__________________________________________
রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র
গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪
গল্প - স্বপ্নের ঠিকানা
__________________________________________
স্বপ্নের ঠিকানা
ছুটির
দরখাস্তখানা অধ্যক্ষের সামনে দিতেই জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন তিনি - "তিন দিনের
ছুটি!"
"জী
স্যার। ঢাকা যাব।"
"ও
আচ্ছা। মেয়ের কাছে?"
এবার আর
উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারলেন না।
"মেয়ের কাছে যাব, তবে এবার একটা বিশেষ দরকারে যাচ্ছি। একটা প্লটের
বুকিং দিতে যাচ্ছি।"
"সারাজীবন
থাকলেন এখানে আর এখন প্লট বুকিং দেবেন ঢাকায়?"
"কী
করবো স্যার। ছেলেমেয়ে দুটো ঢাকায়। ওদের কথা হল ঢাকায় না থাকলে ক্যারিয়ার গড়া যায়
না। লেখাপড়া, চাকরি সবকিছুর সুবিধা ঢাকায়। তো কিনব তো ওদেরই জন্য। তাই আর
কি।"
"কথাটা
সত্যি। কত বিকেন্দ্রীকরণের কথা শুনলাম। কিন্তু সে কেবল কাগজে কলমে। বাস্তবে ঢাকা
মাইনাস পুরো দেশটাই জিরো। ঠিক আছে, আমি সাইন করে দিচ্ছি। আপনি কেরানির কাছে জমা
দিয়ে যান। উইশ ইউ বেস্ট অব লাক।"
সালাম
দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আজ ক'দিন থেকে মনটা হাওয়ায় উড়ছে। ভাবতেই ভাল লাগছে
একটা জমি হবে। এক টুকরো আবাস, একটা স্থায়ী ঠিকানা।
টিকেট
আগেই কাটা ছিল। বাসায় এসে শেষ মুহূর্তের গোছগাছ করতে করতেই মেয়ের ফোন এল -
"রেডি হয়েছেন আম্মা?"
"হ্যাঁ
মা রেডি।"
"তাহলে
বেরিয়ে পড়েন। আর হ্যাঁ, স্টেশনে শিমুল আর রাশেদ থাকবে।"
"আমিতো
একাই যেতে পারতাম। তাছাড়া শিমুল একাই তো যথেষ্ট। রাশেদকে কেন আবার কষ্ট
দিবি?"
"সবকিছুতে
সবার কষ্ট হবে ভাবেন কেন আম্মা? কোন কোন কষ্টে আনন্দও থাকে। স্টেশনে যাবে তাতে
কষ্ট কিসের? তাছাড়া ট্রেনের কোন ঠিক-ঠিকানা আছে? ন'টার ট্রেন ক'টায় পৌঁছাবে কেউ
নিশ্চিত করতে পারে? আপনি এসে পৌঁছালে আমার স্বস্তি। আর হ্যাঁ, ট্রেন ছাড়লে আমাকে
একটা ফোন করবেন। রাখি তাহলে। খোদা হাফেজ।"
"খোদা হাফেজ।"
মোবাইল ফোনের লাইন কেটে দিলেন। ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠল। তৃপ্তির
হাসি। আজকাল মেয়ের আচরণে কে মেয়ে কে মা বুঝে উঠতে পারেন না। বাচ্চামেয়ের মত
সারাক্ষণ তত্ত্বতালাশ করে তাকে আগলে বেড়াচ্ছে।
মেয়ের এই ছোট ছোট খোঁজ-খবর আর উদ্বিগ্নতায় এক ধরনের পরিতৃপ্তি বোধ করেন সুলেখা
হাসান। নিজেকে সুখী মনে হয়। জীবনের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার কষ্ট আর বঞ্চনাগুলো মুছে
গিয়ে পরম শান্তিতে ভরে ওঠে মন। ছেলে-মেয়ে মায়ের জন্য উদ্বিগ্ন - এরচেয়ে সুখ আর কী
আছে?
