছোড চৌধুরী থাকব ক্যামনে হেই মাইয়ারও বিয়া হইল ছোডভাইসাবও মইরা গেল কত কত ঘটনা ঘটল মাইয়াডাও আর দ্যাশে আইতনা আহারে কি কি অইল আশেপাশের হগল মানুষ মইরা গেল, খালি মনজিলারই মরণ নাই

          মনজিলা আল্লারে ডাকে আর শোকর করে নিজের মরণ নিজে চাওয়া নাকি পাপ নই্লে মনের জ্বালায় শরীরের জ্বালায় কবেই বিষ খাইত কিন্তু দুনিয়ায়তো কিছু পাইল না আবার পরকালে দোখজের শাস্তি এসব ভাইবা ভয়ে কোন দিন মরণের কথা ভাবে নাই এই যে আইজকা মনা কইল বড়ভাবীজানের লাশ আইছে, মনজিলার তো একবার দেখতেও যাইবার ক্ষ্যামতা নাই যদি যাইতে পারত তাইলে শেষবার মুখখানা দেইখতে পারত

          কথাটা মনে হতেই হঠাৎ মনজিলার ভীষণ ইচ্ছে করে লাশের মুখটা একবার দেখতে কিন্তু নাতনীটা বাতিটাও নিবাইয়া দিয়া গেছে বাইরে থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো আসছে মনজিলার মনে হয় চোখের জ্যোতি না থাকলে যেটুকু আবছা দেখে তাতে কি পথ চিনে যাওয়া যায় না? বাড়ির রাস্তাতো তার মুখস্থ চোখ থাইকলে তো হাঁইটা যাইত এহনও কি পারব না? ইচ্ছেটা হঠাৎ প্রবল হয়ে উঠতে নিজেকে আর সামলাতে পারে না সে নিজের শরীরটা অনেক কষ্টে মাচা থেকে তুলে নিজের লাঠিটা হাতড়ায় পায় না আরও একটু হাত বাড়িয়ে খুঁজতে যায় অন্ধকারে বুঝতে পারে না কোথায় লাঠিটা হঠাৎ মাচা থেকে ধপ করে পতনের শব্দ হয় মাচার নিচে ছাগল আর হাঁস-মুরগিগুলো নিজেদের ভাষায় আরেকবার চ্যাঁচামেচি করে চুপ করে যায়

 

****


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩১-৩২

----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ __________________________...

Popular Posts