Tuesday, 18 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - ইচ্ছাপূরণ


 ________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - দহনের কাল ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭

গল্প - ইচ্ছাপূরণ
_______________________________________

ইচ্ছাপূরণ


মহা দুশ্চিন্তায় আছেন সাইফুর রহমান খানপ্রায় দুবছর থেকে একটি কিডনী নষ্টসম্প্রতি সিঙ্গাপুরে ফলোআপে গিয়ে জানতে পেরেছেন অন্যটিও নষ্ট হওয়ার পথে। সুতরাং বাঁচতে হলে এবার তাকে কিডনী ট্রান্সপ্লানটেশন করতেই হবে। অথচ ব্যাপারটা ততো সহজ নয়। কত বয়স তার? মাত্র তেষট্টি। সুস্থ থাকতে পারলে কমপক্ষে আরো বিশবছর বাঁচবেন। যদিও হায়াত-মউত আল্লার হাতে। তবু সবার ওপরে বিশ্বাস করেন, টাকা থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব। এমনকি হায়াতও।

          বালক বয়সে মুরুব্বিদের মুখে একটা প্রবাদ প্রায়ই শুনতেন- টাকার নাও পাহাড়ের ওপর দিয়ে চলে।

     একদিন অবাক হয়ে দাদাকে প্রশ্ন করেছিলেন, "আচ্ছা দাদা, পাহাড়তো অনেক উঁচা তো নাও ভর্তি টাকা ক্যামনে পাহাড়ের উপর দিয়া চলব, নাও তো পানি ছাড়া চলে না।"

          দাদা ডাব্বা হুঁকা টানতে টানতে হেসে উঠেছিলেন নাতির কথা শুনে। তারপর বলেছিলেন, "এইটা হইল, একটা দৃষ্টান্ত। যার মাইনে হচ্ছে ট্যাকা থাকলে অসম্ভবরেও সম্ভব করন যায়।"

          আজ সাইফুল নিজেও এই প্রবচনটি শতভাগ নয় সহস্রভাগ বিশ্বাস করেন। টাকা থাকার কারণেইতো বার বার সিঙ্গাপুর ব্যাংককে চিকিৎসা নিতে পারছেন। কোটি টাকা খরচ করছেন। অথচ পাঁচশ টাকার অভাবে কত মানুষ এক ফাইল ওষুধ খেতে পারছে না। নাহ, এসব সেন্টিমেন্টাল ভাবনা সাইফুর ভাবেন না। তার এখন একটাই ভাবনা মিল মত কিডনি কার কাছে পাবেন। ঠারেঠোরে আত্মীয়স্বজনদের কাছে চেয়েছিলেন। রক্তের সম্পর্ক হলে ভাইবোন বা ছেলেমেয়েরা দিতে পারে। (সরকার আবার আইন করেছে কিডনি কেনাবেচা করা যাবে না। যত্তোসব।) অনেক টাকার অফারও দিয়েছিলেন। কিন্তু গরীব ফুপাতো বোনটিও রাজি হয়নি। ভগ্নিপতিটি আবার গলা ফুলিয়ে বলেছে- গরীব হইছি বইলা কি আমাগো জীবনের মূল্য নাই!

          আরে গাধা। টাকা না থাকলে জীবনের মূল্য কী? একটা কিডনির বদলে আমি যা দিতাম তা তোর চৌদ্দপুরুষও কল্পনা করতে পারত না।

          ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠতেই দ্রুত রিসিভ করলেন।

          -হ্যাঁ, গফুর কি খবর?