স্টেশনে
এসে জানলেন যথারীতি ট্রেন লেট। বাংলাদেশে এটাই এখন সংস্কৃতি। ট্রেন লেট, বাস
যানজটে আটকা - বসে থাকো ঘন্টার পর ঘন্টা। আর ঢাকা গেলে তো কথাই নেই - গলি থেকে
রাজপথ সর্বত্রই যানজট দিন দিন বাড়ছেই। কবে যে এ অবস্থা থেকে মুক্তি কেউ জানে না।
ভাবতে ভাবতেই নিজের তল্পিতল্পা নিয়ে ঠাঁই খুঁজতে লাগলেন। নাহ্ কোথাও
এতটুকু তিল ঠাঁই আর নাহি রে। অগত্যা দাঁড়িয়ে থাকলেন। বেশিক্ষণ দাঁড়ালে আজকাল পায়ে ব্যথা হয়। হাঁটুর ওপর খুব চাপ পড়ে। কিন্তু
কিছু করার নেই। চারপাশে লোক গিজগিজ করছে।
মনে পড়ল হুমায়ূন আহমেদের একটা লেখায় পড়েছিলেন চারপাশের জগতকে ভুলে গিয়ে
নিজের মধ্যে ডুব দিতে পারলে সব দুঃখকষ্টকে ভুলে থাকা যায়। যেমন প্রচন্ড গরমে কেউ
যদি মনোজগত তৈরি করতে পারে যে সে খুব ঠান্ডার দেশে আছে, তার চারপাশে সবকিছু জমে
বরফ হয়ে যাচ্ছে তখন আস্তে আস্তে তার ঠান্ডার অনুভূতি হবে। জীবনের নানা যন্ত্রণাকে
ভুলতে কয়েকবার চেষ্টাও করেছেন কিন্তু সফল হননি। কোন কিছু ভাবতে গেলে শুধু নিজের
অতীতই ভেসে ওঠে।
জন্মের
দু'বছরের মধ্যে মাকে হারিয়ে নিঃসন্তান খালার কোলে মানুষ হয়েছেন। মায়ের মৃত্যুর পর
খালার কাছে দিতে বাধ্য হলেও বাবা কখনোই বিষয়টা মেনে নিতে পারেন নি। তাই মাঝে মাঝেই
হানা দিতেন খালার বাড়িতে মেয়েকে নিতে। তখন যে কী কষ্ট হত ছোট্ট বুকটায়। বাবার চোখে
না পড়ার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াতে হত। বাড়ির আনাচে কানাচে ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকতে
থাকতে কখনো গাছ কখনো পাখি হয়ে যেতে ইচ্ছে করত।
কিন্তু ছোট্ট মেয়েটার ছোট্ট বুকের ভেতর পাখাঝাপটানো কষ্টটা বাবা কখনও বুঝতে
চাইতেন না। খালা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাবাকে মানাতে চেষ্টা করতেন - "একটু বড়
হোক, তারপর নিজেই যাবে।"
বাবা যাবার সময় শাসিয়ে যেতেন - "তুমি আমার মেয়ে। আমার সঙ্গে যেতেই
হবে। ঠিক আছে এখন রেখে গেলাম। আমি আবার আসব।" এই "আসব" শব্দটা কী ভয়ঙ্কর হয়ে গুরগুর শব্দে বাজত মনের ভেতর।
আবার একটু বড় হতেই বুঝতে পারলেন যে পরিবারে তিনি বেড়ে উঠছেন সেখানে তার কোন
শিকড় নেই। তাই খালা-খালুর একমাত্র সন্তানের মত পরম আদরে বেড়ে উঠেও নিজেকে
বৃন্তচ্যুত মনে হত। তখন বাবার ওপর খুব রাগ হত।
কিন্তু বাবা ততদিনে রাগ-অভিমানের অনেক উর্ধ্বে। আঠারো বছর না পেরোতেই
সত্যিকারের এতিম অনাথ হয়ে যাওয়া। তবু সইত। কিন্তু যাদের আঁকড়ে বড় হলেন ক্যান্সারে
ভুগে অল্পদিনে তারাও চলে গেলেন। ভিড়ের মধ্যেই সুলেখা হারিয়ে গেলেন ফেলে আসা দিনে।
খালুবাবার
কাফনে জড়ানো শরীরটা বিশাল উঠানের মাঝখানে। আত্মীয়-স্বজন গিজগিজ করছে বাড়ি। হঠাৎ
কানে এল বাবার ভাইয়ের ছেলে আলমের কন্ঠ মসজিদের মাইক থেকে - "প্রিয় গ্রামবাসী।
আস্সালামু আলাইকুম। আমার চাচা আমানত আলী চৌধুরি গতকাল ইন্তেকাল করেছেন।
ইন্নালিল্লাহি--। আপনারা জানেন তাঁর কোন ওয়ারিশ বা আওলাদ ছিল না। আমরাই তাঁর
ওয়ারিশ। তাই জীবিত অবস্থায় তাঁর সকল ভুলত্রুটির জন্য আমরা আপনাদের কাছে মাফ চাইছি।
যদি কেউ পাওনাদার থাকেন তাহলে আমাদের.....।"
ভিড়ের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠল-
"এটা কী কইল আলম? মেয়েটা মাত্র বাপ হারাইল, এখন এ কথা কেন?"
