Sunday, 23 February 2025

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ২৯ - ৩০


 

-----------------------------------

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫

___________________________________

২৯

 

শীলা আর মামুন বাসায় ঢুকতে ছেলেমেয়ে দুটো কলকলিয়ে উঠল

          "তোমরা এত তাড়াতাড়ি এসে গেছ আমরা ভেবেছিলাম আরও দেরি হবে"

          "হ্যাঁ মা, আমি আর ভাইয়া প্ল্যান করেছিলাম তোমরা আসার আগে রান্না করে তোমাদের তাক লাগিয়ে দেব!"

          "না মা, তাক লাগাতে হবে না আমিই রান্না করব কাপড় বদলে আসি" বলতে বলতে শীলা শোবার ঘরের দিকে পা বাড়াতে মনিকা আর মহুল দুদিক থেকে মায়ের দুহাত জড়িয়ে ধরল

          "কেন মা, আমরা কি পারি না? আমরাতো বড় হয়েছি তোমাদের একটু আরাম দিতে পারলে আমাদেরওতো ভাল লাগে"

              "তোমাদের শরবত দিই মা" মনিকা মায়ের গায়ের গন্ধ নিতে নিতে বলল

              মামুন এতক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল এবার বলল, "শুধু তোদের মাকেই দিবি শরবত!"

              "কেন বাবা আমিতোতোমাদেরবলেছি তুমি বহুবচন ভুলে গেছ"

              মামুন হেসে উঠল "সরি, সরি মামণি, আমি খেয়াল করিনি"

          "আমাদের মনিকা ব্যাকরণে পাণিনি-পতঞ্জলি হয়ে যাচ্ছে বাবা শুধু ভাষার ভুল ধরে"

          "ধরব না! আমি যে বাংলায় A+ পেয়েছি আরে কথা বলতে বলতে শরবত বানাতে দেরি হয়ে যাচ্ছে আর কোন কথা নয় মা-বাবা তোমরা একটু রেস্ট নাও আমরা শরবত নিয়ে আসছি এই ভাইয়া আয়"

          "তোমার ছেলে-মেয়ে দুটো মা বলতে পাগল"

          "কিন্তু ওরা তো ওদের বাবাকে বেশি ভালবাসে কারণ বাবা বকা দেয় না"

          "আরে ওটাতো কথার কথা প্রাণের কথা যে ভিন্ন"

          "ওইটুকুইতো আমার জীবনের পরম পাওয়া ডাবল-ডাবল বাবা মা হারিয়েছি পৃথিবীতে ওদের চেয়ে বড় সম্পদ আমার আর কিছু নেই কিছু চাইও না শুধু চাইওরা যেন সত্যিকারের মানুষ হয় দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করতে পারে তাইনা?"

          "এটাতো তোমার তসবি জপা"মামুন হেসে উঠল

          "মা দেখতো মিষ্টি ঠিকমত হল কিনা"

          "আমার লক্ষী মেয়ের হাতে করা শরবত এমনিতেই মিষ্টি"- শীলা আদর করে বলল

          "না মা চিনি আমি দিয়েছি" মহুলের কথায় একসঙ্গে চারজনই হেসে উঠল

          সারাটা পথ যে স্মৃতির বিষাদে শীলার নটা ভারী হয়ে ছিল ঘরে ফিরে ছেলে মেয়ের ভালবাসার রোদ্দুরে সে মেঘ কেটে গেল

          বাথরুম থেকে বেরিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে শীলা দেখল টেবিলে খাবার রেডি টেবিলের কাছে এসে দেখল ভাত, আলুভর্তা, ডিমের তরকারি, সবজি আর ডাল

          নিচু হয়ে রসুন বাগার দেওয়া ডালের সুবাস নিতে নিতে শীলা মন্তব্য করল, "বাব্বাহ এত কিছু! কই তোদের বাবাকে ডাক এত মজার খাবার দেখে আমার খিদে একেবারে চনমন করছে"

          "বসে যাও, বসে যাও সকাল থেকে তো দানাপানি তেমন পেটে পড়েনি শুরু করে দাও, আমি আসছি" ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মামুন হাঁক দিল

          টেবিলে বসেই মামুন বলল, "সব তোরা রেঁধেছিস?"