          -খবর বেশি ভালও না আবার খারাপও না স্যার।

          -এত প্যাঁচাও কেন মিয়া? সোজাসুজি বল। তিনদিন হল তুমি গেছ কোন           আশার কথাতো শোনাতে পারনি।

          -স্যার, এইটা কি এত সহজ কাজ! একদিকে সরকারের আইন, অন্যদিকে এলাকার মানুষের সন্দেহ হইলে আমারে দিব ফাটকে ঢুকাইয়া। এমনকি আজকাল মানুষ যেভাবে গণপিটুনি দেয়- তখন কি হইব স্যার।

          -কিচ্ছু হবে না। তুমি তাড়াতাড়ি জানাও প্রোগ্রেস কদ্দূর। নাহলে তোমার চাকরি নট হবে।

          ফোনটা কেটে দিলেন। বললেন, চাকরি নট। কিন্তু তার কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ। দেশে কিডনী পাচারচক্র সক্রিয়। বহুসংখ্যাক দালাল আর ক্লিনিক এর সাথে জড়িত। কখনও পাশের দেশেও চালান করে দেয়। এদিকে সরকার আইন করে কিডনী কেনাবেচা নিষিদ্ধ করেছে। যত্তোসব ফালতু। একটা সুস্থ কিডনী নিয়ে মানুষ দীর্ঘদিন বাঁচতে পারে। কারো কারো নাকি জন্মগতভাবে একটা কিডনিও থাকে। সেও দিব্বি বেঁচে থাকে।

          আবার ফোন বেজে ওঠে। এবার রংপুর থেকে হারিছ ফোন করেছে।

          -বলো হারিছ

          -সালামালেকুম স্যার।

          -ওয়ালাইকুম। সময় নষ্ট করোনা আসল কথা বলো।

          -পাওয়া গেছে স্যার।

          -কি মহিলা না পুরুষ?

          -দুইটাই স্যার। একজন পুরুষ একজন মহিলা।

          -বেশ ভাল কথা। কি কথাবার্তা হল তাদের সাথে।

          -আমি এখনও সরাসরি কথা বলি নাই। যে দালালকে লাগাইছি সে কথা চালাইতেছে। স্যার!

          -হ্যাঁ বলো।

          -আমারে তো এইখানে কম করে আরো চারপাঁচদিন থাকতে হবে। টাকা পয়সার একটু টানাটানি হইতেছে।

          -কেন, তোমাকে না যাওয়ার সময় পাঁচহাজার টাকা দিলাম!



          -আমার খরচ আর লোকজনরে চা সিগ্রেট খাওয়াইতে গিয়া টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন সাতশ টাকার মত আছে। চা-দোকানে, হাটে-বাজারে না বসলে একটু গল্পগুজব না করলে তো খবর বাইর করা যায় না।

          -ঠিক আছে, ঠিক আছে। আরো তিনহাজার টাকা বিকাশ করে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

          -স্যার আরেকটু বেশি দিয়েন।

          -না, না। আর দিতে পারব না। এভাবে সবাইকে দিতে গেলে আমিতো ফতুর হয়ে যাব। কাজ ঠিকমত কর তাহলে যা চাও পাবে।

          ফোন কেটে দেন সাইফুর রহমান।

          -ব্যাটা না দিয়া যাইব কই! জানের মায়া বড় মায়া। আজকে না দাও কালকে দিবা। আমি হারিছ ভূঞা। কিডনীর দালালী করে দশ বছর কাটাইলাম। তোমাদের মত বড়লোকদের চেনা আছে। গাই দোহানোর মত তোমাদের দিনে দিনে দুইতে হয়।

          সোবহান যোগাযোগ করছে না দুদিন থেকে। অথচ এসব কাজে সেইই সবচেয়ে বিশ্বস্ত। টাকা কিছু বেশি খায় কিন্তু কোন কাজ দিলে সেটা যেভাবেই হোক সে করবেই। হিলি বন্দর থেকে টেকনাফের ইয়াবার চালান সবই সে নিখুঁতভাবে করে।

          কিছুটা চিন্তিত মনে সোবহানের নাম্বারে কল দিলেন। রিং বাজছে ...। কপালে ভাঁজ সাইফুর রহমানের। কী ব্যাপার, কোথাও কি ফেঁসে গেল? তাহলেওতো জানার কথা। প্রশাসন আর পুলিশ-বিজিবির সবখানেইতো তার লোক আছে। কিছু হলে অন্তত খবর তো আসবে।