আর সুলেখা? তার মনে হচ্ছিল তার বুকের ভেতরটা এ ফোঁড় ও ফোঁড় হয়ে গেল। ভিতরটা
উথলে উঠল বুকভাঙা কান্নায় - "আমি তবে কে গো? কে আমি?"
সম্পত্তি এমনই একবস্তু মুহূর্তে আপনাকেও পর করে দেয়। সেই যে আশৈশব বেড়ে ওঠা
গৃহপরিবেশ সেই পরিচিত গ্রাম মানুষজন ছেড়ে এসেছিলেন আর কোনদিন সেখানে যাননি। অথচ
এখনও এত বছর পরও পেছনে তাকালেই দেখতে পান সেই গ্রাম ঘর আর মায়া-মমতায় অবিচ্ছেদ্য
সম্পর্কে জড়ানো মানুষগুলো।
ঘোষণা
হচ্ছে আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন স্টেশনে আসবে। নিজেকে নিজেই বললেন,
"সুলেখা ওঠো। গাড়ি আসছে। ঢাকা যেতে হবে। সেখানে তোমার রাতুল শিমুল অপেক্ষা
করছে। এবার তোর মরা গাঙে......।"
নিজেকে চাঙা করার জন্য এভাবেই মনে মনে
গুনগুন করে ওঠেন। এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস।
ট্রেন ছাড়তে ঠিকঠাক হয়ে বসেন। স্টেশন থেকে কেনা পত্রিকা আর ম্যাগাজিনগুলো
ভাঁজ করে ব্যাগে রাখেন। আজ পড়তে ইচ্ছে করছে না। প্রতিবার এমন ভ্রমণে একটা গল্পের বই কিংবা উপন্যাস পড়া হয়ে যায়। আর পেপার
ম্যাগাজিনতো থাকেই। ব্যস্ত জীবনে এই ভ্রমণটুকু একটা বড় বিনোদন। কিন্তু এবার যেন
সবকিছু ছাপিয়ে শুধু আনন্দ খেলা করছে মনে।
অপরিচিত বাবার বাড়িতে কোনদিন যাওয়া হয়ে ওঠেনি। যেখানে বড় হয়েছেন সেই সুবর্ণগ্রামের সাথে
চিরবিচ্ছেদ ঘটে গেছে। হাসানদের গ্রামে বাড়ি ছিল। কিন্তু তারা কখনও যেত না। তাই
শ্বশুরবাড়ির ভিটেখানাও তেমন করে চিনতে পারেননি।
সারাজীবন ভাড়াবাড়িতে কাটিয়ে নিজেকে উন্মুল মনে হত। আজ মেয়ে উদ্যোগ নিয়েছে
মায়ের জন্য ভাইয়ের জন্য একটা ঠিকানা গড়ার। প্রস্তাবটা দিয়েছিল এভাবে -
"আম্মা, টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন দেখেছেন?"
"কোন্টা
রে?"
"ঐ
যে বিখ্যাত গায়িকা রাশনা হক করে।"
"দেখেছি
তো। জান্নাতুল ফেরদৌস হাউজিং। ইদানীং প্রায়ই দেখাচ্ছে। বেশ সুন্দর জায়গাটা।"
"হ্যাঁ,
ঠিক ধরেছেন। আচ্ছা আম্মা ওখানে যদি আমরা একটা প্লট নিই কেমন হয়?"
মেয়ের
কথা শুনে হেসে উঠেছিলেন - "এত টাকা কোথায় পাবি? আমার তো প্রভিডেন্ট ফান্ড
ছাড়া তেমন কিছু নেই।"
"তাতে
কী? এসবতো কিস্তিতে নেয়া যায়। আমি কিছু দেব, আপনি কিছু দেবেন। আর শিমুল চাকরিতে
ঢুকেছে, পারলে সেও কিছু দেবে।"
"ওর
তো নতুন চাকরি। পারবে কি?"
