_____________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - বোধন ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৯
গল্প - ফেরা
__________________________
ফেরা
পড়া
শেষ হতেই টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে দেয় শম্পা। আর সঙ্গে সঙ্গে জানালা দিয়ে এক মুঠো
ভোরের আলো ঘরে প্রবেশ করে। আবছা আলোতে ঘরটাকে একটু অন্যরকম দেখায়। জানালার গ্রিলে
মুখ রেখে বাইরে তাকায় শম্পা। এখনো সূর্য উঠেনি অথচ কী মিষ্টি একটা আলো ছড়িয়ে আছে
সারা পৃথিবীতে। বাসার পাশের খালি জায়গাটাতে সবুজ ঘাস আর আলো মিলে এক অপরূপ
সৌন্দর্য তৈরি হয়েছে। শম্পা কয়েকবার চোখ বন্ধ করল-খুলল। যেন ক্যামেরার ছবি তোলার
মত এই সবুজ ভোরের দৃশ্যটাকে নিজের ভেতর ধরে রাখতে চায়। তারপর দরজা খুলে ছাদে এল।
ততক্ষণে আকাশের লাল সূর্যটা উঠতে শুরু করেছে। কী অপূর্ব! কতদিন এমন সুন্দর ভোর দেখেনি শম্পা। ক-ত-দি-ন। শুধু পড়া আর পড়া। পড়ো আর
পড়ো। বাবার একটাই কথা¾ ডাক্তার হতে হবে শম্পাকে। এখন শম্পা ডাক্তারী
পড়ে। আর এক সপ্তাহ পরে পরীক্ষা। ডাক্তারী পড়াশোনার প্রথম পরীক্ষা। দিন রাত পড়তে
হচ্ছে। এর আগেও এসএসসি, এইচএসসিতে ভাল পাশ করার জন্য শম্পাকে প্রচুর পড়তে
হয়েছে। এখন ভোরের এই রঙিন আকাশ আর সবুজ
মাটি দেখে শম্পার আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। উহ্!
ডাক্তার হয়ে কী হবে?
বাবার
মত সারাক্ষণ ব্যস্ত জীবন। সারাক্ষণ হাসপাতাল, চেম্বার আর ক্লিনিকে ছোটাছুটি। শম্পা
একবার এইচএসচসি পরীক্ষার পর বেঁকে বসেছিল¾
সে ডাক্তার হবে না। এত ব্যস্ত জীবন তার ভাল লাগে না। তার চেয়ে সে সাহিত্য অথবা
ইতিহাস নিয়ে পড়বে। তাতে আনন্দও থাকবে আবার পড়াও হবে। ছোটবেলায় বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ বইটা ছিল শম্পার সবচেয়ে
প্রিয়। এত সুন্দর প্রকৃতির বর্ণনা যে বার বার পড়তে পড়তে শম্পা যেন নিশ্চিন্দিপুরের
নোনা গাছ, অপুদের সেই বাড়িটা সব দেখতে পায়।
কিন্তু বাবা তা শুনবেন কেন? তাঁর এক কথা
এবং সেটাই মানতে হবে। এত সুন্দর সকালেও কথাটা মনে হতে বিতৃষ্ণায় ভরে যায় শম্পার
মনটা। হঠাৎ দূরের দিকে চেয়ে কী
যেন ভাবে। তারপর এক সময়ে ছাদ থেকে নেমে আসে।
ঘরে ঢুকেই শম্পা টেবিলের উপর খোলা
ফ্রাঙ্ক নিটারের ‘এটলাস অফ হিউমেন এনাটমি’ বইটা বন্ধ করে দেয়। তারপর নিজেই নিজেকে বলে¾ ‘আমি আর পড়ব না’।
নিজের কলেজের ব্যাগটাতে দ্রুত হাতে দু’একটা কাপড় আর
টুকিটাকি জিনিস তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নেয়। এখনও বাসার সবাই ঘুমিয়ে। এই ফাঁকেই শম্পা
বেরিয়ে পড়বে। চলে যাবে দূরে কোথাও। যেখানে বাবা নেই, পড়া নেই। আছে অপার স্বাধীনতা,
মুক্তি।
গেট দিয়ে বেরোবার সময়
দারোয়ান জিজ্ঞেস করে¾ আফা
কই যান?
এক মুহূর্ত থমকায় শম্পা। তারপরই ঝটিতি উত্তর দেয়¾ আমার এক বন্ধুর বাসায়
পড়তে যাচ্ছি।
¾ গাড়িতে যাইবেন না?