          অপেক্ষা করে করে তিনবার কল করার পর যখন হতাশ হয়ে পড়লেন তখনই ফোন বেজে উঠল। সোবহানের নম্বর! তাড়াতাড়ি রিসিভ করলেন।      -সোবহান-

          -জী স্যার।

          -কি খবর। তোমার পাত্তা নেই কেন? দুদিন হয়ে গেল।

          -আমার ডায়রিয়া হয়েছে স্যার। গত দুদিন থেকে কেবল পায়খানায় যাচ্ছি আর আসছি। এখনও পায়খানা থেকে এলাম।

          -ডাক্তার দেখিয়েছ? কি খেয়ে এমন অসুখ বাঁধালে?

          -দেখিয়েছি। ডাক্তার বলেছে হাসপাতালে ভর্তি হতে। এখানকার ভাণ্ডারিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।

          -তাহলে হচ্ছনা কেন? টাকা-পয়সা যা লাগে বিকাশ করে দেব।

          -না স্যার। যেখানে সেখানে হাসপাতালে ভর্তি হলে বিপদ আছে। চিন্তা করবেন না। স্যালাইন খাচ্ছি। ওষুধ খাচ্ছি। আশা করি আজকের মধ্যে কমে যাবে।

          -কিন্তু তোমার কাজের কদ্দূর? এ অবস্থায় কিভাবে কাজ করবে।

          -অসুবিধা নাই। আমার লোকজনতো খোঁজ খবর করছে আমি অসুস্থ হইলেও তারাতো বসে নাই।

          -আচ্ছা আচ্ছে সবার আগে তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো।

          ফোনটা রেখে মাথার চুলগুলো দুহাতে মুঠো করে ধরলেন। ভাবলেন, আর কতদিন আয়ু আছে? নিজের হাতে গড়া এশিয়া ইন্টারন্যাশনাল মাল্টি বিজনেস কোম্পানির কী হবে?

          একটু দেরিতেই বিয়ে করেছেন সাইফুর। প্রথম দুটো মেয়ে তারপর একমাত্র ছেলে রাইয়ান। তার এশিয়া ইন্টারন্যাশনালের উত্তরাধিকারী। কিন্তু ছেলে মাত্র ও লেভেল শেষ করে এ লেভেল পড়ছে। এসময়ে তার কিছু হলে ব্যবসার হাল ধরবে কে? ছোটমেয়ে ইংল্যান্ডে লেখাপড়া করছে। কবে ফিরে না ফিরে তার ঠিক নেই। বড়মেয়ের জামাইয়ের নিজেরই ব্যবসা আছে তাছাড়া যতই হোক জামাই- পরের ছেলে। কথায় আছে যম-জামাই-ভাগনা এই তিন নয় আপনা। শেষে দেখা যাবে নিজের ছেলেই দেউলিয়া হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে।

          সেলফোন বেজে উঠল- জসীম!

          -জী স্যার।

          -কোন খবর আছে?

          -আছে স্যার। সুখবর।

          -সুখবর?

          -জী স্যার তিনজনরে পাওয়া গেছে। দুইজন পুরুষ একজন মহিলা।

          -তারা রাজি?

          -রাজি স্যার। তবে টাকা বেশি চায়।

          -কত?

          -বার লাখের কমে রাজি হয় না। পুরুষটাতো পনের লাখ চায়।

          -কি বল- এত টাকা? ওদের ধারণা আছে টাকা সম্পর্কে, কিভাবে টাকা রোজগার করতে হয়?