"পারবে
পারবে। ইচ্ছে করলেই পারা যায়। জীবনের শুরু থেকে না করলে কীভাবে হবে? এরপর
বিয়ে-শাদি হলে খরচ বাড়বে। তখন তো আরো পারবে না। আর আমি তো আছি।"
মেয়ের 'আমি তো আছি' কথাটা সুলেখাকে একটা শক্ত জমির ওপর দাঁড় করিয়ে দেয় যেন।
বলেন "তাহলে দ্যাখ।"
স্টেশনে ট্রেনটা থামতেই শিমুল আর রাশেদকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসতে দেখলেন।
খুশিতে মনটা আবারো দাপাদাপি শুরু করল। হঠাৎ মনে হল এত যে সুখ - সইবে কি?
ধুর্ এত আনন্দের মুহূর্তে মন কেন কু গাইতে বসল। তাড়াতাড়ি ভাবনা থেকে
নিজেকে সরিয়ে আনেন।
মেয়ে
দরজা খুলেই দাঁড়িয়ে ছিল। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই দু'হাতে জড়িয়ে ধরল। এর চেয়ে সুখ আর কী!
'সুলেখা তুমি ভাগ্যবতী' মনে মনে বললেন নিজেকে।
রাতুল মায়ের বুকের ওম নিতে নিতেই রাশেদকে জানাল -"মোহিতভাই এসে বসে
আছে।"
"মোহিতভাই
কে?"
"জান্নাতুল
ফেরদৌসের কো-অর্ডিনেটর।"
ঘরে ঢুকতেই সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে সালাম দিল মোহিত।
"ভাল আছেন খালাম্মা?"
"জী
ভাল।"
"অনেক
কষ্ট হয়েছে না? ঢাকা-চট্টগ্রাম মাশাহ্ আল্লাহ যে লম্বা জার্নি!"
"হ্যাঁ
তা তো একটু......."
হাতমুখ
ধুয়ে আসতেই মেয়ে ডাকল চা খেতে।
বসার ঘরে মোহিত সহ সবার জন্যে চায়ের আয়োজন। মোহিতের হাতে একতাড়া কাগজ। চা
খেতে খেতেই রাশেদ বলল -"প্লটগুলো নাকি হুড়হুড় করে নিয়ে নিচ্ছে লোকে। আমাদের
অফিসেও বেশ কয়েকজন নিয়েছে। মোহিতভাই আমাকে বলল তাড়াতাড়ি খালাম্মাকে নিয়ে
আসেন-"
"হ্যাঁ
তাইতো। আমি খালাম্মার জন্য একটা কর্নার প্লট রেখেছি খুব সুন্দর লোকেশানে। এই যে
দেখেন।"
স্ক্রল করা কাগজটা দ্রুত সেন্টার টেবিলে মেলে ধরল মোহিত। এত দ্রুত এবং
নিপুণভাবে কাজটা করল যে তার দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন সুলেখা।
ভাল করে তাকিয়ে দেখলেন মোহিতের দিকে। বয়স বত্রিশ-চৌত্রিশ হবে। সুদর্শন বলতে
যা বোঝায় ছেলেটা তাই। তবে মুখে দাড়ি। সেগুলো কিছুটা বিশৃঙ্খল এবং পরস্পর
বিচ্ছিন্নভাবে বেড়েছে যা সৌন্দর্যের কিছুটা হানি করেছে। আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করলেন।
ছেলেটা কথায় কথায় সোবহান আল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, মাশাহ আল্লাহ বলছে। ছেলেটার বয়স,
পোশাক-আশাক কথাবার্তার সঙ্গে এ দুটো ব্যাপার কিছুটা বিসদৃশ ঠেকে।
কাগজের
ওপর ঝুঁকে পড়ে শিমুল আর রাশেদ খুব মনযোগ দিয়ে প্লটটা বোঝার চেষ্টা করছে। মোহিত বার
বার বলছে "পাঁচ কাঠার মাশাহ্আল্লাহ একটা ভাল প্লট ছিল খালাম্মা। ওটা নিলে
ভাল হত।"
"কিন্তু
অত টাকা কোথায়?" যেন নিজেকে শুনিয়ে প্রশ্ন করলেন সুলেখা।
"নাউজুবিল্লাহ।
মন খারাপ করবেন না খালাম্মা। আল্লাহ্পাক যা দিয়েছেন তা নিয়ে শোকর করতে হয়। আপনার
জন্য সাড়ে তিন কাঠার এই কর্নার প্লটটা খুউব সুন্দর" বলতে বলতে প্ল্যানটার ওপর
আঙুল দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করে।
সুলেখাও ব্যাগ থেকে চশমা জোড়া বের করে পরতে পরতে কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়েন।
প্ল্যানটা দেখতে দেখতেই বলেন "আমাকে একবার জায়গাটা দেখাতে নিয়ে যাবে?"