¾ না। বলেই শম্পা
তাড়াতাড়ি গেটের বাইরে এসে একটা রিক্সা নেয়। রিক্সায় চলতে চলতেই শম্পা সিদ্ধান্ত
নেয়। তারপর বলে গন্তব্যের কথা।
বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই শম্পার মনটা ভরে উঠে। বাসটা
শহর ছাড়িয়ে এসেছে। সবুজ মাঠ আর গাছ পালা। মাঝে মাঝে গ্রামের ঘর বাড়ি গুলো এত
সুন্দর দেখাচ্ছে। এখন শরৎকাল।
বর্ষার বৃষ্টিতে ধোয়া গাছের পাতা গুলো ঘন সবুজ হয়ে আছে। সকালের রোদ যেন পিছলে
যাচ্ছে পাতার উপর দিয়ে। উপরে আকাশ ঘন নীল। শম্পা গুন গুন করে আপন মনে গেয়ে উঠল¾ আজি শরৎ তপনে
প্রভাত স্বপনে জানি পরান কী যে যায়।
প্রায়
আড়াই ঘন্টা জার্নি শেষে শম্পা যেখানে এসে পৌঁছাল সেটা একেবারেই অজপাড়া গাঁ।
স্টপেজে নামতেই পাশের চায়ের দোকানে বসা দু’একজন লোক তাকে তাকিয়ে দেখল।
একটা রিক্সা এগিয়ে এল। শম্পা রিক্সা নিল না। বাড়িটা সে চেনে। হেঁটে হেঁটে দেখতে
দেখতে যাবে।
¾‘তুমি ঘুমাও নিটার। ঘুমাক তোমার বিখ্যাত এনাটমি বইটিও।
আমি আপাততঃ মনের সুখে আছি’ ¾ মনে মনে বলল শম্পা। তার মুখে এখন পরিতৃপ্তির হাসি,
মুক্তির আনন্দ।
প্রায়
দশ মিনিট হেঁটে শম্পা যে বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াল সে বাড়ির গৃহিনী তাকে দেখে
কিছুক্ষণ অবাক তাকিয়ে রইল। তারপর একরাশ বিস্ময় ঝরা কন্ঠে বলল ¾
আফা! আফনে কোথ্থেইকা?
শম্পা এগিয়ে গিয়ে মহিলার কাঁধে হাত রাখল¾ হ্যাঁ রাফিজা ভাবী।
আমি শম্পা আপা। আপনাদের এখানে বেড়াতে এসেছি। আপনার কাছে থাকব কয়েকদিন।
রাফিজা অবাক চোখে আবারও তাকাল। শম্পা
এবার হেসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল¾ আশ্চর্য হচ্ছেন কেন? আমি আপনাদের বাড়িতে আসতে পারি না?
কোন অসুবিধা আছে? তাহলে বলুন, চলে যাই।
রাফিজা বিব্রত হল¾ ‘না না আফা কী যে কন?’
বিব্রত হতে হতে হাঁক পাড়ে ¾ ‘অ টুনি, কই গেলি?
দ্যাখ কে আইছে’।
টুনি নামের ছোট্ট মেয়েটা পুকুরে বড়শি ফেলে মাছ ধরছিল। ছুটে
এল। এসে অবাক হয়ে দূরে থেকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছুটে এল¾ আরে শম্পা ফুপু না?
জড়িয়ে ধরল শম্পাকে।
ততক্ষণে আশে পাশের ঘর থেকে বউ ঝিয়েরা এসে গেছে। সবাই কৌতূহলে
তাকিয়ে দেখছে শম্পাকে। এবার রাফিজা কল কল করে উঠে¾ ‘ও বকুল, ও রাজিয়া ভাবী, তোমরা চিনতে পার নাই শম্পা
আফারে? ঐ যে একবার পিকনিকে যাওয়ার সময় আমাদের বাড়িতে আইছিল আমাগো সাহেব। ওনার বড়
মাইয়া শম্পা আপা। তখন ছোট ছিল। স্কুলে পড়ত। এখন ডাক্তারী পড়ে বড় ডাক্তার হইব।
¾ ডাক্তার না কচু! মনে
মনে জিভ ভ্যাংচায় শম্পা। কিন্তু এখন তাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আশে পাশে ভীড়
করা মহিলা এবং শিশুরা তাকে এমন ভাবে দেখছে যেন সে ভিন্ গ্রহের মানুষ।
সকালে ঘুম থেকে ডাকতে গিয়ে মা একটু অবাক হলেন। শম্পা বিছানায়
নেই। সাধারণত সে রাত জেগে পড়াশোনা করে। কলেজে যাওয়ার সময় হলে তিনি ডেকে দেন। শম্পা
তার বাবার সাথে এক সঙ্গে যায়। বিছানায় না দেখে তিনি ভাবলেন হয়তো টয়লেটে নয়তো ছাদে।
কিছুক্ষণ ঘুরে এসে ডাকলেন ¾ শম্পা, শম্পা। না কোথাও নেই। কিন্তু কাল রাতে তো বলেনি
সকালে কোথাও যাবে। হয়তো কোথাও গিয়েছে। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে। এবার
বারান্দায় এসে ডাকলেন¾
¾ দারোয়ান, দারোয়ান।
¾ জী খালাম্মা।
¾ শম্পা বাইরে গেছে?