          -স্যার ভুলে যাবেন না, এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। সব তথ্য সবাই জানে। টেলিভিশনে দেখে। তো মানুষটা আমারে কইল, বেআইনী কাম করুম, আবার জীবনেরও ঝুঁকি আছে, উনি বাঁইচলে আমিতো মইরা যাইতেও পারি তখন আমার পরিবারের কি অইব।

          -ফালাও এসব সেন্টিমেন্টাল কথাবার্তা। বলে দাও যারটা মিলবে এবং নেয়া হবে তাকে আট লাখ টাকা দেব। এটা ফাইনাল আর বাকিদের ঢাকা আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া খরচ আর জনপ্রতি দশহাজার করে দেব। আর এসব বেকুবদের বুঝাও এই ফাঁকে বিনামূল্যে তাদের একটা চেকআপও হয়ে যাবে।

          -আচ্ছা স্যার।

          -আচ্ছা স্যার না। তাড়াতাড়ি করো। তোমাদেরকেও বোনাস দেব বলেছি, মনে আছে।

          -জ্বী।

          -হ্যাঁ মনে রাখবে। এখন রাখি আমাকে এখন হায়াত রিজেন্সিতে যেতে হবে চায়না থেকে ডেলিগেট আসবে। আজকে আর আমাকে ফোন করবে না। কাল সকাল দশটায় আমি তোমাদের কাছ থেকে ফলো আপ নেব।

          সাইফুর গার্মেন্টসের গেস্ট হাউসে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একে একে ওরা দশজন যখন এসে পৌঁছাল তখন কেউ কাউকে চেনে না। ভুরুঙ্গামারীর করিমন বেওয়া তখনও গুনগুন করে কাঁদছে। একমাত্র ছাওয়াল রমজান তারে কুনখানে পাঠাইল? মা, বেড়াই আসো, জেবনেতো কিছুক দেখ নাই এইবার এই উছিলায় ঢাকা শহরখান দেইছে আস না কেনে।

          -ঢাকা শহর কুনঠে বাপ, কত দূরে তোদের ফেলাইয়া এত দূরে যাইতে হামাক মন চায় না

          -কিচ্ছু হইব না মা গিয়া দেখন তোমার লাহান আরও অনেক বেটিছাওয়াল যাবা। কুনো ভয় নাই।

          নতুন জুতা, জামা-কাপড় কিনে দিয়েছে ছেলে। জীবনে এতকিছু একসাথে কখনও পায় নাই। এমনকি সেই এগারো বছর বয়সে যখন বিয়া দিছিল বাপ তখনও খালিপায়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল।

          -এই যে আফা নামেন। তাড়াতাড়ি নামেন। নিজের ইচ্ছায় আইছেন, অহন কান্দেন ক্যা? একজন মহিলা এসে ঝাঁঝালো গলায় করিমনকে বকা দিতে দিতে হাত ধরে টেনে নামাতে চেষ্টা করল।

          -হ আফা, আপনে না নামলে আমিতো নামতে পারতাছি না। সেই কতক্ষণ থেইকা গাড়িতে বইসা আছি। আমার বমি বমি লাগতেছে।

          সামনে পিছনে তাড়া খেয়ে টলতে টলতে গাড়ি থেকে নেমে এল করিমন। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার অবসাদ কাটার আগেই অবাক চোখে তাকিয়ে দেখল সামনে এক বিশাল রাজবাড়ি।

          -তাইলে হামাক রাজবাড়ি দেখাইতে পাঠাইল সাওয়াল, বাপরে তুই বহুতদিন বাঁচুক। কিন্তুক চক্ষে পানি আহে ক্যান, কান্দন ক্যান আহে- করিমন বুঝতে পারে না।

          গেস্ট হাউজে একে একে দশজন আসার পর তাদের নিজেদের মধ্যে চেনা পরিচয়ের পালা শুরু হল। এদের মাঝে চারজন মহিলা, চারজন মধ্যবয়সী পুরুষ আর দুজন জোয়ান ছোকরা।