"জী খালাম্মা, কেন নয়? ইনশাল্লাহ আমি আগামী পরশুই আপনাকে নিয়ে যাব।
কোন চিন্তা করবেন না।"
সুলেখা
আশ্বস্ত হন। মুগ্ধ হন মোহিতের করিৎকর্মা আচরণে। যাক্ কথাবার্তাগুলো খুব ভাল
লাগছে।
মোহিতের
কথামত পরদিন রাশেদকে নিয়ে তাদের অফিসে যান সুলেখা। কিছু কাগজপত্র সই করতে হবে।
ধানমন্ডির সুপরিসর সড়কের পাশে বিরাট সুউচ্চভবন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। ভবনের
গায়ে উৎকীর্ণ অনুবাদসহ পবিত্র কোরানের বিভিন্ন আয়াত। অন্তরে এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করেন। যাক এরা
অন্তত ঠকাবে না। কালকে মোহিতকেও দেখেছেন প্রত্যেকটা কাজের শুরুতে আল্লাহর নাম নেয়।
চুক্তিপত্র
সই হবার পর রাশেদ আর মোহিতসহ আবাসন প্রকল্পের দিকে রওনা দেয় তারা। সারা পথ সুলেখার মনে অতীত স্মৃতির
ওঠাপড়া। মামার বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে। মামাতো ভাইবোনেরা হাসানের সঙ্গে দুষ্টুমি করছে।
সুলেখা কাঁদছেন - খালাম্মা আর খালুবাবাকে মনে পড়ছে। হাসানদের বাড়ি - হাসানের
বন্ধুরা বউ দেখতে এসে ঠাট্টা করছে। সুলেখা ঘোমটার আড়ালে হাসি চাপতে গিয়ে কেঁপে
কেঁপে উঠছেন। রাতুল এল। ফুটফুটে ছোট্ট রাতুল। জীবনের পরম পাওয়া। এতদিনের রিক্ত
জীবনে যেন পূর্ণতার জোয়ার। বাবার কথা মনে পড়ছে। বুঝতে পারছেন তাকে নিয়ে বাবার
পাগলামী। সন্তানের জন্য মনটা এমন করে বলেই বাবা বলতেন 'আমি আবার আসব'।
আহারে! তখন কেন বুঝতে পারেনি!
আরেকদিন - বসার বারান্দায় ওটা কে শুয়ে আছে? মুখটা ঢাকা কেন? সুলেখা দেখতে
চান। সবাই তাকে ধরে রেখেছে। একদিকে সুলেখা অন্যদিকে সবাই। কিছুতেই ওদের ছাড়াতে পারছেন না। কিন্তু নিঃসাড় মানুষটার
কাছে তার যে অনেক জিজ্ঞাসা।
মানুষটা অফিসে গেল আর ফিরে এল এভাবে। কেন সে অসাবধানে রাস্তা পার হতে গেল?
কেন ভাবল না ছোট্ট রাতুল আর শিমুলের কথা। সুলেখার কি এই পৃথিবীতে আর কেউ আপন আছে?
জীবনের সমস্ত না পাওয়া নিয়ে এই মানুষটার কাছেই তো হাত পেতেছিলেন। মানুষটাকে ঘিরে
তার সুখ আর স্বপ্নগুলো এত তাড়াতাড়ি শেষ হতে পারে না। না কেউ দেখতে দেয়নি। সবার এক
কথা - 'তুমি সইতে পারবে না'।
অ্যাকসিডেন্টে ওর মাথার খুলিটা উড়ে গেছে। কেন, কেন এমন হবে? জীবন এত কঠিন
কেন?
তারপর একটানা সংগ্রাম। যৌথ পরিবারে থেকে পড়াশোনা করা। কী কঠিন পরিশ্রমে
বিএ-এমএ পাশ করা। তারপর এই কলেজের চাকরিটা। বাইশ বছর একটানা ঘানি টানা।
তবে সাফল্য পুরষ্কার একেবারে আসেনি তা নয়। ছেলেমেয়ে দুটো মেধাবী ছিল। ওরা
গড়ে উঠেছে, চাকরি করছে। প্রতিষ্ঠার পথে এগুচ্ছে। এখন একটা ঠিকানা হলে আর কী! আর কী
চাইতে পারেন সুলেখা?