¾ জ্বী।
¾ গাড়ি নিয়ে গেছে?
¾ না। কইলেন বান্ধবীর
বাসায় যাচ্ছেন পড়তে। তারপর রিক্সা করে চইল্যা গেলেন।
মা আশ্বস্ত হলেন। তাহলে কিছুক্ষণ পর চলে আসবে। তিনি টেবিলে
নাস্তা দিতে গেলেন।
বাবা কলেজ থেকে ফোন করলেন। শম্পা ক্লাসে আসেনি। তা হলে কোথায়
গেল? বুঝতে পারে না। ব্যস্ত হয়ে শম্পার সব চেয়ে কাছের বন্ধু রায়নাকে ফোন করলেন।
রায়না বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সময় পেলেই শম্পা ওদের বাসায় ছুটে যায়।
¾ না খালাম্মা। আসেনি
তো। তাছাড়া ওরতো পরীক্ষা মাত্র ক’দিন পরে। সেদিন শুধু
বলছিল¾ এত পড়তে আর ভাল লাগছে
না। কোন দিন পড়া ছেড়ে দেব দেখিস।
মায়ের বুকটা ধুক্ করে ওঠে। মেয়েটা ডাক্তারী পড়তে চায়নি। শুধু
ওর বাবার চাপে পড়ে রাজী হয়েছিল। নিজে ডাক্তার, মেয়েকে ডাক্তার বানাবেন এই তার শখ।
তাহলে কোথায় গেল শম্পা?
আজ দিনটা ভারী আনন্দে কেটেছে শম্পার।
টুনিকে নিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছে। নোনাফল আর আতা যে এক জিনিস তা জানত না। টুনিই
তাকে চিনিয়ে দিল। বাঁশঝাড়ের নিচে বসে ঘুঘু আর দোয়েলের গান শুনছিল। সাঁতার জানে না
তবু একটা মাটির কলসী ধরে কিছুক্ষণ পানিতে দাপাদাপি করল। ছোটবেলায় নিজেদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হত। তখন পুকুরে গোসল
করত বাবা আর ছোট কাকার সঙ্গে। তারপর দাদী মারা গেল। বাড়ি যাওয়া বন্ধ হল। এখন শুধু
বছরে দু’একবার
সবাই মিলে পিকনিকে যাওয়া হয়। আত্মীয় স্বজন সবাই শহরে থাকে। ইচ্ছে করলেও গ্রামে
যাওয়া যায় না। আর গত ক’বছরে
তো শুধু পড়া আর পড়া। ভাবতেই মনটা আবারও তেতো হয়ে যায়। হঠাৎ মনে হল¾ মা কী করছে? এখন তো
প্রায় সন্ধ্যা। এতক্ষণে বাবাও কি চিন্তিত নয়?
পরিচিত
অপরিচিত যত টেলিফোন নম্বর ছিল সবখানে ফোন করা হলো। না কোথাও যায়নি শম্পা। দূরে
দূরে আত্মীয় স্বজনকে জানানো হল। বন্ধুদের সবার বাড়িতে শম্পার বাবা-মা গাড়ি নিয়ে
ঘুরতে লাগলেন। কোথাও নেই। কী আশ্চর্য! মেয়েটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেল?