          "হ্যাঁ বাবা, শুধু সবজিটা বুয়া করে দিয়েছে আমি দাঁড়িয়ে দেখেছি এখন থেকে আমিই পারব"

          "বাহ্‌ তাহলে তো আর ভাবনা নেই আমার মেয়ে পাকা রাঁধুনী হয়ে গেল এবার কবজি ডুবিয়ে খেতে পারব"

          মামুনের কথায় বাকি তিনজন হেসে উঠল খেতে খেতে মহুল জানতে চাইল- "আত্মীয় স্বজন নিশ্চয় সবাই এসেছিল নানুর চেয়ে বড় তো আর কেউ ছিল না"

          "হ্যাঁ, অনেকে এসেছিল আবার অনেকে ঢাকাতে জানাযা পড়েছে তারা আর আসেনি"

          "অনেক ছোটবেলায় দেখেছিলাম নানাভাইয়া থাকতে আমরা যখন ঢাকায় ওনাদের বাসায় বেড়াতে যেতাম তখন খুব আদর করতেন"

          "তখন দিনগুলো অন্যরকম ছিল, তাই না মা!"

          "হ্যাঁ বাবা, তখন দিনগুলো সত্যিই অন্যরকম ছিল প্রিয়জনরা প্রিয়ই ছিল এত দূরত্ব ছিল না ওরাই আমার ভাই ছিল, বোন ছিল" কথাগুলো বলতে বলতে শীলা কিছুটা বিষন্ন হয়ে উঠল

          "নানাভাইয়ার বাড়িতেও খুব মজা ছিল আমাদের পরীক্ষা হলে তোমার ছুটি হলে আমরা বাড়ি যেতাম এঘরে ওঘরে আমাদের কত খেলার সাথী ছিল, পরী, মোহনা, পারুল, মুনিয়া"- মনিকা বলতে থাকল

          "হ্যাঁ, ওরা সবাই এখন শ্বশুর বাড়িতে কেউ কেউ বাচ্চার মা হয়ে গেছে প্রায় সবাই এসেছিল"

          "আচ্ছা কথা বলতে বলতে খাওনা তুমি দেখি কথা বলতে বলতে হাত তুলে বসে আছ দুদিন ধরে তো বলতে গেলে না খেয়ে আছ" মামুন তাড়া দেয় "ছেলে-মেয়ে এত কষ্ট করে রান্না করেছে খেয়ে সার্টিফিকেট দিতে হবে না খাও, খাও"

          "খাচ্ছি তো"

          ডিম ভাজিটা শীলার পাতে তুলে দিতে দিতে মামুন বলল, "জানিস আমরা যখন মামার বাসায় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন যে বুয়া আমাদের রান্না করত, একদিন তোদের ফরিদ কাকা দুষ্টুমী করে বলেছিল, আজ কি রেধেছ ডার্লিং?"

          বুয়া তেমন ভাল রাঁধতে পারত না সে তখন না বুঝেই বলেছিল, " ভাইজান আইজকা ডাইল আর ডিমই রানছি সেই থেকে ডাল ডিম রান্না হলে আমরা বলতামডার্লিং"

          মহুল মনিকা হাসতে হাসতে বিষম খাবার অবস্থা শীলা অবশ্য আগেও শুনেছে ঘটনা সে বলল, "তোদের বাবার ভান্ডারে এসব গল্পের অভাব নেই বড় হচ্ছিস কত শুনতে পাবি"

          "মা, তোমার আসলে মন ভাল নেইতো তাই কোন কিছুই তোমার ভাল লাগছে না"

          "ভাল কিভাবে লাগবে বল আমার খালাম্মা আমাকে ছোট থেকে কত আদর রেছে মাঝখানে 'টা বছর অভিমানে আমি দূরে সরে গেলাম দেখতে ইচ্ছে করলেও যেতাম না এখন কেমন যেন আফসোস হচ্ছে"