"না, আমার আর কিছু চাই না। একটা ঠিকানা হোক। আর আমার সন্তান থাক
দুধে-ভাতে। হে খোদা, তুমি শুধু এটুকু দিও।"
শহর থেকে বেশ অনেকটা দূরে এসে থামল গাড়ি। এতক্ষণ কথা বলছিল মোহিত আর রাশেদ।
সাভারের এই এলাকাটা এখনো বেশ জঙ্গুলে। গাড়ি থেকে নেমে চারদিক তাকালেন। কই কাগজে যেভাবে
দেখেছেন সেরকম কোথাও তো দেখতে পাচ্ছেন না। তাছাড়া ওদের অফিসের দেয়ালে একটা বিশাল
মাস্টারপ্ল্যান বাঁধাই করা ছিল। সেখানেও মোহিত তাকে প্লটটা দেখিয়েছিল। কই এখানে তো
তেমন দেখতে পাচ্ছেন না। এ তো এবড়ো থেবড়ো জঙ্গলে ভরা। এখানে প্লট কোথায়?
কৌতূহল চাপতে না পেরে মোহিতকে ডাকেন। জানতে চান - "রাশনা হকের বাড়িটা
কোন্ দিকে?"
"রাশনা হক কে?" কিছুটা অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে মোহিত।
"কেন তুমি জান না? তোমাদের আবাসনের বিজ্ঞাপনে দেশের বিখ্যাত গায়িকা
রাশনা হক আর তাঁর বাড়ি দেখায় যে।"
"ওহ্ হো। আচ্ছা আচ্ছা বুঝতে পারছি। নাউজুবিল্লাহ। আমি কী বেকুব।
কীভাবে ভুলে গেলাম, তওবা, তওবা।"
"না, না এত অপ্রস্তুত হওয়ার কী আছে? ভুল তো হতেই পারে।"
"তবুও এত বড় ভুল! আস্তাগফিরুল্লাহ। জী জী খালাম্মা আপনি ঠিকই বলেছেন।
রাশনা হকের প্লট। আসলে কী জানেন খালাম্মা রাশনা হকের বাড়িটা আমাদের অন্য
প্রকল্পে।"
"তাহলে এখানে দেখাল কেন? আমি তো সেটা দেখে আগ্রহী হলাম। আমার কলিগদের
মজা করে বলেছি আমি রাশনা হকের প্রতিবেশী হতে যাচ্ছি।"
সুলেখার কথা শুনে একসঙ্গে হেসে ওঠে রাশেদ আর মোহিত।
শেষ পর্যন্ত পাঁচ লাখ টাকা এককালীন আর মাসিক আঠার হাজার টাকা কিস্তির
চুক্তি সই করে ঠিকানার স্বপ্নে বিভোর সুলেখা হাসান ফিরে এলেন কর্মস্থল চট্টগ্রামে।
প্রায়
সাত মাস পর এক সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাযের পর এক কাপ চা নিয়ে বিছানায় বসে
টিভি অন করলেন সুলেখা।
সান্ধ্যকালীন এই চা আর খবর শোনা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। শিরোনামগুলো শুনতে
শুনতেই চমকে উঠলেন। কী বলছে এসব! জান্নাতুল ফেরদৌস আবাসন
প্রকল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে রাজউক। জনগণকে সতর্ক করা হচ্ছে যেন কোন রকম
জমি বা প্লট তাদের কাছ থেকে না কিনে। রাজউক কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে জানতে পেরেছে
সাভার মডেল টাউনে ভুয়া জমি দেখিয়ে তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে
নিয়েছে।
খাটটা কি দুলে উঠল? ভূমিকম্প হচ্ছে? সুলেখা এখন কী করবেন? হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। যন্ত্রচালিতের মত হাতে তুলে নিলেন মোবাইল। রিসিভ
করতেই ওপাশ থেকে মেয়ের কান্নাভেজা গলা শুনতে পেলেন - "আম্মা, আম্মা খবর
শুনেছেন টিভিতে -"
"হ্যাঁ শুনেছি। রাশেদ কি মোহিতের সাথে যোগাযোগ করেছে?"
"আম্মা, ফোন করতে করতে রাশেদের হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফোন
বন্ধ" - বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠল রাতুল।
সুলেখা কী সান্ত্বনা দেবেন? তার সারাজীবনের সঞ্চয় প্রভিডেন্ট ফান্ডের
টাকাটার এ কী অপচয়!
বিড়বিড় করে কোনমতে বললেন, "কারো কারো জীবনের ঠিকানা হয় না। স্বপ্নের
ঠিকানা স্বপ্নই থেকে যায়।"
No comments:
Post a Comment