          পুরুষ আর নারীদের আলাদা থাকার ব্যবস্থা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা নারীরা দুদিনের মধ্যেই ওরা পরস্পরের আপন হয়ে গেল। যার যার ভাষার আঞ্চলিকতা সত্ত্বেও তারা একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নিবিড় সখ্য গড়ে তুলে। নিজেদের সুখ দুঃখের কাহিনী একে অপরের কাছে বর্ণনা করে সময় কাটাতে শুরু করল।

          করিমন বেওয়া নামাজ পড়ে আর গুনগুন করে কাঁদে। নোয়াখালীর হাসনা বানু তাকে বুঝায়, খালা কান্দেন ক্যান। কান্দি কি অইব? আমরা ব্যাকেই তো ঠ্যাকায় আইছি।

          -হামি কুনো ঠেকায় আসি নাই। হামাক সাওয়াল ট্যাকার লোভে মোকো মরিবার পাঠাইল।

          আবার হু হু করে কান্দে।

          -আরে হুনেন। আপ্নের পোলা চালাক। টেয়া-হইসা অইলে অভাব যাইবো হিয়ার লাই মায়েরে কামে লাগাইল। অসুবিদা কী? একখান কিডনী লইয়াই মানুষ বাঁচে, বহুদিন বাঁচি থাইকতে পারে। তই এইবার আপ্নে কন, টেহাও পাইলেন আবার এক্কেনা সুখের মুকও দেকলেন। আর আসল কতা আন্নের কিডনি ম্যাছ অয় কিনা হেইডাই ব্যাপার। না অইলে যেমন বান্দা তেমন দ্যাশে চলি যাইবেন। কান্দিয়েননা খালা। আইয়েন আন্নের মাতাত ত্যাল দিয়া দিই। আরাম অইব, ঘুম অইব।

          করিমন বেওয়ারে সান্ত্বনা দিলেও হাসনাবানু নিজেরই মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তা হয়। কিডনীতো নিজের ইচ্ছায় দিতে এসেছে। নোয়াখালীর সেই সুবর্ণচর থেকে এসেছে, স্বামীর চিকিৎসার টাকার যোগাড় করতে। যেদিন দালাল আবদুল আলীম সকিনারে তার বাড়ি পাঠিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেদিন শুনে প্রথম থ বনে গিয়েছিল, হাসনা বানু।

          দশ লক্ষ টাকা! সে কত টাকা? এত টাকা দিয়ে কী করবে? পরে সকিনা যখন তাকে বুঝালো স্বামী হালিমের সুচিকিৎসা, তার সুস্থতা, মেয়েদের লেখাপড়া, ভিটায় টিনের ঘর তখন নিজের সাথে অনেক লড়াই করে হাসনা বানু কিডনী বিক্রিতে রাজিতে হয়েছে। তারপর একদিন নিজের সাহসে ভর করে রাতের বেলা আব্দুল আলীমের সাথে বাসে চড়েছে। হাসনাবানু জানে এসব নিয়ে গ্রামে অনেক কথা হবে কিন্তু সে এসবের তোয়াক্কা করে না। সবাই টাকার বশ। যদি দশ লাখ টাকা পায় তাহলে মেম্বারকে হাজার দু হাজার দিলে সবার মুখ বন্ধ হবে। শুধু খারাপ লাগে যখন কিশোরী মেয়ে দুটো আর তাদের বাপের কথা মনে পড়ে। কিন্তু জীবনযুদ্ধে যুঝতে যুঝতে এখন অনেক সাহসী হয়েছে হাসনা বানু। তাছাড়া টিকে থাকার সহজাত যুদ্ধ তার বুদ্ধিকেও ধারাল করেছে। এখন একটাই আশা, কিডনীটা সাহেবের সাথে মিলে গেলেই হয়। সবাইকে সান্ত্বনা দিলে সে কায়মনে প্রার্থনা করে তার কিডনীটাই যেন মিলে। হে খোদা, আল্লাহ এই একবার জীবনে একটা সুযোগ দাও।