          "আফসোস করোনা তো তুমি যা করেছ তা হান্ড্রের্ড পারসেন্ট সঠিক নানাভাইয়ের সাথে ওরা যে আচরণ করেছে তাতে ওদের বাসায় যেতে তোমার ইচ্ছে করবে কেন?" মহুল মাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করল

          খাওয়া শেষ হতেই মনিকা বলল, "মা টেবিল আমি গোছাব তুমি রেস্ট নাও তোমাকে খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে পর পর দুদিন জার্নি আসলে তো চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই দুবার"

          বেসিনে মুখ ধুতে ধুতেই শীলার মোবাইল বেজে উঠল মহুল ফোনটা এনে মায়ের হাতে দিল

          "কে করেছে রে?" শীলা জানতে চাইল

          "মামা"

ফোন ধরে শান্ত বলে ডাকতেই ওপাশ থেকে জবাব এল, "জী কখন ফিরলেন?"

          "এই তো ঘন্টা দুয়েক হল তোরা সবাই ভাল আছিস?"

          "হ্যাঁ, সবকিছু ঠিকঠাকমতো হয়েছে তো?"

          "হ্যাঁ, হ্যাঁ"

          "আমরা এখানে জানাযা পড়েছি ঠিক আছে আপনি এখন রেস্ট নেন পরে কথা হবে"

          "আচ্ছা, খোদা হাফেজ"

          মোবাইলটা রাখার আগেই আবার বেজে উঠল- বাটন চাপ দিয়ে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নিতু কথা বলে উঠল- "আপা ফিরেছেন?"

          "হ্যাঁ"

          "কখন? শরীরের কলকব্জা ঠিক আছে তো হাইওয়ের অবস্থা যা খারাপ তার ওপর আপনার ব্যাকপেইন তাই চিন্তায় ছিলাম"

          "না ভাল আছিরে"

          "মহুল-মনি কেমন আছে? ওদের কোন সমস্যা হয়নি তো!"

          "না, না ওরা ভালই ছিল আজকে তো দুজনে আমাদের জন্য রান্নাবান্না করে টেবিল সাজিয়ে রেখেছে"

          "আপনি খেয়েছেন?"

          "হ্যাঁ, এইতো খেয়ে উঠলাম"

          "ভাইয়া?"

          "ভাল আছে"

          "আচ্ছা, আচ্ছা আপনি রেস্ট করেন মনিকে ফোনটা দেন"

          মনিকার হাতে ফোন দিয়ে শীলা বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল মামুন ইতিমধ্যে নাক ডাকাতে শুরু করেছে

          বেশ কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পরও শীলার ঘুম আসে না কেবলই সুবর্ণগ্রামের কথা মনে পড়ছে আম্মা-বাবা, খালাম্মা-জেঠামনি বাড়ির লোকজন, পাড়া-পড়শী, মনে পড়ছে মাঠঘাট, নদী-নৌকা, শীত-গ্রীষ্ম কত কী যে মানুষের চিন্তার গতি কি আলোর গতির চেয়েও বেশি! যদি না হয় এই মুহূর্তে জীবনের টাশটি বছরের হাজারো ঘটনা মাথার ভেতর বিদ্যুৎগতিতে ছুটে যাচ্ছে কেন?

          "মা ঘুমাওনি!"

          "নারে মা ঘুম আসছে না"

          "নানুর জন্য বেশি খারাপ লাগছে?"

          "ঠিক তাও নয় খারাপ একটু লাগছে এটা সত্যি তবে পরিণত মৃত্যু তেমন শোকার্ত করে না"

          "তাহলে?"

          "আসলে অনেকদিন পর সুবর্ণগ্রামে গিয়ে অজস্র স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে এক কাপ চা বানিয়ে দিবি মা?"

          "অবশ্যই তুমি এতক্ষণ বলোনি কেন?"