তিন
দিন হয়ে গেল। শম্পার মা শয্যা নিয়েছেন। বাবা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছেন না। এবার
হয়তো ভেঙে পড়বেন। এত রাশভারী মানুষটা ভেঙে পড়লে কী অবস্থা হবে? বাসায় মানুষের
আনাগোনা, মেডিকেল কলেজের ছাত্রশিক্ষকের আসা যাওয়ার অন্ত নেই। এদের কেউ শম্পার
বন্ধু-বান্ধব, কেউ তার বাবার। ডাঃ রাহবার খানকে এত বছরে একটা শিশুর মত ব্যাকুল হতে
কেউ দেখেনি।
¾ টুনি টুনি। ওঠ্ তাড়াতাড়ি। আমি সলিমের বাড়ি যাইতাছি। সলিমের বউটার নাকি
অবস্থা খারাপ।
¾ কেন,
কী হয়েছে ভাবী?
মাটিতে পাতা বিছানা থেকে উঠতে উঠতে
জিজ্ঞেস করল শম্পা। টুনি এখনো ঘুমে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে সবে ভোরের আলো আসতে শুরু
করেছে। শম্পা উঠে এসে আবার জানতে চাইল¾ কী
হয়েছিল ওনার?
¾ পোয়াতী বউ। এ
মাসেই বাচ্চা হবে, কিন্তু কালকে থেকে শরীলডা খুব খারাপ। পেটে খুব ব্যাথা। বুঝতাছে
না কী করবে।
¾ কেন,
হাসপাতালে নিয়ে যায় না কেন?
¾ কী যে কন
আফা? হাসপাতাল কি কাছে? তাছাড়া নিবে কিসে?
¾ কেন,
এম্বুলেন্স?
দুঃখের
মধ্যেও হেসে ফেলে রাফিজা¾ এম্বুলেন্স
কই পাইব আফা? এইডা কি শহর? আছে শুধু রিক্সা। তা এই অবস্থায় রিক্সায় কীভাবে নিবে?
¾ চলো আমিও যাবো তোমার
সঙ্গে।
¾ চলেন। আপনে তো ডাক্তার।
চলেন দেইখ্যা আসবেন।
বাড়ির
পিছনে পুকুর পাড়ের রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসে মাঠে নামল তারা। তারপর দুটো বড় মাঠ
পেরিয়ে সলিমের বাড়িতে এল। ছোট খুপরির মত ঘরটিতে যখন ওরা এসে পৌঁছল তখন বাইরে বাঁশ
কেটে ডুলি বাঁধা হচ্ছে বৌটাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য।
অন্ধকার
ঘর। ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ লাগল চোখ সয়ে নিতে। কয়েকজন মহিলা ঘিরে বসে আছে সলিমের বউকে।
সবার মুখে হতাশার ছাপ। অসহায় সবাই। দু’একজনের কোলে আবার বাচ্চা। শীর্ণ, দুর্বল। সলিমের বউ
ব্যাথায় বারবার কঁকিয়ে উঠছে। এক একবার মনে হচ্ছে এক্ষুণি দম বন্ধ হয়ে যাবে। শম্পার
ভেতরে তোলপাড় হচ্ছে। এত কষ্ট মানুষের, এত কষ্ট! এখনো এদেশের মানুষ এত অন্ধকারে
থাকে! চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরে?
ডুলি
তৈরি হলে সলিমের বউকে সবাই ধরাধরি করে এনে তোলে। কৈ মাছের মত লাফাচ্ছে মহিলা।
মায়ের অবস্থা দেখে দু’বছর বয়সী মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদছে। কারো কোলে থাকতে চাইছে না। কিন্তু মায়ের
এখন মেয়ের দিকে নজর নেই। নিজেরই প্রাণ যাচ্ছে। সলিম কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যা করার তা
পাড়া-প্রতিবেশীরাই করছে।
¾ শম্পা, শম্পা। শম্পা যেন বুকের ভেতর বাবার ডাক শুনতে পায়।
¾ আসছি বাবা, আমি আসছি। তোমার কথাই ঠিক¾ এই অসহায় মানুষ গুলোকে সাহায্য করতে আমি ডাক্তার হবো।
ঘরে এসে নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে নেয়
শম্পা। টুনি এখনো ঘুমাচ্ছে। ঘুমোক। আবার এলে দেখা হবে। শম্পা এখন ফিরে যাবে।
পরীক্ষার এখনো কয়েকদিন আছে। গ্রামের পথ দিয়ে একটা ডুলি কাঁধে কয়েকজন লোক যাচ্ছে।
যেন একটা মিছিল। সবার পেছনে শম্পা। সে ফিরে যাচ্ছে শহরে। আবার একদিন ডাক্তার হয়ে
এইসব মানুষদের কাছে আসার প্রত্যয় নিয়ে।
No comments:
Post a Comment