          হাবীব আর মানিকের দিন কাটছে মহাসুখে। গেস্ট হাউসের বড় রুমটাতে দেয়াল জোড়া টেলিভিশন। সেখানে সারাক্ষণ সিনেমা গান চলছে। হাউজ কিপার সকাল আটটার দিকে টিভি ছেড়ে দেয়। তারপর রাত বারোটা পর্যন্ত একটানা চলে। প্রথম প্রথম রিমোট ব্যবহার করতে জানত না, এখন শিখে গেছে। সারাদিন দুজনে বসে ইচ্ছে মত সিনেমা দেখে। গ্রামের হাটে-বাজারে যে টেলিভিশন দেখেছে সেগুলোকে এখন একদম ফালতু মনে হয়। দুজনে গল্প করে।

          হাবীব মা-বাবাকে বলে আসেনি। বলে আসেনি তার পরাণপাখি টুনটুনিকেও। কারণ বাবা-মা, টুনটুনি কেউ এ ব্যাপারটা জানলে তাকে আসতে দিত না। আসার সময় বলেছে, দ্যাশে তো তেমন কাম-কাইজ নাই। দেখি ঢাকা গিয়া যদি কোন ভাল কাম জুটাইতে পারি। শুনছি ঢাকা শহরে নাকি ট্যাকা উড়ে।

          টুনটুনি কান্নাকাটি করেছিল, বাপে যদি আমারে বিয়া দিয়া দেয়, তুমি না থাকলে বাধা দিব কে?

          এসব কথায় হাবীব দমেনি, বলেছে, তাইলে সিনেমার নায়িকার মতন জামাইর কাছ থেইকা ছিনাইয়া আইন্যা তোরে আমি বিয়া করুম। একটুও ডরাইস না।

          টুনটুনিকে আশ্বাস দিতে দিতে হাবীবের মাথায় তখন ঘুরছিল সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, সৌদি আরব কত কত দেশে মানুষ যায়। হাবীবের বন্ধু-বান্ধব, সমবয়সীরা গিয়েছে। তাদের বাপের জায়গা-জমি বিক্রি করে গেছে। আবার টাকা পাঠিয়ে কিনেছেও। কিন্তু তার বাপের ভিটেখানাও নেই। কোনরকমে বেড়িবাঁধের ওপর একটা ছাউনির নিচে বসবাস। তবু ব্র্যাকের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল, মাথাটাও ভাল ছিল। কিন্তু সুযোগ ছিল না। লক্ষ্যহীন অনির্দিষ্ট কাজ আজ এটা কাল ওটা করে বাইশ বছরের জীবন কেটেছে। সন্ধ্যার পর একটাই কাজ ছিল এলাকার হাটে-বাজারে নিয়মিত টেলিভশন দেখত। খবর শুনতে, পত্রিকা পড়তেও ভাল লাগত হাবীবের। তাই নিজে থেকেই অনেক কিছু জেনেছে। তাই এলাকার আলতাফ আলী যখন আড়ালে ডেকে কথাটা বলেছিল। তখন সিঙ্গাপুর নামটা শুনে চমকে উঠেছিল। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, আবুধাবী, সৌদি আরব কত জন যায়! মাথার মধ্যে ঘুরছিল সিঙ্গাপুর, সিঙ্গাপুর----- একবার যদি যাইতে পারি। সারাদিন একসাথে থাকলেও হাবীব ভুলেও মানিকের সাথে এসব আলাপ করে না। মানিককে একটু হাবাগোবাই মনে হয় হাবীবের। মা বাপ নেই। মামা-মামীর বুদ্ধিতে এসেছে।