          "না এক্ষুনি মনে হল ঘুম যখন আসছে না চা খেলে হয়তো একটু ভাল লাগবে"

          "দেখ বাবা কেমন নাক ডাকাচ্ছে আর তুমি ঘুমাতে পারছ না"

          "তোর বাবাতো সুখী মানুষ কোন কিছুতে অভিযোগও নাই অসন্তুষ্টিও নাই"

          "বাবা খুব ভাল মানুষ"

          "তা হতে পারে তবে আমি এখনই সার্টিফিকেট দিচ্ছি না"

          "মা তুমি না অনেক হিংসুটে" বলে হেসে উঠল মনিকা

          "কে হিংসুটে রে"জড়ানো গলায় বলতে বলতে পাশ ফিরে শুল মামুন "তোদের মা-মেয়ের জ্বালায় ঘুমাতে পারছি না"

          "আচ্ছা বাবা তুমি আরাম করে ঘুমাও মা চলো আমার ঘরে ঘুম যখন আসছে না আমরা গল্প করব"

          শীলা উঠে স্যান্ডেল জোড়া পায়ে গলিয়ে মনিকার ঘরের দিকে যায় ট্রেতে করে চা আনতেই শীলা চোখ বড় করে জানতে চায়, "এত চা কে খাবেরে!"

          "কেন ভাইয়া, তুমি আর আমি খাব"

          "মহুল ঘুমায়নি?"

              "না কম্পিউটারে কাজ করছে কী অ্যাসাইনমেন্ট নাকি জমা দিতে হবে"

              বিছানায় বসতে বসতেই হাঁক দিল মনিকা"ভাইয়া চা খাবিতো আয়"

          চায়ে চুমুক দিয়ে মহুল বলল, "মা তোমার ছোটবেলার কথা বল"

          "এই তো সবার যেমন ছোটবেলা কাটে দৌড়ঝাঁপ খেলাধুলা করে আমারও তেমনি কেটেছে তবে একটা বিষয় অন্যরকম ছিল"

          "কী রকম?"

          "আমার বয়সী আর সবাই যখন খেলতে যেত বড়শী দিয়ে মাছ ধরত, ভোরবেলা বা ঝড়ের দিনে আম কুড়াতো- এমনকি তোদের লীলা খালামনিও, তখন আমাকে ঘরে বন্দী থাকতে হতো"

          "কেন কেন?"

          "আমার বাবা ভাবতেন এসব করতে গিয়ে আমার বিপদ হতে পারে তাই আমার সবকিছু ছিল সীমিত গন্ডিতে আবদ্ধ হয়তো দুপুরবেলা লীলা আমি এবং আরো আরো ভাইবোনেরা মাঠে গিয়েছি কচি খেসারি কুড়াবো বলে বাবা আমাকে ডেকে পিঠে করে তুলে নিয়ে এলেন ঘুম পাড়ানোর জন্য তারপর বিকেলে দেখি রান্নাঘরে এক ঝাঁকা কচি খেসারি কত খাবে খাও"

          "তোমার বাবাটা বড্ড বেরসিক ছিল"

          "না তা নয় আমাকে নিয়ে ওঁদের একটা হারাই হারাই ভাব ছিল একটু জ্বর হলেই আম্মা অস্থির হয়ে পড়তেন যেন আমি আর বাঁচব না আর বাবাতো সারাক্ষণ মাথার পাশে বসে থাকতেন হাত-পা টিপে দিতেন মাথায় জলপট্টি"বলতে বলতে শীলার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠল

          মহুল আর মনিকা দুপাশ থেকে জড়িয়ে ধরল- "মা মা আমরাতো আছি আমরাও তোমাকে ভালবাসি"

          শীলাও দুজনকে দুহাতে জড়িয়ে বলল, "ভালবাসা আসলে বহুমাত্রিক তোদেরটা একরকম, আমার বাবা-আম্মারটা আরেকরকম"

          মহুল-মনিকা চুপ করে শোনে বুঝতে পারে অনেকদিন পর সুবর্ণগ্রামে গিয়ে মা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছে কথাগুলো বলে ফেললে হয়তো একটু শান্ত হবে

              শীলা বলতে থাকে- "জানিস আমাদের ছোট নদীটা বর্ষাকালে কেমন ভরে উঠত এপার-ওপার তখন দেখা যেতনা পালতোলা নৌকা যেত বেপারীদের নৌকা আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুনতাম- একটা-দুটো-তিনটা আরো যে আরো আসছে সামনে দিয়ে পাল উড়িয়ে নৌকাগুলো যখন চলে যেত তখন মনে হত ওদের সাথে আমরাও কত দেশ-দেশান্তরে যাচ্ছি

          নদীর পাড়ে আমাদের অনেক মিষ্টি আলুর ক্ষেত ছিল সেই আলু মাটির নিচে থেকে তুলে নদীর পানিতে ধুয়ে সবাই খেতাম আর শাপলা-শালুক তো ছিলই কিন্তু সবাই খেত খুব মজা করে দেখিয়ে দেখিয়ে আর আমাকে খেতে হত লুকিয়ে লুকিয়ে"

          "তুমি যে নানাভাইয়া আর নানুর চোখের মনি ছিলে নানুকে তো মনে নেই কিন্তু নানাভাইয়া আমাদের কি কম আদর করেছে আমাদের সব আবদারতো আর কাছেই ছিল আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া থেকে আইসক্রীম খাওয়া সবইতো তাঁর সাথে"

              "হ্যাঁ রে বাপ আমার বাবা তোদের যেভাবে যত্ন নিতেন তা দেখে পাড়া প্রতিবেশীরা অবাক হত একটা পুরুষ মানুষ বাচ্চাদের এত যত্ন করে কীভাবে"

          "আমাদের অসুখ হলে নানাভাইয়ার কোলে চড়ে কাঁধে মাথা রাখতাম আর উনি ঘরের মধ্যে হেঁটে বেড়াতেন তোর মনে আছে মনি?" মহুল জ্ঞিজ্ঞেস করল

          "হ্যাঁ ভাইয়া"

          "হ্যাঁ, আমাকে বলতেন তুমি ঘুমাও আমি ওদের দেখব আমার কষ্ট একদম সইতে পারতেন না অথচ আমি - আমি তাঁদের জন্য কিছুই করতে পারিনি"- এবার হু হু করে কেঁদে ওঠে শীলা

          "মা, মা কাঁদে না লক্ষী মা" মহুল মায়ের মাথায় হাত বুলায় মনিকা কোলে মুখ গোঁজে - "মা, মাগো কেঁদো না"

          নিজেকে সামলে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে শীলা হঠাৎ মহুল বলে ওঠে- "মা দেখ বড়মামারা কেমন (এখনও জহিরকে বড়মামাই ডাকে মহুল) এত টাকা-পয়সা হল অথচ ভাই-বোনে মিল নেই আর তোমরা ভাইবোনরা দূরে দূরে মানুষ হলে, অথচ কি নিবিড় সম্পর্ক তোমাদের এই যে তুমি এলে গেলে আন্নি আর মামা কতবার আমাদের খোঁজ নিল

              "হ্যাঁ বাবা আমি মাতৃহারা হয়ে আম্মার কোলে আশ্রয় পেলেও তারা আমার পিতাকে ঠিকই চিনিয়েছিলেন আমি জানতাম আমরা ভাইবোন একই পিতার সন্তান আমাদের সবার শিরায় শিরায় বহমান একই জন্মদাতার রক্তের উত্তরাধিকার"

          "তবে একটা কথা মা"- মহুল বলে, "নানা অনেক সম্পত্তি রেখে গেলে তোমরাও হয়তো এরকম থাকতে না"

          "তাও হতে পারে তবে আমার সম্পত্তির চেয়েও সম্পদের দিকে লোভ বেশি তোরা দুজন আমার সেই সম্পদ তোরা ভাল থাকিস পৃথিবীতে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই"

          দুভাইবোন আবার মায়ের কাছে ঘনিষ্ট হয়ে বসে মসজিদে মাগরিবের আযান দিচ্ছে এবার উঠতে হবে মহুল উঠে ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দেয় মামুনও উঠে আসে