          ঢাকার সবচেয়ে নামকরা কিডনী হাসপাতালে প্রতিদিনই ওদের দু-তিনজনকে নিয়ে টেস্ট করা হয়। নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে যাদের সাথে সবকিছু ম্যাচ করবে তাদের তিনজনকে সাথে নিয়ে সিঙ্গাপুর উড়াল দেবেন আশরাফ উদ্দীন। সঙ্গে যাবে স্ত্রী বড়ছেলে আর কোম্পানীর এডিশনাল ম্যানেজার মাহবুব আলী।

          যেদিন টেস্ট করতে যাওয়ার কথা তার আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই জায়নামাযে বসে থাকেন বশীরুল্লাহ। আল্লার কাছে তার একটাই প্রার্থনা, তার কিডনীটি যেন সাহেবের সাথে মিলে যায়। অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান বশীর। যমুনার ভাঙনে এই মধ্যবয়সে ঘরবাড়ি হারিয়ে সরকারের আশ্রায়ন প্রকল্পে ঠাঁই নিয়েছেন। বড়ো কষ্টের এ জীবন। স্বচ্ছল জীবনে অভ্যস্ত সর্বস্ব হারানো এই মানুষটির একটাই স্বপ্ন সর্বনাশী যমুনার পার থেকে অনেক দূরে গিয়ে পরিবারের জন্য অন্তত একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই গড়বেন, নিজের নতুন ঠিকানা হবে। আল্লাহ তুমি মহান আমাকে এটুকু দয়া করো। এতে যদি মরণও আসে তাতেও কোন আফসোস থাকবে না। টাকাটা পেলে অন্তত তার সন্তানেরা বাঁচবে। বিড়বিড় করে মোনাজাতের সময় তার দুচোখ থেকে অবিরত অশ্রু ঝরে।

          প্রার্থনা শেষ হলে ঝালকাঠির হাশেম জানতে চায়- আফনে এত কান্দেন ক্যান ভাইসাব। মোরা হক্কলেই আইছি ট্যাকা-পয়সার লাগি, জীবনের বিপদও আছে হেইডাও জানি। কিন্তুক কেউতো এমুন কান্দে না।

          -হ, ভাইজান, আমি কান্দি আমার দুঃখে, আমার কষ্টে- বলতে বলতে হু হু করে আরও কাঁদেন।

          তার সঙ্গী বাকি দুজন চেয়ে থাকে। তাদের বুকও চিনচিন করে-খোদা না খাস্তা যদি কোন বিপদ ঘটে যায়!

          -নাহ ডাক্তার সাহেব কইছেন, এহন এসবে কোন বিপদ নাই! বিপদ না থাকলে আর জুইড়া গেলে- অনেক টাকা!

          বাকি দুজন গোপনে প্রাণপণ প্রার্থনা করে হে আল্লাহ তুমি আশার আলো, আমারে নিরাশ কইরো না। দশলাখ টাকা! যদি পাই, যদি পাই! একজন ভাবে যৌতুকের লাইগা মেয়েটারে জামাই এত অইত্যাচার করে হারামজাদারে কিছু ট্যাকা দিয়া যদি মুখ বন্ধ করণ যায়।

          অন্যজন ভাবে, বন্ধকী জমি আর হালের বলদটা ছাড়ান গেলে দুনিয়াতে আর কুন অবাব নাই এত সুখের জেবন কি হাঁছাই ধরা দিব

          শুধু কোন কথা বলে না বিধু চাকমা। নাইক্ষ্যংছড়ির যেখান থেকে সে এসেছে তার সেখানকার ভাষার সঙ্গে এদের ভাষার দূরত্ব অনেক তাই অহর্নিশ তার ভিতরে বোবা কান্না গুমরে মরে। এখানে আসার পর থেকেই তার ভিতরে একটাই প্রশ্ন- ঠিক করলাম না ভুল!