 

****

৩০

 

সকাল থেকেই জহিরদের তোড়জোড় শুরু হল তাড়াতাড়ি রওনা না দিলে জ্যামে পড়তে হবে নাস্তা খেয়েই সবাই রেডি জহিরের পাজেরো জিপ রেডি মাইক্রো ভাড়া করা হয়েছে একটি বেশিরভাগ মেহমান কাল চলে গেছে জহিররা চলে গেলে আজ থাকবে শুধু তারিক শরীফ আর তাদের পরিবার শেলি আপা তার ছেলেদের সাথে কালকেই চলে গেছে বাড়ির-গ্রামের লোকজন এসেছে দেখা করতে কেউ কেউ নিজেদের সমস্যার কথা বলতে হাতে সময় নেই তবু কাউকে কাউকে সময় দিতে হচ্ছে লীলা বাড়িতে থাকছে তার উপরই সামলানোর ভার দিয়ে যাচ্ছে

          আন্না, আয়না আর মালিহা দাঁড়িয়ে দেখছে অরিন-আরিয়ানা আর তাদের মামাতো খালাতো ভাইবোনদের সাথে একদিনেই অনেক ভাব জমে গেছে তার ওদের চলে যাওয়া দেখে তাই মালিহার খারাপ লাগছে আগামীকাল দাদুর কুলখানি করবে বাবা আর মেজকা কিন্তু বড়কাকাকে একবারও বলছে না থাকতে

          আন্নাও ভাবছে একবার অন্তত বলুক শরীফ, "ভাইজান থাকেন" এসব অনুষ্ঠানেতো মানুষ অপরিচিতকেও দাওয়াত দেয় কাল রাতেও আন্না কয়েকবার অনুরোধ করেছে শরীফকে- "ভদ্রতার খাতিরে হলেও একবার বল তোমার মায়ের পেটের ভাই"

          এক পর্যায়ে শরীফ রেগে গিয়ে বলেছে, "মায়ের পেটের ভাইতো আমার তোমার এত দরদ কেন?"

          এরপর আন্না আর কিছু বলেনি

              ওদের বিদায়পর্বে উপস্থিত হয়ে আন্না আয়নাকে প্রস্তাব দিল- "আমরা একবার বলব ভাবি! আমরা বাড়ির বউ আমাদেরওতো কিছু অধিকার আছে"

              "না ভাই, অধিকার তোমার থাকলেও আমি মনে করি না আমার আছে আমিতো তোমার মেজভাইকে চিনি, শেষে নিজেই মানসম্মান হারাব"

          সাবেরা একে একে বিদায় নিল সবার কাছ থেকে দুইজাকে জড়িয়ে ধরল মালিহার কপালে চুমু খেল অরিন, আরিয়ানাও বিদায় নিল মালিহার কাছ থেকে একটা দিনের জন্য দেখা হয়েও সবাইকে কেমন আপন মনে হচ্ছে বিশেষ করে মালিহার জন্য খুবই মায়া হচ্ছে

          অরিন মালিহার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, "আসি মালিহা"

          "ঢাকায় গেলে দেখা হবে, কথা হবে" ফিসফিসিয়ে বলল মালিহা, "একদিন আমরা একসাথে হব"

          অরিন অবাক চোখে মালিহার দিকে তাকাল এই ছোট্ট কিশোরী মেয়েটি যার মাত্র পিউবার্টি শুরু হয়েছে সে এমন আশা নিয়ে কথা বলছে!

          অরিনের এমনিতে মন খারাপ ঢাকায় গিয়েই তাকে ভিসার জন্য আমেরিকান অ্যামবেসিতে দৌড়াতে হবে পুরো এক মাসও হাতে নেই তারপর- থাক তারপর ভাবতে ইচ্ছে করছে না অভীটা যে কী করল! কেমন করে ওকে না দেখে থাকবে সে! 

****


No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩৭-৪১

  ----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ ________________________...

Popular Posts