          অবশেষে তিনজনের কিডনি সবদিক থেকে ম্যাচ করল। হাবীব, বশিরুল্লাহ আর কল্পনার। মেয়েদের মধ্যে যে অল্পবয়সী বিধবা মেয়েটি বিষণ্ণ চুপচাপ থাকত সেই জিতে গেল। হাসনাবানুর বুকের ভিতরটা জ্বলে যায়। এতদূর এসেও ভাগ্য তার হাতে ধরা দিল না। সব আশা সব স্বপ্ন মাটি। যেদিন হাসপাতালের ডাক্তারসাহেব এ কথাটা জানালেন, হাসনাবানুর ইচ্ছে করছিল এই ঢাকা শহরেই কোন একটা গাড়ির নিচে ঝাঁপ দিতে। কিন্তু যে গাড়িতে ফিরেছিল, সেটার দরজা-জানালা বন্ধ ছিল। কালো কাচে ঢাকা সেই গাড়িতে এসি চললেও তার মাথায় তখন হাবিয়া দোজখের আগুন জ্বলছিল।

          হাবীব বেজায় খুশি। তার ভিতরে একটাই উত্তেজনা একবার সিঙ্গাপুর যেতে পারলেই হল। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সে চম্পট দেবে। তারপর কোথাও না কোথাও বাঙালীভাইদের খুঁজে পাবে। কিডনী সে দিতে চায় না। এই জোয়ান বয়সে কিডনী দিয়ে মরবে নাকি! সিঙ্গাপুর যেতে পারলে দশ লাখ টাকাতো কিছুই না। হাবীব নিজেকে যতই জ্ঞানী ভাবুক সে জানে না সিঙ্গাপুরের আইন আর সাইফুর রহমানদের লম্বা হাতের কথা। তাই পাসপোর্ট-ভিসা ইত্যাদির প্রক্রিয়ায় যে কদিন দেরি হয় তাতেই সে অস্থির হয়ে পড়ে।

          করিমন বেওয়া দু রাকাত নফল নামাজ পড়ে। কোথায় কোন দেশে যে তাকে যেতে হয়নি তার জন্য শোকর গুজরান করে। নীলুবেগম যেমন চুপচাপ এসেছিল তেমনি চুপচাপ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। স্বামীর প্রথম স্ত্রী এবং নিঃসন্তান হয়ে তার জীবনে কোন আশা-আকাঙ্ক্ষা নেই। স্বামীর ইচ্ছায় এসেছিল এখন ফিরে গিয়ে আরো হেনস্থা হতে হবে। যার যা কপাল- ঠোঁট চেপে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।

          যারা ফেরত যাচ্ছে তারা একে একে গাড়িতে ওঠে। হাসনা বানুর আবদুল আলীমের কাছে পাওনা দশহাজার টাকা চাইলে সে খেঁকিয়ে ওঠে- আগে বাড়িত যাও। ওরা সাতজন চলে যেতে বিশাল গেস্ট হাউসটা খালি হয়ে যায়। মানিকের জন্য হাবীবের মনটা কেমন করে। বুকের ভেতরটা আকুলি বিকুলি করে টুনটুনি আর বাপ-মায়ের জন্য কিন্তু সিঙ্গাপুর যাবার স্বপ্নে সেসব ভুলতে তার দেরি হয় না।

          দীর্ঘ তিনমাস সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে কাটিয়ে সাইফুর রহমান খান যখন ফিরে আসেন তখন অফিসের লোকদের কাছে তাকে অনেক তরতাজা লাগে। হাবীব আর কল্পনা আগেই ফিরে এসেছে। বশীরুল্লাহও ফিরেছে তাদের কিছুদিন পর। তবে সপ্রাণ নয়। তার নিষ্প্রাণ দেহটা বাংলাদেশ এসেছিল। তার কিডনী দুটি সবচেয়ে সুস্থ ছিল। কিন্তু একটি কিডনী দেয়ার পরই তার অপর কিডনীটি আকস্মিক ফেইলিওর হয়।

          বশীরউল্লাহর ছেলেরা বাপের মৃত্যুতেও সুখী- তাদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩১-৩২

----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ __________________________...

Popular Posts